পাতা বাহার পর্ব ১৪

পাতা বাহার পর্ব ১৪
বেলা শেখ 

তীব্র গরমের মাঝে স্বস্তিদায়ক সকাল। রোদ তেজ দেখিয়ে উঠলেও এলোমেলো বাতাসের দাপটে রোদের আলো তেমন গায়ে লাগছে না। তবে বাতাস ক্ষণিকের ব্যবধানে স্থির থাকলে যেন গরমে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সরকার বাড়ির পরিবেশটা সবসময় শীতল। বড় ছোট গাছপালায় ঘেরা সবুজ শ্যামল নীড়। দেখলেই যেন চোখ তনুমন শীতলতায় ছেয়ে যায়। অরুণ সরকার ছেলেকে পড়া কমপ্লিট করিয়ে, খাইয়ে দাইয়ে স্কুলের জন্য রেডি করাচ্ছে। প্যান্ট পরিয়ে শার্ট গায়ে চড়িয়ে বোতাম লাগাচ্ছে।

চঞ্চল ভোর মোটেও চুপ করে নেই। তার কত শত বুলি। একটার পর একটা গল্পের জুড়ি খুলে‌ বসেছে। তবে তার বেশিরভাগ কথাই নতুন বাইককে ঘিরে। অরুণ মোটেও বিরক্ত হচ্ছে না। বরং ছেলের প্রত্যেকটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মাঝে মাঝে ছেলের গালে চুমু দিয়ে সায় জানায়। পাতাবাহার বাবা ছেলের দিকে কুটুর কুটুর করে চেয়ে আছে। বিছানায় রাখা ভোরের মুজোটা চুপি চুপি নিয়ে বিছানার তলে রাখে। তারপর আবার দেখায় মনোযোগ দেয়। অরুণ ছেলেকে শার্ট পরিয়ে টাই বেঁধে দিল। ভোর পাশে বিড়ালের দিকে তাকাতেই বিড়াল চোখ পিট পিট করে। ভোর হেসে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” আব্বু দেখ পাতাবাহার কিউট কিউট করে তাকাচ্ছে? একদম মিস পাতার মতো!”
অরুণ চোখ ছোট ছোট করে ভোরের দিকে চায়। কাল সারাদিন থেকে একবারো মিস পাতাবাহারের নাম নেয় নি ভোর। ভোরের কিছু মনে পড়ায় ভোর বাবার গালে হাত বুলিয়ে বলে,
-” আব্বু আমার বাইকে কিন্তু মিস পাতাকে তুলব!”
-“কেন?”
-” বাহ রে আমি তার বাইকে উঠে ছিলাম আর এখন আমার বাইকে তাকে নেব না?”
অরুণ মাথা নাড়ে।

-” না নেব না! সি ইজ ডেঞ্জারাস ফর মি!”
-” আব্বু কেন নিবে না? আমি তাকে বলেছি আব্বু বাইক নিলে আপনাকে নিয়ে অনেক ঘুরব!”
অরুণ ছেলের চুল ব্রাশ করে বিছানায় মুজো খুঁজতে খুঁজতে বলে,
-” আমার বাইকে শুধু আমি আর তুমি!”
-” আব্বু তুমি বলেছিলে ওটা আমার বাইক।”
-” হুম তোমারি তো কলিজা!”
-” তাহলে মিসকে তুলতে হবে! হবে মানে হবে!”
অরুণ ছেলের দিকে চায়। তবে কিছু বলে না। মুজো জোরা না পেয়ে নতুন একজোরা মুজো আলমারি থেকে বের করে বলে,

-” আশ্চর্য মুজো এখানেই তো রেখেছিলাম। গেল টা কোথায়?”
বিড়াল শাবক ফট করে বিছানা থেকে নেমে বিছানার তল থেকে একটা মুজো পা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বের করে। ভোর বাবাকে সেদিকে তাকাতে ইশারা করে। অরুণ পাতাবাহারের কাছে মুজো দেখে চোখ পাকিয়ে বিড়ালকে ধরতে গেলেই সে রুম থেকে পগারপার।
-” এই পাতাবাহারটা এতো দুষ্টু না!”
বলে ভোরকে মুজো শু পড়িয়ে গলায় আইডি কার্ড ঝুলিয়ে দিল। নিজে আলমারি থেকে নরমাল টি শার্ট জিন্স পড়ে রেডি হয়ে সানগ্লাস টি শার্টের গলায় ঝুলিয়ে দিল। বাইরে অনেক রোদ কি না! ভোর বাবাকে দেখে হেসে বলে,

-” আব্বু তোমাকে সেই লাগছে! একদম হিরো হিরো!”
অরুণ মুচকি হেসে চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
-” দেখতে হবে না আব্বু টা কার?”
ভোর হেসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে।অরুণ ছেলেকে কোলে নিয়ে ফাইল হাতে নিল যাতে ক্লিপ বোর্ড ও পেন্সিল বক্স রাখা। রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখে সবাই এখানেই উপস্থিত। আনিকাও রেডি! অরুণ ছেলেকে ধীমে সুরে বলে,
-” আব্বু আজ তোমার প্রথম এক্সাম! সবার থেকে দোয়া চাইবে! বুঝলে?”
ভোর মাথা নাড়ে।অরুণ ছেলেকে নামিয়ে দিল।

ড্রয়িং রুমে আসমা বেগম বসে চা খাচ্ছেন। আরিয়ান নিউজ পেপার পড়ছে। আদুরি কাল বিকেলেই ট্রিপে চলে গেছে। রুবি রুপমকে কোলে নিয়ে আনিকাকে এটা ওটা বলছে। আনিকা প্লেতে পড়ে । দুজনকে একি স্কুলে দিতে চেয়েছিল সবাই। কিন্তু অরুণ সেটা চাই নি। এমনিতেই ভোর প্লে পড়ে নি। অরুণ ভর্তি করিয়েছিল। ভোর না ক্লাসে গিয়েছে না এক্সাম দিয়েছে। শুধু মিস টুম্পার কাছে সকাল বেলা টিউশনি করেছে। তারপর বাবার সাথে অফিস‌। অরুণ তো টেনশনে ছিল নার্সারিতেও না এমন করে! প্রথম প্রথম যেতে চাইতো না। কান্না কাটি করতো! তারপর রোহানের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর আর বাহানা দেখায় না।

ভোর টা জেদি। আনিকার সাথে খুব একটা ভাব নেই ওর। ঝগড়া লেগেই থাকে। আর তাছাড়া রুবি আরিয়ান মেয়েকে যে স্কুলে ভর্তি করার কথা বলেছিল সেটা অরুণের অফিসের উল্টো দিকে। আর সানশাইন স্কুল তার অফিসে যাওয়ার রাস্তায়ই পড়ে। আর সেখানকার প্রিন্সিপাল ম্যাম তার আপন খালা। তাকে বেশ স্নেহ করে তাই সেখানেই দিয়েছে। আসমা বেগম ভোরকে দেখে হেসে বলে,

