নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি শেষ পর্ব
ঝিলিক মল্লিক
সময় কীভাবে দেখতে দেখতে চলে যায়, না? রিদির তো বিশ্বাসও হতে চায় না৷ দিনগুলো কীভাবে যে ব্যস্ততায় চলে গেল, তা ঠাহর করে উঠতে পারলো না। সংসার! সে-তো বোঝেনি রিদি৷ আরবিন কখনোই ওকে বুঝতে দেয়নি। অবশ্য রিদির ভালোর জন্যই। মাঝেমধ্যে ছেলেমানুষী করে ফেললেও এসব ব্যাপারগগুলো এখন বেশ ভালো বোঝে রিদি। কঠিন হতে শিখেছে ও। একা পথে চলতে শিখেছে। যদিও হাতটা বাড়িয়ে এক কদম এগিয়ে দিয়েছিল আরবিন। তারপর চলতি পথে ছেড়েছিল ইচ্ছাকৃত-ই। যেকারণে রিদির আজ এই একা পথ চলার প্রয়াস, আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সংগ্রাম। দিনে দিনে স্বয়ংসম্পূর্ণা হয়ে উঠছে ও।
বিবাহিত জীবনের আজ কয় মাস? হিসাব করতে বসে গেল রিদি। উমমম! নয় মাস হবে প্রায়। দিন তো দেখতে দেখতেই কেটে যায়। তাতে কী? সুখবিলাসের কী আর শেষ আছে? পড়াশোনার চাপ কমলো বলে। একটু হাঁপ ছেড়ে বসতে পারে এখন ও। আজ রিদির বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। মেডিকেলে চান্স হয়নি রিদির৷ মাত্র দুই মার্কের জন্য মিস হয়ে গেল। রিদি যে সেদিন কি ভয়াবহ কান্না করেছিল! মরাকান্না যাকে বলে। শেষের মাসটা ভয়ঙ্কর পরিশ্রম করেছিল ও। রীতিমতো নাওয়াখাওয়া আর ঘুম বাদ দিয়ে পড়ার টেবিলে পরে থাকতো মুখ গুঁজে। চুল উষ্কখুষ্ক হয়ে জট পাকিয়ে খোঁপা করে রাখতো এলোমেলোভাবে। আরবিন ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফিরে এসে টেবিলে রিদির চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়েই ওর চুল আঁচড়ে জট ছাড়িয়ে সুন্দর এবং পরিপাটিভাবে খোঁপা করে দিতো। তারপর গিয়ে দুই মগ কফি বানিয়ে নিয়ে আসতো। এক মগ রিদিকে দিয়ে আরেক মগ নিজে নিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসতো। কাজের মধ্যে মাঝেমধ্যে আড়চোখে রিদির পড়াশোনা খেয়াল করতো। পড়ার দিকে মনোযোগ থাকলেও আরবিনের ওই সতর্ক দৃষ্টি অনুভব করতে রিদির নূন্যতমও অসুবিধা হতো না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রান্নাবান্নার দিকটা বরাবরের মতোই আরবিন-ই দেখে। রিদির অ্যাডমিশন এক্সামের আগের দিনগুলোতে তো আরবিনের আরো বাজে দশা। দিন এবং সন্ধ্যার পুরোটা সময় ডিউটিতে থাকা, তারপর ফিরে রাতের রান্না করা, সারারাত জেগে রিদির জন্য শিট, নোট তৈরি করে দেওয়া, ওকে পড়ানো; তারপর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে ভোরে উঠে এক্সারসাইজের পর সকালের নাস্তা আর দুপুরের রান্না করে রেখে ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সারাদিনের ধকল— এই ক’দিনে আরবিন সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে গেছে। দুশ্চিন্তা করেছে খুব। ওর মুখের দিকে তাকালে সেই দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারতো রিদি। কোথাও গিয়ে বুকে ধাক্কা লাগতো। প্রবলভাবে গেঁথে দেওয়া ছুরিকাঘাতের মতো। ইশশ! মানুষটা ওর সাফল্যের জন্য এতোটা পরিশ্রম করেছে, সেই সাফল্য যদি হাতে এসে ধরা না দেয়, তখন? তখন অনুশোচনায় কোথায় গিয়ে মুখ লুকাবে রিদি? আরবিনের বুকে? ওই বুকে তখন জায়গা হবে ওর? নিজের বিবেকে বাঁধবে না? এমনিতে এতগুলো দিনেও আরবিনের সাথে সঙ্গমটা হয়ে ওঠেনি রিদির। অবশ্য সিদ্ধান্ত আরবিনের-ই। রিদির মনোযোগ সরে যাবে অ্যাডমিশনের দিক থেকে — এই চিন্তাভাবনা করেই মেয়েটাকে দূরে দূরে রেখেছিল আরবিন। কি দরকার! গুরুত্বপূর্ণ এই জীবনে কিছু অভিলাষ দীর্ঘ সময় অপূর্ণ থাকলে ক্ষতি কী? একটু বরং সবুর করা যাক। সবুরে মেওয়া ফলে!
