নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৩৩

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৩৩
ঝিলিক মল্লিক

দীর্ঘ দু’টো দিন রিদির সাথে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারেনি আরবিন। এই দু’দিন ওর কাছে বর্তমানে দুই যুগের সমান। ক্যান্টনমেন্ট, ডিউটি কোনোকিছুতে মন বসাতে পারছে না। মেয়েটা চলে তো গেছেই, সাথে আরবিনের রাতের ঘুমও কেড়ে নিয়ে গেছে। সারারাত জেগে সিগারেটের পর সিগারেট উড়ানো ব্যতীত আর কোনো কাজ হচ্ছে না ওর দ্বারা। আরবিন নিজের বাড়িতেও ফোন করেনি হুটহাট। এমনকি শ্বশুরবাড়িতেও নয়। ভেবেছিল, তারা-ই হয়তো আগে ফোন করবে৷ কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি।

আজ রাতটা আরবিন আর পার করতে পারছে না কোনোভাবেই। সময় যেন কাটতেই চাইছে না। রীতিমতো বিরক্ত আরবিন৷ এবার সিগারেট ছাড়লো ও। অ্যাশ ট্রে-তে পিষে নিভিয়ে ফেললো। তারপর ফোনটা হাতে তুলে নিলো। ব্যালকনির দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে ও। জোরে শ্বাস টেনে নিজের মনের সব জড়তাকে একপাশে সরিয়ে দিলো। তারপর কল লিস্টে যেয়ে নিজের শাশুড়ির নাম্বারে কল দিলো৷ রিদির নাম্বারে কল দিয়ে লাভ নেই। ওকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিয়েছি রিদি। কনট্যাক্ট করার কোনো উপায়-ই রাখেনি। কল দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ফোন রিসিভ হলো। গলা ঝেড়ে কেশে আরবিন বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হ্যালো আম্মু। আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো আব্বা?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন আম্মু?”
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ।”
“আব্বু কেমন আছেন?”
“তোমার শ্বশুরের কথা আর কি বলবো! কিছুদিন হলো শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছে। জ্বর-ঠান্ডা লেগেই আছে৷ খুব অনিয়ম করে বুঝলে। আমার কথা আর শোনে কই?”
“ওহহো! এটা তো খুব খারাপ খবর। ডাক্তার দেখিয়েছেন?”
“হ্যাঁ। এইতো সেদিন ফার্মেসি থেকে একগাদা ঔষুধ দিলো।”
“এখন কী অবস্থা আব্বুর?”

“আলহামদুলিল্লাহ এখন মোটামুটি সুস্থ। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি, কিছুদিনেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।”
“আম্মু বলছিলাম, রিদি কোথায়?”
“ওর সাথে কথা হয়নি তোমার?”
“তেমন কথা বলার সুযোগ হইনি দু’দিন। আসলে কাজের প্রেশার তো খুব৷ ডিউটি টাইমের ঠিক নেই। কখনো চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বাইশ ঘন্টা-ই ডিউটিতে থাকতে হচ্ছে, কখনো আবার পুরো চব্বিশ ঘণ্টা-ই। একারণে..”
আরবিনের কথা কিঞ্চিৎ সত্য, আর কিঞ্চিৎ মিথ্যা মেশানো। তানিয়া বেগম এবার কৌতূহলী হয়ে বললেন,
“রিদিকে কল দিয়ে ওর খোঁজ-খবর নিতে পারো।”
“মানে? রিদি কোথায় আছে? বাসায় নেই?”

“না। ও তো ওর কাকাবাড়ি গেছে সেদিন এসেই। তোমার কাছে আমি এ ব্যাপারে শুনতে চেয়েছিলাম। ফোন করে যে জিজ্ঞাসা করবো, সেই খেয়াল ছিল না। হঠাৎ মেয়েটার কী হলো বলো তো? হুট করে একাই সিলেট থেকে চলে আসলো এখানে। আমি জিজ্ঞাসা করায় বললো, তুমি নাকি বাসে উঠিয়ে দিয়েছো; তারপর বাকিটা পথ একা এসেছে। কিন্তু কেন এই অসময়ে হঠাৎ আসলো, তা আর বলেনি৷ এখানে আসার পরেরদিনই বললো, ওর নাকি বাসায় থাকতে ভালো লাগছে না। ওর কাকাবাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসবে কিছুদিনের জন্য। একারণে তোমার শ্বশুর গিয়ে এগিয়ে দিয়ে আসলো সেখানে। ফিরবে হয়তো সপ্তাহখানেক পরে।”

