নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১৭
সিনথিয়া
“কি চাই আপনার? কেনো বেঁধে রেখেছেন আমায় এখানে?”
আরশি তেজি কন্ঠে পশ্চিমা ভাষায় বললো কথাগুলো! নিটল চোখে আক্রোশের অমাবস্যা। কপালের ভাঁজে আকুতির ছিটেফোঁটা টুকু নেই!
অথচ কিশোরীর তর্জন গর্জনে হেলদোল হলো না লোকটার। উল্টে পিছন থেকে একটা চাপাতি বের করে ধীর পায়ে এগোলো আরশির দিকে।
ধারালো ইস্পাত মেয়েটার পেলব গাল ছুঁলো মুহূর্তেই। হৃদপিন্ড থমকালো ওর। স্কেলিটন মাস্কের ভিতরে থাকা পৈশাচিক মুখ ইংরেজিতে আওড়ালো,
“আমার শত্রুতা তো তোমার সাথে নয় ডার্লিং। তুমি তো শুধু একটা টোপ মাত্র। মূল শিকার তো করবো কিছুক্ষন পর!”
চাপাতির উপর লোকটার হাতের জোর বাড়লো। পাতলা চামড়া ভেদ করে ক্ষুরধার অংশটুকু লাগতেই ফিনকির মতো দেহতরলে রক্তিম হলো পান্ডুর কপোল।
চোখ খিঁচে, দাঁতে দাঁত পিষে আরশি সহ্য করলো যন্ত্রনাটুকু। কানে ভেসে এলো আবারো সেই বিদেশি বুলি,
“কষ্ট হচ্ছে? ব্যাথা লাগছে না খুব! আমারও লাগে জানো! যখন তোমাকে অন্য কারোর সাথে দেখি, তখন এই চাপাতির চাইতেও ধারালো কিছু একটা ছিন্ন বিন্ন করে দেয় আমার বুকের ভিতর!”
মাইনাসের নিচে তাপমাত্রায় ফ্যাকাশে হওয়া মুখটা সামনে তাকালো বিস্ময়সমেত। ক্রুর হাসলো অজ্ঞেয়! অন্য হাতে গাল চেপে ধরে বললো,
“বি মাইন…ডার্লিং! অনলি আই ক্যান সেইভ ইউ ফ্রম দিস সিচুয়েশন। বাট ইফ ডোন্ট, দ্যান…”
কথা শেষ হওয়ার আগেই মাস্কের উপর থুতু ছুড়লো আরশি। কঠোর কন্ঠে শুধোলো,
“দ্যান হোয়াট!”
চমকালো লোকটা। মিনিট খানেক থমকে দাঁড়িয়ে আঁকড়ে ধরা গাল সহ পুরো মাথাটা ঠুকে দিলো গাছের সাথে। হিসহিসিয়ে বললো,
“দ্যান ডাই!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চেলসির পাবলিক লাইব্রেরি থেকে শিফট শেষ করে মাত্র বের হলো জারা। ছাই রঙা আকাশের দিকে তাকিয়ে ছোট করে শ্বাস ফেললো ও। আয়ান গত রাতে আর বাসায় ফেরেনি। ফোনও ধরেনি জারার। জন্মদিনের সারপ্রাইজ দিয়ে সেই যে ফেরারি হয়েছেন অফিসার! এখন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ নেই!
তুষারপাতের পরিমাণ বেড়েছে। তাই আজ আগে ভাগেই বন্ধ করতে হয়েছে বইয়ের বেচা-কেনা। কর্মব্যস্ত মানুষেরা নীরে ফেরার তাড়ায়। বুটজুতো আর বাহারি ছাতার মেলায় কোলাহলপূর্ণ চেলসির সড়কপথ।
জারাও টোট ব্যাগ থেকে হলদে ছাতাটা বের করলো হাঁটতে হাঁটতে। কিন্তু হঠাৎই চোখ গেলো রাস্তার ওপর পাশে। বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আয়ান। পরনের কালো জ্যাকেটের কাঁধে বরফ জমেছে। হাত নেড়ে ইশারা করছে ওকে!
কিশোরীর বিমর্ষ মুখে হাসি ফুটলো অমনি। রাস্তা পার হয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মানুষটা বলে উঠলো,
“বাইকে ওঠো বাটারফ্লাই! আজকে একসাথে বাসায় ফিরবো! মানে যদি তোমার আপত্তি না থাকে–”
এমনিতেই আবহাওয়া খারাপ। তারউপর পায়ে হেঁটে এতোটা রাস্তা বাসায় ফেরা দুঃসাধ্য তো বটেই। কিন্তু পুলিশের বাইকে ফ্রী রাইড? জারাকে আর পায় কে? আয়ানের পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই দু চাকার গাড়িটায় উঠে বসলো সে।
ঠোঁট কামড়ে হাসলো অফিসার। চুলের বরফ ঝেড়ে এগিয়ে এসে বসলো জারার সামনে।
“আজকে সূর্য কোন দিকে উঠলো বলো তো বাটারফ্লাই?”
আয়ানের দুষ্টুমি ধরে ফেলতে সময় নিলো না কিশোরী। কড়া চোখে চাইতেই তড়িঘড়ি থ্রটলে হাত ঘোরালো অফিসার। খানিকবাদে পেছন থেকে প্রশ্ন ছুড়লো মেয়েটা,
“গতকাল রাতে এক্সাক্টলি কি হয়েছিল আপনাদের থানায়?”
“একটা সাইকোপ্যাথ চাপাতি দিয়ে জখম করেছে কয়েকজন অফিসারকে। লুট-ফুট কিছু না! যাওয়ার সময় আবার আমার রুমে ঢুকে টেবিলে চিরকুট রেখে গেছে! ‘উই উইল মিট সুন অফিসার আয়ান হান্টার!’”
আয়ান যতটা স্বাভাবিক ভাবে কথাগুলো বললো, ততটাই ঘাবড়ে গেলো জারা। অজানা আশঙ্কায় বুকটা ধরফর করলো ওর। কি সাংঘাতিক ঘটনা! অথচ এই মানুষটা এতো হাল্কাভাবে কি করে নিচ্ছে পুরো বিষয়টা, সেটাই মাথায় ঢুকছে না মেয়েটার!
“যে এই কাজগুলো তাকে ধরতে পেরেছন?”
“মুখটা দেখতে পারলে ধরে ফেলা যেতো বুঝলে! কিন্তু মুখটাই তো দেখতে পাইনি সিসিটিভি ফুটেজে! মাস্ক পড়ে ছিল হতচ্ছাড়া!”
“কেমন মাস্ক?”
কথাখানা শোনা মাত্রই আচমকা ব্রেক কষলো আয়ান। পেছন হতে পিঠের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো জারা। উঠে রাগ দেখানোর আগেই মানুষটা বললো,
“একটা স্কেলিটন মাস্ক! স্ট্রেঞ্জ তাই না? আমারও এটাই মনে হচ্ছে! নয়তো রাতের বেলা পুলিশ স্টেশনে এসে কোপস্ দের উপর চাপাতি দিয়ে হামলা? তারউপর পুলিশের টেবিলে চিরকুটে হুমকি লিখে রাখা? কোনো পাগল ছাড়া সুস্থ মানুষের পক্ষে এটা করা সম্ভব?”
ক্যানিয়নের দেয়াল জুড়ে আলো আঁধারের খেলা। সূর্য নেমে দিগন্ত ছুঁয়েছে মাত্র। নীরবতায় ঢাকা পড়েছে জঙ্গলের পথ সাথে বেড়েছে ঠান্ডার প্রকোপ।
ধীরে ধীরে আধবোজা চোখে তাকালো আরশি। মাস্ক পড়া লোকটা আশপাশে নেই দেখে বসা অবস্থায় থেকেই গাছের সাথে বাঁধা হাত আর পা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো ও। কিন্তু শরীর সায় দিলো না।
চোখের পানিতে মেয়েটার গাল ভিজলো । বেঁচে থাকার সমস্ত চেষ্টা নিস্তেজ হলো মূহুর্তেই! মন্থর হয়ে আসলো হৃদপিণ্ডের গতিও। শেষ নিশ্বাসটা ফেলার আগে একটা বার শেহজাদকে দেখতে পেলে কি খুব খারাপ হতো? ও তো সরিও বলতে পারলো না ওনার নাম্বার জাম্বুবান নামে সেভ করার জন্য!
তখনই ঝোপের ভেতর হতে দৌঁড়ে আসলো সকালের কটনটেইল রেবিটটা। মেয়েটার কাছে এসে দাঁড়ালো দু’পায়ে। পরপর হাতের দড়িটা কেঁটে লাগলো ধারালো দাঁত দিয়ে। আরশি বিস্মিত। অবাক চোখে তাকায় সেদিকে। হিম হওয়া ঠোঁট কেঁপে ওঠে সামান্য। কিছু বলতে চায় স্তিমিত কণ্ঠস্বর। তবে আজ যে সেটুকু শক্তিও নেই সেখানে।
হাতের দড়িটা কাঁটা হলে নিজেই পায়ের বাঁধন খুললো ও। হাইপোথার্মিয়া জেঁকে ধরার আগেই দেহের সবটুকু বল খাঁটিয়ে উঠে দাঁড়ালো। একবার যখন উপরওয়ালা একটা সুযোগ দিয়েছে বেঁচে ফেরার তখন আর এক মূহুর্তও এখানে নয়। খরগোশটার মাথায় হাত বুলিয়ে অবশ পা-টা কোনোমতে সামনে বাড়ালো আরশি।
তখনি শুনতে পায় কারো অট্টহাসি! ক্লান্ত চোখদুটো চকিত ফিরে চাইতেই পা জোড়া আপনাআপনি থেমে যায় ওর। বিমূঢ় চোখ জোড়া মূকবোনে দেখে স্কেলিটন মাস্ক পড়া সেই লোককে। খরগোশটাকে হাতে নিয়ে দুলে দুলে হাসছে সে!
“ডোন্ট… হার্ট হার!”
গলা ধরে আসে ওর। তবুও দাঁড়ায় শক্ত হয়ে।
“হোয়াই? ইজ দিস ইয়র ফ্রেন্ড?”
পশ্চিমা ভাষায় কথাটা জিজ্ঞেস করতেই ওপর নিচ মাথা নাড়লো আরশি। নিজের যা হোক, কিন্তু খরগোশটা যেনো বেঁচে থাকে!
কিছু একটা ভেবে এগিয়ে আসলো সেই লোক। কটনটেইল রেবিটটা ওর হাতে দিয়ে তাকালো কাঁটা গালের দিকে। শুকিয়ে যাওয়া রক্ত জমাট বেঁধেছে সেখানে। ইংরেজিতে বললো,
“ইশশ! কতটা কেঁটেছে দেখেছো! তাই বলছি আমি যা চাইছি তা মেনে নাও! চলো আমার সাথে!”
“ইন ইয়র ড্রিম ইউ ব্লাডি সাইকোপ্যাথ! —”
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১৬
পুরো কথা শেষ করতে পারলো না আরশি! তার আগেই ওর মুখ চেপে ধরলো মাস্ক পরিহিত লোকটা। টেনে হিঁচড়ে নিতে গেলেই কানে ভেসে আসলো পরিচিত সেই কন্ঠ! শেহজাদ ডাকছে ওকে,
“আরশিইইই!”