রিদির মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার পর সেদিন-ই আরবিন ওকে ডেকে বলেছিল,
“তোমার মেডিকেল আর পাবলিকের রেজাল্ট দেওয়ার পরপরই তোমাকে একটা সুন্দর রাত উপহার দেবো৷ কাঙ্ক্ষিত সেই রাত। লাইক বেনসনকে প্রেগন্যান্ট বানানোর মতো। কি, দারুণ হবে না?”
রিদি সেদিন লজ্জায় কোনো কথা বলতে পারেনি। ভীষণ আড়ষ্ট হয়েছিল। অসহ্যকর অনুভূতির উদয় হয়েছিল। যেই অনুভূতির সাথে সহসা জানাশোনা হয়না রিদির৷ আর না হয় বোঝাপড়া। কিন্তু রিদির মন ভাঙতে সময় লাগলো না। সেদিন যখন মেডিকেল এক্সামের রেজাল্ট দিলো, তখন রেজাল্ট দেখে রিদির মানসিক স্থিতি আর ঠিক ছিল না। মাত্র দুইটা মার্কের জন্য স্বপ্ন ছুঁতে পারলো না ও! ছুঁই ছুঁই করেও হাতছাড়া হয়ে গেল! রিদি হাউমাউ করে কান্না করেছিল সেদিন। বাঁধ ভেঙে সে-কি কান্না।।আরবিন ওকে টেনে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল দীর্ঘ অনেকটা সময়। তারপর ওর মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিয়ে বলেছিল,
“জীবনের এই স্বপ্ন-ই শেষ স্বপ্ন নয়। হতেও তো পারে, এরচেয়েও সুন্দর কোনো ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। মেডিকেল কলেজে না হোক; আল্লাহ দিলে পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যেতে পারো। তোমার জন্য অলৌকিক কিছু ঘটাতেও পারেন সৃষ্টিকর্তা। এতোটা আশাহত হচ্ছো কেন? বোকারা নিরাশ হয়। বুদ্ধিমানেরা নয়। অপশন এখনো কতগুলো তোমার সামনে পড়ে আছে। সেগুলোর দিকে ফোকাস দাও।”
আরবিনের বুকে মাথা রেখে সেদিন সব কথা মনোযোগ সহকারে শুনেছিল রিদি। বেশ ভালো করে মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। নিজের মধ্যে একটা অদম্য জেদের উদয় হয়েছিল— যে-কোনোভাবেই হোক একটা না একটা পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেতেই হবে। ওদিকে আব্বা-আম্মা, শ্বশুর-শাশুড়ী সবাই কত আশা বুকে ধারণ করে রেখেছেন। এদিকে স্বামীর অমানবিক, নির্নিমেষ পরিশ্রম তার জন্য। সবকিছু বৃথা যেতে দেয় কী করে রিদি? মুখ উজ্জ্বল করার শেষ চেষ্টাটা নাহয় করেই দেখুক। খুব জোরালোভাবে!
