নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪৩
সিনথিয়া
শেহজাদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হলো সেদিন। ধূসর মেঘের আড়ালে রূপোলী চাঁদটা যখন ঘুমের কোলে পাড়ি জমানোর পায়তারায় তখন হাসান ভিলার সদর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে শেহজাদ।
ক্লান্ত অবসন্ন আদলের দীপ্তমান চোখগুলো খুঁজে ফিরলো একটা পরিচিত মুখ। অথচ যাকে খুঁজছে তার টিকিটিও নেই পুরো বসার ঘরে।
অগত্যা অনুতাপের পোড়া শ্বাস পেছনে ফেলে সিড়ি ভেঙে উপরে উঠলো মানুষটা। কিন্তু বেডরুমের দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখ চলে গেলো বিছানায়। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠলো সেখানে শুয়ে থাকা অবয়বটি।
শেহজাদ মাথা নোয়ালো। আনত মুখের রক্তিম ঠোঁটজোড়া বিস্তৃত হলো দুদিকে।
নিঃশব্দে হাসলে আরশির পাষাণ পুরুষ।
প্রিন্সিপালের জরুরী তলবে সন্ধ্যের আগে ফিরতে না পারার বিষাদটুকু মূহুর্তেই উবে গেলো মন থেকে।
বরং প্রিয়দর্শিনীর অভিমান ভাঙাতে সেখানে এসে নোঙর ভেড়ালো প্রেম প্রেম অনুভূতি।
নীল চোখের মানুষটা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো বিছানার কাছে।
ডিভানের ওপর ছুড়ে ফেললো পরনের ওভারকোটখানা। আলো-আঁধারির মাঝে দৃশ্যমান হলো টার্টলনেক সোয়েটারে তার আঁটসাঁট হওয়া বলিষ্ঠ গতর।
খানিকটা সংশয় নিয়ে ধীরে ধীরে বিছানার পাশে বসলো সে। আন্দাজ করতে চাইলো আরশি ঠিক কতটুকু অভিমান করে আছে তার উপর। প্রেম সে এ জীবনে করেনি! আর করলেও প্রেয়সীর রাগ ভাঙানোর মতো ফুরসত হয়তো পেতো না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তাই আন্দাজের ফলাফল শূন্যে গিয়ে ঠেকে
দোহারা চেহারায় ফুটে উঠলো স্ত্রীর প্রতি জমে থাকা অনুরাগ। কিঞ্চিত বিদ্রুপ মিশিয়ে নিচু স্বরে আওড়ালো,
‘হঠাৎ আজ এতো তাড়াতাড়ি পাশ ফিরে কম্বল মুড়ি দিয়েছেন কেনো? সকালে ওভাবে বলেছি বলে আমার মুখ দেখবেন না, এমন কোনো পণ করলেন নাকি?’
আরশির সাড়াশব্দ নেই। শেহজাদের কথাগুলো তার কর্ণকুহর অব্দি পৌঁছোলো কি না, সে প্রশ্ন বাহুল্য! শেহজাদের গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্ব বিচলিত হলো আরশির একটুখানি ফিরে চাওয়ার আশায়। ছটফট করলো ভিতর ভিতর।
আয়ান বলেছে মেয়েরা নরম মনের হয়! বেশিক্ষণ রেগেটেগে থাকতে পারে না! অথচ তার বউ কিনা ফিরেও চাইছে না তার দিকে? এ কেমন ধারা ব্যবহার?
মসৃণ ললাটপটে ভাজ পড়লো শেহজাদের। কম্বলের উপর থেকে আরশিকে ছুঁতে গিয়েও গুটিয়ে ফেললো হাতখানা। খানিক অনুযোগের স্বরে বললো,
‘আমি জানি তুমি ঘুমোওনি! দেরি করে এসেছি বলে ইচ্ছে করে আমাকে ইগনোর করছো তাই না?’
