নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫০

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫০
সিনথিয়া

আরশি সেদিন রাতে অবশ্য জানাতে পারলো না কাউকে কিছু। আরো কিছু প্রমাণ জোগাড় করতে হবে। সেই চিন্তায় রাতটা হাঁসফাঁস করেই কাটতে লাগলো তরুণীর। বিছানায় আসতেই সহধর্মিণীর এমন ছটফট নজরে এড়ালো না শেহজাদের।

ফরমাল পাল্টে মাত্রই গায়ে চড়িয়েছে সফেদ টি-শার্ট আর ট্রাউজার। রাতের খাবার শেষে ল্যাপটপ কোলের উপর রেখে আধশোয়া হয়ে বসেছে বিছানায়। আজও আয়ানের থানায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছে আদির ব্যাপারে। আয়ানরা তৎপর। তার টিম ইতিমধ্যেই নজরবন্দি করে রেখেছে আদির বাবা-মাকে। আদিও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না তুখোড় এই সুরক্ষাবাহিণীর হাত থেকে। উর্দি যখন পরেছে মান তো রাখতেই হবে।
এমনটাই বলেছে আয়ান। নিজের হাজারটা চিন্তা লুকিয়ে শেহজাদকে দুশ্চিন্তা করতেও না করেছে কথার ফাঁকে। তার মতে শেহজাদের এখন উচিত আয়ানকে চাচা বানানোর চিন্তা বেশি বেশি করা। আদি-টাদিকে সে সামলে নিতে পারবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়ানের নিছক দুষ্টুমি ধরতে পেরে মৃদু হেসেছিল শেহজাদ। জলদগম্ভীর চেহারাখানা পাল্টে ঠোঁটের বাঁকে তখন খেলে গিয়েছিল বাঁকা হাসি। সেদিন বিকেলের মূহুর্তটুকু মানস পটে ভাসতেই মস্তিষ্ক ছক কষলো আরশিকে আরো খানিক নাজেহাল করার পায়তারায়। নাজুক পেলব শরীরটা যে তার বেলেল্লাপনায় এ’কদিনেই নাজেহাল সে চিন্তাটা খুব সূক্ষ্মভাবে ঝেড়ে ফেলেছে শেহজাদ। যতগুলো রাত আরশি সবকিছু বুঝেও দূরে থেকেছে, তার সুদসমেত আসল ফেরত নিতে হবে না? একথা ভাবনাতে আসতেই আরো একদফা মুচকি হাসলো নীল চোখের মানুষটা।
তেছড়া দৃষ্টিতে পরখ করে নিলো তার পাশে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করা রমনীকে। পরপরই ঠোঁটের হাসি চেপে পরিষ্কার গলায় শুধালো,

“ ঘুম না আসলে জোর করে এপাশ-ওপাশ করার দরকার নেই। জোর করে ঘুমের ভান করারও দরকার নেই। আমি আজ রাতে তোমাকে বেশি একটা জ্বালাবো না!”
হুট করেই স্থির হয় রমনী। কথার মানে আন্দাজ করে কাঠ হয় গতর। রুশার ভাবনাটুকু আপতত সরিয়ে ঋজু হয়ে উঠে বসে। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকায় ল্যাপটপে মনোযোগী হওয়া পুরুষটার পানে। শুধায়,
“ বেশি একটা জ্বালাবো না মানে? আর আপনার কেন মনে হলো যে আপনি জ্বালাতন করেন বলেই আমি আগেভাগে ঘুমিয়ে যাচ্ছি?”
শেহজাদ ল্যাপটপের নীল সাদা স্ক্রিনে চোখ রেখেই শান্ত গলায় বললো,
“ গতকাল রাতেও তুমি আমার আগে ঘুমিয়ে পড়েছিল! ডিড ইউ রিমেম্বার?”
আরশি থতমত খেলো। লজ্জায় টইটম্বুর হলো ডাগরডাগর চোখজোড়া। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে মাথা নুইয়ে কোনোমতে আওড়ালো,

“ সে তো গতকাল রাতে আপনি না আমায় বললেন যে আপনি কীসব ডক্টরাল থিসিস নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন! তাই তো আমি চাইনি আপনাকে বিরক্ত…”
আরশি পুরো কথা শেষও করতে পারলো না। তার আগেই বিস্ফোরিত চোখজোড়া খেয়াল করলো শেহজাদ কোলের ল্যাপটপটা বেডসাইড টেবিলে রেখে ঝুঁকে এসেছে ওর উপর। আরশি জানে এরপর কী হবে! তবুও দুরুদুরু কাঁপে ওর বুক। তেষ্টায় কাঠ হয় গলা। মরন আসে চোখে। শেহজাদের ঐ ঘোরলাগা চোখে চোখ রেখে চুপচাপ বসে থাকা অসাধ্য হয়ে যায় মেয়েটার জন্য। তাই তো পেছোনো শুরু করে একটু একটু করে। তারপর আচমকাই খেয়াল হয় তার পিঠ লেগে গেছে বেডের হেডবোর্ডে। ম্যাটেলের ঘড়ি পরা বলিষ্ঠ হাতখানা তার মাথার পাশে রেখে কেউ একজন খুব কৌশলে বাহুবন্ধ করেছে তাকে। পালাবার সব পথ রুদ্ধ করে মেঘমন্দ্র ভারী স্বরটা বলে উঠলো,

“ আমি যতোই ব্যস্ত থাকি না কেনো আরশি! রাতে আমার তোমাকে প্রয়োজন। ঘুমন্ত মানুষের ঘুম নষ্ট করিনা আমি! তাই নিজেকে বহু কষ্টে সামলে নিয়েছি গতকাল। কিন্তু প্রতিদিন সেটা হচ্ছে না। আমি প্রতিদিন নিজেকে সামলাবো না স্নোফ্ল্যাক!”
আরশি তখন চোখ তুলে তাকিয়েছে কোনমতে। রাজ্যের বিস্ময় ভর করেছে ঐ নিকষকালো মণি জোড়ায়। সপ্রশ্ন কন্ঠে শুধালো,
“ তাহলে আপনি কী করবেন?”
শেহজাদ হাসলো নিঃশব্দে। লাজবন্তীর কৌতূহল দমাতে আস্কারা দিলো বেহায়া মনটা। হাতের তর্জনী তুলে আলগোছে গুছিয়ে দিলো আরশির কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো। তারপর কন্ঠ নামিয়ে আওড়ালো,
“ তোমাকে জ্বালাবো! খুব বাজেভাবে।”

আরশি বোঝে শেহজাদের ইঙ্গিত। তবুও কথা ঘোরাতে অবুঝ বালিকার মতো জিজ্ঞেস করলো,
“ স্নোবল যেভাবে জ্বালায়? আপনিও সেভাবে জ্বালাবেন? ইস! কী লজ্জার কথা! স্নোবল না হয় অবুঝ অবলা প্রাণী। তাই বলে আপনিও ওর সাথে পাল্লা দেবেন?”
নিচের ঠোঁট দাঁতে পিষে হাসলো শেহজাদ। আরশির টুকটুকে কোমল ওষ্ঠপুটে বেলেহাজ দৃষ্টি ফেলে জবাবে বললো,
“ দেবো তো! পাল্লা দিয়ে আমি ওর চাইতেও বেশি জ্বালাবো তোমাকে। আমার আগে ঘুমিয়ে গেলে এই জ্বালানোর সময়সীমা বাড়বে। তবে এর ধরন হবে ভিন্ন। স্নোবলের বেলায় তুমি যেমন বিরক্ত হয়ে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদো? আমার বেলায় তুমি সুখের তাড়নায় কাঁদবে। আদরে আদরে লেপ্টে যাবে তোমার চোখের কাজল। এলোমেলো হবে এই গোছানো চুল। এবার বলো! সারা রাতের ঘুম নষ্ট করে সহ্য করে নেবে সেসব? নাকি অপেক্ষা করবে আমার জন্য?”