হ্যাঁ রিদি করলোও তাই। আরো কঠিন হলো পড়াশোনার ক্ষেত্রে। আরো বেশি মনোযোগী। তারপর মাসখানেকের মধ্যে একে একে সবগুলো পাবলিক ভার্সিটির অ্যাডমিশন এক্সাম শুরু হলো। রিদি সবগুলো এক্সাম দিলোও ভালোমতো। আর আজ রেজাল্ট দেবে সেগুলোর মধ্যে কয়েকটার। রিদি তখন ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে বিমূর্তভাবে। আরবিন পাশে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর ট্রাউজার গায়ে জড়িয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে মুখ শক্ত করে চেয়ে আছে একদৃষ্টিতে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আজ ও ফ্রেশও হয়নি ঠিকমতো। নাস্তাও করেনি। ওর দক্ষ হাত দ্রুতবেগে চলছে কি-বোর্ডের ওপর। টাইপিং করে স্পেস বসিয়ে ইংরেজি অক্ষরে লিখছে ও। রিদির চোখও সেদিকেই। আবার ফোনের দিকেও মনোযোগ যাচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর।
যদি এরইমধ্যে মেসেজ চলে আসে। রিদি কাছ ঘেঁষে বসেই পেছন থেকে আরবিনের জিম করে লোহার মতো শক্তপোক্ত বানানো পেট নিটোলভাবে চেপে ধরে ওর পিঠে থুঁতনি রেখে বসে আছে। চোখে-মুখে ওর কি মারাত্মক দুশ্চিন্তা। কি জানি কি হয়! ভয়ে বুক কাঁপে। আরবিন ওকে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর-ই কয়েকবার আশ্বস্ত করেছে, অভয় দিয়েছে। তবু রিদির নার্ভাসনেস কমছে না। আরবিন ওদিকে কাজ চালানোর আগেই রিদি ফোনের মেসেজ অপশনের আনসিন রাখা মেসেজ সংখ্যাকে বারো থেকে তেরো তারপর চৌদ্দ এর কোঠায় যেতে দেখে মেসেজ অপশনে প্রবেশ করা মাত্র-ই প্রবল উত্তেজিত হয়ে পরলো। আরবিনকে ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে। আরবিন বুঝলো ব্যাপারটা। রিদি রীতিমতো কাঁপছে। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে আছে ফোন স্ক্রিনের দিকে। চোখ জ্বলজ্বল করছে ওর।
ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। আরবিন উঠে ঘুরে দাঁড়াতেই রিদি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। হামলে পরলো আরবিনের বুকে। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। না, এ দুঃখের অশ্রু নয়। অশ্রুনিপাত তো সুখেও হয়। দুঃখেরা তবে কেন অশ্রুজলকে একান্তই তাদের নিজের করতে চায়? কেন তাদের জন্য স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে চায়? অশ্রুজলের ওপর তো অন্যান্য অনুভূতির পঙক্তিমালারও হক বর্তায়।
হ্যাঁ, অশ্রু বিসর্জন শুধুমাত্র দুঃখে করতে হয় না। মাঝেমধ্যে সুখের অশ্রুও দারুণ পরিবেশের সৃষ্টি করে। যন্ত্রণা দেয় না। বরং সুখ সুখ অনুভব করায়। রিদি পেরেছে।
