পাতা বাহার পর্ব ২৫(২)
বেলা শেখ
ঝুমঝুম বারি ধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে মেদিনী। রাস্তা, মাঠ, ঘাট সব বৃষ্টির জলে স্নানে ব্যস্ত। বৃষ্টির ঝম ঝমে শব্দ যেন কানে ঝংকার তুলছে। বৃষ্টির জল ফোঁটার মৃদু বাতাসে যেমন পরিবেশ, তনু জুড়িয়ে শীতলতায় ছেয়ে যায় তেমনি বৃষ্টির ‘ঝম ঝম’ শব্দে শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করে মনটা জুড়িয়ে অন্দরমহলকে শীতলতায় ভরিয়ে তোলে। আর যে ব্যাক্তির বারিধারার শ্রুতিমধুর প্রকৃত সৃষ্ট বাদ্যযন্ত্রের তানে মন না জুড়ায় সে কঠোর! বর্ষনের সময় যে মৃদু মেঘের গর্জন শোনা যায় তারও আলাদা তান আছে। ঘন ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি! বৃষ্টির ঝুম ঝুম তান! ভূপৃষ্ঠের স্থল ও জলভাগে বৃষ্টি পতনের রিমঝিম কলতান!
মেঘের গর্জনে গান! হালকা বাতাসের শম শম সুর! সব মিলিয়ে একজন বর্ষণ প্রেমী মানুষ ঘোরে চলে যায়। রুবি পাতার ঘরে বিছানায় জানালার ধার ঘেঁষে বসে বৃষ্টি বিলাসে ব্যস্ত। পাশে ঘুমে বিভোর ছোট্ট রূপ! হা করে ঘুমুচ্ছে। পাতা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে । তার একপাশে লাবিব ওপর পাশে আদুরি বসে ভাইয়ের দোষ, গুনগান গাইছে। লতা সামনে চেয়ারে বসে মেয়েকে কোলে নিয়ে তার কথা শুনছে। মাঝে মাঝে নিজের বোনের গুন বলতে ভুলছে না। পাতা কখনো শুনছে, কখনো না। ভোর টেবিলে বসে পাতার আঁকানো ড্রয়িং দেখছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আনিকা তার সঙ্গী। একটা করে দেখছে আর প্রশংসার ফুলঝুরি। ড্রয়িং রুমে বড়রা বিয়ের দিন ক্ষণ অনুষ্ঠানের বিষয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। আর বাকিরা পাতার সাথে আড্ডায়। পাতা বিছানায় বসে তার সামনে দন্ডায়মান ড্রেসিন টেবিলের আয়নায় আড়চোখে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছে মাঝে মাঝে। মনে মনে ভাবে ,নাহ! মন্দ লাগছে না! বাহ পাতা তুই এতো সুন্দর আগে তো দেখিনি! আজ রূপ যেন ফুটে উঠেছে। গ্লো করছিস? হুম হুম ব্যাপারটা কি? বিয়ের রঙ লেগেছে নাকি? নিজের চেহারার উজ্জলতা দেখে নিজেই যেন ক্রাশ খাচ্ছে পাতা তাহলে জামাই তো ক্রাশ বাঁশ সবই খাওয়ার কথা! কিন্তু নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটার নজর তার উপর নিবদ্ধ হলে তো! আনরোমান্টিক গোমরামুখো! পাতা নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পায়। আশ্চর্য টিনেজারদের মতো বিহেভ করছে কেন হৃদয়ের অন্তঃস্থল! তার লজ্জাঘেরা ভাবনার মাঝেই দরজা নক করে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ভিতরে প্রবেশ করে রাতুল ভুঁইয়া। রুবি ঠিক হয়ে বসে। রাতুল হাসিমুখে বলে,
-” বাহ বাহ আমাদের রেখেই আড্ডা জমে ক্ষীর! এটা কিন্তু ঠিক না! কোথায় ভেবেছি নতুন সুন্দরী বেয়ানদের সাথে বৃষ্টি মুখর রোমান্টিক পরিবেশে আড্ডা দেব!”