এবারেও অপরপাশে বিরাজ করলো নীরবতা। বিরান বাতাসে মিশে গেলো শেহজাদের পৌরুষ কন্ঠ।
স্ত্রীর অভিমান ভাঙার অপারগতা মেনে নিতে না পেরে উদ্ধত হলো মন। বেলেহাজ স্বরে বলে উঠলো,
‘ইফ ইউ থিঙ্ক এভাবে আমার থেকে পালিয়ে বেড়াবে দ্যান লেইট মি ক্লিয়ার ইউ! আমি কিন্তু অতোটাও জেন্টেলম্যান নই!
আমি এক থেকে তিন গুনবো! আর এই তিন গোনার মধ্যে কম্বল না সরলে আগামী এক সপ্তাহ ঘরের বাইরে যাওয়ার মতো অবস্থা থাকবে না তোমার! এন্ড বিলিভ মি অর নট জান! হোয়াট আই হ্যাভ সেইড দিস টাইম, আই উইল ডু!’
তখনো নিরুত্তাপ রমনী। স্বভাবসুলভ কাঁপাকাপিটুকু পর্যন্ত নেই। তবে কি সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লো আরশি?
ভাবনার ইস্তফা ঘটাতেই ভারী শোনালো শেহজাদের কন্ঠস্বর। থেমে থেমে গুনতে শুরু করলো সংখ্যাগুলো,
‘এক…দুই..’
এ পর্যায়ে শেহজাদ থামলো। আরশি এখনো উঠছেনা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো! তবে যেই না তিন গুনতে যাবে তখনই ভূত দেখার চমকালো সে। থমকে গেলো গলবিল। বিদুৎস্পৃষ্টের ন্যায় দাঁড়িয়ে কোনোরকমে হাতড়ে টিপলো বেডসুইচটা।
বাতি জ্বালাতেই সম্মুখে দৃশ্যমান হলো কম্বল জড়িয়ে বসে থাকা থমথমে গড়ন। কাঁচাপাকা চুল আর গোঁফ।
শেহজাদ কথা হারিয়ে ফেলেছে। তাকে ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেহমেদ হাসান বলে উঠলেন,
‘এইজন্য আমি ভাবি আরশি মা তোমাকে পছন্দ করে না কেনো? অসভ্য বেয়াদপ ছেলে! বাবাকে এক সপ্তাহ রুম থেকে বেরোতে দেবে না তুমি? ইয়ার্কি করার জায়গা পাও না তাই না?’
শেহজাদের ঠোঁটজোড়া ফাঁক হয়ে আছে বিস্ময়ে। থতমত ভাবটা গিলে বিমূঢ় স্বরে শুধালো,
‘তার আগে বলো তুমি এ ঘরে কী করছো? আর আরশি কোথায়?’
মেহমেদ ভ্রু গোটালেন। গোলগাল নাদুসনুদুস চেহারায় মন খারাপের ছটা। বিষন্ন গলায় আরেকদিকে ফিরে বললেন,
‘আরশিকে তোমার মা সাথে নিয়ে ঘুমিয়েছেন! আগামী কয়েকদিন নাকি সে আরশির সাথেই ঘুমোবে!’
মায়ের হঠাৎ এমন চাওয়ার মানে শেহজাদ ঠিক ধরতে না পেরে বাবার ওপর বিরক্তি ঝেড়ে বলে উঠলো,
‘আশ্চর্য! মা চাইলো আর তুমি চলে এলে এ ঘরে?’
মেহমেদ হাসান খানিকটা ক্রোধ নিয়েই ঘুরে তাকালেন এবার। ছেলের দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে বললেন,
‘আশ্চর্য? এখানে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? বাপ ছেলে কয়েকদিন একসাথে ঘুমোতে পারবে না? আমাকে এতোটাই পর ভাবো তুমি? ভাববেই তো! একদম মায়ের মতো হয়েছো কি না!’
