নীল চিরকুট পর্ব ৫+৬
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
নম্রতা হাসলো। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল,
‘ বলদ ছিলাম না। তবে এভাবে ধরা খেয়ে যাব চিন্তাও করিনি কখনো।’
অন্তু শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে কলার ঠিক করলো। ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলো,
‘ তারপর কী হলো? এই বাঁশেই প্রেমিক পুরুষের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার হয়ে গেল তোর?’
নম্রতা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলল,
‘ আরে ধূর! তখন উদ্ধার হলে কী আজ এই অবস্থা হয় আমার? চরম বাঁশ খাওয়ার পর কিছুদিন চুপচাপ ছিলাম। তবে, আমাদের প্রেমটা মূলত সেখান থেকেই শুরু। প্রেম নয় হয়তো বন্ধুত্বের শুরু। তখন থেকেই ধীরে ধীরে পাল্টে যায় আমাদের চিঠির ধরন।’
‘ বাপরে! তো এতো প্রেম হঠাৎ উবে গেলো কীভাবে?’
নাদিম অবাক কন্ঠে বলল,
‘ তুই সত্যি সত্যিই এই চিঠি-পত্রের সাথে প্রেম করে ফেললি? মানে, সত্যিই? ওই ব্যাটা যদি বুইড়া, টাকপড়া বা গাঞ্জা খোর হতো তো? ব্যাটার নাম কী?’
নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ জানি না।’
নীরা ব্যতিত বাকী সবাই চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ জানিস না মানে? তুই ওই ছেলের নামটা পর্যন্ত জানিস না? তোকে আমরা এতোটা বলদও ভাবি নি। তোর মতো বুদ্ধিমতি মেয়ে এমন বলদামো কেমনে করল?’
নম্রতা নিরাশ চোখে নিজের পায়ের দিকে তাকালো। ক্লান্ত গলায় বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ কখনো জিগ্যেস করা হয় নি। দু’জনের কেউ-ই প্রয়োজনবোধ করি নি। তবে কথায় কথায় একবার বলেছিল, তাদের পরিবারের সবার নামের প্রথম অক্ষর নাকি ‘এন’ দিয়ে শুরু। অদ্ভুতভাবে, একদম দাদার বাবা থেকে ‘এন’ রীতি চলে আসছে তাদের। সে হিসেবে ওর নাম ‘এন’ লেটার দিয়েই হওয়ার কথা।’
ছোঁয়া বোকা বোকা গলায় বলল,
‘ “এন” দিয়ে তো বাংলাদেশেই অসংখ্য নাম আছে। কিভাবে বুঝবি কোনটা ওই লোকের নাম? আমাদের নাদিমের নামও তো ‘এন’ দিয়ে। এই নাদিম? তুই কিছু করিস নি তো?’
নাদিম অত্যন্ত বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাল। ধমকে উঠে বলল,
‘ তোরে আল্লায় মুখস্থ করার গুণ ছাড়া আর কিছু দেয় নি। তোর আই কিউ মাইনস জিরোর থেকেও কম। বালের কথা বলে অলওয়েজ।’
ছোঁয়া ফুঁসে ওঠে কিছু বলবে তার আগেই উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো রঞ্জন,
‘ ছেলে কই পড়তো জানিস? প্লিজ এবার এটা বলিস না যে, ওই ব্যাটা কই পড়াশোনা করত সেটাও জানিস না তুই।’
নম্রতা অপরাধী চোখে তাকিয়ে থেকে চোখ নামাল। রঞ্জন আৎকে উঠে বলল,
‘ তারমানে তুই সত্যিই জানিস না?’
নাদিম হাত উল্টে হতাশ কন্ঠে বলল,
‘ ওই পোলায় যে পড়াশোনা করত তারই বা কী গ্যারেন্টি আছে? আমার তো মনে হচ্ছে ওইটা কোনো পোলাই না। মাইয়া মানুষ ফাইজলামো করছে।’
নম্রতা ব্যস্ত গলায় বলল,
‘ একদমই না। কোনো মেয়ে শুধু মজার ছলে গোটা আড়াই বছর নিয়ম করে চিঠি চালান করবে না। তাছাড়া, চিঠিতে থাকা আমাদের অনুভূতিগুলো সত্য ছিল। তোদের বোঝাতে পারছি না। তোরা ঠিক বুঝবি না। কিন্তু আমি বুঝি, আপাতত সেই সময়টাতে সে আমাকে ভালোবাসতো। কখনো কখনো আমার থেকেও বেশি ভালোবাসতো। আর ও তখন স্টুডেন্টই ছিল। ঢাকারই কোনো ভার্সিটিতে পড়তো তখন।
অন্তু ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘ তুই কী করে জানলি? আন্দাজই?’
