নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩৭

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩৭
সিনথিয়া

বুনো বাতাসের তর্জনে গর্জনে লন্ডভন্ড হাসান ভিলার ব্যাকইয়ার্ড। ক্যাবল ছিড়েছে! তাই কারেন্ট আসার সম্ভাবনা আজ রাতে অন্তত নেই।
বসার ঘরে মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালানো শুধু!
জারা বসেছে আয়ানের ঠিক সামনে।
একটা পাতলা কম্ফোর্টার মুড়িয়ে
গালের নিচে হাত রেখে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দেখছে আয়ানকে!
আয়ানের গান থামলো। গিটারটা কোল থেকে সরে স্থান পেলো সোফার সাইডে। চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো সুরের মূর্ছনায় তাবৎ ধ্যান হারিয়েছে জারা।
নীলিমার সবটা জুড়ে উপচে পড়ছে বিস্ময়!
“আপনি গানও গাইতে জানেন? তাও এতো সুন্দর করে?”
আয়ানের হাবভাব বেড়ে গেলো অমনি। ঠোঁট বাঁকিয়ে মিছেমিছি কাঁধের কলার ঠিক করলো!
খুব গর্ব করে বললো,

“ডোন্ট আন্ডারএস্টিমেট দ্য পাওয়ার অফ অ্য পুলিসম্যান বাটারফ্লাই! নেহাৎ এ বাড়ির ফ্লোর ভালো না দেখে তুমি আমার নাচটা মিস করলে! নয়তো এমন কিছু নেই যেটা এই আয়ান হান্টার পারে না! হুহ!”
জারা চোখ খিঁচে পেট চেপে ধরলো দুহাতে! হাসতে হাসতে দম যাওয়ার জোগাড়।
“আয়ান হান্টারের ফ্লোর ভালো না দেখে নাচিনি আর বাঙালির নাচ না জানলে উঠোন বাঁকা দুটোই কিন্তু এক জানেন?”
মানুষটার মানইজ্জত নিলামে উঠিয়ে আরেক দফা হাসিতে গড়াগড়ি খেলো জারা!
“মোটেই না! আমি আরো অনেক কিছু জানি!”
আয়ানের গলার স্বর গম্ভীর! অনেক কষ্টে থামলো মেয়েটা। এগিয়ে এলো ফুলে থাকা মুখখানার সামনে। চোখ পিটপিট করে শুধোলো,
“তা শুনি শুনি! আর কি কি জানেন?”
আয়ানও ঝুঁকলো সামনের দিকে! জারার দুপাশে হাত রেখে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এই যেমন একটা মেয়েকে রোজ একটু একটু করে ভালোবাসতে জানি! লাইব্রেরির সামনে থেকে মেয়েটাকে বাইকে চড়িয়ে পুরো বিশ্ব ঘোরাতে জানি! তার সাথে পৃথিবীর সবচাইতে ভয়ঙ্কর হরর মুভিটাও দেখতে জানি! তার বকা খেতে জানি! তাকে চুমু–!”
আয়ানকে থামতে হলো এবার! ঠোঁট টিপে ঢোক গিললো! খেই হারানো চোখদুটো কথা খুঁজতে গিয়ে আঁছড়ে পড়লো ঐ তুলোর ন্যায় পাতলা অধর জোড়ায়!
মনে পড়লো দুপুরের সেই ঘটনা! ওষ্ঠপুটের দখলদারিত্বে ভীষণ অপটু একটা মেয়ের কুন্ঠায় লাল-নীল হওয়ার দৃশ্য!
সহসা উঠে দাঁড়ালো অফিসার! হড়বড়ালো হিবিজিবি ভাবে!
“ক-কফি খাবে? যা ঠান্ডা পড়েছে না! আমি বানিয়ে আনছি! দাঁড়াও!”
জগতের সমস্ত ব্যস্ততা দেখিয়ে কিচেনের দিকে যাওয়া মানুষটার হাতে টান পড়লো অমনি। ফিরে চাইতেই দেখলো জারা ধরে আছে ওকে!
“আপনি তো ভূতে ভয় পান! অন্ধকারে একা একা কফি বানাবেন কি করে? ভয় পাবেন তো! দাঁড়ান! আমিও আসছি!”