আদুরি হেসে কপালে পরে থাকা চুল কানের পিঠে গুজে ভাব নিয়ে বলে,
-” মানা করেছে কে দুলাভাই বেয়াই! আমরা তো আপনারই অপেক্ষায় প্রহর গুনছি!”
বলেই হেসে ওঠে। রাতুল নাটকীয় ভঙ্গিতে বুকে হাত রেখে মুচকি হেসে বলে,
-” ওহে রমনী! এভাবে হাসতে নেই! তোমার ওই মিষ্টি মধুর হাসিতে চাঁদও লজ্জায় মুখ লুকাবে! বাইরে বহমান বৃষ্টির পানিও হিংসেই জ্বলে উঠলো বলে!”
আদুরি খানিকটা লজ্জায় পড়ে। রুবি বাহবা দেয়,
-” বাহ বেয়াই সাব! আপনার ফ্লার্টিং স্কিল দুর্দান্ত! এক চুটকিতে মেয়ে পটাতে পারবেন! সাহসও আছে নইলে বেয়ানের সামনে অন্য মেয়ের প্রশংসা! সবাই পারে না!”
রাতুল হাসিমুখে লতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” তুমিও আছো? খেয়াল করি নি! মজা করছিলাম তো!”
আদুরি চেহারায় কৃত্রিম অবাকতা ফুটিয়ে বলে,
-” এতো সুন্দর বউকে খেয়াল করেন নি!”
-” এতো সুন্দরীদের ভিড়ে চোখ ধাঁধিয়ে গেছে।”
রাতুলের কথায় হাসির রোল পড়ে। লতা আড়চোখে রাতুলকে চোখ রাঙায়। ব্যস রাতুল হলুদ কার্ড পেয়ে গেল। এখন সাবধান। সে দরজা থেকে ভিতরে প্রবেশ করে। তার পিছন পিছন ঘরে প্রবেশ করে আরিয়ান ও অরুণ সরকার। পাতা তাদের দেখে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে যায়। ইশ! এখন বসবে কোথায়? ছোট্ট একটা ঘর মানুষে ভরে গেছে। লতাও উঠে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে। রাতুল সেখানে আরিয়ানকে বসতে বলে। আরিয়ান বসে যায়। লতা বিছানায় উঠে রুবির কাছে বসে।লাবিবও উঠে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। রাতুল অরুণকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হেসে বলে,
-” ভাই আপনি আপনাকে কোথায় বসতে দিই বলুনতো?”
ভোর ড্রয়িং খাতা বন্ধ করে অরুণকে তারপাশে টেবিলে ইশারা করে বলে,
-” আব্বু তুমি এখানে বসো। আমরা আম্মুর ড্রয়িং দেখবো একসাথে!”
রাতুল অরুণের হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে পাতাকেও পাশে বসায়। পাতা উঠে আসতে নিলে রাতুল চোখ পাকায়! অগত্যা পাতা মাথা নিচু করে বসে ঘোমটাটা আরেকটু টেনে নিল। আশ্চর্য আজ তার এতো লজ্জা লাগছে কেন?
অরুণ গম্ভীর মুখে বসে থাকে। রাতুল এবার বিজয়ী হেসে বলে,
-” দুজনে একেবারে রাজ যোটক! আরে লজ্জা পাচ্ছো কেন তোমরা! ওলরেডি বিয়ে হয়ে গেছে তোমাদের। টেক ইট ইজি গাইস!”
অরুণ শু খুলে এক পা বিছানায় তুলে বসে। ফলে পাতার সাথে ছোঁয়া লাগে। পাতা জড়সড় হয়ে বসে। অরুণ খেয়াল করে আদুরির দিকে তাকিয়ে বলে,
-” একটু ওদিকে যা?”