নম্রতা অন্তুর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আন্দাজই তো নয়। বিশ্বাসে। নম্রতার বিশ্বাস চিঠিতে লেখা একটা কথাও সে মিথ্যে লিখে নি। সে মিথ্যে বলতে জানে না।
তখন বর্ষার মাঝামাঝি। নম্রতাদের চিঠি দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টি তখন সপ্তাহে গড়িয়েছে। কখনো বা সপ্তাহে দুটো। শ্যামলতা ও সে- এর মাঝে তখন প্রেম না চললেও চলছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। সম্বোধনের আপনি লেখা জায়গাটাতে তখন তুমিময় রাজত্ব। নম্রতার মাত্রই প্রি-টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বর্ষার ঝুম বৃষ্টিতে বাইরে যাওয়া বারণ। নম্রতারা তখন তাদের ধানমন্ডির নতুন বাড়িটিতে থাকে। শাহবাগ থেকে ধানমন্ডির দূরত্ব খুব বেশি না হলেও এই বিশ্রী বর্ষাকালে অযথা জল-কাদা এক করার কোনো কারণ নেই। অন্তত মায়ের চোখে তো নেই-ই। সেই সময়টুকু ঘরে বসে পরীক্ষার শীট মুখস্থ করে, গলা ছেড়ে গান গেয়ে, পুরোনো চিঠিগুলো পড়ে আর নিরন্তর ঝড়ে পড়া বৃষ্টিকন্যাদের নৃত্য দেখেই কেটে যায় নম্রতার। প্রি-টেস্ট পরীক্ষার পর এক সপ্তাহ জ্বর আরেক সপ্তাহ মায়ের কড়া ইন্সট্রাকশনের কারণে শাহবাগে যাওয়া হয়ে উঠলো না নম্রতার। তাদের উত্তাল চিঠি আদান-প্রদানে ভাটা পড়ল। প্রায় দুসপ্তাহ পর কলেজ আর টিউশনিতে যাওয়ার অনুমতি পেয়েই শাহবাগে ছুটে গেল নম্রতা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেদিন ছিলো শনিবার। গ্রন্থাগারে ছুটির দিন। নম্রতার আর চিঠি পাওয়া হলো না। মন খারাপ নম্রতা মাঝরাতে ওঠে চিঠি লিখতে বসলো,
‘ শুনো,
আজ আমার মনটা খুব খারাপ। এত্তো কাঁদতে ইচ্ছে
করছে কী বলব! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কী জানো? আমার মন খারাপের নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। ভীষণ অগোছালো চিন্তা আজ মাথা জুড়ে। মানুষের বোধহয় বেঁচে থাকার জন্য সত্যিই একটা ভালোবাসার মানুষ প্রয়োজন, তাই না? যে মানুষটি শুধু আমার হবে। যাকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাড়া করবে না। পৃথিবীর যেকোনো কোণায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে থেকেও জানব আমার একজন মানুষ আছে। আমারই থাকবে। আমার কিশোরী মনটা যখন ভয়ানক মেঘে ঢেকে যাবে তখন আমি জানবো ওই মেঘগুলোর আড়ালে আমার নিজস্ব এক সূর্য আছে। নিজস্ব এক পুরুষ আছে। তাহলে আর কষ্ট করে পড়াশোনা করা লাগতো না। প্রি-টেস্ট পরীক্ষাটা যা খারাপ হয়েছে। টেস্ট দিতে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। এই দুঃখ-কষ্টময় জীবন দিয়ে কী হবে বলো তো? বাবা-মা তো বিয়ের কথাও ভাবছে না। ধূর! কিচ্ছু ভালো লাগছে না।
[ বিঃদ্রঃ এতোদিন পর চিঠি পেলে। এই দিনগুলোতে মনে পড়েছিল আমায়?]
ইতি
শ্যামলতা ‘
এবারের চিঠির জবাবটা দু’দিনের মাথাতেই হাতে পেয়ে গেল নম্রতা। প্রথম দফায় বিস্মিত হলেও পরমুহূর্তেই খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠলো। মনে মনে ভেবে নিলো, সেই মানুষটি হয়তো তাকেই ভাবছিল। তার চিঠির জন্যই ছটফট করছিলো নয়তো এতো তাড়াতাড়ি চিঠি পাওয়ার ভাগ্য কী নম্রতার হতো? নম্রতা চিঠি নিয়ে ফিরে গেল বাসায়। পুরোটা সময় অদ্ভুত এক উত্তেজনা চেপে থাকল বুকজুড়ে । না-জানি কী আছে চিঠিতে! কী লিখেছে ওই অদ্ভুত লোকটি? নম্রতা বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে দরজা দিয়ে চিঠি খুললো। সাথে সাথেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো গুটি গুটি অক্ষরে লেখা আনন্দময় শব্দগুচ্ছ গুলো। চিঠির অদ্ভুত সুন্দর শব্দগুলো মিলেমিশে তৈরি হয়ে গেল কাল্পনিক এক পুরুষালি মুখমন্ডল। গম্ভীর মুখভঙ্গিতে ধীরে ধীরে কথা বলছে সে। কথার মাঝে হাসছে। সেইসাথে হাসছে তার সুন্দর দুটো চোখ।
‘ শ্যামলতা,
তুমি এতো পড়াচোর কেন, বল তো? তোমার লাস্ট চিঠিটা পড়ে কত্ত হেসেছি কোনো ধারণা আছে তোমার? প্রথম দফায় ভাবলাম বাচ্চা মেয়েটার এতো কষ্ট দূর করতে একটা নিজস্ব পুরুষ মানুষ কিনে দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু শেষটা পড়ে তো আমি হতভম্ব। ম্যাডাম যে পরীক্ষার ভয়ে পুরুষ মানুষ চাইছে সে তো আমার কল্পনারও বাইরে ছিল।তবে, আমি কিন্তু পড়াশোনা ফাঁকি একদম পছন্দ করি না। আমি নিজেও ভীষণ পড়াকু তাই চাই আশেপাশের মানুষগুলোও ভীষণ পড়াকু হোক। আমার ইচ্ছে কী জানো? আমার ইচ্ছে আমাদের ভার্সিটিরই টিচার হিসেবে জয়েন দেওয়া। আমার বাবার ইচ্ছেটাও ছিল তাই। কিন্তু টাকা-পয়সার অভাবে বাবার ইচ্ছেটা আর পূরণ হয়ে উঠে নি।
ভাইয়াও বাবার স্বপ্নটাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয় নি। তাই টিচিং প্রফেশনের দিকে না ঝুঁকে নিজের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে। এখন আমি আর নিদ্রাই বাবার একমাত্র ভরসা। নিদ্রা কিন্তু তোমার মতোই পড়াচোর। পড়াশোনা নাকি তার মাথার ওপর দিয়ে যায়। আমাকে বলে, আমি নাকি রসকষহীন রোবট মানব। যার ভেতর শুধু একটাই সফটওয়্যার। পড়ো, পড়ো এবং পড়ো। কিন্তু তোমার কাছে এসে ব্যাপারটা ভিন্ন। আমার পৃথিবীতে হাতেগুণা মানুষদের মাঝে তুমি একজন যে আমার বাইরেটা নয় ভেতরটা জানে। মস্তিষ্কের বাইরেও আমার যে একটা মন আছে তা তোমার সাথে কথা না হলে হয়তো ঠিকঠাক প্রকাশ পেতো না শ্যামলতা। এই যে তুমি পড়াশোনায় টালবাহানা করো। আমার কী মনে হয় জানো? মনে হয়, তোমার সাথে এমনটাই মানায়।
তোমাকে ঠিক এমনটাই হওয়া উচিত। তোমার প্রাণোবন্ততার সাথে তো এমনটাই সাজে। তাই বলে, পড়াশোনায় অবহেলা কিন্তু ঠিক নয়। মেয়েদের তো আরো নয়। তোমার না দেশ ঘুরে-বেড়ানোর শখ? পড়াশোনা না করলে সেই দেশ ঘোরাটা কী আদৌ হয়ে উঠবে? তোমার সেই নিজস্ব পুরুষ মানুষ যে তোমায় সেই স্বাধীনতাটুকু দিবেই দিবে। তারই বা কী গ্যারেন্টি আছে? তাছাড়া নিজেকে শিক্ষিত, মার্জিত, আত্মবিশ্বাসী আর স্বাবলম্বী ভাবতেও তো অন্যরকম অনুভূতি হওয়ার কথা। আমার তো হয়। তোমার স্বাবলম্বী হতে ইচ্ছে করে না? কোনো এক ঘরের কোণায় সংসারের যাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে থাকা শ্যামলতাকে ভাবলেই তো দমবন্ধ লাগে। তোমার লাগে না?
