নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪৯

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪৯
সিনথিয়া

“ইজ ইট ফান টকিং টু মাই ওয়াইফ মিস্টার?”
শেহজাদের শীতল হুমকিতে নীরবতা নামলো ক্যাফেটেরিয়ায়। ছু”ড়ি-চামচের টুংটাং শব্দ থামিয়ে কৌতূহলী মুখগুলো একযোগে তাকালো প্রফেসরের দিকে। বেইজ রঙা ওভারকোটের নিচে কালো হাইনেক সোয়েটার পরনের মানুষটা তখনও প্রস্তরীভূত প্রহরীর ন্যায় দাঁড়িয়ে আরশি আর রেজার সামনে। জোড়া কালো ভ্রুযুগলের নিচে তপ্ত লাভার ন্যায় জ্বলছে তার নীল চোখ। রেজার অবশ্য তাতে কিছু এলো গেলো না। সে শেহজাদের বিদগ্ধ চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো কেবল। একপাশ থেকে চূড়ায় উঠলো তার তামাটে ঠোঁট। ডেনিম জ্যাকেট এর নিচে পরা একটা ক্যাজুয়াল সাদা টি-শার্টে বড্ড নিরুত্তাপ লাগলো শ্যামপুরুষকে। মাথার কোঁকড়ানো চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে বড়লোকের বিগড়ানো ছেলেদের মতো করে বলে উঠলো,

“ওহ! ইট ওয়াজ অলওয়েজ ফান টকিং টু ইয়্যুর ওয়াইফ প্রফেসর! শি ইজ দ্য সুইটেস্ট চিক আই হ্যাভ এভার মিট মাই ইনটায়ার লাইফ ট্রাস্ট মি!”
অমনি প্রচন্ড ক্রোধে আরশির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো জারা। আরশির চোখেমুখে তখন স্পষ্ট শঙ্কা। দুরুদুরু বুকে সে তাকিয়ে আছে শেহজাদের থমথমে মুখপানে। যেনো ঝড় আসার পূর্ব মূহুর্তের মহড়া শুরু হয়েছে সেখানে কোনো। একটু পরই লন্ডভন্ড হয়ে যাবে সবকিছু।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রেজার কথা বলার ধরন শুনে জারার মেজাজ চড়ে বসলো। আরশির কানের কাছে ঘেঁষে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“আমি বাটপার দেখেছি, কিন্তু এই রেজালার মতো বাটপারি করতে কাউকে দেখিনি! তুই তো শুরুতে ওকে চিনতেই পারিসনি! অথচ দেখ! প্রফেসরের সামনে এমন কনফিডেন্সের কথাগুলো বলছে যেনো তোর সাথে ওর কত ভালো সম্পর্ক! ইচ্ছে তো করছে এখনি গিয়ে ঘুষি মেরে নাকটা ফাটিয়ে দেই!”
আরশি তৎক্ষনাৎ কী প্রতিত্তোর করবে ভেবে পেলো না। জারা আর শেহজাদের মারকুটে অভিব্যক্তির সামনে ঠান্ডার মধ্যেও কুলকুল ঘামছে তার ললাটপট। ফর্সা বদনে জমেছে দুশ্চিন্তার মেঘ। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানালো,
“ মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, তুই আর জাম্বুবান দুই ভাইবোন! দু’জনেরই রাগ নাকের ডগায়। কথায় কথায় শুধু মারামারি! শুধু শুধু এখন এই ছেলের সাথে মারামারি করে কী দরকার ঝামেলায় জড়ানোর?”

