নীল চিরকুট পর্ব ৫৯+৬০

নীল চিরকুট পর্ব ৫৯+৬০
নৌশিন আহমেদ রোদেলা

পূর্বাকাশ যখন সিঁদুর রঙে রাঙা হল, ভোরের বাতাস আলোড়িত করে বেজে উঠল প্রার্থনায় নিমজ্জিত হওয়ার আহ্বান। ঠিক তখনই দুই চোখ বোজল নম্রতা। ঘুমগুলো এসে ধরা দিল ধীর পায়ে। অশ্রুসিক্ত ফোলা চোখদুটো দু’দন্ড শান্তি কুড়ালো এবার। ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেল সকল বিষাদ।
চওড়া বারান্দায় চেয়ার বিছিয়ে বসে আছেন নুরুল সাহেব। চোখের সামনে মেলে রাখা খবরের কাগজ। চোখ-মুখ গম্ভীর। পাশের ক্যাসেটে বাজছে স্মৃতিবিজরিত গান।

‘একটাই কথা আছে বাংলাতে
মুখ আর বুক বলে একসাথে
সে হল বন্ধু, বন্ধু আমার
বন্ধু আমার, বন্ধু আমার।
কে গরীব, কে আমীর সে মানে না
জাতের বিচার করা সে জানে না
সে হল বন্ধু.বন্ধু আমার
বন্ধু আমার।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বাপ্পী লাহিড়ী ও মুন্না আজিজের কন্ঠে গাওয়া মাস্টারপিস। তরুন বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বসে এই গানটাই বেতারে শোনা হয়েছে অসংখ্যবার। আসাদ, মাসুদ, ইব্রাহিম আরও কতজন ছিল তখন। এখন নেই। কে, কোথায় আছে সে খবর নেওয়ার সময়, সুযোগটাও নেই। নুরুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে খবর কাগজের পাতা উল্টালেন। ততক্ষণে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে নম্রতা। এলোমেলো চুলে হাত খোপা। গায়ে রাতের টি-শার্ট আর টাউজার। নম্রতা বিধ্বস্ত মুখেই মৃদু হাসল। টলমলে পায়ে চেয়ারের কাছে এসে বলল,
‘ শুভ সকাল বাবা।’
নুরুল সাহেব গানের সাউন্ড কমিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। খবরের কাগজটা ভাঁজ করে পাশে রাখতে রাখতে বললেন,

‘ শুভ সকাল, মা।’
নম্রতা চেয়ারে বসে হাসল,
‘ হাও ইজ দ্য মর্নিং? রিমেম্বারিং দ্য ওল্ড ডেইজ?’
নুরুল সাহেব হাসলেন। চোখ থেকে চশমা খুলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভীষণ আনমনা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টটির গায়ে।
‘ বন্ধু পাওয়া প্রাপ্তি, বন্ধু হারিয়ে ফেলা ব্যর্থতা। জীবনের এই পর্যায়ে এসে নিজের ব্যর্থতাগুলো গুণার চেষ্টা করছিলাম।’
নুরুল সাহেব আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ঠোঁটে হাসি টেনে মেয়ের দিকে তাকাতেই কপাল কুঁচকালেন। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,

‘ কিন্তু তোর এই অবস্থা কেন? চোখ-মুখ ফোলা লাগছে। ঠিক আছিস মা?’
নম্রতা হাসার চেষ্টা করল। চেষ্টা সফল হল না। নিজের চেয়ারটা বাবার পাশাপাশি রেখে বলল,
‘ তোমায় একটু জড়িয়ে ধরব বাবা? আমার ঘুম হচ্ছে না।’
নুরুল সাহেবের উদ্বেগ বাড়ল। মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে আলতো হাত বুলিয়ে দিলেন মাথায়। মেয়েকে এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করলেন না। চুলে বিলি কাটতে কাটতে শুধু বললেন,
‘ বাবা তোকে খুব ভালোবাসে মা। জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে বাবা তোকে ভালোবাসবে।’
নম্রতা চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস নিল। বাবাকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরে বিড়বিড় করে বলল,
‘ ইউ আর দ্য বেস্ট ফাদার ইন দ্য ইউনিভার্স। লাভ ইউ মোর। মোর এন্ড মোর।’

সকাল এগারোটা। সিএনজি-তে বসে একদৃষ্টে ফোনের দিকে চেয়ে আছে নম্রতা। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে দেখছে, আরফানের ফোন বন্ধ। আরফান তাকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করেনি। রাতে ওভাবে ফোন কাটার পর একটা বারও তার নম্রতার কথা মনে পড়েনি? একবারও নয়? নম্রতা নিজে থেকেই ফোন দিল, ফোন বন্ধ। নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিএনজির সিটে গা এলিয়ে দেয়। এই বিদঘুটে, বিষন্ন দুপুরটার প্রতি জন্মায় রাজ্যের ক্ষোভ। ভার্সিটির গেইটের কাছে সিএনজি থামতেই ছোঁয়াকে দেখতে পায় নম্রতা। গোলাপি কুর্তি আর সাদা সালোয়ার গায়ে গাড়ি থেকে নামছে ছোঁয়া। নম্রতা তাকে দেখেই বিরক্ত চোখে তাকাল। অযথা রাগ দেখিয়ে বলল,