বিঃদ্রঃ তোমায় মনে পড়েছে কি-না জানি না। তবে বেশ কিছুদিন যাবৎ হঠাৎ-ই আমার ঘরে বেলীফুলের সুবাস আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজ আবার আসছে। বেলীফুলরা হয়তো জেনে গিয়েছে, আজ আমার খুশি হওয়ার দিন! ‘
সেই দমবন্ধ করা শেষ লাইনগুলো পড়ে বিস্ময়ে, আনন্দে কেঁদে ফেললো নম্রতা। আর সেদিন থেকেই পড়াশোনার প্রতি আলাদা দৃষ্টি তৈরি হলো তার। মাথায় খেলে গেল একটাই কথা। সত্যিই তো? পড়াশোনা করে স্বাবলম্বী না হলে কী করে চলবে তার? তার এতো এতো স্বপ্নগুলোকে পাখা দিতে ঠিকঠাক পড়াশোনা করা তো চাই-ই চাই। তাছাড়া তার ‘সে’ যে পড়তে ভালোবাসে। সে- এর ভালোবাসার জিনিসে নম্রতার এতো উদাসীনাতা মানায়? কক্ষনো না।
‘ বাপরে! এদিক বিবেচনা করলে ওই ব্যাটাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া যেতেই পারে। এক চিঠিতেই তোকে ঢাবির স্টুডেন্ট বানিয়ে ছেঁড়ে দিলো? এটা একটা কাজের কাজ হয়েছে। ব্যাটা হিপনোটিজম ভালো পারে। গুড!’
অন্তুর কথায় ঘোট কাটলো নম্রতার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসার চেষ্টা করলো। রঞ্জন হাতে থাকা কাগজের টুকরো দিয়ে বাতাস করতে করতে বলল,
‘ ব্যাটা বলল, সে ভার্সিটির টিচার হতে চায় আর তুই মেনে নিলি? মিথ্যাও তো বলতে পারে। পারে না?’
নাদিম চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘ পোলায় সত্যি বললেও এতো অল্প ইনফরমেশনে কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পাবলিকে পড়তো নাকি প্রাইভেটে পড়তো সেটাও তো জানিস না বাল। ঢাকাতেই তো কত্তোগুলো ইউনিভার্সিটি।’
নম্রতা অবাক হয়ে বলল,
‘ মানে কী? তোরা কী ওকে খোঁজার পরিকল্পনা করছিস নাকি?’
নাদিম স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
‘ তো? খুঁজব না? ব্যাটায় আমাগো দোস্তরে ছ্যাকা দিয়া ব্যাকা বানিয়ে দিয়ে গেল আর আমরা চুপ থাকব? আপাতত দশ-বারোটা ঘুষিতে তার প্রাপ্য। নমু? তুই তাকে খুঁজার চেষ্টা করিস নি কখনও?’
‘ কিভাবে খুঁজবো, কোথায় খুঁজবো বুঝতেই পারি নি। নামটাও তো জানি না।’
‘ আচ্ছা। ওসব বাদ। বাকি গল্পটুকু বল। প্রেমের শুরুটা?’
নম্রতা কিছু বলবে তার আগেই উঠে দাঁড়ালো ছোঁয়া। তাড়াহুড়ো করে বলল,
‘ মাম্মা আমাকে নয়টার মধ্যে বাসায় থাকতে বলেছিল। এখন অলরেডি নয়টা বিশ বাজে। আই হ্যাভ টু গো।’
নাদিম খেঁকিয়ে বলে উঠল,
‘ তো যা না। তোরে এনে বসে থাকতে কইছে ক্যাডায়? সবসময় আজাইরা আলাপ বা..’
ছোঁয়া তেজ দেখিয়ে বলল,
‘ খবরদার বাকিটা উচ্চারণ করবি না। আর ক্যাডায় মানে কী? ভাষার কী ছিঁড়ি! তোর গার্লফ্রেন্ড তোকে সহ্য করে কিভাবে বুঝি না আমি। থার্ডক্লাস কথাবার্তা।’
নাদিম গোঁ নিয়ে বলল,
‘ আল্লায় দিলে মুখটা আমার পার্সোনাল। আমার মুখ দিয়া আমার যেমনে মন চায় তেমনে কতা কমু। তোর বাপের কী? শালা ইংরেজ কোথাকার!’
