নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৬০
সিনথিয়া
‘ পায়ে বরফ লাগালেই ব্যথা সেরে যাবে। প্যানিক করার কিছু নেই!’
এমিলিয়া তবুও চোখমুখ খিঁচে রইলো। হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরলো অভির বিছানার চাদর। ছেলেটা সেদিকে একনজর চেয়েই চোখ সরায়। শুকনো ঢোক গিলে মনোযোগ আনে হাতে ধরে রাখা আইসব্যাগে।
মূলত একটা অনধিকারচর্চা করে ফেলেছে সে। এমিলিয়াকে কোলে তোলার পর নিয়ে এসেছে নিজের রুমে। নিজের বিছানায়। অবশ্য তাতে বিশেষ ভাবান্তর দেখা গেলো না পুরুষালী সৌম্য মুখটায়।
পরপর ফর্সা তুলতুলে পা টা উরুর উপর আলতো হাতে তুলে নেয় অভি। অমনি আঁতকে ওঠে তরুণী। পা সরিয়ে নিতে উদ্যত হলেও মুখখানা নীল হয়ে আসে ব্যথার প্রকোপে। অভি বিরক্ত হয় না। রাগ করে না। সে যথাসম্ভব শান্ত গলায় আওড়ায়,
‘ আমি ছুঁলে কি জাত যাবে আপনার? নাকি সামান্য বরফ লাগাতে গেলেও আগে অনুমতি চেয়ে নিতে হবে আপনার কাছ থেকে?’
হতবুদ্ধ এমি মাথা নাড়াতেও ভুলে যায়। গাঢ় গলার স্বরে খাবি খায় তার প্রচন্ড নারীবাদী সব আয়োজন । অভি লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
‘ উত্তর যেহেতু নেই, সেহেতু চুপচাপ শান্ত হয়ে বসুন! আমাকে আমার কাজটা করতে দিন! এজ অ্য মেড-স্টুডেন্ট, আমি শুধু আপনাকে ফার্স্ট এইড টুকুই দেবো এখন। তবে পারলে একবার ক্লিনিকে গিয়ে একজন ভালো অর্থোপেডিককে দেখিয়ে আসবেন। মচকে যাওয়া জায়গাটা যেভাবে ফুলেছে, বেশ কয়েকদিন ভোগাবে মনে হচ্ছে আপনাকে!’
অভি বরফ লাগাতে লাগাতে গলার স্বর নামায়। মিহি স্বরে শুধায়,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ অস্বস্তি হচ্ছে?’
এমির গলা চিড়ে শব্দ আসে না। যে যত্ন নিয়ে এই অপরিচিত মানুষটা ওর পায়ে বরফ লাগিয়ে দিচ্ছে, তাতে মোটেও অস্বস্তি হচ্ছে না ওর! তবে কোথাও একটা খুব করে মনে হচ্ছে , এমন যত্নের অভাবেই হয়তো মনটাও কী ভীষণ শক্ত ছিল তার। অথচ আজ মমের মতো গলতে চাইছে সেটা। কী বাজেভাবে উবে যাচ্ছে ওর সেই শক্তপোক্ত খোলস।
‘ নিন! হয়ে গেছে!’
এমিলিয়া চমকায়। ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে দৃষ্টি রাখে আগন্তুকের চোখ বরাবর। ঠোঁট নেড়ে অস্পষ্টে শুধোয়,
‘ আপনার নাম?’
‘ কেনো? নাম জানলে উপকারটুকু ফেরত দিতে সুবিধা হবে বুঝি?’
এমিলিয়ার স্ফীত মুখখানা শক্ত হয়ে যায় অমনি। অভিই প্রসঙ্গ টানে। বলে,
‘ অভিনব! সম্পর্কে ভাইয়ার কাজিন! তাই এতো ফরমালিটিজ দেখিয়ে আপনি আজ্ঞে না করলেও খুব একটা মাইন্ড করতাম না! অবশ্য এতে আমার খুব একটা অসুবিধেও নেই! আ’ম এবস্যালুটলি ফাইন উইথ হোয়াটএভার ইউ কল মি!’
একটু থামে অভি। পরপর অনুমতি চাওয়ার মতো করে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘ এবার আসি?
‘আসি’ মানেই ভালো লাগার এই মুহূর্তটুকুর এখানেই ইতি টানুন! লাগাম টানুন নিজের অনুভূতিদের। আপনি আমার মতো ভালো মানুষের যোগ্য নন। কিন্তু এমিলিয়া পারলো না।
অভি বিছানা ছেড়ে উঠতে নিলেই ছটফট করে উঠলো সে। যেন ভ্রম কেটেছে এতক্ষণে। তেমন করেই বলে বসলো,
‘ থ্যাঙ্ক ইয়্যু…অভি…মিস্টার অভিনব!’
অভি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
‘ বাপ্রে! এতো সম্মান? তখন তো খুব ধমকালেন আপনাকে কোলে তুলেছিলাম বলে! তাই শুধু শুকনো থ্যাঙ্কু ইয়্যুতে আমারও এখন পোষাবে না ম্যাডাম!’
‘ আমি কখনো কারো উপকার রাখিনি! আপনারও রাখবো না! বলুন কী করলে আপনার উপকার ফিরিয়ে দিতে পারবো?’
এমিলিয়ার মলিন শক্ত চোখ দুটোয় চোখ পড়তেই এক চিলতে হাসি দোল খায় অভির ওষ্ঠ কোণে। পরপর কী যেন মনে করে দু’হাতে বিছানায় নিজের ভর ছেড়ে ঝুঁকে আসে এমিলিয়ার দিকে।
মেয়েটা চমকায়। সরে যেতে গিয়ে আরেকটা চোট পাওয়ার আগেই ওর মাথা আর হেডবোর্ডের মধ্যিখানে তুরন্ত হাত রাখে অভি। স্বর নামিয়ে আওড়ায়,
‘ উপকার ফিরিয়ে দিতে চান তো? বেশ! তাহলে কথা দিন যে আপনি ওভাবে আর কাঁদবেন না কখনো!’
এমির বিস্ফোরিত চোখজোড়া পলক ফেলতে ভুলে যায়। রাতে সে কেঁদেছিল ঠিকই। তবে সেটা নিজের ভুল বুঝতে পেরে। নিজের বোকামির জন্য সবার কতই না অপছন্দের ছিল সে। কিন্তু এই লোক সেটা জানল কী করে?
এমিলিয়াকে পাল্টা প্রশ্নের সুযোগ না দিয়েই ওর মাথার পিছন থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নেয় অভি। পাঞ্জাবির হাতা গোটাতো গোটাতে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
‘ আপনি উঠতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না! তারচাইতে বরং এখানেই রেস্ট নিন কিছুক্ষণ! আম..আমি আসছি! ভাবী বা রুশা আপুকে দেখতে পেলে পাঠিয়ে দেবো এ ঘরে! ব্যস্ত হয়ে আবার নিজে নিজে নামতে যাবেন না যেন বিছানা থেকে!’
বলেই তড়িঘড়ি নিজের প্রস্থান সারে ছেলেটা। রুম ছেড়ে বেরিয়ে লবির দিকে যেতে গিয়েই যেন টের পায় প্রকোষ্ঠের ভিতর ম্যারাথনে নেমেছে হৃদযন্ত্রটা। প্রতি মিনিটে বিপদসীমা পার করছে স্পন্দনের গতি।
অমনি বুকের বা পাশটা পাঞ্জাবির ওপর থেকেই খামচে ধরে। স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস ফেলার চেষ্টা করে বারকয়েক।
ভাগ্যিস তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে! নয়তো মিস এনিমিয়ার সামনে উল্টোপাল্টা কিছু একটা বলে ফেলতো নির্ঘাত।
‘ বুক ধরফর করছে নাকি শালাভায়া?’
পিছন থেকে আচানক এলো প্রশ্নখানা। ঘুরে তাকিয়ে আয়ানকে দেখতেই মুখের রঙ উড়ে গেলো অভির। ধরা পড়ে গেছে সে! অস্বীকার করলো না। শুধু অনুরোধের স্বরে জানাল,
‘ আয়ান ভাই! আমি আসলে…প্লিজ তুমি মামাকে এখনই কিছু বলো না!’
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে মাথা নোয়ায় সে। আনত মুখে আওড়ায়,
‘ আসলে অনুভূতিটা একতরফাও হতে পারে! উনি কী ভাবছেন আমার ব্যাপারে সেটা নিশ্চিত না হয়ে মামা মামীকে জানাতে চাইছি না আপতত কিছু!’
ঠোঁট টিপে হাসিটুকু লুকিয়ে ফেললো আয়ান। নেহাৎ ভালো মানুষ সে। অভিকে আশ্বস্ত করতে সহজসরল গলায় বলল,
‘ সে নাহয় আমি বললাম না! কিন্তু প্রথম প্রেমের অনুভূতি সবসময় একতরফা হয় না অভিবাবু! কখনো কখনো দোতরফাও হয়!’
‘ তুমি কী করে বুঝলে?’
আয়ান বেশ আয়েশ করে এবার হাত রাখলো অভির কাঁধে। পরপর অভিজ্ঞের মতো করে আওড়াল,
‘ বুঝবো না? এসব ব্যাপারে তোমার থেকে আমার অভিজ্ঞতা কত বেশি জানো? পাক্কা ন’মাসের প্রেম! ছোটবেলার প্রথম ক্রাশ! বড় বেলার ওয়াইফ! শুধু কি তাই? আমি তো চোখের সামনে তোমার ভবিষ্যতও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি!’
‘ কী দেখতে পাচ্ছো?’
আয়ান নিজের গলার স্বর ভীষণ রকম সিরিয়াস বানিয়ে বলল,
‘ এই যে আমাদের উডবি ডক্টর অচিরেই আমার মতো একজন সার্টিফাইড বউপাগলু হতে চলেছে! এসবই আর কি!’
অভি ফের ঘাড় নোয়ায়। নিঃশব্দে মুচকি হাসে আয়ানের কথা শুনে। অমনি ঝেরে কাশে আয়ান। গলা পরিষ্কার করে বলে,
‘ শালাভায়া! এতো হেসো না বুঝলে? তোমার মামাকে তো চেনো না? আমাকে যে কী নাচান নাচিয়েছে একরাতে তুমি ভাবতে পারবে না! তোমাকেও কী করে বলা যাচ্ছে না! খুব একটা আশা ভরসা পাচ্ছি না আমি!’
অভি মাথা তুললো। দৃষ্টিতে ভ্যাবাচেকা খাওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট।
‘ মানে?’
‘ মানে খুবই সিম্পল! হয়তো সার্টিফাইড বউপাগলুর খেতাব পাবে আর নয়তো…,’
‘ মামুর শ্বশুরবাড়ির লোককে লাইন মারার অপরাধে মামুর হাতের ধুমধাম পেঁদানি?’
আয়ান শব্দ করে হেসে ফেললো অভির কথায়। পোক্ত ঐ কাঁধে হাত রেখেই ইয়ার্ডের দিকে যেতে যেতে গান ধরলো,
‘ পেয়ার হুয়া, ইকরার হুয়া হেয়…
পেয়ার ছে ফির কিউ ডারতা হেয় দিল!
ডারতা হেয় দিল, রাস্তা মুশকিল
মালুম নেহি হেয় কাহা মাঞ্জিল..?
হুমমম…পেয়ার হুয়া, ইকরার হুয়া..!’
ঠিক তখনই বাইরে থেকে ভেসে এলো ধস্তাধস্তির শব্দ। ডিউটিরত পুলিশগুলো ওয়াকিটকিতে আয়ানকে এলার্ট করলো সহসা। জানালো সন্দেহভাজন একজনকে পাকড়াও করেছে তারা বাড়ির সদরদরজা থেকে। পালাচ্ছিল সে লোক। তখনই হাতে নাতে ধরা পড়ে।
হলুদ পাঞ্জাবিতে আঁটসাঁট যুবক আর অপেক্ষা করে না। পকেট থেকে রিভলবার বের করতে করতে ব্যগ্র কদম ফেলে বাড়ির বাইরে! সঙ্গে বের হয় অভিও। এতো আনন্দের একটা দিনে আবার নতুন কোন বিপদের মহড়া শুরু হলো ওদের জন্য কে জানে?
‘ একটু বাদে অনুষ্ঠান শুরু হবে! কত মেহমান আসছে বাড়িতে। বাবার পরিচিত বড় বড় সব বিজনেস পার্টনার একেকজন! আপনার কলিগরা, প্রিন্সিপাল মিস্টার বিল! প্রফেসর মিসেস বেলা! তারাও এসেছেন। আপনি তাদেরকে ছেড়ে এখানে এসে সময় নষ্ট কেনো করছেন বলুন তো? এমন পাগলামি মানায় আপনাকে?’
আরশি এক নিশ্বাসে এতকিছু বলেও থামলোনা৷ মাথা নিচু করে ঠোঁট টিপে হাসতে থাকা ভদ্রলোককে একেবারে ঠেলেঠুলে বের করে দিতে চাইলো রুমের বাইরে! কিন্তু আফসোস! এক বিন্দুও টলাতে পারলো না শেহজাদকে।
শেহজাদ অটল নিজের জায়গায়। আরশি যখন তার বুকের ওপর দু’হাত রেখে তাকে সরাতে ব্যস্ত তখন শেহজাদের এক হাত উঠে এলো মেয়েটার কোমরে। পরম আদরে ছুঁয়ে দিলো তার ভুবনমোহিনীকে। লাস্যময়ী কোমরটা টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে কপালে কপাল ঠেকালো। চোখ বন্ধ করে হাস্কি স্বরে আওড়াল,
‘ পুরো আট ঘন্টা তোমাকে কাছে পাইনি! আদর করতে পারিনি! মনে হচ্ছে গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে আমার! এতোবার করে পানি খাচ্ছি, কাজই হচ্ছে না!’
কেঁপে উঠল লাজবন্তী। চওড়া বুকে হাত রেখেই শ্বাস ফেললো ঘনঘন। চোখ বুঁজে শুধোলো,
‘ আপনি…আপনি প্লিজ যান তো!’
দু’পাশে সজোরে মাথা নাড়লো শেহজাদ। কেমন দূর্বল গলায় আওড়াল,
‘ উহু! যাবো না! তুমি নামক গন্তব্য যেখানে আমি পেয়েছি, আমার সব গন্তব্য সেখানেই শেষ আরশি! আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই বিশ্বাস করো! কোত্থাও না!’
কাজলটানা অক্ষিযুগল ভিজলো আরশির। এই নয় মাসের প্রতিটা মূহুর্ত ভেসে উঠলো দৃষ্টিপটে।
তখনই শেহজাদ তার অন্য হাতটা আলতো করে ছোঁয়ায় ওর গালে। ধীরে ধীরে কাঁচা হলুদের প্রলেপ টানে সেখানে। পরপর আরশির হলুদ লাগানো গালে নিজের গাল ছোঁয়ায় শেহজাদ। ওভাবেই থেকে গিয়ে আওড়ায়,
‘ ভাগ্যিস সেদিন তুমি জেদ ধরেছিল এদেশে আসার। ভাগ্যিস! ভাগ্যিস সেদিন তুমি আমার সব অপরাধ ভুলে গিয়ে পা রেখেছিল আমার ঐ রঙহীন এপার্টমেন্টটাতে! ভাগ্যিস! নইলে কে সামলাতো আমাকে?’
‘ আপনাকে এখনোও বা আমি সামলাতে পারছি কই? এইযে কেমন পাগলামি করছেন এখানে এসে! এটা কোনো সময় হলো আদর করার? আর আর..আমায় হলুদ লাগালেন কেনো এখন?’
শেহজাদ চোখ মেলে চাইলো অমনি। পুরুষোচিত ভারী গলায় কামনার বান।
বলল,
‘ সবাই তোমাকে যখন হলুদ লাগাবে তখন যেন আমার হিংসে না হয়, তাই আগেভাগে লাগিয়ে রেখে গেলাম! নিজের হাতে, নিজের মানুষটাকে!’
আরশি জুতসই কথা খুঁজে পায় না। আইঢাই করে ওঠে লাজে। প্রসাধনীহীন মুখখানা রক্তিম হয়। লজ্জারা ছুটে ছুটে বেরোয় রমনীর লালিত কপালে কপোলে।
শেহজাদ আবদারের স্বরে বলে উঠলো,
‘ দরজাটা আধ ঘন্টার জন্য বন্ধ করে দেই? জাস্ট আধ ঘন্টার জন্য! এর থেকে একটুও বেশি সময় নেবো না তোমার! সারাদিনে আর একবারও জ্বালাতে আসবো না! প্লিজ আরশি! একদম লক্ষী ছেলে হয়ে…!’
‘ ছোট সাহেব?’
কেয়ারটেকার রবিনের গলা পেয়ে ওখানেই থেমে গেলো শেহজাদ। পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে গেলো ওর বেলেহাজ কথা, বেপরোয়া ইচ্ছেগুলো।
রবিন দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে। তার বেঢপ ছায়াটা দেখা যাচ্ছে কার্টেনের এপাশ থেকে। শেহজাদ বিরক্ত হলো ভীষণ। তবে সেটুকু প্রকাশ পেলল না তার উত্তরে।
ততক্ষনে ঘাবড়ে গিয়েছে আরশি। ভাবলো এই বুঝি রবিন চাচা দেখে ফেললো ওদেরকে এভাবে। মেয়েটা সাত-পাঁচ ভেবে সরে যেতে চাইলেও শেহজাদ সরতে দিলো না ওকে। নিজের সাথে আগলে রেখেই রবিনের কাছে ঠান্ডা গলায় জানতে চাইলো,
‘ যদি জরুরী দরকার না হয়, তাহলে আমি আধ ঘন্টা পর এসে আপনার কথা শুনছি! আপনি যেতে পারেন। বাবার হয়তো প্রয়োজন হবে আপনাকে!’
রবিন কার্টেনের ওপাশ থেকেই ইতস্তত গলায় আওড়াল,
‘ আসলে হয়েছে কী…ইয়ে মানে…একবার বাগানে আসুন ছোট সাহেব! কান্ড ঘটে গেছে সেখানে। একটা অপরিচিত ছেলে! গেস্ট লিস্টে নামধাম কিচ্ছু নেই। পুলিশ হাতে নাতে ধরতেই আরশি ম্যাডামের নাম নিয়ে চেচাচ্ছে অনবরত! বলছে, ম্যাডাম নাকি চেনে তাকে! দেখলেই চিনতে পারবে। আপনি একবার আসুন নিচে। সবাই সেখানেই আছে! আপনার আর ম্যাডামের খোঁজ করছে সবাই!’
ইয়ার্ডে ছোটখাটো একটা জটলা পেকেছে ডিউটিরত পুলিশদের হাতে ধরা পড়া ঐ আগন্তুককে ঘিরে। হট্টগোল টের পেয়ে গৃহপরিচারিকা ক্যারোলিনের কাঁধে ভর দিয়ে এমিলিয়াও এসেছে সেখানে।
প্রায় প্রত্যেকের দৃষ্টি উৎসুক হলেও ওর দৃষ্টিতে জেঁকে বসেছে ভয়। আদি নামক অমানুষটা আজকেও জেল পালিয়ে এখানে আসেনি তো?
কিন্তু আগন্তুকের মুখের মাস্ক টেনে খুলতেই মোটামুটি অপরিচিতের আসনেই তাকে দাঁড় করালো এমিলিয়া।
মিনিখানেক বাদে শেহজাদ আর আরশিও এলো সেখানে। ভীর ঠেলে জারার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখ কপালে উঠল আরশির। সপ্রশ্ন কন্ঠে স্বগোতক্তি করে বলল,
‘ রেজা?’
শেহজাদ বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষন। টানটান তার চোয়ালের মাংসপেশি। তীক্ষ্ণ চাওনি সম্মুখে। সবাই বিস্ময় নিয়ে রেজাকে দেখলেও তার ঈগল দৃষ্টিতে বিস্ময়ের লেশমাত্রটি নেই। সতর্ক সে! তবে তার পাশের মানুষটা ততোধিক আঁতকে উঠেছে আরশির মুখে আগন্তুকের নাম শুনে। শেহজাদের কানের পাশে ফিসফিসিয়ে এসে শুধাল,
‘ সর্বনাশ! তোর বউয়ের এক্স-টেক্স নয়তো এই ব্যাটা?’
শেহজাদ নিরুত্তাপ গলায় জানাল,
‘ শাট আপ আয়ান! শী নেভার ডেটেড এনিওয়ান, নর ডিড শী হ্যাভ অ্য ম্যান ইন হার লাইফ বিফর মি! এক্স তো অনেক দূরের কথা!’
‘ তাহলে ছেলেটা?’
‘ আরশির ক্লাসমেট!’
এতক্ষণে হাঁপ ছাড়লো আয়ান।
‘ তাই তো বলি! এমন বিদেশি কায়দায় আমাদের খরগোশের মাকে এরশি এরশি বলে ডাকছে কোন হাঁদারাম!’
শেহজাদ শক্ত স্বরে হিসহিসিয়ে আওড়াল,
‘ আরশি ম্যারিড জানার পরও এখানে এসে শুধু শুধু আরশির নাম নিয়ে সিন ক্রিয়েট করলো? আর তুই দাঁড়িয়ে ছিলি? শ্যুট করে দিতে পারলি না ব্লাডি ইডিয়টটাকে?’
আয়ান অসহায় হাসে। বন্ধুকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে কাঁধে হাত রাখতে গিয়েও সরিয়ে নেয় তৎক্ষনাৎ। যেভাবে তেতে আছে ছেলেটা, ওর হাতটাই না পুড়ে যায়!
‘ সে আমি শ্যুট করতেই পারতাম! কিন্তু আমাদেরও তো কিছু নিয়মনীতি আছে ভাই। ইনোসেন্ট কারোর উপর এ্যকশন নিলে সুপারিয়ররা আমাদের উপর এ্যকশন নেবে। তারউপর ছুটে এসে দেখি ছেলে সমানে তোর বউয়ের নাম ধরে ডাকছে। ভাবলাম দেবদাস টাইপ কাহিনী। মাথার তার ফার ছিড়ে গেছে! ওমা! এখন তো দেখি ব্যাটার মাথায় তারই নেই!’
শেহজাদ ঠান্ডা চোখে একবার আয়ানের দিকে তাকাতেই থেমে গেলো সে। চোখ সরিয়ে নিতেই আরশি বলে উঠল,
‘ ওকে ছেড়ে দাও আয়ান ভাই! আমাদের ক্লাসমেট। খারাপ মানুষ নয়! আমি আর জারা চিনি তো ওকে!’
শেহজাদ বিস্ময়সমেত চাইলো উদ্বিগ্ন মুখটার দিকে। হাউ ডেয়ার শী? আরশি বাইরের একটা ছেলেকে ডিফেন্ড করছে কোন সাহসে?
বন্ধুর চোখ পড়ে ফেললো আয়ান। হাসি আঁটকে ইশারায় বাকি পুলিশদের ছেড়ে দিতে বলল রেজাকে। পরপর সামনে গিয়ে রেজার ঘাড়ে হাত রেখে পশ্চিমা শব্দে শুধাল,
‘ ক্লাসমেটের বিয়ে খেতে এসেছিলে ভালো কথা! কিন্তু তাই বলে দেখা না করেই পালাতে চাইছিলে? আর এটা কেমন ড্রেসআপ! আমি তো আরেকটু হলে তোমাকে শত্রুপক্ষের স্পাই ভেবে তোমার খুলি উড়িয়ে দিতাম ভাই!’
এমিলিয়ার গলা শোনা গেলো এবার। খুড়িয়ে খুড়িয়ে সামনে এসে বলল,
‘ ওনার সাথেই একটু আগে ধাক্কা লেগেছিল আমার। উনি চুপচাপ বাড়ির ভিতরে ঢুকতে চেয়েছিলেন হয়তো। আমার সাথে ধাক্কা লাগার পর আর ঢোকেননি ভিতরে! চলে যান ওখান থেকে!’
এমিলিয়া যে মিথ্যে বলছে না, তার সাক্ষী দিলো অভি নিজে। জানালো সে-ও দেখেছে এমিলিয়াকে দরজার সামনে পড়ে থাকতে। বেকায়দায় পা টাও মচকেছে বেচারির।
সব শুনে আয়ান ফিরে তাকালো রেজার দিকে। বুকে হাত গুঁজে আরামসে দাঁড়াল। পরপর তাচ্ছিল্যের স্বরে শুধোলো,
‘ লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে চাইছিলে কেনো ভাইটু? বিয়েতে গিফট না আনার ভয়ে?’
রেজা মাথা নোয়াল। শ্যামলা মুখখানা অপমানে কালো হয়ে গেছে যেন। পা থেকে মাথা অবধি আড়ষ্টতা! যদিও পুলিশ খালি করেছে জায়গাটা, তবুও গাট হয়ে রইলো সে। বেশ অনেক্ষন এভাবে থাকার পর শেষমেশ স্বীকার করলো নিজের ভুল। বলল,
‘ আসলে আমি শেষবারের মতো দেখা করতে এসেছিলাম প্রফেসর আর আরশির সাথে। শুরুর দিকে জানতাম না আরশি প্রফেসরের ওয়াইফ! এ নিয়ে বাকবিতন্ডা, তর্কাতর্কি এমনকি মারামারি অবধি হয়েছে আমার আর ওনার মধ্যে। কারণ হিসেবে আমার তরফ থেকেই ভুলের পরিমাণটা বেশি। আরশি বিবাহিত জানার পরও তাকে পছন্দ করার ধৃষ্টতা দেখাই প্রফেসরের সামনে। সেসব আর না বলি।
আগামীকাল আমি আমার বাড়িতে ফিরে যাব। লেখাপড়াটা আর চালাতে পারবো না হয়তো। বাবার ঘরোয়া ব্যবসায় কিছুটা হাত লাগাবো, পাশাপাশি একটা চাকরি যদি পাই…! তাই ক্ষমা চেয়ে যেতে এসেছিলাম প্রফেসরের কাছে, আর আরশির কাছেও শেষবারের মতো।
কিন্তু এখানে সবাই এতো ব্যস্ত, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করতে পেরে সোজা বাড়ির ভিতর ঢুকবো বলে ঠিক করি, আর তখনই ধাক্কাটা লাগে ওনার সাথে আমার। আমি আপনার নাম জানি না মিস! তবুও আমি দুঃখীত! আমি সবার কাছে ভীষণভাবে দুঃখীত!’
‘ তোমার টিউশন ফি, আর ডর্মে থাকার ব্যাপারে প্রিন্সিপালের সাথে আলাপ করেছো? ফাইনানশিয়াল প্রবলেম হলে উনি হেল্প করতে পারতেন কিছুটা।’
শেহজাদের কন্ঠ ভেসে ওদের মাঝ থেকে। চিরায়ত গম্ভীর মুখটা আশ্চর্য রকমের নরম। আরশি অবাক হয়। সেই সাথে আয়ানও। কানের পাশে এসে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘ এইমাত্র না শ্যুট করে দিতে বলছিলি? এখন টিউশন ফি মওকুফ করার কথা বলছিস? তুই আসলে একটা ইয়ে…আদাছেঁচা! সাংঘাতিক রকমের আনপ্রেডিক্টেবল একটা মানুষ! ছেহ!’
শেহজাদ পাত্তা দিলো না ওর কথায়। তার মনোযোগ রেজার দিকে। ছেলেটা ধরা গলায় বলল,
‘ গিয়েছিলাম স্যার! কাজ হয়নি! তদবির লাগবে। রিকমেন্ডশন ছাড়া উনিও নিরুপায়!’
শেহজাদ বুঝলো ব্যাপারটা। কিছুক্ষণ নীরব থেকে স্নেহসুলভ কন্ঠে আওড়াল,
‘ আমার কিছু পরিচিত মুখ আছে। আমি আলাপ করবো তোমার ব্যাপারে তাদের সাথে। তদবির পেয়ে যাবে! আর প্রিন্সিপালের সাথেও আলাপ করবো। বাট তোমাকেও চেষ্টা করতে হবে পড়াশোনাটা ধরে রাখার। ডু ইউ গেট ইট রেজা?’
রেজার বিমূঢ় মুখের অন্ধকার কেটে যায়। ভেতরটা ভেঙেচুরে আসে অনুতাপে। শুরুতে কতই না ভুল বুঝেছিল এই মানুষটাকে।
শেহজাদের প্রশ্নে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে ও। হাজারটা ধন্যবাদে ফেনা তোলে মুখে। আয়ান ওর কাঁধ চাপড়ে বলল,
‘ হয়েছে হয়েছে! আর ধন্যবাদ দিতে হবে না! তুমি বরং আমার সাথে এসো! আজকাল সারাদিনই শুধু খাওয়াদাওয়া! একেকটা ডিশ আন্টি যা বানিয়েছে না! পোলাও, রোস্ট, কাবাব, রেজালা, বোরহানি কী নেই! এ্যাই? তুমি বাঙালি খাবার খেতে পারবে তো? স্পাইস একটু বেশি, কিন্তু খেতে অমৃত! বুঝলে? ওদিকটায় গিয়ে কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে বাকি আলাপ করবে চলো!’
আয়ান রেজাকে নিয়ে যেতে গিয়েও থামলো। অভির দিকে তাকিয়ে কন্ঠ তুলে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কী হে অভিবাবু! আপনিও যাবেন নাকি আমাদের সাথে?’
অভি চওড়া হাসে। সে-ও কন্ঠ উঁচুতে তুলে বলে,
‘ অবশ্যই! খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আমার কোনো রেস্ট্রিকশনস নেই!’
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৯
দুশ্চিন্তার মেঘ কাটলো অমনি। আবার আনন্দের রোদে ভাসলো ভিলার প্রতিটা মুখ। যে যার কাজে ব্যস্ত হলেও
আরশি এক ধ্যানে তাকিয়েছিল শেহজাদের দিকে। তবে শেহজাদ তাকালো না। নির্লিপ্ত চোখে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো স্রেফ। প্রথমবার এমন হোঁচট খায় আরশি! এভাবে চলে গেলো কেনো মানুষটা? রাগ না করলে তো এভাবে আরশিকে অদৃশ্য মনে করে বসে না সে! কিন্তু হুট করে রেগেই বা গেলেন কী কারণে? এবার আবার কী করলো ও?