-” আরে আরে ভোর সরকার।একদম রেডি ! প্রিপারেশন কেমন রিভাইস দিয়েছো?”
ভোর হেসে দাদির কোলে বসে। আসমা বেগম তাকে আদর করে অরুণের দিকে চায়। আরিয়ান ভাই ও মাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। অরুণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ভোর হাসিমুখে বলে,
-” রিভাইস ডিভাইস সব দিয়েছি দাদি! তুমি শুধু দোয়া করবে কেমন?”
আসমা বেগম হেসে ভোরের হাতে পাঁচশ টাকার একটা নোট দিয়ে তার কপালে চুমু খায়।
-” অবশ্যই দোয়া করবো। ভালোভাবে এক্সাম দেবে। একটুও ঘাবড়াবে না!”
ভোর টাকা পেয়ে খুব খুশি। তবে বাবার দিকে আড়চোখে চাইলে খুশি উড়ে যায়। অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আসমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-“ছোট মা শুধু দোয়া করে দাও! ও ছোট বাচ্চা টাকা দিয়ে কি করবে? ভোর দাদিকে দিয়ে দাও?”
ভোর মন খারাপ করে দাদিকে টাকা দিল। আসমা বেগমের মুখের হাসি নিভে যায়।অরুনের দিকে তাকিয়ে টাকাটা নিয়ে হাতের মুঠোয় রেখে দিল।অপর হাতে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। অরুণ দেখল তবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল না। আরিয়ানের মুখশ্রী গম্ভীর তার দৃষ্টি মায়ের মলিন মুখে স্থির। সে ভোরকে কাছে ডাকে ভোর আসমা বেগমের কোল থেকে নেমে আরিয়ানের কাছে যায়। আরিয়ান তার গাল টিপে বলে,
-” ভালোভাবে এক্সাম দিবে। ভয় পাবে না ঠিকাছে?”
ভোর মাথা নাড়ে। আরিয়ান পাশ থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে সেটা খুলে কিছু পেন্সিল আর একটা চকলেট বক্স বের করে হেসে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ভোর? তোমার আব্বুকে জিজ্ঞেস কর তো এটা নিতে দিবে নাকি তোমায়?”
ভোর বাবার দিকে চায়। অরুণ গম্ভীর মুখে তাদের দিকেই চেয়ে।
-” এটা কেমন কথা? আমি ওকে কখনো মানা করি নি তোদের থেকে কিছু নিতে! ছোটমা টাকা দিচ্ছিল তুই বল ও টাকা দিয়ে কি করবে?”
আরিয়ান হাসিমুখে বলে,
-” কি করবে সেটা বিষয় না! ভালোবেসে দিয়েছিল সেটাই মুখ্য! কিন্তু তোর চোখে তো আমাদের ভালোবাসা নজরে আসে না! মা শুধু ভোরকে না আনিকাকেও টাকাই দিয়েছে! আনিকা নিল আমি তো মানা করি নি। এখন বল এগুলো কি ও নিতে পারবে?”

শক্ত মুখে ‘না’ বলে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে মেইন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। ভোর উঁকি দিয়ে বাবার প্রস্থান দেখে আরিয়ানের থেকে চকলেট পেন্সিল নিয়ে দাদির কাছে যায়। হাত পেতে মুচকি হেসে বলে,
-” দাও টাকা আমি নিব তো!দাদি তুমি ভালোবেসে দিয়েছো আর আমি নেব না ?”
আসমা বেগম হেসে টাকাটা তার হাতে দিল। ভোর সেটা পকেটে পুরে রুবির কাছে যায়। ছোট রূপের গালে চুমু দিয়ে বলে,

-” স্মল ব্রো আমি এক্সাম দিতে যাচ্ছি আমার জন্য দোয়া করবে ঠিকাছে? চাচিমনি তুমিও দোয়া করবে কিন্তু সব দোয়া আনিকাকে দিয়ে দিও না যেন! আসি?”
দৌড়ে আরিয়ানের কাছে গিয়ে তার গালে টুপ করে চুমু দিল।
-” চাচ্চু আব্বুর উপর রাগ কোরো না কেমন? আমি তো সব নিয়েইছি! আসছি?”
আনিকার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আনি ভালো করে এক্সাম দিবি? আমার জন্য দোয়া করবি তবেই তোকে দোয়া করবো আমি হুম!
বলে রান্নাঘরের দিকে যায়। আনিকা ভেংচি কাটলো ‌। আসমা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে,
-” ওসব না বললে হতো না? ছেলেটা রেগে চলে গেল!”
আরিয়ান আনিকার জন্য আনা চকলেট বক্স আনিকাকে দিয়ে রূপকে কোলে নিল। রুবি আজ ছুটি নিয়েছে। মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাবে।
-” মা! না বললে হতো না! ভাই সবসময় এমন করে! আমাদের আপন ভাবতে তার অনেক দায়!”
রুবি মেয়েকে বলল,

-” আনি যাও বড় চাচ্চুকে বলে এসো !”
-” চাচ্চু তো চলে গেল আম্মু?”
আরিয়ান মেয়ের কথায় হেসে বলে,
-” কলিজাকে রেখে যাবে নাকি! বাইরেই আছে! বাইকের কাছে হয়তো!”
আনিকা দৌড়ে চলে যায় সেখানে। আরিয়ান মেয়ের যাওয়ার দিকে চেয়ে রয়।
আনিকা মেইন দরজা পেরিয়ে বাইরে চলছে আসে। আশেপাশের চাচ্চুকে খুঁজতে থাকে। গেইটের কাছেও তো নেই কোথায় গেল? সে বামদিকে ফিরতেই নজরে আসে চাচ্চু ব্রেঞ্চে বসে আছে। অন্যদিকে ফিরে থাকায় তাকে দেখতে পাচ্ছে না। আনিকা চুপি চুপি তার পিছনে গিয়ে ভাও দেয়। অরুণ পিছনে ফিরে আনিকাকে দেখে অল্প হাসে। হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে চুমু এঁকে দেয় কপালে। আনিকা হেসে বলে,

-” তুমি চলে এলে কেন?”
অরুণ আনিকার মাথায় ছোট ঝুটি ঠিক করে দিয়ে বলে,
-” এমনি!”
-” আমিও এক্সাম দিব আজ! আমার জন্য দোয়া করবে না?”
অরুণ তার গালে আদর করে বলে,
-” অবশ্যই আনি বুড়ি! ভালোভাবে পরীক্ষা দেবে কেমন? দেখেশুনে এনসার করবে। কোশশেন না বুঝলে টিচারকে জিজ্ঞেস করবে !”
আনিকা মাথা নেড়ে হাত পেতে বলে,

-” সবাই আমাকে গিফট দিয়েছে তুমি দিবে না?”
অরুণ চিন্তায় পড়ে যায়। কি দেবে? তার কাছে তো এখন কিছুই নেই দেওয়ার মতো!রুমে যেতে হবে!
-” আনি বুড়ি এক্সাম দিয়ে এসো তারপর গিফট দিবো কেমন?”
-” না না আমার এখনি চাই! তোমার কাছে গিফট নেই?”
অরুণ মাথা নাড়ে নেই তো! আনিকা হেসে একটু দূরে স্ট্যান্ড করে রাখা নতুন বাইক ইশারা করে বলে,
-” তাহলে আমায় বাইকে চড়িয়ে ঘুরাবে?”
-“কেন নয় মামনি? অবশ্যই। বিকেলে নিয়ে যাবো ওকে?”
-” না! এখনি ঘুরিয়ে আন একটু বেশি না! এক্সাম শুরু হতে ঢের বাকি!”
-” দেন লেটস গো মামনি?”

মিনু নিজের রুমে বসে পান বানাচ্ছে। রান্না বান্না ও সকলকে খাওয়ানো শেষ। তাদের খাওয়াও সম্পূর্ণ। আভারি বাজারে গিয়েছে। আজ ভোরের সাথে অরুণ যাবে তাই তার ছুটি। মিনুর পান খাওয়ার অভ্যাস বেশ পুরনো। পান না খেলে তার চলে না। তবে ভোরের নজর বাঁচিয়ে খেতে হয়। সে দেখলে খাওয়ার জন্য বায়না ধরে। বুঝিয়েও কাজ হয় না। সে পান বানিয়ে মুখে পুরে চিবোতে থাকে।

তখনই ভোর মিনু খালা মিনু খালা বলে দৌড়ে আসে। হাতে চকলেট ,পেন্সিল। মিনু চোখ বড় বড় করে একপ্রকার দৌড়েই ওয়াশ রুম গিয়ে পিক ফেলে কুলকুচি করে আসে। ভোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে।
-” মিনু খালা সত্যি করে বলো তো! তুমি কি লুকাচ্ছো?”
মিনূ হে হে করে হেসে বলে,
-” কই কিছুই না!”
ভোর সন্দেহি নজরে চেয়েই থাকে।
-” আমায় দেখে দৌড়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলে? ”
-” ওই এমনি মুখ ধুইতে গেছিলাম! হলুদ গুড়া ভইরেছিল !”
-” ওহ। ভারি কাক্কু কোথায়?”
-” সে তো বাজারে!”
ভোর মুখ ফুলিয়ে বলে,
-” আমার এক্সাম দোয়া করে গেল না?”
মিনু হেসে ভোরকে আদর করে বলে,
-” কইরেছে অনেক দোয়া! আব্বাজান ভালো কইরে পরীক্ষা দিয়ো!”
ভোর হেসে বলে,

-” আচ্ছা।আমি যাই হ্যা আব্বু দাঁড়িয়ে আছে বাইরে! আর এই চকলেট বক্স আর পেন্সিল আমার রুমে রেখে এসো!”
বলে বেরিয়ে যায়। আরিয়ান আসমা বেগম রুবিকে টাটা দিয়ে বাইরে আসে। বাবাকে খুঁজে পায় না। গেইটে দারোয়ানকে দেখে এগিয়ে এসে বলে,
-” ও মামা মামা? কেমন আছো তুমি?”
মধ্যবয়স্ক দারোয়ান গোছের লোকটি হেসে চেয়ার থেকে উঠে বলে,
-” ভালো আছি স্যার তুমি কেমন আছো?”
ভোর তার হাত থাকা লাঠিটা নিয়ে নেড়েচেড়ে বলে,
-” ভালোই আছি! আজ না আমার পরীক্ষা বুঝলে! এই এতটুকু আমি এত বড় বড় পরীক্ষা কিভাবে দিব বলো তো? তুমি একটু দোয়া কোরো বেশি করে ।”

লোকটি হাসে! মালিকের ছেলে তার মতো সামান্য দারোয়ানকে কি সুন্দর মামা বলে ডাকে। মনটাই জুড়িয়ে যায়। আবার তার থেকে দোয়াও চাইছে । সে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
-” অবশ্যই স্যার! ভালোভাবে পরীক্ষা দেও! অনেক অনেক বড় হও!”
ভোর হেসে তার লাঠি তাকে দিয়ে বলে,
-” আব্বুকে দেখেছো?”
দারোয়ান কিছু বলবে এর পূর্বেই গেইটের বাইরে থেকে বাইকের হর্ণের আওয়াজ আসে। সে গিয়ে গেট খুলে দিল। বাইক নিয়ে প্রবেশ করে অরুণ। আনিকা তার সামনে বসে হাসি মুখে। ভোরের দিকে তাকিয়ে জোরে বলে,
-” ভোর দেখ চাচ্চু আমাকে সবার আগে বাইকে চড়িয়েছে! আমরা অনেক মজা করেছি!”
ভোর দুজনের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে সরে যায়। অরুণ বাইক স্ট্যান্ড করে আনিকাকে নামিয়ে দিল। ভোরকে ডেকে বলে,

-” জলদি এসো দেড়ি হয়ে যাচ্ছে! আর ওই ব্রেঞ্চে তোমার ফাইল আছে নিয়ে আসো! আর মামনি ভেতরে যাও তোমারও দেড়ি হচ্ছে।”
আনিকা চলে যায়। যাওয়ার আগে ভোরের দিকে তাকাতে ভোলে না। ভোর বাবার দিকে চেয়ে বলে,
-” আনতে হবে না। আমি এক্সাম দেব না!”
বলে গলার আইডি কার্ড ছুড়ে ফেলে দিল। অরুণ চোখ রাঙায় ভোর তোয়াক্কা করে না। হন হন করে হাঁটা দেয়। দেবে না এক্সাম সে। অরুণ বাইক থেকে নেমে আইডি কার্ড তুলে নেয়। বড় বড় পা ফেলে ভোরকে কোলে তুলে নিল।
-” সব সময় বাড়াবাড়ি করবে না ভোর! এক্সাম তুমি দিবে তোমার বাপও দিবে!”
ভোর হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে করতে বলে,

-” তাহলে তুমিই দাও এক্সাম! আমায় ছাড়ো! আনি কে বাইকে করে স্কুলে নিয়ে যাও! আমি তো কেউ না!”
অরুণ ছেলেকে কোলে নিয়ে ফাইল ও হেলমেট নিয়ে আসে।
-” ইশ এতো জেদ! আনি আবদার করল না করতাম কি করে? ওর মন খারাপ হতো না?’
-” হ্যা শুধু ওর ই মন খারাপ হয়! বাইকে সবার আগে আমি চড়তে চেয়েছিলাম। ওকে চড়ালে। আমার মন খারাপ হয় না তো! সব তোমার মামনির! আমি কেউ না!”
অরুণ ছেলেকে বাইকে সামনে বসিয়ে নিজেও বসে। ছেলের গালে চুমু দিয়ে হেলমেট বাঁধে। টি শার্টে ঝুলে থাকা সানগ্লাস ছেলেকে পড়িয়ে দেয়।

-” তুমি তো আমার কলিজা সোনা! এই বাইক তো তোমারই। যখন খুশি চড়বে। আব্বু মন খারাপ করে না তো!”
ভোর কিছু বলে না মুখ ফুলিয়ে রাখে। অরুণ ছেলের পিঠ বুকের সাথে মিলিয়ে বাইক স্টার্ট দেয়।
-” আব্বু শক্ত করে ধরবে। ভয় লাগলে বলবে আমায়!”
ভোর মাথা নাড়ে। অরুণ খানিকটা হেসে বলে,
-” আমার কলিজাটা! আব্বু লাভস ইউ ভেরি মাচ!”

পুরো রুম জুরে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। ফুল পাওয়ারে তিনটা ফ্যান ঘুরছে সিলিং এ। দরজা জানালা খুলে রাখা। বাচ্চারা ব্রেঞ্চে বসে এক্সাম পেপারে আনসার লিখতে ব্যস্ত। প্রতি ব্রেঞ্চের এ মাথায় ও মাথায় দুজন করে বসেছে। কেউ লিখছে তো কেউ পেন্সিল কামড়ে মনে করার চেষ্টায় তো কেউ ইরেজার দিয়ে পেপারে ঘষামাজা করতে ব্যস্ত। পাতা ও আরেক টিচার নাম সৈয়দ। দুজন পরিদর্শক হিসেবে উপস্থিত আছে ক্লাস রুমে। পাতা সৈয়দ রুম জুড়ে হাঁটছে। কোনো বাচ্চার প্রশ্ন বুঝতে প্রবলেম হলে হাসিমুখে বুঝিয়ে দিচ্ছে। এমন সময় একটি বাচ্চার দিকে নজর যায় সৈয়দের। বাচ্চাটি কাঁদছে। চোখের পানি নাকের পানি একাকার। সে পাতাকে ইশারা করে। পাতা বাচ্চাদের সামলাতে এক্সপার্ট কি না! পাতা এগিয়ে যায়। বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলাতেই ঝড়ঝড় করে কেঁদে দেয়। পাতা তার চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু খায়।

-” মৃদুল কাঁদছো কেন? কি হয়েছে বলো মিসকে?”
সব বাচ্চা মৃদুলের দিকে তাকিয়ে। ভোর ও চায়! কাঁদছে কেন মৃদুল? আর মিস পাতা আদরও করলো তাকে?
মৃদুল নামক বাচ্চা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
-” আমার কিছু মনে পড়ছে না মিস! সব পড়েছিলাম! লিখেওছি অনেক বার কিন্তু এখন কিছুই মনে পড়ছে না!”
পাতা ব্রেঞ্চে বসে মৃদুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” তাই কাঁদতে হবে? মিস কে বললেই হতো! আর মনে পড়বে সব! তুমি তো পড়েছো। আসলো তুমি ভয় পাচ্ছ তাই গুলিয়ে যাচ্ছে। পানি খাও মাথা ঠান্ডা করে ধীরে ধীরে লিখ কেমন? না পারলেও সমস্যা নেই! এটা তো ফাস্ট টার্মিনাল মাত্র!”
মৃদুল চোখ মুখ মুছে বলে,

-” আম্মু যদি বকে?”
পাতা হেসে বলে,
-” বকবে না। আর তুমি তো গুড স্টুডেন্ট তুমি সব পারবে! একটু চেষ্টা করলেই! এখন লিখ!”
মৃদুল পানি পান করে পেন্সিল হাতে নিয়ে আঁকিবুঁকি করতে থাকে। পাতা সবাইকে লিখতে বলে,ঠান্ডা মাথায়। ভয় না করতে! সবাই লেখায় মনোযোগ দেয়। ভোর হা করে তাকিয়ে পাতার দিকে। পাতা ইশারায় লিখতে বলে। ভোর পলক ফেলে না তাকিয়েই থাকে। পাতা তার ব্রেঞ্চে গিয়ে মৃদু থাপ্পড় লাগায় ব্রেঞ্চে।
-” হা করে তাকিয়ে আছো কেন? লিখ?”

ভোর পলক ফেলে লেখায় মনোযোগী দেয়। পাতা ঘুরে ফিরে সব বাচ্চার দিকে নজর দেয়। হঠাৎ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখতে পায় কেউ উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে দূর থেকে। সে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। মি. অরুণ সরকারকে দেখে একটু অবাকই হয়। ফরমাল ড্রেস আপেই দেখে এসেছে এতদিন। আজ টি শার্ট জিন্স! চোখে সানগ্লাসও ঝুলছে। ঘেমে নেয়ে একাকার। টি শার্ট সুঠাম দেহের সাথে লেগে আছে। ভিজে কপালের উপরে চুল লেপ্টে আছে। হাতে পানির বোতল। কিন্তু উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে কেন? পাতা কিছু বলে না। গম্ভীর মুখ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
অরুণ নিজেই এগিয়ে আসে। বেশ গরম পড়েছে। সে মাঠেই ছিল। ছেলেটার নিশ্চয়ই গরম লাগছে। বাপ ছেলে একদমই গরম সহ্য করতে পারে না। কলিজাটার তৃষ্ণা পায় যদি! আজ পানির বোতলও তো কাছে নেই। তাই বোতল কিনে এনেছে।এখন কিভাবে দেবে? ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। পাতাকে দেখে সে এগিয়ে আসে। পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,

-” মিস পাতাবাহার ভোরকে বোতলটা দিবেন! নিশ্চয়ই তৃষ্ণা পেয়েছে। ছেলেটা গরম সহ্য করতে পারে না!”
পাতা অরুণের হাতের দিকে চায়। ফর্সা লোমশ হাত। লোমগুলো কালো কুচকুচে আর বেশ বড় । দামি ঘড়িতে বেশ লাগছে। সে পানির বোতল নিল না। হা হু কিছুই না বলে রুমের দিকে চলে যায়। অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে তার যাওয়া দেখলো। বাড়ানো পানির বোতল গুটিয়ে নিল। এই টুকুনই মেয়ের আবার ইগো! অরুণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চায়।
পাতা সৈয়দের সাথে টুকটাক কথা বলছে। মাঝে মাঝে হাসছেও। সৈয়দ পাতার একবছরের জুনিয়র! সানশাইন স্কুলে অধিকাংশ টিচারই ইয়াং। হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যবয়স্ক। সৈয়দ বলে,

-” লোকটা ভোর সরকারের বাবা না?”
পাতা অরুণের দিকে চায়। এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে।
-” হুম! অরুণ সরকার।”
-” কি বলল?”
-” কিছু না! তুমি একটু যাও দেখ কি বলে?”
সৈয়দ চেয়ারে বসে বলে,
-” লেডিস হলে যেতাম! ইউ নো হোয়াট আই লাভ ওমেন!”
বলেই চোখ টিপে। পাতা হেসে উঠলো।
-” হুম। তাই তো আজও সিঙ্গেল তুমি!”
-” ওহ মিস রাজি হয়ে যাও! মিঙ্গেল হয়ে যাই !”
পাতা হাই তুলে বলে,
-” ভাই জুনিয়র চলবে না! সিনিয়র হলে ভেবে দেখতাম!”
-” তাই না? ইয়াং ছেলে পছন্দ না?তোমার কপালে বুইড়া জুটবে দেখে নিও!”

পাতা অরুনের দিকে চায় পুনরায়। এই লোক এখনো দাঁড়িয়ে! সে এগিয়ে যায়। সিরিয়াস কিছু হবে হয়তোবা! আর তাছাড়াও প্রিন্সিপালের পরিচিত।তার নামে না আবার কমপ্লেইন করে বসে। সে অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলে,
-” বোতল?”
অরুণ দেয় না। পাতা কটমট করে চাইলো। উফ্ তার আসাই ভুল হয়েছে। শালা ম্যানারলেস নাক উঁচু!
-” শুনুন মি. ভোরের বাবা? রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আধা ঘন্টা করে হলেও একটু ম্যানারস শিখবেন! আপনাকে দেখে দেখে ভোরও না এমন হয়ে যায়! রাস্তাঘাটে পরিচিত কাউকে দেখলে ভদ্রতার খাতিরেও হাই হ্যালো বললে নাক ছোট হয়ে যায় না! নাক উঁচু কোথাকার!”
পাতা দাঁতে দাঁত চেপে ধীরে হিসহিসিয়ে বলে।অরুণ পকেটে হাত ঢুকিয়ে শান্ত ভাবে চায় তার দিকে।
-” মিস পাতাবাহার? আজ পর্যন্ত কেউ ম্যানারস শেখায় নি আমাকে। আপনি শেখাবেন? আমি খুবই ওয়াচফুল স্টুডেন্ট!”

পাতা অরুণের হাতে থাকা বোতল ছিনিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
-” আমি বাচ্চাদের পড়াই! বাচ্চাদের বাপকে না! আর আমি আপনার বেয়ান লাগি না যে মজা করবেন আমার সাথে!”
অরুণ চোখ ছোট ছোট করে তার প্রস্থাণ দেখে। দেখতে ছোট হলে কি হবে ঝাঁঝ আছে।
এক্সাম শেষ হলে ভোর পেন্সিল ইরেজার সব গুছিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, সাথে রোহান। এক হাতে ফাইল অপর হাতে আধ খাওয়া পানির বোতল। মাঠে সব গার্ডিয়ানস অপেক্ষা করছে। আজ স্কুলে স্টুডেন্ট অপেক্ষা গার্ডিয়ান বেশি। এক্সাম চলছে কিনা। ভোর সবার ভিড়ে বাবাকে খোঁজে। অরুণ এগিয়ে আসে। হাতে তার দুটো চকবার। ছেলের ঠান্ডার ধাত আছে তবুও কিনেছে। যে গরম পড়েছে একটা খেলে কিছুই হবে না।অরুণ ছেলেকে একহাতে কোলে তুলে নিল।

-” কেমন হয়েছে এক্সাম? রোহান তোমার কেমন হলো?”
রোহান হেসে বলে,
-” অনেক ভালো হয়েছে আঙ্কেল। সব আনসার করেছি। তবে ভোর একটা বাদ দিয়েছে!”
ভোর রোহানকে চোখ রাঙায়। আব্বুকে কেন বলতে হবে? অরুণ একটা চকবার রোহানের দিকে বাড়িয়ে বলে,
-” নাও! গরমে চকবার খাও! আর ভোর বাদ দিয়েছো কেন?”
-” একদম বকবে না আব্বু! আমি দিতে চেয়েছিলাম তো! কিন্তু সময় ফুরিয়ে গেলে আমি কি করবো? সব দোষ সময়ের!”
অরুণ চকবার ছিঁড়ে ভোরের মুখে দিল।

পাতা বাহার পর্ব ১৩

-” তোমার লেখা চালু করতে হবে আব্বু! বেশি বেশি লিখতে হবে। অথচ লিখতে তোমার যত বাহানা!”
ভোর হেসে আইসক্রিমে বাইট দেয়। নিজের হাতে নিয়ে বাবার মুখে ধরতে ভুলে না। অরুণ বাইট নিল। ইতিমধ্যে রোহানের মা এসে তাকে নিয়ে যায়। অরুণ ছেলের হাত থেকে ফাইল বোতল নিল। ছেলের গালে চুমু দিয়ে বাইকের কাছে যায়।

পাতা বাহার পর্ব ১৫