নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৬
সিনথিয়া
শেহজাদ এসে যখন আয়ানের পাশে বসলো তখনও ছেলেটা নিজের ভাবনায় বিভোর। সামনে রাখা সেমাইয়ের বাটি ধোয়া ছেড়েছে বহুক্ষন। একটু ঠান্ডা হোক, তারপর খাচ্ছি খাচ্ছি করেও শেষ অবধি গলা থেকে নামলো না কিছুই আয়ানের।
আরশি বসেছে শেহজাদের বরাবর উল্টো পাশের চেয়ারটাতে। জারার কাছে। আরশিকে খেয়াল করতেই মরিয়ম বেগম জিজ্ঞেস করে বসলেন,
“ কাল রাতে যে বললি, শায়ানটার কি সব যেন খোঁয়া গেছে, সেসব গুছিয়ে দিয়েই চলে আসবি! কই এলি না তো? আমি আর রুশা কতক্ষণ বসে রইলাম তোর জন্য!”
জারা হেসে ফেললো ঠোঁট টিপে। আঞ্জুমান মনখারাপের সুরে বললেন,
“ সে কি? তোমরা রাতে গল্প করেছো! আর আমাকে বললে না? এ কিন্তু ভারি অন্যায়!”
জারা এবার হাসি থামিয়ে টেনে টেনে আওড়ালো,
“ মনি! তুমি মন খারাপ করো না! পরেরবার থেকে তোমাকেই বলবো! আরশিটা এতো ভুলো মনা না? কিছুই মনে থাকে না ওর! কাল রাতেও তো মনে হয় ভুলে গিয়েছিল আমাদের আড্ডা দেয়ার কথা! এজন্যই আসতে পারেনি! তাই না রে আরশি!”
মরিয়ম আঁতকে উঠলেন মেয়ের কথায়। বোকা বোকা চোখে আরশিকে কতক্ষন দেখেই কিছু একটা মনে পড়লো তার। শাসানোর ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ এজন্যই আমি তোকে এতো করে বাদাম টাদাম খেতে বলি। এভাবে সবকিছু ভুলে গেলে তো পরীক্ষায় ডাব্বা মেরে বসে থাকবি। হ্যাঁ রে! ক্লাসে পড়া টড়া ঠিক করে দিতে পারিস তো? তোকে নিয়ে আমার এতো দুশ্চিন্তা হয় না!”
আরশি নিজের জন্য প্লেট ওল্টাচ্ছিল। মরিয়মের কথা শোনামাত্রই আনমনে বলে বসলো,
“ আরে ধূর! মা তুমি বেশি চিন্তা করছো আমাকে নিয়ে। আমি ভুলে টুলে যাইনি কিছু! সে- তো কাল রাতে আমি তোমার ছেলেকে…!
পাউরুটিতে বাটার লাগাতে লাগাতে মরিয়মের হাত থেমে গেলো। আঞ্জুমান খাওয়া থামিয়ে দিলেন। জারা চোখ বড় বড় করে ঘাড় ঘোরালো আরশির দিকে। মুখে তার সেমাইয়ের চামচ। আয়ানও এবার টেবিল থেকে চোখ তুলে তাকালো আরশির দিকে।
ওদিকে শেহজাদ? যে এতক্ষণ নিজের জায়গায় বেশ নির্বিকারই ছিল। সে পর্যন্ত মুখের সামনে জুসের গ্লাস নিয়েই বিষম খেয়ে বসলো আরশির কথা শেষ হওয়ার আগে।
আরশি জমে বরফ। এতো জোড়া চোখ ওর দিকে তাকিয়ে? কী বলে ফেললো সে এটা?
আঞ্জুমান কোনোমতে ঢোকের সাথে গলার খাবারটুকু গিললেন৷ পরপরই একবার শেহজাদ আর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধিয়ে বসলেন,
“ তুমি শেহজাদকে… কী করেছিলে মা?”
এতক্ষণে আরশি অসহায় চোখে তাকালো সবার দিকে। অপ্রস্তুত হলো ভীষণ। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো! যেন উপায় খুঁজলো কথা ঘুরোনোর! অবশেষে কিছু না পেয়ে শব্দ করে হেসে উঠলো মেয়েটা। ভাবলো, একটু বেশি হাসলে বোধহয় সবাই কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যাবে ব্যাপারটা নিয়ে। মুখ ফসকে মানুষ তো কত কিছুই বলে ফেলে! সব এমন করে ধরলে চলে?
কিন্তু কেউ-ই ঠিক ভুলে গেলো না ব্যাপারখানা। আরো উন্মুখ হয়ে রইলো শেহজাদকে আরশি কী করেছে শোনার জন্য। এমনকি আয়ানও। শ্বশুরের চিন্তায় যার মুখ শুকিয়ে এইটুকুন হয়েছিল? সে-ও এখন বন্ধুর হাঁটে হাড়ি ভাঙার জন্য সবচেয়ে বেশি উদগ্রীব।
ওদিকে সমানে কেশে যাচ্ছে শেহজাদ। যেন আরশিকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য অদৃশ্য অনুরোধ করে চলেছে দু’হাত জোর করে।
ছেলের কাশির শব্দে কপাল গোটালেন মরিয়ম। মুখ দিয়ে ‘চ’ সূচক শব্দ করে বলে উঠলেন,
“ আশ্চর্য! জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে এতো কাশছিস কেনো শায়ান। হয় জুস খা, নয় পানি খা! আমাদের শুনতে দে পুরো ব্যাপারটা আরশির মুখ দিয়ে!”
কে শোনে কার কথা? মায়ের কথা শুনে যেন কমে যাওয়ার বদলে কাশির মাত্রা আরো বেড়ে গেলো শেহজাদের। বড় বড় চোখে আরশির দিকে চেয়ে বুকে হাত রাখলো ছেলেটা। বা পাশটায় ব্যথা করছে কেনো হঠাৎ? টেনশনে?
আরশি জোর করে হেসে চলেছে তখনও। এখন কীভাবে সে বলবে কাল রাতে সে কী করেছে?
আয়ান মরিয়মের দিকে তাকিয়ে ছদ্ম অবাক কন্ঠে শুধালো,
“ একি অবস্থা? একজন সমানে কেশে চলেছে আর আরেকজন সমানে হাসছে! আন্টি! ওদের ভূতে টূতে পায়নি তো?”
আঞ্জুমান প্রতিবাদ জানিয়ে বললো,
“ কী বলছো বাবা? বিদেশে ভূত আসবে কী করে?”
জারার ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি,
“ বলা যায় না মনি! বিদেশে সাহেব ভূত থাকতেও পারে। কিন্তু তারা আরশিকে ধরলো কেনো? সেটাই তো বুঝতে পারছি না!”
মরিয়ম এবারেও বিরক্ত হলেন ভীষণ। দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলেন,
“ তোরা থামবি? মেয়েটা কী বলতে চাইছে সেটা অন্তত শুনতে দে!”
আরশি মনে মনে কপাল ঠুকলো টেবিলের সাথে। সে কিছু বলতে চাইছে না দেখেই তো হাসছে পাগলের মতো। সবাই যখন ওর মুখ থেকে গতরাতের কথা শুনেই ছাড়বে তখনই মেয়েটা হড়বড় করে বলে উঠলো,
“ না-নাচ শেখাচ্ছিলাম! ওনাকে আমি নাচ শেখাচ্ছিলাম গতকাল রাতে। জারা আর আয়ান ভাইয়ের বিয়েতে একটা সারপ্রাইজ পারফরম্যান্স করতে চেয়েছিলাম ওনাকে নিয়ে! কিন্তু নাচ টাচ তো উনি কিছুই পারেন না! তাই একটু শিখিয়ে দিচ্ছিলাম আর কি!”
সবাই ভূতগ্রস্তের মতো একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে এক স্বরে বলে উঠলো,
“ শেহজাদ আর নাচ?”
অসহায়ের মতো হাসলো আরশি। চোখ বন্ধ করে ঘাড় নোয়ালো শেহজাদ। বুকের ওপর চাপটা এখন একটু কম কম লাগছে যেন।
জারাই একমাত্র হাসি আড়াল করলো ঠোঁট টিপে। তারপর আরশির কথার সাথে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,
“ হ্যাঁ হ্যাঁ! আরশি ঠিকই বলেছে! গতকাল রাতে আমিও শুনেছি!”
সবাই আরো একবার তারস্বরে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
“ কী শুনেছো?”
আবারও শ্বাস খিঁচে নিলো আরশি। শেহজাদ কাঠ হয়ে বসে রইলো নিজের জায়গায়।
“ আরশি আর ভাইয়ার রুম থেকে গানের আওয়াজ আসছিল রাতে! আমি পানি খেতে রুম থেকে বেরিয়েছিলাম। তখনই শুনেছি! মানে আরশি আসলেই ভাইয়াকে কাপল ডান্স শেখাচ্ছিল আরকি। শুধু শুধু তোমরা মেয়েটাকে নার্ভাস করে দিলে! এখন কি আর সারপ্রাইজ, সারপ্রাইজ রইলো! সেই তো জেনেই গেলাম আমরা সবাই! ”
আরশি হতবুদ্ধ চোখে তাকালো জারার মুখের দিকে। কিন্তু আয়ান এতো সহজে ছাড়লো না শেহজাদকে। সে বন্ধুর আনত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই সমান অবাক কন্ঠে শুধালো,
“ তাই বলে এই আদা ছেঁচা আর ডান্স? যে মানুষ জীবনে একটা কবিতা আবৃত্তি করে দেখেছে কি না সন্দেহ! সে আমার বিয়েতে নাচবে? এটা তো আমার কল্পনারও বাইরে!”
মরিয়ম বেগমও শেহজাদের দিকে তাকালেন। হাতের কাজটুকু সারতে সারতে সমান অবাক স্বরে আওড়ালেন,
“ আমারও তো বিশ্বাস হচ্ছে না! হুটহাট…এতো পরিবর্তন?”
এতোক্ষণে যেন হাঁফ ছাড়লো আরশি। চোরাচোখে একবার দেখে নিলো শেহজাদকে। আহারে বেচারা! সবার প্রশ্নের মুখে পড়ে জমে বরফ হয়ে গেলো নাকি? পরপরই কিছু একটা শর্টসার্কিটের মতো খেলে গেলো মাথায়! ধড়ফড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো আয়ানকে,
“ আসল কথাই তো জানা হলো না! আয়ান ভাই! তোমার অগ্নিপরীক্ষা কেমন গেলো?”
জারাও খাওয়া থামিয়ে সপ্রশ্ন চোখে তাকালো আয়ানের বিমর্ষ মুখখানার দিকে। আয়ান প্লেটের খাবার নাড়তে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তাতেই যা বোঝার বুঝে ফেললো জারা। মনটা কেমন হুহু করে উঠলো আয়ানের এমন অবস্থা দেখে।
হুট করে এতোগুলো কাছের মানুষ পেয়ে সে কি তবে অবহেলা করে ফেললো নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে? রাতে একবার অন্তত আয়ানের খোঁজ নিয়ে আসা উচিত ছিল ওর!
আরশিও ফের নরম গলায় শুধালো,
“ তোমার চোখগুলো কেমন আলুর মতো ফুলে গিয়েছে ভাই! সত্যি করো বলো তো! তুমি কি কান্নাকাটি করেছো? তোমাকে মারে টারেনি তো বাবা?”
অমনি আঁতকে উঠলো জারা। আয়ান…পুলিশ হয়েও মার খেয়েছে শ্বশুরের হাতে? একযোগে খাবার টেবিলের সবার চোখ গেলো আয়ানের দিকে! কটমট করে উঠলেন মরিয়ম। মেহমেদের উপর হওয়া রাগ ঝাড়লেন হাতে ধরে রাখা পাউরুটিটার উপর। ওটাকে এক চাপে ভর্তা বানিয়ে ফেলে বললেন,
“ আজকে আসুক তোর বাবা! এতো বড় সাহস মেহমেদের! আমার সোনার টুকরো ছেলেটার গায়ে হাত তোলে ও? ক্যারোলিন! আমার রুটি বানানোর বেলন টা নিয়ে আয় তো! আজ ঐ মেহমেদ হাসানের একদিন কি আমার একদিন!”
আরশি ঢোক গিললো শাশুড়ির আচমকা এই রুদ্রমূর্তি দেখে। ওদিকে নির্লিপ্ত ভীষণ শেহজাদ। সে সেদ্ধ ব্রকলি আর ডিম চিবুচ্ছে মনের সুখে। যেন মেহমেদকে এমন মার-টার খেতে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে সে। নতুন কিছু নয় তা!
কিন্তু আরশি আর জারা ব্যাপারটা ঠিক হজম করতে পারলো না। আরশি তড়িঘড়ি করে বললো,
“ আহা! মা! তুমি শুধু শুধু বাবার উপর রেগে যাচ্ছো! ওটা তো আমি কথার কথা বলেছি! আয়ান ভাইয়ের মুখ থেকেই শুনি না পুরো কাহিনী!”
পরপর মনোযোগ ফেরালো আয়ানের দিকে। জিজ্ঞেস করলো,
“ ভাই! তুমি বলো তো গতকাল রাতে কী হয়েছে? বাবা কি কিছু বলেছে তোমাদের বিয়ে নিয়ে?”
আয়ান মাথা নাড়লো দু’পাশে। ছোট করে বললো,
“ না আরশি! কিছুই বলেনি!”
“ তাহলে? তোমার চোখগুলো অমন আলুর মতোন ফুলে গেলো কেমন করে?”
আরশির প্রশ্নে দুঃখে কষ্টে আয়ানের বুকটা ছিঁড়ে এলো যেন। হাওয়ার মতো যেটুকু মান সম্মান ছিল, জারার সামনে নাক দিয়ে পানি পড়লে তো সেটুকুও শেষ! তাই মনের জোরে নিজেকে শক্ত রাখলো সে। নয়তো বলেই ফেলতো,
“ আর আলু! তোমার শ্বশুর আমার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই করে রুম থেকে বেরিয়েছে গতকাল রাতে। হুমকি ধমকি দিয়ে অস্থির অবস্থা! আমার মতো নিরীহ একটা ছেলেকে কি না সে বলে, আমার মেয়ের জীবন থেকে বেরিয়ে যাও? আরে! আজব মানুষ তো! বেরিয়ে আমি যাবো টা কোথায়? যে দু-চোখে বাটারফ্লাই ছাড়া অন্ধকার দেখে! দিনে যার বাটারফ্লাইকে অন্তত একশটা চুমু না খেলে পেটের ভাত হজম হয় না। পারলে দিনের চব্বিশ ঘন্টাই যে তার মেয়ের পিছন পিছন ঘোরে! তাকে কি না সে এমন কড়া কড়া কথা বলে দিলো? একবারও বুক কাঁপলো না তার?”
আয়ানের চোখ ছলছল করে উঠলো হুট করে। শেহজাদও এবার গম্ভীর মুখে পিঠে হাত রাখলো ছেলেটার। দুষ্টমি বাদ দিয়ে স্বর নামিয়ে বললো,
“ বাবা না মানলে, আমি, আরশি আর মা আছি না? আমরা লুকিয়ে হলেও তোদের বিয়ে দিয়ে দিবো! চাপ নেই!”
আরশিও মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সম্মতি জানালো শেহজাদের সাথে। অথচ মূহুর্তেই শক্ত হয়ে গেলো আয়ানের চোখমুখ। শেহজাদের দিকে উদাসীন দৃষ্টি ফেলে বললো,
“ বাটারফ্লাইয়ের সাথে বিয়ে দিতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে তুই যে আমাকে পাচার করে দিবি না? সেটা আমি বুঝতে পারছি না ভেবেছিস? আমি জানি! মনে মনে আঙ্কেলের মতোই তুই অপছন্দ করিস আমাকে। তবে আমিও বলে রাখছি! শেয়ালের মুরগী ধরার দিন শেষ। আমাকে মুরগী ভেবে যদি ধরবি বলে বসে থাকিস! তাহলে কোনো লাভ হবে না। আগেই বলে দিলাম!”
আরশি বোকা বোকা স্বরে আওড়ালো,
“ কিন্তু মুরগী তো মেয়ে! তোমাকে ভাবলে বড়জোর মোরগ ভাবা যেতে পারে!”
লজ্জায় আয়ান চোখ খিঁচে নিলেও ফিক করে হেসে ফেললো জারা। যাকে নিয়ে এতো দুঃখ, সে-ই কি না আয়ানের দুঃখে হাসছে? মানুষটা বিস্ময়াহত হয়ে আওড়ালো,
“ এবার আমি বুঝতে পারছি! এমন নির্দয় হৃদয় শেহজাদ আর বাটারফ্লাই কার কাছ থেকে পেয়েছে? দু’জনই একেবারে রক্তে রক্তে আমার শ্বশুরমশাইয়ের ডিএনএ নিয়ে ঘুরছে যে! মন তো পাষাণ হবেই!”
মরিয়ম বেগম রাগের মধ্যেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন এবার। কাজের ছুঁতোয় পালিয়ে গেলেন রান্নাঘরে! রাগ কমতেই আয়ান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শুধোলো,
“ আন্টি চলে গেলো কেনো ওভাবে?”
শেহজাদ হতাশ শ্বাস ফেলে মাথা নাড়লো দু’পাশে। বিড়বিড় করে বললো,
“ গরু!”
অবশ্য সেটাও শুনে ফেললো আয়ান। আরশির কাছে নালিশ করার মতো করে আওড়ালো,
“ দেখলে আরশি দেখলে? তোমার বর আমাকে কেমন করে গরু বললো! শোন শেহজাদ! শুধু ভবিষ্যতে তুই আমার সম্বন্ধি হবি দেখে! নইলে, নইলে…!”
শেহজাদ নিস্পৃহ কন্ঠে শুধালো,
“ নইলে কী করবি তুই?”
আরশি ফের অসহায়ের মতো হাসলো পরিস্থিতি সামলাতে। এই দু’জনের মধ্যে মারামারি লেগে গেলে তো বিয়ের সব আনন্দ মাটি। পরপরই আয়ানকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
“ আরে ভাই! গরু কতো মিষ্টি একটা শব্দ তুমি জানো? গরু মানে তো বেস্ট ফ্রেন্ড! তুমি তো দেখছি বাংলা শব্দের কিছুই জানো না!”
শেহজাদ মাঝখান দিয়ে ব্রকলি চিবুতে চিবুতে বলে উঠলো,
“ মোটেই না! আমি ওকে মাঠের গরুই বলেছি! কোনো বেস্টফ্রেন্ড ট্রেন্ড মিন করে বলিনি!”
আয়ান ফের তেড়েফুঁড়ে উঠতে নিতেই আরশি বলে উঠলো,
“ আহা! ভাই! ওনার কথা বাদ দাও তো! আগে বলো বাবা কী আসলেই কিছু বলেননি রাতে তোমাকে? আমি তো ভেবেছিলাম কালকে রাতেই বাবা রাজি হয়ে যাবেন তোমাদের বিয়েতে। তুমিও প্রথম বলেই ছক্কা মেরে শ্বশুরকে পটিয়ে ফেলবে!”
আরশির কথায় দমে গেলো আয়ান। আবারও দুঃখী দুঃখী হয়ে গেলো তার মুখটা! অসহায় প্রেমিকের মতো টলমল চোখ নিয়ে বিড়বিড়ালো,
“ আর ছক্কা! আমার তো মনে হয়, প্রথম বলেই স্ট্যাম্প আউট হয়ে গেছি আমি আরশি! এখন শুধু কানটা ধরে আমাকে গ্যালারির বাইরে বের করে দেয়ার অপেক্ষায় বসে আছেন আমার শ্বশুরমশাই!”
“ আমি কান ধরে গ্যালারির বাইরে বের করি, এমন মিসইনফরমেশন তোমাকে কে দিয়েছে শুনি?”
গম্ভীর কন্ঠ শুনেই চেয়ারের সাথে সিটিয়ে গেলো আয়ান। মেহমেদ হাসান নেমে এসেছেন উপর থেকে? তার পিছনে দাঁড়িয়ে শুনেও নিয়েছেন সবটা?
জারা তো মনে মনে ঠিক করেই ফেলেছে! আয়ানের সাথে বিয়ে না হলে সে-ও বুকে পাথর চাপা দিয়ে গৃহত্যাগী হবে! এতবছর তো ছিলোই দূরে! আরো কিছু বছর না হয় থাকবে!
মেহমেদ এসে বসলেন টেবিলের একদম মাথায় রাখা চেয়ারটায়। ওনাকে বসতে দেখেই তেড়ে এলেন মরিয়ম। হাতে পরোটার ডালা। সেটা শব্দ করে রাখলেন ওনার সামনে। তারপর ঝাঁঝালো স্বরে শুধালেন,
“ তুমি রুশার বিয়ে নিয়ে কী ভেবেছ আমাদের একটু পরিষ্কার করে বলবে? নাকি তোমাকে বাদ দিয়েই আমি দিয়ে দেবো আমার মেয়ের বিয়ে?”
মেহমেদ থতমত খেলেন অল্প। সহধর্মিণীর সামনে বরাবরই সে বড় বাধ্য স্বামী। উচ্চবাচ্য তো দূর, মরিয়ম রেগে গেলে তার চোখের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস অবধি করেন না মেহমেদ। এবারও তেমনটাই হলো।
মিনমিন করে আওড়ালেন,
“ রেগে যাচ্ছো কেনো লক্ষ্মীটি? আমি তো সে ব্যাপারেই কথা বলবো বলে এলাম!”
ছেলো-মেয়েগুলোর সামনে মেহমেদের মুখে এমন ডাক শুনেই বিব্রত বোধ করলেন বোধহয় মরিয়ম। এদিকওদিক তাকালেন কুণ্ঠিত মুখখানা এড়াতে। কিন্তু! রাগটাও তো ধরে রাখতে হবে নাকি? যদি বিয়েতে আবার বাচ্চাদের মতো কোনো শর্ত টর্ত রেখে ছেলেটাকে নাজেহাল করতে চায় মেহমেদ?
আশপাশের মানুষের উপস্থিতি উপলব্ধি হতেই মেহমেদ আগের মতোই গম্ভীর করে ফেললেন মুখটা! গলার শ্লেষা দূর করে বলতে শুরু করলেন,
“ আয়ান আর রুশার বিয়েতে,…”
মেহমেদের এই সন্দেহজনক বিরতিতে আয়ানের প্রাণটা যেন গলায় এসে আঁটকে রইলো! আরশি তো সমানে ডেকে চলেছে উপরওয়ালাকে। শেহজাদের বিশেষ ভাবান্তর হলো বা অবশ্য। আঞ্জুমান আর মরিয়ম মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন একে অপরের।
একটু থেমে মেহমেদ অবশেষে সমাপ্তি টানলেন বাক্যখানায়,
“ আমি রাজি!”
প্রথমে মিনিটখানেক নীরবতা! তারপরই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল আয়ান। যেন ম্যাচ জিতে গিয়েছে এমনভাবে হইহই করে দৌড়ে গেলো টেবিলের ও মাথায়। গিয়েই জাপ্টে ধরলো চেয়ারে বসে থাকা মেহমেদকে। খুশিতে হুঁশ হারিয়ে চুমু খেয়ে বসলো শ্বশুরের গালে।
অমনি যেন আঁতকে উঠলো টেবিলে বসে থাকা সবাই। দু’পা পিছিয়ে গেলেন মরিয়ম। শেহজাদ ফের মাথা নাড়লো দু’পাশে। এ-ই পাগল কি-না বিয়ে করবে? যে পাগল বিয়ের খুশিতে শ্বশুরকে ধরে গালে চুমু খায়?
মেহমেদ তখনও বাকরুদ্ধ। আয়ান তাকে ছেড়ে হাসি হাসি মুখে বললো,
“ থ্যাঙ্কু শ্বশুরমশাই! থ্যাঙ্কুু!”
সবাই ভেবেছিল বোধহয় আবারও রেগে যাবেন মেহমেদ। কিন্তু সেই সবার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে আচমকাই ঘর কাঁপিয়ে হেসে ফেললেন তিনি। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ইশারায় কাছে ডাকলেন আয়ানকে। কাছে আসতেই দু’হাতে বুকে টেনে নিলেন ছেলেটাকে। পরপর স্বভাবসুলভ ফুরফুরে মেজাজে আওড়ালেন,
“ হাহা! ইয়র মোস্ট ওয়েলকাম ইয়ং ম্যান! ইয়র মোস্ট ওয়েলকাম!”
একটু থামলেন তিনি। তারপর ফের বললেন,
“ জামাই নয়! ছেলে হয়ে থেকো আমার পরিবারে বাবা! ছেলে হয়ে থেকো! এখন থেকে মনে রেখো, তোমার আরো একটা বাবা আছে! বাবার মতো কাজ হয়তো করতে পারিনি কোনোদিন, কিন্তু কথা দিচ্ছি! সামনে থেকে তোমার সমস্ত কঠিন পরিস্থিতে তুমি এই বাবাকে তোমার ঢাল হিসেবে পাবে! কথা দিচ্ছি আমি!”
আয়ান স্তম্ভিত ছিল। কিন্তু মেহমেদের কথায় এবার ঐ পুরুষ চোখেও পানি জমলো তার। বাবা-মায়ের অনুপস্থিতি বড়বেলায় না কাঁদালেও মেহমেদের এই একটা কথা তাকে কাঁদালো আজ।
সত্যি বলতে, শেহজাদও একেবারে নিশ্চিন্ত ছিলো না। তবে মেহমেদের বলা কথাগুলো যেন স্বস্তি দিয়েছে তাকেও।
তার নীল চোখজোড়া ঘুরে এলো আরশির দিকে। আরশি তখন মুচকি মুচকি হাসছে। শেহজাদকে তাকাতে দেখেই তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো মেয়েটা। ভাবখানা এমন যেন সে বহুআগে থেকেই জানতো, মেহমেদ মেনে নেবেন আয়ান আর জারাকে! শ্বশুরের ওপর তার প্রিয় বউমার যে সাংঘাতিক পর্যায়ের ভরসা!
শেহজাদও আর গোমড়া মুখে বসে থাকতে পারলো না৷ দুহাত মুখের সামনে এনে মাথা নোয়াতেই সূক্ষ্ম হাসির রেখা ছড়িয়ে পড়লো পীবর ঐ ওষ্ঠপুটে।
জারা বাবাকে জড়িয়ে ধরলো না ঠিকই, কিন্তু চোখজোড়া চিকচিক করে উঠলো তার আনন্দে। ওর প্রিয় মানুষটা ওর পরিবারের কাছ থেকে এতো আদর পাচ্ছে, এতো ভালোবাসা পাচ্ছে! এর থেকে শান্তির আর কিছু হতে পারে বুঝি?
মেহমেদ আর আয়ানের এই মূহুর্তটুকু মোবাইল বের করে ক্যামেরাবন্দি করে ফেললেন আঞ্জুমান। মরিয়মও চোখ মুছলেন মলিন হেসে। মিছে ভয়টুকু এতক্ষণে যেন দূর হয়েছে তার! তারপর ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে আওড়ালেন,
“ আর বিয়ের তারিখ? আমার কিন্তু তর সইছে না! আর আমি বাপু আগেই বলে রাখছি! আমার ছেলে- মেয়ে দুজনই বিয়ের পর আমার কাছে থাকবে! এ বাড়িটাই হবে ওদের নিজেদের বাড়ি! হ্যাঁ! আমরা বুড়ো-বুড়ি যখন আর থাকবো না, তখনকার কথা আলাদা। কিন্তু এখন কিছুতেই আমাদের থেকে আলাদা থাকা যাবে না!”
মেহমেদ মাথা দুলিয়ে হাসলেন। আঞ্জুমান বললেন,
“ তাহলে আসছে শুক্রবারই সেরে ফেলা যাক? শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি হবে ততই ভালো!”
মরিয়ম বেগমও সায় দিলেন,
“ সে-ই ভালো! তুমি কী বলো মেহমেদ?”
মেহমেদ যেন এবার বেশ রহস্য করে আওড়ালেন,
“ শুক্রবারেই? ভেবে বলছো তো? পারবে তো এতো তাড়াতাড়ি তোমাদের শপিং টপিং সব সেরে ফেলতে? বিয়ে কিন্তু একটা নয়!”
“ সে আমি ঠিক…!”
মরিয়ম একনাগারে কথাগুলো বলে যেতে নিয়েও থামলেন। চমকে তাকালেন মেহমেদের দিকে।
“ দাঁড়াও দাঁড়াও! বিয়ে একটা নয় মানে?”
চমকালো বাকিরাও। সবাই যখন প্রশ্ন চোখে মেহমেদের দিকে তাকিয়ে, তখনই আয়ান সরে এলো জারার পাশে। কন্ঠ নামিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“ শ্বশুরমশাই মনে হয় আরেকটা বিয়ে করবেন বাটারফ্লাই! কথায় কথায় আন্টির বেলন হাতে তেড়ে আসা নিয়েই মনে হয়, আঙ্কেল মনে মনে আপসেট ছিলেন এতোদিন। আজ আর থাকতে না পেরে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন! আহারে বেচারা!”
বাক্যে বিরাম দিয়ে আয়ান কেবল চুকচুক ধরনের আওয়াজ বের করবে, তার আগেই ওর পিঠের চামড়ায় চাপা চিমটি কাটলো জারা। মুখে ছদ্ম হাসি ধরে রেখে নিজেও কন্ঠ নামিয়ে বললো,
“ মা তো বেলন নিয়ে আসে! তুমি আর একটা উল্টো পাল্টা কথা বললে আমি কী নিয়ে আসবো জানো?”
অসহায় হাসলো আয়ান। ব্যথায় কুইকুই করতে করতেও কোনোমতে বললো,
“ ছিঃ ছিঃ! কি যে বলো না বাটারফ্লাই! আহ…আমার বউয়ের নরম হাত! বেলন, খুন্তি ওসব পঁচা পঁচা জিনিস…আহ! ওসব আমি তোমার হাতের আশেপাশেই রাখবো না! নিয়ে আসা তো দূরের কথা!”
মেহমেদ হাসানের রহস্যের এই খেলায় ব্যস্ত হলো আরশিও। অস্থির হয়ে বলে উঠলো,
“ বাবা! এবার কিন্তু তুমি বেশি রহস্য করে ফেলছো! এতো সাসপেন্স আর নেয়া যাচ্ছে না কিন্তু!”
মেহমেদ নিঃশব্দে হাসলেন আরশির কথায়। আঞ্জুমানও বললেন,
“ ভাইজান! আরশি মা কিন্তু ঠিকই বলেছে। আপনি বলেই ফেলুন তো! দুটো বিয়ের কাদের কাদের? যদিও আমি একটু একটু আন্দাজ করতে পারছি! তবুও আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই!”
অতঃপর রহস্য ভেদ করলেন মেহমেদ। শেহজাদ আর আরশির উদগ্রীব মুখের দিকে একবার একবার করে তাকিয়ে দৃষ্টি ফেললেন মরিয়মের দিকে। পরপর বেশ দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“ শুক্রবার দুটো বিয়ে হবে! একটা আমাদের আয়ান-রুশার! আরেকটা আমাদের শেহজাদ আর আরশি মায়ের!”
কথাখানা শোনা মাত্রই সবার আগে মুখে আঙুল পুরে শিস বাজালো আয়ান। জারা দৌড়ে এসে জাপ্টে ধরলো আরশিকে।
শেহজাদ ঘাড় তুললো না আর। নিচের ঠোঁট কামড়ে হেসে গেলো কেবল। মেহমেদ ফের বলে উঠলেন,
“ তোমার মনে আছে মরিয়ম? ওদের কিন্তু সেভাবে বিয়ের কোনো অনুষ্ঠানও হয়নি! ঘরোয়াভাবে বিয়ে, সেটাও কি ছেলের রাগের যন্ত্রণায় একটুও উপভোগ করতে পেরেছি?”
মরিয়মও মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললেন,
“ ঠিকই তো! রুশা আর আয়ানের বিয়ে এতো ধুমধাম করে হলে শেহজাদ আর আরশির বিয়ে এতো পানসে থাকবে কেনো? আমি তো সুন্দর সুন্দর ছবিও তুলতে পারিনি ওদের বিয়েতে! এবারে জমিয়ে ছবি তুলবো আমার এই চার ছেলেমেয়ের বিয়েতে!”
আঞ্জুমান বললেন,
“ আর ছবি তোলার দায়িত্ব কিন্তু আগে থেকেই আমি নিয়ে নিলাম আপা! ও ডিপার্টমেন্ট আমার!”
“ বেশ! সে না হয় নিলে! কিন্তু আরো যে অনেক কাজ বাকি! ডেকোরেশন, বিয়ের মেনু, শপিং কোনো কিছুই যে হয়নি!”
“ আরে আপা! আপনি শুধু শুধুই চিন্তা করছেন! বিয়ের কার্ডটা একবার বানানো হয়ে গেলে, বাকি কাজগুলো দেখবেন আপনা-আপনিই হয়ে গিয়েছে!”
মেহমেদ বললেন,
“ আর কয়েক মাস আগে সবটা ঠিক করতে পারলে বিয়ের আগেই আরশি মায়ের মা-বাবা আসতে পারতেন! কিন্তু এখন যখন সেটা হলো না, তারমানে বরদের বাবা, আর কনেদের বাবা, সবই কিন্তু আমি নিজে! এখানে কারোর ভাগ বসালে চলবে না!”
আরশি সেসব কিছু ভাবতেই পারলোনা। লজ্জায় কেবলই নুয়ে পড়তে লাগলো শেহজাদের এই লাজবন্তী। আসলেই তো! প্রথমবারে বিয়ে এতোই অদ্ভুতভাবে হয়েছিল, যে একটা ছবি পর্যন্ত তোলা হয়নি তাদের। আনন্দ করা তো দূরের কথা। তবুও দ্বিধা কমলো না ওর। আইঢাই করে বলে উঠলো,
“ ননদের বিয়েতে ভাবী হয়ে আমি যদি নিজেই বউ সেজে বসে থাকি, তাহলে এতো এতো কাজ কে করবে বাবা? এ তোমার ভারি অন্যায় আবদার!”
অমনি মরিয়ম পিছন থেকে ওর চিবুক ধরে বলে উঠলেন,
“ ওরে আমার পাকা বুড়িরে! তুই দু’দিন কাজ না করলে কী সূর্য উঠবে না এদেশে? আর তার থেকেও বড় কথা! তুই কখনো দেখেছিস, নতুন বউকে কাজ করতে?”
“ নতুন বউ মানে?”
পাশ থেকে ওর কাঁধ জড়িয়ে ধরলো জারা! চোখ টিপে বললো,
“ মানে এই যে, ভাইয়ার সাথে তোর বিয়েটা আবার নতুন করে হবে! প্রথম বিয়ে তো আমি পুরো মিস করে ফেলেছি! এবার কিন্তু আর একটা ইভেন্টও মিস করছি না!”
মরিয়ম বেগম বেশ শক্ত কন্ঠেই বললেন,
“ বিয়ের আগ অবধি তুই শেহজাদের আর কোনো ফাইফরমাশ খাটতে যাবি না বলে দিলাম! ওর কাজ ও একা একা করে নেবে! ও ঘরেও তোর যাওয়ার দরকার নেই! বিয়ে তো বিয়েই! ছেলেমেয়ের বিয়ের আগে এতো মেলামেশা ভালো নয়! বুঝলি?”
হাসি থামিয়ে মেহমেদ বিচলিত স্বরে বলে উঠলেন,
“ আমি তাহলে কার্ড ছাপাতে দিয়ে আসি? আর ডেকোরেটরকেও তো বলে রাখতে হবে আগে আগে! বাকি প্লানিং তোমরা মেয়েরা করে ফেলো? আর আয়ান বাবা! তুমি ছুটি নিয়ে ফেলো ক’দিনের জন্য। এ ক’দিন আর কাজে যাওয়ার দরকার নেই! শেহজাদ তোকেও বলছি! ভার্সিটির প্রেশার দেখাতে আসবি না আমাকে। ছুটি নিয়ে বাবার হাতে হাতে সাহায্য করবি! দু’দুটো বিয়ের কত কাজ তুই জানিস!”
বাধ্য ছেলের মতো মাথা দোলালো শেহজাদ। অমনি ভ্রু কুঁচকে ফেললো আরশি! মনে মনে বিড়বিড় করে বললো,
“ যেই নিজের বিয়ের কথা শুনেছে, অমনি খুব মজা নেয়া হচ্ছে তাই না? কেমন বোকার মতো হাসছে দেখো! আবার মাথাও নাড়ছে ছুটি নেবে বলে! বাবা তো আর জানেন না, যে তার ছেলে অলরেডি ছুটিই কাটাচ্ছে! জাম্বুবান কোথাকার! দাঁড়ান না! বের করছি আপনার হাসি!”
যেমন ভাবনা তেমন কাজ! সবাই যখন নিজেদের মতো বিয়ে নিয়ে আলাপ করতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই আরশি পা নাড়াতে নাড়াতে টেবিলের তলা দিয়েই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিলো শেহজাদের জুতোজোড়া। পরপর ক্রমেই শেহজাদ পা ঘেষে ওপরের দিকে উঠতে লাগলো আরশির বাসায় পরা স্লিপারখানা।
প্রথমে ব্যাপারটা পাত্তা না দিলেও এবার সতর্ক হলো শেহজাদ। আরশি বারবার একই কাজ করায় জুসের গ্লাসটা ঠোঁটের সামনে এনেই সরাসরি ওর দিকে তাকালো মানুষটা। আর যেন এই মূহুর্তেরই অপেক্ষায় ছিল রমনী। শেহজাদ তাকাতেই তাকে লক্ষ্য করে চোখ মেরে দিলো ও!
অমনি আরো একদফায় বিষম খেয়ে বসলো শেহজাদ। নাকে মুখে উঠে গেলো গ্লাসের জুস। কাশতে কাশতে চোখমুখ লাল হয়ে যাওয়ার পর সবার মনোযোগ ফিরলো ওর দিকে। মরিয়ম ফের বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন,
“ আমি বুঝি না! এ নিয়ে দু’দুবার তুই জুসের গ্লাস হাতে রেখে বিষম খেলি! দেখছিস আমরা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছি! একটু সাবধানে খেতে পারিস না সবকিছু!”
আয়ান দৌঁড়ে এলো শেহজাদের কাছে। বন্ধুকে শাশুড়ির বকা থেকে বাঁচাতে গিয়ে বলে বসলো,
“ থাক আন্টি! বকবেন না ওকে! বুড়ো মানুষ তো! তাই হয়তো বারবার জুস খেতে গিয়ে কেশে-টেশে একাকার করে ফেলছে!”
শেহজাদ চোখ গরম করে আয়ানের দিকে তাকাতেই আরো হাসি পেয়ে বসলো আরশির৷ তবুও ঠোঁট টিপে রাখলো। এখন কোনোমতেই হাসা যাবে না!
উল্টে মোবাইলে কিছু একটা টাইপ করে পাঠিয়ে দিলো শেহজাদকে। মানুষটা যখন কিছুটা ধাতস্থ হলো তখনই টুং করে ভেসে এলো মেসেজের শব্দ। আরশির দিকে তাকিয়ে থেকেই পকেট হাতড়ে ফোনখানা বের করলো শেহজাদ। বড় বড় শ্বাস ফেলে দেখলো তার স্নোফ্ল্যাকের নামটাই ভাসছে স্ক্রিনের ওপরে। নিচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা,
“ বিয়ের কথা শুনেই বিষম খেয়ে বসলেন বর মশাই? বিয়ের পর কী করবেন তাহলে? আমি কী তবে আমার জন্য বর পাল্টে দিতে বলবো বাবাকে? বলবো নাকি যে তাদের ছেলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছে?”
লেখাগুলো পড়েই ঠোঁটের কোণ চূড়ায় উঠল শেহজাদের। আরশির দুষ্টমি ধরতে পেরেও একহাতে লিখে পাঠালো,
“ এজ ইফ ইউ ডেয়ার?”
“……”
“ আমাকে ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুরে দিও না স্নোফ্ল্যাক! শুক্রবারের দিন তোমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে হলেও আমি করবো! এতোদিন আমি আমার বউ ছাড়া থাকতে পারবো না! অসম্ভব!”
“ বললেই হলো নাকি? আমি কেনো শুনবো আপনার কথা?”
“ কথাও শুনবে আর আজ সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে আমার সাথে ঘুরতেও বেরোবে! আমি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবো তোমার জন্য!”
“ লুকিয়ে কেনো বেরোবো?”
“ এটাই তো এডভ্যাঞ্চার জান! বিয়ের আগে বর বউয়ের আলাদা করে সময় কাটানো উচিত! জানো না বুঝি?”
“ মা বারণ করেছেন শুনলেন না? আর বলুন যে সবাইকে বলে বের হলে যে ধরা পড়ে যাবেন, আপনার রাতে বলা মিথ্যের জন্য! তাই এসব বলছেন! বেশ বুঝতে পারছি!”
“ একটু মিথ্যে বলে যদি আরো কিছুটা সময় তোমার সাথে কাটাতে পারি, তাহলে সেই মিথ্যের জন্য হাজারটা শাস্তিও আমি মাথা পেতে নিতে রাজি স্নোফ্ল্যাক!”
“ আপনাকে শাস্তি তো আমি দেবো!”
“ যথাআজ্ঞা মহারাণী! শাস্তি দিও! শুধু তোমার আশেপাশে তোমার ছায়া হয়ে থাকতে না করো না! তাহলেই হবে!”
আইঢাই করো স্ক্রিন থেকে চোখ তুললো আরশি। অমনি শেহজাদের নরম চোখে চোখ পড়লো ওর। বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো বোবা শঙ্কায়! শেহজাদের নীলাম্বরে দাপিয়ে বেরানো মেয়েটা হঠাৎই যেন মিইয়ে গেলো লাজে।
কেয়ার টেকার রবিন স্পিকার মুছছিলেন। হাতে চাপ লেগে চালু হয়ে গেলো ওটা। কানে ভেসে এলো কিছু নীরব প্রতিশ্রুতি!
একটা গানের কিছু লাইন,
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৫
“Main toh bas teri chaahat mein
chaahun rehna sada
Main toh bas teri qurbat mein
chaahun rehna sada
Saaya bhi tera main
hone na doon juda, maine tay kar liya”