নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫
সিনথিয়া

“টুডেই উই উইল বি ডিসকাসিং স্ট্যাটিসটিক্স..ডাজ এ্যানিওয়ান হ্যাভ এ্যানি কুইশ্চন বিফর উই বিগিন?
গ্যালারির মতো সুবিশাল ক্লাস রুমটিতে প্রায় শ’খানেক স্টুডেন্টের ক্লাস নিচ্ছে শেহজাদ। কঠোর মুখাবয়ব দেখে বোঝার উপায় নেই যে
তার নীলাভ চোখজোড়া রুমটির এদিক-ওদিক খুঁজছে কোনো একজনকে।
কিন্তু নাহ্! ক্লাসের কোথাও যখন আরশির দেখা সেই চোখ জোড়া পেলো না, তখনই শুভ্র ললাটে ভাঁজ পড়লো শেহজাদের।
একটু আগেও তো মেয়েটাকে ভার্সিটি আসার জন্য রেডি হয়ে টেবিলে বসা দেখেছিল। তাহলে কি এখনো এসে পৌঁছাতে পারেনি?
কন্ঠের শ্লেষা দূর করে আবারও বোর্ডের দিকে ফিরলো মানুষটা। কিন্তু মনোযোগ আর দিতে পারলো কই? সব তো ঐ একরত্তি মেয়ে নিয়ে বসে আছে। অচেনা শহর! কোনো বিপদ-আপদ হলে?
ব্যাস! শেহজাদের ক্লাস নেয়ার দফারফা হয়ে গেলো তখনই। আরশি কোনো বিপদে পড়তে পারে, এই খেয়ালটা ওর মাথায় আগে আসলো না কেনো?
বিরক্তির ‘চ’ সূচক শব্দ করে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করতেই স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে উঠলো সেভ করা একটা নাম্বার।

যেখান থেকে একটু আগেই পরাপর তিন তিন বার কল এসেছে।
নাম্বারটা দেখেই কিছু একটা হলো ওর বুকের ভিতর। যেটা আগে কখনো হয়নি। আগেও
তো কতবার আরশির কল ইগনোর করেছে! কই তখন তো এমন লাগেনি?
শেহজাদ সময় নষ্ট করলো না। ক্লাস রুম থেকে বের হয়েই কল ব্যাক করলো ঐ নাম্বারে। চোখ বন্ধ করে মনে মনে জপলো-
“আরশি পিক আপ দ্যা ফোন! পিক দ্যা ফোন ইডিয়ট!”
অপর পাশ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বাসার সিসিটিভি ক্যামেরা চেক করলো শেহজাদ। দেখলো বের হওয়ার দরজার সামনেই আরশির বাসায় পড়া জুতো জোড়া রাখা। তারমানে বাসায় নেই ও!
মানুষটার শুভ্র আননে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ। সরু নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু স্বেদ কণিকারা স্থান গেঁড়েছে। এই এক মেয়ে আর কত ভোগাবে ওকে? কোন আক্কেলে যে ও মেয়েটাকে ওভাবে একা একা চলা ফেরা করতে এ্যালাও করলো? এখন যদি রুশার মতো আরশিও-

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হ্যালো শেহজাদ! ”
পুরুষালী কণ্ঠে বিভ্রম কাঁটলো শেহজাদের।
ঠান্ডা ঘামে কপালটাও ভিজে উঠেছে। সেটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল,
“আ-আয়ান! আই নিড ইয়র হেল্প বাডি! এ-একটা লোকেশন ট্র্যাক করতে হবে! ফাস্ট!”
ফোনের অপর পাশের মানুষটা নড়েচড়ে বসলো নিজের চেয়ারে। শেহজাদকে এতোটা উদগ্রীব হয়ে কথা বলতে যে এই প্রথমবার শুনলো ও।
“তুই শান্ত হ ভাই। কার লোকেশন ট্র্যাক করতে হবে আর কি হয়েছে?”
শেহজাদের উদভ্রান্ত কন্ঠস্বর শান্ত হলো না। আর না শান্ত হলো সে নিজে। বারবার রুশার হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতি যেনো মস্তিষ্ক কুরে কুরে খাচ্ছে।
সেভাবেই বলল,
“মা-মাই…ওয়াইফ! আরশি! সি ইজ মিসিং আয়ান! এন্ড আই নিড টু ফাইন্ড হার এ্যাট এ্যানি কস্ট!”

সি-ক্লাস ব্ল্যাক মার্সিডিজ গাড়ির সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘন্টায় দু’শ পঞ্চাশ কিলোমিটার।
সেখানে ব্রুকলিনের একটি রাস্তায় তিন’শ কিলোমিটার গতিবেগে এটি চালাচ্ছে শেহজাদ।
ওর পিছনে পিছনে আসছে আয়ান সহ পুলিশের একটি পুরো টিম। কিন্তু তারাও যেনো শেহজাদের গাড়িটাকে ফলো করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছে
একটু পর পর। এতো জোরে কেউ গাড়ি চালায়? যেখানে ম্যানহাটন থেকে ব্রুকলিনে আসতে প্রায় একঘন্টা লাগে, সেখানে মাত্র বিশ মিনিটে এসে পৌঁছেছে শেহজাদের গাড়ি।
ব্রুকলিন ব্রিজের সামনে আসতেই শেহজাদের চোখ পড়লো অন্য গাড়ি গুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে চলা একটা সাদা গাড়ি উপর।
খটকা লাগতেই আয়ান ফোনে বলে উঠলো,
“শেহজাদ। ভাবীর ফোনের সিগন্যাল তোর সামনের ঐ সাদা গাড়িটা থেকে আসছে! আঁটকা ওটাকে!”
আয়ান বলার সাথে সাথেই গাড়ির অ্যাকসিলারেটরের পেডেলে চাপ বাড়ালো শেহজাদ।
মূহুর্তেই ধূলো উড়িয়ে সাদা গাড়িটাকে ওভারটেক করে সামনে থেকে ঘেরাও করলো শেহজাদের ব্ল্যাক মার্সিডিজ।
পেছন থেকে কিডন্যাপারের গাড়িটা যেনো পালাতে না পারে, সেজন্য আয়ান আর ওর টিম তো আছেই! তারা ঘেরাও করলো পেছন থেকে।

মার্সিডিজের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো শেহজাদ। লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলো কিডন্যাপারের সাদা গাড়িটার কাছে।
সোজা গিয়ে ঘুষি বসালো গাড়ির জানালায়।
পাগলের মতো মুষ্ঠ্যাঘাতে কাঁচ ফুটে জখম হলো মুঠির গোড়া। কিন্তু শেহজাদের থামার নাম গন্ধ নেই।
এক পর্যায়ে গাড়ির জানালার কাঁচ ভাঙলো। ভাঙা জানালা দিয়েই মাস্ক পড়া লোকটাকে টেনে বের করলো শেহজাদ।
মাটিতে পা মিশতেই ঘুষির তোড়ে মুখে বেঁকে গেলো লোকটার।
শেহজাদের একটাই কথা,
“হাউ ডেয়ার ইউ টাচ মাই ওয়াইফ?”
এতোগুলা ঘুষির মাঝে লোকটা কোনোমতে পুলিশ গুলোর দিকে তাকিয়ে শুধু বলল,
“আই ডিড’নট টাচ হার। বিলিভ মি! প্লিজ সামওয়ান হেল্প মি ফ্রম দিস ম্যাডম্যান!”
আয়ান ঠোঁট টিপে হাসলো। পশ্চিমা ভাষায় না বলে বাংলাতেই বলল,
“ম্যাডম্যানের বউকে কিডন্যাপ যখন করতে চেয়েছ, ঘুষি তো তোমাকেই খেতেই হবে বাছাধন!”
শেহজাদের এসবে ধ্যান নেই। জখম হাতেই সে একের পর এক ঘুষি বসিয়ে চলেছে মাস্ক পড়া লোকটার গালে।
এক পর্যায়ে আয়ান এসে ওকে থামায়। শেহজাদকে পিছন থেকে জাপ্টে ধরে বলে,

“ছাড় ভাই এটাকে! আর কতো মারবি। একেবারে না মেরে নিশ্বাস টা অন্তত রাখ,
বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি। তুই ভাবিকে বের করে আন গাড়ি থেকে।”
ততক্ষণে শেহজাদ লোকটাকে মারতে মারতে শুইয়ে দিয়েছে ব্রিজের উপর।
কিন্তু আরশির কথা শুনতেই ওর হাত থামলো। শেষ ঘুষিটা তুলেছিল কেবল, মূহুর্তেই আবার নামিয়ে ফেলল সেটা। উঠে দাঁড়ালো ঘন ঘন শ্বাস ফেলে।
ততক্ষণে আয়ানের টিমের লোকেরা কিডন্যাপারটার হাতে হাতকড়া পড়িয়ে গাড়িতে তুলে ফেলেছে।
এতক্ষনের মারকুটে মানুষটা উদভ্রান্তের মতো দৌঁড়ে গেলো কিডন্যাপারের গাড়ির কাছে। হ্যাঁচকা টানে দরজা খুলতেই দেখলো
পিছনের সিটে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে আরশি।

কপাল কেঁটে ফোঁটা ফোঁটা রক্তবিন্দু গড়িয়ে ভিজেছে পান্ডুর গাল।
শেহজাদ মাথা নুইয়ে ধীরে ধীরে ওর কাছে গেলো। নাম ধরে ডাকলো কয়েকবার। কাজ হলো না।
আয়ান পিছনেই ছিল। কোত্থেকে একটা পানির বোতল শেহজাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“জ্ঞান নেই শেহজাদ। পানি ছেটাতে হবে মুখে!”
মানুষটা কাঁপা হাতে বোতলের মুখ খুলল। ঝুঁকে এসে আরশির মুখে পানি ছিটিয়ে দিতেই
ধীরে ধীরে চোখ খুলল ও।
চোখ খুলেই শেহজাদকে দেখে, প্রথম দফায়
সবটা স্বপ্ন মনে হলো আরশির কাছে। এক অলীক স্বপ্ন। যেখানে এখনই হয়তো শেহজাদ ওর গাল ছুঁয়ে বলবে,
“আরশি? ঠিক আছো তুমি?”
কিন্তু সত্যি সত্যি শেহজাদ যখন ওর গাল ছুঁলো, অলীক সেই স্বপ্নের মতো করে বলল,
“ঠিক আছো আরশি?”
তখনই চোখ জোড়া ভিজে উঠলো অভিমানে। শেহজাদের দু’হাতের ফাঁক গলিয়ে শুয়ে থেকেই জড়িয়ে ধরলো পুরুষালী
চওড়া বুক। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলল,

“এতো দেরি কেনো করলেন আসতে? আমি কত ভয় পেয়ে গেছিলাম জানেন আপনি? ”
শেহজাদও জখম হাতেই আরশির মাথার পিছনে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“এই তো চলে এসেছি! এখন আর ভয় করবে না!”
আয়ান কেশে উঠলো গাড়ির বাইরে থেকে।
বলল,
“সব রোম্যান্স কি তোরা গাড়ির ভিতরেই সেরে ফেলবি? অন্তত বাসায় গিয়ে করার জন্য কিছু বাকি রাখ!”
আয়ানের কন্ঠ শুনে শেহজাদের বুক থেকে মাথা তুলল আরশি। পরপর চোখ গেলো শেহজাদের জখম হওয়া হাতের দিকে।
আঁতকে উঠল মেয়েটা।
রক্তশূন্য মুখখানা আরো যেনো ফ্যাকাশে হলো সহসা।
পাতলা অধর নাড়িয়ে অস্পষ্টে বলল,
“আপনার হাত? এতোটা কাঁটা? ক-কি করে হলো এমন?”
কথা শেষ করতেই ওর ঠোঁটে তর্জনী ছোঁয়ালো শেহজাদ।
গাড়ির ভিতর বসেই আলগোছে কোলে তুলে নিলো আরশিকে। মেয়েটাকে তুলোর মতো হাতে জাগিয়ে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে।
শেহজাদ এখন যতটা শান্ত, আরশি ততোটাই হতবাক, হতবুদ্ধ। বিস্ময়ের তোড়ে চোখে ছানাবড়া আর চোয়াল ঝুলে পড়ার জোগাড়।
ও ওর জাম্বুবানের কোলে? তা-ও এতোকিছু হয়ে যাওয়ার পর?
এটাও সম্ভব?

শেহজাদ আরশিকে কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই আয়ান ওদের কাছে আসলো।
কিছু পুলিশ এখনো দাঁড়িয়ে ওদের গাড়ির সামনে।
লজ্জায় শেহজাদের বুকে মুখ লুকালো আরশি।
ছিঃ ছিঃ এতোগুলা মানুষ দেখে ফেললো, এতো বড় মেয়ে বরের কোলে উঠেছে?
আরশি যতটা লজ্জা পাচ্ছে, আয়ান ঠিক ততটাই স্বাভাবিক কন্ঠে শেহজাদকে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই ড্রাইভ করতে পারবি? না আমি এগিয়ে দেবো তোদের?”
শেহজাদ গম্ভীর কন্ঠে শুধু বলল,
“পারবো! বিসাইড, আই নিড টু টক টু হার…এলোন!”
আয়ানের সোনালী চোখ জোড়ায় দুষ্টুমির ছাঁপ স্পষ্ট। দু’হাত উপরে তুলে ঠোঁট গোল করলো। টেনে টেনে বলল,
“ওওওওকে ! বিপদ যখন কেঁটে গেছে, তখন আমি আর এখানে থেকে ‘কাবাব মেয় হাড্ডি’ হবো না! ”
পরপর কপালে স্যালুট করার ভঙ্গিতে দু’ আঙুল ঠেকিয়ে বিদায় জানালো। কিন্তু
যাওয়ার সময় শেহজাদের কানে কানে বলল,

“আজ যদি চাচা-টাচা হয়ে যাই, খুব একটা অবাক হবো না কিন্তু!”
আরশি কথাটা না শুনলেও শেহজাদ চোখ গরম দেখালো আয়ানকে।
যেতে যেতে আবারও ফিসফিস করে বলল,
“বেস্ট অফ লাক ভাই! আজকে প্রমাণ করে দে যে তুই আমার বন্ধু!”
আয়ানের কথায় এবার আর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না শেহজাদ।
আরশিকে কোলে নিয়েই পা বাড়ালো নিজের গাড়ির দিকে।

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪

কালবৈশাখী ঝড়ের আগে আশপাশ যেমন থম মেরে থাকে! তেমনই থম মেরে আছে মানুষটা! বকাবকিও করছে না আরশিকে। এতোভালো কবে থেকে হলো এই লোক।
নাকি আবার কোনো ঝড় উঠানোর পূর্ব প্রস্তুতি নিচ্ছে মনে মনে?
সেই ঝড়, সামলাতে পারবে তো আরশি?

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৬