পাতা বাহার পর্ব ৩
বেলা শেখ
শুনশান নিরবতা বিরাজ করছে আশপাশে। অন্ধকার রজনীতে চাঁদের ম্লান আলোয় আবছা আলোকিত পরিবেশ। শস্য শ্যামলা ধানের ক্ষেতে চাঁদের ম্লান আলো পড়ছে। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাসে দোদুল্যমান ধানের ক্ষেত উপরে বড় গোলাকার জোৎস্না! বিশাল সারি সারি ধান ক্ষেতের চতুর্দিকে বড় বড় গাছের ছায়া। তারকারাজি মিটমিটিয়ে হাসছে। এ যেন এক স্বর্গীয় দৃশ্য! বিনা আলোয় ধানের ক্ষেতের মাঝখানে বসে সচক্ষে অনুভূত করলে তনু মন জুড়ে শীতল স্রোত বইয়ে যায়! গা ছমছম করে সাথে অনেকটা ভালোলাগার অনুভূতি।
পাতাদের বাড়ি নগর থেকে খানিক দূরে। রাস্তার ধারে। ফসলি জমি ভরাট করে বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। শুধু তারাই নয় তাদের বাড়ির আশেপাশের সব বাড়িই ফসলি জমিতে। বাড়ির পিছনেই ফসলি ক্ষেত। পাতাদের একতলা বাড়ি। পাতা বিছানায় শুয়ে আছে। তার বিছানার সাথেই জানালা। সেই জানালায় বাইরের স্বর্গীয় দৃশ্যবলী দেখা যাচ্ছে। চাইলেই সে গিয়ে অনুভবও করতে পারে। কিন্তু সে খুবই ভিতু তাই একা যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভবই বলা যায়। তার রুমের আলোও জ্বলছে। সে আলো জ্বালিয়েই ঘুমোয়! অন্ধকারে তার ফোবিয়া আছে। আর তাছাড়াও তার যাওয়ার মন নেই। সে জানালার দিকে আরেকটু সেটে যায়। এক হাত জানালার গ্রিলে রাখে। মায়ের কথাগুলো কানে বাজছে এখনো। তার জীবনটা এমন কেন? সব থেকেও যে তার কিছুই নেই! বড় দুই ভাই বোনের মতো বাবা মার কাছে আবদার করতে পারে না! তাদের মতো ভালোবাসাও পায় না। আদৌ তাকে ভালোবাসে তো! ভালোবাসলে নিশ্চয়ই জন্মের পর অন্যের কাছে রেখে আসতো না!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এভাবে যেকোনো ডিভোর্সি লোকদের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগতো না। এমন না যে সে তাদের উপর বোঝা হয়ে আছে। মাস শেষ বিশ হাজার টাকার ষোলো হাজার মায়ের হাতে দেয়। নিজের হাতখরচা বাবদ চারহাজার রাখে। এবাড়িতে সে এক আগাছার মতো । যাকে তার বাবা মা চায় নি। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে এসে গেছিল। কেটে দূরেও ঠেলে দিয়েছিল! কিন্ত বোঝাসরুপ আবার ঠায় হয়। পাতার একটা সংসারের শখ। সে নিজের একটা সংসার চায়। যেখানে সব তার হবে। কেউ দূরছাই করতে পারবে না। একজন আদর্শ জীবনসঙ্গী!
যে তাকে আগলে রাখবে! তার জন্য একটু পাগলামি করবে! রোমান্টিক হবে! তাকে চোখে হারাবে! আর. আর. আরো অনেক কিছু! শশুর, শাশুড়ি, ননদ ,দেবর! সবাই তাকে স্নেহ সম্মান দুটো করবে। তার সে স্বপ্ন বোধহয় স্বপ্নই থেকে যাবে। তার কপালে বোধহয় কোনো ডিভোর্সিই নাচছে। তার ভালো সম্বন্ধ আসে নি এমন না! এসেছে বেশ কিছু। তবে তাদের চাহিদাও অনেক। আজকাল তো যৌতুক নেই! সেটা উঠে গেছে। এখন তো শুধু পাত্রের মুরুব্বি গোছের লোকেরা পাত্রীর ভালোর জন্য ,ভালো থাকার জন্য উপহার চায়! এই যেমন- ‘ছেলের ঘর সাজানোর জন্য সোফার সেট! ড্রেসিন টেবিল! আলমারি! সহ আরো বিভিন্ন সামগ্রী! এগুলো তো আপনাদের মেয়েরই থাকবে! শুধু ছেলের জন্য মটরসাইকেল!’
‘ছেলের চাকরি নিতে অনেক টাকা দিতে হয়েছে আপনারা কিছু হেল্প করুন। এই যেমন দশ বিশ লাখ! কামাই করে তো আপনার মেয়েকেই খাওয়াবে!:
‘ ছেলের চাকরি কনফার্ম। শুধু কিছু টাকা দিলেই জয়েন করবে! আমরা জোগাড় করেছি শুধু কিছু টাকা শর্ট আছে। আপনারা বারো লাখ দিন। সব সেটেল্ড।’
পাতার হাসি পায়। কি অভিনব পদ্ধতি যৌতুক নেয়ার!
রাতের খাবার খেতে বসেছে সরকার পরিবার। সকলেই উপস্থিত আছে ভোর ছাড়া। অরুণের ছোট বোন আদুরি বসেছে অরুণের পাশে। সে প্লেটের রুটি ছিঁড়ে মুখে দিয়ে অরুণকে বলল,
-” বড় ভাইয়া আমার কিছু টাকা লাগবে। আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে ট্যুরে যাবে। কক্সবাজারে! আমিও যাবো! তোমরা কিন্তু না করতে পারবে না। না করলেও শুনবো না। চাঁদা এখনো ঠিক হয় নি। তবে বড় ভাইয়া চাঁদার টাকা তুমি দেবে। আর এডভোকেট সাহেব আপনি শপিং আর হাত খরচ দিবেন। আগেই বলে রাগলাম কিন্তু?”
আসমা বেগমের পছন্দ হলো না।তিনি মেয়েকে বললেন,
-” আদু কক্সবাজার অনেক দূরে। আর ভার্সিটি থেকে অনেক ছেলেপেলে যাবে! আজকালকার ছেলেদের ভরসা নেই। আর তোর বান্ধবীরাও কেমন যেন! ওদেরও ভরসা নেই। কোথাও যাওয়া হবে না তোর!”
আদুরির খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। চোখ ভরে আসে। নাক টেনে বলে,
-” মা আমি এখন ছোট নই । নিজের খেয়াল রাখতে জানি। আর আমাদের স্যারেরাও যাচ্ছে। আর ভাইয়ারাও তো গিয়েছিল তাদের সময়। আমিও যাব! আরিয়ান ভাইয়া বোঝাও না মাকে?”
আরিয়ান মাকে বোঝায়,
-” মা যাক না! এখনই তো ওদের এনজয় করার সময়! ঘুরতে গেলে এক্সপেরিয়েন্স হয়! আর স্যারেরা যাচ্ছে তো। আমি ওর স্যারদের সাথে কথা বলে নেব! কোনো প্রবলেম হবে না!”
অরুণ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে নরম স্বরে বলে,
-” ছোট মা যেতে দাও! ছোটু খুবই স্ট্রং। নিজের প্রটেক্ট নিজেই করতে জানে। আর স্যারেরা সেফটি নিয়েই যাবে। ছেলে মেয়েদের বাস আলাদা আলাদা ভাবে যাবে।তাই না?”
আদুরি মাথা নাড়িয়ে জানায় আলাদাই যাবে।
আসমা বেগম খানিকটা নরম হয়ে বলে,
-” আচ্ছা তোমরা যখন বলছো তবে যাবে! তবে কোনো সমস্যা হলে দেখিস কি করি আদু?”
আদু হেসে ভাইদের ইশারা করে ধন্যবাদ জানায়। মাকে বলে,
-” ইনশাআল্লাহ কিছু হবে না মায় সুইট মম!”
আসমা বেগম মুচকি হাসে। অরুণের দিকে চেয়ে বলে,
-” ভোরকে ডাকো খেয়ে নিক। তখন ওভাবে মেরে একদম ঠিক কর নি!”
