নূরজাহানের সংসার পর্ব ৪

নূরজাহানের সংসার পর্ব ৪
শ্রীমতি প্রজ্ঞা মঞ্জরী

“অর্ণব নূরকে ফরিয়ে আনো তুমি।তুমি না পারলে আমায় বলো,সে আমার কথা ফেলবে না।আমি বললে সে অবশ্যই আসবে। আমি বুঝাবো।” অর্ণবের দিকে তাকি বলে ওঠেন মুমতাহিনা।
“আম্মা,অভ্রকে নিন।আমি সত্যিই জানিনা আম্মা নূরজাহান কোথায় গেছে।আমি জানলে তাকে নিয়ে আসতাম আম্মা।” বলেই অভ্রকে তার দাদীর কোলে দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় অভ্র। রুমে এসে কাবার্ড খুলে নিজের টিশার্ট আর ট্রাউজার নেয়,ডানপাশে তাকাতেই কেমন খালি-খালি লাগে। এখানে নূরের কাপড় থাকতো, গত পাঁচমাসে এভাবে যায়গাটা ফাঁকা দেখে অভ্যস্ত নয় অর্ণব। আর সাত-পাঁচ না ভেবে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় অর্ণব।
খানিকক্ষণ বাদে ওয়াশরুম থেকে চিল্লিয়ে বলে ওঠে, “নুরজাহান আমার তোয়ালে টা দাও তো,ফেলে এসেছি।” কোনো উত্তর না পেয়ে আবারো একই কথা বলে ওঠে অর্ণব।হঠাৎ মস্তিষ্ক মহাশয় জানান দেন যে নূরজাহান নেই। নূরজাহান চলে গেছে অর্ণবকে রেখে।

অন্যদিকে,
স্নেহা নূরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে।কলিংবেল বাজিয়েছে দুইবার কিন্তু এখনো কেউ দরজা খোলেনি। স্নেহা বিরক্তি হয়ে নিজের মা-কে কল করবে এমন সময় স্নেহার ছোট ভাই সোহেল এসে দরজা খোলে।
“এই বাটুল,কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি? কি করিস ঘরে বসে?” সোহেলের পেটে খোঁচা মেরে বলে ওঠে স্নেহা।
“ধুর আপু,সবসময় খোঁচাতে থাকবেনা তো ভালোলাগেনা। ” বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে সোহেল।
“যাহ,খোঁচালাম না তোকে। নিচে গেটের সামনে দেখ আমাদের দু’জনের ব্যাগ রাখা জলদি করে নিয়ে আয়। তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি। দ্রুত ব্যাগ আনতে দ্রুত পাবি।”
উপহারের কথা শুনে দৌঁড় দেয় সোহেল।স্নেহা নূরকে নিয়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। মারজানা খাতুন তখন ডাইনিং এ বসে কলমি শাক বাছছিলেন। স্নেহা গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। মারজানা খাতুন চমকে ওঠেন।মেয়েকে দেখে খুশি হন ভীষণ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তুই তা দুইদিন পর আসতে চাইলি?”
“আজ ই আসলাম মা। ভাবলাম ছুটি যখন পেয়েছি চলেই আসি। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“কি সারপ্রাইজ?” স্নেহার কথার উত্তরে বলে ওঠেন মারজানা।
“ওই দেখ, তোমার ইকবাল ভাইয়ের মেয়ে।নূর;নূরজাহান। ” মারজানা তাকালেন নূরের দিকে।খুশিতে চোখজোড়া চকচক করে উঠলো তার।নূরের কাছে গিয়ে সন্তোর্পনে জড়িয়ে ধরলেন নূরকে।
“কতো বড় হয়ে গেছিস মা!সেই তোর ছয় বছর বয়সের সময় ভাইজান বরিশাল ছাড়লেন।আর এসেছিলেন মামি মানে তোর দাদির মৃত্যুর সময়ে। কিন্তু তোর ফুফাজান অসুস্থ থাকায় আমি যেতে পারিনি। কত বছর পরে তোর সাথে দেখা।”

কিছুটা বিরতি নিয়ে মারজানা খাতুন আবার বলে ওঠেন,
“একা এসেছিস? ভাইজান আসেনি?”
বাবার কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল নূরের।
“বাবা নেই ফুপ্পি। ৯মাস আগেই বাবা চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে।”
মারজানা যেন ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে আকাশ থেকে পড়লেন।চোখজোড়া জলে টইটুম্বুর হয়ে গেল। নূরের বাবা ছিলেন তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। নূরের দাদা যখন মারা যান তখন নূরের বাবা বয়স দশ কি বারো। এরপর নূরের দাদী মারা যান যখন নূরের বাবা রাহেলাকে দ্বিতীয় বিবাহ করেন তখন।তিনি মারা যাওয়ার পর আর কেউ ছিলোনা গ্রামে,যারা নূরের বাবার খোঁজ নিবে। ফলে দীর্ঘ বারো বছর তিনি আর গ্রামের মাটিতে পা রাখেননি।নূরের বাবা মারা গেলে তাকে ঢাকাতেই কবরস্থ করা হয়।

“ঘরে যা মা।কতো দূর থেকে এসেছিস। ফ্রেশ হ,আমি তোদের খাবার দিচ্ছি। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে একদম।”
নূরের হাত ধরে বলে ওঠেন মারজানা।
সোহেল স্নেহা আর নূরের ব্যাগ নিয়ে উপরে আসলে ;স্নেহা নূরের ব্যাগ নিজের রুমে নিয়ে যায়।নূরও পিছন পিছন যায়। স্নেহার রুমে যেতেই স্নেহা নূরকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দেয়। নূর নিজের ব্যাগ থেকে একসেট কাপড় বের করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।

প্রায় আধা ঘন্টা লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হয় অর্ণব। শরীরটা খুবই ক্লান্ত,কিন্তু ঘুম আসছেনা চোখে। নূরকে খুঁজে বের করা খুবই জরুরী তার জন্য। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট, কোথায় কোথায় ঘুরে বেরাচ্ছে কে জানে! এতো কিছু ভাবনার মাঝে অর্ণব নিজের ল্যাপটপ টা অন করে। সাতদিনের একটা লিভ এপ্লিকেশন লিখে অফিসের হেড অফিসে মেইল করে দেয়। রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং এ বসে মুমতাহিনা চৌধুরীকে ডাকে অর্ণব।
অভ্রকে অনেক কষ্টে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছেন মুমতাহিনা। অর্ণবের ডাকে ডাইনিং এ আসেন তিনি।
“আম্মা খেতে দিন,অনেক ক্ষুধা পেয়েছে।” মাথা নিচু করে বলে অর্ণব।
মুমতাহিনা ফ্রেঞ্চ টোস্ট,অরেঞ্জ জুস,সেদ্ধ ডিম, আর বাটার রাখে অর্ণবের সামনে। অভ্রকে সামলাতে গিয়ে নাস্তা টা বানাতে পারেননি তিনি। এসব খাবার দেখে অভ্র ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়ে। নূর প্রতিদিন সকালে পরোটা,ডিম ভাজি,পাঁচ-মেশালি তরকারি বা অন্য যে কোনো আইটেম বানিয়ে ডাইনিং সাজিয়ে রাখতো।আজ এই শুকনো টোস্ট দিয়েই ক্ষুধা নিবারণ করতে হবে অর্ণবের।

“অর্ণব?”
মুমতাহিনার ডাকে মাথা তুলে তাকালো অর্ণব। হালকা স্বরে উত্তর করলো, “জ্বী আম্মা?”
“আমায় বলো তোমাদের মাঝে কি হয়েছে? নূর কোথায় গেছে? কি এমন মনমালিন্য হলো?”
“আম্মা,আমি নূরের বাবার বাড়ি গিয়েছিলাম।নূর যায়নি ওখানে।অনেকবার ফোনে ট্রাই করেছি আম্মা,ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে।” ঠাণ্ডা স্বরে বলে ওঠে অর্ণব।
“বেয়ান কি বললেন? নূর তার সাথে যোগাযোগ করেছে?”
“উনিও কিছু জানেন না আম্মা। আপনি চিন্তা করবেন না,আমি নূরকে খুঁজে আনবোই।” বলে কোনো রকম খেয়ে উঠে গেলো অর্ণব। রুমে গিয়ে তার বন্ধু তাসিন কে কল করলো। তাসিন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে আছে। নূরের ফোনের লাস্ট লোকেশন ট্রাক করা গেলে তাকে খুঁজে বের করা যাবে।
কল রিসিভ হতেই অর্ণব বলে ওঠে,

“তাসিন?”
ওপাশ থেকে উত্তর আসে,”হ্যালো অর্ণব? কেমন আছিস?”
“চলছে, তুই ফ্রি আছিস? দেখা করতে পারবি?”
“হ্যাঁ পারবো। কখন দেখা করবি?”
“এখনি,আমি তোর বাসায় আসছি।” বলেই কল কেটে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে নেয় অর্ণব। গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
একবারে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয় নূর। শরীরটা আর সায় দিচ্ছেনা।এমন সময়ে এতক্ষণ না খেয়ে থেকে কাহিল হয়ে পড়েছে সে। চুলগুলো গামছা দিয়ে মুছে ভিজে গামছা টা বারান্দায় নেড়ে দেয় নূর। মারজানা খেতে ডাকছিলেন স্নেহা আর নূরকে।

নূর নিজের ব্যাগ থেকে মারজানার জন্য তার বাবার রেখে যাওয়া চিঠিটা বের করে হাতে নেয়। এরপর রুম থেকে বেরিয়ে এসে ডাইনিং এ যায়। মারজানা টেবিলে খাবার গুছিয়ে রেখেছেন ইতমধ্যেই। নূরকে দেখে তিনি চেয়ার এগিয়ে বসতে বললেন।নূর বসতেই প্লেটে খাবার সাজিয়ে দিলেন মারজানা। স্নেহা আসতেই নূরও আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলো। খাবার শেষে মারজানাকে চিঠিটা দিলো নূর।
“বাবা আপনাকে দিতে বলেছিলেন চিঠিটা।”
মারজানা হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন। নূরকে স্নেহার সাথে রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বলে চিঠিটা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন।
নূরও বিনাবাক্য স্নেহার রুমে চলে গেল। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো নূর।

শান্ত নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে অর্ণব। সচরাচর স্মোক করতে দেখা যায়না অর্ণবকে। তব কাজের অনেক স্ট্রেস আর মানসিক চিন্তায় থাকলে সিগারেটে সুখটান দিয়ে সমস্যাগুলো ধোঁয়ার সাথে উঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে সে।
অদূরেই অর্ণবের গাড়ির ডিকির উপর পা তুলে বসে আছে তাসিন। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে দেখছে অর্ণবকে। অর্ণবের এমন এলোমেলো চেহারা দেখে তাসিন প্রথমেই আঁচ করতে পেরেছিলো কোনো না কোনো গণ্ডগোল আছেই;অর্ণবের থেকে সবটা শোনার পর আরো ভালো বিষয়টা নিশ্চিত হয়েছে তাসিন।
“ভাবী প্রেগন্যান্ট? তাও আবার টুইন প্রেগন্যান্সি?
অর্ণব ফিরে তাকায় না।ওভাবেই স্মোক করতে করতে উত্তর করে,
“ইয়াহ! ওয়ান মান্থ প্লাস।”

নূরজাহানের সংসার পর্ব ৩

“তোর সমস্যাটা কি অর্ণব? বাচ্চার কথা শুনে এতো রিয়েক্ট কেন করেছিস?”
অর্ণব সিগারেটের বাকি অংশটুকু ফেলে দেয়; পা দিয়ে পিষে সিগারেটটা নিভিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।
“নূরজাহান এর মা অর্থাৎ আমার শাশুড়ি বিয়ের আগে আমায় বলেছিলেন নূরের কোনোদিন বাচ্চা হবেনা। শারীরিক কোনো জটিলতার কারণে সে বাচ্চা জন্ম দিতে অক্ষম। আর বিয়েতে আমি মূলত সে কারণেই রাজি ছিলাম তাসিন।”

নূরজাহানের সংসার পর্ব ৫