আরশি কিছু বলতে পারেনা। প্রচন্ড লজ্জায় আড়ষ্ট তার গলবিল। ফ্যালফ্যালে চোখের পাতা নড়লো! পলক পড়লো ঘনঘন৷ লালিমায় মাখামাখি হলো কপোল। তিরতির করে কাঁপলো ঠোঁট। কাঁপলো তার সমস্ত শরীর৷ লোম দাঁড়িয়ে গেলো ঘাড়ের। এই অসম্ভব অসভ্য লোকটার থেকে নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিতে কোনমতে আওড়ালো,
“ তারমানে আপনি বলতে চাইছেন আমি না ঘুমোলে আপনি এসব করবেন না? আমাকে জ্বালাবেন না?”
“করবো না? এই চিনলে তুমি আমাকে? স্নোফ্ল্যাক! আমি কিন্তু অতটাও শুদ্ধ, পবিত্র পুরুষ নই! ঐ যে বললাম! আমার কথা শুনলে শুধু ফারাক থাকবে তোমার রাতের ঘুমের। কথা শুনে চললে শেষ রাতে হয়তো ঘুমোতে পারবে, নয়তো সারারাত…”
অমনি একহাত তুলে শেহজাদের লাগামহীন মুখটা চেপে ধরলো আরশি। অন্যদিকে চোখ ফেরালো। কন্ঠে আকুতি নিয়ে বললো,

“ আচ্ছা শুনবো! সব কথাই শুনবো আপনার। তবুও দয়া করে আর কিছু বলবেন না। আপনি বলছেন অথচ লজ্জা লাগছে আমার। এবার একটু থামুন। প্লিজ”
আরশির শ্বাস পড়ছে ঘনঘন। না চাইতেও শতশত প্রজাপতির দলবল নিয়ে যেনো ছুটে বেড়াচ্ছে পেটের ভিতর। অশান্ত স্বরে আওড়ালো,
“ জাম্বুবান নামটাই যায় আপনার সাথে! তবে এবার থেকে আরো একটা শব্দ যোগ করবো। আপনাকে ডাকবো ঠোঁটকাটা জাম্বুবান বলে। বেশ হবে!”
শেহজাদের চোখ হাসে। ঠোঁটের উপর চেপে রাখা ছোট্ট হাতটার কব্জি ধরে হাতের তালুতে চুমু খায় প্রিয়দর্শিনীর পানে তাকিয়ে।
হাতে ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে আরশি ফিরে চায়। থমকায়। চমকে তাকিয়ে থাকে অপলক। পরপর নিজের হুঁশ ফিরিয়ে হাতটা সরিয়ে নিতেই শেহজাদ বলে উঠলো,

“ আর কত নাম দেবে আমার স্নোফ্ল্যাক! এবার থেকে অন্তত বাচ্চাদের নামও একটু ভেবে রেখো? উমম..লেট মি থিঙ্ক! আমি চাই আমাদের দুটো মেয়ে বাবু হোক। জমজ। তুমি ওদের নাম ঠিক না করে রাখলে আমিই নাম রেখে দেবো! পরে আবার আমার ঠিক করা নাম নিয়ে অভিযোগ করে বসো না!”
শেহজাদের কথার পিঠে আরশি অনুনয় নিয়ে তাকায়। আর কত লজ্জায় ফেলবে লোকটা ওকে? আর কত এসব বলে গালদুটো গরম করে দেবে ওর?
শেহজাদ আরশির ঐ অনুনয় ভরা চোখে তাকিয়ে আবারও ঠোঁট কামড়ে হাসে। সৌম্য সুন্দর মুখটায় ছড়িয়ে পড়ে তৃপ্ততার অনুভূতি।

তারপর ধীরে ধীরে ঝুঁকে এসে সে প্রথমেই চুমু খেলো আরশির ঐ কম্পিত ঠোঁটে। শিহরণে চোখ বুঁজে ফেলে মেয়েটা। মাথার পিছনে হাত রেখে তাকে বালিশে শোয়ালো শেহজাদ। তুলতুলে অধরজোড়া না ছেড়েই একহাতে খুলে ফেললো নিজের পরনের টি-শার্টটা। ততক্ষণে ঐ ঘনকালো চুলের ফাঁকে দৃশ্যমান হয়েছে আরশির ছোট ছোট আঙুলগুলো। প্রথমে ছটফট করলেও ধীরে ধীরে সয়ে নিয়েছে সবটা। নিজেও উন্মত্ত হয়েছে অর্ধাঙ্গের বেহায়া স্পর্শে। এ কেমন অনুভূতি? আরশি নাম খুঁজে পায় না। শুধু অনুভব করে ওর শরীর নয়, মনটাও যে আদরে জড়িয়ে নিয়েছে শেহজাদ। এই মানুষটার থেকে পালানোর চিন্তা করাও পাপ। মুখ ঘুরিয়ে নেয়া অন্যায়৷ তার ডাকে সাড়া না দেয়া মানে ওদের এই পবিত্র ভালোবাসার অপমান।
তাই তো যেনো পুতুলটির মতো পড়ে রয় ওর থেকে দ্বিগুণ বড় ঐ দেহের নিচে। শেহজাদের চওড়া কাঁধ পিঠ ছাপিয়ে রুমের সিলিংটুকুও অদৃশ্য হয় দৃষ্টিসীমার। সত্যি সত্যি এবার আরশির চোখে ভেজে। শেহজাদ মেয়েটার মৃদু কান্নার শব্দ শুনে থমকে তাকায়। স্বর নামিয়ে চিন্তিত হয়ে শুধায়,

“আজকেও কষ্ট হচ্ছে?”
আরশি ঠোঁট টিপে চোখ খিঁচে দু’দিকে মাথা নাড়লো। তবুও জল গড়ায় বন্ধ চোখের কার্ণিশ বেয়ে। আদুরে হাত দুটো আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে শেহজাদের কাঁধ।
শেহজাদ মৃদু হাসে। আলতো চুমু খায় আরশির ভেজা চোখে। মেয়েটার চোখের পানিতে ঠোঁট ভিজিয়ে মুখ ডোবায় ওর গলার ভাঁজে।
ভোর অবধি তাদের এভাবেই কাটে। আদরে ভাসে দুটো বন্য মন। তারপর অনেকটাসময় অনাচ্ছাদিত শরীরজোড়া লেপ্টে থাকে একে অপরের সাথে৷ কোমর অবধি চাদর টেনে শেহজাদের বাহুর ওপর মাথা রেখেছে আরশি। কান্নাকাটির পাট চুকিয়ে চুপচাপ তর্জনী ঘুরিয়ে চলে উন্মুক্ত পুরুষালী বুকে। শেহজাদ মাথার নিচে ভাজ করে রেখেছে তার অন্যহাত। নরম চোখে দেখে যাচ্ছে আরশির আঙুল দিয়ে এই অদৃশ্য আঁকিবুঁকি। তন্মধ্যেই শুনতে পায় আদরিনীর ক্ষীণ কন্ঠ,

“ আপনি তখন জমজ মেয়ের কথা কেনো বললেন? আপনার কী মেয়ে বাবু খুব পছন্দ?”
শেহজাদ তখনও চোখ ফেরাতে পারে না ঐ ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মুখটা থেকে। ছোট করে জানায়,
“ হু! পছন্দ তো! তোমার মতো মেয়ে বাবু পছন্দ!”
আরশি মেকি গাল ফুলায়। ঠোঁট উল্টে বলে,
“ আমি মোটেই বাবু নই!”
“বড়ও তো নও!”
আরশি দমে যায়। শেহজাদের ফুরফুরে মেজাজ দেখেশুনে ফের খুলে বসে নিজের প্রশ্নের ঝুলি। জিজ্ঞেস করে,
“ আর আপনার মেয়ে বাবু কেনো এতো পছন্দ?”
এবার একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলার শব্দ শোনে আরশি। শেহজাদ কিছুটা সময় চুপ থেকে শান্ত স্বরে ধীরে ধীরে আওড়ালো,
“ রুশার জন্য।”

রুশার নাম শুনেই আরশি মুখ তুলে চাইলো শেহজাদের দিকে। মানুষটার ঐ সৌম্যজ্জ্বল আননখানা হুট করেই ভীষণ মলিন ঠেকলো তার চোখে। কন্ঠটাও শোনালো বিষন্ন। আরশির দিকে না তাকিয়েই এবার শেহজাদ বলতে লাগলো,
“ তোমাকে আমার আর রুশার ছোট বেলার ছোট্ট একটা গল্প শোনাই। শুনবে?”
আরশি সাগ্রহে তাকাতেই শেহজাদ বলতে লাগলো,
“আমি জয়েন ফ্যামিলিতে বড় হতে পারিনি। বাবার কাজের সুবাদে ছোট থেকেই দেশান্তর তোমার এই নিপাট ভদ্রলোক স্বামীটি!”
“ সবাই এটা জানলেও শুধু বোধ হয় আমিই জানি যে আপনি মোটেও ভদ্রলোক নন। নিপাট ভদ্রলোকের বেশ ধরা অতি অভদ্র একজন মানুষ আপনি। তাই মিথ্যে বলার জন্য আপনার এক নাম্বার কাটা। সে যাই হোক! তারপর বলুন !”

আরশি আর কথা বাড়ালো না। আবারও আগ্রহ নিয়ে তাকালো বাকিটুকু শুনতে। শেহজাদ আলতো হেসে আওড়ালো,
“ আমি ছোট থেকে দশ-বারো বছর পর্যন্ত একাই বড় হয়েছি! আয়ান ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, ভাই সব। তবুও মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতাম একটা মেয়ে বাবুর জন্য। সবসময় ভাবতাম যদি আমার একটা বোন থাকতো তাহলে তাকে এটা কিনে দিতাম ওটা কিনে দিতাম। সবসময় পুতুল বানিয়ে রাখতাম নিজের কাছে। যা চাইতো তাই এনে দিতাম।
অবশেষে আমাদের পরিবারের এই পুতুলটির না থাকার ফাঁকটুকু পূরণ হলো৷ হাসান ভিলায় খবর এলো ওর আগমনী বার্তার। আমি মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম আমার বোনকে সব বিপদ থেকে আগলানোর জন্য। সব বিপদ থেকে! তারপর হুট করেই একদিন সত্যি সত্যি আমাদের রুশা এলো। হসপিটালে ওর ঐ ছোট্ট শরীরটা সবার প্রথমে নিজে কোলে নেয়ার জন্য তোলপাড় জুড়ে দিলাম। বায়না করলাম আমার বোনকে সবার আগে আমি কোলে নেবো। আবার ভয়ও পাচ্ছিলাম যদি ও ব্যথা পায় এই ভেবে। মা হাসতেন আমার পাগলামি দেখে। আবার আমার মতো ভয়ও পেতেন। সত্যি সত্যি যদি ফেলে টেলে দেই কোলে নিতে গিয়ে। তাই আমার কোলে দিতেন না খুব একটা৷ আমি কোলে না নিলেও অবাক বিস্ময়ে ওর ছোট্ট ছোট্ট আঙুলগুলো ধরে দেখতাম। ওর ছোট্ট পা টা দেখিয়ে মাকে বলতাম, মা বাচ্চাদের পা বুঝি এতো নরম হয়? ও তো হাঁটতেই পারবে না!”

“তারপর?”
শেহজাদ একটু থামলো। মাথা নুইয়ে কাঠ হেসে বললো,
“ মা হাসতেন। বলতেন, তুই আছিস না? বোন হাঁটতে না পারলে তুই ওকে কাঁধে চড়িয়ে দুনিয়া ঘোরাবি। পারবি না? আমিও মায়ের সাথে হাসতাম৷ খুব আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছিলাম পারবো৷ কিন্তু আমি পারিনি। ওকে দুনিয়া ঘোরানোর আগেই…”
শেহজাদের গলা ধরে আসে। যে মানুষগুলো রুশার জন্য এতো ছটফট করে, প্রতিনিয়ত এতো কষ্ট পায় তারা তো জানেই না রুশা তাদের কত্তো কাছে আছে। আরশি ঢোক গেলে। গলায় দলা পাকানো কান্নাটুকু গিলে রেখে বলে,
“ আমি একটা আবদার করবো? আপনি রাখবেন?”
শেহজাদ প্রশ্ন চোখে তাকাতেই আরশি আওড়ায়,

“ এ মাসে কী আছে জানেন তো?”
“মায়ের জন্মদিন? এছাড়া বিশেষ কিছু তো মনে পড়ছে না!”
আরশি এবার সোজা হয়ে উঠে বসে। কন্ঠ টানটান করে বলে,
“ হ্যাঁ! মায়ের জন্মদিন! আর মায়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমরা সবাই মিলে একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করবো। আর আপনার কাজ হলো আমি যা যা বলবো সেগুলো আমাকে এনে দেওয়া। পারবেন তো?”
শেহজাদ দোটানায় পড়ে। আমতা আমতা করে জানায়,
“ আরশি, আই নো! তুমি সবার খুশির জন্য এসব আয়োজন করতে চাইছো! কিন্তু মা এসব হয়তো পছন্দ করবেন না। নিজের কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানই সে পালন করতে পছন্দ করে না রুশা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে। আমরাও মাকে জোর করি না!”

“ তাহলে আমার জন্মদিন যে ধুমধাম করে পালন করলেন? কই? তখন তো মাকে একবারও মন খারাপ করে থাকতে দেখিনি?”
“ দেখোনি কারণ মা তোমাকে স্নেহ করেন! স্নেহ বোঝো?”
আরশি বোঝে মায়ের স্নেহ কী জিনিস! তাই তো দৃঢ় কন্ঠে জানায়,
“ তবুও আপনি সব আয়োজন করবেন! মায়ের জন্যই করবেন! এটা আপনার কাছে আমার শেষ অনুরোধ! পারবেন না?”
শেহজাদ এবার স্মিত হাসে। আরশির জেদের সামনে হার মানে তার সমস্ত দ্বিরুক্তি। মেয়েটাকে টেনে এনে বুকের সাথে মিশিয়ে সম্মতি দিতেই খুশিতে ঝুমঝুম করে ওঠে আরশি। ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হয় মিষ্টি এক হাসিতে। তারপর কখন যে একটু জিরিয়ে নিতে চোখ বুঁজে নেয়? ভারী ঐ বুকটায় মাথা ঠেকিয়ে বড় শান্তি শান্তি অনুভব করে মেয়েটা। এরপর যে অনেক কাজ তার! শেহজাদ আলতো হাতে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় শ্রান্ত চোখজোড়া।

ক্যালেন্ডারের পাতা বদলানোর সাথে সাথে রঙ বদলায় নিউইয়র্কের প্রকৃতিতেও। গ্রীষ্মের কড়কড়া রোদে মানুষ গরম কাপড় তুলে রেখে থিতু হয় পাতলা কাপড়ে। গাছের ডালে নতুন কুড়ি গজায়! ইস্টার্ন ফোবি লেজ নেড়ে তার মোটা গলায় গান ধরে নতুন ঋতুর অভ্যর্থনায়। আজও পুবের গায়ে হামাগুড়ি দিয়ে ওঠে ঝলমলে রোদ। কিন্তু বিকেলের দিকে এসেই আবার থমথমে মেঘ জমে আকাশে। মৃদুমন্দ বাতাসে আরশির এলোখোঁপার চুল ওড়ে। কোমরে আঁচল গুঁজে বিরিয়ানি চড়িয়েছে আরশি। একটু পর পর হাতের উল্টো পিঠে ঘাম মুছে নিচ্ছে কপালের।
সকাল থেকে পুরোদস্তুর মতে চলছে মরিয়ম বেগমের জন্মদিনের আয়োজন। আরশিই খেটেখুটে যা করার করছে। মরিয়ম বেগমকে নিচে অবধি নামতে দেয়নি। আরশি সব কাজ গুছিয়ে তাকেও শাড়ি পরিয়ে একবারে নিয়ে আসবে নিচের বসার ঘরে। এমনটাই পরিকল্পনা রমনীর।

পাকা গিন্নির মতো হলুদ সাদা সুতির শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে আগেই মরিয়ম বেগমকে রাজি করিয়েছে অনুষ্ঠানটা হতে দিতে। আরশির মা-সুলভ আবদার ফেলতে পারেনি মরিয়ম। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলেননি। যা করতে চাইছে করুক, সে-ই বা আর কতদিন নিজের দুঃখ ভুলতে অন্যের আনন্দ আঁটকে রাখবে?
বাইরে আঁধার থাকলেও সন্ধ্যে নামতেই ঝলমলিয়ে উঠলো হাসান ভিলার আঙিনা। সমস্ত বসার ঘর, বারান্দা, রুমগুলোতে ফেইরি-লাইট লাগিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে বাড়ির ড্রাইভার রবিনসন। তবুও মুখে লেপ্টে আছে তার অমায়িক হাসি। আরশির রান্নাবান্নার কাজ শেষ। মরিয়ম বেগমকে সাজিয়ে নিজেকেও গুছিয়ে নিলো মেয়েটা। তারপর ঘড়ির কাঁটা গুণেগুণে অপেক্ষা করতে লাগলো শেহজাদের। কেক নিয়ে এখনো আসছে না কেন মানুষটা? জারা আর আয়ান ভাইকেই বা কখন আনতে যাবেন?

ঠিক তখনই দরজা পরিয়ে বসার ঘরে ঢোকে একজোড়া দৃঢ় কদম। ফরমাল সফেদ শার্টটার হাতা কনুই অবধি গোটানো। মসৃণ কপালখানায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাতে কেকের বক্স।
শেহজাদকে দেখেই আরশির মুখে হাসি ফোঁটে। দৌড়ে এসে আগে জিজ্ঞেস করে,
“ আপনার কষ্ট হয়ে গেলো না এসব আনতে?”
শেহজাদ এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা দেখে নেয় প্রথমে। হাতের কেকটা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে দু-হাত পিছনে গোঁজে। ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি ঝুলিয়ে আরশির দিকে ঝুঁকে আসে অল্প। গম্ভীর গলার মানুষটা হুট করে স্বর পাল্টে বলে উঠলো,
“ আমি নাহয় একটু কষ্ট করলাম! তুমি নাহয় সেসব কষ্ট পুষিয়ে দিতে রাতে একটু কম কম কিপ্টেমি করলে? এতো মিষ্টি একটা বউ আমার! শুধু কথায় কথায় লজ্জা পেয়ে নাক লাল করে ফেললে হবে? স্বামীর আবদার মেটাতে হবে না?”

erআরশি সেদিন রাতে অবশ্য জানাতে পারলো না কাউকে কিছু। আরো কিছু প্রমাণ জোগাড় করতে হবে। সেই চিন্তায় রাতটা হাঁসফাঁস করেই কাটতে লাগলো তরুণীর। বিছানায় আসতেই সহধর্মিণীর এমন ছটফট নজরে এড়ালো না শেহজাদের।
ফরমাল পাল্টে মাত্রই গায়ে চড়িয়েছে সফেদ টি-শার্ট আর ট্রাউজার। রাতের খাবার শেষে ল্যাপটপ কোলের উপর রেখে আধশোয়া হয়ে বসেছে বিছানায়। আজও আয়ানের থানায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছে আদির ব্যাপারে। আয়ানরা তৎপর। তার টিম ইতিমধ্যেই নজরবন্দি করে রেখেছে আদির বাবা-মাকে। আদিও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না তুখোড় এই সুরক্ষাবাহিণীর হাত থেকে। উর্দি যখন পরেছে মান তো রাখতেই হবে।
এমনটাই বলেছে আয়ান। নিজের হাজারটা চিন্তা লুকিয়ে শেহজাদকে দুশ্চিন্তা করতেও না করেছে কথার ফাঁকে। তার মতে শেহজাদের এখন উচিত আয়ানকে চাচা বানানোর চিন্তা বেশি বেশি করা। আদি-টাদিকে সে সামলে নিতে পারবে।

আয়ানের নিছক দুষ্টুমি ধরতে পেরে মৃদু হেসেছিল শেহজাদ। জলদগম্ভীর চেহারাখানা পাল্টে ঠোঁটের বাঁকে তখন খেলে গিয়েছিল বাঁকা হাসি। সেদিন বিকেলের মূহুর্তটুকু মানস পটে ভাসতেই মস্তিষ্ক ছক কষলো আরশিকে আরো খানিক নাজেহাল করার পায়তারায়। নাজুক পেলব শরীরটা যে তার বেলেল্লাপনায় এ’কদিনেই নাজেহাল সে চিন্তাটা খুব সূক্ষ্মভাবে ঝেড়ে ফেলেছে শেহজাদ। যতগুলো রাত আরশি সবকিছু বুঝেও দূরে থেকেছে, তার সুদসমেত আসল ফেরত নিতে হবে না? একথা ভাবনাতে আসতেই আরো একদফা মুচকি হাসলো নীল চোখের মানুষটা।
তেছড়া দৃষ্টিতে পরখ করে নিলো তার পাশে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করা রমনীকে। পরপরই ঠোঁটের হাসি চেপে পরিষ্কার গলায় শুধালো,

“ ঘুম না আসলে জোর করে এপাশ-ওপাশ করার দরকার নেই। জোর করে ঘুমের ভান করারও দরকার নেই। আমি আজ রাতে তোমাকে বেশি একটা জ্বালাবো না!”
হুট করেই স্থির হয় রমনী। কথার মানে আন্দাজ করে কাঠ হয় গতর। রুশার ভাবনাটুকু আপতত সরিয়ে ঋজু হয়ে উঠে বসে। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকায় ল্যাপটপে মনোযোগী হওয়া পুরুষটার পানে। শুধায়,
“ বেশি একটা জ্বালাবো না মানে? আর আপনার কেন মনে হলো যে আপনি জ্বালাতন করেন বলেই আমি আগেভাগে ঘুমিয়ে যাচ্ছি?”
শেহজাদ ল্যাপটপের নীল সাদা স্ক্রিনে চোখ রেখেই শান্ত গলায় বললো,
“ গতকাল রাতেও তুমি আমার আগে ঘুমিয়ে পড়েছিল! ডিড ইউ রিমেম্বার?”
আরশি থতমত খেলো। লজ্জায় টইটম্বুর হলো ডাগরডাগর চোখজোড়া। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে মাথা নুইয়ে কোনোমতে আওড়ালো,

“ সে তো গতকাল রাতে আপনি না আমায় বললেন যে আপনি কীসব ডক্টরাল থিসিস নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন! তাই তো আমি চাইনি আপনাকে বিরক্ত…”
আরশি পুরো কথা শেষও করতে পারলো না। তার আগেই বিস্ফোরিত চোখজোড়া খেয়াল করলো শেহজাদ কোলের ল্যাপটপটা বেডসাইড টেবিলে রেখে ঝুঁকে এসেছে ওর উপর। আরশি জানে এরপর কী হবে! তবুও দুরুদুরু কাঁপে ওর বুক। তেষ্টায় কাঠ হয় গলা। মরন আসে চোখে। শেহজাদের ঐ ঘোরলাগা চোখে চোখ রেখে চুপচাপ বসে থাকা অসাধ্য হয়ে যায় মেয়েটার জন্য। তাই তো পেছোনো শুরু করে একটু একটু করে। তারপর আচমকাই খেয়াল হয় তার পিঠ লেগে গেছে বেডের হেডবোর্ডে। ম্যাটেলের ঘড়ি পরা বলিষ্ঠ হাতখানা তার মাথার পাশে রেখে কেউ একজন খুব কৌশলে বাহুবন্ধ করেছে তাকে। পালাবার সব পথ রুদ্ধ করে মেঘমন্দ্র ভারী স্বরটা বলে উঠলো,
“ আমি যতোই ব্যস্ত থাকি না কেনো আরশি! রাতে আমার তোমাকে প্রয়োজন। ঘুমন্ত মানুষের ঘুম নষ্ট করিনা আমি! তাই নিজেকে বহু কষ্টে সামলে নিয়েছি গতকাল। কিন্তু প্রতিদিন সেটা হচ্ছে না। আমি প্রতিদিন নিজেকে সামলাবো না স্নোফ্ল্যাক!”
আরশি তখন চোখ তুলে তাকিয়েছে কোনমতে। রাজ্যের বিস্ময় ভর করেছে ঐ নিকষকালো মণি জোড়ায়। সপ্রশ্ন কন্ঠে শুধালো,

“ তাহলে আপনি কী করবেন?”
শেহজাদ হাসলো নিঃশব্দে। লাজবন্তীর কৌতূহল দমাতে আস্কারা দিলো বেহায়া মনটা। হাতের তর্জনী তুলে আলগোছে গুছিয়ে দিলো আরশির কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো। তারপর কন্ঠ নামিয়ে আওড়ালো,
“ তোমাকে জ্বালাবো! খুব বাজেভাবে।”
আরশি বোঝে শেহজাদের ইঙ্গিত। তবুও কথা ঘোরাতে অবুঝ বালিকার মতো জিজ্ঞেস করলো,
“ স্নোবল যেভাবে জ্বালায়? আপনিও সেভাবে জ্বালাবেন? ইস! কী লজ্জার কথা! স্নোবল না হয় অবুঝ অবলা প্রাণী। তাই বলে আপনিও ওর সাথে পাল্লা দেবেন?”
নিচের ঠোঁট দাঁতে পিষে হাসলো শেহজাদ। আরশির টুকটুকে কোমল ওষ্ঠপুটে বেলেহাজ দৃষ্টি ফেলে জবাবে বললো,
“ দেবো তো! পাল্লা দিয়ে আমি ওর চাইতেও বেশি জ্বালাবো তোমাকে। আমার আগে ঘুমিয়ে গেলে এই জ্বালানোর সময়সীমা বাড়বে। তবে এর ধরন হবে ভিন্ন। স্নোবলের বেলায় তুমি যেমন বিরক্ত হয়ে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদো? আমার বেলায় তুমি সুখের তাড়নায় কাঁদবে। আদরে আদরে লেপ্টে যাবে তোমার চোখের কাজল। এলোমেলো হবে এই গোছানো চুল। এবার বলো! সারা রাতের ঘুম নষ্ট করে সহ্য করে নেবে সেসব? নাকি অপেক্ষা করবে আমার জন্য?”

আরশি কিছু বলতে পারেনা। প্রচন্ড লজ্জায় আড়ষ্ট তার গলবিল। ফ্যালফ্যালে চোখের পাতা নড়লো! পলক পড়লো ঘনঘন৷ লালিমায় মাখামাখি হলো কপোল। তিরতির করে কাঁপলো ঠোঁট। কাঁপলো তার সমস্ত শরীর৷ লোম দাঁড়িয়ে গেলো ঘাড়ের। এই অসম্ভব অসভ্য লোকটার থেকে নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিতে কোনমতে আওড়ালো,
“ তারমানে আপনি বলতে চাইছেন আমি না ঘুমোলে আপনি এসব করবেন না? আমাকে জ্বালাবেন না?”
“করবো না? এই চিনলে তুমি আমাকে? স্নোফ্ল্যাক! আমি কিন্তু অতটাও শুদ্ধ, পবিত্র পুরুষ নই! ঐ যে বললাম! আমার কথা শুনলে শুধু ফারাক থাকবে তোমার রাতের ঘুমের। কথা শুনে চললে শেষ রাতে হয়তো ঘুমোতে পারবে, নয়তো সারারাত…”
অমনি একহাত তুলে শেহজাদের লাগামহীন মুখটা চেপে ধরলো আরশি। অন্যদিকে চোখ ফেরালো। কন্ঠে আকুতি নিয়ে বললো,

“ আচ্ছা শুনবো! সব কথাই শুনবো আপনার। তবুও দয়া করে আর কিছু বলবেন না। আপনি বলছেন অথচ লজ্জা লাগছে আমার। এবার একটু থামুন। প্লিজ”
আরশির শ্বাস পড়ছে ঘনঘন। না চাইতেও শতশত প্রজাপতির দলবল নিয়ে যেনো ছুটে বেড়াচ্ছে পেটের ভিতর। অশান্ত স্বরে আওড়ালো,
“ জাম্বুবান নামটাই যায় আপনার সাথে! তবে এবার থেকে আরো একটা শব্দ যোগ করবো। আপনাকে ডাকবো ঠোঁটকাটা জাম্বুবান বলে। বেশ হবে!”
শেহজাদের চোখ হাসে। ঠোঁটের উপর চেপে রাখা ছোট্ট হাতটার কব্জি ধরে হাতের তালুতে চুমু খায় প্রিয়দর্শিনীর পানে তাকিয়ে।
হাতে ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে আরশি ফিরে চায়। থমকায়। চমকে তাকিয়ে থাকে অপলক। পরপর নিজের হুঁশ ফিরিয়ে হাতটা সরিয়ে নিতেই শেহজাদ বলে উঠলো,

“ আর কত নাম দেবে আমার স্নোফ্ল্যাক! এবার থেকে অন্তত বাচ্চাদের নামও একটু ভেবে রেখো? উমম..লেট মি থিঙ্ক! আমি চাই আমাদের দুটো মেয়ে বাবু হোক। জমজ। তুমি ওদের নাম ঠিক না করে রাখলে আমিই নাম রেখে দেবো! পরে আবার আমার ঠিক করা নাম নিয়ে অভিযোগ করে বসো না!”
শেহজাদের কথার পিঠে আরশি অনুনয় নিয়ে তাকায়। আর কত লজ্জায় ফেলবে লোকটা ওকে? আর কত এসব বলে গালদুটো গরম করে দেবে ওর?
শেহজাদ আরশির ঐ অনুনয় ভরা চোখে তাকিয়ে আবারও ঠোঁট কামড়ে হাসে। সৌম্য সুন্দর মুখটায় ছড়িয়ে পড়ে তৃপ্ততার অনুভূতি।

তারপর ধীরে ধীরে ঝুঁকে এসে সে প্রথমেই চুমু খেলো আরশির ঐ কম্পিত ঠোঁটে। শিহরণে চোখ বুঁজে ফেলে মেয়েটা। মাথার পিছনে হাত রেখে তাকে বালিশে শোয়ালো শেহজাদ। তুলতুলে অধরজোড়া না ছেড়েই একহাতে খুলে ফেললো নিজের পরনের টি-শার্টটা। ততক্ষণে ঐ ঘনকালো চুলের ফাঁকে দৃশ্যমান হয়েছে আরশির ছোট ছোট আঙুলগুলো। প্রথমে ছটফট করলেও ধীরে ধীরে সয়ে নিয়েছে সবটা। নিজেও উন্মত্ত হয়েছে অর্ধাঙ্গের বেহায়া স্পর্শে। এ কেমন অনুভূতি? আরশি নাম খুঁজে পায় না। শুধু অনুভব করে ওর শরীর নয়, মনটাও যে আদরে জড়িয়ে নিয়েছে শেহজাদ। এই মানুষটার থেকে পালানোর চিন্তা করাও পাপ। মুখ ঘুরিয়ে নেয়া অন্যায়৷ তার ডাকে সাড়া না দেয়া মানে ওদের এই পবিত্র ভালোবাসার অপমান।
তাই তো যেনো পুতুলটির মতো পড়ে রয় ওর থেকে দ্বিগুণ বড় ঐ দেহের নিচে। শেহজাদের চওড়া কাঁধ পিঠ ছাপিয়ে রুমের সিলিংটুকুও অদৃশ্য হয় দৃষ্টিসীমার। সত্যি সত্যি এবার আরশির চোখে ভেজে। শেহজাদ মেয়েটার মৃদু কান্নার শব্দ শুনে থমকে তাকায়। স্বর নামিয়ে চিন্তিত হয়ে শুধায়,

“আজকেও কষ্ট হচ্ছে?”
আরশি ঠোঁট টিপে চোখ খিঁচে দু’দিকে মাথা নাড়লো। তবুও জল গড়ায় বন্ধ চোখের কার্ণিশ বেয়ে। আদুরে হাত দুটো আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে শেহজাদের কাঁধ।
শেহজাদ মৃদু হাসে। আলতো চুমু খায় আরশির ভেজা চোখে। মেয়েটার চোখের পানিতে ঠোঁট ভিজিয়ে মুখ ডোবায় ওর গলার ভাঁজে।
ভোর অবধি তাদের এভাবেই কাটে। আদরে ভাসে দুটো বন্য মন। তারপর অনেকটাসময় অনাচ্ছাদিত শরীরজোড়া লেপ্টে থাকে একে অপরের সাথে৷ কোমর অবধি চাদর টেনে শেহজাদের বাহুর ওপর মাথা রেখেছে আরশি। কান্নাকাটির পাট চুকিয়ে চুপচাপ তর্জনী ঘুরিয়ে চলে উন্মুক্ত পুরুষালী বুকে। শেহজাদ মাথার নিচে ভাজ করে রেখেছে তার অন্যহাত। নরম চোখে দেখে যাচ্ছে আরশির আঙুল দিয়ে এই অদৃশ্য আঁকিবুঁকি। তন্মধ্যেই শুনতে পায় আদরিনীর ক্ষীণ কন্ঠ,

“ আপনি তখন জমজ মেয়ের কথা কেনো বললেন? আপনার কী মেয়ে বাবু খুব পছন্দ?”
শেহজাদ তখনও চোখ ফেরাতে পারে না ঐ ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মুখটা থেকে। ছোট করে জানায়,
“ হু! পছন্দ তো! তোমার মতো মেয়ে বাবু পছন্দ!”
আরশি মেকি গাল ফুলায়। ঠোঁট উল্টে বলে,
“ আমি মোটেই বাবু নই!”
“বড়ও তো নও!”
আরশি দমে যায়। শেহজাদের ফুরফুরে মেজাজ দেখেশুনে ফের খুলে বসে নিজের প্রশ্নের ঝুলি। জিজ্ঞেস করে,
“ আর আপনার মেয়ে বাবু কেনো এতো পছন্দ?”
এবার একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলার শব্দ শোনে আরশি। শেহজাদ কিছুটা সময় চুপ থেকে শান্ত স্বরে ধীরে ধীরে আওড়ালো,

“ রুশার জন্য।”
রুশার নাম শুনেই আরশি মুখ তুলে চাইলো শেহজাদের দিকে। মানুষটার ঐ সৌম্যজ্জ্বল আননখানা হুট করেই ভীষণ মলিন ঠেকলো তার চোখে। কন্ঠটাও শোনালো বিষন্ন। আরশির দিকে না তাকিয়েই এবার শেহজাদ বলতে লাগলো,
“ তোমাকে আমার আর রুশার ছোট বেলার ছোট্ট একটা গল্প শোনাই। শুনবে?”
আরশি সাগ্রহে তাকাতেই শেহজাদ বলতে লাগলো,
“আমি জয়েন ফ্যামিলিতে বড় হতে পারিনি। বাবার কাজের সুবাদে ছোট থেকেই দেশান্তর তোমার এই নিপাট ভদ্রলোক স্বামীটি!”
“ সবাই এটা জানলেও শুধু বোধ হয় আমিই জানি যে আপনি মোটেও ভদ্রলোক নন। নিপাট ভদ্রলোকের বেশ ধরা অতি অভদ্র একজন মানুষ আপনি। তাই মিথ্যে বলার জন্য আপনার এক নাম্বার কাটা। সে যাই হোক! তারপর বলুন !”

আরশি আর কথা বাড়ালো না। আবারও আগ্রহ নিয়ে তাকালো বাকিটুকু শুনতে। শেহজাদ আলতো হেসে আওড়ালো,
“ আমি ছোট থেকে দশ-বারো বছর পর্যন্ত একাই বড় হয়েছি! আয়ান ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, ভাই সব। তবুও মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতাম একটা মেয়ে বাবুর জন্য। সবসময় ভাবতাম যদি আমার একটা বোন থাকতো তাহলে তাকে এটা কিনে দিতাম ওটা কিনে দিতাম। সবসময় পুতুল বানিয়ে রাখতাম নিজের কাছে। যা চাইতো তাই এনে দিতাম।
অবশেষে আমাদের পরিবারের এই পুতুলটির না থাকার ফাঁকটুকু পূরণ হলো৷ হাসান ভিলায় খবর এলো ওর আগমনী বার্তার। আমি মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম আমার বোনকে সব বিপদ থেকে আগলানোর জন্য। সব বিপদ থেকে! তারপর হুট করেই একদিন সত্যি সত্যি আমাদের রুশা এলো। হসপিটালে ওর ঐ ছোট্ট শরীরটা সবার প্রথমে নিজে কোলে নেয়ার জন্য তোলপাড় জুড়ে দিলাম। বায়না করলাম আমার বোনকে সবার আগে আমি কোলে নেবো। আবার ভয়ও পাচ্ছিলাম যদি ও ব্যথা পায় এই ভেবে। মা হাসতেন আমার পাগলামি দেখে। আবার আমার মতো ভয়ও পেতেন। সত্যি সত্যি যদি ফেলে টেলে দেই কোলে নিতে গিয়ে। তাই আমার কোলে দিতেন না খুব একটা৷ আমি কোলে না নিলেও অবাক বিস্ময়ে ওর ছোট্ট ছোট্ট আঙুলগুলো ধরে দেখতাম। ওর ছোট্ট পা টা দেখিয়ে মাকে বলতাম, মা বাচ্চাদের পা বুঝি এতো নরম হয়? ও তো হাঁটতেই পারবে না!”

“তারপর?”
শেহজাদ একটু থামলো। মাথা নুইয়ে কাঠ হেসে বললো,
“ মা হাসতেন। বলতেন, তুই আছিস না? বোন হাঁটতে না পারলে তুই ওকে কাঁধে চড়িয়ে দুনিয়া ঘোরাবি। পারবি না? আমিও মায়ের সাথে হাসতাম৷ খুব আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছিলাম পারবো৷ কিন্তু আমি পারিনি। ওকে দুনিয়া ঘোরানোর আগেই…”
শেহজাদের গলা ধরে আসে। যে মানুষগুলো রুশার জন্য এতো ছটফট করে, প্রতিনিয়ত এতো কষ্ট পায় তারা তো জানেই না রুশা তাদের কত্তো কাছে আছে। আরশি ঢোক গেলে। গলায় দলা পাকানো কান্নাটুকু গিলে রেখে বলে,
“ আমি একটা আবদার করবো? আপনি রাখবেন?”
শেহজাদ প্রশ্ন চোখে তাকাতেই আরশি আওড়ায়,
“ এ মাসে কী আছে জানেন তো?”
“মায়ের জন্মদিন? এছাড়া বিশেষ কিছু তো মনে পড়ছে না!”
আরশি এবার সোজা হয়ে উঠে বসে। কন্ঠ টানটান করে বলে,

“ হ্যাঁ! মায়ের জন্মদিন! আর মায়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমরা সবাই মিলে একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করবো। আর আপনার কাজ হলো আমি যা যা বলবো সেগুলো আমাকে এনে দেওয়া। পারবেন তো?”
শেহজাদ দোটানায় পড়ে। আমতা আমতা করে জানায়,
“ আরশি, আই নো! তুমি সবার খুশির জন্য এসব আয়োজন করতে চাইছো! কিন্তু মা এসব হয়তো পছন্দ করবেন না। নিজের কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানই সে পালন করতে পছন্দ করে না রুশা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে। আমরাও মাকে জোর করি না!”
“ তাহলে আমার জন্মদিন যে ধুমধাম করে পালন করলেন? কই? তখন তো মাকে একবারও মন খারাপ করে থাকতে দেখিনি?”
“ দেখোনি কারণ মা তোমাকে স্নেহ করেন! স্নেহ বোঝো?”
আরশি বোঝে মায়ের স্নেহ কী জিনিস! তাই তো দৃঢ় কন্ঠে জানায়,
“ তবুও আপনি সব আয়োজন করবেন! মায়ের জন্যই করবেন! এটা আপনার কাছে আমার শেষ অনুরোধ! পারবেন না?”

শেহজাদ এবার স্মিত হাসে। আরশির জেদের সামনে হার মানে তার সমস্ত দ্বিরুক্তি। মেয়েটাকে টেনে এনে বুকের সাথে মিশিয়ে সম্মতি দিতেই খুশিতে ঝুমঝুম করে ওঠে আরশি। ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হয় মিষ্টি এক হাসিতে। তারপর কখন যে একটু জিরিয়ে নিতে চোখ বুঁজে নেয়? ভারী ঐ বুকটায় মাথা ঠেকিয়ে বড় শান্তি শান্তি অনুভব করে মেয়েটা। এরপর যে অনেক কাজ তার! শেহজাদ আলতো হাতে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় শ্রান্ত চোখজোড়া।

ক্যালেন্ডারের পাতা বদলানোর সাথে সাথে রঙ বদলায় নিউইয়র্কের প্রকৃতিতেও। গ্রীষ্মের কড়কড়া রোদে মানুষ গরম কাপড় তুলে রেখে থিতু হয় পাতলা কাপড়ে। গাছের ডালে নতুন কুড়ি গজায়! ইস্টার্ন ফোবি লেজ নেড়ে তার মোটা গলায় গান ধরে নতুন ঋতুর অভ্যর্থনায়। আজও পুবের গায়ে হামাগুড়ি দিয়ে ওঠে ঝলমলে রোদ। কিন্তু বিকেলের দিকে এসেই আবার থমথমে মেঘ জমে আকাশে। মৃদুমন্দ বাতাসে আরশির এলোখোঁপার চুল ওড়ে। কোমরে আঁচল গুঁজে বিরিয়ানি চড়িয়েছে আরশি। একটু পর পর হাতের উল্টো পিঠে ঘাম মুছে নিচ্ছে কপালের।
সকাল থেকে পুরোদস্তুর মতে চলছে মরিয়ম বেগমের জন্মদিনের আয়োজন। আরশিই খেটেখুটে যা করার করছে। মরিয়ম বেগমকে নিচে অবধি নামতে দেয়নি। আরশি সব কাজ গুছিয়ে তাকেও শাড়ি পরিয়ে একবারে নিয়ে আসবে নিচের বসার ঘরে। এমনটাই পরিকল্পনা রমনীর।

পাকা গিন্নির মতো হলুদ সাদা সুতির শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে আগেই মরিয়ম বেগমকে রাজি করিয়েছে অনুষ্ঠানটা হতে দিতে। আরশির মা-সুলভ আবদার ফেলতে পারেনি মরিয়ম। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলেননি। যা করতে চাইছে করুক, সে-ই বা আর কতদিন নিজের দুঃখ ভুলতে অন্যের আনন্দ আঁটকে রাখবে?
বাইরে আঁধার থাকলেও সন্ধ্যে নামতেই ঝলমলিয়ে উঠলো হাসান ভিলার আঙিনা। সমস্ত বসার ঘর, বারান্দা, রুমগুলোতে ফেইরি-লাইট লাগিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে বাড়ির ড্রাইভার রবিনসন। তবুও মুখে লেপ্টে আছে তার অমায়িক হাসি। আরশির রান্নাবান্নার কাজ শেষ। মরিয়ম বেগমকে সাজিয়ে নিজেকেও গুছিয়ে নিলো মেয়েটা। তারপর ঘড়ির কাঁটা গুণেগুণে অপেক্ষা করতে লাগলো শেহজাদের। কেক নিয়ে এখনো আসছে না কেন মানুষটা? জারা আর আয়ান ভাইকেই বা কখন আনতে যাবেন?

ঠিক তখনই দরজা পরিয়ে বসার ঘরে ঢোকে একজোড়া দৃঢ় কদম। ফরমাল সফেদ শার্টটার হাতা কনুই অবধি গোটানো। মসৃণ কপালখানায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাতে কেকের বক্স।
শেহজাদকে দেখেই আরশির মুখে হাসি ফোঁটে। দৌড়ে এসে আগে জিজ্ঞেস করে,
“ আপনার কষ্ট হয়ে গেলো না এসব আনতে?”
শেহজাদ এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা দেখে নেয় প্রথমে। হাতের কেকটা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে দু-হাত পিছনে গোঁজে। ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি ঝুলিয়ে আরশির দিকে ঝুঁকে আসে অল্প। গম্ভীর গলার মানুষটা হুট করে স্বর পাল্টে বলে উঠলো,
“ আমি নাহয় একটু কষ্ট করলাম! তুমি নাহয় সেসব কষ্ট পুষিয়ে দিতে রাতে একটু কম কম কিপ্টেমি করলে? এতো মিষ্টি একটা বউ আমার! শুধু কথায় কথায় লজ্জা পেয়ে নাক লাল করে ফেললে হবে? স্বামীর আবদার মেটাতে হবে না?”

আরশির চোখ বিস্ময়ে রসগোল্লা। শেহজাদ কথা থামাতেই তড়িৎ হাতে ঢেকে ফেলে নিজের নাক। এতো সাজুগুজু করে কী লাভ হলো? সেই যদি নাকটাই সার্কাসের জোকারের মতো লাল হয়ে থাকে? মেয়েটা অস্বস্তিতে পড়লো ভীষণ। শেহজাদের পানে চেয়ে অসহায় কন্ঠে শুধালো,
“ আসলেই কি আমার নাক লাল হয়ে গিয়েছে? বিচ্ছিরি লাগছে খুব?”

শেহজাদ ঠোঁট টিপে হাসি আঁটকে ঋজু হয়ে দাঁড়ায়। নীলাভ চোখ জোড়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যেন স্ক্যান করে নেয় আলুথালু গোছে শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকা আরশিকে। অমনি ঠোঁটের সেই হাসি মুছে যায় শেহজাদের৷ শুকনো ঢোকের সাথে নড়ে ওঠে ওর গলার ঢিবির মতো জায়গাটা। চোখ আঁটকে গেছে শাড়ির আঁচলের ফাঁক গলে বেরিয়ে থাকা আরশির মেদহীন উদরে। ফর্সা শরীরে সাদা ব্লাউজ আর হলুদ সুতির শাড়িতে মেয়েটার রূপ-লাবণ্য বেড়েছে দ্বিগুন। আকৃষ্ট হচ্ছে ওর পৌরুষ সত্তা। নিজেকে আঁটকে রাখতে না পেরে দু’হাত আরশির কোমরে গলিয়ে তাকে টেনে মেশায় বুকের সাথে। তারপর এক হাত তুলে খুলে দেয় আরশির এলো খোঁপা। লম্বা রেশমের মতো ঘনকালো চুলগুলো ঝুপ করে লুটিয়ে পড়ে রমনীর পিঠে। হতবিহ্বল চোখজোড়া শেহজাদের দিকে তাকাতেই মানুষটা প্রশ্রয়ের সুরে বলে উঠলো,

“ এতক্ষণ কিছু একটার খামতি ছিল। এখন পরিপূর্ণ হয়েছে!”
“ কীসের খামতি ছিল?”
শেহজাদ হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে। আরো শক্ত করে মেশায় মেয়েটাকে বক্ষভাগে। তারপর স্বর নামিয়ে আওড়ালো,
“ তোমার গালের এই লজ্জাটুকুর খামতি ছিল। এই খোলা চুলের খামতি ছিল। চুলগুলো খোলাই রেখো সবসময় শাড়ির সাথে! আমি আমার চোখের তেষ্টা মেটাবো এই স্নিগ্ধময়ীকে দেখে দেখে!”
আরশি আরো খানিকটা লজ্জায় মিইয়ে যায় শেহজাদের বুকে। তবে সবাই এসে যাবে খেয়াল হতেই হাঁসফাঁস করে ওঠে লাজবন্তী। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই থমকায় মেয়েটা৷ শুনতে পায় সদর দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসা পুরুষালী স্বর। সাথে মেয়েলী খিলখিল হাসি।

“ তোরা এমন পথ আঁটকে রোমান্স করবি জানলে আরেকটু পরেই না হয় আসতাম! শুধু শুধু আমার মতো এমন অবিবাহিত মিঙ্গেলদের ডেকে টর্চার করার কোনো মানে হয়?”
আয়ান আহত। মর্মাহত। বন্ধুর এহেন দশা দেখে লটকে গেছে ওর চোখমুখ। গলার স্বর সেই লটকানো চোখমুখ থেকেও দ্বিগুণ বেশি দুঃখী। জারা সেসব দেখে পেট চেপে ধরে হাসছে। আয়ানের পাশেই দাঁড়ানো সে। পরনের সাদা মিডি ড্রেসের সাথে হাতে ফুলের তোড়া। সাথে জেনেথ ওয়ালজের দ্য গ্লাস কাস্টেল বইটি। মরিয়ম বেগমের জন্যই নিয়ে এসেছে। মানুষটা বই পড়তে যে ভালোবাসে সে কথা আরশিই জানিয়েছে জারাকে।
আয়ান তখনও ডিউটির কালো পোশাক পরে আছে। চোখেমুখে মেকি বিরক্তি নিয়ে সে শেহজাদের দিকে তাকাতেই প্রফেসর ব্যস্ত হাতে ছেড়ে দেয় আরশিকে।

