নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৪

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৪
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

“আজকে আমরা একটা সম্পর্ক গড়ার আলোচনা করছি এর মাঝে কি এমন ইমার্জেন্সি কাজ পড়লো তোমার যে কিছুক্ষন পরই তোমাকে ফ্লাইট ধরে কানাডা ব্যাক করতে হবে?”(হালকা রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে)
আদিত কল্যাণীর কথায় মুখোভঙ্গি পাল্টালো। শুকনো ঢোক গিলে, আমতা আমতা করে বলে উঠলো,
“আপাতত.. আপাতত বুঝনোর পরিস্থিতি নেই মা। আর কিছুক্ষন পর আমার ফ্লাইট, বেরোতে হবে। কথা দিচ্ছি দ্রুতই ফিরে আসবো।”(ঢোক গিলে)

কল্যাণী আর কিছু বলতে নিবে এর মাঝেই ইলা মুখ কালো করে বলে উঠলো,,
“দ্রুত ফিরবেন কথা যখন দিয়েছেন, তাহলে যান। শাশুড়িমা, অনেক ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে ওনার। ফ্লাইটেরও দেরী হয়ে যাচ্ছে, উনি সামনে এগোক।”(মুখ কালো করে)
কল্যাণী নিশ্চুপ হয়ে ইলার মুখশ্রী পানে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটার ফর্সা মুখশ্রীতে আঁধারে ছেঁয়ে আছে। কণ্ঠে অভিমান স্পষ্ট ছিল। কল্যাণীর খারাপ লাগলো, মেয়েটা আজকে কত খুশি ছিল তা উনি ইলার মুখশ্রী দেখে বুঝেছিলেন। কিন্তু এখন হঠাৎ আদিতের কানাডা ফিরে যাওয়া, মেয়েটার খুশিই মাটি হয়ে গেলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কল্যাণী। ডাইনিং টেবিলে সবাই নিশ্চুপ। কৌশিক চৌধুরী মেয়ের মুখশ্রী পানে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটা ভেতরে ভেতরে বেশ কষ্ট পাচ্ছে, এতগুলো বছর মেয়েটা আদিতের জন্য অপেক্ষা করেছে। হাজার চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করার তবুও পারেনি। কৌশিক চৌধুরী ইলার হাবভাব দেখে তখন সবটাই বুঝতেন, তিনি এটাও জানতেন আদিত মূলত ওনার বলা মিথ্যে ঘটনায় অর্থাৎ ইলার বিয়ের কথা বলায় ও পারিবারিক কিছু সমস্যার জন্য আদিত, বিপুল রায় সহ কানাডা চলে যায়।
সব ভেবে ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললেন তিনি। মৃদু স্বরে বলে উঠলেন,,

“কথা যখন দিয়েছো দ্রুত ফিরবে তাহলে আর বাঁধা নেই। এগোও সামনের দিকে।”(মৃদু স্বরে)
সারুর ঘনঘন বুমিটিং হয়, উঠে বসলেই মাথা ঘুড়ায়। সারাদিন সারু ঘরে শুয়ে ছিল, পাশে শেরহামও ছিল। যতবার শেরহাম তাকে খাইয়ে দিতে চেয়েছিলো ততবারই সে পেট থেকে সব উগড়ে দিয়েছে। শেরহাম কোনো বাক্য ক্ষয় করা ছাড়াই সবটা পরিষ্কার করে কিছুক্ষন পর পুনরায় খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল।

চার পাঁচবার এমন হওয়ার পর একটু কিছু খেতে পেরেছিলো সারু। ভীষণ দুর্বলতা জেঁকে ধরেছে তাকে তবুও বাড়িতে আজকে আদিত ইলার বিয়ের কথা হবে। সারু এই দুর্বলতার মাঝেও কৌতূহলী হলো সবার মাঝে উপস্থিত থাকতে।
শেরহাম সাফ মানা করেছিল এই অবস্থায় নিচে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু সারুর ঘ্যান ঘ্যান কি আর থামে? অগত্যা শেরহাম সারুকে নিজের সাথে মিশিয়ে আলতো পায়ে নিচে নিয়ে যাচ্ছে সিঁড়ি বেয়ে।

ডাইনিং টেবিলের ওখানে উপস্থিত হয়ে সবার এমন নীরবতা ও সবার তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো সারু আর শেরহাম। শুকনো কাঁশি দিয়ে শেরহাম বলে উঠলো,,
“সবাই এতো নিশ্চুপ হয়ে বসে আছো কেনো? কি হয়েছে?”(কাঁশি দিয়ে)
কল্যাণী শান্ত স্বরে বলে উঠলেন,,
“আদিত ইমার্জেন্সি কানাডা যাচ্ছে, কিছুক্ষন পর ওর ফ্লাইট। এদের উচিৎ বেরোনো।”(শান্ত স্বরে)
আদিত কল্যাণীর দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে ইলার দিকে তাকালো। ইলা মলিন মুখশ্রীতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইলার চোখ অভিযোগ করছে তার কাছে।

আদিত নজর সরালো, ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললো। শেরহাম আদিতের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আদিত শেরহামের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো তার পিছু আসতে। ইশারা দিয়ে আদিত নিজের ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। শেরহাম সারুকে সাবধানে চেয়ারে বসিয়ে আদিতের পিছু পিছু গেলো।
“ইমার্জেন্সি কানাডা যাওয়ার কারণ?”(গম্ভীর হয়ে)
শেরহামের গম্ভীর কণ্ঠের প্রশ্নে আদিত কিয়ৎক্ষণ চুপ থাকলো অতঃপর বলে উঠলো,,

“শুনতে অদ্ভুত লাগলেও বলছি, তুমি জানোই আমি আমার প্রফেশন থেকে সরে এসেছি প্রায় দু বছর হতে যাচ্ছে। আজ অব্দি অনেক মা’র্ডা’র করেছি, এর শাস্তি তখন না পেলেও এখন পেতে যাচ্ছি। এসজে গ্রুপের প্রাক্তন লিডার আসাদ মাহমুদকে মা’র্ডা’র করেছিলাম তাঁরই ভাইয়ের অর্ডারে। তার ভাই শিমুল মাহমুদ টাকার বিনিময়ে আমার হাতে মার্ডার করিয়েছেন আসাদ মাহমুদকে। আসাদ মাহমুদের সব প্রোপার্টি শিমুল মাহমুদ নিজের করে পেতে চেয়েছিলেন, তাই টাকার বিনিময়ে আমাকে দিয়ে মার্ডার করিয়েছিলেন আসাদ মাহমুদকে।

আমি সম্পর্ক বা কিছু জানার চেষ্টা করিনি, হিটম্যান হিসেবে সিম্পলভাবে হাফ টাকা নিয়ে মার্ডার করেছিলাম আসাদ মাহমুদকে কিন্তু এর পরে বাকি টাকা নিয়ে আমার সাথে গাদ্দারি করেছিলেন শিমুল মাহমুদ তাই তাকেও আমি মার্ডার করেছিলাম। বর্তমানে এসজে গ্রুপের লিডার আসাদ মাহমুদের ছেলে অভীক মাহমুদ। আমি পরিচয় হাইড করে হিটম্যান হলেও আমার পরিচয় কেউ লিক করে দিয়েছে অভীক মাহমুদের কাছে। বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এখন পাগল কুকুর হয়ে আছে অভীক মাহমুদ। বাবার আশেপাশে থাকা প্রায় গার্ডকে নিহত করে বাবাকে তুলে নিয়ে যায় ওরা।

বাবাকে অনেক আঘাত করে ভিডিও করে তা গতকাল রাত দুটোয় আমার কাছে পাঠিয়ে অভীক বলেছে আমি যদি এখন কানাডা নাই যাই তাহলে বাবাকে মে’রে ফেলবে যা আমি চাইনা তাই আমায় যেতে হচ্ছে। জানোই বাবা কানাডায় নিজের বিজনেসের জন্য মোটামুটি পরিচিত সবার কাছে। বাবার উপর হঠাৎ এই হামলায় ওই এরিয়াতে এখন পরিস্থিতি বেগতিক। বাবার পিএ এহমাদ সাফিক আহত অবস্থায় আছেন এখন, ওই এরিয়ার প্রেস মিডিয়া মুখিয়ে আছে। একটু উনিশ থেকে বিশ হলে বাবাকে হারাবো সেই সাথে আমার পরিচয়ও সবার সামনে এসে যাবে। অবশ্য আমি আমার চিন্তা করছিনা, বাবার চিন্তা করছি। আমি আমার শাস্তি পাবো তবে আমার শাস্তি আমার বাবাকে পেতে দিবোনা শেরহাম।”(থেমে থেমে)

শেরহাম এতসব শুনে অবাক হলো। মার্ডার করা বিষয়টাতে অবাক না হলেও বিপুল রায়কে কিডন্যাপ করার বিষয়টা শুনে অবাক হলো শেরহাম। অবাক স্বরে বলে উঠলো,,
“জেঠুকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে, টর্চার করা হয়েছে! এসব তুমি আমায় আগে বলোনি কেনো? তোমার পরিচয় লিক হলো কিভাবে! আজিব ঘটনা!”(অবাক স্বরে)
আদিত চুল খামচে ধরে বলে উঠলো,,

“জানিনা, আমি নিজেকে সম্পূর্ণ হাইড করেই এই প্রফেশনে ছিলাম তবুও জানিনা কিভাবে.. ওয়েট! শিমুল মাহমুদকে মার্ডার করার সময় ওনার পার্সোনাল সেক্রেটারি আমায় দেখেছিলো কিন্তু তাকে তো আমি প্রায় মৃত্যুর মুখে ছেড়ে দিয়েছিলাম! বাঁচার চান্স ধরতে গেলে ছিলই না! শিট!”
শেরহাম কি বলবে বুঝে উঠতে পারলোনা। পরিস্থিতিও বুঝা যাচ্ছেনা, কখন কি থেকে কি হবে। তবুও পরিস্থিতি তো সামলাতে হবে। শেরহাম চেহারায় কাঠিন্যতা ফুটিয়ে তুললো। আদিতের কাঁধে হাত রেখে শক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,,

“কৈ মাছকে মৃ’ত্যু দিলে সম্পূর্ণ মৃ’ত্যু দিতে হয়। মৃ’ত্যুর দ্বারপ্রান্তে হলেও কৈ মাছ তবুও বেঁচে থাকে। তাই তাদের সম্পূর্ণ মৃ’ত্যু দিতে হয়। যেই প্রফেশন ছেড়ে দিয়েছ সেই প্রফেশনে তোমায় আবার ফিরতে হবে জেঠুকে বাঁচানোর জন্য। তুমি দক্ষ, আশা করি লক্ষ্যে সফল হবে।(শক্ত কণ্ঠে)
শেরহামের বাক্য বচন শুনে স্মিত হাসলো আদিত। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেও বিষণ্ণ স্বরে বলে উঠলো,,

“না আমার নিজেকে নিয়ে টেনশন আর না যাদের মে’রেছি তাদের কেনো মে”রেছি এই নিয়ে অনুশোচনা একটুও হচ্ছেনা। যে মানুষগুলো ভদ্রতার মুখোশ পরিধান করে নারী পাচার, ড্রাগস স্মাগলিন, অবৈধ আরও অনেক কাজকর্ম করে তাদের পৃথিবীর বুকে বেঁচে না থাকাই শ্রেয়। বুঝলে? আমি যদি মা’রাও যাই তাহলে আমার হয়ে এই পরিবারের জন্য তুমি আছো। এই নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই, মাথাব্যথা হচ্ছে এখানে বাবাকে কিডন্যাপ করে আ’ঘা’ত করেছে। যতক্ষণ না ওদের বুক থেকে হৃদপিন্ড বের করে তাতে লবন না ছিটাচ্ছি আমি শান্ত হবোনা। বাবার র’ক্ত ঝরানোর দাম ভারী পড়বে ওদের উপর।”
আদিত সবটা বলার সময় প্রথমে বিষন্ন স্বরে বললেও শেষের দিকে রাগান্নিত স্বরে বলেছে। শেরহাম মৃদু হাসলো, বললো,

“সাইকো হিটম্যান আপনার কিছুই হবেনা, আমার বিশ্বাস আপনি সবটা আপনার বুদ্ধি দিয়ে সামলাতে পারবেন। দ্রুত কানাডা থেকে চলে আসবেন জেঠুকে নিয়ে। বয়স অনেক তো হলো, পাত্রীও রেডি আছে আর কত? কয়দিন পর দেখা যাবে আমার ছেলে মেয়েকে কোলে নিয়ে জেঠিমণি আপনার কান ধরে টানছেন নাতি নাতনির জন্য।”(মৃদু হেসে)

টেনশনের মাঝেও ফিক করে হেসে উঠলো আদিত। যাবতীয় সব জিনিস ট্রলিতে গুছিয়ে নিয়েছিল। আগে থেকে তৈরিও ছিল, এজন্য ট্রলি নিয়ে আদিত আর শেরহাম বের হলো।
নিচে ডাইনিং টেবিলের ওখানে আসতেই তারা দেখলো সবাই বিষন্ন হয়ে বসে আছে টেবিলে।
আদিত আর শেরহামকে দেখা মাত্রই নেহাল রায় বলে উঠলেন,,
“তোমাকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিতে আমি, শেরহাম, কল্যাণী আর কৌশিক চৌধুরী ওনারা যাবেন। সারুর যেহেতু শরীর তেমন ভালো নেই তাই ওর সাথে মিতালি থাকবে। চল এবার।”
আদিত হঠাৎ অনুভব করলো তার কণ্ঠনালিতে শক্ত কি যেন একটা বিঁধে গিয়েছে। ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে তার। সারু আর মিতালি বাদে সবাই আদিতের সাথে এয়ারপোর্ট যাবে। মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে মিতালিকে বলে উঠলো,,

“কাকীমণি, আমিতো কানাডা যাচ্ছি। আসার সময় কি আনবো তোমার জন্য বল। এবার তো হুট্ করে এসেছি তাই কিছুই আনতে পারিনি।”(মুচকি হেসে)
মিতালি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলেন,,

“কিছু লাগবেনা, তুই দ্রুত ফিরলেই হলো। এবার কিন্তু সাথে করে দাভাইকে নিয়ে আসবি একেবারের জন্য। আপন নীড়, আপনজন ছেড়ে ওখানে থাকার কোনো মানেই হয়না। অতশত জানিনা তুই দ্রুত ফিরবি আর দাভাইকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবি একেবারের জন্য ব্যস।”(কাঁদো কাঁদো স্বরে)
আদিত মুখের হাসি বিলীন করলোনা। আড়চোখে ইলার দিকে চাইলো। ইলা নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে।
আদিত লম্বা একটা শ্বাস ফেললো। সারুর দিকে চেয়ে “নিজের যত্ন নিও সারু, ভালো থেকো।” বলে মিতালির থেকে আশীর্বাদ নিয়ে বেরোনোর উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো আদিত।

এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় আধা ঘন্টা লেগেছে। সবাই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। আদিত সামনে ট্রলি নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়ালো। ইলা চোখ নিচে নামিয়ে রেখেছে। আদিত সবার থেকে বিদায় নিলো। ইলাকে মৃদু স্বরে বলল,,
“ভালো থেকো ইলা, দ্রুতই ফিরে আসবো।”(মৃদু স্বরে)

ইলা নিশ্চুপ হলেও, চক্ষুদ্বয় নিশ্চুপ থাকলোনা। আকাশের মতো অশ্রু বর্ষিত করতে লাগলো। আদিত ইলার শান্ত মুখশ্রীর অশান্ত চক্ষুদ্বয় দেখে থমকালো। আদিতের মনে হলো তার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দুটো লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে ঠিক করলো আদিত। ইলা নিস্তেজ স্বরে বলল,
“নিজের খেয়াল রাখবেন। পৌঁছে আমাদের ফোন দিবেন। দ্রুত ফিরবেন, অপেক্ষায় থাকবো আপনার।”(নিস্তেজ স্বরে)

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৩

আদিত মৃদু হাসলো। ইশারা দিয়ে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। আদিত যতই এগোচ্ছে তার মনে হচ্ছে কিছু একটা সেটা ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে। হয়তো সেই কিছু একটা আর দেখতে পাবেনা আদিত।

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৫