অরুণ এখনো প্লেটে খাবারে হাত দেয় নি। মিনু সবার প্লেটেই দুটো করে রুটি, অমলেট আর মাংসের ঝুড়া ভাজি দিয়েছে। সবার আলাদা বাটিতে ডালও দিয়েছে । রুবি মেয়েকে কোলে বসিয়ে রুটি ছোট ছোট করে ছিঁড়ে খাইয়ে দিচ্ছে। রূপম ঘুমিয়ে। সে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ভাইয়া আপনি কাজটা ভালো করেন নি! ভোর আনিকা দুজনেই ছোট। খেলতে খেলতে পড়ে গেছে হয়তো! ওদের ছোটদের মধ্যে বাজবে! ওরাই আবার গলা জড়িয়ে ঘুরবে! তাই বলে ছেলেটাকে মারবেন? আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি!”
অরুণ গম্ভীর। রুবির কোলে আনিকার দিকে চায়।
-” ওটা প্রাপ্য ছিল ওর। আনি মামনির অনেকটা লেগেছে। আর শাসন না করলে পরবর্তীতে আরো বেশি দুষ্টুমি করবে। পরে নাগাল না পাওয়া যায়!”
আরিয়ান পানি পান করে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
-” বুঝতে পারছি। তুই আমাদের উপরের রাগটা বাচ্চাটার উপর ঝাড়লি! আমি আর মা ওভাবে বলি নি তোকে!”
অরুণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” কি বলছিস এসব! মোটেও না। আসলে ও স্কুলেও একটা ছেলেকে ধাক্কা দিয়েছিল। ছেলেটার কপাল কেটে গেছে অল্প! আবার বাড়িতেও! তাই রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল! মিনু আপা যাও ভোরকে ডেকে আনো?”
মিনু পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। অরুণের কথায় চলে যায়। আদুরি কাঠের টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে বলে,
-” বড় ভাইয়া? এভাবে আর কতদিন চলবে? তোমার পুরো লাইফ পড়ে আছে এখনো। ভোরটাও ছোট্ট। তোমার বিয়েটা করে নেওয়া উচিত! তিন বছর কম সময় না!”
অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে আদুরির দিকে চায়। বাকি সবাই অরুণের দিকে। অরুণ কিছু বলে না। কি বলবে! রুবি মেয়েকে পানি পান করিয়ে গ্লাস টেবিলে রেখে বলে,
-” ভাইয়া আদুরি ঠিক বলেছে। তিন বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ আপনি তিন বছর আগেই আটকে আছেন! আপনি কি বর্ষা ভাবির জন্য এখনো ওয়েট করে আছেন? তাকে আবার ফিরিয়ে আনার…”
তাকে থামিয়ে দিয়ে অরুণ চোয়াল শক্ত করে বলে,
-” ডোন্ট কল হার ভাবি। সি ইজ নাথিং টু মি।একবার থুতু ফেললে সে থুতু তুলে পুনরায় কেউ মুখে আনে না।”
আরিয়ান মুচকি হাসে। তার ভাইকে সে চেনে।আগা গোড়া জেদ আর গোস্বায় ভরা। প্রাক্তন প্রেমিকা ,স্ত্রী যেটাই বলুক হাজার পায়ে পড়ে মাফ চাইলেও ফিরে চাইবে না।সে সিরিয়াস হয়ে বলে,
-” তাহলে মুভ অন কর? তোর প্রাক্তন তো নেক্সট ইয়ারেই নতুন বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছিল। শুনেছি বিয়েও করেছে! বাচ্চাও আছে মে বি! অথচ তুই? দেখ এভাবে একা থাকা যায় না। এখন কোনো মতে চালিয়ে নিলেও কয়েকবছর পর বুঝতে পারবি জীবনে লাইফ পার্টনার কতটা ইম্পর্টেন্ট। জীবনে একা চলা কষ্টকর। ছেলে নিজের লাইভ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে! আর তুই একলা! একাকিত্বের গভীরে ডুবে যাবি! ভাই যে একা থাকে সেই বোঝে একাকিত্বের যন্ত্রণা! আমি তুমি সেটা ভাবতেও পারি না। মানব জীবনে সবাই স্বার্থপর! এই যে আমরাও তো! ছেলে মেয়ে বড় হবে! ভালো পড়ালেখার ফেসিলিটির জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে হবে!চলেও যাবো। তুই একা হয়ে যাবি না?”
অরুণ রুটি নাড়াচাড়া করছে। একাকিত্ব কতটা ভয়াবহ কিছুটা হলেও অনুভব করেছে এমনকি করছেও।
আসমা চুপ করে ছিলেন এতক্ষণ। এবার তিনিও মুখ খুললেন,
-” আচ্ছা তুমি একাই কাটিয়ে দিলে পুরোটা জীবন! কিন্তু ভোর? দুই আড়াই বছর বয়সেই মা ছেড়ে চলে গেছে। মায়ের ভালোবাসা মমতা কতটুকু পেয়েছে? আর পাঁচটা ছেলের মতো ও তো মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার রাখে! নিজের জন্য না হলেও ওর জন্য একটা মা তো আনতেও পারো?”
অরুণ আসমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” পারি! কিন্তু সেটা সৎ মা হবে। আর সেই মা ওকে মায়ের মতই ভালোবাসবে তার তো গ্যারান্টি নেই তাই না ছোটমা?”
আসমা বেগমের মুখটা মলিন হয়ে যায়। অরুণ খানিকটা হাসে। আদুরি বলে,
-” ভাই আমরা দেখে শুনে খোঁজ খবর নিয়ে তবেই না আনবো নতুন ভাবি?”
-” আব্বা? তোমার আব্বায় ডাকে খাইয়ে লও?”
ভোর পরনের গেঞ্জিটা টেনে চোখ মুছে নাক মুছল। মিনু এগিয়ে এসে আঁচল দিয়ে মুছে দেয়। তখন ওভাবে ভোরকে নিয়ে সরাসরি রুমে আসে। যে যাই বলুক না কেন ছেলেটাকে সে ছেলের মতো ভালোবাসে। ছোট্ট ভোর কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলছিল
-” আমি কিছু করিনি খালা!”
মিনু তাকে শান্ত করায় বুকে জড়িয়ে।ভোর শান্ত হয় তবে একটু পরপর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
-” আমি খাব না খালা! তুমি যাও!”
মিনু হেসে তার গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” ভোর আব্বা তোমার বাবা তাইলে আরো রাইগে যাইবে! চল?”
ভোর মুখ ফুলিয়ে বিছানা থেকে নামল। মিনুর পিছু পিছু চলল।
অরুণ আদুরির কথায় ভ্রু কুঁচকে চায়
-” আমি এখনি ওসব ভাবতে চাচ্ছি না!”
আরিয়ান মুখে রুটি পুরে বলে,
-” তোকে ভাবতে হবে না। তুই শুধু কবুল বলবি ব্যস। ভালো ভাবি খোঁজার দায়িত্ব আমাদের! যে ভোরকেও ভালোবাসবে আর তোকেও!”
বলেই মুচকি হাসে। আদুরিসহ বাকি সবাই হাসে। আসমা বেগমের মুখটা খানিক মলিন। অরুণ চোখ রাঙায় ওদের ওরা থোরাই কেয়ার করে। অরুণ ভোরকে মিনুর পিছন পিছন আসতে দেখে বলে,
-” ভোরের সামনে যেন এসব কথা না ওঠে!”
রুবি বলে,
-” কেন? ওর আগে জানা উচিত ভাইয়া! নইলে বাজে ইফেক্ট পরবে!”
-” সময় হোক!”
বলে ভোরের দিকে চায় অরুণ। চোখ নাক মুখ ফুলে লাল টকটক অরছে যেন টোকা দিলেই রক্ত বেরোবে। টি শার্টে সর্দি লেগে আছে। তার বুকটা ভারি হয়ে যায়। ছেলেটাকে ওভাবে মারা বড্ড অনুচিত হয়েছে।ভোর বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে এই আশায় যে নিত্যদিনের মতো তাকে ডেকে কোলে বসিয়ে আদর করে খাইয়ে দিবে। কিন্তু বাবা কিছু না বলায় ছোট্ট ভোর নাক টেনে চেয়ারে বসে। কাঠের ডাইনিং টেবিল সাথে কাঠের বড় বড় রাজকীয় কেদারা। ভোর সেথায় বসলে শুধু মাথা টুকু দেখা যায়। তাই দাঁড়িয়ে পড়ল সে, দাঁড়িয়েই খাবে। অরুণ ছেলের অভিমান বোঝে।
-” আমার কাছে আসো খাইয়ে দিচ্ছি!”
ভোর মনে মনে বেশ খুশি হয়। নামতে নিবে তখনই আদুরি গিয়ে ভোরকে কোলে নিয়ে গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” রাজকুমারকে আজ আমি খাইয়ে দিব! কেমন হবে?”
আদর পাগল ভোর খুশি হয়ে বলে,
-” খুব ভালো!”
আদুরি অরুণের পাশে বসে ভোরকে কোলে বসিয়ে অল্প রুটি ছিঁড়ে অমলেট দিয়ে খাইয়ে দেয়। ভোর হাসিমুখে খেয়ে নেয়। একটু আগের কথা যেন ভুলেই বসেছে। অরুণ ছেলের খাওয়া দেখে তবেই মুখে রুটি তোলে। এতক্ষণ তার গলা দিয়ে খাবার নামতো না।
আরিয়ানের খাওয়া শেষ। সে চেয়ারে পা তুলে বসে আনিকাকে কোলে নেয়। সে ঘুমিয়ে। রুবি খাওয়া শুরু করে। আরিয়ান বলে,
-” ভোর বাবা তোমার মা চাই?”
ভোর বোঝে না। তার প্রশ্নত্তক চাহনি দেখে আরিয়ান পুনরায় বলে,
-” আম্মু চাই তোমার?”
ভোর বাবার দিকে চায়। অরুণও তার দিকেই চেয়ে।
-” আব্বু তো বলে আব্বুই আব্বু আবার আব্বুই আম্মু!”
অরুণ প্লেটে নজর দেয়।আরিয়ান হেসে বলে,
-” তোমার জন্য তোমার আব্বু একটা ভালো আম্মু নিয়ে আসবে। যে তোমাকে অন্নেক আদর করবে ও ভালোবাসবে!”
ভালোবাসা ও আদরের কথা শুনে ভোরের চোখ যেন উজ্জীবিত হয়ে উঠে।
-” সত্যি?”
আরিয়ান মাথা নাড়ল। ভোর খুশি হয় বেশ। বাবার দিকে কয়েকবার পিটপিট করে চায়।অরুণ তাকায় না। খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। ভোর অল্প খেয়েই আভারির ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। অরুণ খেয়ে নিয়ে ভাইয়ের সাথে টুকটাক কথা বলে আভারির দোরে গিয়ে কড়া নাড়ে।আভারি ভিতর থেকে আওয়াজ দেয়,
-” ভিতরে আসুন স্যার!”
অরুণ ভিতরে ঢুকে। ভোর উপুড় হয়ে বালিশে মুখ লুকিয়ে শুয়ে আছে। অরুণ ডাক দেয় ছেলেকে।
-” ভোর? আব্বু?”
ভোর ওভাবেই শুয়ে থাকে। সারা দেয় না।অরুণ আরো কয়েকবার ডাকে। আভারি বলে,
-” ঘুমিয়েছে বোধহয়!”
অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে হাটা দেয়। ভোর তবুও নড়ে না। রূমের কাছাকাছি গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” আমি জানি তুমি ঘুমাও নি!”
ভোর হালকা নড়ে ওঠে। অরুণের গম্ভীর মুখশ্রীতে হালকা হাসির রেখা ফুটে । তবে সেটা ক্ষিণ। ভিতরে নিয়ে গিয়ে ওয়াশ রুমে গিয়ে ভোরকে ব্রাশ করিয়ে দিয়ে নিজেও ব্রাশ করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। ভোর চোখ বুজেই ছিল । শুধু ই- করে দন্তপাটি বের করেছিল। অরুণ ছেলেকে শুইয়ে দিয়ে পরনের টি শার্ট খুলে লাইট ওফ করে ছেলের পাশে শোয়। ভোর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে। অরুণ ডাক দেয়,
-” আব্বু? ভোর? আমার জান? আমার সোনা? আমার মানিক? আমার কলিজা?”
এতো নরম এত মোলায়েম আদুরে কণ্ঠ কেউ কখনো শুনেছে অরুণের মুখে ?নাহ উপর ওয়ালা আর ভোর ছাড়া ছাড়া কেউ না! ভোর তবুও সারা দেয় না। অরুণ তাকে টেনে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেয় শক্ত করে। ভোর ছোটাছুটি করে না। শান্ত হয়ে বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে থাকে। অরুণ ছেলের মাথা তুলে পুরো মুখ জুড়ে চুমু খায়। ভোরের পরনের টি শার্ট খুলে দিয়ে বাহুতে ঠোঁট বুলিয়ে বলে,
-” আব্বু খুব স্যরি আব্বু! অনেক ব্যাথা পেয়েছো? হুম? তুমি আনি মামুনিকে ফেলে দিয়েছো কেন? ও তো অনেক ব্যথা পেয়েছে। হাত ছিলে গেছে। আব্বু? আব্বু?”
অরুণ বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
-” ফেলে দেই নি আমি তোমার মামুনিকে!”
বলে অরুণের ঘারে মুখ গুজে সব কিছু খুলে বলে। অরুণ সব শুনে ছেলেকে আরেকটু মিশিয়ে নেয়। মাথায় চুমু দিয়ে বলে,
-” এই কথাগুলো তখন বলতে পারো নি? আর তখন ওভাবে আনিকে রেখে চলে আসা ঠিক হয় নি তোমার!”
ভোর বাবার ঘার থেকে মাথা তুলে বাবার পেটের উপর বসে গাল ফুলিয়ে বলে,
-” তোমার মতে আমি তো কিছুই ঠিক করি না ! হুম!”
অরুণ হেসে ভোরের পেটে কাতুকুতু দেয়।
-” আব্বু এটা কিন্তু ঠিক না?”
বলেই খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো। তার হাসি যেন থামছেই না। হাসছে আর ছটফট করছে কাতুকুতুর চোটে। ছেলের হাসিতে অরুণের বুকটা খানিক হালকা হয়। কাতুকুতু দেয়া থামিয়ে ছেলেকে বুকে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ভোর বাবাকে জড়িয়ে থাকে। ওভাবেই শুয়ে থেকে হঠাৎ প্রশ্ন করে,
-” আব্বু তুমি সত্যিই আমার জন্য আম্মু আনবে?”
অরুণের হাত থেমে যায়। ভোর আবার বলে,
-” তাহলে খুব ভালো হবে। সবার মতো আমারও আম্মু হবে! ইয়ে! আমাকে অনেক ভালোবাসবে! খাইয়ে দেবে! ঘুম পাড়িয়ে দেবে! গোসল করিয়ে দেবে! স্কুল ড্রেস পড়িয়ে দেবে আবার পাল্টিয়েও দেবে! চাচিমনি যেভাবে আনি ও রুপকে আদর করে আমাকেও করবে! আমরা একসাথে কার্টুনও দেখবো একসাথে। রাতে তুমি আম্মু আর মাঝখানে আমি ঘুমাবো। আমি আম্মুর বুকে ঘুমাবো তোমার বুকেও ঘুমাবো তবে বেশিক্ষণ কিন্তু নয়! তুমি রাগ করবে আব্বু? রাগ করবে ন কিন্তু!”
পাতা বাহার পর্ব ২
আরো কতশত বায়না তার মায়েকে ঘিরে অথচ তার নির্দয় জন্মধারীনি এই ছোট্ট মাসুম বাচ্চাকে রেখে কিভাবে ডিভোর্স নিয়ে চলে যায় বিদেশ ভুঁইয়া! ক্যারিয়ার শক্ত করতে!
আর ছেলেটা মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার কত আকাঙ্ক্ষায়!কি করবে সে! ভাবতে ভাবতে চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বেয়ে পড়ে।