‘ তোর না কাল বিয়ে? বিয়ে রেখে ভার্সিটিতে এসেছিস কোন দুঃখে?’
ছোঁয়া নম্রতার রাগটা ধরতে পারল না। নম্রতার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সরল কন্ঠে বলল,
‘ বিয়ে তো কাল। আজ তো কোনো কাজ নেই আমার। শুধু শুধু বাড়ি বসে থাকব কেন?’
নম্রতা দাঁড়িয়ে গেল। চোখে-মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ ঠিক বলেছিস। তোর তো কোনো কাজ নেই। আমার ধারণামতে, বিয়ের দিনও তোর কোনো কাজটাজ থাকবে না। দুই মিনিটের কবুল বলা ছাড়া বউদের তেমন কাজ থাকেও না। বাসর রাতেও কোনো কাজ নেই তোর। বর বাসর করবে, সেখানে অযথা তোর কী কাজ? আমরা কাল গ্রুপ স্টাডির প্ল্যান করছি। ফ্রী-ই যেহেতু আছিস, ওয়ান্না জয়েন আস?’
ছোঁয়া চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘ জয়েন করতে পারলে বেশ হতো। কিন্তু মাম্মা বোধহয় এলাউ করবে না।’
নম্রতা রাগ নিয়ে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ নাদিমের বলা ইউনিভার্সাল ট্রুথ কি জানিস?’
ছোঁয়া জিজ্ঞেসা নিয়ে তাকাল। নম্রতা আকাশসম বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ তুই আসলেই একটা বলদ।’
নম্রতা-ছোঁয়ার কথার মাঝেই রিকশা থেকে ডেকে উঠল একটি মেয়ে। নম্রতা প্রথম দফায় চিনতে না পারলেও সম্বোধন শুনে চট করে চিনে ফেলল। ঠোঁটে হাসি টানার চেষ্টা করে বলল,
‘ আপনি এখানে?কেমন আছেন আপু?’
নিদ্রা হেসে বলল,

‘ আমি এই ভার্সিটিরই প্রাক্তন ছাত্রী। কিছু কাগজপত্র তুলতে এসেছিলাম। টিচার্স নিয়োগে এপ্লাই করব এবার। কিন্তু তোমার এই অবস্থা কেন? আর ইউ ওকে? ভীষণ সিক দেখাচ্ছে তোমায়।’
নম্রতা হেসে বলল,
‘ তেমন কিছু না। রাতে ঘুম হয়নি তো তাই এমন দেখাচ্ছে।’
‘ ঘুম হবে না কেন? ভাইয়া ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও তার প্রিয়তমার এই অবস্থা! মানা যাচ্ছে না। তাকে বলোনি?’
নম্রতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ নিষ্প্রভের ফোন অফ। তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।’
নিদ্রা কপাল কুঁচকে তাকাল। তার সুন্দর ঠোঁট জোড়া বাচ্চাদের মতো উল্টে ফেলে বলল,
‘ ভাইয়ার তো দুটো নাম্বার। তুমি সেকেন্ডটাতে ট্রাই করো। ভাইয়া তো একসাথে দুটো নাম্বারই বন্ধ রাখে না।’
নম্রতা অবাক হলো। বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ নিষ্প্রভের সেকেন্ড কোনো নাম্বার তো আমার কাছে নেই।’
নিদ্রা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল। নম্রতাকে তৎক্ষনাৎ আরফানের নাম্বার দিয়ে বিদায় নিল। নম্রতা অনুভূতিশূন্য চোখে ছোঁয়ার দিকে তাকাল। ছোঁয়া ভীষণ অবাক হয়ে বলল,
‘ মেয়েটা কি ম্যান্টালি সিক? তোকে ছোঁড়াছুড়ি বলে ডাকছিল কেন? এটা কেন নাম হলো? আশ্চর্য!’

নম্রতা উত্তর দিল না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। মনে মনে শুধু একটা প্রার্থনায় করতে লাগল, আরফানের এই নাম্বারটাও যেন বন্ধ থাকে। আরফানের এই নাম্বারটা খোলা থাকলে, নম্রতার অবুঝ মনটা তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের সাথে পেরে উঠবে না। মস্তিষ্কের হাজারও যৌক্তিক প্রশ্নের জবাবে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো রাস্তা থাকবে না। ভীষণ অস্থিরতা নিয়ে গোটা একটা ক্লাস করল নম্রতা। আরফানের নাম্বারে ফোন দেওয়ার মানসিক শক্তি জুগাতে গিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল শরীর। যদি ফোনটা লেগে যায়? হাজারও দ্বিধা-দ্বন্দের অবসান ঘটিয়ে কল করল নম্রতা। তার হৃৎস্পন্দন থামিয়ে দিয়ে, সকল প্রার্থনা মিথ্যে করে দিয়ে প্রথমবারেই ফোন রিসিভ করল আরফান। নম্রতা বোবা হয়ে বসে রইল। তবে কি নম্রতার জন্যই সীম অফ রেখেছিল আরফান? যদি তা না হয় তাহলে এই নাম্বারটা কেন দেয়নি তাকে? সকালে একটাবারও কেন মনে পড়েনি তাকে?

‘ নম্রতা? আপনাকে একটু পর ফোন দিই? আমি এখন পেশেন্টের সামনে। ব্যস্ত আছি।’
হঠাৎ আরফানের কন্ঠে ভাবনায় ছেদ ঘটল নম্রতার। চমকে উঠে বলল,
‘ হু?’
‘ আমি আপনাকে একটু পর ফোন দিচ্ছি নম্রতা।’
নম্রতা নিজেকে খুব দ্রুত ধাতস্থ করে নিয়ে বলল,
‘ সকালে একটা বার আমাকে কল দেওয়ার প্রয়োজন কি আপনার ছিল না?’
আরফান মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ সরি! খেয়াল ছিল না।’
নম্রতা যার পর নাই অবাক হলো। মেজাজ বিগড়ে গেল। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলল,