মেহমেদ হাসানের উচ্চবাচ্যে আর কিছু বললো না শেহজাদ। দম ফেলে বুঝে নিলো যা বোঝার।
কাবার্ড থেকে টাওয়াল আর গ্রে ট্রাউজারটা বের করে এগোলো ওয়াশরুমের দিকে।
কিন্তু দরজার কাছাকাছি গিয়ে কিছু একটা ভেবে হুট করেই থামলো সে। বিছানায় থম মেরে বসে থাকা মেহমেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘তুমি আর মা ঝগড়া করেছো! ফাইন! কিন্তু ঝগড়া করে আমার বউ নিয়ে যেভাবে টানাটানি করছো দ্যাটস্ রিয়্যালি চাইল্ডিশ!’
মেহমেদ আনত মুখে গম্ভীর হয়ে বললেন,
‘চাইল্ডিশ কাজগুলো তোমার মা করছে। রাগ করে রুম থেকেই বের করে দিয়েছেন আমাকে তিনি।’
সবটা শুনে শেহজাদ মেকি হতাশ স্বরে আওড়ালো,
‘দ্য গ্রেট বিজনেস ম্যান মেহমেদ হাসান নিজের বউয়ের মান ভাঙাতে পারছে না? হাউ শেইম ফুল! যাই হোক! শোনো! তুমি আর মা যা খুশি করো, কিন্তু সুন্দর মতো আমার বউকে আমার রুমে ফেরত দিয়ে যাও! আমি আবার বউ ছাড়া রাতে ঘুমাতে পারি না!’
মেহমেদ তপ্ত চোখে চেয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লেন,
‘কেনো? আমি ঘুমোতে পারলে তুমি পারবে না কেনো?’
শেহজাদ ঠোঁট উল্টে জানালো,
‘মেইবি শি স্পয়েল্ড লিটল টু মাচ?’
মেহমেদকে বিব্রত করে ঠোঁট টিপে হাসলো শেহজাদ। ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার ট্যাপ অন করে চড়া গলায় বললো,
‘এখন তোমাকে যেটা বললাম সেটা তাড়াতাড়ি করো! বের হয়ে যেনো না দেখি তুমি এখনো এখানে বসে আছো!’
মেহমেদ হাসান দায়সারা জবাবে বললেন,
‘তোমার মায়ের রাগ কি করে ভাঙাবো? সে তো তাকাচ্ছেও না আমার দিকে!’
‘বি অ্য ম্যান ডেড! বউয়ের রাগ কি করে ভাঙাবে সেটাও এখন আমি বলে দেবো?’
ছেলের কথা মেনে নিয়ে তিনি ‘বি অ্য ম্যান’ হতে গিয়েও কেনো যেনো হতে পারলেন না! শেহজাদ যতক্ষণ শাওয়ার নিলো ততক্ষণ থম মেরে বসে রইলেন বিছানায়।
শেহজাদ একহাতে চুল মুছতে মুছতে যখন বের হলো তখনও মেহমেদ বসে আছেন। তাকে দেখে ভ্রুকুটি করলো শেহজাদ। উদোম বুকে হাত বেঁধে জিজ্ঞেস করলো,
‘তুমি এখনো এখানে বসে আছো? যাওনি মায়ের কাছে?’
মেহমেদ হাসান চোখেমুখে তীব্র অসন্তুষ্টি নিয়ে বললেন,
‘আমার মনে হয় তুমি আগেই ভালো ছিলে। অন্তত কথা কম বলতে। তোমাকে হুট করে এতো কথা বলতে দেখে আমার বিপি বেড়ে যাচ্ছে! ইউ নিড টু টক লেস ফ্রম নাও অন শায়ান!’
বাবাকে প্রসঙ্গ পাল্টাতে দেখে খুব একটা অবাক হলো না শেহজাদ। বরং গম্ভীর গলায় শুধালো,
‘ডিনার করেছো? নাকি আমি খাবার গরম করে দেবো?’
ছেলের প্রশ্রয়ের সুরে গলে গেলেন মেহমেদ। উঠে দাঁড়িয়ে গলা পরিষ্কার করে বললেন,
‘থাক অতো আদর দেখাতে হবে না! চলো দেখি তোমার মা ঘুমিয়েছেন কি না! তারপর আরশি মাকে নিয়ে এসো এই রুমে! নয়তো আবার বলে বসবে আমার জন্য তোমার রাতের ঘুম হয়নি! দিনদিন তো অসভ্যের চূড়ান্ত হচ্ছো!’