আদুরি ভাইয়ের দিকে ছোট ছোট করে চায়। তারপর শয়তানি হেসে নিজেও দু পা তুলে আরো বেশি জায়গা জুড়ে বসে অরুণকে পাতার দিকে ঠেলে দিল। অরুণ সকলের মাঝে কিছু বলতেও পারে না। এর মাঝে লুবমান আসে, হাতে চায়ের ট্রে। হাসিমুখে সবার হাতে চা দেয়। লতা সাহায্য করে। বৃষ্টির মুখর শীতল পরিবেশে গরম গরম চা! আহা! মনটা জুড়িয়ে যায় যেন! সবাই ধোয়া উড়ানো চায়ের কাপে চুমুক বসায়। তবে পাতার হাত ফাঁকা। তাকে চা দেয় নি রাতুল। পাতা কিছুটা খুশিই হয়েছে। সকলের মাঝে চা খাবে কেমন করে? তবে রাতুল তার খুশির ঝুড়ি উল্টিয়ে অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” ভাই আপনি আমার সিনিয়র হলেও সম্পর্কে কিন্তু আমি আপনার বড় বুঝলেন! তো আপনাকে কিছু সিক্রেট বলি! আমাদের পাতা খুবই নরম শোভা! জামাই পাগল হবে মিলিয়ে নিবেন। আপনার নামে একটু এদিক সেদিক বললেই যেন রৌদ্র রূপ ধারণ করে! বলাই যায় না!”
-” দুলাভাই?”
পাতার ডাকে রাতুল তার দিকে তাকায়। পাতা করুণ চোখে চায়। এভাবে মান ইজ্জতের ফালুদা না করলে নয়!অরুণ আড়চোখে পাতার দিকে চায়। সত্যিই কথাটা? রাতুল পাতার চুপসানো মুখশ্রী দেখে আর কিছু বলে না।
সবার জন্য চা আনলেও বাচ্চাদের জন্য মাঝারি সাইজের গ্লাসে গরম দুধ দেওয়া হয়। লাবিব দুধ দেখেই নাক ছিটকিয়ে মায়ের কোলে মুখ লুকায়। লতা মাথা তুলে চোখ পাকাতেই গটগট করে দুধ সাবাড় করে। তার কান্ডে সবাই হেসে ওঠে। ভোর আনিকার আবার দুধ খেতে বাহানা নেই। তাদের পছন্দ। আনি তো ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলে।
ভোর ড্রয়িং দেখায় ব্যস্ত তাই টেবিলে রেখে দিল। আনি চুপিচুপি তার গ্লাস তুলে ছোট্ট চুমুক বসায়। ভোর দেখে ফেলে! আনিকার দিকে রেগে তাকাতেই আনি দুধের গ্লাস রেখে কান ধরে স্যরি বলে। কিন্তু ভোর তো ভোরই! দুধের গ্লাস ঠেলে ফেলে দেয় ফ্লোরে। কাচের গ্লাস হওয়ায় ভেঙে চুরমার। দুধ ছিটকে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। দরজা ভিজিয়ে রাখায় বাইরে তেমন শব্দ যেতে পারে নি। রুমের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে। পাতা চমকে উঠে! ছোট্ট রূপ চমকে ঘুম থেকে উঠে কেঁদে উঠল। আনিকাও কেঁদে দেয়। আরিয়ান উঠে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই আনিকা কেঁদে কেঁদে বলে,
-” ওর গ্লাসের দুধ থেকে এইটুকু খেয়েছি! স্যরিও বলেছি!”
অরুণ এসে ঝটকা দিয়ে ভোরকে টেবিল থেকে নামায়। ধমকে বলে,
-” কি করলে এটা বেয়াদব ছেলে? এক চরে গাল লাল করে দেব! ”
ভোর চুপচাপ দাঁড়িয়ে কিছু বলে না। চোখ মুখ শক্ত। অরুণ আবার ধমক দিবে লতা এগিয়ে এসে বলে,
-” ছোট বাচ্চা! বুঝতে পারে নি! আপনি ছাড়ুন তো ভাইয়া! ভোর যাও পাতার কাছে যাও!”
অরুণ ছেলেকে চোখ রাঙায়। ভোরের চোখে অশ্রু ভিড় করে! সে অরুণের হাত ঝটকায় ছাড়িয়ে পাতার কোমড় জড়িয়ে ধরে নাক টানে। আরিয়ান ক্রন্দনরত মেয়েকে নিয়ে বাইরে যায়। লুবমান ট্রেতে কাচের টুকরো গুলো তুলে নিয়ে যায়। লতা ফ্লোরটা মুছে দেয় তৎক্ষণাৎ। লাবিব বিছানায় বসে ভোরকে মনে মনে বকে। দুষ্টু ছেলে! রূপ অল্প কেদেই ঘুমিয়ে যায়। রুবি ছেলেকে পুনরায় শুইয়ে দিল। পাতা ভোরকে বিছানায় বসিয়ে চোক্ষু যুগল থেকে বেরিয়ে আসা অল্প অশ্রু মুছে দেয় হাত দিয়ে। কপালে চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বলে,
-” ভোর কি হয়েছে? ওভাবে ফেলে দিলে কেন?”