‘ খেয়াল ছিল না? আমার এক্সজিসটেন্স কী তবে খেয়াল হওয়া পর্যন্ত ডক্টর?’
‘ ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে কেন ঝামেলা করছেন নম্রতা? আমি আপনাকে পরে কল দিই?’
‘ ঝামেলা? ঝামেলা কোথায় করলাম? আই ওয়াজ জাস্ট আস্কিং। ফোন বন্ধ কেন আপনার?’
‘ ফোন বন্ধ থাকলে কল এলো কিভাবে?’
‘ সীমটা বন্ধ রেখেছেন।’
‘ ওহ! কাল রাতে অফ করেছিলাম। অন করতে মনে নেই। আমি পরে ফোন দিচ্ছি।’
‘ কাল রাতে কোনো ইম্পোর্টেন্ট কল এটেন্ট করেছেন?’
আরফান বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ আমার সামনে পেশেন্ট বসা নম্রতা। আমি ব্যস্ত আছি।’
নম্রতা জবাব দিল না। ডানচোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল গালে। বিড়বিড় কন্ঠে বলল,
‘ আপনার জীবনে আমার অস্তিত্ব ব্যস্ততা আর খেয়াল হওয়ার মাঝে সীমাবদ্ধ ডক্টর। আমি এতোটা ঠুনকো কখনও বুঝতেই পারিনি!’
আরফান বুঝতে না পেরে বলল,
‘ কি বললেন বুঝতে পারিনি। এখন রাখি, প্লিজ?’
নম্রতা রেখে দিল। দুই চোখে ভর করল রাজ্যের বৃষ্টি। বুকের বাম পাশে থাকা ছোট্ট মনটা ব্যথা করে উঠল নিষ্ঠুরভাবে। চার বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা। প্রতিটি রাতের একাকিত্ব যন্ত্রণা, কান্নাগুলো যেন আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠল চোখে। যার খেয়ালে সে মগ্ন থেকেছে এতটা কাল। এতটা বছর। এতোগুলো রাত-দিন! সেই তার কাছে নম্রতার অস্তিত্ব আজ খেয়ালের উপর টিকে আছে। ভালোবাসার মানুষের কথাও বুঝি খেয়াল থাকে না? খেয়াল করে নিতে হয়? কি আশ্চর্য! তবে কি নম্রতা ভালোবাসতে পারেনি? তার কেন খেয়াল করতে হয় না?

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতেই ছটফট করতে লাগল নীরা। বার বার উদগ্রীব চোখে তাকাতে লাগল দরজায়। শাশুড়ী মাকে রান্নায় সাহায্য করতে গিয়েও বাঁধাল গন্ডগোল। পিঁয়াজ কাটতে গিয়ে হাত কেটে বলি করল। জাহানারা মেজাজ খারাপ করে তাকালেন। ধমকে উঠে বললেন,
‘ একটা কাজ ঠিকঠাক করতে পারো না? কাজ করার সময় মন থাকে কই? বরকে দেখাতে চাও, তোমার শাশুড়ী তোমাকে অত্যাচার কে মেরে ফেলছে? হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? পানি ঢালো হাতে। অয়ন? এই হারামজাদা। সারাদিন টিভিতে কি দেখিস তুই? তোরে আর তোর টিভি দুইটাকেই এক কোপে দুই ভাগ করে ফেলব হারামির বাচ্চা। ভাবির হাত কেটেছে, স্যাভলন আন। কাজ করতে এসে যত অকাম। জীবনটা শ্যাষ করে ফেলল আমার। এখনও দাঁড়ায় আছ কেন তুমি?যেতে বলি নাই?’

জাহানারার ধমকে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে নীরা। অয়ন হাতে পট্টি বেঁধে দেওয়ার পর রান্নার কোনো কাজে হাত দিতে দেননি জাহানারা। সন্ধ্যা থেকে রাত অব্দি ধমকা-ধমকি করেই পাড় করেছেন সময়। নীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকা শুনেছে আর শাশুড়ী মায়ের ছেলের জন্য অপেক্ষা করেছে। কাল রাতের পর অন্তুকে ধারেকাছে পায়নি নীরা। ছেলেটা সারাদিন বাইরে বাইরে কী করে কে জানে? নীরার এই চঞ্চলা অপেক্ষার অবসান ঘটল রাত এগারোটায়। অন্তু বাড়ি ফিরেই খেতে বসল। অয়ন আর নীরা ব্যতীত সবাই তখন যার যার ঘরে। অন্তু খেতে বসেই প্রথম নীরার দিকে তাকাল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,

‘ খাওয়া হয়েছে ম্যাডাম?’
নীরা মৃদু হেসে বলল,
‘ পরে খাব।’
অয়ন সোফায় শুয়ে ক্রিকেট ম্যাচ দেখছিল। ভাই-ভাবীর কথার এক পর্যায়ে গলা উঁচিয়ে বলল,
‘ নীরাপু থুক্কু ভাবী আজ হাত কেটে ফেলেছে ভাইয়া।’
অন্তু কপাল কুঁচকে তাকাল। মাথা হেলিয়ে উঁকি দিয়ে বলল,
‘ কোন হাত? দেখি?’
নীরা ডানহাতটা একটু উঁচু করে নিজের চোখের সামনে ধরল। তারপর বলল,
‘ অত কাটেনি। একটু।’
অন্তু কিছু বলল না। নীরা অয়নের দিকে চেয়ে বলল,
‘ এই তুই এখনও ঘুমোতে যাস না কেন? বাবা যদি দেখে এখনও টিভি চলছে, খুন করে ফেলবে একদম। যা ঘুমোতে যা।’
অয়ন আগের মতোই লম্বালম্বিভাবে শুয়ে পড়ে বলল,

‘ ম্যাচ শেষ না হলে ঘুম আসবে না। ভাইয়া? আজকের ম্যাচটা কিন্তু জটিল হচ্ছে।’
নীরা অন্তুর পাতে খাবার দিয়ে নিজের ঘরে গেল। ছাদে শুকোতে দেওয়া জামা-কাপড়গুলো অগোছালোভাবে পড়ে আছে বিছানায়। নীরা বিছানায় বসে এক এক করে কাপড়গুলো গুছাতে নিতেই ঘরে এলো অন্তু। মুখভর্তি হাসি নিয়ে ফোনে কথা বলছে সে। এক হাতে তার খাবারের প্লেট। অন্যহাতে ফোন। অন্তু ফোনে কথা বলতে বলতেই বিছানায় এসে বসল। কথার ধরন দেখে বুঝা গেল নাদিমের সাথে কথা বলছে সে। অন্তুর হাসি বিস্তৃত হলো। বিচিত্র ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁট কামড়ে বলল,

‘ ওই মেয়ে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টেই পড়ে। তেজ ব্যাপক। তোর দ্বারা সম্ভব হবে না।’
কথা বলতে বলতেই খাবার মেখে নীরার সামনে ধরল অন্তু। নীরার মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টি এবার বিস্ময়ে রূপ নিল। অন্তু তখন নাদিমের বিপক্ষে কথার ঝুলি সাজাতে ব্যস্ত। নীরার বিস্মিত চাহনি তার চোখে পড়ল না। নীরা মুখ বাড়িয়ে খাবার মুখে নিল। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়েই একের পর এক লোকমা এগিয়ে দিল অন্তু। নাদিমের সাথে হাস্যোজ্জল আলাপন করতে করতে নীরার চোখের বিস্ময়, মোহ ঠাহর করতে পারল না সে। হঠাৎই শব্দ করে হাসল অন্তু। ফোনের ওপাশে বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ চাপা মারিস না। আমি অবশ্যই পারতাম। কিন্তু তারে দিয়ে আমি করুমটা কি? ওই মেয়ের জায়গায় তোর বোন হলে নাহয় একটা কথা ছিল। আহা! আমাদের প্রেমকাহিনীটা তুই পুরো হতে দিলি না।’
নাদিম অশ্লীল কিছু গালি দিয়ে বলল,

‘ তুই তো শালা বিরাট চরিত্রহীন। ঘরে বউ রাইখা বাইরে নজর দেস।’
অন্তু হাসে। নীরার দিকে শেষ লোকমা এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ বউ রাইখা নজর দিলাম কই? নজর তো আমার আগে থেকেই ছিল। এক বউ দিয়ে আসলে চলছে না। তোর বোনকে মাস্ট দরকার।’

নীরা মুগ্ধ চোখে অন্তুর হাসি দেখছে। এই ছেলের এই হাসির জন্যই শেষমেশ প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়েছিল নীরা। এত এত গালি শোনার পরও অন্তু নির্বিকার হেসে বলত, আর কত বকবি দোস্ত? রেস্ট নে। সামনের মাসে প্রপোজ করলে বাকি গালি দিস। এখন গালি শোনার মুড নাই। নীরা তখনও মুগ্ধ চোখে দেখত। সেই চোরা দৃষ্টি এখন প্রকাশ্য। সেই নিষিদ্ধ মোহ এখন বাধাহীন, পবিত্র। অন্তুর সুন্দর, স্বচ্ছ হাসির দিকে চেয়ে থেকেই হঠাৎ ভীষণ অগোছালো হয়ে পড়ল নীরা। হঠাৎই উঠে গিয়ে অন্তুর খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

তারপরই বর্ণনাতীত এক কাজ করে বসল সে। ডানহাতটা অন্তুর কাঁধে রেখে অন্তুর মোহাচ্ছন্ন ঠোঁট জোড়াতে ঠোঁট রাখল পরম আবেশে। অন্তু হঠাৎই কিছু বুঝে উঠতে পারল না। পুরো ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই হতভম্ব হয়ে গেল সে। নীরার অকল্পনীয় কাজে কাঠ হয়ে বসে রইল। হাত থেকে গড়িয়ে পড়ল ভাতের প্লেট, ফোন। প্লেট পড়ার শব্দ হতেই ছিটকে সরে দাঁড়াল নীরা। কাঁপা হাতে প্লেটটা তুলে নিয়েই দ্রুত পায়ে ঘর ত্যাগ করল। একটাবারও অন্তুর চোখে চাওয়ার সাহস করে উঠতে পারল না। অন্তু হতভম্ব চোখে নীরার যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। ঠিক এই মুহূর্তে কি ঘটে গেল, কিভাবে ঘটে গেল কিচ্ছু বুঝতে পারছে না অন্তু। ফোনের ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠল নাদিম,
‘ তুই কি মইরা গেছিস দোস্ত? টিকেট কাইট্টা গেছে তোর? কথা কস না ক্যারে?’
অন্তু কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে নিয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বিরবির করে বলল,
‘ আমার বোধহয় আট্যাক ফ্যাটাক হয়ে যাচ্ছে দোস্ত। শরীর কাঁপছে। কি হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।’

রাত বাড়ছে, ফুরিয়ে যাচ্ছে অভ্যস্ত জীবনের আয়ু। বই হাতে দুই তলার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া। পুরো দু’তলা জুড়ে পিনপতন নীরবতা। আত্মীয়-স্বজনদের কেউই দু-তলার সিঁড়ি মারাচ্ছেন না। সিঁথি হকের কড়া নির্দেশ, ছোঁয়াকে কিছুতেই বিরক্ত করা যাবে না। ছোঁয়া ছোঁয়ার মতো খাবে, ঘুমাবে। বিয়ের আগের দিন হৈ-চৈ এ ঘুম না হলে চোখের নিচে কালী পড়বে। সুন্দর দেখাবে না। কিন্তু ছোঁয়ার ঘুম হচ্ছে না। কিছু একটা, কোথাও একটা তাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। চারপাশের এতো আয়োজন, এতো আলো, এতো হৈ-চৈ এর কোথাও সে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে না। সবকিছু তাকে ঘিরে হলেও যেন এসবে সে নেই।

তার অস্তিত্বটুকু ভীষণ দূরের কোনো ঘুমন্তপুরীতে আবদ্ধ। একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বড় নিঃস্পৃহ, রসহীন, সাধারণ। ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাইব্রেরি ঘরে ঢুকল। বাবার আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে উপন্যাসের পাতা উল্টাল। খুব পানসে এই ঘটনাপ্রবাহ। অপ্রয়োজনীয়, বিরক্তিকর। ছোঁয়ার হঠাৎই মনে হলো, এই অধ্যায় আর তার জীবন একই উপন্যাসে গাঁথা। একই তার ধারাবাহিকতা। একই তার ঘটনাপ্রবহতা। একই রকম নিষ্প্রয়োজন। অত্যাধুনিক ফোনের নিদারুণ চিৎকারে গুরুগম্ভীর ভাবনা থেকে খানিক ছিটকে পড়ল ছোঁয়া। ঘড়িতে তখন দুটো বাজে। এতোরাতে ফোন দেওয়ার মানুষ তো ছোঁয়ার নেই। তবে?ছোঁয়া কৌতূহল নিয়ে ফোন উঠাল। ওপাশ থেকে রাশভারী কন্ঠে প্রশ্ন এলো,

‘ হঠাৎ যদি সূদুর অতীত থেকে উঠে আসা কোনো দৈত্য আপনাকে জিগ্যেস করে, হোয়াট ইজ ইউর উইশেস? তাহলে আপনার উত্তর কী হবে?’
হঠাৎ এমন প্রশ্নে ভরকে গেল ছোঁয়া। ভয়ানক বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল। বোকা বোকা কন্ঠে বলল,
‘ অতীত তো অতীতই। অতীত থেকে দৈত্য কি করে আসবে?’
‘ দৈত্যের নিজস্ব টাইম মেশিন থাকতে পারে। সে আলোর বেগে ছুটে আপনার কাছে চলে আসতেই পারে। দৈত্যদের অনেক ক্ষমতা জানেন না?’
ছোঁয়া বেশ ভাবনায় পড়ল। কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
‘ কিন্তু তাত্ত্বিকভাবেও তো অতীতে আসা সম্ভব নয়। প্রকৃতি তা মেনে নিবে না।’
‘ বাহ! এই বিষয়ে পড়েছেন তাহলে? কিন্তু দৈত্য তো অতীতে যাচ্ছে না। সে আসছে ভবিষ্যতে। তার জন্য আপনি তার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য। আলোর গতিতে ছুটতে পারলে ভবিষ্যতে আসা তো অসম্ভব কিছু নয়। তাই না?’
ছোঁয়া ফোনের এপাশেই মাথা নাড়ল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ভীষণ বুদ্ধিমতির মতো বলল,
‘ ভবিষ্যতে যাওয়া সম্ভব হলেও দৈত্যের আসার সম্ভবনা নেই। প্রথমত, অতীতের পৃথিবী প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। সেখানে কোনো টাইম মেশিন নেই। দ্বিতীয়ত, দৈত্য বলে কোনো বস্তু পৃথিবীতেই নেই।’

‘ কে বলল নেই?’
ছোঁয়া অবাক হয়ে বলল,
‘ আছে নাকি?’
‘ থাকতেই পারে। পৃথিবী হলো একটা রহস্য পিন্ড। যার অনেক রহস্যই অমীমাংসিত হয়ে বসে আছে নাকের ডগায়। যেমন ধরুন বাল্ট্রা দ্বীপ। দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডরের কাছাকাছি গ্যালাপাগোস নামে একটি দ্বীপপুঞ্জ আছে। নাম শুনেছেন কখনও?’
ছোঁয়া অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ উহু।’
‘ না শুনলেও সমস্যা নেই। এখন শুনুন। সেই গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপের নাম হলো বাল্ট্রা। বাল্ট্রা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল হওয়ায় এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানেন?’
ছোঁয়া কৌতূহল নিয়ে বলল,
‘ কি?’

‘ এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হলেও বৃষ্টির একটি ফোঁটাও বাল্ট্রা দ্বীপে পড়ে না।’
ছোঁয়া অবাক হয়ে বলল,
‘ মাই গড! ইজ ইট পসিবল?’
‘ অবশ্যই। সম্ভব না হলে তো এমনটা ঘটতো না। শুধু তাই নয় এই দ্বীপে থাকার সময় কম্পাস অস্বাভাবিকভাবে স্থির হয়ে থাকে অথবা ভুল দিক প্রদর্শন করে। এই দ্বীপ অতিক্রমকালে প্লেনেও ঠিক একই সমস্যা দেখা দেয়। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এই দ্বীপে পা রাখার সাথে সাথেই কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এখানে গাছ কিংবা পশুপাখি নেই। উড়ন্ত পাখিরা উড়ে বাল্ট্রার কাছাকাছি এসে আবার ফিরে যায়। যেন কোন অদৃশ্য দেয়ালে বাঁধা পড়ে। অনেকে মনে করেন এই দ্বীপে অস্বাভাবিক কোন শক্তির অস্তিত্ব রয়েছে। হু নোস? এটা কোনো দৈত্যদের রাজ্য। অদৃশ্য দৈত্য।’
ছোঁয়া আকাশসম বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ এমন দ্বীপ সত্যি আছে?’
‘ অবশ্যই। আমি নিশ্চয় আপনার সাথে মজা করছি না। এবার উত্তরটা দিন। দৈত্যের প্রশ্নের উত্তরে কি জবাব দিবেন আপনি? কি চাইবেন?’
ছোঁয়া অনেকটা সহজ হয়ে এলো এবার। পানসে ভাবটা মিলিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল,
‘ ইচ্ছেগুলো ঠিক বলতে পারছি না। আমি কোনো ইচ্ছে খুঁজেই পাই না। তবে একটা উইশ অবশ্যই করব।’
‘ কি উইশ?’
‘ আমাকে যেন কক্ষনো এদেশ ছেড়ে যেতে না হয়। কিন্তু হচ্ছে। আমার তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।’
‘ বাহ! আপনি তো বেশ দেশপ্রেমিক টাইপের নারী।’
ছোঁয়া উত্তর দিল না। সাইমকে বলতে ইচ্ছে করল না, দেশ ছেড়ে না যাওয়ার ইচ্ছেটা তার দেশকে ভেবে নেওয়া নয়। অন্যকিছুর টানেই তার এই ঐচ্ছিক প্রকাশ।

‘ বাল্ট্রায় যাওয়া সম্ভব হলে আমি আপনাকে হানিমুনে বাল্ট্রা নিয়ে যেতাম ছোঁয়া। আপনি অবাক হয়ে দেখতেন, আকাশে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে অথচ সেই বৃষ্টি আপনাকে ছুঁতে পারছে না।’
সাইমের কথা বলার ভঙ্গি চমৎকার। প্রতিটি উচ্চারণ ছাড়া ছাড়া, সুন্দর। সেই সুন্দর উচ্চারণে বলা কথাগুলো ছোঁয়ার অনুভূতিশূণ্য মনে অনুভূতির সৃষ্টি করল। বন্ধুদের বাইরেও অন্যকারো কথায় প্রভাবিত হলো সে। আবদ্ধ মনে নতুন একটা ইচ্ছের সঞ্চার হলো, সত্যি যদি বাল্ট্রা যেতে পারত! সাইম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

‘ ছোঁয়া? আপনি কি জানেন? আপনি ম্যানিক ডিপ্রেসনে ভুগছেন। সহজ ভাষায় বলতে গেলে বাইপোলার ডিসওর্ডার। আপনি নিজেই সাইকোলজি স্টুডেন্ট। ইউ নো, হোয়াট ইজ বাইপোলার ডিসওর্ডার। দেখুন ছোঁয়া, কাল আমাদের বিয়ে অথচ আপনি আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আমার পুরো নাম জানেন কি-না তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমি কোন ভার্সিটিতে কর্মরত, কোন বিষয়ে অধ্যাপনা করছি, আমার পরিবারে কে কে আছে। কিচ্ছু জানেন না। কিন্তু কেন জানেন না? আপনার জীবন সঙ্গী হিসেবে এই ব্যাপারটা যেকারো জন্যই হতাশার। কিন্তু আমি হতাশ হইনি। গোটা একমাস আমি আপনাকে লক্ষ্য করেছি। আর তাতে যতটুকু বুঝেছি , আপনার আচরণ ইচ্ছেকৃত নয়। আপনি যে শুধু আমার প্রতিই উদাসীন তেমনও নয়। আপনি আপনার গোটা জীবনের প্রতিই উদাসীন। হয়তো আপনাকে ধীরে ধীরে উদাসীন করে দেওয়া হয়েছে। আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন ছোঁয়া?’

ছোঁয়া খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। এই প্রথম নিজের আচরণে অস্বাভাবিকতা আছে কি-না বুঝতে চেষ্টা করছিল। সাইমের প্রশ্নে সাড়া দিতেই আবারও বলতে শুরু করল সাইম,
‘ এভাবে জীবন চলে না ছোঁয়া। ইউ হ্যাভ টু গেট রিড ফ্রম হেয়ার। আপনি সব সময় কনফিউজড থাকেন। কালার কনফিউশান, ডিসিশন নিয়ে কনফিউশান এব্রিথিং। এর মূল কারণ হলো, আপনার নার্সিং। আমাদের বিয়ের পর এই কনফিউশান, উদাসীনতা, বিষন্নতাগুলো আপনাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। আমার সাথে কথা বলতে শিখতে হবে। যেমনটা আজ বললেন। তার আগে নিজের জন্য কথা বলতে শিখতে হবে। বিয়ের পর আপনার মায়ের কোনো ডিসিশন আমি এলাউ করব না। আপনার ব্যাপারে ডিসিশন হতে হবে আপনার। ভুল হোক বা সঠিক, ডিসিশন হবে আপনার। আপনি আপনার মাকে গিয়ে স্পষ্টভাবে বলবেন, তিনি যেন আপনার সাংসারিক সিদ্ধান্তগুলো আপনার উপর ছেড়ে দেয়। আই অ্যাম উইথ ইউ ছোঁয়া।’

ছোঁয়া উত্তর দিল না। সাইম খুব সাবধানে বলল,
‘ আপনার বন্ধুরা কিন্তু আমায় আশ্বাস দিয়েছিল যে, ইউ আর এবল টু গেট রিড ফ্রম হেয়ার।’
ছোঁয়া ভাবনাতীত বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ বন্ধুরা?’
সাইম হেসে বলল,
‘ নাদিম, রঞ্জন, নম্রতা! তবে কি তারা মিথ্যে বলেছিল? আপনি কথাগুলো মাকে বলতে পারবেন না?’
ছোঁয়ার ভীষণ কান্না পেয়ে গেল। এই প্রথমবারের মতো ভাবনা-চিন্তা না করেই বলে ফেলল,
‘ পারব।’
কথাটা বলে ফেলে উপলব্ধি করল ভীষণ শান্তি লাগছে তার। চারপাশের বিষন্নতা কেটে যাচ্ছে। জীবনের নিঃস্পৃহ ভাব কেটে গিয়ে টলমল জলে তরঙ্গ দিচ্ছে ঢেউ।বন্ধুদের অদৃশ্য মমতায় কেটে যাচ্ছে ভয়!

অচেনা নাম্বার থেকে কলটা আসতেই মেজাজ চটে গেল আরফানের। প্রথমবার কেটে দিতেই দ্বিতীয়বার বেজে উঠল ফোন। আরফান যার পর নাই বিরক্ত হয়ে ফোন তুলল। ভেতরটা রাগে রি রি করলেও ভদ্র কন্ঠে বলল,
‘ কান্নাকাটি বন্ধ করে সত্যি করে বলুন, আপনি কে? কি চান?’
ওপাশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে স্পষ্ট উত্তর,
‘ বললাম তো শ্যামলতা। শ্যামলতা কি চাইতে পারে জানো না? আর আপনি আপনি বলছ কেন? চিঠিতে তো আপনি করে বলতে না।’
আরফান নিজেকে সংযত করল। মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
‘ আচ্ছা। মানলাম আপনি শ্যামলতা। কিন্তু প্রমাণ কী?’
ওপাশের কন্ঠস্বরে বিস্ময় খেলে গেল,

‘ প্রমাণ? এখন আমায় প্রমাণ দিতে হবে? চিঠিতে তো খুব বলতে, তোমার নাকি আমার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনেও চিনে ফেলার ক্ষমতা আছে। অথচ আজ প্রমাণ চাইছ? আচ্ছা! বিয়ে টিয়ে করে ফেলেছ নাকি? সুন্দরী বউ পেয়ে আমার আবেগ কেটে গিয়েছে? স্বার্থপর!’
আরফানের বিরক্তি এবার আকাশ ছুঁলো। এক চড়ে মেয়েটার গাল ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ শ্যামলতা আপনার মতো বেহায়া নয়। শ্যামলতা আমার সাথেই আছে।’
‘ ভালোবাসলে সবাই বেহায়া হয়। তুমি ভালোবাসোনি বলে বেহায়া হতে পারোনি। তোমার সাথে যে আছে সেই তোমার শ্যামলতা তার কি প্রমাণ আছে?’