ছোঁয়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। রঞ্জন শার্টটা টেনেটুনে ঠিক করে ওঠে দাঁড়াল। নম্রতাদের বন্ধু মহলে রঞ্জন সব থেকে সুদর্শন পুরুষ। গৌড়বর্ণ, সুঠাম দেহ। মাথা ভর্তি কোকরানো চুল। খাড়া নাকের নিচে পাতলা কালচে ঠোঁট। মুখভর্তি ছোট ছোট দাড়ির মেলা। সনাতন ধর্মাবলম্বী রঞ্জনের সবচেয়ে সুন্দর দেখতে ওর চোখ। রঞ্জন ছাড়া গলায় বলল,
‘ চল তোরে রিক্সা করে দিই। একা যেতে পারবি? নাকি আমরা কেউ যাব সাথে?’
ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ পারব। তুই সাথে গেলেই বরং অস্বস্তি ফিল করব। মেয়েদের চোখে তো তুই মানুষ না। মিষ্টির দোকান। হা করে তাকিয়ে থাকে। বিরক্তিকর।’
রঞ্জন হাসল। আবারও বসে পড়ে বলল,
‘ তাহলে একাই যা। এখান থেকেই রিক্সা নে। অন্তু দেখ তো রিক্সা আছে নাকি আশেপাশে।’
ছোঁয়া রাস্তার দিকে পা বাড়িয়েও আবার ফিরে এলো। ব্যস্ত গলায় বলল,
‘ আরে! তোদের তো একটা ইম্পোর্টেন্ট কথা বলায় হয় নি। মাম্মা তাদের বুটিক হাউজ থেকে ট্যুরের প্ল্যান করেছে। দে আর গুয়িং টু কক্সবাজার। তোরা কী যেতে চাস? হোটেল রেন্ট আর যাতায়াত খরচ ফ্রি।’
নাদিম ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ সারাদিন মাম্মা মাম্মা করছ কেন বাল? বাঙালী না তুই? খাঁটি বাঙালিদের কখনো ম্যা ম্যা করতে শুনছিস? খুব তো ভাষা নিয়ে হাদিস মারো। আবার ম্যা ম্যা করো। আমার সামনে ম্যা ম্যা করতে এলে চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব। বাঙালী মাইয়া তুই। মায়েরে আম্মা ডাকবি। অলটারনেটিভ হিসেবে মা ডাকবি। ম্যা ম্যা আবার কী? আর আমরা কোনো ম্যা ম্যা-এর সাথে পিকনিকে যাব না। ভাগ তুই।’
ছোঁয়া ফুঁসে উঠল। রঞ্জন শান্ত গলায় বলল,
‘ না-রে ছোঁয়া। আন্টি-আংকেলের সাথে পিকনিকে জয়েন করাটা কেমন দেখায় না? ওদের সাথে থাকলে ইঞ্জয়ও করতে পারব না ঠিকঠাক। গার্ডিয়ানরা সুযোগ পেলেই তো ওয়ান, টু-এর বাচ্চাদের মতো ট্রিট করে। কী লাভ শুধু শুধু সময় নষ্ট করে?’
‘ কিন্তু আব্বু আর মাম্মা কেউই তো যাচ্ছে না আমাদের সাথে। আমি শুধু আমাদের কথা বলছি। আমরা ছয়জন।’
অন্তুর চোখদুটো উত্তেজনায় ধ্বক করে উঠল। উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ মানে? উনারে যাবে না কেন?’
‘ মাম্মাদের প্ল্যানটা লাস্ট মোমেন্টে এসে ওয়াক করে নি। হোটেল, গাড়ি সব বুক করা হয়ে গিয়েছে। আগামী কালেরই প্ল্যান। কিন্তু আজ হঠাৎ একটা কাজ পড়ে গিয়েছে। বুকিং ক্যান্সেলও করা যাচ্ছে না। আর করলেও মাম্মা আমার এবং আমার বন্ধুদের জন্য অফারটা ছেড়ে দিচ্ছেন। তোরা রাজি?’
নাদিম, অন্তু, রঞ্জন চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ অবিয়েসলি!’
নীরা বিরস মুখে বলল,
‘ বাসায় শুনলে কেলাবে। সম্ভব না। তোরা যা।’
নম্রতা সায় দিয়ে বলল,
‘ আমার বাসাতেও মানবে না বোধহয়। কতদিনের ট্রিপ?’
‘ তিনদিন।’
অন্তু মুখ ভার করে বলল,
‘ এটা কোনো কথা? গেলে ছয়জনই যাব। নয়তো একজনও না।’
রঞ্জন কুটিল হেসে বলল,
‘ সব্বাই যাচ্ছি। কাল সকাল সাতটাই দেখা হচ্ছে। এখন সবাই হলে গিয়ে ঘুমা।’
নীরা আৎকে উঠে বলল,
‘ আম্মু আমায় মেরে ফেলবে। তোরা যা প্লিজ। আমি যাব না।’
নম্রতা বিরবির করে বলল,
‘ আমারও মন ভালো নেই। আর আব্বু বোধহয় মানবে না।’
নাদিম গিটার হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ ধুরু! বাসায় জানলে তো কাহিনী ঘটবে। জানাবি না। ব্যস!’
নীরা-নম্রতা চোখ বড় বড় করে বলল,
‘ কী বলছিস?’
রঞ্জন তুড়ি বাজিয়ে বলল,
‘ সুন্দর আইডিয়া। তোদের বাপ-মা তো আর হলে এসে খোঁজ নিবে না। ফোনই করবে। আর ফোন তো তোদের কাছেই থাকবে। তিনদিনেরই ব্যাপার। বাকিটা আমরা সামলে নিব। রিল্যাক্স।’
নীরা ভীত চোখে তাকাল। নাদিম নীরার মাথায় চাটি মেরে বলল,
‘ ভয় পাস না ভতী। ডর বাদুইরা কোথাকার। আমরা তো আছিই। সামলায় নিমু। কিন্তু তোগো ছাড়া যাইতাম না।’
নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজি হলো। ওদের দুই জনের জন্য সবার আনন্দ নষ্ট করার কোনো মানে নেই। তাছাড়া এই ইট-পাথরের শহর থেকে দূরে গিয়ে কষ্টের ভার যদি একটু লাঘব হয়, তাহলে ক্ষতি কী? আলোচনা শেষে রঞ্জু আর নাদিম নম্রতা-নীরাকে হলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রওনা হলো। অন্তু ক্যাম্পাসের বাইরে থাকে বিধায় ছোঁয়াকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়লো অন্তুর ঘাঁড়ে। বন্ধুদের চেষ্টায় ক্ষণিকের জন্য অপরিচিত ‘সে’- কে ভুলে গেল নম্রতা। কিছুক্ষণের জন্য বুকভরে শ্বাস নিলো। নতুন করে ভাবার চেষ্টা করল। কিন্তু নিয়তি কী আদৌ তাই চায়?
শহরে ভোর নেমেছে প্রায় দু’ ঘন্টা হলো। ঘড়িতে সাতটা কি আটটা বাজে। খানিকবাদেই গ্রীষ্মের সোনালি রোদে ঝলমল করে উঠবে জনাকীর্ণ ঢাকা শহরের গাঁ। ধানমন্ডির ছয় নম্বর রোডে সাদা রঙের বিশাল বিল্ডিংয়ের পার্কিং-এ দাঁড়িয়ে আছে নম্রতার বন্ধুরা। তাদের সামনে কালো রঙের চমৎকার এক প্রাইভেট কার। সাদা একটা ন্যাকড়া দিয়ে নিরন্তর গাড়িটির গাঁ মুছে চলেছেন একজন ড্রাইভার। বিরসমুখী ড্রাইভারের গাঁয়ে ঝকঝকে সাদা ইউনিফর্ম। চিমসে যাওয়া গাল দুটো লেগে আছে গালের দু’পাশের চ্যাপ্টা হাড়ে। থেবড়ানো নাকে হাজার টন বিরক্তি। ছোট ছোট চোখে মাত্রাতিরিক্ত প্রভূভক্তি। রঞ্জনের গায়ে কালো রঙের পোলো শার্ট। পরনে অফ হোয়াইট জিন্স। পায়ে ব্ল্যাক কেডস। পুরু ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত।
‘ শালা! এই অন্তু মরছেটা কই? খোঁজ-খবর নাই কোনো।’
নাদিম গিটারে সুর তোলার চেষ্টা করছিল। গায়ে পরা নীল-কালো চেকশার্টটির উপরের বোতামদুটো খোলা। ঘন চুলের এক গাছি পড়ে আছে কপালে। কাগজের মতো সাদা মুখে বিরক্তির ছাপ। রঞ্জনের কথায় কপালের চুলগুলোকে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে গেইটের দিকে তাকাল নাদিম। নম্রতা ট্রলি ব্যাগের উপর গালে হাত দিয়ে বসে ছিল। ফু দিয়ে নিজের কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো উড়িয়ে দিতে দিতে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। ঠিক এমন সময় গেইট পেরিয়ে ভেতরে এলো অন্তু। কালো গায়ে ঝকঝকে সাদা রঙের টি-শার্ট।
পরনে ছাই রঙের ঢিলাঢালা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট। পিঠে ট্যুরিস্ট ব্যাগ। চুলগুলো খাঁড়া করে পেছন দিকে আঁচড়ানো। পেটানো, প্রশস্ত বুকের ছেলেটি ঘেমে অস্থির। পার্কিং-এ বন্ধুদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো অন্তু। রাগান্বিত বন্ধুরা কিছু বলার আগেই ভুবন ভুলানো হাসি হাসল। গায়ের রং কালো হলেও নিজের হাসিটা যে মারাত্মক সুন্দর সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন অন্তু। শুধুমাত্র এই মায়াভরা, ইনোসেন্ট হাসিটার জন্যই অসংখ্যবার অঙ্ক স্যারের ভয়ানক মার থেকে বেঁচে গিয়েছে সে। সে হাসলে আশেপাশের মেয়েরা যে বারবার ঘুরে তাকায় তা একটু বয়স হতেই নিজ জ্ঞানে বুঝে নিয়েছে অন্তু। কিন্তু হায় নিয়তি! একমাত্র নীরাকেই এই হাসির মায়ায় কাবু করতে পারল না সে। রঞ্জন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ শালা! এতোক্ষণ লাগে আসতে? আমরা হল থেকে চলে এলাম আর তুমি ধানমন্ডিতে থাকা সত্ত্বেও ঠিক টাইমে পৌঁছাতে পারো না। খারাপ কথা মুখে আসছিল একখান।’
অন্তু বিগলিত হেসে বলল,
‘ আরে, বাসায় একটু ঝামেলা হইছিলো। আব্বায় হঠাৎ বাজারে পাঠাই দিছিল।’
কথাটা বলে এদিক-ওদিক তাকাল অন্তু। নম্রতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ কী রে? আরগুলা কই?’
নম্রতা সরু চোখে তাকাল। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘ আরগুলা? নাকি নীরা?’
রঞ্জন হাসল। নাদিম গিটারে রোমান্টিক টুন দেওয়ার চেষ্টা করল। অন্তু মাথা চুলকে গরম চোখে তাকাল। কপট রাগ নিয়ে বলল,
‘ খোঁচা মারস কেন হারামি? খালি নীরার কথা জিগ্যেস করব কেন? ছোঁয়াও তো নাই। রওনা দিবি কখন?’
অন্তুর প্রশ্নের মাঝেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ছোঁয়া আর নীরা। তাদের পেছনেই ছোঁয়ার বাবা-মা প্রফেসর সালাম হক এবং সিঁথি হক। ছোঁয়ার বাবা মার উপস্থিতিতে বন্ধুমহলের প্রশ্ন-উত্তর পর্বে ভাটা পড়ল। সবাই হঠাৎ করেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। প্রফেসর সালাম হক ছেলে-মেয়েদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে ড্রাইভারকে বিস্তর বোঝালেন। কিভাবে সাবধানে তাদের কক্সবাজার পর্যন্ত পৌঁছে দিবেন তার বিস্তর উপদেশ দিলেন। সিঁথি হক আর সালাম হকের খবরদারিতে ছোঁয়া ব্যতিত বাকি পাঁচজনেরই ভ্রু কুঁচকে এলো। নাদিম মুখ কাঁচুমাচু করে নিচু গলায় বলল,
‘ মামা? মনে তো হইতাছে আমরা কেজি স্কুলে পড়ি। প্রথম প্রথম স্কুল কী জিনিস দেখতে যাইতাছি। বাল! এতো ঢং-এর মানে কী?’