আরবিন রীতিমতো হতবাক হলো। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলো৷ কি ভয়াবহ মিথ্যা! মেয়েটা একপ্রকার পালিয়ে গেছে ওর কাছ থেকে। একবার যদি আরবিন ঘুণাক্ষরেও টের পেতো যে, রিদি ওকে ছেড়ে এভাবে চলে যাবে; তাহলে ও তৎক্ষণাৎ যাওয়ার সব উপায় বন্ধ করার বন্দোবস্ত করতো। কিন্তু না! মেয়েটা বড্ড শেয়ানা আর বেয়াড়া। আর এখন গিয়ে উঠেছে নিজের কাকাইয়ের বাসায়। যা মোটেও পছন্দ হয়নি আরবিনের। যোগাযোগ করার সব পথ বন্ধ করে দিচ্ছে রিদি। অসহ্যকর ব্যাপার-স্যাপার। আরবিন খুবই ভদ্রোচিতভাবে শাশুড়ির প্রশ্নের জবাবে বললো,

“ওর কয়েকদিন ধরেই ঢাকায় যাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করছিল। এজন্য আমি আর বাঁধা দিইনি। কিছুদিন ঘোরাফেরা করুক সেখানে, তারপর নাহয় আমি অথোরিটিতে আবেদন করে একদিনের জন্য ছুটি নিয়ে ওকে নিতে আসবো আম্মু। আপনি যতো দ্রুত সম্ভব ওকে বাড়িতে ফেরানোর ব্যবস্থা করুন। এই সময়টা ওর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন চাচাবাড়িতে ঘুরেফিরে বেড়ালে পড়াশোনা উচ্ছন্নে যাবে।”
“আচ্ছা বাজান। আমি তোমার শ্বশুরের সাথে এ বিষয়ে আজ-ই কথা বলবো। তুমি দুশ্চিন্তা কোরো না।”
শাশুড়ির সাথে আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা চললো আরবিনের। তারপর যখন কথা শেষ হলো, তার কিছু সময় পরেই ফ্ল্যাটের কলিংবেল বেজে উঠতেই তড়িঘড়ি করে উঠে গেল আরবিন। এতো রাতে কে এসেছে, তাই দেখতে।

লেফটেন্যান্ট কায়েস। আরবিনের জুনিয়র এই ছেলেটা অত্যন্ত ভদ্রোচিত এবং মনের দিক থেকে ভীষণ ভালো। দু’দিন ধরে সে রীতিমতো আরবিনকে ধাতাচ্ছে। কারণ সে খেয়াল করেছে, ক্যান্টনমেন্টে সবসময় দক্ষতার সহিত কাজের জন্য প্রশংসা পাওয়া অফিসারদের মধ্যে অন্যতম একজন সিনিয়র অফিসার লেফটেন্যান্ট আরবিন স্যারের আজ দু’দিন যাবত কাজে তেমন মন নেই। এমনকি এ নিয়ে আবদুল মুহিত স্যারের সাথে মোটামুটি একটা আলাপও হয়ে গেছে কায়েসের। আজ কায়েস একপ্রকার মনের ওপর জোর দিয়েই পারমিশন নিয়ে আবাসিক কোয়ার্টারে এসেছে আরবিনের সাথে দেখা করতে। সোফার ওপর বসে ফোন চালাচ্ছে কায়েস। ওদিকে আরবিন গেছে রান্নাঘরে। কফি বানাতে।

কিছুক্ষণ পরে আরবিন ট্রে হাতে ফিরলো রান্নাঘর থেকে। দুই কাপ কফি আর কিছু স্ন্যাকস নিয়ে। কফির মগ হাতে তুলে তাতে চুমুক দিতে দিতে আশেপাশে তাকালো কায়েস। তারপর বললো,
“স্যার, তাহলে যা শুনেছিলাম; তা-ই কী ঠিক?”
“কী?”
“আপনার ওয়াইফ সত্যিই আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে।”
“পার্সোনাল লাইফ নিয়ে আলাপ করা পছন্দ করি না কায়েস, জানো তুমি।”
“জি স্যার। জানি তো। তবে কয়েকজনের কানাঘুঁষা শুনে কৌতূহল দমন করতে পারলাম না।”
“কৌতূহল দমন করতে শেখো, বেটার ফর ইওর মেন্টাল হেলথ।”
“স্যার, কৌতূহলী হওয়ার কারণ আছে। হতে পারে, আমি আপনাকে কোনো হেল্প করতে পারি।”
“কেমন?”

