নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৭

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৭
সিনথিয়া

ঝরা পাতায় মোড়ানো ম্যানহাটনের রাস্তা। পা মিলিয়ে হেঁটে চলেছে হাসান ভিলার রমনীগণ। মরিয়ম, আঞ্জুমান, জারা সবার হাতেই শপিং ব্যাগ। কেনাকাটার এই যুদ্ধ শেষেও তাদের হাসিমুখগুলোয় একরত্তি ক্লান্তির ছাপ নেই। কেয়ার টেকার রবিন হাঁটছিলেন তাদের পিছন পিছন। উদ্বিগ্ন আননে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন,
—“ গাড়িটা এদিকে নিয়ে আসি? আপনারা হেঁটে হেঁটে এদ্দূর এসেছেন শুনলে সাহেব রাগ করবেন যে!”
মরিয়ম বেগম হেসে উড়িয়ে দিলেন রবিনের কথাগুলো। ফুরফুরে মেজাজে আওড়ালেন,
—“ সেই তো তোমার সাহেবের ঐ কাঁচ বন্দী গাড়ি করেই বাড়ি ফিরতে হবে! গাড়ি অবধি না হয় একটু হেঁটেই যাই? আরশি মা? তুই কি বলিস?”
রাস্তার শুকনো ম্যাপল পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা রমনী এতক্ষণে হকচকিয়ে চাইলো মরিয়মের দিকে। মলিন মুখে বললো,

—“ তুমি যা বলবে? আমার হাঁটতে খারাপ লাগছে না মা!”
মরিয়ম চওড়া হেসে তাকালেন রবিনের দিকে,
—“ শুনলে তো! তোমার সাহেবের বউ কী বলেছে? এবার গাড়ি নিয়ে বাড়ি যাও! আমরা হেঁটে হেঁটেই ফিরবো। আর পিছনে পিছনে ঘুরে একই প্রশ্ন বারবার করো না তো বাপু!”
—“ কিন্তু ম্যাডাম! এতোগুলো ব্যাগ…”
আঞ্জুমানও বাঁধ সাধলেন। কথার মাঝেই বললেন,
—“ ব্যাগ তেমন কিচ্ছুটি ভারী নয় রবিন ভাই! আপনি শুধু শুধুই টেনশন করছেন! আমার তো ভালোই লাগছে! ম্যানহাটনের বিকেল যে এতো সুন্দর হতে পারে, এই সময় না আসলে তো জানতেই পারতাম না!”
মরিয়ম বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—“ আপনি তো এখানাকার সেন্ট্রাল পার্কে এখন অবধি গেলেনই না! ওখানটা আরো বেশি সুন্দর। বাতাসে বছর ঘুরে আবারও সেই শীত আসার আগের মূহুর্তের ঘ্রাণ। লেকের ধারে ভায়োলিন নিয়ে বসে থাকা মিউজিশিয়ানরা কী অসাধারণ সুর তোলে! না দেখলে আপনি বিশ্বাসই করতে পারবেন না আপা! যাবেন ওখানে?”
—“ যাওয়াই যায়! যে’কদিন আছি এখানে, একটু ঘুরে ঘুরে না হয় দেখে যাই আমার জারা মায়ের শহরটা!”
ঘোরাঘুরির কথা শুনেই একপায়ে রাজি হয়ে গেলো জারা। কিন্তু বেচারা রবিন? রমনীকুলের সাথে পেরে না উঠে দীর্ঘশ্বাস ফেললো! পা চালাতে চালাতে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামটুকু মুছে নিলো হাতের উল্টো পিঠে। বাড়ি তো ফিরবে, শুধু খালি গাড়ি নিয়ে ফিরে শেহজাদ আর মেহমেদের তোপের মুখে না পড়লেই হয়! যদিও তারা ভীষণ ভালো মানুষ, কিন্তু বাড়ির গিন্নীদের ব্যাপারে একটু বেশিই পজেসিভ। নয়তো এতো দুশ্চিন্তা করতো না রবিন।
মরিয়ম বেগম আবারও গল্প শুরু করলেন। আঞ্জুমানের মনোযোগ সেদিকে থাকলেও জারা আড়চোখে খেয়াল করছিল আরশিকে। অমন চাঁদ মুখখানায় আজ যেন অমানিশার ঘোর অন্ধকার। আরশি সেই অন্ধকার মুখেই বারবার তাকাচ্ছে হাতে ধরে রাখা ফোনটার দিকে। সময় দেখছে, নাকি অপেক্ষা করছে কারোর মেসেজের?
জারা তো শেষমেশ না থাকতে পেরে জিজ্ঞেস করেই বসলো,

—“ ভাইয়া সাথে নেই দেখে মন খারাপ?”
আরশি চমকে তাকালো পাশে। জারা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেও আরশির সাবধানী চোখজোড়া সামনে তাকিয়ে দেখে নিলো মরিয়ম আর আঞ্জুমানকে। যখন বুঝলো তারা খেয়াল করছে না এদিকটায় তখনই দম ফেললো মেয়েটা। পরপর ধরা পড়ে যাওয়া মুখে তাকালো জারার দিকে,
—“ তুই কী করে বুঝলি?”
জারা ভ্রু নাচালো। হাঁটতে হাঁটতেই গর্বের সাথে বুকে হাত গুঁজে বললো,
—“ তোর মুখের দিকে তাকালে যে কেউ বুঝে যাবে যে তোর ভাইয়ার জন্য মন খারাপ! আরে বাবা, ক্লাস নিতে গিয়েছে! রাতে তো চলেই আসবে! বরকে এতো চোখে হারালে হয়?”
আরশি ঘাড় নোয়ালো আক্ষেপে। ক্ষীণ কন্ঠে আওড়ালো,
—“ বারণ করে দিয়েছি তো! চোখে আর হারালাম কই? চোখে হারালে কী বারণ করতে পারতাম?”
—“ এ্যাঁ?”

জারা এবার হয়তো জোরেই করে ফেললো শব্দটা। আঞ্জুমান, মরিয়ম পেছন ফিরে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই তড়িৎ ঠোঁটে ছদ্ম হাসি টানলো জারা। তাড়াহুড়ো করে বললো,
–“ আরে! তোমরা দাঁড়িয়ে পড়লে কেনো? হাঁটো হাঁটো!”
রমনীগণ আর ঘাটালো না জারাকে। ভ্রুক্ষেপহীন হাঁটা শুরু করতেই হাঁপ ছাড়লো জারা। তারপর আরশির পাশ ঘেঁষে শুধালো,
—“ বারণ করে দিয়েছিস মানে? ভাইয়ার সাথে কী কোথাও বেরোনোর কথা হয়েছিল তোর?”
আরশি নত মুখেই ওপর-নিচ করলো মাথা। বিষন্ন গলায় বললো,
—“ হয়েছিল তো! কিন্তু মা আর আঞ্জুমান আন্টি হুট করে শপিং করতে বেরোবেন, তা তো জানতাম না!”
—“ না করে দিতি তাদের? তাহলেই তো হতো! বলে দিতি যে, ভাইয়া বেরোবে বলেছে তোকে নিয়ে! দাঁড়া দাঁড়া! ভাইয়ার না ক্লাস নিতে গেলো ভার্সিটিতে! তাহলে তোকে নিয়ে বেরোতো কখন?”

—“ ওটাই তো! মিথ্যে বলেছিল। ক্লাস নেই আজ ওনার! আর এদিকে আমিও মা’কে না করতে পারিনি। ওনাকে অপেক্ষা করিয়ে রেখেই চলে এসেছি এখানে।”
—“ কিন্তু এখন তোর ভাইয়ার জন্য মন কেমন করছে! তাই তো?”
আরশি স্ফীত চোখে তাকালো জারার দিকে। ঠোঁট উল্টে ফের মাথা নাড়তেই পেট চেপে হেসে ফেললো জারা।
—“ তোদের চেয়ে আমাকে আর বানরমশাইকে বেশি বিবাহিত মনে হয়! আর তোরা? তিনবছর বিয়ের বয়স পার করেও ধরা পড়ার ভয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করবি?”
জারার চোখ খিঁচে হাসাটা মোটেও পছন্দ হলো না আরশির। সে কড়া চোখে শাসিয়ে দিলো বান্ধবীকে,

—“ মোটেও আমাদের নিয়ে হাসবি না বলে দিলাম জারা! প্রেম করার আবার বয়স হয় নাকি? আমি তো ঠিক করে রেখেছি! বুড়ো বয়সেও আমরা লুকিয়ে ঘুরতে যাবো! বিয়ের আগে প্রেম করতে পারিনি তো কী হয়েছে? এখন করবো! এরকম থ্রিলিং ব্যাপার স্যাপার মিস করা যায় না! বুঝলি?
—“ সেই! তোরা বুড়ো বয়সে প্রেম করবি, আর আমি তোদের পাহারা দেবো? এবার খুশি?”
জারা হাসি হাসি মুখে এমনভাবে জিজ্ঞেস করলো, যে আরশিও আর মুখ কালো করে থাকতে পারলো না। নিঃশব্দে হেসে ফেললো অমনি। তখনই মরিয়ম ওদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
—“ সেন্ট্রাল পার্ক হয়ে ভাবছি একবার অভিনবদের বাসায় যাবো! বিয়ের দাওয়াতটা দিয়ে আসবো গিয়ে!”
জারা আরশি দুজনেই সপ্রশ্ন চোখে চাইলো মরিয়মের দিকে। আরশি জিজ্ঞেস করলো,
—“ কিন্তু মা! অভিনব কে? আগে তো কখনো শুনিনি এই নাম!”
মরিয়র স্মিত হাসলেন।

—“ অভিনব হলো তোমার বাবার বোনপো। রুশা আর শায়ানের কাজিন বলতে পারো। মা-মরা ছেলে, বাবাকে নিয়ে একাই থাকে। তবে বেশ হাসিখুশী। তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না আরশি! পুরো যেন শেহজাদের বিপরীত। তবে, আয়ানের সাথে বেশ জমবে। ওর মতোই আমুদে আর হৈ-হুল্লোড় করতে পটু একেবারে আমাদের অভি। বিয়ের কথা শুনলে হয়তো বলেই বসবে, মামি! তোমাদের বাড়িতে বিয়ে! আর তুমি আমাকে এখন বলছো? আরো দশদিন আগে বলবে না?”
মরিয়ম এসব বলতে বলতে হাঁটলেও আরশির খেয়াল নেই সেদিকে। তার চোখ আঁটকে আছে পাশের গলির অন্ধকারে। কেউ কি তাদের ফলো করছে?
গোধূলি লগ্নের আলো আঁধারির খেলায় মত্ত থাকে পুরোনো এসব গলি। কেউ গা ঢাকা দিয়ে থাকলেও সহজে চোখে পড়ার মতো নয়। তবুও আরশির মনে হচ্ছে কেউ অনবরত দেখছে তাকে। অনুসরণ করে চলেছে ছায়ার মতো।
আরশিকে থমকে যেতে দেখেই তাগাদা দিলো জারা। এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

—“ আরশি! দাঁড়িয়ে পড়লি কেনো? তাড়াতাড়ি আয়! সন্ধ্যে নামাবি নাকি হাঁটতে হাঁটতে?”
আরশি হ্যাঁ-না করার সুযোগটুকুও পেলো না। জারা ততক্ষণে সামনে তাকিয়েছে। আর এই সুযোগেই যেনো আরশির মুখ চেপে তাকে হ্যাঁচকা টান দিলো সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তি। ব্যস্ত রাস্তা থেকে কাউকে এমন উধাও করে ফেলার সাহস কিড”ন্যাপার ছাড়া আর কারো হতে পারে? কোনো গুন্ডা-বদমাশ নয়তো?
আরশি ছটফট করে উঠলো ঐ লোহার মতো শক্ত বুকে পিঠ ঠেকতেই! হাতদুটো সেই ছায়ামানবের হাতের মুঠোয় থাকলেও পাজোরা এলোপাথাড়ি ছুড়লো সে! এটাই আরশির মোক্ষমাস্ত্র। জায়গা মতো একটা লাথি মারতে পারলেই খেল-খতম! তারপর কোনোমতে হাতদুটো ছাড়াতে পারলেই ভোঁ-দৌড় লাগাবে ও!
কিন্তু ভাবনা মতো পা উঠানোর আগেই, কানের পাশে মুখ নামালো সেই মানুষ। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,
—“ স্টপ আরশি! এটা আমি! তোমার জাম্বুবান! কোনো কিডন্যাপার নই! প্লিজ আর লাথি-টাথি মেরো না! প্লিজ!”

ভারী পল্লব ফেলে ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরালো
আরশি। পেছনে তাকিয়েও যেন বিশ্বাস করতে পারলো না যে, তাকে পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা শেহজাদ! তবে পরিচিত পারফিউমের ঘ্রাণ পেতেই, ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া চোখমুখ হুট করেই নরম হয়ে এলো মেয়েটার। ধরা গলায় বলে উঠলো,
—“ আপনি? আমার জাম্বুবান?”
—“ তোমার জাম্বুবান!”
হাতদুটো আলগা হলো। অমনি শেহজাদের দিকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো আরশি।
—“ আপনি ফলো করছিলেন আমাদের? কখন থেকে?”
—“ শুরু থেকে!”
মুহূর্তেই রাগে ফুঁসে উঠলো ওর ছোট্ট নাকটা। শক্ত গলায় বললো,
—“ আর আরেকটু হলে যে, ভয়ে আমি মূর্ছা যেতাম সে বেলা? বড় এসেছেন আমি তোমার জাম্বুবান! জাম্বুবান তো কী হয়েছে? জাম্বুবান হলেই ভূতের মতো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এভাবে পাকড়াও করতে হবে? ফলো করতে হবে?”
শেহজাদ কিছু বলতে গিয়েও মাথা নোয়ালো। হাতদুটো সামনে এনে বাধ্য হয়ে দাঁড়ালো বউয়ের সামনে। ফের খানিকটা সাহস জুগিয়ে মিনমিন করে বললো,

—“ তোমাকে তো এমনিতেও এ’কদিনে আর পাবো না। আজকে ঘুরতে যাবো বললাম, তা-ও না করে দিলে! তাই তো বাধ্য হয়ে…!”
—“ ঘুরতে যেতে পারেননি বলে নিজের বউকে মাঝরাস্তায় কিডন্যাপ করবেন? আপনি না প্রফেসার? এই শেখাবেন আপনি আপনার স্টুডেন্টদের?”
এবারে ঠোঁটের কোণ ঠেলে দুষ্টমির হাসি হাসলো শেহজাদ। আচমকাই ধীর গতিতে এক-পা দু’পা করে এগিয়ে এলো আরশির দিকে। বেচারি পিছোতে পিছোতে গিয়ে ঠেকলো পুরোনো ইটের দেয়ালে। রাগ-টাগ উবে গিয়ে তাকে ঘিরে ধরলো একঝাঁক লাজ। শেহজাদও নিজের লাজবন্তীকে দেয়ালের সাথে কোণঠাসা করে চওড়া করলো নিজের হাসি। একহাত আরশির মাথার একপাশে রাখলো ঠেস দিয়ে দাঁড়াতে। পরপর অন্য হাতে তুলে নিলো রমনীর চিবুক। হাস্কি স্বরে বললো,

—“ কথায় কথায় প্রফেসর হওয়ার খোঁটা কেনো দাও স্নোফ্ল্যাক?”
—“ কা-কারণ আপনার কাজকারবারই এমন!”
—“কেমন?”
—“ ভীষণ…আনপ্রেডিক্টেবল!”
—“ আমি মানুষটাই যে ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল জান! কিন্তু চিন্তা নেই! তোমার জন্য একটু একটু করে প্রেডিক্টেবল হওয়ার চেষ্টা করছি!”
শেহজাদের দৃষ্টি তখন আরশির ঠোঁট আর চোখে এলোমেলো ঘুরছে। ঢোকের সাথে ওঠানামা করছে তার কণ্ঠমণি। মৌনতা যেন শরীরী উত্তাপ হয়ে জেঁকে বসেছে তাদের মধ্যিখানে। বুকের ভিতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে হৃদযন্ত্রখানা।
আরশি সতর্কচোখে তাকালো পাশের রাস্তায়। গলির এই আবছা অন্ধকারে যে কেউ এভাবে দেখে ফেলবে ওদের। ধরা পড়ার নয়, বাঙালি মনটা মান সম্মান চলে যাওয়ার ভয়ে আইঢাই করে উঠলো ওর! শেহজাদের তো ভরসা নেই! যদি এখানেই কিছু করে বসেন?

—“ কী ভাবছো?”
—“ ভা-ভাবছি, অন্য কোথাও যাই? এখানে…”
ঐ অবধিই থেমে গেলো বাক্যটুকু। সেই সাথে থেমে গেলো আরশির নিঃশ্বাসের গতি। ঠোঁটের দখলদারিত্বে এখন শেহজাদ। শ্বাসটুকু পর্যন্ত নিতে দিলো না আরশিকে। ছাড় দিলো না নরম মোলায়েম ঠোঁটখানাও। আরশি সেসবে খেয়ালও রইলো না। চোখ বুঁজে ঘাড় বাঁকাল সে। আনমনেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আঁকড়ে ধরলো প্রিয় মানুষটার ঘন চুলগুলো।
যখন হুঁশ ফিরলো তখন দুজনেরই অবস্থা বেহাল। দুজনেরই চুল এলোমেলো। ঠোঁটে রক্ত জমাট বেঁধে কালশিটে পড়ে গেছে। নিজেদের দেখে নিজেরাই হেসে ফেললো ওরা। শেহজাদ তার প্রিয়দর্শিনীর ঠোঁটের কোণে ফের একবার আলতো চুমু খেয়ে বললো,
—“ তাহলে বাসায় যাই চলো?”
আরশি ভ্রু নাচিয়ে শুধোলো,
—“ এতো কায়দা করে কিডন্যাপ করলেন ভিক্টিমকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বুঝি? শহর ঘুরাবেন না?”
—“ তুমি ঘুরবে আমার সাথে?”
—“ ভদ্রলোক হয়ে থাকলে ভেবে দেখবো ঠিক করেছি!”

শেহজাদ মাথা নোয়ালো নিম্নাষ্ঠ কামড়ে। ঠোঁটে তার ছড়িয়ে আছে বেলেহাজ হাসি। স্বর নামিয়ে আওড়ালো,
—“ এভাবে কন্টিনিউসলি সিডিউস করলে কতক্ষণ ভদ্রলোক হয়ে থাকবো? যতক্ষণ বাসায় না ফিরছি?”
আরশিও ঠোঁট কামড়ে চোখ নামালো। হাসি থামাতে নয়! শেহজাদের অমন ঘোরলাগা দৃষ্টি থেকে পালাতে। কিন্তু চোখ সরালেও বা কি? লাল লাল হয়ে যাওয়া গালদুটো? তারা শেহজাদের নজর এড়াতে পারবে তো?
পরপরই ব্যস্ত হাতে দু’হাতে আলতো ধাক্কা দিলো শেহজাদকে। সামনে থেকে মানুষটাকে সরিয়ে বেরিয়ে গেলো চড়ুই পাখির মতো। গলির মুখে গিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারলো রাস্তায়। নাহ! জারারা নেই। চলে গিয়েছে তারমানে! তক্ষুনি মোবাইলটা টুং করে বেজে উঠলো আরশির৷ বের করতেই দেখলো জারার মেসেজ এসেছে। যেখানে লেখা,
—“ মা আর মনিকে আমি ম্যানেজ করে ফেলবো। চাপ নিস না! এনজয় ইয়্যর ডেট ডার্লিং!”
তার মানে জারা খেয়াল করেছে সবটা? অমনি মুচকি হাসি ফুটলো আরশির ঠোঁটে।
ঘুরে তাকালো দেয়াল পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ানো শেহজাদের দিকে। সে মানুষ ভীষণ শান্ত এখন। অপেক্ষা করছে নিজের প্রশ্নের উত্তরের জন্য! আরশি গলি থেকে বেরোতে বেরোতে গলার স্বর উঁচিয়ে বলে উঠলো,

—“ যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের বিয়েটা আবার হয়ে যাচ্ছে? ততক্ষণ পর্যন্ত তো আপনাকে জেন্টেলম্যান হয়েই থাকতে হবে মিস্টার বউ কিডন্যাপার!”
শেহজাদ সোজা হয়ে দাঁড়ালো তখন। শার্টের স্লিভ কনুই অবধি ফোল্ড করতে করতে প্রস্তুতি নিলো আরশিকে ধরার জন্য।
—“ দাঁড়াও আরশি! দৌঁড়ানোর চিন্তা করো না। আমার সাথে পারবে না কিন্তু!”
আরশি হাসলো ঠোঁট টিপে। ও থামলো না। শেহজাদের দিকে তাকিয়ে পিছিয়ে যেতে লাগলো ক্রমশ। হুট করেই সেই প্রাণবন্ত নিজেকে নিজের মধ্যে খুঁজে পেয়ে উল্লসিত গলায় আওড়ালো,
—“ আজকে আমিও দেখি! দ্য গ্রেট শায়ান শেহজাদ তার বউকে দৌঁড়ে ধরতে পারে কি না?”

এমিলিয়া আগন্তুকের পাঠানোর সেই মেসেজে লেখা ঠিকানাটা আরো একবার পড়লো। তারপর চোখ তুলে তাকালো মাথার উপরে লাগানো সাইনবোর্ডের দিকে। নিউইয়র্ক কফিশপ!
ঠিক ঠিক জায়গাতেই এসেছে তারমানে ও। জিন্সের সাথে ক্যাজুয়াল হুডি পরনে এমিলিয়ার। ভিতরে ভিতরে ভয় পেলেও বাইরের কঠোরতা বজায় রেখে কফিশপের ভিতরে ঢুকলো মেয়েটা।
এখানে মানুষজনের ভীর কম নয়। তবুও একেবারে শেষে টেবিলের কর্ণারে বসে থাকা মানুষটাই সবার আগে চোখে পড়লো ওর। আতঙ্কের দুধ-সাদা স্রোত বয়ে গেলো মেরুদণ্ড বেয়ে। আগন্তুক ওকে দেখেই যেন ফিচেল হাসলো। কালো লেদার গ্লাভস পরা হাতটা উঁচু করে ইশারায় কাছে ডাকলো এমিলিয়াকে।
এমিলিয়া একবার ভাবলো ছুটে পালাবে এখান থেকে। লোকটা দূর থেকেই যেন শুষে নিচ্ছে ওর সমস্ত ভালোটুকু। কেমন এক অশুভ শক্তি ঘিরে আছে ঐ কালোলেদার জ্যাকেট আর স্কেলিটন মাস্কের ভিতরে থাকা মানুষটার চারপাশে।

কিন্তু যতক্ষণে এমিলিয়া সাহস জোগাল, ততক্ষণে ওর শরীর যেন আপনাআপনিই চলে গিয়েছে ঐ শেষের টেবিলটার সামনে। চেয়ার টেনে বসার সাহস আর পায়নি। এমিলিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই হাসির তোড়ে দুলে উঠলো মাস্ক পরা মানুষটা। নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে এগিয়ে এলো এমিলিয়ার সামনে।
এমিলিয়া ঢোক গিলে আশেপাশে তাকালো। সবাই যে যার মতো নিজের জগতে ব্যস্ত। বিপদে পড়লে আদৌ কী কেউ সাহায্য করতে আসবে ওকে?
—“ অনেকদিন পর দেখা হলো আমাদের, আমার না হওয়া বউ! বাই দ্য ওয়ে, ডিড ইউ থ্রো দ্যাট রিং এওয়ে? আওয়ার এ্যাঙ্গেজমেন্ট রিং? ওহ! ইউ ডিড?!”
ভারী স্বর কর্ণগোচর হতেই বড় বড় চোখে আগন্তুকের দিকে চাইলো এমিলিয়া। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,
—“ আ-আদি?”
মুখ দিয়ে আফসোসের শব্দ করলো আদি। স্কেলিটন মাস্কটা খুললো পরপর। গা হিম করা হাসি হেসে তাকালো এমিলিয়ার দিকে।

—“ চিনতে পেরেছো তাহলে? আমি তো ভেবেছিলাম চিনতেই পারবেনা! গুড গার্ল! আ’ম ইমপ্রেসড!”
এমিলিয়া সবিস্ময় কন্ঠে শুধোলো,
—“ কিন্তু! তুমি তো জেলে ছিলে! ছাড়া পেলে কী করে?”
আদি ফের দুলে উঠলো হাসতে গিয়ে। মাস্কটা মুখে গলিয়ে আওড়ালো,
—“ ছাড়া পাইনি তো! পালিয়েছি!”
আঁতকে উঠলো এমিলিয়া,
—“ পালিয়েছো?”
স্বর বদলে গেলো আদির। হিসহিসিয়ে বললো,
—“ পালিয়েছি! ঐ পরিবারটার জন্য আজ আমাকে পালিয়ে পালিয়ে বাঁচতে হচ্ছে! আরশি আর শেহজাদ! ওরা দুজন, নরক বানিয়ে ছেড়েছে আমার জীবনটা! জানো, তুমি জানো? আমি খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছি কার জন্য জানো?”
এমিলিয়া কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলো না। আদিই বলে গেলো পরপর,
—“ দ্যাট ফা*কিং বি*চ! আরশি! শি স্ট্যাবড মি! ছু”ড়ি বসিয়ে দিয়েছিল আমার পায়ে! জান হাতে নিয়ে পালিয়েছি সেদিন আমি ছাঁদ থেকে! কী দোষ ছিল আমার? কী দোষ ছিল? আমি তো ভালোবেসেছি ওকে! শেহজাদ ওকে যেভাবে ভালোবাসে, সেভাবেই তো ভালোবেসেছি!”

শেহজাদের নাম শুনেই চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো এমিলিয়ার। চোখমুখ শক্ত করে করতলের পাশ দিয়ে মুছে ফেললো পানিটুকু। কার্ণিশ বেয়ে গড়াতে দিলো না নিজের দূর্বলতা। মেঝেতে দৃষ্টি রেখেই দৃঢ় গলায় বললো,
—“ তোমার মতো মানুষ কখনোই শেহজাদের মতো করে কাউকে ভালোবাসতে পারবে না! তাই দয়া করে নিজেকে তার সাথে তুলনা করো না!”
কথাটা শেষ হওয়ার মূহুর্তেই আদি একহাতে গাল চেপে ধরলো এমির। আদির ক্ষিপ্রতা এতোটাই প্রকট ছিল যে আশেপাশের মানুষেরও নজর এড়ালো না তা। কয়েকজোড়া উৎসুক চোখ ওদের দিকে তাকাতেই গালের চাপটা আলগা হলো এমিলিয়ার। আদি ছেড়ে দিলো ওকে। কিন্তু নিজের মাথার দু’পাশ দু’হাতে চেপে ধরলো ও। পরপর রক্তিম চোখে চাইলো এমিলিয়ার দিকে। হিসহিসিয়ে আওড়ালো,
—“ তাই নাকি? আমি শেহজাদের মতো করে ভালোবাসতে পারবো না? কেনো? কারণ আমি ওর মতো ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকি না বলে?”

—“ কী করে ভালোবাসতে হয়, তুমি তো জানোই না আদি! তাই আমার ভালোবাসার মানুষকে নিয়েও আরেকটা উল্টোপাল্টা কথা বলার কোনো অধিকার নেই তোমার!”
—“ ঠিক! ঠিক বলেছো তুমি সুইটহার্ট! কী করে ভালোবাসতে হয় আমি তো জানিই না!”
এটুকু বলে থামলো আদি! পরপর হিংস্র জন্তুর মতো আওড়ালো,
—“ আমি শুধু আসক্ত হতে জানি! ড্রা”গসের চেয়েও মারাত্মক আসক্তি আমার আরশির প্রতি! আ’ম ফাকিং অবসেসড উইথ হার!”
তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো এমিলিয়া। ধিমি স্বরে শুধোলো,
—“ এখন আমাকে কী করতে হবে বলো! কেনো ডেকেছো আমাকে এখানে?”
বাঁকা হাসলো আদি। এমিলিয়ার চিবুকের নিচে মধ্যমা রেখে বৃদ্ধাঙ্গুলি বোলালো ওর গালে। তারপর কানের পাশে মুখ নিয়ে আওড়ালো,

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৬

—“ শেহজাদের পুরো পরিবারের ধ্বং”স চাই আমি! তুমি ওদের সাথে এমনভাবে মিশে যাবে যেনো ওরা তোমার সাথে নির্দ্বিধায় সবকিছু বলতে পারে। ওদের সাথে মিশে ওদের দূর্বল জায়গাগুলো খুঁজে বের করবে তুমি! ও বাড়ির সব খবর দেবে আমাকে। কখন বাড়িতে কী হচ্ছে না হচ্ছে সবখবর! আমার সব ডিটেইলস চাই ও বাড়ির! তারপর বাকি কাজ আমার!”
—“ বদলে? বদলে আমি কী পাবো?”
সোজা হয়ে দাঁড়ালো আদি! চৌকষ হাসলো মাস্কের আড়ালে। পরপর বললো,
—“ যার জন্য এতোগুলো দিন ও বাড়িতে পড়ে আছো! আরশি না থাকলে তাকে পেয়ে যাবে? এটাই কি যথেষ্ট নয় এমিলিয়া?”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here