রঞ্জন উত্তর দিল না। অন্তু মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে চুপ করে রইল। বাবা-মায়ের বাধ্য মেয়ে ছোঁয়া সময় নিয়ে বাবা-মার থেকে বিদায় নিলো। বন্ধুরা কুঁচকানো ভ্রু আর একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে গাড়িতে উঠল। গাড়ি যখন ধানমন্ডি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জের রাস্তায় ছুটলো তখন সূর্যের যৌবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে পথঘাট, পথচারী। প্রায় আধঘন্টা চলার পর থমথমে গলায় আদেশ করল রঞ্জন,
‘ মামা? গাড়ি ঘুরাও। আমরা কেরানীগঞ্জ যাব। পুরাতন ঢাকা।’
রঞ্জনের কথায় চরকির মতো ঘুরে এসে তার মুখের উপর স্থির হলো পাঁচ জোড়া চোখ। বিস্মিত ড্যাবড্যাবে চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো রঞ্জন। কে, কী বুঝলো জানা নেই। নাদিম জোরের সাথে বলল,
‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ। মামা গাড়ি ঘুরাও। কেরানীগঞ্জের রোড ধরো। পুরাতন ঢাকায় যামু।’
ওদের কথায় ড্রাইভার অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। তার চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে, সে মহাপাপীদের সাথে বসবাস করছে। এই পাপীদের সাথে বসে থেকে সে প্রচন্ড কুন্ঠিত, লজ্জিত এবং রাগান্বিত। রঞ্জন আবারও বলল,
‘ কী হলো মামা? গাড়ি ঘুরাতে বললাম না?’
ড্রাইভার ডাঁট হয়ে বসে রইল। চোখদুটো সামনের দিকে নিবদ্ধ। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে থমথমে কন্ঠে বলল,
‘ ম্যাডাম কইছে, ডিরেক্ট কক্সবাজার যাবা। হেতেহুতে অযথা থামাইবা না। আমিও থামাইতাম না। সিদা কক্সবাজার যাওম। গাড়ি ঘুরামু ক্যান? ম্যাডাম তো কেরানীগঞ্জ যাইতে কয় নাই।’
অন্তু-রঞ্জন একে অপরের দিকে তাকাল। দু’জনের ভ্রুই কুঞ্চিত। নাদিম তিক্তমুখে বলল,
‘ একটু জোরে চালান মিয়া। এমনে ভ্যান গাড়ির মতো চালাইতাছেন ক্যান? আর একটা ফার্স্টক্লাস গান দেন। এভাবে কেউ ট্যুরে যায়?’
‘ গাড়ি ঠিক গতিতেই চলতাছে। ম্যাডাম কইছে গাড়ির গতি ত্রিশের উপরে না নিতে। আর গান দেওন যাইত না। ম্যাডাম কইছে গানে ফোকাস নষ্ট হয়। ফোকাস নষ্ট করুন যাইত না।’
বিরক্তিতে কুঁকড়ে উঠলো নাদিম। বিরবির করে বলল,
‘ বাল যাইত না। অসহ্য! অসহ্য!’
অন্তু জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
‘ পুরাতন ঢাকায় আমাদের এক বন্ধু আছে। সাথে যাবে। ওখান থেকে ওকে তুলে নিয়ে তারপর কক্সবাজার যাব। গাড়ি ঘুরান।’
ছোঁয়া কিছু বলবে তার আগেই চোখ রাঙাল নাদিম। যার অর্থ, কথা কবি তো চড়াই দাঁত ফেলাই দিমু! ড্রাইভার লাফিয়ে উঠে বলল,
‘ ম্যাডাম তো কইছিল ছয়জন যাইবো। আপনারা কারে নিতে চাইতাছেন? আপনাগো হাব ভাব সুবিধার লাগে না তো। আমি ম্যাডামের অনুমতি ছাড়া কোনোহানে যাইতাম না।’
রাগে রঞ্জনের ফর্সা গাল দুটোতে লাল রঙের আভা ফুটে উঠল। ছোঁয়া ড্রাইভারের পাশে বসেছিল। পেছনে নম্রতা, নীরা আর রঞ্জন। একদম পিছনের দিকটাই অন্তু আর নাদিম। রঞ্জন নম্রতার দিকে ঝুঁকে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ কেমন মুডে আছিস নমু?’
নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। চোখদুটো ছোট ছোট করে বলল,
‘ মানে?’
‘ এডভেঞ্চার মুড?’
‘ এনিটাইম।’
নম্রতা হাসল। রঞ্জন বাম চোখটা টিপে দিয়ে হাসল। নীরাকে ইশারা করে বলল,
‘ গ্যাঞ্জাম নাম্বার ৩।’
নম্রতা সেই কথাটাই নীরার কানে পৌঁছাল। হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে নিচু গলায় বলল,
‘ গ্যাঞ্জাম নাম্বার ৩, হবে?’
নীরা চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। কোনো প্রশ্ন না করেই দুনিয়া অন্ধকার করে চেঁচিয়ে উঠল। নম্রতা অস্থির গলায় বলল,
‘ নীরু? কী হয়েছে? এমন করছিস কেন!’
নীরা দমবন্ধ গলায় বলল,
‘ ব… মি। বমি পাচ্ছে। গাড়ি থামাও। নি..নিশ্বাস আটকে আছে আমার! ওয়াক…’
ড্রাইভার চোখ বড় বড় করে নীরার দিকে তাকাল। নীরার চোখ দুটো উল্টো যাওয়ার উপক্রম। কপালের আশেপাশে ঘাম। কি বিভৎস দৃশ্য। মেয়েটা মরে টরে যাবে না তো! নাদিম খেঁকিয়ে উঠে বলল,
‘ ওই মিয়া! থামাতে বলতাছে শুনো না? মাইয়ার কিছু হইলে তোমারে খাইছি।’
ড্রাইভার কয়েক সেকেন্ড দ্বিধা-দন্দে থেকে গাড়ি থামাল। নম্রতা ছোঁয়ার গায়ে পর পর দুটো চড় বসিয়ে দিয়ে বলল,
‘ তোর ড্রাইভারকে বল একটা মেডিসিনের দোকান থেকে দুটো দুটো….’
এটুকু বলে থেমে গেল নম্রতা। অসহায় চোখে বন্ধুদের দিকে তাকাল। অন্তু ফট করে বলল,
‘ দুটো নাপা এক্সট্রা ট্যাবলেট আনতে বল।’
নম্রতা সাই দিয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ। নাপা এক্সট্রা আনতে বল।’
পরক্ষণেই অবাক হয়ে বলল,
‘ অ্যা! নাপা এক্সট্রা!’
বন্ধুদের কার্যকলাপ দেখে চোয়াল ঝুলে পড়ার অবস্থা ছোঁয়ার। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ? নাপা এক্সট্রা! নাপা এক্সট্রা দিয়ে…’
এটুকু বলতেই আবারও আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে বমির ভঙ্গিমা করল নীরা। ছোঁয়া আৎকে উঠল। মাথার চিন্তাশক্তি গুলিয়ে গেল। অন্তু ধমক দিয়ে বলল,
‘ ওই তব্দা? তোর ড্রাইভারকে ট্যাবলেট আনতে বলবি? নাকি থাপড়া খাবি? নীরুর কিছু হলে তোর দোষ।’
ছোঁয়া থতমত খেয়ে ড্রাইভারকে মেডিসিন কিনতে পাঠাল। ড্রাইভার একরাশ দ্বিধা আর বিরক্তি নিয়ে মেডিসিনের দোকান খুঁজতে গেল। নাদিম এতোক্ষণ চিন্তিত মুখে ম্যাগাজিন দিয়ে নীরার চোখে-মুখে হাওয়া দিচ্ছিল। ড্রাইভার নেমে যেতেই থেমে গেল তার হাত। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে দেখল। তারপর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। তার সাথে সাথে নেমে দাঁড়াল অন্তু,রঞ্জন। অসুস্থ নীরাও চোখের পলকে সুস্থ,সবল হয়ে উঠল। এক মুহূর্ত নষ্ট না করে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। ছোঁয়া হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করল,
‘ কী করছিস তোরা? কোথায় যাচ্ছিস? গাড়ি থেকে নামছিস কেন? নীরা? তুই না অসুস্থ!’
সবাই উল্টো পথে দৌঁড় লাগাতে লাগাতে বলল,
‘ গ্যাঞ্জাম নাম্বার ৩, বলদ। এখনও বুঝস নাই?’
ছোঁয়া দিশেহারা কন্ঠে বলল,
‘ কিন্তু কেন!’
নীরা উঁচু গলায় বলল,
‘ জানি না। আসলে আয় নয়তো তব্দার মতো বসে থাক।’
বন্ধুদের থেকে জুতসই উত্তর না পেয়ে ব্যাগ কাঁধে নিজেও দৌঁড় লাগাল ছোঁয়া। বন্ধুদের হাবভাব বুঝতে না পেরে মাথা ভনভন করছে তার। আশ্চর্য! কী করতে চাইছে ওরা? ওরা কী ট্যুরে যাবে না? না গেলে বললেই হয়। এতো নাটক কেন? কিছুদূর আসার পর বাস ধরলো ওরা। জনাকীর্ণ বাসে দাঁড়াবার মতো জায়গা নেই। বাসে কোনোরকম ঠেলেঠুলেই দাঁড়িয়ে পড়ল ছয়জন। এই কোণঠাসা বাসে ছোঁয়ার অবস্থা বেকাহিল। ঢাকার লোকাল বাসগুলোতে উঠার অভ্যাস তার নেই বললেই চলে। রঞ্জন বাসের দরজায় ঝুলে রইলো। ওদের তিনজনকে ঘিরে দাঁড়াল অন্তু আর নাদিম। কিছুক্ষণের মাঝেই আড্ডায় মজে উঠল পাঁচজন।
একপর্যায়ে গিয়ে পেছন থেকে মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক বাজে ভাবে স্পর্শ করল ছোঁয়ার স্পর্শকাতর স্থানে। ছোঁয়া অসহায় চোখে বন্ধুদের দিকে তাকাল। নাদিমের দিকে কিছুটা সরে আসার চেষ্টা করল। অন্তু নম্রতাকে ইশারা করতেই ছোঁয়ার জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল নম্রতা। বাসে ঝাঁকি লাগতেই পেছনের দিকে হেলে পড়ে দানবীয় ভাবে লোকটির পা মাড়িয়ে দিল নম্রতা। পেন্সিল হিলের ভয়ানক আঘাতে আর্তনাদ করে উঠল লোকটি। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কিছু বলবে তার আগেই অন্তু বলল,
‘ আহা চাচা। বাসে উঠলে একটু আধটু ধাক্কা খেতেই হয়। ওমন চেঁচামেচি করলে তো চলে না।’
কিছুক্ষণ পর আবারও একই কাজ করল নম্রতা। লোকটি প্রতিবাদ করতেই নাদিম খেঁকিয়ে উঠে বলল,
‘ ফাইজলামি পাইছেন মিয়া? ধাক্কাধাক্কি সহ্য না হলে নাইমা যান। কেউ ইচ্ছে করে ধাক্কা দিব ক্যান আপনারে? এতো ফেচফেচ করতাছেন ক্যান?’
লোকটি আর কথা বাড়াল না। বন্ধুরা আবারও আড্ডায় মাতলো। দুপুরের শেষ ভাগে কেরানীগঞ্জ গিয়ে পৌঁছাল তারা। সেখান থেকে পুরাতন ঢাকা। দুপুর আড়াইটার দিকে পুরাতন ঢাকার একটা রেস্টুরেন্টে পেট পুড়ে খাবার খেলো সবাই। ছোঁয়া উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
‘ হেই গাইস? আই থিংক, আই এম ইঞ্জয়িং দিস ট্যুর!’
নাদিম বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ আবার ইংরেজি মারাস। বাংলায় কথা কইতে পারিস না তুই? ইংরেজের বাচ্চা!’
নীরা হাই তুলতে তুলতে বলল,
‘ ঝগড়া রাখ। আমরা কী কক্সবাজার যাচ্ছি? নাকি যাচ্ছি না? এতো ঢং করে এখানে আসারই বা কারণ কী?’
রঞ্জন টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
‘ যাচ্ছি।’
‘ তাহলে গাড়ি ছাড়লাম কেন?’
অন্তু দাঁত কেলিয়ে বলল,
‘ ওইটা ট্যুর ছিল? ওই ড্রাইভারকে সাথে নিলে ট্যুরের বারোটা বাজত। আমরা কক্সবাজারে যাচ্ছি লঞ্চে করে। ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। পাঁচটায় লঞ্চ।’
ছোঁয়া আৎকে উঠে বলল,
‘ লঞ্চ! আমি কখনো লঞ্চে উঠি নি। লঞ্চ যদি ডুবে যায়? আর লঞ্চে করে কক্সবাজারে কিভাবে?’
নাদিম বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ সবাই যেভাবে যায় সেভাবে।’
নম্রতা খাবার চিবোতে চিবোতে বলল,
‘ যেতেই তো দু’দিন লাগবে। কক্সবাজার থাকব কখন?’
রঞ্জন ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ তাই কী? কক্সবাজার তো বহুত গিয়েছি। এবার না হয় আশেপাশের জায়গাগুলোতেই বেশি থাকলাম। সদরঘাট থেকে হালুয়া ঘাট। ওখান থেকে দশটার লঞ্চে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম একরাত থেকে পরের দিন কুতুবদিয়া হয়ে কক্সবাজার। দুইদিনে যাব। একদিন কক্সবাজারে থাকব। চতুর্থদিন সড়কপথে ফিরে আসব।’
ছোঁয়া হা-হুতাশ করে বলল,
‘ মাম্মা কে কী বলব? মাম্মা আমাকে মেরে ফেলবে।’
নাদিম বিরবির করে বলল,
‘ শুরু হইছে ম্যা ম্যা।’
সারাদিন পুরাতন ঢাকার এখানে সেখানে ঘুরে, আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিল নম্রতারা। সন্ধ্যা পাঁচটায় সদরঘাটে পৌঁছে নির্দিষ্ট লঞ্চে উঠল তারা। রঞ্জন দুটো কেবিন বুক করেছে। একটা মেয়েদের জন্য। অন্যটি ছেলেদের জন্য। লঞ্চ সদরঘাট ছাড়লো সন্ধ্যা ছয়টার দিকে। ধীরে ধীরে দৃষ্টি সীমার আড়ালে পড়ল শহরের দূষিত বাতাস। সবাই যার যার মতো ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসে বসলো রাত আটটার দিকে। কিছুক্ষণ আড্ডা চলার পর হঠাৎই মন খারাপ হয়ে গেল নম্রতার। বন্ধুদের রেখে ডায়েরি হাতে ধীরে ধীরে নিচে নেমে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল সে। রাতের আকাশে মস্ত এক চাঁদ। দিগন্ত বিস্তৃত জলধারায় চকচকে জ্যোৎস্নার আলো। গা কাঁপানো তীব্র বাতাস। নম্রতা বুক ভরে শ্বাস নিলো। টলমলে অনুভূতি নিয়ে ডায়েরিটা খুলে পড়ার চেষ্টা করল। বুক ভরে চিঠির গায়ে থাকা সুঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করল। নম্রতাদের প্রেমের এক পর্যায়ে ‘সে’ নামক ব্যক্তিটি চিঠির গায়ে সুন্দর এক সুগন্ধি ব্যবহার করত। চিঠি খুলতেই অসাধারণ এক সুগন্ধে বুক ভরে আসত নম্রতার। নম্রতা জিগ্যেস করায় বলেছিল,
‘ তুমি যে চিঠিগুলো অসংখ্যবার পড়ো ,জানি। চিঠিগুলো যখন খুলবে। এই গন্ধটা যখন নাকে লাগবে। ঠিক তখনই, আমার খুব কাছে থাকার অনুভূতি হবে তোমার। তাছাড়া! নীল চিরকুটের সুগন্ধ কী সাধারণ কাগজের মতো সাধারণ হলে চলে? শ্যামলতাই বা বারবার কাগজের এই বিশ্রী গন্ধটা কেন নিবে? শ্যামলতা মানেই তো হাজারও বেলীর সৌরভ!’
নম্রতার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। চোখদুটো বোজে নিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলো। ঠিক তখনই পেছন থেকে প্রচন্ড ধাক্কায় সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল নম্রতা। এক হাতে রেলিং আঁকড়ে ধরে নিজেকে রক্ষা করলেও হাতের ডায়েরিটা গিয়ে পড়ল টলমলে নদীটিতে। নম্রতা আৎকে উঠলো। সারা শরীর কেঁপে উঠল। ডায়েরিটাকে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে দেখে মাথা ঘুরে উঠল তার। রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
নীল চিরকুট পর্ব ৩+৪
‘ আমার ডায়েরি। নীরু! নীরু! আমার ডায়েরি। রঞ্জন!’
নম্রতাকে রেলিং-এর ঝুঁকে পড়তে দেখে পেছন থেকে শক্ত একটি হাত আকঁড়ে ধরল নম্রতার ডান হাত। বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ আরে! করছেন কী? পড়ে যাবেন তো!’