এবার একটু নড়েচড়ে বসলো আরবিন। কায়েস বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
“কমান্ডারের ওয়াইফও কিন্তু রাগ করে ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল। আবার ফিরেও এসেছে, সে খবর রেখেছেন?”
“কবে?”
“এইতো গত পরশু। এবার জিজ্ঞাসা করবেন না কীভাবে ফিরে আসলো?”
“কীভাবে?”
“সেদিন স্যারের সাথে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা হলো অনেকক্ষণ। তখন স্যার কথায় কথায় বলছিলেন, তার আর তার ওয়াইফের মধ্যে নাকি খুবই সিরিয়াস একটা ঝামেলা লেগেছিল। আগামী এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে তার ওয়াইফের ফিরে আসার কোনো সম্ভবনা ছিল না। তবে ম্যাজিকের মতো হঠাৎ বাচ্চাকাচ্চাসহ তার ওয়াইফ ফিরে আসলেন। কারণ, স্যার একটা চাল চেলেছিলেন।”

“কেমন চাল?”
আরবিন একনাগাড়ে কায়েসের কথা শুনছে। মনোযোগী শ্রোতার ন্যায়। মাঝেমধ্যে দু-একটা প্রশ্নও করছে। এখন কায়েসের কথাগুলো শুনতে বিরক্তও লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে, নিশ্চয়ই কাজের কাজ কিছু হবে এই কথাগুলো শুনলে। কায়েস এবার অতি উৎসুক হয়ে বললো,
“স্যার আপনি একটু বেহেড হয়ে যান।”
“মানে?”
“মানে, কোনো স্ত্রী-ই চায় না; তার স্বামী বেহেড হোক। দরকার পড়লে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করবেন ভাবীকে।”
“এতে কাজ হবে বলছো?”

“হবে না মানে? নির্ঘাত হবে৷ হতেই হবে!”
“বাট আই উইল নট উইলিংলি কন্ট্যাক্ট হার কায়েস।”
“স্যার, এতো ইগো ধরে রেখে কী হবে? যদি আপনার বউ-ই না থাকে! আপনার চোখের নিচে কালি পড়েছে। আপনার এমন দশা মানতে পারছি না। আপনি পরিপাটি মানুষ। হঠাৎ এমন এলোমেলো হয়ে গেলে চলবে বলেন? বরং সব ইগো সাইডে রেখে একটু সেক্রিফাইস করুন না।”
আরবিন চোখ বুঁজে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। শক্ত হাতে চুলগুলোকে পেছনে টেনে দিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বললো,
“ওকেহ। আমি ওর সাথে কনট্যাক্ট করবো।”

“স্যার সময় নষ্ট করবেন না। যত দ্রুত সম্ভব কনট্যাক্ট করে আমাকে রেজাল্ট জানাবেন। মেয়েমানুষের মেজাজের ঠিক নাই এমনিতেও। আমার গার্লফ্রেন্ড এইতো সেদিন ব্রেকআপ করলো; তেমন সময় দিতে পারি না বলে৷ একটু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতেই নিজে থেকেই আবার সব ঠিক করে নিলো।”
আরবিন আর কায়েসের মধ্যে আরো অনেকটা সময় ধরে আড্ডা চললো৷ আরো দুই মগ কফি বানিয়ে নিয়ে আসলো আরবিন। কায়েস মূলত আড্ডা দিতেই এসেছিল। সাহস করে কথাগুলো বলতে পেরেছে—এই ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। রাত অনেকটা হতেই ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গেল কায়েস।

কাকাবাড়িতে আসার পর থেকে রিদির রুটিন বদলেছে। প্রায়-ই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকা হচ্ছে। পড়াশোনার একটা নির্দিষ্ট সময় ওই রাত নয়টা পর্যন্ত-ই।
আজ রাতে জামিয়া আর তিতাসের সাথে বসে ফোনে লুডু অ্যাপ ডাউনলোড করে লুডু খেলছিল রিদি। সাথে ছিল চা আর বিস্কুট। সবার মনোযোগ খেলার দিকেই। চা যে ঠান্ডা হয়ে গেছে, সেদিকে নূন্যতম খেয়াল নেই। তিতাস খেলায় কারচুপি করছে। জামিয়ার দানও উল্টোপাল্টাভাবে চেলে দিচ্ছে সুযোগ পেলেই। এবার জামিয়া উঠে তিতাসের পিঠে একটা কিল বসালো জোরে। রিদি হাসতে হাসতে ওদের দু’টোকে ছাড়াতে লাগলো। হালিমা খাতুন এতোক্ষণ বিছানার ওপর একপাশে বসে ওদের কর্মকাণ্ড দেখছিলেন হাসিমুখে। হঠাৎ পাশের ঘর থেকে সেলফোনের রিংটোন জোরে আওয়াজ করার শব্দে উঠে গেলেন তিনি। রিদি, জামিয়া আর তিতাসের মনোযোগ তখনও খেলার দিকে।
হালিমা খাতুন কানে ফোন চেপে ধরে জামিয়ার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রিদিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“ও রিদি, তোর ফোনে কী হইছে রে মা?”
রিদি খেলার মধ্যে এমন কথা শুনে এবার মাথা তুলে তাকালো কাকিমণির দিকে৷ তারপর কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,
“কিছুই তো হয়নি কাকিমণি। ফোন চার্জে রয়েছে। কেন? কী হয়েছে?”
হালিমা খাতুন এবার এগিয়ে এসে বললেন,
“জামাই নাকি তোকে ফোনে পাচ্ছে না। কেন বল তো?”
রিদির হাতটা ফোন স্ক্রিনের ওপর ছিলো। কাকিমণির কথা শুনে তা ধীরেধীরে সরে গেল। রিদি স্তব্ধ, বোবা হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কাকিমণির প্রশ্নের জবাব দিলো না। হালিমা খাতুন কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন রিদির দিকে। তারপর ওর দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,

”নে, জামাইয়ের সাথে কথা বল।”
“আমি কারো সাথে কথা বলবো না কাকিমণি৷ অপরিচিত মানুষের সাথে তো মোটেও নয়।”
“মানে? কী বলছিস তুই? তোর মাথা ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ, আমার মাথা ঠিকই আছে। আমি বলেছি, আমি কারো সাথে কথা বলবো না।”
হালিমা খাতুন এবার বোধহয় বুঝলেন কিছু একটা। জামিয়া আর তিতাস উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়েছিল। হালিমা খাতুন গম্ভীর স্বরে ওদেরকে বললেন,
“এই তোরা একটু বাইরে যা তো।”

জামিয়া আর তিতাস মায়ের আদেশ অমান্য না করে সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাইরে চলে গেল৷ হালিমা খাতুন এবার ফোনের দিকে তাকালেন৷ আরবিন এখনও কলে রয়েছে৷ হালিমা খাতুন কানে ফোনটা চেপে ধরে বললেন,
“বাজান, তোমাকে আমি একটু পরে ফোন দিচ্ছি।”
কথাটা বলেই ফোন কাটলেন হালিমা খাতুন। তারপর রিদির সামনে বসে চেপে ধরলেন ওকে। বললেন,
“এই! তোদের মধ্যে কী হয়েছে? সত্যি করে বল তো!”
“কিছু হয়নি তো কাকিমণি।”

“না, না! কিছু একটা তো হয়েছে। আমাকে মিথ্যে বলিস না রিদি। কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি তোকে। হঠাৎ সিলেট থেকে ঢাকা চলে আসলি৷ তার পরেরদিনই আমাদের এখানে৷ তাতে কোনোরকম অসুবিধা নেই। তুই ধারে থাকলে আমার আরো ভালো লাগে। বাড়িটা সজীব হয়ে ওঠে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই দু’দিনে তোর মধ্যে বেশকিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি আমি। তোর আরবিনের সাথে কথা হয়নি মোটেও। আরবিনের সাথে ঝামেলা করেছিস? সিলেট থেকে হুট করে চলে আসার কারণও নিশ্চয়ই এটা? তোদের সমস্যাটা কী বল তো? শুরু থেকেই তোদের সম্পর্কটাকে পাকাপোক্ত মনে হয়নি আমার৷ ভেবেছিলাম, সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে।”
“কিচ্ছু ঠিক হয়নি কাকিমণি। কিচ্ছু না। এজন্য আমি ঠিক করেছি, উনাকে ডিভোর্স দেবো।”
“এসব কী ধরনের কথাবার্তা বলছিস রিদি? ভেবেচিন্তে বলছিস তো?”
“অনেক ভেবেছি কাকিমণি। আর ভাবার মতো কিছু নেই। আমি এখন একটু বাঁচতে চাই শান্তিতে।”
“তোর গায়ে হাত তোলে নাকি?”

হালিমা খাতুন বেশ সিরিয়াস হয়েছেন। গম্ভীরভাবে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে রিদির দিকে চেয়ে এবার প্রশ্নটা করলেন তিনি৷ রিদি এবার আফসোসের সুরে বললো,
“তাহলেও তো হতো। তবুও বুঝতাম, তার কাছে আমার নূন্যতম গুরুত্বটুকু অন্তত আছে। আমাকে একজন মানুষের পর্যায়ে ধরে, যেকারণে গায়ে হাত তোলে। কিন্তু সেসবও তো করেন না তিনি। তার কাছে আমার কোনোরকম গুরুত্ব-ই নেই।”
“তোদের মধ্যে কখনো কিছু হয়েছে?”
হালিমা খাতুন ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নটা করেন৷ রিদি আড়ষ্টতায় মাথা নামিয়ে ফেলে৷ হালিমা খাতুন এবার গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করেন,
“দ্যাখ রিদি, ডিভোর্স কোনো সাধারণ বিষয় নয়। কোনো ছেলেখেলাও নয়। জীবন বড্ড কঠিন। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছি। লজ্জা না পেয়ে ঠিকমতো জবাব দে।”
রিদি এবার নতমুখে ধীরেধীরে জবাব দিলো,

“হ্যাঁ হয়েছে। বেশ কয়েকবার।”
“তাহলে তুই ওকে ডিভোর্স দিবি কীভাবে?!”
হালিমা খাতুন আশ্চর্য হয়ে প্রশ্নটা করলেন। রিদি এবার হালিমা খাতুনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমি অতোকিছু জানি না কাকিমণি। শুধু জানি, ওই লোকের সাথে থাকলে আমি বাঁচতে পারবো না৷ অমন পাষাণ লোকের সাথে থাকা যায় না। ওই লোক অবহেলা করে করে আমাকে মে’রে ফেলবে৷ বেঁচে থেকেও ম’রে যাব আমি।”
“শান্ত হ মা। কাঁদিস না। আমি সমাধান খুঁজছি। তোর অভিভাবকরা এখনো বেঁচে আছে। তোকে কষ্ট পেতে দেবে না মোটেও।”
হালিমা খাতুন রিদির পিঠে-মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৩২

ব্র্যান্ডেড জিনিস। এটা লুকোচুরি করে অত্যন্ত গোপনীয়তা এবং সাবধানতার সাথে ভেতরে আনতে পেরেছে আরবিন। কলেজ জীবনে বন্ধুদের গিলতে দেখেছিল। এই প্রথম নিজে চুমুক দিচ্ছে এতে৷ ঢকঢক করে গিললো৷ এক চুমুকেই শেষ। ভরা বোতলটা শেষ করে আরবিন শ্বাস ছাড়লো জোরে জোরে। চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে ওর৷ কাঁচের বোতলটা ফ্লোরের ওপর আছড়ে ভেঙে ফেলে চোয়াল শক্ত করে ও দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“হাউ রিডিকিউলাস! ওই বেয়াদব মেয়েমানুষ আমাকে ইগনোর করছে! আমাকে! ভেবেছে ওর বিরহে আমি ম’রে যাব! মাথামোটা একটা। মাথার তাঁরতুর সব ছিঁড়ে গেছে। একবার সামনে পেলে মে’রে ফেলবো৷ নির্ঘাত মে’রে ফেলবো!”

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৩৪