নিজেকে এতোদিনে গড়ে তুলতে পেরেছে বলে ওর মনে হলো৷ আজ ওর নিজেকে সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণা মনে হচ্ছে। যে পুরোপুরি আত্মনির্ভরশীল, আত্মবাদী, আত্মপ্রয়াসী। যদিও এই রিদিকে গড়ে তোলার পেছনে আরবিনের বিরাট একটা কৃতিত্ব রয়েছে। তবে এই রিদি যদি নিজেকে নিজে না বুঝতো, উপলব্ধি করতে না পারতো; তাহলে আজ প্রাপ্ত তার এই সাফল্যের দ্বার কখনোই খুলতো না। ব্ল্যাকহোলের গহ্বরে তলিয়ে যেতো বরং। বলা হয়ে থাকে, একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে শুধুমাত্র পথের দিশা দিতে পারেন। তবে পথ পার করে দিতে নয়। শিক্ষক পথ চেনালেও শিক্ষার্থীর নিজের পায়ের জোরেই সেই পথে এগিয়ে যেতে হয়। পরবর্তী গন্তব্য খুঁজে নিতে হয়৷ আরবিনও রিদির সাথে তেমনটাই করেছে। মানে হোক, ভালো-মন্দে হোক; রিদিকে পথ চিনিয়েছে। আর গন্তব্য রিদি নিজেই খুঁজে নিয়েছে। একাই নিজের পথে এগিয়েছে। আরবিন শুধুমাত্র একটি জ্বলন্ত মশালের ন্যায় রিদির অন্ধকার পথের আলোকশিখা হয়ে গন্তব্য বুঝিয়ে দিয়েছে।
যত যা কিছু-ই হয়ে যাক, আজও আরবিন ওর শিক্ষক-ই রয়ে গেছে। যে সবকিছুর মধ্যেও শিক্ষা দিতে সদাসর্বদা প্রস্তুত। রিদির এবার কান্নার মাঝেই হাসি পেল। তৃপ্তির হাসি৷ আজ নিজেকে আটকানোর দিন নয় বুঝি! রিদি মুচকি হাসলো। হালকা ঝংকারও উঠলো সেই হাসির শব্দে। আরবিন আলতো স্বরে জিজ্ঞাসা করে,
“হাসছো যে?”
“হাসতে পারি না?”
“কাঁদছিলে তো মাত্র।”
“আমার মতিগতির ঠিক আছে?”
“হাসির কারণ?”
“আপনি আজ-ও সেই কাটখোট্টা শিক্ষক-ই রয়ে গেলেন আমার।”
রিদির কথা শুনে আরবিন হঠাৎ মুখ উঁচু করে হোহো করে হাসতে থাকে। রিদি সেই হাস্যরত উচ্ছৃঙ্খল মুখখানার দিকে চরম মুগ্ধতা আর লোভ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। ইশশ! লোকটা দীর্ঘ ক্লান্তি শেষে কতদিন পর হাসলো। এই হাসি, আব্বা-আম্মা, শ্বশুর-শাশুড়ী— সবার জন্যই তো এতকিছু। এসব যে রিদির একচ্ছত্র পৃথিবীর মহামূল্যবান সম্পদ। রিদি আবার আরবিনের বুকে মুখ গুঁজে হালকা রসিকতার সুরে বলে,
“এমন শিক্ষক সবার ঘরে ঘরে আসুক।”
আরবিনও মুচকি হেসে বলে,
“আসুক!”
রিদি আবার মুখ তুলে তাকায়।
রিদির আরবিনের বুকে আচনক ঝাঁপিয়ে পরার মুহূর্তে বেসামাল হয়ে পরেছিল আরবিন। রিদিকে একহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখে আরেক হাত বিছানার পাশের কেবিনেটের কোনায় শক্তভাবে চেপে ধরে এখনো দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে আছে রিদিকে নিয়ে। রিদি তা খেয়াল করে আরবিনের পেট দুইহাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
“এভাবেই সারাজীবন আগলে রাখতে পারবেন আমাকে? একহাতে কর্মক্ষেত্র, অন্যহাতে আমি?”
“জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত জ্বলন্ত একখানা বেনসন এক হাতে নিয়েও অন্য হাতে তোমাকে সামলাবো দেখো। কিংবা ঠোঁটে একবার বেনসন, আরেকবার তোমার..”
রিদি লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখে আরবিনের বুকে৷ লোকটা মন্দ রসিকতা করছে। না, না! ইহাকে বলে, চরিত্রহীন রসিকতা। পরমুহূর্তেই আবার মনে প্রশ্ন জাগে— বউয়ের সাথে এহেন রসিকতাকে কী চরিত্রহীন রসিকতা বলা যায়? নাকি জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ রসিকতা?
রিদি উত্তর খুঁজে পায় না। না তো কোনো অনুসন্ধান। তবু ভাবে। ভাবতে ওর বেশ ভালোই লাগে। বিশেষত আরবিনের প্রতিটা কথা, প্রতিটা কাজকর্মসহ সমস্ত কিছু! এই গোটা মানুষটাই তো ওর। রাগ-ক্ষোভ, অভিমান, খু’নোখুনি-মা’রামারি, হানাহানি — যা কিছু হোক; তবু তো ওর-ই। একথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল সমাবেশে লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়েও কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এমনকি গোপনেও নয়। আরবিন এবার কেবিনেট ছেড়ে রিদিকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
“সবাইকে কল দিয়ে খুশির সংবাদটা জানাও। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট আর শাবিপ্রবিতে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে চান্স হয়েছে। অন্যান্যগুলোর রেজাল্ট যদিও এখানো আসেনি। তবে তুমি শাবিপ্রবিতেই ভর্তি হবে। আমার কাছে থাকবে।”
শেষের কথাটুকুতে অধিকারবোধ খাটানোর প্রবল জোর পাওয়া গেল। রিদি তা বুঝতে পেরে সূক্ষ্ম হাসলো৷ আরবিন তখন আচনক রিদির কানের নরম লতিতে একটা গাঢ় চুমু বসিয়ে তারপর আলতো করে একটা কামড় দিয়ে রাশভারী গলায় প্রশ্ন করলো,
“আজ সংসারটা বরং তুমি গুছিয়ে নিও জান। কিছুদিনের জন্য তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম এই সংসারের চাবি। তারপর নাহয় আবার আমি ফিরিয়ে নেবো। দু’জনে ভাগাভাগি করে নেবো সবটা৷ আজ দুপুরে আমি বাইরে থেকে লাঞ্চ করবো। তুমি বরং রাতের রান্নাটা করে রেখো। যা খুশি, এনিথিং। টেস্ট খারাপ হলেও তোমার ঠোঁটের দিকে চেয়ে চুপচাপ গিলে হজম করে নেবো। কিছু বলবো না, ধমকও খাবে না; প্রমিস।”
আরবিন থামলো। জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস টেনে তারপর অযথা-ই যেন বাতাসের কানেও না যায়, এমন সুরে বললো,
“আজকের রাতটা আমাকে দেবে সোনা? ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফিরবো রাত করে সম্ভবত। আজ তুমি যেভাবে খুশি সাজবে। আমি আসবো। অপেক্ষা কোরো, কেমন?”
আরবিন আর দাঁড়ালো না সেখানে। গামছা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। গোসলটা সেরে রেডি হয়ে ক্যান্টনমেন্টে যাবে। এদিকে রিদি ওড়না শক্ত করে চেপে ধরে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তাজা অনুভূতি নিয়ে। এই ব্যাটা এমন কথা-ও বলতে পারে? চরম আশ্চর্য!