ভোর জেদি গলায় বলে,
-” ও সবসময় এমন করে। আমার খাবার চুপিচুপি খেয়ে এঁটো করে দিবে! পঁচা আনি!”
-” ও তো তোমার ছোট্ট বোন! একটু দুষ্টুমি করেছে তাই এরকম করবে? কিভাবে কাদলো? স্যরিও বলেছিল!”
পাতার কথায় ভোর গাল ফুলিয়ে পিট পিট করে চায়।
-” আমিও স্যরি!”
পাতা তার গাল টিপে বলে,
-” আমাকে না! আনিকে গিয়ে বলো!”
ভোর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
-” না বললে হবে না?”
-” তুমি না গুড বয়! গুড বয় রা ভুল করলে স্যরি বলে তো!”
ভোর পাতার গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” আমি এক্ষুনি স্যরি বলে আসি আনিকে!”
বলেই নেমে দৌড়ে চলে যায়। আদুরি হামি তুলে হেসে বলে,
-” ভাই শেখ কিছু! তুই তো পারিস শুধু ধমক আর হাত তুলতে! ওরা ছোট ঝগড়া করবে আবার গলা জড়িয়ে ঘুরবে।”
অরুণ আদুরির দিকে শান্ত চোখে চায়। আদুরি আমতা আমতা করে বলে,
-” আমি আসছি হ্যাঁ! তোমরা থাকো? বৃষ্টি থেমে গেছে বাইরে গিয়ে কয়েকটি ছবি তুলে আসি!”
লুবমান, লতা কাঁচের টুকরো নিয়ে বাইরে চলে যায়। রুবি বিছানা থেকে নেমে পাতাকে বলে,
-” তুমি আমার ছোটই হবে বয়সে! তবে সম্পর্কে বড়! তাই বড় ভাবি বললাম। ছেলেটাকে দেখ? আমি দেখি মেয়েটার কান্না থামলো কি না!”
বলেই চলে যায়! ঘরে রাতুল, পাতা, অরুণ, লাবিব! আর ঘুমন্ত রূপ! রাতুল অরুণ পাতাকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হেসে বলে,
-” বাচ্চারা এমনি! বাদ দাও! এই উছিলায় দুজনে কিছু সময় পেলে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করার! ওল দা বেস্ট গাইস! সুযোগের সদ্ব্যাবহার করো!”
বলে চোখ টিপে। পাতা চোখ রাঙায়! কথার কি ছি!রি! অরুণ নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। রাতুল পাতার চোখ রাঙানোতে হেসে বলে,
-” চোখ পাকিয়ে লাভ নেই! আমি জানি তোমরা দুজনেও এটাই চাইছিলে! এই ব্যেটা চল?”
লাবিব বিছানা গেড়ে বসলো যেন।
-” আমি যাবো না। মায়ের বোনকে যদি এই খালুজানটা ধমকায়!”
রাতুল এগিয়ে এসে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
-” ধমকাবেনা বাপ!”
বেরোনোর পর দরজা লাগাতে ভুলে না। পাতা ঢের অস্বস্তিতে পড়ে। এই দুলাভাইটাও না! সে এখন কি করবে? অরুণ কিছু বলে না। বিছানায় রিল্যাক্সড মুডে বসে দু হাত বিছানায় রেখে দিয়ে পিছনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পাতার দিকে চায় সরাসরি। না রাখঢাক না আড়চোখে। আর না এদিক সেদিক। সম্পূর্ণ নজর পাতার আপাদমস্তক ঘিরে। কানে তার দেয়া সোনার ঝুমকো জোড়া জ্বল জ্বল করছে। নাকে নোস পিনটা যেন মুখের আদলটাই চেঞ্জ করে দিয়েছে। চেহারায় অষ্টাদশী ছাপটা আর নেই। একদম যুবতী পরিস্ফুটিত নারীর মতোই লাগছে। ফর্সা হাতে বালা জোড়া চিকচিক করছে। হাতে বিদ্যমান কাঁচের চুড়ি খুলে ফেলেছে। শুধু তার মায়ের স্মৃতি বিজড়িত বালা জোড়া। জলপাই রঙের বেনারসীতে বেশ মানিয়েছে পাতাবাহারকে।
অরুণকে পলকহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাতা খানিকটা ঘাবড়ে যায়। ঢোক গিলে লম্বা শ্বাস নেয়। লোকটি এভাবে তাকিয়েছে কেন? আচ্ছা লোকটার নজরে কি মুগ্ধতা ভিড় করেছে? কি জানি! সেটা বুঝবে কি করে! পাতার কাছে তো লোকটার দৃষ্টি মহাভারতের শকুনীর মতো লাগছে! সে মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
-” ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
অরুণ নজর হাঁটায় না। এক ভ্রু উচিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
-” দেখছি!”
পাতাও এক ভ্রু উঁচিয়ে অরুনের মতো করে বলে,
-” কি দেখছেন?”
-” তোমাকে?”
বাব্বাহ! তুমি বলছে। আপনি থেকে তুমিতে! শুনতে মন্দ লাগছে না। ভালোই শোনাচ্ছে। আপনি ডাকলে নিজেকে কেমন বুড়ি বুড়ি ফিল আসতো! পাতা অধরকোণে আসতে চাওয়া হাসি লুকিয়ে হালকা ভাব নিয়ে বলে,
-” কেমন লাগছে?”
-” ভালো!”
পাতার মনটা প্রসন্ন হয়। লোকটা প্রশংসা করলো!
-” শুধুই ভালো? সুন্দর লাগছে না?”
-” হুম!”
পাতা ভ্রুযুগল কুঁচকে যায়। লোকটা সত্যিই বলছে নাকি তার মন রক্ষার্থে। পাতা মাথার ঘোমটা ফেলে দেয়। বেনারসীতে বেশ গরম তার! খোপা করা চুল খুলে দিল। কাঁধ সমান ঝর ঝরে সিল্কি চুল ছড়িয়ে পড়ে। পাতা চিরুনি চালিয়ে রাবার হাতে নেয় চুল বাঁধার জন্য। অরুণের দৃষ্টি এখনো পাতার দিকে। মেয়েটা কত অবলিলায় মাথার ঘোমটা ফেলে দিল! যেন তারা দু বছর সংসার করা দম্পতি! অরুণ পাতার চুলের দিকে চায়। মাথা ভর্তি চুল তবে এতো ছোট কেন? মেয়েটাকি জানে না লম্বা চুল মেয়েদের সৌন্দর্য বর্ধিত করে। পাতা চুল ঝুটি করে আঁচল কোমড়ে গুজে অরুণের সামনে বুকে হাত গুজে দাঁড়ায়। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। পাতা অরুণের মতো গম্ভীর সুরে বলে,
-” তখন ভোরকে বকলেন কেন?”
-” দুষ্টুমি করলে বকা খাবেই!”
স্পষ্ট জবাব অরুনের। পাতা অরুনের চোখে চোখ রেখে বলে,
-” বাচ্চারা দুষ্টুমি করবে না তো কি বাচ্চার বাপে করবে?”
-” সব ব্যাপারে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক নয় পাতাবাহার!”
-” বুঝিয়ে বললেই বুঝবে। ভোর খুবই বুঝদার ছেলে। অথচ আপনি অবুঝ! শুধু ধমকাধমকি!”
অরুণ কিছু বলে না তবে তার অধরকোণে ক্ষীণ হাসির রেশ। পাতার নজর এড়ায়নি।
-” বাড়িতে এসে আব্বুকে সালাম দিয়েছিলেন?”
অরুণ খানিক ভেবে ঠোঁট নাড়িয়ে জবাব দেয়,
-” উনিই দিয়েছিল!”
পাতা ক্ষেপে গিয়ে বলে,
-” আর আপনি ঘোড়ার ঘাস কাটছিলেন? ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করেছিলেন? না বলবেন না প্লিজ?”
অরুণ না করে না।
-” উনিই জিজ্ঞেস করেছিল আমি উত্তর দিয়েছি!”
পাতা কি বলবে ভেবে পায় না।এই লোকটা কি দিয়ে তৈরি! সে অরুণের দিকে এগিয়ে এসে খানিকটা ঝুকে কটমট করে বলে,
-” সেদিন কত করে বললাম গুরুজনদের দেখলে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করতে হয়! আপনার কানে আদৌ ঢুকেছিল? এই শুনুন কথা বললে কি ট্যাক্স লাগে নাকি! সবসময় মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন? ভোর তো এসেই সালাম দিয়েছিল মিষ্টি করে। ছেলের থেকেও কিছু শিখতে পারেন!”
-” ধীরে ভদ্রভাবে কথা বলুন! ঝগরুটে মেয়েদের মতো তেড়ে আসছেন কেন?”
শান্ত ভঙ্গিতে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে অরুণ। পাতা রেগে আঙ্গুল তুলে কিছু বলবে কিন্তু গতবারের কথা স্মরণে আসায় আঙ্গুল নামিয়ে নেয়। অরুণ মুচকি হাসে পাতার কান্ডে। পাতা অরুণের হাসি দেখে চোখ পাকিয়ে বলে,
-” আপনি ঝগরুটে বললেন আমায়? আবার হাসছেন?”
অরুণ হাসি লুকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
-” না তো! কিছু বলছিলেন?”
পাতা হতাশ! এই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোককে ম্যানারস শেখানো তার সাধ্যের বাইরে। শালার জামাই! সে অসহায় মুখে অরুণের দিকে চায়। তাদের মধ্যে দূরত্ব একহাতের মতো হবে। পাতা অরুণকে এতো কাছ থেকে প্রথমবার দেখছে। নাক উঁচু লোকটার নাকটা মোটেও উচু না। বরং একটু বোচা বলা যায়। তবে বেশি না, এই সামান্য! অতি কাছে না এলে বোঝা যায় না। গম্ভীর চোখ দুটো ছোট ছোট কিন্তু ভোরের ডাগর ডাগর। ভ্রু যুগল একদম ভোরের মতো। চোখের পাপড়ি গুলো বড় বড়। চোখের মনি কালো কুচকুচে। গোফ দাড়িতে কপোল, চোয়ালদ্বয় ঢাকা! গালের দিকে নজর আসতেই চোখে পড়ে কালচে দাগ! কিছু টা কামড়ের মতো লাগছে। সে অরুণের সেই দাগে তর্জনী আঙ্গুল ছুঁয়ে দেয়। অরুণ চমকে ওঠে। পাতার উষ্ণ আঙ্গুলের ছোঁয়ায় গরমটা যেন বেড়ে গেল। তনুমন উষ্ণতায় ছেয়ে যায়। বুকের বা পাশে অবস্থানরত বক্ষ দেশীয় কশেরুকা বরাবর আড়াইশো থেকে তিনশত নব্বই গ্রামের ত্রিকোনাকার মোচার মতো অঙ্গটি যেন ধ্বক করে উঠলো। নিঃশ্বাসের গতি একটু বাড়লো কি? পাতার এসবে খেয়াল নেই সে দাগে তর্জনী ঠেকিয়ে প্রশ্ন করে,
-” এটা কিসের দাগ? নতুন মনে হচ্ছে!”
কণ্ঠে খানিক সন্দেহের আভাস! অরুণ মনে মনে হাসে। এই না হলো মেয়ে মানুষ! সন্দেহ তাদের রগে রগে! অরুণ সন্দেহে ঘি ঢালতে বলে,
-” কামড়ের দাগ!”
ব্যস! পাতার চোখ জোড়ায় সন্দেহ টইটম্বুর। পাতা আঙ্গুলটা গালে ডাবিয়ে দেয়। অরুণ চোখ জোড়া বুজে নেয়। ব্যথায়? কি জানি!
পাতা শান্ত কঠোর গলায় বলে,
-” কার কামড়ের দাগ?”
অরুণ সময় নেয় জবাব দিতে। এতে যেন পাতার সন্দেহ চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে যায়। অরুণ ভাবনার সুরে বলে,
-” উম.. কার হবে?”
পাতা হাত সরিয়ে নিল।
-” থাক বলতে হবে না!”
অরুণ অভিমানী পাতার দিকে চায়। কয়েকদিনের সম্পর্ক! অথচ মেয়েটা অভিমান করতে শিখেছে? অধিকারের সাথে প্রশ্ন করে জবাব চাইছে? অরুণ পাতার হাত ধরে আটকায়। শক্ত খসখসে হাতের মুঠোয় পাতার নরম হাত বন্দি করে। অপর হাতে পাতার নাকের ডগা টেনে বলে,
-” পার্ফেক্ট বাঙালি বধূ! সন্দেহ নাকের ডগায়। ছেলে কামড় দিয়েছিল!”
পাতা জিভে কামড় দিয়ে গালে ঠেকায়! সে কি না ভেবেছিল! মেয়ে মানুষ আসলেই বেশি বুঝে। পাতা আমতা আমতা করে বলে,
-” কই সন্দেহ করলাম! এমনি জিজ্ঞেস করলাম। আপনিই বেশি বুঝেন!”
অরুণ হাতের চাপ বৃদ্ধি করে।
-” আচ্ছা?”
পাতা হাত মোচরা মুচরি করতে থাকে। তার নরম কোমল হাতটা এই লোকের শক্ত হাতের মুঠোয় ইন্না লিল্লাহি না করে বসে। কেমন খসখসে শক্ত হাত! অরুণ হাতের বাঁধন ঢিলে করে দেয় তবে ছাড়ে না। পাতাকে আরেকটু কাছে আনে। দুজনের মধ্যে অল্প দূরত্ব বিদ্যমান। অরুণ বিছানায় বসে। আর পাতা তার দিকে ঝুঁকে খানিকটা। পাতা হাত মোচড়ানো থামিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে অরুণের চোখে চোখ রাখে। অরুণের উষ্ণ নিঃশ্বাস তার মুখে আছরে পড়ছে। লোকটা এতো কাছে টানল? কি হতে চলেছে? রোমান্টিক মুভির মতো কোনো রোমান্টিক সিন? পাতার বক্ষস্থল কেঁপে উঠলো। চোক্ষু যুগলের আকার বড় হয় ধীরে ধীরে। অরুণ হালকা হাসে, পাতার মনোভাব বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে পাতার মুখশ্রীতে ঠোঁট নাড়িয়ে মৃদু ফু দেয়। পাতা যেন ঘোরের মাঝে চলে যায়। ঢোক গিলে! আবেশে চোখ মুদে নেয়। অরুণের এবার বেশ হাসি পায়। ঠোঁট চেপে হাসি আটকিয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” পাতাবাহার! তোমার কিউট টাম্মিতে অবস্থানরত অশ্লীল কালো তিলটা উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে আমায়! তাকে সাবধান করে দিও। আমি কিন্তু মোটেও সাধু পুরুষ নই!”
পাতা বাহার পর্ব ২৫
পাতার মুদে রাখা চোখ কপালে। তার সকল ভাবনা চুরমার করে ভেঙ্গে এই লোক কি বললো? অরুণের ঢিলে হয়ে যাওয়া হাতের ফাঁক থেকে হাত টেনে কোমড়ে গোজা আঁচল খুলে ভালোভাবে ঢেকে নেয়। অরুণের দিকে না তাকিয়ে সরে যায় তার সামনে থেকে। কি সব দমবন্ধকর কথাবার্তা! কিউট টাম্মি? কারো পেটও কিউট হয়! আরে শালার জামাই! উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে ভালোকথা! দিতেই পারে, তোকে বলতে হবে? তুই ও উঁকি ঝুঁকি দে? হিসেব বরাবর। পর পুরুষ তো নয়। দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র জামাই তার! ক্রাশ ট্রাশ খেয়ে উকি দিতেই পারে! তুই সুযোগের সদ্ব্যাবহার কর।