“ একটা ঘুষি খেয়ে কেউ ম”রে না মাই ডিয়ার! মাত্র দুই সেকেন্ডের ব্যাপার। নাকটা একটু থেঁতলে যাবে! ব্যস! তারপর আর ভুলেও তোদের মধ্যে ঝামেলা পাকাতে আসার সাহস করবে না এই ছেলে!”
জারার নির্বিকার চিত্তে বলা কথাগুলো শুনে আরশি যত না বেশি অবাক হলো, তার থেকেও বেশি অবাক হলো শেহজাদকে হুট করে হাসতে দেখে। রেজা থামতেই মেঝেতে দৃষ্টি ফেলে দু’দিকে মাথা নাড়ছে শেহজাদ। তাচ্ছিল্যের হাসিতে প্রসারিত তার ওষ্ঠপুট। প্রতাপী পা জোড়া ধীর লয়ে এগিয়ে এলো রেজার মুখোমুখি। তারপর অকস্মাৎ…হাসি থামিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাতের প্রচন্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিলো রেজার নাক বরাবর।
আরশি হকচকালো। বিহ্বলতার শৃঙ্গে চড়ে শব্দ হারিয়েছে তার গলবিল। ওদিকে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে একের পর এক শব্দহীন শীষ বাজিয়ে চলেছে জারা। কারণ অফিসারের মতো শব্দ করে শীষ বাজানোটা যে এখনও অবধি আয়ত্ত হয়নি রমনীর। তাই আপাতত এভাবে কাজ চালাতে হচ্ছে তার।

শেহজাদের আচমকা আক্রমন আর ক্যাফেটেরিয়ার শ’খানেক ছাত্রছাত্রীর সামনে এমন অপমানে নীল হয়ে গেছে রেজার সর্বাঙ্গ। নাক ফেটে নামা তরল স্রোতে মাখামাখি তার অধর আর চিবুকের অনেকখানি। সেখানটা হাত দিয়ে চেপে ধরতেই শেহজাদ ভরাট কন্ঠে বলে উঠলো,

“ আমার ভাষায় সাবধান করেছিলাম! শুনিসনি! তাই এবার তোর ভাষায় বলছি! স্টে এওয়ে ফ্রম মাই গড ড্যাম ওয়াইফ! নইলে এবার তো শুধু নাকে ফ্র্যাকচার হয়েছে, পরেরবার পুরো শরীরে ফ্র্যাকচার হবে। তারপর যেখান থেকে এসেছিস সেখানেই ফেরত পাঠাবো তোকে! পারলে নিজের ফোনে কথাগুলো রিমাইন্ডার দিয়ে রাখিস। আর বলে দিস, প্রতিদিন একবার হলেও যেনো তোকে মনে করিয়ে দেয়!”,
আরশির সম্বিত ফিরল এবার। শেহজাদ রাগের মাথায় আরো কিছু করে বসার আগেই দৌঁড়ে এসে তার হাত টেনে ধরলো মেয়েটা। চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে নিচু স্বরে আওড়ালো,
“ আপনি কি পাগল? এভাবে কেউ কাউকে মারে? তারউপর যাকে মারছেন সে-ও কিন্তু আপনারই স্টুডেন্ট! বুঝুন একটু বিষয়টা! এটা ভার্সিটি! এখানে আপনার রেপুটেশন জড়িয়ে আছে! ”

উহু! তাতেও কাজ হলো না। এতক্ষণেও শান্ত হতে পারলো না শেহজাদ। রেজার দিকে তাকিয়েই হিসহিসিয়ে বললো,
“ রেপুটেশনের ভয়ে ওকে আমি ছেড়ে দেবো? হি ফা”কিং ডেয়ারড টু ডিসরেসপেক্ট ইউ আরশি! ওকে যে এখনো অবধি জানে মে”রে ফেলিনি…”
বাক্যে দাঁড়ি পড়ার আগেই শব্দ কেড়ে নিলো আরশি। ক্যাফেটেরিয়া থেকে শেহজাদের হাত ধরে তাকে টেনে বাইরে নিয়ে যেতে যেতে বললো,

