নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪১
সিনথিয়া
শেহজাদের নিরেট স্বর কর্ণগোচর হতেই থমকালো আরশি। ইঙ্গিতপূর্ণ হুমকিটুকু খাবার নামতে দিলো না গলার। কুন্ঠায় দৃষ্টিজোড়া ছুটে এলো কোলের উপরটায়।
তবে সেসব যেনো দেখেও না দেখার ভান করলো প্রফেসর! রমণীর কপোলজুড়ে একরাশ পলাশ ফুটিয়ে লম্বা পা ফেলে দোতলায় উঠে গেলো মানুষটা। যাওয়ার সময় একটিবার ফিরেও চাইলো না পিছনে।
মূর্তি বোনে থাকা আরশিকে লক্ষ্য করে মরিয়ম তাগাদা দিয়ে শুধোলেন,
“কী রে মা! খাচ্ছিস না কেনো? এটা ভালো লাগছে না? অন্য কিছু দেবো?”
আরশির হুশ ফেরে। আলগোছে দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে যোগ আনে খাবার প্লেটে। কিন্তু মনটা? সে তো বারবার ছুটে যেতে চাইছে দোতলায়! অমন ডাকাতসুলভ হুমকির পিঠে কষে একটা চুমু খেয়ে পাষাণ পুরুষটাকে মিনিটখানেক তব্দা লাগিয়ে দেয়া গেলে বেশ হতো! কিন্তু এতগুলো মানুষের সামনে থেকে উঠে গিয়ে যে তার এই লেহাজহীন বাসনা পূরণ হওয়ার নয়!
এমন লোভনীয় সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো ওর। মুখরোচক হোয়াইট সস পাস্তাটাও বিস্বাদ ঠেকলো মুখে। উশখুশ ভাব বাড়লো! চোরা চোখ তুলে ওপরে চাইতেই ঘটলো আরেক বিপত্তি! ধরা পড়ে গেলো আয়ানের হাতে। ভাইসুলভ মানুষটার সকৌতুক দৃষ্টিতে কলমি লতার ন্যায় আরেকদফা লজ্জায় নুয়ে এলো আরশি!
আয়ানও কম যায় না! সবাইকে চমকে দিয়ে প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো। জারার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“জারা! তোমার ফোন কি রুমে রেখে এসেছো?”
জারা হকচকিয়ে পকেটে হাত দিলো! জায়গার ফোন জায়গায় পেয়ে বিভ্রমে আওড়ালো,
“কই না তো? আমার ফোন তো আমার কাছেই…”
বাক্যে দাঁড়ি পড়ার আগেই কথা কেড়ে নিলো আয়ান!
সৌম্যসুন্দর মুখটায় উদ্বেগ নিয়ে বললো,
“নেই তো? জানতাম! এইজন্যই তো বলি এতগুলো ‘আই লাভ ইউ’ লিখে মেসেজ পাঠালাম, একটারও রিপ্লাই পেলাম না কেনো? ভাবলাম বুঝি আবারও রিজেক্ট করে দিলে এই অধমকে! এই বয়সে এতো টেনশন নেয়া যায়? আঙ্কেল আপনিই বলুন?”
মেহমেদ হাসানের হাসিখুশি মুখটাতেও গাম্ভীর্যের ছায়া বর্তালো! মেঘমেদুর গলায় আওড়ালেন,
“উহু! একদমই নেয়া যায় না! এই বয়সে এতো টেনশন নেয়া হার্টের জন্য ক্ষতিকারক! প্রেমিকা ‘আই লাভ ইউ’ লেখা টেক্সটের রিপ্লাই দিচ্ছে না, সেটা তো আরো ক্ষতিকারক। হাই ব্লাড প্রেশার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও চূড়ান্ত!”
জারা হতভম্ব! সেদিকে তাকিয়েই চোখ টিপলো আয়ান! ইশারায় প্রেমিকাকে বোঝাতে চাইলো নিজের অভিসন্ধি। পরপর আরশির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“ফোনটা তো মনে হয় তোমাদের রুমেই আছে বোন! একটু গিয়ে দেখো তো খুঁজে পাও কি না?”
জারা আর মরিয়ম বেগমও এতক্ষণে বুঝে ফেললো আয়ান কী চাইছে! আর অমনি সবাই একপ্রকার হাত-পা ধুয়ে লাগলো আরশিকে উপরে পাঠাতে।
প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও একপর্যায়ে উঠে দাঁড়ালো আরশি। বিমূঢ় দেখালো তার স্নিগ্ধ মুখটা। ঝিলের মতো টলটলে চোখে এক প্রহর বিস্ময়!
সবাই কি ইচ্ছে করে এমন করছে? নয়তো জাম্বুবানের কাছে যাওয়ার ইচ্ছেটা এমন কাকতালীয় ভাবে পূরণ হয়ে গেলো কী করে?
ফর্সা পা জোড়া শব্দহীন এসে দাঁড়ালো ওদের রুমের সামনে। ভিড়ানো দরজা ঠেলে ভেতরে শুধু মাথাটা ঢোকালো আরশি। কিন্তু পোনিটেল করে রাখা চুলে অমায়িক সুন্দর মুখটা একপ্রকার উপেক্ষা করেই নিজের কাজে মন দিলো শেহজাদ।
পরনের টিশার্ট আর ট্রাউজার বদলে ফরমাল পরেছে। টার্টলনেইক এর সাথে গায়ে চাপিয়েছে হাঁটু অবধি ওভারকোট।
ঘন চুলগুলো আঙুলের সাহায্যে পিছনে ঠেলে ক্রিড এ্যাভেন্টাসে সুরভিত করেছে নিজেকে।
আরশি বেশ অনেকক্ষণ যাবত তার এই সাজসজ্জা দেখলো। তারপর উপেক্ষিত হওয়া নিজেকে কোনোমতে টেনে এনে দাঁড় করালো শেহজাদের পিছনে। নীরবতা ভেঙে আস্তে আস্তে শুধালো,
“আপনার কি আর কিছু লাগবে?”
ঠান্ডা গলায় উত্তর এলো শেহজাদের! এক শব্দে ছোট করে শুধু বললো,
“না!”
আরশি চমকায়! অপ্রত্যাশিত কিছু অভিমান চেপে বসে মনে। তবুও হাল ছাড়লো না সে। জিভে ঠোঁট ভিজিয়ে ফের জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কি রাগ করে আছেন আমার উপর?”
হাতের এ্যানালগ ঘড়িতে টাইম দেখছিল শেহজাদ। প্রশ্নের পিঠে প্রচন্ড বিরক্তি সমেত তাকালো আরশির দিকে। উত্তরের বদলে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বললো,
“আমার রাগ করার কোনো কারণ আছে কি?”
কারণ তো আছে! সহস্রাধিক কারণের ভীরে সবচেয়ে বড় কারণ সে নিজে। এমনটাই মনে হলো আরশির। মেদুর মুখে নামলো সন্ধ্যের বিষণ্নতা। রাঙা ঠোঁট ভেঙেচুরে এলো দুঃখ দুঃখ কান্নায়। তবুও সেসব গিলে নিলো আরশি। প্রিয় মানুষটার কড়া কড়া কথায় দৃষ্টি নামিয়ে মেঝেতে ফেললো!
তখনই এক কান্ড ঘটিয়ে বসলো শেহজাদ। দুম করে ঝুঁকে এলো মুখের সামনে। নীল অক্ষিপটে কামনার মাদুর বিছিয়ে তাকালো আরশির দিকে। তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটে নিজের তপ্ত অধরজোড়া ছুঁইয়ে ফেব্রুয়ারীর শেষ শীতে বসন্তের উষ্ণতা আঁকলো। অন্তঃপটে ছড়ালো কিছু তুলতুলে অনুভূতি।
অধর ছেড়ে শেহজাদ যখন ফের ঐ বন্ধ চোখের সামনে এলো? তখন সে তৃষ্ণার্ত। কাহিল তার চাওনি। নতজানু হলো সংযম ধরে রাখার সমস্ত প্রচেষ্টা। অস্থির হয়ে জানতে চাইলো তার প্রিয়দর্শিনীর কাছে,
“ডু ইউ নো হাউ পেইশেন্ট আই অ্যাম?”
উত্তর তো আরশির ঠোঁটের আগায়। তবুও গলা চিড়ে কথা বেরোয় না। কোনোমতে ওপর নিচ মাথা নাড়তেই কানে এসে পৌঁছালো শেহজাদের পুরু স্বর, লাজহীন স্বীকারোক্তি,
“গুড! কারণ উইথ ইন ফাইভ মিনিটস, তোমার মনে হবে আমার একটুও ধৈর্য নেই! লজ্জা নেই! লেহাজ নেই! পারবে না এই বেলেহাজ আমিটাকে সহ্য করতে?”
শেহজাদ হয়তো উত্তরের আশা করছিল। কিছু একটা বলুক আরশি। না হয় সম্মতির ইশারা দিক তাকে! এবারটায় অন্তত মিলেমিশে একাকার হয়ে যাক তারা।
কিন্তু বরাবরের মতোই শেহজাদের এমন প্রশ্নের সামনে কথা গুলিয়ে ফেললো আরশি! অসহায় হাওয়া গিললো। শুকনো ঢোকের সাথে গিলে নিতে চাইলো গলার কাছে দলা পাকানো ঐ ভয়টুকু। কিন্তু পারলো না! জড়ের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়! শিশির ভেজা ভোরের মতো স্নিগ্ধ মুখটা হয়ে রইলো তটস্থ, ভীত।
তবে সামনে দাঁড়ানো মানুষটা যে স্থৈর্যহীন। ইস্পাত-দৃঢ় বাহুডোরে আরশিকে লুফে নিতে গেলেই ভয়ে দুকদম পিছিয়ে গেলো মেয়েটা।
মিনিটখানেক হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শেহজাদ। মূহুর্তেই কেঁপে উঠলো তার দৃঢ় চোয়াল। কঠোর হলো চিবুক। তার শ্যেনদৃষ্টি আরো যেনো জড়সড় করলো আরশিকে।
আবার সেই আড়ষ্টতা? ঘন কালো ভ্রুজোড়ার মাঝে ভাজ পড়লো শেহজাদের। কিছু একটা ভেবে নিজে থেকেই পিছিয়ে গেলো। তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো নিঃশব্দে। মেঝেতে দৃষ্টি ফেলে বললো,
“একটা শেষ উপকার করবে আমায় আরশি?”
মেয়েটা প্রশ্নচোখে তাকাতেই মাথা তুললো শেহজাদও। মেঘমন্দ্র স্বরে আওড়ালো,
“আর কক্ষনো এসো না আমার সামনে! প্লিজ!”
আরশির পৃথিবীটা হয়তো থেমে গেলো একমুহূর্তের জন্য৷ আর কক্ষনো সামনে আসবে না মানে? তাহলে কোথায় যাবে ও?
মানুষটা দাঁড়ালো না আর। তবে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই প্রশ্ন ছুড়লো আরশি। স্বচ্ছ দীঘির মতো নিটোল চোখে উপচে পড়া অভিমান নিয়ে আওড়ালো,
“কেনো আসবো না আমি আপনার সামনে?”
শেহজাদের ভারি রাগ হলো এবার। কিন্তু স্বভাবসুলভ রাগটা প্রকাশ করতে দিলো না ভিতরের আদর আদর ভালোবাসাটুকু। আরশির জন্য জমা হওয়া একবুক অনুযোগ বুকেই চাপা পড়ে রইলো তার!
অথচ গম্ভীর গলায় কটাক্ষ করে আওড়ালো,
“সেটা তো তুমিই ভালো বলতে পারবে আরশি!”
নিটোল চোখ অশ্রুসিক্ত হলো আরশির। গাঢ় বিষাদের ছায়া পড়লো অন্তঃকরণজুড়ে। তার মানে মনে মনে যা সন্দেহ করেছিল সেটাই সঠিক। প্রতিবার আরশির পিছিয়ে যাওয়াই কি শেহজাদের এতো রাগের কারণ?
প্রফেসর ফের একবার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে বলিষ্ঠ হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো ও। খুব অভিমান করে বলতে চাইলো,
“আপনি তো ভালোবাসি বলেই খালাস! ভালোবাসলে তার ভালো মন্দ সবটা নিয়ে তাকে ভালোবাসতে হয়! তাকে বুঝতে না পারলেও অন্তত বোঝার চেষ্টা করে যেতে হয়! অথচ আপনি শুধু বারবার আমার পিছিয়ে যাওয়াই টাই দেখলেন! কেনো পিছিয়ে যাই, সেটা একবারও জানতে চাইলেন না! কেনো বলুন তো?”
এই যে এতো এতো শব্দ! একটাও কি মুখ ফুটে বলতে পারলো আরশি? পারলো না! শেহজাদের হাত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো কেবল। অভিমানি পায়রাগুলো বৃষ্টি হয়ে গাল ভেজাল। তবুও মন গললো না শেহজাদের। শক্ত মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কপালে ভাঁজ ফেলল। ঠান্ডা গলায় দায়সারা ভাবে বলে উঠলো,
“হাত ছাড়ো আরশি! আমার লেইট হচ্ছে!”
আরশি উঠে যাওয়ার পরপরই একপ্রস্ত হাসাহাসিতে লুটিয়ে পড়লো সবাই। হাসান ভিলার খাওয়ার টেবিল, বাড়ির দেয়াল খিলখিল শব্দে মুখর হলো।
কিন্তু এতো হাসিঠাট্টার মধ্যেও জারার নীলাম্বর জুড়ে রাজত্ব চালালো এক প্রাঞ্জল মুখশ্রী। দৃষ্টিতে লজ্জার ফুলঝুরি ছোটায় যার বলিষ্ঠ গড়ন, প্রখর ব্যক্তিত্ব! আবার একপশলা বৃষ্টির মতো মনকে শীতল করে দিয়ে যায় যার দুষ্টুমিগুলো! তার দিকে প্রেমের মদিরা চোখে নিয়ে চেয়ে রইলো জারা।
হুট করেই আয়ানের সাথে চোখাচোখি হলো! আরক্ত মুখখানা কুন্ঠায় নেমে এলো নিচে। প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে নিম্নাষ্ঠ কামড়ে হাসলো আয়ান। কিছু বলতে যাবে তখনই শুনতে পেলো সিঁড়ি ভেঙে কারোর নেমে আসার শব্দ।
সহসা থেমে গেলো সকলের হর্ষধ্বনি। অক্সফোর্ড জুতোয় আওয়াজ তুলে নেমে এলো একখানা দৃপ্ত মুখ। দৃঢ় গড়ন! গুরুতর কিছু যে হয়েছে তা যেনো শেহজাদের থমথমে চেহারা দেখেই সবাই আন্দাজ করে ফেললো।
মরিয়ম বেগম ভিতরের উৎকন্ঠা টুকু চেপে রেখে সহাস্যে শুধালেন,
“একা যাবি নাকি? আরশি যাবে না তোর সাথে? ও রেডি হয়েছে?”
শেহজাদ উত্তর দেয়ার আগেই গুমোট পরিবেশ ভেঙে নিচে নেমে এলো আরশি। তার টিকালো নাক, ভাসা ভাসা চোখ টইটম্বুর বালিকাসুলভ দুঃখে।
ভেজা অক্ষিপট আর গালে কান্নার চিহ্ন স্পষ্ট।
মেহমেদ হাসানের মতো হাসিখুশি মানুষটাও এবার গম্ভীর হলেন। ছেলেকে শাসন করার সুরে বললেন,
“শেহজাদ! আরশি মা কাঁদছে কেনো? কী বলেছো তুমি ওকে?”
উচ্চবাচ্য, চিৎকার, চেচামেচি কোনোটাই তার ধাতে নেই! রেগেও যান না খুব একটা! অথচ আজ ছেলেকে তার এই ডাকনাম বিহীন সম্বোধনে কিছুটা ভড়কে গেলো সবাই। একমাত্র নির্বিকার রইলো শেহজাদ। তারপর কারোর কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।
মিনিটখানেক তব্দা খেয়ে শেষমেশ উঠে দাঁড়ালো আয়ান। মেহমেদ হাসানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি দেখছি আঙ্কেল! আপনি চিন্তা করবেন না!”
মাথা নোয়ালেন মেহমেদ। এক টুকরো প্রলম্বিত শ্বাস বেরিয়ে এলো প্রৌঢ় বুক চিড়ে। ছেলের এই জেদ, এই রাগ কি কোনোদিন ঠিক হবে না?
আয়ান দেরি করলো না। এক পল জারাকে দেখে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পিছু ডাকলেন মরিয়ম।
মায়ের মন! স্বভাবসুলভ চিন্তার ভারে রুদ্ধ তার গলার স্বর! তবুও কাতর কন্ঠে বললেন,
“শায়ানটার সাথে একটু থাকিস বাবা! মাথা গরম হলে কখন কী করে বসে ঠিক নেই! একের পর এক এতো ঝড়ঝাপটা যাচ্ছে ছেলেমেয়ে দুটোর উপর থেকে…”
বাকি কথাগুলো আর শুনতে পেলো না আরশি। একটা বিষন্ন সুর হুহু করে উঠলো বুকের ভিতর।
হাসান ভিলার সুখ সুখ বাতাসে ভাসতে থাকা এতক্ষণের আনন্দ, হাসি, ঠাট্টা ম্লান হয়ে গেলো ঐ উদ্বিগ্ন মুখগুলোর আড়ালে।
সকালের সেই ঝলমলে রোদের গায়ে চাদর জড়িয়েছে মেঘমল্লার। তুষারপাতের বদলে ধূসর অম্বরের বুক চিড়ে নেমেছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। নিউইয়র্কের ব্যস্ত নগরীতে ছড়িয়ে দিয়েছে হাড়হিম করা ঠান্ডা, শীত শীত আবহ।
শেহজাদের কালো মার্সিডিজ বেঞ্জ ব্র্যান্ডের গাড়িটা সদর্পে দাঁড়িয়ে পিচ ঢালা রাস্তায়। রাস্তার দু’পাশেই বরফের স্তুপ। ভারী স্বাস্থ্যের একজন ফিরিঙ্গি মতোন লোক তটস্থ হয়ে টিন্টেড গ্লাসে লেগে থাকা বৃষ্টির পানি মুছছেন। উনি এ বাড়ির পুরোনো ড্রাইভার! মিস্টার রবিনসন ক্রুসো!
নাম মাত্র পদবিটাই সযত্নে আগলে রেগে এখনো টিকে আছেন এ বাড়িতে। এ বাড়ির মানুষগুলো এতো ভালো, যে অবসর নিতে চাইলেও মন সায় দেয় না রবিনসনের। যদিও খুব একটা জরুরত না হলে, গাড়িও চালাতে হয় না তাকে।
যেমন আজকেও হলো না। শেহজাদ আসতেই গাড়ির চাবিটা এগিয়ে দিলেন রবিনসন। বৃষ্টিতে ভিজে গেছে শেহজাদের ছাই রঙা উলের ওভারকোট। ফোঁটা ফোঁটা স্বচ্ছ জলকণারা আসন পেতেছে শক্তপোক্ত আননজুড়ে। সিক্ত করেছে ঘন কালো চুল। তবুও সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মানুষটার। চাবি হাতে গাড়িতে উঠে বসা অব্দি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন রবিনসনও।
কিন্তু হুট করেই কারোর গলার আওয়াজে আঁতকে ওঠেন তিনি। মোটা গোঁপের আড়ালে চিহ্ন ফেলে স্পষ্ট বিরক্তি। ঢলঢলে মুখটা ঘোরাতেই দেখতে পেলেন চেঁচাতে চেঁচাতে গাড়ির কাছে দৌঁড়ে আসছে পুলিশের ইউনিফর্ম পরিহিত এক লোক। এসেই লাফিয়ে উঠে পড়লো শেহজাদের গাড়িতে।
রবিনসন বিব্রত হলেন খানিক। ওঠার ধরন দেখেই চিনে ফেললেন যে ইনি শেহজাদের বন্ধু। কিন্তু স্যারের মতো শান্তশিষ্ট একজন মানুষের ভাগ্যে এমন লাফঝাঁপ দেয়া বন্ধু কি করে জুটলো সেটাই যেনো ভেবে পেলেন না ভদ্রলোক।
আয়ানকে লাফিয়ে উঠতে দেখেই কটমটে চোখে তাকালো শেহজাদ। গুরুগম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো,
“এখানে কী চাই?”
আয়ান সবে মাত্র কায়দা করে বসেছে সিটে। দৌঁড়ে আসায় শ্বাসের গতি উর্ধ্বে। তবুও ধাতস্থ হয়ে বললো,
“বউ চাই! প্লিজ ভাই! বিয়ে করিয়ে দে আমাকে আমার বাটারফ্লাইয়ের সাথে। আর কতকাল এমন অবিবাহিতদের মতো কাপলদের মান অভিমান দেখবো বল তো? নিজেরও তো একটু করতে ইচ্ছে করে নাকি?”
শেহজাদ ফের একবার ঐ তপ্ত চোখে চাইতেই তাড়াহুড়ো করলো আয়ান। হড়বড়িয়ে বললো,
“আ- আই মিন ‘মান অভিমান’! তোদের এমন ‘হাম তুমহারে হ্যায় কোন’ টাইপ রাগারাগি দেখলে মনে চায় বিয়েটা এখনই করে ফেলি!”
পরপর প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বললো,
“শুধু ব্যস্ততার জন্যই হচ্ছে না! নয়তো এতোদিনে আমার বাচ্চাকাচ্চা দিয়ে তোকে এ্যানাকোন্ডা চাচা ডাকাতাম! তোকে দেখলেই ওরা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতো আর বলতো, আব্বু এ্যানাকোন্ডা চাচা এসেছে!”
“তুই নামবি গাড়ি থেকে! না আমি ছুড়ে ফেলে দেবো তোকে?”
শেহজাদের ছুড়ে ফেলে দেয়ার হুমকি খুব একটা গায়ে মাখলো না আয়ান। সে আরাম করে বসে বললো,
“বললেই হলো নাকি ‘ছুড়ে ফেলে দেবো’? ঐটুকু মাসলের জোর দেখাও তুমি? দুদিনের বৈরাগী! পোলাও রে বলো ফ্রাইড রাইস? শোন শায়ান! এই আমি গাড়িতে বসলাম! এখন দেখি তুই কিভাবে আমাকে ঠেলে ফেলিস!”
আয়ানের প্রগলভতায় অতিষ্ঠ শ্বাস ফেললো শেহজাদ। কতক্ষণ ফুঁসে থেকেও দেরি হয়ে যাচ্ছে ভেবে গাড়ির চাবি ঘোরালো। দাঁতে দাঁত পিষে অফিসারকে নিয়েই রওনা হলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।
আয়ানের চোখেমুখে লেপ্টে রইলো যুদ্ধজয়ের হাসি।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই স্বগোতক্তিতে শুধালো,
“এবার বল! এতে রেগে আছিস কেনো? ভাবির সাথে কিছু…হয়েছে?”
আয়ান প্রশ্ন করেও পড়লো মুসিবতে। শেহজাদের গম্ভীরতা যেনো আরো বাড়লো। গাড়ির ভিতর নিজেরই হাঁসফাঁস লাগলো ওর। পরপর বিরক্ত স্বরে বলে উঠলো,
“এই ব্যাটা! তোর সমস্যাটা কী? বোবায় পাইছে তোরে?”
আয়ানের ভাষার এমন ব্যবহারে কিছুটা ভড়কালো শেহজাদ। ঠান্ডা গলায় বললো,
“ঠিক করে কথা বল আয়ান! বোবায় পাইছে আবার কী ভাষা?”
আয়ান কিছু একটা বলতে গিয়েও ঠোঁট টিপলো। মুখে আসা অশিষ্ট গালিটুকু হজম করে আওড়ালো,
“শোন শায়ান! আমি না তোর স্টুডেন্ট নই! আমি তোর বন্ধু। অতো তেল দিয়ে কথা বলা আমার পোষাবে না। শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, কি হয়েছে বল! নয়তো আবারও ভাষার অপপ্রয়োগ ঘটে গেলে আমাকে দোষ দিতে পারবি না কিন্তু বলে দিলাম!”
অগত্যা হাল ছেড়ে দিলো শেহজাদ। এতক্ষণের কুঁচকে থাকা কপাল মসৃণ হলো ধীরে ধীরে। তারপর দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে বললো,
“সমস্যাটা মনে হয় আমি! আর আমাদের হিউজ এজ গ্যাপ! আই থিঙ্ক, এই একটা কারণেই আরশি আমাকে এত ভয় পায়!”
বাকিটা আর বুঝিয়ে বলতে হলো না আয়ানকে। বন্ধুর দুঃখে সেও যে সমান দুঃখী এমন মুখ করে জিজ্ঞেস করলো,
“তোদের এজ গ্যাপ কত বছরের?”
“দশ-বারো? মনে হয়! শিওর বলতে পারছি না!”
আঁতকে উঠল আয়ান। ততধিক বিস্ময় নিয়ে চাইলো শেহজাদও। হাওয়া গিলে শুধালো,
“অনেক বেশি? না রে?”
অবলা বন্ধুটির দিকে ক্ষীণ কাল বিস্ময়ভূত হয়ে চেয়ে থেকে শ্বাস ফেললো অফিসার। তারপর আহত স্বরে আওড়ালো,
“এই চিনিবাবার যুগে বউকে চুমু না খেয়ে তুমি দশ-বারো বছরের এজ গ্যাপ নিয়ে সেন্টি খাচ্ছো মিয়া? ফাজলামো করো আমার সাথে? আমার কাউন্সিলিং এর কোনো দাম নেই না?”
শেহজাদ ফের তপ্ত চোখে তাকাতেই মেকি রাগ টুকু ধরে রাখার বদলে হেসে ফেললো আয়ান! নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
“আচ্ছা বেশ! মজা করছিলাম! এখন আসল কথায় আসি! তারমানে তুই এই সামান্য বিষয় নিয়ে আরশিকে বকেছিস?”
স্বভাবে চুপচাপ শেহজাদ আরো খানিকটা নীরব হতেই আয়ান নড়েচড়ে বসলো। বিজ্ঞের ন্যায় মাথা নেড়ে বললো,
“টেনশন করিস না! মেয়েদের রাগ বেশিক্ষণ থাকে না। আর সুন্দর ছেলেদের উপর তো আরোই রাগ করে থাকতে পারে না। এই যেমন আমি! কখনো দেখেছিস বাটারফ্লাই আমার উপর রাগ করে আছে?
অবশ্য তোর কথা ভিন্ন!”
শেহজাদের মসৃণ কপালে ফের ভাজ পড়লো। আয়ানের দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে শুধালো,
“তুই কি আমাকে ঘুরিয়ে পেচিয়ে অসুন্দর বললি?”
“নাহ! আমি ঘুরিয়ে পেচিয়ে নিজেকে সুন্দর বলেছি। যাকগে! ওসব বাদ। আগে তুই বল, আরশিকে সরি বলছিস কখন? বেশ হাঁটু গেড়ে বলবি কিন্তু! মনে থাকবে?”
শেহজাদ চোখ ফেরালো রাস্তায়। স্টিয়ারিং হুইলে মনোযোগ রেখে অপ্রস্তুতে বলে উঠলো,
“আমি? আমি কেনো সরি বলবো ওকে?”
আয়ানের দৃপ্ত চোখে-মুখে ঠিকরে এলো অবিশ্বাস! কন্ঠ শৃঙ্গে তুলে শুধালো,
“ভালোবাসিস! অথচ বউকে হাঁটু গেড়ে সরি বলতে পারবি না?
“না!”
আয়ানের মেজাজ খারাপ হলো এবার। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪০
“সেই তো! তুই কেনো সরি বলবি? সরি বলবে আমার মতো হ্যান্ডসাম, সুন্দর ছেলেরা। তুই তো আর সুন্দর নস। তুই হলি জাম্বুবান, আদা ছেঁচা, এ্যানাকোন্ডা! যতসব বিচ্ছিরি জিনিস! ইয়াক!”
কথাগুলো বলে আয়ান যথাসম্ভব মুখ ভার করে রাখার চেষ্টা করলো। শেহজাদ চোখ গরম করে আয়ানের থমথমে মুখের দিকে তাকাতেই মানুষটা আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না। হো হো করে হেসে উঠলো শেহজাদের পাশে বসে।
বন্ধুর সংক্রামক হাসির উপসর্গ দেখা দিলো শেহজাদের পাতলা অধরজোড়ায়ও। সময় যেতে যেতে দুই বন্ধুর হাস্যকল্ললে হারিয়ে গেলো মন খারাপের গানগুলো।
বিষন্ন বৃষ্টির সকালটাও হেসে উঠলো তাদের সাথে সাথে!