আজকের দিনটা সুন্দর। রিদির জন্য হয়তো খুব বেশিই সুন্দর। আজ রিদি নিজের মনের মতো করে সেজেছে। আরবিন ওকে সাজতে বলেছে। পরনে শিফনের কালো শাড়ি, কনুইয়ের ওপর অবধি হাতা তোলা একটা সোনালি ব্লাউজ। তাতে আবার পিঠ বেশ খোলামেলা। ফিতা বাঁধা। ইচ্ছাকৃতভাবেই এমন একটা ব্লাউজ বানিয়ে রেখেছিল রিদি। আজ তা কাজে লাগাতে পেরে বেশ আনন্দ হচ্ছে ওর৷ মনটা অনেক বেশি ফুরফুরে। রাত দশটার কাছাকাছি সময়। কিছুক্ষণ আগেই আব্বা-আম্মা, শ্বশুর-শাশুড়ীর সাথে কয়েক দফায় কথাবার্তা হয়েছে ওর। রিদির আব্বা-আম্মা যে কি মারাত্মক খুশি হয়েছেন রিদির রেজাল্টের কথায়! সকালেই সবাইকে দিয়েছিল সংবাদটা। এখন আবার ঘটা করে দেওয়া হলো। কাকিমণির সাথেও কথা বলে নিয়েছে। জামিয়া এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়েছে এ অত্যন্ত খুশির খবর। রিদিও তার কাকিমণিকে রেজাল্টের কথা জানাতেই তিনিও সে কি ভীষণ খুশি! চোখ ছলছল করে উঠেছিল তার। এখন রিদির আম্মাও কথা বলার সময় বারবার কেঁদে ফেলছেন খুশিতে। বাপেরবাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির মানুষদের সাথে কথা বলে ঠিক করে রাখলো, বিয়ের পর তার আর আরবিনের জীবনের আসন্ন প্রথম ইদটা তারা একসাথে ঢাকাতেই পালন করবে সবার সাথে। রিদি কতশত পরিকল্পনা করলো তার আম্মা আর শাশুড়ীর সাথে আলাপ করে।
কথাবার্তা শেষ করে এখন রিদি উঠে দাঁড়িয়েছে। ঘরময় পায়চারি করছে। আরবিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে চলেছে ও। লোকটা কখন যে ফিরবে! ডিউটি টাইমের তো আবার ঠিক নেই। রিদির পায়চারির মাঝেই কলিংবেল বাজলো। আজ আরবিন চাবি নিয়ে যায়নি। রিদি শাড়ি সামলে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সদর দরজা খুলে দিলো৷ আরবিন ফোন বের করছিল পকেট থেকে। তখনই সামনের খোলা দরজার দিকে চোখ পরতেই কিঞ্চিৎ চমকে উঠলো ও। ঢোক গিলে নিলো। কন্ঠনালীর শিরায় টান লাগলো বারকয়েক। রিদি সরে দাঁড়াতেই আরবিন ভেতরে আসলে। আরবিনের চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করলো রিদি। এতো সুন্দর করে শাড়ি পরেছে, সাজগোজ করেছে, তবু কোনো প্রশংসা করলো না! কথাটা ভেবে রিদি প্রথমে একটু গাল ফোলালো। তারপর আবার ভাবলো, সবার থেকে সবকিছু আশা করা যায় না। আর এই লোক তো এমনই! আরবিন সোজা শোবার ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে ততক্ষণে। রিদি ওর পেছনে ছুটলো। আরবিন ফ্রেশ হলো শুধু। তা-ও দুই মিনিটের মধ্যে। রিদি ব্যাপারটা খেয়াল করে দেখে জিজ্ঞাসা করলো,
“ড্রেস চেঞ্জ করবেন না?”
আরবিন তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে জবাব দিলো,
“নাহ।”
“ডাইনিং-এ আসুন। খাবার বেড়ে দিচ্ছি। খেয়ে নেবেন।”
রিদি শাড়ির আঁচল চেপে ধরে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তৎক্ষণাৎ পেছন থেকে হাতে টান পরলো। রিদি ঘুরে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরবিনের দিকে। আরবিনের দৃষ্টি তখন উদভ্রান্ত। গভীর চাহনিতে রিদিকে দেখছে। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মনে মনেই সামান্য হাসলো রিদি। ওর হাতের বাহু ধরে টেনে নিজের কাছে এগিয়ে নিলো আরবিন। শক্ত হাতে রিদির কোমড় জড়িয়ে ধরে এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো রিদির দিকে। রিদি আরবিনের গলা জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করে,
“খাবেন নাহ?”
“নাহ।”
জবাবটা দিয়েই রিদিকে পাঁজকোলে তুলে বিছানার ওপর বালিশের সাথে হেলান দিইয়ে বসিয়ে দিলো। রিদি উঠে বসার আগেই আরবিন হাঁটু গেড়ে রিদির পায়ের কাছে ফ্লোরের ওপর বসলো। ইউনিফর্মের প্যান্টের পকেট হাতড়ে একটা লাল রঙের ছোট্ট গোলাপের নকশা করা জুয়েলারি বক্স বের করলো। বক্সটা খুলতেই একজোড়া চকচকে নূপুর বের হলো। হ্যাঁ রূপোর নূপুর। রিদি খেয়াল করে দেখলো সেটা। কি-যে ভয়াবহ রকমের সুন্দর দেখতে! আরবিন ওর মসৃণ পায়ে নূপুর-জোড়া পরিয়ে দিতে লাগলো। রিদি সব কর্মকাণ্ড সম্মোহিতের ন্যায় দেখতে থাকে। নূপুর পরিয়ে দিতে দিতে আরবিন বলে,
“খেয়াল করেছিলাম। একজোড়া রূপোর নূপুর নেই তোমার পায়ে৷ এটা দেখা মাত্রই নিয়ে নিয়েছি। তোমার পায়ে বেশ মানাবে বলে। আসলেই তাই।”
রিদির পায়ে নূপুর-জোড়া পরিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে আরবিন। তারপর-ই উঠে এসে বসে রিদির কাছ ঘেঁষে। রিদি একপাশে সরে বসে জায়গা করে দেয় আরবিনকে। আরবিন একটা বালিশ টেনে মাথার নিচে নিয়ে ইশারা করে বলে,
“কাছে আসো তো।”
রিদির তখন বুক ধুকপুক করছে। ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তবু এগোলো রিদি। আজ পেছানোর কোনো সুযোগ নেই, ইচ্ছাও নেই। রিদি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল আরবিনের কাছে। আরবিন ওর হাত ধরে টেনে নিজের বুকের ওপরে শুইয়ে দিলো। রিদি তখন বললো,
“তাই বলে ড্রেস চেঞ্জ করবেন না?”
আরবিন নিজের সামনের চুলগুলো টেনে পেছনের দিকে ঠেলে দিতে দিতে জবাব দেয়,
“করলাম না।”
রিদি মুচকি হেসে ওই বুকে আশ্রয় নেয়। তারপর বিরবির করে বলে,
“আমার একটা সুখের সংসার হোক!”
সঙ্গমের চরম মুহূর্তে রিদি হঠাৎ বলে উঠলো,
“আচ্ছা বলুন তো, আমাদের আন্ডাবাচ্চা হলে নাম কী রাখা যায়?”
আরবিন রিদির গলা থেকে মুখ তুলে পাল্টা প্রশ্ন করে,
“কী?”
রিদি এবার অতি উৎসাহী এবং উচ্ছ্বসিত হয়ে জবাব দেয়,
“ভাবছি, আমার নামের সাথে মিলিয়ে রাখবো৷ ছেলে হলে রুবাই ; আর মেয়ে হলে রেবা। যদি জমজ হয় তখনও আমার নামের অক্ষরের সাথেই মিলিয়ে রাখবো।”
আরবিন হঠাৎ ক্ষেপলো কী? বোধহয় কিঞ্চিৎ ক্ষিপ্ত হলো। ভ্রু কুঁচকে বিরক্তির সুরে বললো,
“তুমি তো খুব সেলফিশ। আল্লাহ দিলে বাবু হলে কী তোমার একার হবে নাকি? একটা আন্ডাবাচ্চা হলে তো আমাদের দু’জনের-ই হবে। কিন্তু নাম তুমি একা ডিসাইড করে রাখবে কেন? আমি রাখবো আমাদের সন্তানের নাম।”
“না আমি রাখবো৷ আমি ওর মা হবো। আমার কতৃর্ত্ব বেশি হওয়া উচিত। দশ মাস পেটে আগলে রাখবো আমি। আর ডাউনলোড হওয়ার পরে আপনার কথামতো ও চলবে নাকি?”
“হ্যাঁ চলবে। ওকে মানুষ বানাবো আমি। নাম হবে আমার পছন্দ অনুযায়ী।”
“হবে না।”
রিদি আচনক আরবিনের কলারে হাত রাখে। আরবিন বিক্ষিপ্ত, উত্তপ্ত চাহনিতে বুকের নিচে শুয়ে থাকা রিদির চোখে চোখ রাখে৷ রিদির সাহসে তাতে বিন্দুমাত্রও ভাটা পরলো না। চোখে-মুখে মোটেও ভয়ডর নেই। তা দেখে আরবিন আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয়। তারপর দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
“কলার থেকে হাত সরাও।”
“পারবো না।”
রিদির তেড়িবেড়ি জবাব। আরবিন আবারও একই টোনে বললো,
“সরাও বলছি।”
“পারলাম না।”
“কতবার বলেছি না তোমাকে? আর যা-ই করো, আমার ড্রেসের কলারে কখনো হাত রাখবে না। টোট্যালি টলারেট করতে পারি না। মাথা গরম হয়ে যায়। তবু বারবার একই দুঃসাহস দেখাও!”
“একশোবার দেখাবো। একশোবার কলারে হাত রাখবো। দরকার হয় আমাদের ছেলেমেয়ে হলে তাকেও ঠিক এভাবে কলার ধরা শেখাবো। বুঝেছেন?”
“ছেলেমেয়েকে বেয়াদবি শেখাবে নিজের মতো?”
“উহহ! বেয়াদবি কীসের? স্বামীর কলারে হাত রাখা যেমন স্ত্রীর জন্য পাপ নয়, তেমনি বাচ্চা বয়সে খেলার ছলে বাপের কলারে হাত রাখলে বেয়াদবি করা হয়ে যায় না। বুঝেছেন?”
“ নীতি-নৈতিকতার ভান্ডার খুলে নিয়ে বসেছো দেখছি!”
“বসেছি, তো?”
রিদি ঘাউড়ার মতো জবাব দেয়। আরবিনও পাল্টা ঘাউড়ামি করে মুখের ওপর বলে ওঠে,
“ নীতিবাগীশ!”
রিদি এবার ছ্যাঁত করে উঠে বহুক্ষণ যাবত নিজের গলার ভাঁজে শক্তভাবে বিচরণ করতে থাকা আরবিনের হাতটাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বলে,
“সরেন, দূর হন!”
“হুহ?”
“একদম আমাকে টাচ করার চেষ্টা করবেন নাহ।”
আরবিনের “হুহ” প্রশ্নের বিপরীতে তেতে উঠে জবাবটা দেয় রিদি। আরবিন এবার কলার থেকে টান মেরে রিদির হাতটা সরিয়ে দিয়ে শার্টের বোতাম টেনে খুলে শার্টটাকে ছুঁড়ে ফেলে বিছানার অপর পাশে। রিদিকে শক্ত করে চেপে ধরে নিজের সাথে। ওর বাহু আঁকড়ে ধরে। চোখে চোখ রাখে একবার। সঙ্গে সঙ্গেই সরিয়েও নেয় আবার। তারপর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রিদির ঠোঁটে আশ্লেষে গভীরভাবে চুমু খেতে থাকে। একসময় ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শ নরম করে ফিসফিসিয়ে বলে,
“করলাম না তোমাকে টাচ। তাতে বয়েই গেল!”
রিদি এবার আরবিনের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
“দেখবেন, আমাদের বাচ্চাটাও আপনার মতো ঘাড়ত্যাড়া হয়েছে।”
“আমার মতো না। আমি ঘাড়ত্যাড়া নই। যথেষ্ট ভালো আছি। বরং, তোমার মতো ঘাড়ত্যাড়া হবে দেখো।”
রাত গভীর হতে থাকে। দু’জনে তখন অনুভূতির অতল স্পর্শে, সঙ্গমের চূড়ান্ত অবগাহনে ডুবে যাচ্ছে প্রায়। তখনও তারা একে-অপরকে বলে চলেছে,
নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৩৮
“না, আপনার মতো ঘাড়ত্যাড়া হবে আমাদের বাচ্চা।”
“নাহ তোমার মতো ঘাড়ত্যাড়া হবে…”