“ নো! দ্যাটস নট হাউ ইউ বিহেভ এজ হিজ টিচার!”
“ বাট দ্যাটস হাউ আই শ্যুড বিহেভ এজ ইয়্যুর হাজবেন্ড স্নোফ্ল্যাক!”
আরশি থমকালো। কথার মানে ধরতে পেরে উষ্ণ হলো কপোল। উৎকন্ঠার পাহাড় ডিঙিয়ে হাজারো প্রজাপতির দল ছুটলো সমস্ত মন জুড়ে। কিন্তু লাজবন্তীর লাজ ভাঙার আগেই নাগালের বাইরে শেহজাদ। লম্বা লম্বা পা ফেলে সে এতক্ষণে চলে গেছে পার্কিং স্লটে। আরশির জন্য গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়াতেই পরাস্ত ভঙ্গিতে গাড়িতে উঠে বসলো মেয়েটা। বিড়বিড় করে আওড়ালো,

“ কে আমাকে কখন কী বলবে সেই ভয়তে আমি কি সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে রাখতে পারবো? তারপর দেখবো আপনার মতো আমিও গোমড়ামুখো হয়ে গেলাম আর আমাদের গ্রাম্পি সানশাইন ট্রুপের পুরো দফারফা হয়ে গেলো! তখন? তখন আমার স্নোবল তার সানশাইন মাকে চিনতে পারবে? পারবে চিনতে?”
আরশি টিয়াপাখির মতো কলকল করে চললেও শেহজাদ সাথে সাথে কোনো প্রতিত্তোর করলো না। উল্টে পাশে এসে বসলো আরশির। শব্দহীন ঝুঁকে এসে সিটবেল্টটাও ঠিক করে দিলো পরপর। তবে এক হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে সামলে ক্যাম্পাস পেরোতেই গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

“ কোনো টিয়া পাখিকে কখনো চুপ থাকতে দেখেছো? তাহলে তুমি কী করে কথা না বলে থাকবে?”
আরশি চোখ ছোট ছোট করে শেহজাদের দিকে তাকাতেই শেহজাদ আবারও নিরুত্তাপ স্বরে বলে উঠলো,
“তোমাকে কখনো কোনোকিছু নিয়ে আপোষ করতে হবে না, যতদিন পর্যন্ত আমি আছি স্নোফ্ল্যাক! ইউ ক্যান ডু হোয়াট এভার ইউ উইশ! যদি কেউ তোমাকে কিছু বলতে আসে, ইয়্যুর হাজবেন্ড উইল ডিল উইথ দ্যাম!”
আরশি বেশ অনেকক্ষণ পলকহীন তাকিয়ে রইলো শেহজাদের দিকে। একভাবে। শেহজাদের চোখ রাস্তায়। তবুও বুঝতে বাকি রইলো না যে আরশি তাকে দেখছে। অমনি একচিলতে মুচকি হাসি ফুঁটে উঠলো ঠোঁটের কোণে। নীলাম্বরে উঁকি দিলো সুখ সুখ রোদ। কন্ঠে দুষ্টুমি মিশিয়ে জানতে চাইলো,

“ এতো ইন্টেন্সলি তাকালে ড্রাইভ কী করে করবো স্নোফ্ল্যাক?”
অমনি চোখ সরিয়ে নিলো আরশি। কপালের উপর পড়ে থাকা খুচরো চুলগুলো কানের পিছনে গোঁজার বৃথা চেষ্টায় ব্যস্ত হলো হাত। দৃষ্টি নামিয়ে জিজ্ঞেস করে বসলো,
“ কে বলেছিল এতো হাজবেন্ড ম্যাটেরিয়াল হতে?”
“ যার ওয়াইফ দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা উপন্যাসের বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকে তাকে তো একটু আধটু হাজবেন্ড ম্যাটেরিয়াল হতেই হবে স্নোফ্ল্যাক! নইলে আপনার কল্পপুরুষদের হারাবো কী করে বলুন?”
এবারে একেবারে ঘায়েল প্রতিপক্ষ। পারলে মিশে যায় গাড়ির সিটের সাথে। তবুও কোনোমতে চোখমুখ খিঁচে জানালার দিকে মুখ ঘোরালো আরশি। শান্ত হয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ঝাড়লো খানিক পর। ওভাবেই বলে গেলো,
“আমি আপনাকে বলেছি তাদের হারাতে? নাকি এবার তাদের সাথেও গিয়ে মারামারি করে আসবেন?”
এবারে শব্দ করে হেসে ফেললো শেহজাদ। তার হাসির শব্দ শুনে আরশি ঘাড় ঘোরালো। জড়তা কাটতেই সহজ হয়ে বসলো রমনী। ক্ষুব্ধ স্বরে বলে উঠলো,