ড্রইং রুমের দেয়ালে লাগানো ভিনটেজ ঘড়িটায় রাত তখন দেড়টা। এই সময় জাগতিক সকল প্রাণী ঘুমের দেশে থাকলেও হাসান ভিলার প্রধান কর্তা স্ত্রীর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে নখ কামড়াচ্ছেন।
পিছনে বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে শেহজাদ। কারণ মেহমেদ যতটা সাহসের সাথে বগলদাবা করে ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন, এখন সে ততটাই আতঙ্কগ্রস্ত।
বাবার এই ভয় বাতিক সম্পর্কে শেহজাদ আগে জানতো না। জানলে অন্তত একে সাথে করে সে এখানে বউ নিয়ে যেতে আসতো না।
মেহমেদ হাসান স্ত্রীর রুদ্র মূর্তির ভয়ে না নিজে ঢুকছেন না শেহজাদকে ঢুকতে দিচ্ছেন ঘরের ভিতরে।
কারণ জানতে চাইলেই অশান্ত স্বরে বলে উঠছেন,
‘আহ! দে-দেখছো না? মেডিটেশন করছি? মেডিটেশন শেষ হোক! তারপর ঘরে ঢুকবো!’
শেহজাদ বুঝলো বাবার ভয় বাতিকের সাথে মিথ্যে বলারও বাতিক রয়েছে। যদিও মিথ্যেটা সে গুছিয়ে বলতে পারে না। দশবার তুতলে একটা মিথ্যে বলে।
শেহজাদ দম নিলো। নিজেকে শান্ত করে দীর্ঘ এক শ্বাস ফেললো। তারপর আস্তেধীরে রুমের ভেড়ানো দরজা খুলে শব্দহীন ঢুকে পড়লো ভিতরে।
ছেলের সাহস দেখে আঁতকে উঠলেন মেহমেদ। গলার স্বর নামিয়ে বললেন,
‘আশ্চর্য! যার সাথে এসেছো তাকে ফেলেই চলে যাচ্ছো? দাঁড়াও বলছি!’
শেহজাদ দাঁড়ালো না। অশান্ত পা ফেলে এগিয়ে গেলো বিছানার কাছে।
মরিয়ম বেগমের পাশে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকা মেয়েটার মেদুর মুখে তাকিয়ে ভাজ ফেলা কপাল মসৃণ হলো তার। হৃদ প্রকোষ্ঠে একমুঠো প্রশান্তির হাওয়া বইতেই শীতল হলো উদ্বেগ।
স্মিত হাসলো মানুষটা। কিন্তু স্নোবলকে দেখেই ফের ভ্রু গোটালো শেহজাদ। কেমন বুকের মধ্যে মিশে আছে তার প্রিয়দর্শিনীর?
শুনেছে রাতের বেলা খরগোশরা সবচেয়ে বেশি এ্যাক্টিভ থাকে। আর এই বেটা কী সুন্দর নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে? অথচ সে কি না বউয়ের অভাবে ঘুমোতে পারছে না?
শেহজাদের ভারী রাগ হলো। পলক ফেলার আগেই স্নোবল আর মরিয়ম বেগমের মাঝখান থেকে দুবাহুর ওপরে তুলে নিলো আরশিকে।
নিজের উদোম বুকের সাথে ঘুমন্ত প্রণয়িণীকে মিশিয়ে স্নোবলের দিকে তাকিয়ে জিভ বের করলো। নিজের গুরুগম্ভীর স্বভাবের খাতিরে পাওয়া উপাধিগুলো একলহমায় উধাও করে ভেঙিয়ে দিলো স্নোবলকে।
স্নোবল তখন ঘুমের ঘোরেই চিবুচ্ছে। খাওয়া-দাওয়া তার প্যাশন। সে খালি মুখে ঘুমের ঘোরেও খাবারের স্বপ্ন দেখে। সেখানে কে তাকে ভেঙালো, না ভেঙালো তাতে তার থোরাই কিছু এসে যায়?
অথচ শেহজাদের চোখেমুখে জিতে যাওয়ার ছটা। বীর মহিমায় বউকে নিয়ে পিছন ঘুরতেই দেখলো মেহমেদ হাসান দাঁড়িয়ে। ভীষণ বিস্ময়ে হাওয়ায় লটকে আছে তার চোয়াল। তার চাইতেও প্রবল বিস্ময়ে তিনি জানতে চাইছেন,
‘বাপ মায়ের রুমে এসে বউকে কোলে তুলে নিলে? আর ওটা কী করছিলে তুমি? স্নোবলকে ভেঙাচ্ছিলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?’
শেহজাদ নিরুদবিগ্নে জানালো,
‘বউকে কোলে তুলে নিলে হার্ট ভালো থাকে। চাইলে তুমিও তুলতে পারো তোমার বউকে! কিছুক্ষণ আগে বলছিলে না তোমার বিপি বেড়ে যাচ্ছে? রেমিডিটা ট্রাই করে দেখতো পারো! বিপি, হার্ট রেট সব নরমালে থাকবে!’
ছেলে তাকে একা পেয়ে যে ইচ্ছে করে এমন করছে, সে ভালোই ধরতে পেরেছেন মেহমেদ। নয়তো একাধিকবার করা প্রশ্নে যে শুধু হু-হা তে উত্তর দেয় তার এমন ধারা চৈতন্যের পরিবর্তন কি করে হলো সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দিহান মেহমেদ।
শেহজাদ তাকে বাকরুদ্ধ করে চলে যেতেই স্ত্রীর পাশে বসলেন তিনি। ছেলের কথামতো উদ্যত হলেন রেমিডি এপ্লাইয়ের কাজে। কিন্তু বেচারা হাজারখানেক দোয়া-দরুদ পড়ে স্ত্রীর গায়ে হাত রাখার আগেই তার রুহু কাঁপিয়ে মরিয়ম বেগম বলে উঠলেন,
‘খবরদার আমায় ছুঁয়েছো তো ছুড়ে ফেলে দেবো দোতলা থেকে!’
নিউইয়র্কের সুউচ্চ সব ইমারত ছাপিয়ে ভোরের প্রথম আলো এসে পড়লো আরশির স্নিগ্ধ মুখে। সুডৌল চিবুকের ভাজে আসন গাড়লো এক চিলতে মিষ্টি রোদ। শীতের প্রকোপ কমিয়ে ঘরজুড়ে ওম ছড়ালো সেই রোদটুকু। ক্রিড এভেন্টাসের উডেন ফ্রুটি গন্ধটা তার সাথে সখ্যতা জুড়লো সমান তালে।
পরিচিত ঘ্রাণে ঘুম ভাঙলো আরশির। এলোমেলো চুল আর ঢুলুঢুলু চোখে আশেপাশে চাইতেই প্রকট হলো অক্ষিপট। কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে ভাবতে লাগলো,
ঘুমের ঘোরে জাম্বুবানের ঘরে কি সে নিজেই হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে নাকি কাজটা অন্য কেউ করলো?
কিন্তু কে করতে পারে?
ভাবনার সুতো ছিঁড়ল বিছানা থেকে নামতে গিয়েই। ফ্লোর জুড়ে সহস্র গোলাপের পাপড়ি আর হার্ট শেইপ লাল টুকটুকে বেলুনে ডুবলো ওর ফর্সা পা জোড়া। থমকালো মেয়েটা।
অস্ফুটে আওড়ালো,
‘এসব..কী?’
আনত মুখটা তুলতে না তুলতেই আরেকদফা চমকালো আরশি। বিছানা থেকে একটু দূরেই একটা টি-ট্রলি।
সেখানের সাজানো গোছানো ব্রেকফাস্ট দেখে ভ্রান্তের ন্যায় উঠে দাঁড়ালো সে। গোলাপের পাপড়ি আর বেলুনে মোড়া মেঝেতে পা ফেলে ধীর ধীরে এগিয়ে গেলো টি-ট্রলিটার দিকে।
কেক-পেস্ট্রি কী নেই সেখানে। সাথে সুতো দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে আরো একটা হার্ট শেইপ বেলুন।
বেলুনের গায়ে স্টিকি নোটের সাথে লাগানো একটা খাম। স্টিকি নোটটাতে লেখা,
‘টার্ন অন দ্য সাউন্ড সিস্টেম আফটার রিডিং দ্য লেটার!’
‘লেটার?’
মনে মনেই যেনো নিজেকে প্রশ্নটা করলো আরশি।
পছন্দের সবগুলো খাবার টি-ট্রলিতেই পড়ে রইলো তার। খামটা হাতে সে এসে বসলো বিছানায়।
আন্দাজ করতে পারলো যদিও এসব কার কাজ, তবুও বুকের ভেতর লাফিয়ে বেড়ালো হৃদযন্ত্রটা। খাম খুলে চিঠিটা বের করলো রুদ্ধশ্বাসে। নিভৃতে পড়তে লাগলো গুটিগুটি অক্ষরে লেখা বিশাল চিঠিটা,
‘আজকের দিনটা ভীষণ আদুরে। খুব ইচ্ছে করছিল এই আদুরে দিনটায় আমি তোমাকে আমার গল্প শোনাবো।
তবে তুমি যদি আবার শুনতে না চাও, সেই ভয়তে শুভ্রফুলের জন্য শুভ্র কাগজে লিখে রেখে গেলাম গল্পটা।
আমি না কখনো প্রেম করিনি। শুরুতেই এমন একটা কথা! উইয়ার্ড রাইট? এবার কেনো করিনি তার কারণ শুনে হেসো না প্লিজ!
প্রেম করিনি কারণ, ভীষণ পড়ুয়া আমি পড়াশুনোর চাপে রিলেশনশিপ জিনিসটাকেই ইউজলেস ভাবতাম একটা সময়।
ক্যারিয়ার গোছানোর তাগিদে বিয়ে-থার ব্যাপারেও ছিলাম চূড়ান্ত রকমের উদাসীন। তারপর হঠাৎ একদিন মা-বাবা ধরে বেঁধে নিয়ে গেলেন বাংলাদেশে। আর জোর করে বিয়ে করিয়ে দিলেন যাকে ছোট থেকে অপছন্দ করতে করতে বড় হয়েছি তার সাথে।
যে মেয়েকে অতীত টেনে আমি প্রচন্ড রকমের অপছন্দ করতাম, তার সাথে হুট করে হওয়া এই বিয়েটাও মেনে নিতে পারলাম না। ফিরে এলাম ইউএস।
একদিন, দুদিন বেশ কাটলো।
এরপর থেকে যত দিন গেলো তত বাড়লো আমার অস্থিরতা। বারবার মনে হতো আমি আমার দায়িত্ব ফেলে এসেছি ওদেশে। অবশ্য তার পিছনে বড় একটা কারণ ‘মা’। দিনরাত শুধু একটাই কথা! কিভাবে আমার জন্য তার ছেলের বউয়ের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো, এক্সেটরা এক্সেটরা..!
অগত্যা বাসা ছাড়লাম। একা মানুষ। নিরিবিলি থাকার জন্য ভার্সিটির কাছে ছোট্ট একটা অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে উঠলাম। বেশ কেটে গেলো আমার রংহীন তিনটে বছর।
তারপর কোনো এক তুষার পড়া শীতের সকালে আমার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টটায় মা নিয়ে এলেন আমার লাইফের সবথেকে অপছন্দের সেই মেয়েটাকে। তাকে দেখেই মেজাজ হারালাম। মা চলে যেতেই তার মুখের সামনে তুলে ধরলাম একগাদা রুলসের ফরমান।
ইচ্ছে করেই করছিলাম সেসব। যাতে সে চলে যায়!
কিন্তু আমার এই ত্রিশ বছরের জীবনকে অবাক করে দিয়ে সেই মেয়েটা গেলো না। উদ্ধত আচরণ, আমার দেয়া সবরকমের কষ্ট সহ্য করে সে রয়ে গেলো আমার সাথে।
একবার কি হয়েছে জানো?
জানুয়ারীর এক রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো আমার! প্রচন্ড মাথা ব্যথায় বেহুঁশের মতো পড়ে রইলাম বিছানায়। আমার ভীষণ অপছন্দের সেই মেয়েটা এক অবাক কান্ড ঘটালো তখন!
ভয় পাওয়া সত্বেও মাঝরাতে আমার রুমে এসে হাজির তিনি। সে মাথার পাশে এসে দাঁড়াতেই কী করে যেনো কমে গেলো মাথার সেই তীব্র যন্ত্রণা। জ্বরের ঘোরে তাকে মনে হতে লাগলো ফ্রেডেরিক লেইটনের আঁকা ফ্লেমিং জুনের মতো। বিষাদিনী তবুও কি অদ্ভুত মায়া তার মুখে।
সে আমাকে করুনা করলো তার অধরসুধা পানের। আমিও মরিয়া হয়ে পান করলাম তা। নিমেষেই কমে গেলো আমার তীব্র জ্বর।
her kiss worked like medicine on me.
তারপর থেকেই যেনো আমার ব্যক্তিগত ফ্লেমিং জুন আমার এই কাঠ পাথুরে জীবনে বৃষ্টির মতো প্রেম আনলো।
আমিও সেই প্রেমের মদিরা পানের লোভে এই প্রথমবার প্রেমিক হলাম। তৃষ্ণার্ত আমাকে দিয়ে সে গোনাতে লাগলো অপেক্ষার দীর্ঘ একেকটা প্রহর। কতরাত নির্ঘুম কাটালাম শুধু ঐ মুখটা দু’সেকেণ্ডও চোখের আড়াল করবো না বলে।
অথচ সে তো জানতোই না। তাকে ছোঁয়ার তীব্র ইচ্ছায় প্রতিদিন কতভাবে নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করেছি আমি।
অবশেষে যখন অপেক্ষার প্রহর তার দীর্ঘতা হারাতে বসলো? আমরাও একটু আধটু কাছাকাছি হতে লাগলাম একে অপরের। আর তখনই যেনো নিজেকে আটকাতে হিমশিম খেলাম আমি।
আমার গভীর ছোঁয়ায় তার আড়ষ্টতা, ভয় দেখে নিজেকেই দোষী করলাম। অথচ নিজের ওপর হওয়া রাগটা ছুড়ে ফেললাম তার ওপর। না চাইতেও বলে ফেললাম কঠিন কিছু কথা। ফলস্বরূপ প্রশ্নবিদ্ধ হলো আমার প্রথম প্রেম! আমার ধৈর্যক্ষমতা।
জানো? আমি কিন্তু এতো অধৈর্য কখনোই ছিলাম না! অথচ এই চুয়াল্লিশ দিন দুইঘন্টা পনেরো সেকেন্ডে আমি কতবার যে ধৈর্য হারিয়েছি, সংযম ভেঙেছি তা কেবল আমি জানি।
আমাদের…না না আমার এই অল্প কদিনের প্রেমে গতকাল হুট করে আবিষ্কার করলাম আমি আমার ফ্লেমিং জুনের বার্থডে কবে সেটা জানি না!
তুমি ভাবতে পারছো?
কতটা রাগ লাগছিল নিজের ওপর তখন?
অবশেষে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যখন জানলাম তখন মনে মনেই হাসলাম তার বার্থডে এর দিন আর আমাদের ম্যারেজ এনিভার্সিরির দিনটা আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যাওয়াতে। আর আমিও যেহেতু তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য একটা সুযোগ খুঁজছিলাম! সেহেতু কি ধরে নেবো এটাই ডেস্টিনি?
ডেস্টিনি কি না জানি না, শুধু এটুকু জানি
প্রেমিক আর স্বামী হিসেবে বড় বড় শূন্য পাওয়া এই আমি আমার ফ্লেমিং জুনকে অনেকটা বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।
আই প্রমিজ! আমি আর তাড়াহুড়ো করবো না! যেটা সে ভয় পাচ্ছে, সে বিষয়ে তো একদমই না! রাগারাগিও করবো না। একদম লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকবো। আর শায়ান শেহজাদ যখন প্রমিজ করে, তখন সে কিন্তু তার প্রমিজ রাখতে জানে।
আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী! শুভ জন্মদিন স্নোবলের আম্মু! সাথে তিন বছর আমাকে সহ্য করে বিয়েটা টিকিয়ে রাখার জন্য বিবাহ বার্ষিকীর শুভেচ্ছা! অর মে আই সে হ্যাপি থার্ড এনিভার্সিরি মাই বিলাভড ফ্লেমিং জুন!
[নোট: ১. এবার কি অন্তত তার মান ভাঙবে? অভিমান ভুলে আমার সাথে একটু কথা বলা যাবে? যদি তার মান নাও ভাঙে তবুও যেনো সে আজ সন্ধ্যায় রুফটপে চলে আসে। কেউ একজন সেখানে অপেক্ষায় থাকবে তার জন্য। তার মান ভাঙানোর জন্য!
[নোট: ২. বেডের পাশে একটা গিফট রেখে গেলাম। খুব অপছন্দ না হলে সে সেটা পরতে পারে!]
ইতি
[তার অভদ্র জাম্বুবান]
চিঠিটা পড়া শেষ করতেই আরশি উপলব্ধি করলো সে কাঁদছে। ভেজা চোখে বার বার আবছা হয়ে যাচ্ছে সামনেটা। ঝড়া বেলীর গায়ে বৃষ্টির ফোঁটার মতো বড্ড স্নিগ্ধ লাগলো ওর সেই কান্না।
আরশি ভূতগ্রস্তের ন্যায় উঠে দাঁড়ায়। খোঁজে বিছানার পাশে রাখা গিফট বক্সটা। পেয়েও যায় একসময়। হাতে নিয়ে ওটা খুলতেই দৃশ্যমান হয় একটা নীল শিফনের শাড়ি। সাথে আরো একটা চিরকুট,
‘তোমাকে একদিন শাড়ি পরার জন্য বকেছিলাম! তাই গতকাল নিজে গিয়ে এই শাড়িটা কিনে এনেছি। সম্ভবত সেদিনও তুমি নীল শাড়ি পরেছিলে। আজ আবারও একবার পরবে প্লিজ? খুব জানতে ইচ্ছে করছে, নীল শাড়িতে আমার ফ্লেমিং জুনকেও কি ফ্রেন্সিস এর গাওয়া স্নোফ্ল্যাক্স ইন ডিসেম্বরের মতো লাগবে দেখতে?’
আরশি অপলক সেই চিরকুটটির দিকে তাকিয়ে থেকে একসময় মুচকি হাসলো। তারপর মহাশয়ের কথা মতো সাউন্ড সিস্টেম অন করলো কাঁপা হাতে। মৃদু লয়ে ভেসে এলো একটা গান! আরশির কেনো যেনো মনে হলো গানের কথাগুলো শেহজাদ বলছে ওকে,
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪২
নীলচে আকাশ, ধূসর কালো,
মেঘে ঢেকে যায়
শহর জুড়ে এই বৃষ্টি এসে,
তোমায় ছুঁয়ে যায়!
ধরোনা, আমারই এ হাত
বলোনা, হবে কি আমার
করবো না, চোখের আড়াল তোমায়
কখনো..!
বলোনা, মনে কি রাখবে,
একটু ভালো, আমাকে বাসবে…
বলোনা, থেকে কি যাবে?
পাশে চিরকাল…!’