নূরজাহানের সংসার গল্পের লিংক || শ্রীমতি প্রজ্ঞা মঞ্জরী

নূরজাহানের সংসার পর্ব ১
শ্রীমতি প্রজ্ঞা মঞ্জরী

” কংগ্রাচুলেশনস মিস্টার এন্ড মিসেস অর্ণব ইয়্যু আর গোয়িং টু বি প্যারেন্টস”
ডাক্তারের এহেন কথায় হতভম্ব হিয়ে গেল অর্ণব।
“আপনি শিওর ডক্টর?” ছল-ছল চোখে ডাক্তারকে প্রশ্ন করলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা রমণী। হাতে স্যালাইন ধরানো তার, চোখ মুখ শুকনো। তবে ঠোঁটে হাসির ঝিলিক বিদ্যমান।
“রিপোর্ট তো তা-ই বলছে। ” ঠোঁট প্রসারিত করে জবাব দিলেন ডাক্তার।
“মিস্টার অর্ণব আপনি আমার সাথে একটু চেম্বারে আসুন; আপনার ওয়াইফের প্রেজেন্ট কন্ডিশন নিয়ে কিছু কথা বলার আছে।” বলেই কেবিনের বাইরে চলে গেলেন ডাক্তার।

” এসব কিভাবে সম্ভব নূরজাহান?” তীঘ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নূরজাহানকে জিজ্ঞেস করে অর্ণব।
অর্ণবের এহেন প্রশ্নের জবাব খুঁজে পায়না নূর। কি আশ্চর্য লোকটার কি মতিভ্রম হলো? সে কি ভুলে গেছে সব?
“যেভাবে হওয়ার সেভাবেই হয়েছে।” ভাবলেশহীন জবাব নূরের।
অর্ণব আরো কিছু বলবে তার আগেই কেবিনের দরজার বাইরে থেকে ৩ বছর বয়সি বাচ্চার আওয়াজ ভেসে আসে। তার ছেলে অভ্র এসেছে তার দাদির সাথে।
কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলেন অর্ণবের মা মুমতাহিনা চৌধুরী।বয়স ৫৬ কোঠায় তবে চেহারার জৌলুস কোনো অংশেই কমেনি। অভ্রকে কোল থেকে নামিয়ে নূরের কাছে এলেন তিনি; বেডের পাশের স্টিলের টুল টায় বসে নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ” এখন কেমন লাগছে বউমা?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আগের থেকে একটু ভালো মা। তবে শরীরটা একটু দুর্বল লাগছে।” হালকা হেসে জবাব দিলো নূর।
“ডাক্তার কি বলেছেন অর্ণব?”ছেলের দিকে নজর ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মুমতাহিনা চৌধুরী।
থতমত খেয়ে যায় অর্ণব। আগে সে নূরজাহান এর থেকে এর জবাব চাইবে তারপর মায়ের কাছে বলবে নূরজাহানের প্রেগন্যান্সির কথা।
“ব্লাড প্রেশার লো আম্মা।ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া না করায় শরীরও দুর্বল। তাই মাথা ঘুরে পড়ে গেছে;এসিডিটিও আছে সাথে।” কথাটা বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল অর্ণব।
এদিকে অর্ণবের এমন মিথ্যে কথায় বোকা বনে গেল নূর। মায়ের কাছে মিথ্যে কেন বললো অর্ণব? সে কি বলবে শাশুড়িকে সত্যিটা?
নূরের এতোসব ভাবনার ছেদ ঘটলো গালে ছোট্ট এক নরম হাতের স্পর্শে। পাশে চোখ ফিরিয়ে অভ্র কে দেখেই নিজের কাছে টেনে নিলো নূর।

“তোমার হাতে খুব কষ্ট হচ্ছে মাম্মাম?” নূরের গালে হাত।বুলিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো অভ্র।
“না বাবা, একটুও কষ্ট হচ্ছেনা।তুমি এসে গেছো তো! ” বলেই অভ্রর দুই গালে চুমু খেলো নূর।
মায়ের আদর পেয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো বাচ্চা ছেলেটা। মুমতাহিনা চৌধুরী ও প্রাণভরে দেখলেন ছেলের বউ আর নাতিকে।
অন্যদিকে,
ডাক্তারের রুমে ঢুকেই ডাক্তারের সামনের চেয়ারে বসলো অর্ণব।
“আমার ওয়াইফ কি সত্যিই প্রেগন্যান্ট ডাক্তার?”
অর্ণবের এমন কথায় একটু বিরক্ত হলেন ডাক্তার ফারহান। এই নিয়ে কতোবার জিজ্ঞেস করলো একই কথা।
“হ্যাঁ, আপনার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট।”

“কিন্তু কিভাবে সম্ভব?” ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে অর্ণব।
“কেন সম্ভব নয়? আপনার ওইয়াফের বয়স এখন ২৪। এটা তার পারফেক্ট এইজ বাচ্চার জন্য। তবে হ্যাঁ ওনার কিছু হেলথ কমপ্লিকেসন আছে। টুইন প্রেগন্যান্সিতে যেটা নরমাল”
আরেক দফা অবাক হলো অর্ণব। টুইন প্রেগন্যান্সি!
“দেখুন, আপনার ওয়াইফের হিমোগ্লোবিন লেভেল কম।আয়রনের ও ঘাটতি আছে শরীরে। স্বাভাবিক প্রেগন্যান্সির তুলনায় টুইন প্রেগন্যান্সিতে ঝুঁকি বেশি এবং শরীরে পুষ্টির অভাব হলে বিষয়টা আরো চিন্তার। আপনার ওয়াইফের এখন মাত্র ওইয়ান মান্থ তাই মর্নিং সিকনেস, মাথা ঘোরা, বমি হওয়া এগুলো ছাড়া বিশেষ কোনো সমস্যা চোখে পড়বে না। তবে বেবিরা বড় হওয়ার সাথে সাথে ওনার শরীর দুর্বল হতে শুরু করবে, খাবারের অরুচি আসলে বিষয়টা আরো গুরুতর হবে।তাই ওনার প্রোপার কেয়ার নিন, হয়তো থার্ড বা ফোর্থ মান্থ থেকে ওনাকে রক্তের ইনজেকশন দিতে হতে পারে। এবং।ব্লাড ডোনারও ঠিক করে রাখবেন ইফ পসিবল।”
ডাক্তারের কথা মনযোগ দিয়ে শুনলো অর্ণব। অত:পর নূরের ফাইলগুলো নিয়ে আস্তে ডাক্তারের রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

“বাড়িতে গিয়েই আমার সব প্রশ্নের উত্তর চাই নূরজাহান।” বলেই নূরের কেবিনের দিকে হাঁটা দিলো অর্ণব।
রাত এখন ৯ টা ছুই ছুই। অভ্রকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছে অর্ণব; ছেলেটা জেদ করছিলো তাদের রুমে থাকার জন্য। তবে নূরের সাথে তার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি তার। তাই অভ্রকে ঘুম পাড়িয়ে মায়ের কাছে দিয়ে আসে অর্ণব।
খট করে দরজার ছিটকিনি লাগানোর আওয়াজে ফিরে তাকায় নূর। সে খাটের উপর আধশোয়া হয়ে বই পড়ছিলো। অর্ণবকে দেখে হাতের বইটা বেড সাইট টেবিলে রাখলো নূর; পূর্ণ দৃষ্টি দিলো অর্ণবের দিকে।
অর্ণব তার সামনে এসে দু’হাত বুকে ভাজ করে দাঁড়ায়।
“মা কে আপনি মিথ্যে বললেন কেন?”
কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করে নূর।
” আমার মিথ্যে কি তোমার আর তোমার পরিবারের ছলনার কাছে খুব বেশি হয়ে গেছে নূরজাহান? নিজের এতো প্রতারণার পরেও আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছো তুমি?” অর্ণবের এমন কথায় বোকা বনে গেলো নূর। সে প্রতারণা করেছে?

“প্রতারণা আপনি করেছেন অর্ণব, আপনার যে আমার আগে পাঁচ বছরের সংসার ছিলো এবং ৩ বছরের একটা বাচ্চাও আছে তা আপনি আমায় বলেছিলেন?”
মূহুর্তেই মস্তিস্কে আগুন জ্বলে ওঠে অর্ণবের। “আমি তোমাকে মিথ্যে বলিনি, তোমার মা সবই জানতো। এবং তিনি বলেছেন তুমি সব জেনেই আমাকে বিয়ে করেছো। এখন নিজের দোষটা ঢাকতে আমাকে একউস করা বন্ধ করো নূর।”
মূহুর্তেই তাজ্জব বনে যায় নূর। অর্ণবের সাথে তার সংসারের মেয়াদ ৫ মাস। এই ৫ মাসে অর্ণব একবারও তার সাথে এভাবে কথা বলেনি। এ বাড়িতে যেদিন নূর বিয়ে করে আসে, বাসর রাতে অর্ণব তাকে বলেছিলো তার এই সম্পর্ক মেনে নিতে সময় দরকার। এতে অবশ্য নূর খুশিই হয়েছিলো। নূরের বাবা মারা যাওয়ার পর নূর তার মা আর ভাইয়ের সাথেই থাকতো। হুট করেই একদিন অর্ণবদের বাড়ি থেকে প্রস্তাব এলে নূরের মা ভেবে চিন্তে রাজি হয়ে যান। নূর অবশ্য জানতো তার মা অনেক খোঁজ-খবর নিয়ে তারপর তাকে এ বাড়িতে বিয়ে দিয়েছে।

“কি হলো? মুখে কুলুপ এটে রেখেছো কেন? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নূরজাহান।” নূরের বাহু ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো অর্ণব।
“আমি বা আমার পরিবার কোনো প্রতারণা করিনি।”
নূরের কাটকাট জবাব।
নূরের এমন জবাবে ভীষণ রাগ হলো অর্ণবের। এক ঝাটকায় নূরের বাহু ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে।
“আমার কথা মন এবং মস্তিস্কে গেঁথে নেও নূরজাহান।এই বাড়িতে যদি থাকতে চাও তাহলে ওই বাচ্চা তোমায় অ্যাবরশন করাতে হবে ; আর যদি বাচ্চা রাখতে চাও তাহলে আমার বাড়ির দরজা খোলা আছে। বেরিয়ে যেতে পারো। কাল সকালের আগে তোমার উত্তর তৈরি রেখো।”
বলেই শব্দ করে দরজাটা খুলে সশব্দে বেড়িয়ে গেল অর্ণব।

নূর নিজের অবস্থানেই বসে আছে। অর্ণবের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো অশ্রুভরা চোখ নিয়ে।
” তোমায় তো আমি নিজের মায়ের মতোই ভালোবেসেছিলাম মামণি। সৎ মায়ের নজরে কখনোই দেখিনি। সেই তুমি কি না আমায় এভাবে ঠকালে?” বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নূর।
বাড়ির গ্যারেজ থেকে গাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার শব্দে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায় সে। অর্ণব বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে ; ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলো ৯ টা বেজে ২৫ মিনিট।
ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে আসে নূর। আধশোয়া হয়ে বসে নিজের জীবনের সমীকরণ মেলাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।

নূরের পুরো নাম নূরজাহান বিনতে সারোয়ার। নূরের বয়স যখন ছয় কি সাত তখন নূরের বাবা সারোয়ার ইকবালের সাথে নূরের মা সাবিলা সুলতানার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ওই বয়সের এক বাচ্চা যে বাবা মায়ের স্নেহময় ছায়াতলে বড় হয় ; সে সময়ে নূর পেয়েছে শুধু তার বাবা সারোয়ার ইকবালকে। নূরের মা ছিলেন ক্যারিয়ার ফ্রিক, মর্ডান থিংকিং এর মহিলা। সংসার-বাচ্চা এগুলোর জন্য তার ক্যারিয়ার নষ্ট হচ্ছে এমনি ধারণা ছিলো তার। নূরের জন্মের পরে সে অনেকটাই বেখেয়ালি ছিলো নূরের প্রতি;যা নূরের বাবা ভালো চোখে দেখননি। এসব নিয়ে প্রায়ই ঝামেলা হতো দু’জনের মাঝে। শেষে একদিন নূরের মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন;আর এক মাসের মাথায় ডিভোর্স নোটিশ পাঠালেন নূরের বাবাকে। নূরের বাবা সারোয়ার ইকবাল প্রচণ্ড ভালোবাসতেন নূরের মা সাবিলা সুলতানাকে। ডিভোর্স নোটিশ পেয়ে তিনি নূরকে নিয়ে ছুটলেন সাবিলার বাপের বাড়ি। গিয়ে প্রাণপণ বুঝালেন নূরের মা-কে। একটা ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড় হওয়া বাচ্চাদের জীবন অনেক কষ্টের হয় এই কথা সাবিলাকে হাজার চেষ্টায় ও বুঝাতে পারলেন না নূরের বাবা। সাবিলার উত্তর ছিলো এমন,” তুমি কখনোই একজন ভালো হাসবেন্ড হতে পারো নি ইকবাল। যদি পারতে তাহলে আমার উপর একটার বাচ্চার দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে না।আমি প্রস্তুত ছিলাম না বাচ্চার জন্য;এই বাচ্চাটা হওয়ার পর আমার কাজের উপর বাজে প্রভাব পড়েছে।”

“আমি হয়তো তোমার আইডিয়াল হাসবেন্ড হতে পারিনি সাবিলা কিন্তু আমি একজন আইডিয়াল বাবা হয়ে দেখাবো। নূরের জন্য আমি বেস্ট বাবা হবো।” শক্ত কণ্ঠে জবাব দিয়ে চলে যেতে নিলেন ইকবাল সাহেব।
“আমিও দেখবো ইকবাল তুমি কি করে আইডিয়াল ফাদার হও।” বলেই তাচ্ছিল্য ভরা হাসি দিলেন নূরের মা।
এরপরের তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। নূর সেই-ই শেষবার তার মা কে দেখেছিলো। নূরের মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে অন্য শহরে ট্রান্সফার নিলেন নূরের বাবা।বরিশালের একটা সরকারি কলেজের প্রফেসর ছিলেন তিনি।সেখান থেকে ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় আসেন তিনি। ওখানে থাকলে তার মেয়েকে লোকের বাঁকা কথা শুনতে হবে ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নেন নূরের বাবা।

নূরের বয়স যখন ১২ তখন নূরের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন রাহেলা জান্নাত কে। মেয়ের জন্য সারাজীবন একা থাকার সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন ভদ্রলোক কিন্তু শেষে নিজের শয্যাশায়ী মায়ের শেষ অনুরোধ রাখতে রাহেলাকে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের আগে নূরের থেকে অনুমতি নিতে গেলে নূর বলে, ” আব্বু আমি চাই তুমি বিয়েটা কর, আমার একজন মা দরকার আব্বু। সবার মা আছে স্কুলের,আমার নেই।”

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তখন বিয়েতে রাজি হন ইকবাল সাহেব। রাহেলাকে তিনি জানিয়েছিলেন তার ১২ বছরের এক মেয়ে আছে, এতে রাহেলা কোনো অভিযোগ আনেনি। কারণ তখন তার বয়স ছিলো ২৭,বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ২৭ বছরের মেয়ের বিয়ে না হওয়া বাবা মায়ের জন্য এবং ওই মেয়ের জন্য বেশ ভোগান্তির।
রাহেলা কখনো নূরের সাথে তথাকথিত সৎ মায়ের ন্যায় আচরণ করেন নি। তাকে যথেষ্ট আগলে রেখেছেন;এমনকি বিয়ের ১ বছরের মাথায় যখন তার নিজের সন্তান পৃথিবীতে এলো তখনো তিনি নূরের উপর।অবহেলা করেন নি।
নূরের বাবা হঠাৎ করেই স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেন। বাবার মৃত্যুর ৪ মাসের মাথায় অর্ণবের সাথে বিয়ে হয় নূরের। বিয়ের আগে যদিও অর্ণবের সাথে তার দেখা হয়নি;অর্ণবের মা দেখতে এসে আংটি পড়িয়ে যান নূরকে। তার ১সপ্তাহ পরেই ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হয় নূরজাহান বিনতে সারোয়ার এবং শাফিকুল চৌধুরী অর্ণবের।
বিয়ের তিনদিনের মাথায় নূর জানতে পারে তার স্বামীর প্রথম স্ত্রীর কথা। অর্ণবের প্রতিবেশিরা নূরকে দেখতে আসলে তাদের মধ্যেই একজন বলে ওঠেন, “অর্ণবের কপাল আছে ভাবী,আগের বউ তাহিরার থেকেও নতুন বউ মাশাল্লাহ সুন্দরী।”

তাদের কথায় নূরের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়,মাথায় ঘুরপাক খায় কথাগুলো। মেহমানরা বেরিয়ে গেলে অর্ণব রুমে প্রবেশ করে।
“আপনি বিবাহিত?”
নূরের প্রশ্নের ভ্রু কুচকে তাকায় অর্ণব।
“তিনদিন আগে তিন কবুল বলে তোমায় বিয়ে করলাম;তোমার যে ভুলে যাওয়ার রোগ আছে তোমার পরিবার তো বলেনি আমায়।”
অর্ণবের এমন উত্তরে রাগ হয় নূরের।
“আপনার প্রথম স্ত্রী কোথায়?”
“তিনি নেই;আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।” ভাবলেশহীন জবাব অর্ণবের।
অর্ণবের উত্তরে হতভম্ব হয় নূর। তারমানে ওনারা ঠিকই বলছিলেন!ওনার আমার আগেও একজন স্ত্রী ছিলো।
এরই মধ্যে অভ্রর আগমন ঘটে। বাবা বাবা বলে অর্ণবের কোলে ওঠে সে। আরেকদফা চমকায় নূর।
“আপনার ছেলে?”

“না,আমাদের ছেলে। অভ্র চৌধুরী।”
নূর এবার আর নিজেকে আটকাতে পারেনা। আলমারির পাশেই তার লাগেজ রাখা ছিলো, সেটা খুলে কয়েকটা কাপড় ভরে হনহনিয়ে চলে যায় বাড়ির বাইরে। একটা রিকশা নিয়ে বাবার বাসার ঠিকানায় চলে যায়।
অর্ণব হতভম্ব হয়ে দেখে নূরের কার্যকলাপ;সে ভাবতেও পারেনি নূর বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। সাথে সাথেই সে ফোন লাগায় নূরের মা রাহেলা জান্নাত-কে।
” আসসালামুআলাইকুম মা। আপনার মেয়ে কি আমার প্রথম স্ত্রী ও সন্তান সম্পর্কে জানে না?”
রাহেলা একটু ভয় পেলেন বোধহয়। সালামের উত্তর দিয়ে বলে উঠলেন, “কেন বাবা? নূর কিছু করেছে?”
“বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।” জবাব দিলো অর্ণব।
“আমি ও কে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠাচ্ছি বাবা।”
চিন্তিত স্বরে জবাব দিলেন রাহেলা।
“তার দরকার হবেনা। আমি আসছি একটু পরে।”

বলেই কল কেটে দিলো অর্ণব।
অভ্রকে তার দাদির কাছে রেখে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।
সন্ধ্যা ৭টা বাজে। নিজের ঘরে বসে চোখের পানি ফেলছিলো নূর।
বাড়ি এসে রাহেলার কাছে সব খুলে বলার পর রাহেলা নূরকে বোঝালেন,
“আমিও তোমার বাবার প্রথম স্ত্রী সাবিলার ফেলে যাওয়া সংসার করেছি নূর। আমি জানিনা তোমার বাবার স্ত্রী হিসেবে বা তোমার মা হিসেবে আমি কতটুকু নিজের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি;তবে তোমায় আমি মায়ের ছায়াতলে বড় করার চেষ্টা করেছি।”
নূর তখনো কেঁদেই চলেছে।
“যা হয়ে গেছে তার উপর হাত নেই আমাদের নূর।তুমি যদি ওই ৩ বছরের মাসুম বাচ্চাটাকে মায়ের স্নেহে বড় করতে পারো তাহলে একটা বাচ্চা সুস্থ সুন্দর জীবন পাবে।এখন সিদ্ধান্ত তোমার।” বলেই নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেছেন রাহেলা।

“কান্না বন্ধ করো নূরজাহান।বাড়ি চলো প্লিজ।” হঠাৎ অর্ণবের কণ্ঠে মুখ তুলে তাকায় নূর।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব। নূরের কাছে ধীর পায়ে এগিয়ে তার হাতটা ধরে অর্ণব।
“আমার আর অভ্রর জীবনের অপূর্ণতা গুলো পূরণ করবে নূরজাহান? ফিরিয়ে দিও না প্লিজ।”
নূর এবার শব্দ করে কেঁদে ফেললো। অর্ণব হেসে দুহাতে জড়িয়ে নিলো তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী কে।অর্ণবের পিঠের কাছে শার্ট টুকু আকড়ে ধরলো নূর; একটু পর আপনাআপনি কান্নার বেগ কমে এলো তার। হেচকি তুলে অর্ণবের থেকে একটু দূরে সরে এলো নূর। অর্ণব হাত দিয়ে গালে লেগে থাকা অশ্রুকণা টুকু মুছে দিলো।পাশে থাকা লাগেজটা এক হাতে ধরে অন্য হাতে নূরের বাহু আকড়ে ধরে ঘর থেকে বের হলো অর্ণব। রাহেলার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসালো নূরকে। নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে নূরের সিটবেল্টটা আটকে দিলো;নিজেও সিটবেল্টটা পড়ে নেয়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নূরের ডান হাতটা নিজের বা হাতের মুঠোয় পুরে ডান হাতে ড্রাইভিং করতে থাকে অর্ণব। পাশে বসে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে নূর।
সেদিনের পর অর্ণব ধীরে ধীরে নূরকে আপন করে নেয়।নূরও অভ্রর মা হয়ে ওঠে,হয়ে ওঠে অর্ণবের সহধর্মিণী।
বর্তমান,

ঘড়ির কাটায় সময় ভোর সাড়ে চারটা;নূর সারা রাত জেগে আছে।চোখের পাতায় ঘুম নেই;অর্ণবও বাড়ি ফেরেনি।
ধীর পায়ে বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে যায় নূর। ওযু করে এসে নামাজে দাঁড়ায়; ফজরের আজান হয়ে গেছে। নামাজ শেষ করে সৃষ্টিকর্তার দরবারে হাত তুলে অঝোরে কান্না করে সে। একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস গুছিয়ে নেয়।
খাতা আর পেন নিয়ে বাড়ি ছাড়ার আগে অর্ণবের জন্য শেষ বার্তা রেখে যায়,
প্রিয় অর্ণব,
আমি জানিনা আপনি কেন আমায় আমার সন্তান অ্যাবরশন করতে বলেছেন।তবে আমার পক্ষে এতো বড় পাপ করা সম্ভব নয়।আমি পারলাম না আপনার কথা মতো নিজের বাচ্চাকে হত্যা করে আপনার সংসারে থাকতে,তাই আপনার দেওয়া দ্বিতীয় অপশন টা মেনে নিয়ে চলে যাচ্ছি আমি।ভালো থাকবেন।
ইতি,
আপনার স্ত্রী নূরজাহান।

পেপার ওয়েট দিয়ে কাগজটা চাপা দিলো নূর,এরপর কাপড়ের ব্যাগ, নিজের ফোন আর প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট টা নিয়ে সন্তোর্পনে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে।
আশেপাশে ভোরের আলো এখনো ভালো করে ফুটেনি। নূর জানেনা তার গন্তব্য।বাবার বাড়ি সে যাবেনা;অর্ণবের বীষ ভরা কথার থেকেও তার মা জেনেশুনে তাকে এক বিবাহিত লোক যার একটা বাচ্চা আছে তার সাথে বিয়ে দিয়েছে ভেবেই কষ্টটা দ্বিগুণ হলো তার।

হাতে একটা ব্যাগ, পড়নে সাদা ঢিলেঢালা সালোয়ার কামিজ, ওড়নাটা মাথায় টেনে দেওয়া; আপনজনের কাছ থেকে আঘাত পাওয়া এক রমণী হেঁটে চলেছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্দেশ্য।

নূরজাহানের সংসার পর্ব ২