“ আশ্চর্য! হাসছেন কেনো আপনি?”
“ না, আপাতত তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই ইয়্যুর হাইনেস, কারণ আমি জানি আপনি তাদের নয় শুধু আমাকেই ভালোবাসেন। কিন্তু যদি দেখি এই ভালোবাসায় ভাগ বসাতে আবার অন্য কেউ এসে হাজির হয়েছে, তাহলে একটা না একটা রেভ্যুলেশন যে ঘটিয়ে ফেলবো তাতে কোনো সন্দেহ নেই!”
কথাগুলো শেষ করেই শেহজাদ হাতের মুঠো দিয়ে ঠোঁট ঢেকে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো ঠিকই, কিন্তু লাভ হলো না খুব একটা। হাসির তোড়ে পরন্ত বিকেলের ম্লান রোদের মতোই আরো ঝলমলিয়ে উঠলো তার সৌম্য সুন্দর মুখ। ধারালো চোয়ালে খেলে গেলো জগতকে এক তুড়িতে পিছনে ফেলে দেয়ার উচ্ছ্বাস। ঐ নীল চোখজোড়া যেনো সব জেনে বসে আছে আরশির। যেনো মেয়েটার এমন দু’একটা বোকা বোকা প্রশ্নে তারা বিস্ময় কম, কিছুক্ষণ হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার কারণ বেশি খুঁজে পায়।
এমন আত্মসম্মান লুটে নেয়া হাসিতে আরশি রুষ্ট হলো। বিরক্তিতে তেঁতো হয়ে এলো তার মুখ। মোলায়েম চোখে হঠাৎই ছেয়ে গেলো বৈশাখের তাপদাহের মতো কঠোরতা। বালিকাসুলভ অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো,

“ আপনি গাড়ি থামান!”
“ লাইক রাইট নাও? কিছু লাগবে? আমি তো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে আবার বের হতাম! কী কী লাগবে বলো! আমি না হয় ফেরার পথে নিয়ে আসবো?”
“ আপনি গাড়ি থামান আগে! তারপর বলছি আমার কী কী লাগবে!”
অগত্যা শূন্য প্রয়াস থাকা সত্ত্বেও গাড়ি থামালো শেহজাদ। ভেবেছিল আরশিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে একবার আয়ানের সাথে দেখা করে আসবে আদির কেসটার ব্যাপারে। কিন্তু এখন দেরি করলে তো…
শেহজাদের ভাবনার মধ্যেই নিজের সিট থেকে হামাগুড়ি দিয়ে এসে শেহজাদের উরুর উপর বসে পড়লো তার অভিমানিনী। অপটু দু’হাতে শেহজাদের দু’কাধ ধরলো নিজের টাল সামলাতে। পরপর চোখ খিঁচে পাউটের মতো বানালো নিজের ওষ্ঠপুট। আরশির কাজকর্মে প্রথমে কিছুটা ভড়কে গেলেও কিছুক্ষণ পর আবারও হেসে ফেললো শেহজাদ। আরশির পাউট করে থাকা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাঁচিয়ে শুধালো,

“ নাও হোয়াট ইজ ইট?”
“ অ্যন ইনভাইটেশন টু গিভ মি অ্য কিস! এতক্ষণ তো খুব জানতে চাইছিলেন না যে কী লাগবে? চুমু লাগবে আমার! তাড়াতাড়ি দিন! ফাস্ট!”
কথাগুলো বলেই আবার আগের মতো ঠোঁটটা পাউট করে ফেললো আরশি। চোখও বন্ধ। শেহজাদ মাথা হেলিয়ে শুধু দেখে গেলো তার প্রিয়দর্শিনীর পাগলামি।
“ আপনি শুধু তাকিয়েই থাকবেন নাকি কাজের কাজও কিছু করবেন? এজন্যই আমি আপনাকে জাম্বুবান বলে ডাকি! এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকা যায়? আর ঠোঁটটা? এভাবে হাঁসের মতো উঁচু করে ধরে রাখতে রাখতে ব্যথা হয়ে যাবে না? আপনার জন্য কতটা আত্মত্যাগ স্বীকার করছি আমি, আর আপনি আমাকে সামান্য চুমু খাবেন তাতেও কি-না আপনার পর্যবেক্ষণ করা…”

বাক্যে দাঁড়ি ঝোলানোর আগেই ঝুঁকে এসে আরশির পুরো কথা মাঝপথে আঁটকে দিলো শেহজাদ। দু’জোড়া অধরোষ্ঠের এমন আচমকা যুগলবন্দিতে মূক বোনে রইলো মেয়েটা। নিটল নেত্রদ্বয় ফুঁড়ে খুঁড়ে বেরোলো বিস্ময়। ওভারকোটের ভিতর দিয়ে শেহজাদের অমসৃণ হাতের বিচরণ ঘটলো আরশির কোমরে। অলিন্দের সাথে সাথে শ্বাস প্রশ্বাসেরও গতি বাড়লো মেয়েটার৷ পুরুষালী রুক্ষ ছোঁয়ার সাথে সখ্যতা জুড়তে বেগ পেতে হলো রমনীর। হাঁপড়ের মতো ওঠানামা শুরু হলো বক্ষপিঞ্জরের। শেহজাদ কিছুক্ষণের জন্য শ্বাস নেয়ার সুযোগ করে দিতেই আরশি হড়বড়িয়ে শুধালো,
“ আপনি জানেন! আমার উপন্যাস পড়া নিয়ে আপনার মজা করা একদম উচিত হয়নি!”
নিম্নাষ্ঠ দাঁতে পিষে হাসলো শেহজাদ। আরো একবার ঐ তুলতুলে নরম ওষ্ঠপুটে দখল বসানোর আগে মেঘমন্দ্র ভারী স্বরে বলে উঠলো,
“ আই নো ! এন্ড আ’ম সিনসিয়ারলি আস্কিং ফর ইয়্যুর ফরগিভনেস স্নোফ্ল্যাক!”

সুরমাদানির মতোই কৃষ্ণকালো মেঘে ঢেকে গেছে নিউইয়র্কের আকাশ। অপরাহ্ন বেলায় সেই মেঘের বাড়ি থেকে বরফভেজা রাস্তায় নোলক পরা নববধূর মতো নেমে এসেছে সুখের শ্রাবণ। ম্যাপল গাছের শুকনো ডাল-পালা ভিজিয়ে, সেন্ট্রাল লেকের পানিতে তরঙ্গ তুলে, পথচারীদের কফি শপগুলোতে ঢুকতে বাধ্য করে এই ব্যস্ত শহরজুড়ে ঝড়ছে আদর আদর বৃষ্টি।
চুলোয় চায়ের পানি বসাতে বসাতে সেই বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা উপভোগ করছে আরশি। গরম গরম সবজির পাকোড়া তৈরি। এখন শুধু্ চা হওয়ার অপেক্ষা।

“ আরশি মা! এতো মনোযোগ দিয়ে কী বানাচ্ছো? এ্যানিথিং স্পেশাল?”
আরশি হাতের কাজে সাময়িক ইস্তফা দিতেই একান- ওকানজুড়ে হাসলেন মেহমেদ হাসান। আরশিরও ঠোঁটজোড়া প্রসারিত হলো বাবাকে দেখে। এ বাড়িতে আরশিকে সবচেয়ে বেশি মাথায় তুলে রাখেন মেহমেদ। আদর-আহ্লাদ সবই তো তার কাছে। তাই তো তাকে দেখা মাত্রই রমনী উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠলো,
“ সন্ধ্যার নাস্তা বানিয়েছি বাবা। তোমার আরশি স্পেশাল পাকোড়া সাথে চা। তুমি খাবে তো?”
“ নিশ্চয়ই খাবো! আমার আরশি মা বানিয়েছে আর আমি খাবো না?”
মেহমেদ হাসান খাবেন শুনে যে কী ভীষণ তৃপ্ত হলো আরশি! সেই তৃপ্তির জোয়ার খুশির ঢেউ আনলো রমনীর মনে। ফুরফুরে মেজাজে চা আর পাকোড়ার ট্রেটা হাতে নিয়ে কিচেন থেকে বেরোতে বেরোতে বললো,
“ বৃষ্টির দিনে চায়ের সাথে এই গরম গরম পাকোড়ার ডেডলি কম্বিনেশনটা শুধু মিস করবে কে জানো?”
মেহমেদ দু’দিকে মাথা নাড়তেই আরশি জানালো,

“ দাঁড়াও! হিন্টস দিই! এ বাড়িতে একমাত্র তেল ভাজা জিনিসে এলার্জি আছে কার?”
“ শায়ানের? কিন্তু সে তো এমনিতেও এসব খায় না। স্ট্রিক্ট ডায়েট ফলো করে! আর কথায় কথায় আমাকে মিষ্টি খাওয়া নিয়ে কথা শোনায়!”
খোঁটা যে আরশিও কম বেশি সে-তো আর মেহমেদ জানেন না। তাই তো সে হতাশ কন্ঠে আওড়ালো,
“ ডায়েট মেইনটেইনের নামে ঐ তিন পিস সিদ্ধ ব্রকলি খেয়ে নিজের রুহটাকে কষ্ট না দিয়ে, আমার মতে যখন যা খেতে ইচ্ছে করবে তখন সেটাই খেয়ে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ। কী ঠিক বলেনি বাবা?”
“ আলবাত! আলবাত!”
এরপর আরশি যা যা বললো তাতেই শুধু ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে গেলেন মেহমেদ। বিস্তর আলোচনার শেষ পর্যায়ে আরশি বলে উঠলো,

“ এই রে! দেখলে! আরেকটু বাদেই তো সবার চা ঠান্ডা হয়ে যেতো! তুমি বসো! আমি মাকে ডেকে আনছি। তারপর সবাই একসাথে আমার হাতে বানানো চা আর পাকোড়া খাবে!”
মেহমেদের থেকে হাসি মুখে বিদায় নিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠে তাদের ঘরের দিকে পা বাড়ালো আরশি। কিন্তু ঘরের দোর অবধি গিয়েই থমকালো মেয়েটা। মলিন চোখে দেখলো বিছানার এক কোনে বসে কাঁদছেন মরিয়ম। বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছেন একটা ছোট্ট ফটো ফ্রেম। আরশি একবার ভেবেছিল ভিতরে ঢুকবে না। দরজার এপাশ থেকেই চলে যাবে। কিছুটা সময় একা কাঁটাতে দেবে মরিয়মকে। কিন্তু পারলো না। মরিয়মকে একা রেখে যেতে ইচ্ছে হলো না তার।