ছাড়া পেয়ে আরশি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও বিব্রত হয় ভীষণ। মাথা নুইয়ে শাড়ি ঠিক করে দাঁড়ায়। মানুষটার কী কোনোদিন একটু কান্ডজ্ঞান হবে না? এভাবে বসার ঘরে কেউ জড়িয়ে ধরে? ওনার জন্য কী ভীষণ বেকায়দায় পড়লো আরশি? এবার সবার সামনে আসবে কী করে ও?
জোড়াশালিক দুটিকে মূহুর্তেই দু’দিকে ছিটকে সরে
যেতে দেখে এবার শব্দ করেই হেসে ওঠে আয়ান-জারা দু’জনই। তবে তাতে শেহজাদ মোটেই ইতস্তত হলো না। উল্টে আয়ানের উপর হলো ত্যক্ত-বিরক্ত। আয়ানকে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে দেখেই লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এলো তার কাছাকাছি। তারপর সবাইকে আড়াল করে সজোরে চিমটি কাটলো ওর পেটে। আচমকা এমন আক্রমনে এবার আর সতর্ক হতে পারলো না অফিসার। ব্যথাতুর শব্দ করে মুচড়ে উঠলো চিমটি খেয়ে। শুনলো কানের কাছে এসে শেহজাদ হিসহিসিয়ে বলছে,

“ শুধু একটু ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিস, বাসর তো আর করতে দেখিসনি। তাহলে এতো হাসার কী আছে? দেখছিস না আমার বউ লজ্জা পাচ্ছে? দাঁতগুলো এখনই মুখের ভিতর ঢোকা আর হাসি বন্ধ কর! এখনই করবি! নইলে তোর একদিন কি আমার একদিন আয়ান!”
আরশির চোখ বিস্ময়ে রসগোল্লা। শেহজাদ কথা থামাতেই তড়িৎ হাতে ঢেকে ফেলে নিজের নাক। এতো সাজুগুজু করে কী লাভ হলো? সেই যদি নাকটাই সার্কাসের জোকারের মতো লাল হয়ে থাকে? মেয়েটা অস্বস্তিতে পড়লো ভীষণ। শেহজাদের পানে চেয়ে অসহায় কন্ঠে শুধালো,
“ আসলেই কি আমার নাক লাল হয়ে গিয়েছে? বিচ্ছিরি লাগছে খুব?”

শেহজাদ ঠোঁট টিপে হাসি আঁটকে ঋজু হয়ে দাঁড়ায়। নীলাভ চোখ জোড়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যেন স্ক্যান করে নেয় আলুথালু গোছে শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকা আরশিকে। অমনি ঠোঁটের সেই হাসি মুছে যায় শেহজাদের৷ শুকনো ঢোকের সাথে নড়ে ওঠে ওর গলার ঢিবির মতো জায়গাটা। চোখ আঁটকে গেছে শাড়ির আঁচলের ফাঁক গলে বেরিয়ে থাকা আরশির মেদহীন উদরে। ফর্সা শরীরে সাদা ব্লাউজ আর হলুদ সুতির শাড়িতে মেয়েটার রূপ-লাবণ্য বেড়েছে দ্বিগুন। আকৃষ্ট হচ্ছে ওর পৌরুষ সত্তা। নিজেকে আঁটকে রাখতে না পেরে দু’হাত আরশির কোমরে গলিয়ে তাকে টেনে মেশায় বুকের সাথে। তারপর এক হাত তুলে খুলে দেয় আরশির এলো খোঁপা। লম্বা রেশমের মতো ঘনকালো চুলগুলো ঝুপ করে লুটিয়ে পড়ে রমনীর পিঠে। হতবিহ্বল চোখজোড়া শেহজাদের দিকে তাকাতেই মানুষটা প্রশ্রয়ের সুরে বলে উঠলো,

“ এতক্ষণ কিছু একটার খামতি ছিল। এখন পরিপূর্ণ হয়েছে!”
“ কীসের খামতি ছিল?”
শেহজাদ হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে। আরো শক্ত করে মেশায় মেয়েটাকে বক্ষভাগে। তারপর স্বর নামিয়ে আওড়ালো,
“ তোমার গালের এই লজ্জাটুকুর খামতি ছিল। এই খোলা চুলের খামতি ছিল। চুলগুলো খোলাই রেখো সবসময় শাড়ির সাথে! আমি আমার চোখের তেষ্টা মেটাবো এই স্নিগ্ধময়ীকে দেখে দেখে!”
আরশি আরো খানিকটা লজ্জায় মিইয়ে যায় শেহজাদের বুকে। তবে সবাই এসে যাবে খেয়াল হতেই হাঁসফাঁস করে ওঠে লাজবন্তী। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই থমকায় মেয়েটা৷ শুনতে পায় সদর দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসা পুরুষালী স্বর। সাথে মেয়েলী খিলখিল হাসি।

“ তোরা এমন পথ আঁটকে রোমান্স করবি জানলে আরেকটু পরেই না হয় আসতাম! শুধু শুধু আমার মতো এমন অবিবাহিত মিঙ্গেলদের ডেকে টর্চার করার কোনো মানে হয়?”
আয়ান আহত। মর্মাহত। বন্ধুর এহেন দশা দেখে লটকে গেছে ওর চোখমুখ। গলার স্বর সেই লটকানো চোখমুখ থেকেও দ্বিগুণ বেশি দুঃখী। জারা সেসব দেখে পেট চেপে ধরে হাসছে। আয়ানের পাশেই দাঁড়ানো সে। পরনের সাদা মিডি ড্রেসের সাথে হাতে ফুলের তোড়া। সাথে জেনেথ ওয়ালজের দ্য গ্লাস কাস্টেল বইটি। মরিয়ম বেগমের জন্যই নিয়ে এসেছে। মানুষটা বই পড়তে যে ভালোবাসে সে কথা আরশিই জানিয়েছে জারাকে।
আয়ান তখনও ডিউটির কালো পোশাক পরে আছে। চোখেমুখে মেকি বিরক্তি নিয়ে সে শেহজাদের দিকে তাকাতেই প্রফেসর ব্যস্ত হাতে ছেড়ে দেয় আরশিকে।

ছাড়া পেয়ে আরশি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও বিব্রত হয় ভীষণ। মাথা নুইয়ে শাড়ি ঠিক করে দাঁড়ায়। মানুষটার কী কোনোদিন একটু কান্ডজ্ঞান হবে না? এভাবে বসার ঘরে কেউ জড়িয়ে ধরে? ওনার জন্য কী ভীষণ বেকায়দায় পড়লো আরশি? এবার সবার সামনে আসবে কী করে ও?
জোড়াশালিক দুটিকে মূহুর্তেই দু’দিকে ছিটকে সরে
যেতে দেখে এবার শব্দ করেই হেসে ওঠে আয়ান-জারা দু’জনই। তবে তাতে শেহজাদ মোটেই ইতস্তত হলো না। উল্টে আয়ানের উপর হলো ত্যক্ত-বিরক্ত। আয়ানকে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে দেখেই লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এলো তার কাছাকাছি। তারপর সবাইকে আড়াল করে সজোরে চিমটি কাটলো ওর পেটে। আচমকা এমন আক্রমনে এবার আর সতর্ক হতে পারলো না অফিসার। ব্যথাতুর শব্দ করে মুচড়ে উঠলো চিমটি খেয়ে। শুনলো কানের কাছে এসে শেহজাদ হিসহিসিয়ে বলছে,

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪৯

“ শুধু একটু ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিস, বাসর তো আর করতে দেখিসনি। তাহলে এতো হাসার কী আছে? দেখছিস না আমার বউ লজ্জা পাচ্ছে? দাঁতগুলো এখনই মুখের ভিতর ঢোকা আর হাসি বন্ধ কর! এখনই করবি! নইলে তোর একদিন কি আমার একদিন আয়ান!”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫১