নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৭
সিনথিয়া
“না মানে ফিউচার শেহজাদ যদি গোমড়ামুখো হয় তাহলে ফিউচার আরশিও কি তার মায়ের মতো শব্দ করে বিড়বিড় করবে?”
প্রফেসরের চোখে নিখাঁদ কৌতুক। নিম্নাষ্ঠ কামড়ে প্রশ্নটা করতেই
মুখ তুললো আরশি। টানটান কপালে ভাজ পড়লো ওর।
চোখা নাকটা ফুঁসে উঠলো রাগে। প্রতিবাদে কিছু বলতে গিয়েও ঠোঁট টিপে আটকালো নিজেকে। নেহাৎ ও ভালোমানুষ দেখে ঝগড়াঝাটি করে না! তাই বলে কথায় কথায়
এভাবে খোঁচা মারবে লোকটা?
হুট করেই নিচ তলা থেকে গলা শোনা গেলো মেহমেদ হাসানের। শেহজাদকে ডাকছেন উনি। ছেলের বাড়ির লোকেরা সব চলে এসেছে যে।
মানুষটার খেয়াল সেদিকে ঘুরতেই সুযোগ বুঝে কোমর থেকে হাত সরিয়ে ফেললো আরশি। ত্রস্ত পা চালিয়ে রুম থেকে বের হতে যাবে তখনই ডাক দিলো শেহজাদ। পিছন থেকে বলে উঠলো,
“কোনটা পরবো বলে দিয়ে যাবে না?”
আরশি থমকালো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে চাইলো চওড়া হেসে। কিন্তু অমন প্রকান্ড গতরের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। মুহূর্তেই বাম হাতটা চলে এলো চোখের উপর।
“সবাই তো এক জিনিসই পরবে, আপনি বরং ইউনিক কিছু ট্রাই করুন!”
প্রফেসর ধরতে পারলোনা বোধ হয় কথাগুলো! ভ্রু বেঁকে এলো তার। অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“ইউনিক কিছু ট্রাই করবো মানে?”
ফের আনমনে আওড়ালো আরশি। চিবিয়ে-চিবিয়ে বললো,
“আপনার তো মুড নেই কাপড়চোপড় পরার! তাহলে এভাবেই চলে আসুন না নিচে! আপনাকে অমন এ্যাব-স্যাব বের করে নামতে দেখলে এমি আপু যদি খুশিতে এট্যাক-ফ্যাট্যাক করে ওখানেই উপরে চলে যায়; তাহলে আমারও আর কষ্ট করে তাকে উপরে পাঠাতে হবে না!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শেহজাদের অবিচল ঠোঁটের গতি পাল্টায়। বেঁকে আসে একপাশে।
আরশি থমকায়। এই রে! এটাও শুনে ফেললো জাম্বুবান? এমিলিয়ার না হওয়া মার্ডার মিস্ট্রি ফাঁস হয়ে যাবে নাকি? ভয়ে জিভে ঠোঁট ভেজালো ও। হড়বড়ালো বড্ড অগোছালো ভাবে,
“উপরে চলে যাবে মানে রুফটপে চলে যাবে আরকি! আলাদা করে কথা বলতে হবে না জামাই বাবুর সাথে? ঐটাই বলছিলাম! আসি হ্যাঁ? আন্টি মনে হয় ডাকছে আমাকে!”
মেয়েটা অপেক্ষা করে না। দু’হাতে শাড়ির দুপাশ খামচে ধুপধাপ নেমে যায় সিঁড়ি ভেঙে। কিশোরীর প্রস্থান পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রফেসর। আরশিকে ধরে আঁটকে রাখার সুযোগ থাকলেও এগোয় না।
উদোম গায়ে প্যান্টের পকেটে হাত গোঁজে পরপর। থুতনি গলায় ঠেকিয়ে নিঃশব্দে হেসে আওড়ায়,
“খরগোশের মা তারমানে আসলেই জেলাস? ইমপ্রেসিভ! ”
গোটা রুমজুড়ে পায়চারি করছে জারা। দাঁত দিয়ে নখ কামড়ে শুধু ভাবছে,
কিভাবে একটা সরি বলা যায় আয়ানকে। নাহ্! সরি বললেও তো কম হয়ে যাবে; ওরকম একটা চড় ওর গালে এসে পড়লে ওখানেই তো কেঁদে-কেঁটে
ভাসিয়ে দিতো মেয়েটা। সেখানে অত বড়সড় একটা মানুষ কিচ্ছুটি বললো না?
তখনই আয়ান বের হলো রুম থেকে। পুলিশের ইউনিফর্মে এক গাট্টা-গোট্টা শরীর। তবে থমথমে মুখে আজ আর কাউকে দেখার তাড়া নেই। মাঝেমধ্যে রাতেও হুট করে বের হতে হয় ওকে। তখন ওর বাটারফ্লাইকে খোঁজে চোখজোড়া। মেয়েটাকে একবার না দেখলে কাজে মন বসে না!
সবসময় কেনো ডাকেন বের হওয়ার সময় এই প্রশ্ন এড়াতে বলে, দরজা ভালো করে লক করে নিও।
কিন্তু আজকেই যেনো ব্যাতিক্রম ঘটলো এই রুটিনের।
কিন্তু বুটের আওয়াজ টের পেতেই জারা তড়িঘড়ি এসে দাঁড়ায় সামনে। অফিসারের চোখ ফোনের স্ক্রীনে। হাতে ট্রলি। এগোতে গিয়েও থমকায় পা জোড়া। তবুও তাকায় না মেয়েটার দিকে। জারার অনুতাপে পোড়া মুখটা নোয়ানো।
এক হাত দিয়ে অন্য হাতে কচলে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“স-সরি!”
কোনোমতে গলা চিড়ে এটুকু বের হতেই মাথা তুললো আয়ান। ভ্রু বাঁকিয়ে শুধোলো,
“ফর হোয়াট?”
কন্ঠে রুক্ষতা। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেও ধক করে উঠলো মেয়েটার বুক। চোখের কোটর টলমলে হলো মূহুর্তেই। ধরে আসা গলায় শুধু আওড়ালো,
“আপনাকে ভুল বোঝার জন্য!”
অফিসার হাসলো অল্প। কোনোকিছু না বলে চলে যেতে নিলেই ফের সামনে থেকে আটকালো জারা। মেঝেতে চেয়ে থেকেই বললো,
“আজ বলবেন না দরজা ভালো করে লক করে রাখতে?”
আয়ানের বুটজোড়া থামে না। পাশ কাটিয়ে হাঁটা শুরু করলে হাতের তর্জনী মুঠোয় করে আঁকড়ে ধরে মেয়েটা।
“আমার উপর এতো কেনো রাগ করছেন? আমি তো বললাম স–”
জারা কথা শেষ করতে পারে না! তার আগেই ঐ নরম মুঠোয় থাকা খসখসে আঙুলটা ছাড়িয়ে নেয় অফিসার।
দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে হাতের ঘড়িতে সময় দেখে বললো,
“তুমি বলছিলে না প্রথম দিনই তোমার অন্য বাসা খোঁজা উচিত ছিল? তোমাকে আর কষ্ট করে অন্য বাসা খুঁজতে হবে না। আমিই চলে যাচ্ছি। এতোদিন তোমাকে বিরক্ত করার জন্য…আ’ম সরি!”
প্রস্তরসম মুখের কথাগুলো তীরের মতো এসে লাগে মেয়েটার বুকে। মূর্তিবোনে দাঁড়িয়ে থাকে ও। অফিসার ব্যস্ত পা বাড়ায়।
শব্দ করে দরজা খুলে বেরিয়েও যায় পরপর।
কিন্তু নড়তে পারে না শুধু জারা। পায়ের পাতা যেনো আঁটকে আছে মেঝেতে। বুকের ভিতর ভেঙেচুরে যাচ্ছে! গলার কাছটায় দলা পাকানো কান্নাগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে ওর।
কাল থেকে বানর মশাই আর থাকবে না এই বাসায়! ওকে বাটারফ্লাই বলেও আর ডাকবে না কেউ! ভাবতেই ডুকরে উঠে মেয়েটা। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে ফ্লোরে।
তখনই বেল বাজে দরজায়। বেলের শব্দ শুনেই চোখে মুছে ত্রস্ত উঠে দাঁড়ালো জারা। ভেজা গালেই মলিন হাসলো। বানর মশাই তার বাটারফ্লাইকে একা ফেলে চলে যাবে? এটা হয় বুঝি?
অপেক্ষা করে না ও। দৌঁড়ে আসে দরজার কাছে। তাড়াহুড়োয় না দেখেই খুলে ফেলে কাঠের ডোর।
অমনি দপ করে নিভে যায় মুখের হাসিটা। অস্ফুটে আওড়ায়,
“ক-কে আপনি?”
ছোট ছোট মরিচ বাতিতে সেজেছে হাসান ভিলার ভেতরটাও। সাদা টাইলসে মোড়ানো পুরো বাড়িতে আজ আর্টিফিশিয়াল অর্কিড ফুলের মিশেল।
মেহমানদের সাথে আলাপ সারছেন মেহমেদ হাসান। এমিলিয়াকে বসানো হয়েছে ছেলের পাশে। তবুও ওর চোখজোড়া ঘুরে ফিরে যাচ্ছে দোতলার ঘরটায়। শেহজাদের নামার অপেক্ষায় অধীর মন ভুলেই গেছে আজ এ্যাঙ্গেজমেন্টটা কার!
পাশ থেকে বিষয়টা লক্ষ্য করলেন মরিয়ম বেগম। পেছন থেকে হেসে ঝুঁকে আসলেন এমিলিয়ার কানের কাছে।
“ভুলে যাস না মা! তুই কিন্তু কথা দিয়েছিলি আমাকে! আদি যেনো কষ্ট না পায়!”
ঢোক গেলে এমি। ত্রস্ত চোখ সরাতেই
ওপর থেকে নেমে আসলো আরশি। এসে দাঁড়ালো শাশুড়ির পাশে। ভদ্রমহিলা আদ্রিয়ানের মা-বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন ছেলের বউকে। এমিলিয়ার ভেতরটা পোড়ে তখন। আরশির ঐ হাসি-হাসি মুখটা সহ্য হয় না ওর।
হুট করেই আদির মা শুধোয় পশ্চিমা ভাষায়,
“আপনার ছেলেকে তো দেখছি না! কোথায় সে?”
“শেহজাদ তো–”
মরিয়ম বেগমের কথা শেষ হওয়ার আগেই
রুম ছেড়ে বেরোয় শেহজাদ। পরনে আরশির শাড়ির রঙের সাথে মেলানো শার্ট। চুলগুলো পড়ে আছে কপালের ওপর।
হাতা ফোল্ড করতে করতে সিঁড়ি ভেঙে নামে লম্বা-চওড়া মানুষটা। আরশি তব্দা খায়। জাম্বুবানের এই রূপ আগে কেনো দেখেনি ও?
এতো স্নিগ্ধ কি শুধু ওর কাছেই লাগছে মানুষটাকে? নাকি সবারই লাগছে এমন?
দু’হাতে চোখ ডলে আরশি। ফের বড় বড় করে তাকানোর আগেই সামনে এসে দাঁড়ায় প্রফেসর! ভ্রু নাঁচিয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলে
সজোরে দু’পাশে মাথা নাড়লো মেয়েটা। মাথা খারাপ যে ও বলবে জাম্বুবান দেখতে সুন্দর?
প্রেস্টিজ চলে যাবে না?
শেহজাদকে দেখেই উঠে আসে এমিলিয়ার হবু বর। নিজে থেকেই হাত বাড়ালো হ্যান্ডশেক করার জন্য। পরিচয় দিতে ছোট করে বললো,
“আদি!”
অমনি কপালে ভাজ পড়লো আরশির। কেমন শোনা-শোনা ঠেকলো না কন্ঠটা? কিন্তু সে কি করে শুনবে এই লোকের কন্ঠ। দেখলোই তো প্রথমবার।
প্রফেসরও পকেটে এক হাত গুঁজে অন্য হাত বাড়ালো আদির দিকে।
“শেহজাদ!”
লোকটার চোখ পরপর গিয়ে পড়লো আরশির উপর। ফর্সা মুখে অল্প হাসলো। আওড়ালো
পশ্চিমা ভাষায়,
“ইনি বুঝি আপনার ওয়াইফ! ভীষণ সুন্দর দেখতে! আই মাস্ট সে; ইউ আর সো ড্যাম লাকি ব্রো!”
দ্বিতীয়বার কন্ঠ শুনেও খটকা গেলো না মেয়েটার। বার বার মনে হলো এই গলার স্বর আগেও শুনেছে ও।
শুধু কোথায় যে শুনেছে এটাই মনে করতে পারলো না!
একবার বলবে বিষয়টা জাম্বুবানকে?
কিন্তু শেহজাদের দিকে চাইতেই দমে গেলো ও। প্রফেসরের ঐ ‘ওশান-ব্লু’ চোখজুড়ে বিস্তর কালো ছায়া। চেহারায় স্পষ্ট রাগ। তবুও যেনো জোর করে ধরে রেখেছে ঠোঁটের হাসিটা।
অমনি সব তালগোল পাকিয়ে গেলো আরশির। ঢোক গিলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো পাশে। মনে মনে ভাবলো, “একটু আগেই তো ঠিক ছিল! হঠাৎ করে মুখটা এমন হয়ে গেলো কেনো জাম্বুবানের?”
শেহজাদের উত্তর এলো না দেখে হুহা করে হেসে উঠলো আদি! কাঁধে হাত রেখে ইংরেজিতেই বললো,
“একি সিরিয়াস হয়ে গেলেন নাকি প্রফেসর? চিন্তা নেই! আপনার বউ চুরি করে নিয়ে যাবো না!”
আদির কথায় বাকিরা হেসে উঠলেও নির্বিকার আননে দাঁড়িয়ে শেহজাদ। ব্যাধের দৃষ্টি যেনো শিকারের উপরই। শুধু মাত্র ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারলো না মুখে।
নইলে এতক্ষণে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার মতো অবস্থায় হয়তো থাকতো না এই লোক।
পরিস্থিতি সামলাতে আংটিবদলের তাগাদা দেন মেহমেদ হাসান। আদিকে এনে বসান এমিলিয়ার পাশে।
অনুষ্ঠান শুরু হলেও স্বাভাবিক হয় না শেহজাদ। অমন গম্ভীর হয়ে থাকতে দেখেই ঠোঁট সরু করলো আরশি। সবাই কত আনন্দ করছে! আর ওর জাম্বুবানটাকে দেখো?
পরপরই পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়ালো মেয়েটা। প্রফেসরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে আওড়ালো,
“আপনার কি ওয়াশরুম পেয়েছে?”
শেহজাদ পাশ ফিরে চাইতেই ঘাবড়ে গেলো আরশি। দাঁত বের করে বললো,
“না মানে মুখটা শক্ত করে রেখেছেন তো! তাই ভাবলাম–”
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৬
মুহূর্তেই ওর হাত চেপে ধরলো প্রফেসর। কথা শেষ করার আগেই টেনে নিয়ে যেতে লাগলো কোথাও একটা! মেয়েটার চোখ কোটর ছাড়ায়। বিরক্ত স্বরে হিসহিসিয়ে বলে,
“আরে মশাই! আমার তো আর আপনার মতো ওয়াশরুম পায়নি! তাহলে আমাকে কেনো নিয়ে যাচ্ছেন ওদিকে? আমার সামনেই করবেন নাকি? আমি কিন্তু বমি করে দেবো বলছি! ইয়াকক!”