“কে বলেছে আমি ভয় পাই? ওসব ভয় টয় আমি নিজের বাসাতেই পাই না! তারপর তো এই আদা-ছেঁচার বাসায়! তুমি বোসো! আমি জাস্ট যাবো আর আসবো!”
আয়ানের কথা শেষ হতে না হতেই উঠে এলো জারা। এসে দাঁড়ালো মুখোমুখি। যেখানে দাঁড়ালে অফিসারের হার্টবিট গোনা যাবে। শোনা যাবে অলিন্দের তীব্র হাহাকার।
আয়ান পিছিয়ে গেলো দুকদম। সচেতন দূরত্ব মেপে দাঁড়ালো নড়বড়ে খুঁটির মতো! যেনো জারা আরেকটু এগোলেই ভেঙে যাবে সংযমের এক আস্ত পাহাড়। কিছু একটা করে ফেলবে ও। ভয়ংকর কিছু একটা!
জারাও থামলো না। আয়ান এক কদম পিছিয়ে গেলে দুকদম এগিয়ে এলো ও।
শেষমেষ অন্ধকারে দেয়ালে পিঠ ঠেকলো আয়ানের।
শ্বাসের গতি প্রকট। রুদ্ধ মস্তিষ্ক। এবার আর বন্ধুর নয়, নিজেরই গলা শুকিয়ে কাঠ। আনত মুখে বারবার নিজেকে বোঝালো,

“ না না! কন্ট্রোল আয়ান কন্ট্রোল! বিয়ের আগে আর কিচ্ছু নয়! তোর বাটারফ্লাইকে দ্বিতীয়বার ভুল বোঝার কোনো সুযোগ করে দিস না! প্লিজ!”
কিন্তু তার আগেই কপালে ভাজ পড়ে গেছে জারার। সন্দিহান তার নীল চোখ! অভিমানী সুরে বললো,
“আপনি কি এড়িয়ে যেতে চাইছেন আমাকে?”
পাতলা অধর ফসকে শব্দগুলো বেরোতেই মুখ তুললো আয়ান। আবিষ্কার করলো জারার চোখজোড়া ভেজা। কেমন ফুলিয়ে রেখেছে ফিনফিনে ঠোঁটগুলো।
অমনি কিছু একটা হলো ওর বুকের ভিতর! মাঝের দূরত্বটুকু সেকেন্ডর মাথায় মিটিয়ে জাপ্টে ধরলো মেয়েটাকে।
“আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম না বাটারফ্লাই!
আই সয়্যার! তোমাকে এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য আমার নেই!”
“তাহলে কাছাকাছি আসতে গেলেই পালাচ্ছিলেন কেনো ওভাবে?”
“পালাচ্ছিলাম না! জাস্ট তোমাকে সেইফ রাখতে চাইছিলাম!”
“কার থেকে?”

থামলো আয়ান। খসখসে ঠোঁটজোড়া ভেজালো জিভ দিয়ে। শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“নিজের থেকে! যদি কিছু করে ফেলি? বেখেয়ালে! হুশ হারিয়ে!”
জারার কান্না শেষ! তবে অধরকোণে ধরা দিলো দুষ্টুমি। বলিষ্ঠ পুরুষের বক্ষভাজে মুখ লুকিয়ে আওড়ালো,
“কিন্তু আমি যে আমার এই ভূতে ভয় পাওয়া অফিসারের কাছ থেকে এমন সেইফটি চাইনা! যেখানে ভালোবাসার ভয়ে তাকে দূরে সরে যেতে হয়!”
আয়ানের জগৎ থমকালো এক লহমায়! কর্ণকুহরে পৌঁছোলো নিজের প্রিয়দর্শিনীর লাজুক লাজুক কন্ঠস্বর,
“আমি আপনার ঐ বেখেয়ালের ভালোবাসাটুকুই চাই! আমায় একটু ভালোবাসবেন বানরমশাই? প্লিজ?”

জ্বলজ্বল করছে শেহজাদের হাতে থাকা আদুরে অগ্নিশিখা। দুলে দুলে ম্লান আলো ছড়াচ্ছে ঘরময়! আরশি স্তব্ধ! নির্বাক কিশোরীর দৃষ্টিতেও আধিপত্য শেহজাদের।
“জিজ্ঞেস করবে না? কি লাগবে আমার?”
“আমি তো জ-জিজ্ঞেস করেছি! আপনিই বলেছন আপনার প্যারাসিটামল লাগবে না! অন্য কিছু লাগবে! কিন্তু অন্য কিছু আপতত এই ঘরে নেই! পরে আসুন!”
কথাগুলো বলে খড়খড়ে মরুভূমি হওয়া গলায় ঢোক গিললো কিশোরী। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ার আগেই ব্যান্ডেজ করা হাতে আরশির বাহু আঁকড়ে ধরলো শেহজাদ! টেনে এনে মেশালো নিজের সাথে!
“অন্য কিছু এই ঘরেই আছে! আমার খুব কাছে!”
শরীর ঝাঁকুনি দিলো! কেঁপে উঠলো পেলব গতর! সন্ত্রস্ত হলো ফর্সা মুখটা। কন্ঠে আকুতি ঢেলে বললো,
“কেনো এমন করছেন ? আপনার ব্যথা লাগবে হাতে!”
তিক্ত হাসলো শেহজাদ। গলার এ্যাডাম এ্যাপলটা ওঠানামা করলো ঢোকের সাথে!
হাতের দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে আওড়ালো,
“তুমি তো এর থেকেও বেশি ব্যথা দিচ্ছো! সেই ব্যথা সহ্য করে নিচ্ছি আর হাতের এইটুকু ব্যথা সহ্য করতে পারবো না?”

এতক্ষন ছটফট করা মেয়েটা হুট করেই শান্ত হলো! গোল গোল চোখগুলো গেড়ে বসলো সম্মুখের মুখটায়!
“বানিয়ে বানিয়ে কেনো বলছেন? কখন ব্যথা দিয়েছি আপনাকে? আমি তো রাতে ঘুমোনোর সময়ও মাঝে কোলবালিশ রেখে ঘুমাই! যেনো আপনার গায়ে আবার হাত-পা না ছুড়ে ফেলি! তাহলে ব্যথা দিলাম কি করে?”
“এই তো নিজের মুখে স্বীকার করলে! যে রাতে মাঝে কোলবালিশ রেখে ঘুমাও! আজ তো একেবারে অন্য ঘরেই পাঠিয়ে দিলে! এভাবে আমাকে কষ্ট দেয়ার মানে কি খরগোশের মা?”
আরশি থতমত খেলো খরগোশের মা ডাকটা শুনে! স্নোবলের মা বলে ডাকলেও মানা যেতো! তাই বলে খরগোশের মা?
ওর বাচ্চাকে খরগোশ বলা?
মিনমিন করে আওড়ালো,

“খরগোশের বাবাও তো একটুও ভদ্র সভ্য নয়! এমন না করে উপায় আছে?”
মানুষটার শাণের মতো চোয়াল দৃঢ় হলো সহসা! মোমের হলদে আভা যেনো চিবুকে নয়, পড়েছে কোনো ধারালো ইস্পাতের ওপর! আলোর প্রতিবিম্ব ছিটকে এসে লাগছে আরশির চোখে!
“আহ! মুখ না আয়না? এতো জেল্লা দিচ্ছে কেনো? উফ! দেখি সরুন তো!”
পাহাড়ের মতো শক্ত মানুষটাকে ঠেলে সরাতে দিশেহারা আরশি। তার উপর চোখও মেলতে পারছে না!
“আমার মুখ জেল্লা দিচ্ছে?”
অবাক স্বরে প্রশ্নটা করলো প্রফেসর! আরশি বিরক্ত মুখে আরেকদিক তাকিয়ে। মনে মনে ভাবলো,
“ব্যস! একটু প্রশংসা পেতে না পেতেই শুরু হয়ে গেলো!”
কিন্তু মুখে বললো,

“দিচ্ছে তো! এই যে দেখুন! চোখ মেলতে পারছি না! আপনি প্লিজ মুখটা একটু গিয়ে ধুয়ে আসুন তো! তাহলে যদি জেল্লাটা একটু কমে!”
ভুল! আরশি চোখ মেলতে পারছে না কারণ শেহজাদ অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে! প্রায়ই এমনভাবে তাকাচ্ছে আজকাল! হলো টা কি জাম্বুবানের?
“কিন্তু মিসেস শেহজাদ! আনফরচুনেটলি আমি যে এখন কোত্থাও যেতে পারবো না!”
মানুষটার স্থুল স্বরে ত্রস্ত চোখ মেললো আরশি! কৃষ্ণ গহ্বর বিভ্রান্ত! প্রশ্নের ভাজ কপালে ফেলে চাইলো শেহজাদের দিকে!
“ক-কেনো যেতে পারবেন না?”
“কেউ একজন এখনো বলেনি যে সে আমাকে ভালোবাসে! তাই যতক্ষণ না পর্যন্ত সে বলছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি যেতে পারবো না!”

কথাগুলো শুনতেই যেনো হোঁচট খেলো মেয়েটা! এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো ফ্লোরে! চোখ নামিয়ে আওড়ালো,
“আপনি জানেন? আপনার এখন কি পরিমানে রেস্ট নেয়া প্রয়োজন! কতগুলো মেডিসিন আছে খাওয়ার পরে! বাচ্চাদের মতো জেদ ধরছেন কেনো? এগুলো মানায় আপনাকে?”
একপেশে হাসলো শেহজাদ! চিবুকের নিচে তর্জনী আর উপরে বুড়ো আঙুল রেখে মুখটা তুললো আরশির! ইঞ্চিখানেক দূরত্ব মিটিয়ে ঝুঁকে এলো ঘাড়ের পাশে। কানের নরম পাতায় ওষ্ঠপুট ছুঁইয়ে বললো,
“তুমি বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে আমাকে বাঁচাতে যেতে পারো আর আমি জেদ ধরে ‘ভালোবাসি’ শুনতে পারবো না? আই ডু হ্যাভ রাইটস টু হিয়ার দ্যাট ফ্রম মাই ওয়াইফ!”
কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ মেয়েটার হুশ ফিরলো! কুন্ঠায় বিধ্বস্ত হলো গলবিল। থেমে থেমে আওড়ালো,
“আ-আগে ছেড়ে দিন! পরে বলছি!”
“আগে বলো! পরে ছেড়ে দিচ্ছি!”
আর্ত চোখে তাকালো আরশি! এই মহাবিপদজনক জাম্বুবানটা কেনো ওরই বর হতে গেলো? অন্য কারোরও তো হতে পারতো?

অমন নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে থাকলে কি ভালোবাসি বলা যায়? লজ্জা লাগবে না ওর?
“আমি পারবো না ওসব বলতে!”
ঘাড়ের পাশ হতে সরে এসে আরশির সামনাসামনি হলো শেহজাদ। দেখলো মোমের আলোয় একটা স্নিগ্ধ মুখ! তিরতির করে কাঁপতে থাকা ওষ্ঠযুগলে
চোখ পড়তেই ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো মানুষটার! হারালো অপেক্ষা করার শক্তিটুকু। হাস্কি স্বরে আওড়ালো,

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩৬

“বেশ! আজকেও বলতে হবে না তোমায়! বাট ইউ হ্যাভ টু প্রমিজ মি ওয়ান থিং!”
থামলো শেহজাদ! ভীষণ বোকা বোকাভাবে তাকানো ঐ চোখদুটোয় চোখ রেখে বললো,
“ইফ আই কিস ইউ রাইট নাও; ডোন্ট প্যানিক! শুধু বোলো কখন থামতে হবে! আমি থেমে যাবো!”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩৮