নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২
সিনথিয়া

চকিত চোখ মেলে চাইলো আরশি। আশেপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে খুঁজলো পরিচিত মুখটা। বুঝলো জাম্বুবান নয়, ও নিজে নিজেই বাথটাবে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এসব উল্টো-পাল্টা স্বপ্ন দেখছিল।
মূহুর্তেই রক্তিম হলো কপোল। গরম হয়ে যাওয়া গাল দুটোয় হাত দিয়ে নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ।
কিন্তু সেই স্বপ্ন ওর মাথা থেকে সরলে তো! ঘুরে ফিরে ঐ একি মানুষটা বারবার চলে আসছে ওর ভাবনায়।
এমনিতেই এই স্বপ্নের চক্করে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি গোসল শেষ করলো মেয়েটা।
বেরিয়ে এলো গাঢ় নীল রঙের সুন্দর একটা সুতির শাড়ি পড়ে।
নিজেকে বোঝালো-

“জাম্বুবানটার চোখের সাথে মিল রয়েছে বলে নয়, ছোট থেকেই এই রং টা আমার ভীষণ পছন্দের, তাই পড়েছি। হুহ!”
আরশি খাবার টেবিলে নিয়ে বসে রইলো প্রায় দু’ঘন্টা। মানুষটার আসার নাম-গন্ধ নেই।
মন খারাপ হলো মেয়েটার। কিন্তু যখনই ভাবলো উঠে যাবো, ঠিক তখনই বাসার সদর দরজাটা স্পেয়ার কি’ দিয়ে খুলে
ভিতরে ঢুকলো শায়ান শেহজাদ।
গম্ভীর মুখাবয়ব দেখেই যা বোঝার বুঝে ফেলল আরশি। এখন এখানে থাকা, আর জুরাসিক পার্কে পিকনিকে যাওয়া সমান। দু জায়গায়তেই জীবন সংকটের সমূহ সম্ভাবনা।
তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেঁটে পড়াই শ্রেয়।
“দাঁড়াও!”
বরাদ্দ করা রুমের দিকে
তরুণীর পা বাড়ানোর আগেই পিছন থেকে ডাক দিলো শেহজাদ।
শীতল কণ্ঠস্বরে আরশির পা থেমে গেলো সহসা।
কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, যে মানুষটা
কখনো হেসে দুটো কথা বলে না ওর সাথে, সে আজ নিজে থেকে ওকে ডাকলো?
খানিক লজ্জায়, খানিক ভয়ে জমে যাওয়া পা দুটো আহুতি দিলো ওর শেহজাদের সামনে থেকে ছু্টে পালানোর তীব্র ইচ্ছের কাছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরশিকে দাঁড়া করিয়ে শেহজাদ নিজেই এগিয়ে আসলো ওর সামনে। পরপর
বাজখাঁই এক ধমক দিয়ে বলল-
“তখন কেনো বললে না সত্যিটা আমাকে?
মেয়েগুলো তোমাকে “বুলি” করলো, আর অমনি তুমিও চুমু খেতে চলে গেলে? ওরা যদি আমার বদলে অন্য কাউকে চুমু খেতে বলতো! তখন কি করতে তুমি? চলে যেতে চুমু খেতে?”
দুই বছর! দুই বছর ওদের বিয়ের বয়স। আর ভিনদেশের মাটিতে এই মোটে দুই সপ্তাহের সংসার।
সেখানেই সারাজীবনের সবচেয়ে বড় ধমকটা হয়তো আজ খেলো আরশি।
মানলো ওদের দুজনের বাবা-মার জোরাজুরিতে বিয়েটা হওয়াতেই হয়তো শুরু থেকেই অসন্তুষ্ট ছিল মানুষটা।
তাই বলে,

বিয়ের সাথে সাথে লোকটা বউকে রেখে ফ্লাইট ধরে আমেরিকা চলে আসতে পারে?
যে কিনা এই দুই বছরে বউকে মানুষ বলেই মনে করলো না! কোনোদিন ভালো করে একটা কথা বললো না!
অথচ আরশিকে শেহজাদের বাবা-মা আমেরিকাতে নিয়ে আসার প্রথম দিনেই সে তার হুশিয়ারি বার্তা জারি করলো-
“যদি এখানে থাকতে হয় তাহলে আমার কিছু রুলস এন্ড রেগুলেশন মানতে হবে তোমাকে!
প্রথমত আমি আমার মতো থাকবো, আর তুমি তোমার মতো থাকবে! আমার জিনিস পত্রে হাত দেবে না, আমিও তোমার জিনিসপত্রে হাত দিবো না!
আর দ্বিতীয়ত, বউ হয়ে সং সেজে থাকার কোনো দরকার নেই! পড়াশুনো করতে এসেছো, মন দিয়ে শুধু ওটাই করবে!
আর সবথেকে ইম্পর্ট্যান্ট রুলস- সবসময় অন্তত তিন ফিটের দূরত্ব মেইনটেইন করে চলবে আমার থেকে! বুঝতে পেরেছো?”
কেন ভাই? তুই কি করোনার রোগী? যে তিন ফিটের ডিসট্যান্স মেইনটেইন করে চলতে হবে?
মনে মনেই ভেংচি কেঁটে ভেবেছিল আরশি!
আর আজ সেই এটিটিউডের বস্তা মিস্টার শায়ান শেহজাদ নিজে থেকে আরশির সাথে এতো গুলো কথা বলল?
ভালোবেসে বলল? অবশ্যই নয়! এই জাম্বুবানটা কি কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারে?
মনে মনে ভোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো আরশি। তারউপর কি করে বুঝাবে এই জাম্বুবানকে, যে পুরো ঘটনাটাতে ও শুধু বেকার বেকার ফেঁসে যাওয়া একটা নিরীহ বউ!

“আ’ম আস্কিং ইউ অ্যা ড্যাম কোয়শ্চন ইডিয়ট!! তুমি কি শুনতে পাওনি আমি কি বলেছি?”
শেহজাদের বকা খেয়ে সংবিৎ ফিরল আরশির। মনে মনে ভাবলো-
লোকটা কি চারজোড়া চোখ নিয়েও দেখতে পাচ্ছে না, যে ও কি চরম পর্যায়ের অনুতপ্ত?
তবুও এভাবে ধমকে যাচ্ছেন উনি?
তার অমন একেকটা বাজখাই ধমকে যেখানে
ওর রুহু আত্মা একটু পর পর
সফরে যাচ্ছে? সেখানে ও উত্তর কি করে দেবে?
আর ভয় পেলে আরশি ঠিকঠাক কিছু বলতে গেলেও গুলিয়ে ফেলে। এই যেমন শেহজাদের আরেকটা ধমকের ভয়ে হরবরিয়ে বলে উঠলো-

“আ-আমি আমার স্বামীকে কিস করতেই পারি, তাতে আপনার তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয় প্রফেসর!”
আরশি ভীষণ আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা গুলো বললেও ওর বুকটা বালু ঝড়ের কবলে পড়া তাবুর মতো কাঁপছে।
মিনিটে মিনিটে গলা শুকিয়ে হচ্ছে সাহারা মরুভূমি।
এতবড় একটা কথা এতো অবলীলায় বলে ফেলল ও?
আর স্বামী? যার চোখে চোখ রেখে আরশি এতোদিন একটা কথা বলতে পারেনি, সেই ডিপজল মার্কা লোকটাকে এতো সহজে স্বামী ডেকে ফেললো?
এতক্ষণের শক্ত করে রাখা মুখমন্ডল সহসাই বদলে গেলো শেহজাদের। যেখানে এখন স্থান পেয়েছে এক ফালি চৌকশ হাসি। অবশ্য সেটা আরশিকে লুকিয়ে। মেয়েটা যেভাবে মাথা নিচু রয়েছে! দেখবে কখন?
বুকে বেঁধে রাখা হাত নিচে নামিয়ে ধীর পায়ে আরশির কাছে আরেকটু এগিয়ে আসলো শেহজাদ। এতোটা কাছে এসে দাঁড়ালো যেনো দুই ইঞ্চি দূরত্ব রইলো না তাদের মধ্যে।
তিন ফিটের দূরত্ব তো দূরের কথা!
ক্ষনিকের স্বাভাবিকতাটুকু হারিয়ে আবারও মুখের আদল শক্ত হলো।
সাদা কাচের অন্তরালে থাকা চোখদুটো হাসছে, তবুও কন্ঠ গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করলো-
“তুমি তোমার… হাজবেন্ডকে কিস করেছিলে?”
বেখেয়ালে আরশি ওপর নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে ফেলেছিল প্রায়, বুঝতে পেরে তৎক্ষনাৎ আবার ঘনঘন দুপাশে মাথা নাড়লো!

চোখ দুটো টাইলসের মেঝেতে সুপার গ্লু দিয়ে আঁটকে রাখলো। ভুলেও মাথা তুলে তাকালো না শেহজাদের দিকে। একজনের সমু্দ্রের মতো দু’জোড়া নীল চোখে চোখ রেখে তাকানোর সাহস ওর নেই। আর থাকবেই বা কি করে? থাকার মতো আর কিছু বাকি রেখেছে সে?
তখনই মুখ খুলল শেহজাদ। স্বভাবসুলভ গুরুগম্ভীর কন্ঠে উপহাস মিশিয়ে বলল-
“ঠিকই তো! তুমি তোমার হাজবেন্ডকে কিস করতেই পারো! তোমার পুরো অধিকার আছে এটা করার!”
এই প্রথমবার আরশির মনে হলো যেনো ও চিৎকার করে বলতে চায়-
“হ্যাঁ ধরণি দ্বিধা হও! মাটি ফাঁক করো! আমি ঢুকে কিছুক্ষণ বসে থাকি তোমার ভিতর। দরকার পড়লে তোমাকে বখশিশ দিবো, তবুও আর লজ্জায় ফেলো না আমাকে এই জাম্বুবানের সামনে!”
ধরণি যদি কথা বলতে পারতো তাহলে সেও এতক্ষণে নির্ঘাত আরশির বাঁচানোর রিকোয়েস্ট রিমুভ করে দিয়ে বলতো-
“সরি ডিয়ার। তোমার জাম্বুবান তোমার থেকে দেখতে বেশি সুন্দর! তাই আমি ওর সাইডে।”
বলবে নাই বা কেনো? আমেরিকার মাটি কি না! সামনে দাঁড়ানো জাম্বুবানটার রূপে ওর সাথে সাথে ধরণিও যে কুপোকাত।
এসব ভেবে চকিত চোখ তুলে চাইল আরশি। নিজেকে বাঁচানোর ক্ষীণ প্রয়াসে জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল-
“আ-আমি আসলে ওভাবে বলতে চাইনি কথাটা বি-বিশ্বাস করুন!”
ভাবলো এই বুঝি ওর উপর একটু দয়া হলো বিদেশী জাম্বুবানটার। এই বুঝি শেষবারের মতোন বাঁচিয়ে নিলো ওকে। কিন্তু না!

প্যান্টের পকেট দুটোতে দুহাত ঢুকিয়ে আরামসে দাঁড়াল শেহজাদ। পরপর ঠোঁটে চৌকস হাসি টেনে বলল-
“ বউ যখন স্বামীকে চুমু খেতে পারবে? তাহলেও স্বামীও নিশ্চয়ই তার বউকে চুমু খেতে পারবে?”
থতমত খেলো আরশি। রক্তশূণ্য পেলব চেহারা মূহুর্তেই সঙ্কায় আরো ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। কিছু বলতে গিয়েও যেনো পারলো না। শুকনো মরুভূমির মতো শুকিয়ে কাঠ হয়ে রইলো গলবিল।
অসার অসার লাগলো পুরো শরীর। মনে হলো কেউ মাটি সড়িয়ে নিয়েছে পায়ের তলা থেকে! তবে কি অবশেষে ধরণির দ্বিধা হলো ওর উপর?
কিন্তু কোথায় কি? আরশির আর মাটি খুড়ে ভিতরে ঢোকা হলো না। ততক্ষণে শেহজাদ লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসলো ওর দিকে।
দুকদম পিছিয়ে গেলো মেয়েটা। তবে লাভ হলো না!
টেবিলে পা ঠেকতেই, পিছনে পড়ে যেতে নিলো আরশি। আর ঠিক সঙ্গে সঙ্গে ওর কোমর আঁকড়ে ধরলো সামনে দাঁড়ানো
মানুষটা।

একে অপরের দু’জোড়া দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো এক জায়গায়। শেহজাদের উষ্ণ হাতের স্পর্শে আরশির পৃথিবী থমকালো। মূহুর্তের জন্য যেনো শিথিল হৃদপিণ্ডের গতি।
স্বামীর ছোঁয়া বুঝি এতোটাই মারাত্মক?
যে আরশি নিশ্বাস নিতেই ভুলে গেছে?
ক্ষণিকের জন্য আরশির মনে হলো-
নাহ্! বিশ বসন্ত পর আসা এই তো সেই মানুষ, যে একটু হলেও ভাবে ওর কথা! একটু হলেও চিন্তা করে! একে আঁকড়ে ধরেই তো সারাজীবন কাঁটিয়ে দেয়া যাবে!
আর ঠিক তখনই আরশির কোমড় ছেড়ে দিলো শেহজাদ। ধপাস করে মেয়েটা গিয়ে পড়লো ফ্লোরে। পিছনের হাড্ডি ব্যাথায় টনটনিয়ে উঠতেই শুনলো শেহজাদের সেই হিমশীতল কন্ঠ –
“কী ভেবেছিলে এটা বোলবো আমি? হাউ ফানি! শায়ান শেহজাদ মরে গেলেও তোমাকে নিজের বউ বোলে মেনে নেবে না। যার জন্য আমি আমার বোনকে হারিয়েছি, আমার শৈশব হারিয়েছি, আমার মায়ের সন্তান হারানোর হাহাকার দেখেছি, সেই মেয়েকে আমি ঘৃণা করি! আর তাকে বউ হিসেবে মেনে নেয়ার তো প্রশ্নই আসে না!”
আরশি বাকরুদ্ধ। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সামনের মানুষটার দিকে। ওর প্রতি এতো রাগ মানুষটার? কৈ কেউ তো বললো না কোনোদিন ওকে এসব কথা।
আর ও কিভাবে শেহজাদের বোনের হারিয়ে যাবার জন্য দায়ী হবে?
এই সবকিছু যখন আরশির মাথায় এলোমেলো জট পাকাচ্ছে, তখনই কথার শেষ বিষ বানটা শেহজাদ ছুড়লো আরশির দিকে!

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১

“আর শাড়ি কেনো পড়েছো? আমাকে সিডিউস করতে? বলেছিলাম না? বউ হয়ে সং সেজে থাকার কোনো দরকার নেই! তারপরও কেনো পড়েছো?”
“আ- আর পড়বো না!”
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কোনমতে কথাগুলো আওড়ালো আরশি। শুধু পারছে না এখনি ফেরত চলে যেতে বাংলাদেশে। এই লোকটার বাসায় আর একমুহূর্তও থাকার ইচ্ছে নেই ওর!

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