নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪
সিনথিয়া

জারা আয়ানের বাড়িয়ে দেয়া হাত আর বত্রিশ পাটি দাঁতকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে, উল্টো ঘুরে হাঁটা দিলো নিজের রুমের দিকে।
তখনই পিছন থেকে আয়ান বলে উঠলো –
“ তোমার নাম যে জারা সেটা কিন্তু আমি জানি! আর এটাও জানি যে তুমিও বাঙালি! এ বাড়ির হোমওনার কাল রাতে আমাকে বলেছে!”
আয়ানের সোনালী চোখ জোড়া চকচক করছে। মুখে বিস্তর হাসি নিয়ে পরপর বলল-
“যদিও ভেবেছিলাম আমার নতুন ফ্লাটমেটের সাথে রাতেই বেশ ভালো আড্ডা দেয়া যাবে, কিন্তু এসে দেখি তুমি দরজা আঁটকে অলরেডি নাক ডাকা শুরু করে দিয়েছো। যদিও সুন্দরী মেয়েরা নাক ডাকে না,
কিন্তু তুমি তো শুধু সুন্দরী নয়, তুমি হলে “বিউটি উইথ ব্রেইন” টাইপ সুন্দরী! তাই এই থিওরিটা তোমার জন্য নয়, বাকিদের জন্য!”

এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলে থামলো ছেলেটা। অপেক্ষা করলো জারার পিছন ঘুরে তাকানোর। মেয়েটা কিছু একটা বলুক ওকে!
হলোও তাই। জারা হাঁটা থামিয়ে আয়ানের দিকে ফিরে কোমরে দু’হাত রাখলো। চোখ ছোট ছোট করে বলল-
“তাহলে হোমওনার নিশ্চয়ই আপনাকে এটাও বলে দিয়েছে, যে এখন থেকে এই বাসায় কিছু রুলস এন্ড রেগুলেশন চালু হবে! যেখানে আমি পার্টি এ, এবং আপনি পার্টি বি।”
পরপর কাউন্টার টেবিলের দিকে একটু এগিয়ে এসে বলল-
“ আজ থেকে পার্টির ‘এ’ এর উপস্থিতি পার্টি ‘বি’ বাসায় কোনো উল্টোপাল্টা করলে, সোজা হোমওনারের কাছে বিচার যাবে!
পার্টি ‘বি’ বাসায় মেয়েবাজি করলে, ছেলেদের নিয়ে আড্ডা দিলে সোজা হোমওনারের কাছে বিচার যাবে!
চিড়িয়াখানা ছেড়ে এখানে এসে গান ছেড়ে নাচানাচি করলে সোজা হোমওনারের কাছে বিচার যাবে!
আর পার্টি ‘এ’ এর সাথে ফ্লার্ট করতে আসলে-”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জারা কথাটা শেষ করার আগেই আয়ান বলে উঠলো –
“ওয়েট লে’মমি গেইস, সোজা হোমওনারের কাছে বিচার যাবে! তাই তো?”
জারা আরেকদিকে ফিরে ঠোঁট বাকালো। পরপর আয়ানের চোখে চোখ রেখে উপহাসের স্বরে বলল-
“ভুল! ফ্লার্ট করতে আসলে জায়গা মতো এমন লাথি পড়বে, যে তিনদিনেও হুশ ফিরবে না!”
জারার শেষের কথাটায় ঢোক গিলল আয়ান। একটু নিচু হয়ে আসল জায়গা হাত দিয়ে ঢেকে অপ্রস্তুত হাসলো। কোনমতে বলল-
“কু-কুল ডাউন বাটারফ্লাই! শুরুতেই আমার ফিউচার জেনারেশন নিয়ে ফুটবল খেলার কি দরকার বলো! এখনো বউয়ের মুখ দেখলাম না, তার আগেই যদি-”
জারা আর দাঁড়ালো না। নিজের রুমে যেতে যেতে উঁচু গলায় বলল-
“ফিউচার জেনারেশন বাঁচাতে হলে আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলুন মিস্টার মিস্টার আয়ান হান্টার!”

ম্যানহাটন সিটির আকাশ আজ মেঘাচ্ছন্ন। গগনচু্ৃম্বী ভবনগুলো যেনো সেই মেঘ ভেদ করে দাঁড়িয়ে থাকা একেকটা ক্লাউড ফরেস্ট। জনসমাগমে কানায় কানায় পূর্ণ থাকা সেন্ট্রাল পার্কে মানুষের আনাগোনা সবে বাড়তে শুরু করেছে।
তারমধ্যে থেকেই ঘনঘন শ্বাস ফেলে দৌঁড়চ্ছে আরশি। ভার্সিটি যাওয়ার বাস মিস করেছে, এখন ওর একমাত্র ভরসা এখানকার সাবওয়ে ট্রেন।
কিন্তু ভাগ্য বোধ হয় আজকে
“কোনোমতেই সাহায্য করবো না” বলে পণ করে রেখেছে। নয়তো দৌঁড়ে এসেও কেনো শেষ রক্ষা করতে পারলো না মেয়েটা?
প্লাটফর্মে পৌঁছতে পারলেও দু’সেকেন্ড দেরি করে আসায় মুখের উপর ট্রেনের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো।
ফলস্বরূপ কাঁধের টোট ব্যাগটা হাতে নামিয়ে মাথা নিচু করেই প্লাটফর্ম ছাড়তে হলো ওকে।
একটু আগে যে মেয়েটা দৌঁড়চ্ছিল, সেই মেয়েটার হাঁটার গতি এখন স্বাভাবিকের চাইতেও শিথিল।
মনে মনে ভাবলো – এখন যদি হেলিকপ্টার করেও ও ভার্সিটিতে যায় তবুও শেহজাদ ওকে ক্লাসে ঢুকতে দেবে না।
মূহুর্তেই ম্যানহাটনের সমস্ত মেঘ যেন জমা হলো আরশির আননে। ঠোঁট উল্টে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপনি কেনো এতো পঁচা জাম্বুবান? নিজে গাড়ি করে ভার্সিটি গেলেন। সাথে করে বউটাকেও তো একটু নিয়ে যেতে পারতেন।

কিন্তু না! তাহলে ওনার তিন ফিটের ডিস্টেন্স মেইনটেইন কে করবে? পারে তো ফিতে দিয়ে মেপে মেপে দূরত্ব বজায় রেখে চলেন আমার থেকে!”
কিন্তু অন্তরীক্ষের অন্তরে আরশির আর্তনাদ না পৌঁছালেও, ফেরেশতার মতো এক আগুন্তকের আগমন ঘটলো ওর পাশে। যদিও ফেরেশতা না যমদূত সেটা তো পরে বোঝা যাবে। কারন হুট করে কাউকে ফেরেশতা মনে করা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়।
সফেদ রঙা গাড়িতে বসে থাকা সেই আগুন্তক নিজে থেকেই আরশিকে জিজ্ঞেস করলো-
“ডু ইউ নিড অ্যা রাইড ম্যাম?”
ফ্যাসফ্যাসে পুরুষালী কন্ঠ শুনে পাশ ফিরে চাইলো আরশি। সম্পূর্ণ কালো লেদার জ্যাকেট, প্যান্ট আর মাস্ক পরিহিত একটা লোক গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে কথাটা জিজ্ঞেস করেছে ওকে ।
রাইড নেবে কি নেবে না? এক মূহুর্ত ভাবলো আরশি। কিন্তু এই মূহুর্তে ভাববার চাইতে ক্লাস ধরা টা বেশি জরুরি। তাই তো আগুন্তক লোকটাকে উবার ড্রাইভার মনে করে বলে বসলো-
“ ইট উড বি অ্যা গ্রেট হেল্প ইফ ইউ ক্যান গিভ মি অ্যা রাইড টু মাই ইউনি..ডোন্ট ওয়্যারি, আই উইল পে ফর দ্যা রাইড!”

গাড়িতে বসা লোকটি পশ্চিমা ভাষায় হেসে বলল-
“ শিউর ম্যাম! জাস্ট হোপ অন এন্ড আই উইল টেইক ইউ দ্যায়ার!”
আরশি আগে পিছে আর কিছু ভাবলো না। তাড়াহুড়ো করে গাড়ির পিছনের সিটে উঠে বসতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো সেই লোক।
ঠোঁট গোল করে নিশ্চিন্তের লম্বা শ্বাস ফেলল মেয়েটা। আবার একটু খটকাও লাগলো ওর কাছে। মনে মনে বলল-
“এখনো তো ভালোমতো রাস্তা চিনি না, যদি লোকটা ভালো না হয়! যদি অন্য কোনো জায়গায় নিয়ে চলে যায়? জাম্বুবানকে কি মোবাইল থেকে লোকেশনটা একবার শেয়ার করে রাখবো?”
আর ঠিক যখনই লোকেশন টা শেয়ার করতে যাবে তখনই মাথায় আসলো,
“কিন্তু আমি লোকেশন শেয়ার করলেই বা উনি দেখবে কেনো? এমনেতেই তো আমি ওনার জন্য উড়ে এসে জুড়ে বসা একটা ঝামেলা। যদি নিজে থেকে হারিয়ে যাই, তাহলে তো মনে হয় খুশিই হবে জাম্বুবানটা! মিলাদ-টিলাদও পড়িয়ে ফেলতে পারেন এই খুশিতে!”

তৎক্ষনাত আকাশ ভেঙে ঝিরিঝিরে বৃষ্টি নামলো ভীষণ ব্যস্ত এই শহরটায়।
অবাক চোখে জানালার বাইরে তাকালো আরশি। কিন্তু মুখ বাড়িয়ে বৃষ্টি দেখার আগেই ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটা গাড়ির জানালা তুলে দিলো।
ভড়কে গেলো ও। একে তো মনের ভিতর কু-ডাকছে। তারউপর এভাবে লোকটা গাড়ির জানালা তুলে দিলো কেনো?
ভাবলো, নেমে যাবে। আজকে দেরি যখন হয়েছে তখন আর ভার্সিটি যেয়ে কাজ নেই। এখানে নামলেও একটা বাস ধরে সোজা বাসায় চলে যেতে পারবে ও।
কিন্তু ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলতেই গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দিলো লোকটা। কুটিল হেসে পশ্চিমা ভাষায় বলল-

“এতো অস্থির হচ্ছেন কেনো ম্যাম? আপনি না ভার্সিটি যাবেন? আমি তো আপনাকে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি।”
আরশি শুকনো ঢোক গিলল। কাঁপা কাঁপা হাতে শেহজাদকে কল দিলো। একবার, দুবার, তিনবার। রিং হলো, কিন্তু শেহজাদ সেই কল রিসিভ করলো না।
এদিকে গাড়ির দরজাটাও লক করে রেখছে লোকটা। চাইলেও সেটা খুলতে পারছে না আরশি। আবার নিজের ফোনের দিকে তাকালো মেয়েটা।
কিন্তু ঠিক যখনই ও নাইন ওয়ান ওয়ান নাম্বারটা ডায়াল করতে যাবে, তখনই
প্রচন্ড গতিতে গাড়ি ঘোরালো সেই লোক।
মোবাইল ছিটকে নিচে পড়ে গেলো আরশির হাত থেকে।
বিকট শব্দে ওর মাথা গিয়ে ঠেকলো কাঁচের জানালায়। আচমকা আঘাতে ওখানেই জ্ঞান হারালো মেয়েটা। চোখ বন্ধ হওয়ার আগে শুধু বিড়বিড় করে বলল,
“শেহজাদ! শেহজাদ! প্লিজ বাঁচান আমাকে! প্লিজ! শেহজা-”

“দেখলে! কতোবার বললাম, দেখে কাজ করো, দেখে কাজ করো। হাত-টাত আবার কেঁটো না সবজি কাঁটতে গিয়ে। কিন্তু না! গিন্নির আমার সবকাজে তাড়াহুড়ো করতেই হবে!”
স্ত্রী জেয়নেব চৌধুরীর হাত নিজের কোলের উপর রেখে কথাগুলো বললেন আরশির বাবা ইব্রাহীম চৌধুরী। পরপর হাঁক ছুড়লেন বাড়ির কাজে সহযোগিতা করা হারুকে ডাকতে।
“কই রে হারু! তোর গিন্নি মা হাত কেঁটেছে। তাড়াতাড়ি আমার টেবিল থেকে ফার্স্ট এইডের বক্সটা নিয়ে আয় তো! ও হ্যাঁ! সাথে একটু তুলো আর স্যাভলোনও নিয়ে আসিস।”
জেয়নেব পাশেই বসা ছিলেন। স্বামীকে দেখছিলেন মুগ্ধ হয়ে। এই বয়সেও বউয়ের প্রতি কত যত্ন লোকটার।
ইব্রাহীম চৌধুরী হাঁকডাক শেষ করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। চোখে মায়া মিশিয়ে শুধালেন,
“বেশি ব্যাথা করছে গিন্নি? কি নিয়ে সারাক্ষণ এতো ভাবো বলো তো? এতো উদাসীন হলে চলবে? দিন-দিন বয়সটা বাড়ছে না কমছে বলো তো তোমার? ”
এবারটায় মুখ খুললেন প্রৌঢ়া। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন-

“আসলে মেয়েটার কথা এতো মনে পড়ছে না! ওখানে কেমন আছে? কি খাচ্ছে? আদৌ খাচ্ছে কি না? কিছুই তো ভালো করে বলে না। জানোই তো কি মুখচোরা স্বভাবের মেয়েটা। বুক ফাঁটবে তবু মুখ ফুটবে না ওর।”
ইব্রাহীম চৌধুরী স্ত্রীর কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বললেন,
“তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো গিন্নি। আর ওখানে কি আমাদের মেয়ে একা নাকি? শেহজাদ আছে না ওর সাথে?”
জেয়নেব চৌধুরী তবুও উশখুশ করলেন। অবশেষে মুখ ফসকে বলেই ফেললেন,
“আসলে আমার না কেন যেন আজকে সকাল থেকেই মনটা ভীষণ কু-গাইছে। মেয়েটা ভালো আছে তো?”
“এক কাজ করো, মেয়েটাকে একটা কল দাও। কিছুক্ষণ কথা বলো। দেখবে এসব কু-গাওয়া-টাওয়া কোথায় পালিয়ে গেছে!”

ইব্রাহীম চৌধুরীর কথা শেষ হতে দেরি হলো কিন্তু জেয়নেবের মেয়েকে কল দিতে দেরি হলো না।
ইব্রাহীম চৌধুরী পাশ থেকে বললেন,
“ স্পিকারে দাও তো ফোনটা। আমিও শুনি তোমরা মা-মেয়ে আবার আমার নামে নিন্দে টিন্দে করো কি না!”
“আমি আপনার নামে নিন্দে করি?”
“করো না বলছো গিন্নি? তুমি তো কল দিয়েই এক ঘন্টা আগে আমার বিরুদ্ধে মেয়ের কাছে নালিশ ঠুকে নাও, পরে বাকি কথা বলো!”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩

ইব্রাহীম চৌধুরী হেসে হেসে কথাগুলো বললেও মূহুর্তেই তার সব হাসি উধাও হয়ে গেলো! জেয়নেবও যেনো জমে গেলেন সহসা। কয়েকবার রিং হয়ে কলটা কেঁটে যেতেই দুশ্চিন্তা বাড়লো তাদের। জেয়নেব আহত চোখে স্বামীর পানে চেয়ে বললেন,
“মেয়েটা তো ফোন ধরছে না!”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