আরফান উত্তর দিল না। ফোনটা বন্ধ করে টেবিলের উপর রাখল। মাথায় হাজারও চিন্তা নিয়ে গা এলিয়ে দিল চেয়ারে। অনেকগুলো ছেঁড়া সুতো জুড়ো লাগানোর চেষ্টা চালাল একের পর এক। নার্সের ডাকে ভাবনা কাটলেও চিন্তা গেল না। কপাল কুঁচকে বিরক্ত চোখে চেয়ে রইল নার্সের মুখে। রাউন্ড, ক্লাস কোনো কিছুতেই ঠিকঠাক মনোযোগ দেওয়া গেল না। অল্পতেই মেজাজ খারাপ হতে লাগল। ক্ষণে ক্ষণেই শিরশির করে উঠল হাত। এই মেজাজ খারাপ নিয়ে নম্রতাকে অযথা কল করে মেয়েটার মন খারাপ করিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে আরফানের হলো না। তাই অবসর পেয়েও কল করা হয়ে উঠল না। পুরোটা দুপুর কাটল বিষন্নতা আর উদ্বিগ্নতায়।

ধানমন্ডির হোয়াইট হল কমিউনিটি সেন্টারের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে নাদিম। গায়ে নীল পাঞ্জাবি। পিঠে ঝুলানো গিটার। মাথাভর্তি চুলগুলো স্বভাববতই এলোমেলো, অগোছালো। স্টেজে বর-কনের ফটোসেশান চলছে। অন্তু,নীরা, নম্রতা কিছু দূরেই বসে আড্ডা দিচ্ছে। পরিবেশটা উত্তেজিত করে তুলতে কাছেই কোথাও হাই বিটের ইংরেজি গান বাজছে,
‘ It’s a beautiful night, we’re looking for something dumb to do…
Hey baby, I think I wanna marry you
Is it the look in your eyes or is it this dancing juice?
Who cares, baby, I think I wanna marry you…. ‘

নাদিম বিরস ভঙ্গিতে ওয়াশরুম খুঁজতে লাগল। খাওয়া বেশী হয়ে গিয়েছে। পেটে কেমন গুরগুর শব্দ করছে। বিরাট আপদ! এই সিঁথি বেগম শত্রুতা করে খাবারে উনিশ-বিশ মিশিয়ে দিয়েছে কি-না তা নিয়েও বিরাট সন্দেহ হচ্ছে। ইংরেজি গানের শব্দটাও বড্ড কানে লাগছে। নাদিম হাঁটতে হাঁটতেই বিশ্রী একটা গালি দিয়ে ফেলল। বিয়েতে যদি ইংরেজি গানই বাজাতে হয় তো ব্রিটেনে গিয়ে বাজা, এখানে কি? শালা, রাজাকারের বংশধর! নাদিমের বিগড়ে যাওয়া মেজাজের মাঝেই ফোন দিল আরফান। আরফানের ফোন পেয়ে অতিরিক্ত বিস্ময়ে বোবা বনে গেল নাদিম। ফোন নিয়ে গান-বাজনা থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াতেই আরফান বলল,
‘ এই অসময়ে তোমাকে ডিস্টার্ব করার জন্য সরি, নাদিম।’
নাদিম হেসে বলল,

‘ না ভাই। বেকার মানুষের আবার ডিস্টার্ভেন্স কি? হঠাৎ ফোন ক্যান ভাই? কোনো সমস্যা?’
আরফান কিছুটা ইতস্তত করে বলল,
‘ নম্রতাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। অনেকবার ফোন দিলাম, ফোন তুলল না। ডেইট খেয়াল হতেই মনে পড়ল, আজ ছোঁয়ার বিয়ে। নম্রতা কি তোমাদের সাথেই আছে?’
‘ হ। আমাগো সঙ্গেই আছে। ও তো ফোন বাসায় রাইখা আসছে বলল। ওরে ফোন দিতাম ভাই?’
‘ না না। ঠিক আছে। ইঞ্জয় করুক। নিদ্রার কাছে শুনলাম, ও নাকি অসুস্থ ছিল। একটু খেয়াল রেখো।’
নাদিম ভ্রু কুঁচকাল। ডানদিকে ঝুঁকে নম্রতাকে দেখার চেষ্টা করল। নম্রতাকে কোনোভাবেই অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে। বেশ তো খিলখিল করে হাসছে। নাদিম বিরবির করে বলল, শালার মাইয়া! পোলাডারে সাদাসিদা পাইয়া একদম ভাজা ভাজা করে ফেলল। আরফান সতর্ক কন্ঠে বলল,

‘ কিছু বললে?’
নাদিম অপ্রস্তুত হেসে বলল,
‘ না ভাই। আপনি চিন্তা কইরেন না। আমরা আছি, সমস্যা নাই। আপনার প্রিয়তমা একদম ফিট থাকবে। ফাডা ফাডির কোনো চান্স নাই। আমরা এমনিতেও তাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসব।’
নাদিমের কথার ধরনে হেসে ফেলল আরফান। ওয়াশরুম থেকে ফিরে বন্ধুদের পাশে বসতেই নীরা অন্তুর ব্যাপারটা চোখে পড়ে গেল তার। নাদিম মৃদু হাসল। নাদিমের হাসি খেয়াল করেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল অন্তু। ফিসফিস করে বলল,

‘ হাসছিস কেন?’
নাদিমের হাসি বিস্তৃত হলো। অন্তুর দিকে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ বন্ধু!’
অন্তু কেশে উঠে বলল,
‘ তোর এমন হাসি দেখলে আমার হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। উল্টাপাল্টা কিছু বলবি তো খবর আছে। তোর এই বাজে স্বভাবটা পরিবর্তন কর।’
নাদিম শব্দ করে হাসল। গিটারে সুর তুলে দুষ্ট কন্ঠে গাইল,
‘ আমার এই বাজে স্বভাব কোনোদিন যাবে না,
আমার এই বাজে স্বভাব কোনোদিন যাবে না।’
দুই লাইন গেয়ে বন্ধুদের দিকে তাকাল। গিটারের সুর তীক্ষ্ণ করে ফিচেল হেসে বলল,
‘ সিঁথি আপাকে শান্তিতে থাকতে দিতে ইচ্ছে করছে না।’
নীরা-নম্রতা দাঁত বের করে হাসল। নাদিম গলা ছেড়ে গান ধরল। অন্তু টেবিলে সুর তুলল। নাদিম কিছুদূর গাইতেই গেয়ে উঠল আরও তিনটি কন্ঠস্বর। চারটি কন্ঠেই ফুটে উঠল রাজ্যের উচ্ছ্বাস। আশেপাশের গান বাজনা থেমে গেল। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ নিভে গেল। হঠাৎ এই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল এই অর্ধ পরিচিত চারজন,

‘কথা হবে দেখা হবে, প্রেমে প্রেমে মেলা হবে
কাছে আসা আসি আর হবে না।
চোখে চোখে কথা হবে, ঠোঁটে ঠোঁটে নাড়া দেবে
ভালবাসা-বাসি আর হবে না।
শত রাত জাগা হবে, থালে ভাত জমা রবে
খাওয়া দাওয়া কিছু মজা হবে না।
হুট করে ফিরে এসে, লুট করে নিয়ে যাবে
এই মন ভেঙে যাবে জানো না।
আমার এই বাজে স্বভাব, কোনোদিন যাবেনা
আমার এই বাজে স্বভাব, কোনোদিন যাবেনা। ‘
গান গাওয়ার মাঝেই পাশের টেবিলে বসে থাকা সুন্দরী ললনাকে চোখ টিপে দিল নাদিম। মেয়েটির ড্যাবড্যাব চাহনী বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। সিঁথি হক প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে খেয়াল করলেন। তার মেয়ে স্টেজে ফটোসেশান ছেড়ে বন্ধুদের সাথে নাচছে। গলা মিলিয়ে গান গাইছে!
ভুলভাল ভালবাসি,
কান্নায় কাছে আসি
ঘৃণা হয়ে চলে যাই থাকি না
কথা বলি একা একা,
সেধে এসে খেয়ে ছ্যাঁকা
কেনো গাল দাও আবার বুঝি না…..

রাত দশটা কি সাড়ে দশটা বাজে। অন্ধকারে ঝলমল করছে বিভিন্ন রঙা আলো। কমিউনিটি সেন্টারের গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে বন্ধুরা। বিয়েতে এমন একটা স্ক্যান্ডেল করার পর সিঁথি হকের রাগের প্রতিরূপ কেমন হয়েছিল তা নিয়েই চলছে একের পর এক আলোচনা। এমন সময় ভীষণ অপ্রত্যাশিতভাবে সামনে এসে দাঁড়াল ছোঁয়া। নাদিম সবার সামনে থাকায় কি-না জানা নেই ছোঁয়া ছিঁটকে এসে পড়ল নাদিমের বুকে। নাদিম বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইল। ছোঁয়া ভীষণ বোকা বোকা কন্ঠে বলল,

‘ আমার খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মন খারাপ লাগছে। আই মিস ইউ অল।’
নাদিম অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ মিস করবি ভালা কথা। দূরে গিয়ে মিস কর। তোর অস্ট্রেলিয়ান গরু দেখলে আমারে তুলে আছাড় মারব। বউ ভাগিয়ে নেওয়ার অপবাদে হাজতে দিয়া দিব। ধরার হলে অন্তুরে গিয়ে ধর। আমারে ছাড় ইংরেজ।’
নম্রতা নাদিমের বাহুতে চড় বসিয়ে বলল,
‘ তোর সবসময় ফাজলামো। ছোঁয়া কাঁদছে।’
‘ আইচ্ছা যা ফাইজলামি করলাম না। ওরে এমনে ল্যাপ্টায় খাড়াই থাকতে দেখে ওর ম্যাঁ ম্যাঁ অর্থাৎ আমাগো সিঁথি আপায় আমারে চাবাইয়া খাইয়া ফেললে সব দোষ তোর।’

নীল চিরকুট পর্ব ৫৭+৫৮

পরমুহূর্তেই ডানহাতটা ছোঁয়ার মাথায় রেখে আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে ভীষণ নরম কন্ঠে বলল,
‘ কান্দিস না। দোয়া করে দিলাম, খুব জলদি বলদ থেকে গরু হয়ে যা। ইংরেজ বলদ থেকে ডিরেক্ট অস্ট্রেলিয়ান গরু। আমিন।’
নাদিম সিরিয়াস কিছু বলবে সেই আশায় চেয়ে থাকা বন্ধুরা এবার হেসে ফেলল। হেসে ফেলল বিষন্ন মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছোঁয়াও। নিজের মন বুঝতে ব্যর্থ এই মেয়েটা বিষণ্নতা নিয়েই পাড়ি জমাল অন্যের ঘরে। চোখগুলো টলমল করল। মন পুড়ল। বারবার পেছন ফিরে তাকাল। কোথায় একটা ফাঁকা থেকে গেল। কিছু একটা পাওয়া হলো না।

নীল চিরকুট পর্ব ৬১+৬২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here