উপায়হীন রুমের ভিতরে ঢুকলো আরশি। পা টিপে টিপে মরিয়মের পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখতেই চমকালেন প্রৌঢ়া। বেখেয়ালে হাতের ফ্রেমটাও মেঝেতে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হলো এর বাঁধানো কাঁচ আচানক। ভাগ্যক্রমে শুধু অক্ষত রইলো ছবিটা। মৃদু আর্তনাদ করে উঠলেন প্রৌঢ়া। আরশি ঝুঁকে ভাঙা কাঁচগুলো সরিয়ে সেই ছবিটা হাতে নিতেই মরিয়ম বেগম বলে উঠলেন,
“ রুশার এই একটা ছবিই লুকিয়ে রেখেছিলাম আমি। নয়তো বাকি ছবিগুলোর সাথে এটাও যে ওর বাবা কোথায় নিয়ে রাখতো, তার হদিস সে আর উপরওয়ালা ছাড়া আর কারোর সাধ্যি থাকতো না জানার!”
আরশির খেয়াল অন্যদিকে। ছবির সাথে খুব পরিচিত একটা মুখ মেলানোর জন্য যেনো স্নায়ু যুদ্ধ চলছে মস্তিষ্কের। মেয়েটা সেভাবেই আনমনে বলে উঠলো,

“ তারমানে বাবা রুশার ছবি তোমার কাছে রাখতে দিতে চায় না! বাড়িতেও রুশার কোনো ছবি টাঙানো নেই! োকিন্তু কেনো?”
মরিয়ম বেগম চোখের পানি মুছে জানালেন,
“ ঐ যে, ছবিগুলো দেখলেই যে বারবার ছোট্ট রুশার মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে রে মা। কান্নাকাটি করি, অসুস্থ হয়ে যাই, এজন্যই বাড়িতে রুশার কোনো ছবি রাখেনি তোর বাবা! এই ছবিটা রুশাকে নিয়ে তোদের গাজিপুরের বাড়িতে যখন গিয়েছিলাম তার কয়েকদিন আগের তোলা। লাল টুকটুকে একটা ফ্রক পরিয়ে তোর বাবা ছবিটা তুলে দিয়েছিলেন। সেই রুশাকে আমার থেকে ওরা কেনো নিয়ে গেলো রে আরশি? আমার মেয়েটার তো কোনো দোষ ছিল না!”

বলতে বলতে আবারও গলা ধরে এলো মরিয়মের। ধপ করে বসে পড়লেন বিছানায়। আরশি তাকে সামলে কোনোমতে শান্ত করলো। পানি খাওয়ালো। তারপর আবারো মনোযোগ ফেরালো ছবিতে। মনে হচ্ছে রুশার ছোটবেলার ছবি এ বাড়ি ছাড়াও আরো এক জায়গায় ও দেখেছে। ঠিক তখনই মনে পড়লো সেদিন বিকালের কথা। নৈশব্দ জানান দিলো ক্যাফেটেরিয়ায় জারার ছোটবেলার ছবি দেখেও ওর ঠিক একই কথা মনে হয়েছিল বারবার। জারাও তো ছোটবেলায় হারিয়ে ওর দিদুমণির কাছে বড় হয়েছে গাজীপুরে।
“ তারমানে রুশা আর জারা একই মানুষ! জারাই আমাদের হারিয়ে যাওয়া রুশা? জারাই শেহজাদের বোন, এ বাড়ির একমাত্র মেয়ে?”

মরিয়ম বেগম ঠিক স্পষ্ট শুনতে পেলেন না আরশির কথাগুলো। জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
“ তুই কী কিছু বলছিস মা?”
আরশি আর একমুহূর্তও অপেক্ষা করলো না। ছবিটা হাতে রেখেই বলে উঠলো,
“ বলছিলাম এই ছবিটা যদি আমি আমার কাছে একদিনের জন্য রাখি তাহলে কী তুমি রাগ করবে?”
“ না রাগ করবো কেনো? কিন্তু এই ভাঙাচোরা ছবি রেখে তুই কী করবি?”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪৮

আরশি ততক্ষণে ছবিটা বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে পরম যত্নে। মরিয়মের কান্নাভেজা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে মুছে দিলো চোখের পানিটুকু। মনে মনে আওড়ালো,
“ এই ভাঙাচোরা ছবিটার মতো করে এই পরিবারটাকেও যে আবার নতুন করে জোড়া লাগাতে হবে মা! তোমাকে আর কাঁদতে হবে না রুশার জন্য! কথা দিলাম!”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫০