নূরজাহানের সংসার পর্ব ৭

নূরজাহানের সংসার পর্ব ৭
শ্রীমতি প্রজ্ঞা মঞ্জরী

দুটো ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে মাঠের মাঝে খেলছে নূর। পড়নে নীল শিফন জর্জেট শাড়ি, হাতে নীল রেশমি।চুড়ি, কপালে ছোট্ট একটা টিপ। খোলা চুলগুলো বাতাসে খেলা করছে। বাচ্চা মেয়ে দু’টোর পড়নেও সাদা ফ্রক। কাঁধ ছুঁই-ছুঁই চুলগুলো দুই ঝুঁটি করে বেঁধে রাখা দু’জনেরই।
বাচ্চা মেয়ে দু’টো সবেই হাঁটতে শিখেছে। একটু হেঁটে আবার ধপাস করে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে।আবার উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে খেলছে।সামনের ছোট ছোট দাঁতগুলো দৃশ্যমান হয় হাসির তালে তালে।কি মিষ্টি দৃশ্য! হুট করেই নূর বলে ওঠে, “নূরানী, আস্তে মা।পড়ে যাচ্ছো বার বার। বোনকে দেখো কি সুন্দর হাঁটছে।”
মেয়েটা মায়ের কথা বুঝলো কিনে কে জানে? খিলখিলয়ে হেসে উঠলো সে। অর্ণব দূর থেকে দাঁড়িয়ে এই সুন্দর দৃশ্য অবলোকন করছিলো।মেয়েদের কোলে নেওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়াবে এমন সময় সামনের দৃশ্য দেখে পা জোড়া থেমে যায় অর্ণবের।

কোনো এক অচেনা পুরুষ এসে নূরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে।নূরও আহ্লাদে আটখানা হয়ে লোকটার হাত আঁকড়ে ধরে আছে। লোকটা নূরের গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে মেয়েদের কাছে গেলো। মেয়েরাও আধো আধো বুলিতে “পাপা পাপা” বলে ঝাঁপিয়ে পড়লো লোকটার কোলে। নূর দাঁড়িয়ে দেখছে বাবা আর মেয়েদের ভালোবাসা। হঠাৎ হাতে টান লাগতেই ফিরে তাকায় নূর। অর্ণবকে দেখে কপাল কুচকে বলে ওঠে, “আরে…কে আপনি? অসভ্যের মতো হাত ধরে টানছেন কেন?”
নূরের এহেন কথায় অর্ণবের হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে যায়।নূর এই সুযোগে হাতটা ছাড়িয়ে নিজের স্বামীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। লোকটা এক হাতে আগলে নেয় নূরকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“নূর,আমি অর্ণব;তোমার স্বামী।এই মেয়ে দুটো আমার মেয়ে নূর। আমি ওদের বাবা। তুমি আমায় চিনতে অস্বীকার করছো নূরজাহান?”
“আপনি আমার স্বামী? কোন স্বামী? যে সত্য মিথ্যার যাচাই না করেই আমায় দোষারোপ করেছে সেই স্বামী? যে নিজের সন্তানদের হ*ত্যা করতে বলেছে সেই স্বামী?”
নূরের কথায় অর্ণবের মনটা ভেঙ্গে কয়েক টুকরায় পরিণত হয়। সে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, “নূর… আমার নূরজাহান। ”
নূর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। অত:পর পাশের লোকটাকে দেখিয়ে বলে ওঠে,
“উনিই আমার স্বামী,আমার সন্তানদের বাবা।আমার আশ্রয়স্থল,আমার একমাত্র ভরসার স্থান;যাকে আমি অত্যন্ত ভালোবাসি এবং সম্মান করি।”

নূর অন্য কাউকে নিজের স্বামী বলছে,নিজের সন্তানদের পিতা বলছে। নূর নাকি তাকে ভালোবাসে! অর্ণবের পা দু’টো টলে উঠলো। আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে অর্ণব এবার কয়েক পা পিছিয়ে গেলো।
“আশা করি আপনি আপনার উত্তর পেয়ে গেছেন।এবার আমাকে আর বিরক্ত করবেন না মিস্টার অর্ণব।” বলেই একটা মেয়েকে কোলে নিলো নূর। নূরের হাসবেন্ড আরেকটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে উলটো দিকে ফিরে হাঁটা শুরু করলো।
অর্ণব ধপাস করে ঘাসের উপর বসে পড়লো।অশ্রু চোখে অস্পষ্টভাবে দেখছিলো নূরের চলে যাওয়ার দৃশ্য। নূর,নূরের স্বামী,সন্তান,নূরের সংসার যেখানে কোনো যায়গা নেই অর্ণবের। অর্ণব গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো।

এলার্মের শব্দে ধরফরিয়ে ঘুম থেকে উঠলো অর্ণব। এটা কি স্বপ্ন ছিলো? এতো বাজে স্বপ্ন ও হয়? তার নূর তাকে ছেড়ে অন্য কাউকে নিজের করে নিবে? অন্য কারো ঘরে হবে #নূরজাহানের_সংসার? অর্ণবের পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। ঘরে এসি চলছে তাও ঘামছে অর্ণব। নূরকে হারানো যে তার কাছে মৃত্যু-সমতুল্য তা আর অর্ণবের বুঝতে বাকি নেই।
অর্ণব বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ঘরে আসে। নিজেকে পরিপাটি করে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি ঘর থেকে। মুমতাহিনা চৌধুরীর ঘরে গিয়ে তার থেকে বিদায় নেয় অর্ণব। বের হওয়ার আগে বলে আসে,
“নিজের আর অভ্রর খেয়াল রাখবেন আম্মা। আমি নূরজাহানকে নিয়ে ফিরবো শীঘ্রই।”

নূরকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হয়েছে।শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ না হলেও মানসিক ভাবে একটু সুস্থ বলে চলে। মারজানার কাছে সব বলার পরে নিজেকে অনেকটাই হালকা লাগছে নূরের। স্নেহার রুমের খাটের উপর পা মেলে আধশোয়া হয়ে বসে ছিলো নূর। নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ফোনের চার্জ ফুরিয়ে বন্ধ হয়ে আছে। স্নেহার থেকে চার্জার নিয়ে ফোন চার্জে বসায় নূর। এমন সময় মারজানার আগমন ঘরে। নূরের জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছেন তিনি। কয়েক ধরনের ফল।
“নূর এদিকে আয়। নাস্তা করে নে।তারপর রেস্ট করবি।”
মারজানার কথায় আর টু-শব্দ না করে খেতে শুরু করে নূর। অর্ধেকটা খেয়ে বলে ওঠে, “আর পারবোনা ফুপ্পি।অনেকটা খেয়েছি।”

“অর্ধেক খেয়েছিস সবে।পুরোটা শেষ কর।”
“আর খেতে পারবোনা। দেখ, কেমন বমি বমি পাচ্ছে। জোর করে খেলে সব উগড়ে যাবে।”
নূরকে আর জোর করলেন না মারজানা। একটু সময় পর বলে উঠলেন, “অর্ণবের নাম্বার দে নূর।”
নূর চমকে উঠলো।”ওনার নাম্বার দিয়ে কি করবে ফুপ্পি?”
“দিতে বলেছি দিবি। আমার কথা আছ।”
“প্লিজ ফুপ্পি,আমি এখানে আছি ওনাকে জানিও না। উনি আবার আমায় অপমান করবেন।”
মারজানা হাত রাখলেন নূরের মাথায়। বললেন, “চিন্তা করিস না। আমি থাকতে কেউ তোকে কিচ্ছু বলবে না।কিন্তু আমার জানা দরকার কেন অর্ণব এমনটা করলো।”
নূর ভরসা পেলো। সে নিজের ফোনটা অন করে অর্ণবের নাম্বারটা বের করে দিলো মারজানাকে। মারজানা নাম্বারটা নিজের ফোনে সেভ করে নিলেন। নূরকে বিশ্রাম করতে বলে চলে গেলেন তিনি।
ডাইনিং এর উপর নূরের জন্য নিয়ে যাওয়া ফলের প্লেটটা রেখে মারজানা বলে উঠলেন, “এখানে রাহেলা কিছু একটা করেছেই। অর্ণবের সাথে আমায় কথা বলতে হবে। ভাইজান চিঠিতে যা লিখেছিলেন তা অর্ণবকে জানাতে হবে। নূরের সংসারটা নষ্ট হতে দিবোনা আমি।”

ঢাকা থেকে ফরিদপুরগামী বাসে বসে আছে অর্ণব আর তাসিন। একটু তাদের আগেই বাস ছেড়েছে। তাসিন ফোনে কিছু একটা করছিলো, হঠাৎ কন্ট্রোলরুম থেকে তার কলিগ মিরাজের কল আসে। তাসিন ফোন রিসিভ করতেই মিরাজ বলে ওঠে,
“তাসিন? দুপুরে যেই নাম্বারটা দিলি ওটা আবার এক্তিভেট করা হয়েছে। লোকেশন ফরিদপুরের ঝিলটুলিতে দেখাচ্ছে। আরেকটু অপেক্ষা করলেই এক্সাক লোকেশন রোড নাম্বার সহ আমি তোকে দিতে পারবো।”
“থ্যাংকস ম্যান। আমার ওয়াটসএপে ফুল লোকেশন সেন্ট করে দে তাহলে।” বলেই কল কাটে তাসিন।
অর্ণব উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাসিনের দিকে।
“ভাবীর লোকেশন ট্র‍্যাক করা গেছে।”
“কোথায় আছে নূর?কিভাবে জানলি?” প্রশ্ন করে অর্ণব।
“ফরিদপুরের ঝিলটুলিতে আছেন। আমার কলিগ ফুল লোকেশন পাঠাবে এখনি। যত সময় লাগবে ভেবেছিলাম; তার অর্ধেক সময়ের মধ্যে ভাবীকে খুঁজে পাবো আমরা।”
তাসিনের কথায় সন্তুষ্ট হয় অর্ণব। স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে মনে মনে বলে, “আমি আসছি নূরজাহান।”

মারজানা নিজের ফোন থেকে কল দেয় অর্ণবের নাম্বারে। রিং হয়ে গেলেও অর্ণব ফোন তুলছেনা দেখে আরো কয়েকবার কল দেন মারজানা। কিন্তু ফলাফল শূণ্য। মারজানা হতাশা ভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
সারা রুমে পায়চারি করছে নূর। মনটা অস্থির লাগছে তার কাছে। কিছু কি খারাপ হতে চলেছে? ফুপ্পি অর্ণবের নাম্বার নিয়ে গেলো।যদি অর্ণব এখানে চলে আসে? নূরকে যদি বাচ্চা এবরশন করতে জোর করে? না না সে কিছুতেই নিজের বাচ্চাদের নষ্ট করবেনা।প্রয়োজন হলে বাচ্চা হওয়ার পর সে অর্ণবকে ডিভোর্স দেবে। প্রেগন্যান্ট থাকা অবস্থায় ডিভোর্স কার্যকর হয়না। নিজের পেটে হাত রেখে নূর বলে ওঠে,
“মা তোদের কিছু হতে দেবেনা।তোদের বাবা যতই যা বলুক, আমি তোদের কষ্ট পেতে দিবো না কিছুতেই।”

রাত প্রায় দশটা। অর্ণব আর তাসিন ফরিদপুর বড় বাসস্টপেজ এ আছে। এখান থেকে অটো নিয়ে মিরাজের পাঠানো লোকেশনে যাবে তারা। অর্ণব পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করেই দেখে আননোন নাম্বার থেকে চারটা মিসড কল। ফোনটা সাইলেন্ট থাকার কারণে টের পায়নি অর্ণব। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কল হবে ভেবে আননোন নাম্বারটায় কল ব্যাক করে অর্ণব। কয়েকবার রিং হওয়ার পরেই ওপাশ থেকে ফোনটা রিসিভ করে মেয়েলি গলায় কেউ বলে ওঠে,
“হ্যালো অর্ণব?”
“জ্বী আমি অর্ণব।আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।”
“আমি সম্পর্কে তোমার ফুফু শাশুড়ি হই। তোমার সাথে নূরের ব্যাপারে একটু কথা বলার ছিলো।”
অর্ণব কিছুটা অবাক হয়। তার জানা মতে নূরের বাবার কোনো ভাই বা বোন নেই। তাহলে ইনি কে?
“আমি এখন একটা কাজে ফরিদপুর এসেছি;বাড়িতে যেয়ে আপনাকে আমি কল ব্যাক করি?”
অর্ণবের কথায় মারজানা যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে গেলেন।
“আমার বাসা ঝিলটুলিতে, তুমি এসো আমার বাসায়। বিষয়টা খুবই আর্জেন্ট।”
ঝিলটুলিতে বাসা শুনে অর্ণব ভাবে, তাসিন বলেছিলো নূরের লাস্ট লোকেশন ঝিলটুলিতে। তার মানে কি নূর ওনার বাসায় আছে?

কয়েকটা শুকনো ঢোক গেলে অর্ণব।অত:পর বলে ওঠে, “নূর আপনার বাসায় আছে?”
অর্ণবের হার্টবিট তুঙ্গে।সে সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে প্রার্থনা করছে ফোনের ওপাশ থেকে যেন উত্তর হ্যাঁ আসে।
“হ্যাঁ, নূর আমার বাসায় ই আছে।”
তৎক্ষণাৎ চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয় অর্ণব।তার বুকের ওপর থেকে যেন বড় কোনো পাথর নেমে গেছে। চোখ বন্ধ রেখেই বলে ওঠে, “লোকেশনটা বলুন, আমি আসছি।”
ওপাশ থেকে লোকেশন বলতেই অর্ণব ফোনটা কেটে দেয়।তাসিনকে বলে, “তোর ভাবী যার বাসায় আছে সে কল করেছিলো।নূরের লোকেশন কি *******?
তাসিন তৎক্ষণাৎ উত্তর করে, “হ্যাঁ এই লোকেশনই দিয়েছে মিরাজ।”
অর্ণব আর দেরি করে না।একটা অটো ঠিক করে তাসিনকে নিয়ে রওনা হয় মারজানার বাসার উদ্দেশ্যে।

অর্ণবের সাথে কথা শেষে ফোনটা খাটের পাশে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে আসেন মারজানা। স্নেহা আর নূর শুয়ে পড়েছে। জার্নি করে আসায় স্নেহার আজ তাড়াতাড়ি ঘুম এসেছে। মারজানা একবার স্নেহার রুমে উঁকি দিয়ে দেখলেন মেয়েরা কি করে। অত:পর নিজের রুমে যেয়ে খাটের উপর বসে রইলেন। যেকোনো সময় অর্ণব আসবে,নূরকে সামলাতে হবে তার। নূরের সাথে যে অন্যায় হয়েছে তাতে অর্ণব নিজেও ষড়যন্ত্রের শিকার।কোনো না কোনো সমস্যা আছেই;আর সমস্যার মূল হোতা হিসেবে রাহেলার দিকেই প্রথম সন্দেহের তীরটা যায়।

নূর শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলো।হঠাৎ পানি পিপাসা পেলে শোয়া থেকে উঠে বসে নূর।পাশের টেবিলে ওয়াটার বোতলটা ফাঁকা পড়ে আছে দেখে বোতলটা হাতে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে আসে সে।জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে কিছুটা পানি খেয়ে নেয়,ফাঁকা বোতলটা ভরে ঘরের দিকে রওনা হবে এমন সময় বাসার কলিংবেল বেজে ওঠে। আশে-পাশে কেউ নেই দেখে নিজেই দরজা খুলতে এগোয় নূর।
অন্যদিকে মারজানা ও কলিংবেলের শব্দে নিজের রুম থেকে বের হন;বেরিয়ে দেখেন নূর ইতমধ্যেই দরজার কাছে পৌঁছে গেছে।

নূরজাহানের সংসার পর্ব ৬

নূর দরজাটা খুলতেই সামনের লোকটাকে দেখে তার হাতটা আলগা হয়ে যায়। সদ্য পানি ভরে আনা বোতলটা মেঝেতে পড়ে যায় সশব্দে। সময়ের ব্যবধানেই নূর অবচেতন হয়ে পড়ে যেতে নিলে সামনে থাকা মানুষটা দু’হাতে আগলে নেয় নূরকে। নূরের মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রাখে। এরপর তাকে পাঁজাকোলে করে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে।

নূরজাহানের সংসার পর্ব ৮