পাতা বাহার পর্ব ৩৩
বেলা শেখ
তপ্ত মধ্যাহ্নের সময়। ভ্যাপসা গরমে নাজেহাল নগর জীবন। স্বস্তি নেই একটুও। ফ্যানের বাতাসে শরীর জুড়ে না; গরম অনুভব হয়। ভালোলাগে না এই অসহ্যনীয় গরম। খেয়ে, বসে, ঘুমিয়ে, কাজ করে, খেলে কিছুতেই শান্তি নেই। শুধু মনে হয় ফ্রিজের ভিতর ঢুকে বসে থাকি। নয়তো গরমের এই ছয়মাস শীতকালীন কোনো দেশে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে টোপলা টাপলি নিয়ে বেড়িয়ে পরি। শীত পড়লে ফিরবো আপন নীড়ে। কিন্তু হায় সেটা তো সবার পক্ষে সম্ভবপর নয়। বিদেশ ভ্রমন চাট্টিখানি কথা নয়। উচ্চাভিলাসী বিত্তশালীদের পক্ষে সম্ভবপর হলেও মধ্যবিত্তের জন্য সেটা সোনার ডিম পারা হাঁস। অরুণ সরকার অফিসে ব্যস্ত সময় পার করছে।
এসি সংযুক্ত অফিস হওয়ার দরূণ গরমের অবকাশ নেই। আরামেই কাজ করছে। লম্বা ছুটি কাটানোর পর অফিসে সলেই ব্যস্ত। অরুণ ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং রুমে বসে। শহরের বড় বড় স্বর্ণের জুয়েলারির শো রুম গুলোয় তাদের কালেকশন অহরহ। আমাদের বাংলাদেশে দুই ঈদের পর পর বিয়ের সিজন শুরু হয়। এই সময়গুলোতে ব্যস্ততায় ভরপুর থাকে তাদের অফিসের প্রত্যেকটা কর্মচারী। অরুণ মিটিং শেষ করে তড়িঘড়ি করে বের হয়। আরেক নতুন ক্লায়েন্টের সব কালেকশন ডেলিভারী দিয়েছে। সঠিক ভাবে ডেলিভারী দিতে পারলো কি না সেটা জানা অতি আবশ্যকীয়। একেতো নতুন ক্লায়েন্ট সাথে অনেক গুলো কালেকশন অর্ডার করেছে। চিন্তা হওয়া উচিত।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অরুণ ভাবলো ম্যানেজার সুজনকে সাথে পাঠালে ভালো হয়ো। ইনসিওর হতে পারতো। এটা নিয়ে টুকটাক কথা বলতে বলতে বলতে চিন্তিত ও গম্ভীর মুখে ম্যানেজার সুজনের সাথে নিজ কেবিনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। অফিসের এক সেকশনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পায় ডেস্কটপে একটা মানব মানবীও নেই। সবাই একজায়গায় জড়ো হয়ে গভীর আলাপ চারিতায় ব্যস্ত। সুজন গলা উঁচিয়ে ধমকে কিছু বলবে অরুণ হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো। শব্দহীন পায়ে হেঁটে যায় কেন্দ্রবিন্দুতে। চেনা পরিচিত কর্মচারীদের ভিড়ে এক আপন মুখশ্রীর দেখা মেলে। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়লো।
পাতাবাহার অফিসে? সে আরো দেখে লাবিবের কোলে ভোর হাসিমুখে এটা ওটা বলছে। অরুণ পাতার দিকে চায়। মুখে লাজুক হাসি। পিট পিট করে আঁখি যুগল দ্বারা সবাইকে দেখছে। বাকি সবাই টুকটাক জিজ্ঞাসা করছে তাকে আর মহারানী ধীরে ভদ্রভাবে জবাব দিচ্ছে। বাড়তি একটা কথাও বলছে না। এমন কিউট ও শান্ত ভঙ্গিতে সকলের সাথে কথা বলছে, মনে হচ্ছে এর চেয়ে শান্ত শিষ্ঠ মেয়ে দুটো নেই। অথচ পুরাই সাইক্লোন এই মেয়ে। অরুণের অধর প্রসারিত হয়। এদিকে ওদিকে চেয়ে হাসি লুকিয়ে গম্ভীর ভাব বজায় রাখলো। পাতাবাহার লাবিবের সাথে একটু বেশিই কথা বলছে না? হেসে হেসে বারবার তাকাচ্ছেও। সকালের হুমকির কথা মনে নেই নাকি?
-” হোয়াটস গোয়িং ওন?”
আলাপ চারিতার মাঝে হঠাৎ বসের গম্ভীর গলা শুনে সকলে সচকিত হয়ে বসের দিকে ফেরে। স্বয়ং বসকে দন্ডায়মান দেখে নিজের ডেস্কে যেতে সময় নেয় না। বাকি লাবিব ও মিসেস রুনা। মিসেস রুণা নিজ ডেস্কটপেতেই। লাবিবের ডেস্ক তার পাশে কোলে ভোর থাকার দরুন সে দাঁড়িয়ে থাকে। পাতা অরুণকে দেখে খানিকটা ঘাবড়ে যায়। আমতা আমতা করে, কি বলবে বুঝতে পারে না। তাই চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করে। ভোর মিষ্টি হেসে বাবার দিকে চায়। অরুণ গম্ভীর মুখে লাবিবকে বলল,
-” কাজ লাটে উঠিয়ে কি চলছিলো এখানে?”
লাবিব হেসে পাতার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” বসের বস এসেছে তাকে ওয়েল কাম জানালাম বস! উনিই তো আমাদের মেইন বস! তার আগমনে আজ সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে পারেন স্যার, সাথে ছুটি বোনাস!”
-” মি. লাবিব প্রমোশনের কথা ভেবেছিলাম! কিন্তু আপনার কপালে ডিমোশন নাচছে বোধকরি!”
লাবিবের মুখ খানি চুপসে যায়। গেলো তার প্রমোশন। ভোর তার গাল টেনে কোল থেকে নেমে আসে। অরুণের সামনে দাঁড়াতেই অরুণ হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলো। মিসেস রুনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” মিসেস রুণা আপনার দায়িত্বে দিয়ে গেলাম ফাঁকিবাজদের। কথা না শুনলে কান টেনে সুধরে নেবেন!”
বলে পাতার দিকে চায়। পাতাও তার দিকেই চেয়ে আড়চোখে। নজর মেলায় চোখ ফিরিয়ে গালে জিভ ঠেকায়।
-” আসো!”
বলে অরুণ ধীর গতিতে পা চালায় । পাতা আশেপাশে চেয়ে তার পিছনে হাঁটতে থাকে। স্বল্প দূরত্বের ব্যবধানে অরুণের কেবিনে প্রবেশ করে পাতা। পুরো কেবিনে চোখ বুলিয়ে নেয়। সিনেমায় একজন বিজনেসম্যানের কেবিন যেমন থাকে তেমনি শুধু এই কেবিনে অনেক গুলো গাছের টব। তার মধ্যে দুই তিনটা পাতা চেনে। যেগুলো বাড়িতে আছে। এরিকা পাম, ফিলোডেনড্রন, জিজি প্লান্ট, স্নেক প্লান্ট, ফিগ প্ল্যান্ট ইত্যাদি। পাতা শুনেছে তার মরহুম শশুর মশাই প্রকৃতি প্রেমী মানুষ। অফিসটা তারই হাতে গড়া সেটা অফিসের পরিবেশ দেখলেই বোঝা যায়। অরুণ দরজা লাগিয়ে পাতাকে বসতে বলে। ছেলেকে কোলে নিয়ে নিজেও বসে সোফায়। ছেলেকে আদর করে শু,মুজো, টাই খুলে দিয়ে বলল,
-” আব্বু তোমার আম্মু প্রথমবার এলো অফিসে কিভাবে ওয়েলকাম করি বলো তো?”
ভোর মিষ্টি হেসে বাবার গলা জড়িয়ে বলল,
-” তুমি সকালে আম্মুকে বকেছিলে তাই এখন বেশি করে আদর করে দাও। অনেক গুলো আইসক্রিম দাও! আর লাবিব আঙ্কেলদের মিষ্টি খাওয়াও!”
অরুণ পাতার দিকে চায়। পাতা চোখ বড় বড় করে চেয়ে। কি বলে এই ছেলে? সে মাথা নাড়িয়ে না না ইশারা করে অরুণকে। অরুণের অধরকোণে হাসি ফুটে উঠলো। সে ভোরকে সোফায় বসিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে ম্যানেজারকে কল করে উঠে একটু দূরত্বে যায়। ভোর পাতার কোলে মাথা রেখে সোফায় পা তুলে শুয়ে পড়ে বলল,
-” আম্মু তোমার মন খারাপ?”
পাতা ভোরের কপালে চুমু দিয়ে মাথা নেড়ে না বোঝায়। ছেলেটা বুঝলো কিভাবে তার মন খারাপ? তার মন খারাপ স্কুলে যাওয়ার পরপরই। অরুণ সরকার যাওয়ার পর সে খুশি মনে টিচার্স রুমে যায়। সকলে তার সাথে হাসিখুশি কুশলাদি বিনিময় করে। কিন্তু তারপর খোঁচা মেরে কিছু ফিমেল কলিগ অনেক কথা বলে। তার নতুন ভ্যানিটি,শু’জ, ঘড়ি দেখে টিটকারী করে। কটুক্তি করে বলে,
-” এটা তো নতুন! হাসবেন্ড দিলো বুঝি? সব ব্র্যান্ডের কিন্তু! আগে তো পুরনো কম দামি জিনিস বছর ভরা ব্যবহার করতে। অথচ এখন শুধু ব্র্যান্ডের জিনিসপত্র এ বেলা ও বেলা ইউস করবে! হাসবেন্ডের এতো এতো টাকা, খরচ করবে না?”
বলেই মিষ্টি করে হাসলো। আরেকজন বলল,
-” বাহ্। এই কয়েকদিনে বেশ সুন্দর হয়েছো। আবহাওয়া চেঞ্জ হয়েছে বলে কথা! তবে চোখের নিচ দিয়ে ডার্ক সার্কেল দেখা যাচ্ছে! এই রাতে ঘুম হয় না?”
আরেকজন ম্যাডাম হেসে ধীমে সুরে বলল,
-” আরে নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে ঘুম হবে কিভাবে? এমন একটা সুন্দরী কম বয়সী মেয়ে পেয়েছে রাতভর মজে থাকে হয়তো! তাই না পাতা? শুনেছি বয়স্ক লোকেরা কমবয়সী বউকে একটু বেশিই ভালোবাসে। মাথায় তুলে রাখে!”
-” তোমার তো লটারি লেগেছে। বরের সাথে বাচ্চা ফ্রি! আমাদের কথা মনে নিও না কিন্তু ফান করে বলছি!”
মজার ছলে আরো অনেক কথাই বলেছে তার কলিগরা। পাতা মুক হয়ে তাদের কথা শুনে গেছে। ওনারা এমনভাবে কথাগুলো বলল পাতা জবাব দেয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলো না। আড়ালে আবডালেও অনেক কথা হয়েছে তাকে নিয়ে পাতা বুঝতে পারে। লজ্জা অপমানে পাতার চোখ ভরে উঠেছিল। সে ক্লাসের বাহানায় নিস্তার পায় কথার বাণ থেকে। তবে কথাগুলো তার মন মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরপাক খায় সারাক্ষণ। মনটা বিক্ষিপ্ত বিষন্ন হয়ে ওঠে। মানুষ এভাবে কারো মনে আঘাত হেনে কথা বলতে পারে!! তারা কি জানে না, মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কথা বলতে নেই! সমালোচনা,পরগ্লানি করা যা ব্যাক্তির মনকে আঘাত হানে সেইসব নিয়ে মজা উড়ানো আর আপন ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতুল্য। এখনও পাতার চোক্ষুদ্বয় আবেগে টইটুম্বুর হতে চায় পাতা পলক ঝাপটে নিজেকে সামলে নেয়। মুচকি হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। অরুণ ফোন আলাপ শেষ করে পাতার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-” কি হয়েছে দুজনের মন খারাপ কেন শুনি?”
পাতা সচকিত দৃষ্টিতে চায় লোকটার দিকে! কি করে বুঝলো তার মনটা খারাপ?
অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে পাতার দিকে চেয়ে কন্ঠে আদর ঢেলে বলল,
-” কি হয়েছে পাতাবাহার?”
আদর মিশ্রিত মনমোহন গম্ভীর কণ্ঠে কি ছিল? পাতার মন খারাপের রেশ কর্পূরের মতো উবে যায়। মন প্রসূণে অসংখ্য রঙ বেরঙের প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে থাকে। সকালের মিষ্টি মন ভোলানো মূহূর্তেটুকু মানসপটে ভেসে ওঠে যেন। কপোল জোড় রক্তিমতায় আচ্ছাদিত হয়। নেত্রজোড় পলক ফেলে ঘন ঘন। ভোর তার আম্মুর দিকে একবার তাকিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে বলল,
-” আম্মুর মন খারাপ তাই ভোরেরও মুড ওফ!”
পাতা মুচকি হেসে তার গাল টেনে দেয়।
-” তেমন কিছু না। বাচ্চাদের এক্সামের খাতাগুলো কালকেই সাবমিট করতে হবে। কতগুলো খাতা একবেলায় দেখবো কিভাবে!! তাই!’
অরুণ ঝুঁকে আসে। পাতার দুই পাশে সোফার পিছনে হাত রেখে বন্দি করে নিলো। পাতা খানিকটা ঘাবড়ে গেল। চোখের আকার বড় বড় করে সোফার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে অরুণের দিকে তাকায়। ভোরও বড় বড় করে চেয়ে থাকে, ওষ্ঠোদ্বয় হা করে। অরুণ ছেলের দিকে চায় মুচকি হেসে পাতার ললাটে অধর ছুঁয়ে পরপর দুটো ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে নাকে আলতো কামড় বসিয়ে সরে পাতার পাশ ঘেঁষে বসে পড়লো। ভোর খুশি হয়। আব্বু আম্মুকে আদর করলো। তাহলে তো আম্মু আর মন খারাপ করে থাকবে না।সে পোকার মতো পাতার কোল ডিঙিয়ে অরুণের কোলে মাথা রাখলো। পাতার কোলে তার পিঠ ঠেকিয়ে, পা জোড়া সোফায়। অরুণ ঝুঁকে ছেলের মাথা হালকা উঁচিয়ে গালে মুখে ঠোঁটে আদরের বন্যা বইয়ে দিলো।
পাতা নির্বাক বসে। মিষ্টি ভালোবাসার পরশে পাতার তনুমন জুড়ে শীতল স্রোত বয়ে বেড়ায়। লোকটা এমন কেন? এই ছোট ছোট আদর, যত্ন করে কি বোঝায়? পাতাকে দূর্বল করার স্বৈরতন্ত্র। পাতা বোঝে ষোলো আনা। তবুও দূর্বল হয়ে ওঠে প্রতিক্ষণ। এইরকম আদর যত্ন ছোট ছোট ভালোবাসার বিন্দু কণা পাতাকে লোকটার দিকে আরো আকর্ষিত করে তোরে। দূর্বল করে তোলে। সেই দূর্বলতা আকর্ষণ খুবই ভয়ংকর যা পাতা কিছুটা হলেও ঠাহর করতে পারলো। আবেগী পাতার আঁখি যুগলে আবেগে ভরে ওঠে। আশ্চর্য পাতা আবেগী ছিলো, কিন্তু এতটা? লোকটার সাথে জুড়ে যাওয়ার পর থেকে আবেগটাকি চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে চলেছে নাকি? পঁচিশ বছরের জীবনে কত লোকের টিটকারী, কটুক্তি, তাচ্ছিল্যের এমনকি প্রহারেরও স্বীকার হয়েছে মন খারাপ হলেও অন্তঃস্থলে তালা মেরে গচ্ছিত রাখতো!অথচ এখন একটু যত্নেই সব দুঃখ কষ্ট বেরিয়ে আসতে চায়। এতটা আবেগ কখনো আঁখি প্রকাশ করেছে কি? প্রত্যেকবারের মতো কথা এবারো আবেগ লুকিয়ে নেয় পাতা।
-” আব্বু কলিজা ভোর লাভস ইয়ু সো মাচ!”
-” মি ঠু কলিজা!”
ভোর মিষ্টি করে হাসলো। অরুণ ছেলের চুলে হাত গলিয়ে দেয়। একটু আগেই শত ব্যস্ততা , চিন্তার ভিড়ে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল। কিন্তু এখন মন মস্তিষ্ক সব যেন ভুলে বসেছে। সে পাতার পিঠে হাত গলিয়ে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে বলল,
-” পাতাবাহার হয়ে যাবে সব কাজ! টেনশন নিও না। আই উইল হেল্প ইয়ু!”
পাতা অধর জুড়ে খেলা করে মিষ্টি হাসি। বাচ্চারা বিনা বাক্যব্যয়ে আইসক্রিম পেলে যেমনটি করে হাসে তেমন।
-” সত্যিই হেল্প করবেন?”
-” না মিছেমিছি হেল্প করবো চলবে না?”
-” একদম না আব্বু।”
ভোরের কথায় দুজন তার দিকে চায়। পাতা হেসে দিল। অরুণ চোখ ছোট ছোট করে গম্ভীর মুখে বলল,
-” পরশু রেজাল্ট তোমার! পাশ করতে পারবে তো?”
ভোরের মুখ খানি কালো হয়ে যায়।
-” পাশ করবো কি না সেটা পরের বিষয় এক্সাম দিয়েছি এটাই মুখ্য বিষয়।”
একদম বড়দের মতো করে বলল ভোর। পাতা হাসে এটা সে ক্লাসে বলেছিল এক্সাম শুরু হওয়ার আগে। বাচ্চাটা মুখস্থ করে রেখেছে। অরুণ সিরিয়াস গলায় বলল,
-” পাশ না করলে বিয়ে করিয়ে দিবো!”
ভোর লজ্জা পায় বেশ। কুটুর কুটুর করে চায় বাবার দিকে। কোল থেকে উঠে পা ভাঁজ করে সোফায় বসে চিল্লিয়ে বলল,
-” ছোট না আমি? ছোটরা কখনো বিয়ে করে? করবো না আমি বিয়ে! কখনো না!! তোমার আব্বুকে বিয়ে করিও যাও!”
তার কথা শুনে অরুণ মুচকি হেসে বলল,
-” আমার আব্বুকেই তো বিয়ে করাবো! তুমিই তো আমার আব্বু!”
ভোর যেন কেঁদে দেবে।
-” তোমার বুড়ো আব্বুকে বিয়ে করাও গিয়ে!”
-” সে তো নেই! তাই তোমাকেই বিয়ে করিয়ে বাড়িতে একটা ছোট্ট লাল টুকটুকে বউমা আনবো।”
ভোর এবার কেঁদেই দিলো। পাতা বাবা ছেলের কথাবার্তায় হেসে কুল কিনারা পায় না। ভোরকে কাঁদতে দেখে অরুণকে বলল,
-” কি শুরু করলেন? বাচ্চাটা কাঁদছে! আর কে বলেছে ভোর পাশ করতে পারবে না? ভোর অনেক ব্রেইনি! ও টেন্থ পজিশনের মধ্যে থাকবে দেখে নিবেন!”
এরমধ্যে কেউ দরজা নক করে। অরুণ উঠে আসে। দরজার দিকে যেতে যেতে বলল,
-” বউমা আনার ব্যাপারে কিন্তু আমি সিরিয়াস পাতাবাহার!”
ভোরের কান্না আরো বেড়ে যায়। এই কান্নায় শুধু আওয়াজ শোনা যাচ্ছে কিন্তু ভোরের চোখে পানির দেখা নেই। ভোর দু হাতে চোখ ডলে তবুও বেড়োয় না এক ফোঁটা নোনাজল। পাতা টেনে তাকে কোলে বসিয়ে এটা ওটা বলে শান্ত করে। ভোর শান্ত হয়। আব্বু আরেকবার বিয়ে করানোর কথা বললে সে কথা বলবে না। এতটুকু ছেলে কখনও বিয়ে করে? তার বুঝি লজ্জা করে না এসব শুনলে!
অরুণ বিরিয়ানীর প্যাকেট ও প্লেট রাখে টি টেবিলে। অফিসের সকল স্টাফদের মিষ্টিমুখ করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর নিজেদের লাঞ্চের জন্য বিরিয়ানী ও ডেজার্ট অর্ডার করতে বলেছিল ম্যানেজারকে। ছেলেটা চিকেন বিরিয়ানী পছন্দ করে। অরুণ পাতাকে সব আনপ্যাক করতে বলে ছেলেকে কোলে নিয়ে কেবিন সংলগ্ন রুমে ঢুকে ওয়াশ রুমে চলে গেল। ছেলেকে ফ্রেশ করিয়ে এসে সোফায় বসিয়ে দিলো। পাতা ততক্ষণে প্লেটে বিরিয়ানী সাজিয়ে পরিবেশন করেছে। জাপানিজ কটন চিজ কেকটাও একটা প্লেটে রেখেছে। অরুণ তাকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলে। পাতা ইতস্তত বোধ করে। সে কিছুই চেনে না এখানে। ছোট ভোর কি বুঝলো কে জানে পাতার হাত ধরে নিয়ে যায় ভিতরে। অরুণ সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ছেলেটা তার মোটেও অবুঝ নয়। অনেক কিছুই বুঝতে পারে। আর পাতাবাহার? মেয়েটা শান্ত শিষ্ঠ দস্যি মেয়ে। এই মনে হবে তার চেয়ে শান্ত মেয়ে হয়ই না আবার এই মনে হবে চঞ্চলতায় ঘেরা। তর্ক করবে পায়ে পা লাগিয়ে। এক কথায় বলা যায় কিউট! ভোর স্কুলে যাওয়ার পর থেকেই বলতো তার মিস পাতার কথা! সবাইকে আদর করে! বকে না, মিষ্টি করে কথা বলে! কেউ ঝগড়া করলে বুঝিয়ে বলে! ক্লাসে পড়া না পারলে একটুও বকে না কিন্তু দুষ্টুমি করলে দাঁড় করিয়ে রাখে। আরো কতো কথা! মেয়েটাকে অরুণের ভালোলাগে বেশ। সেই ভালোলাগা কবে ভালোবাসায় রূপ নেবে?
একটু পরেই পাতা ও ভোর এসে সোফায় বসে। অরুণ বিরিয়ানী প্লেট নিজের কাছে টেনে নিয়ে ছোট লোকমা বানিয়ে ছেলের মুখে দেয়। ভোর অন্যদিকে চেয়ে গাল ফুলিয়ে মুখে নেয়। পরের লোকমা অরুণ পাতার মুখের সামনে ধরলো। পাতা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে বাড়িয়ে দেয়া লোকমার দিকে। মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে যায় অল্প পরিসরে। অরুণ মুখে বিরিয়ানী পুরে দিলো। ফলাফল স্বরূপ গালে মুখে লেগে যায়। অরুণ মুছেও দিলো। পাতা তার স্মৃতির পাতা ওলট পালট করে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখে, বুঝ হওয়ার পর কেউ তাকে এতটা যত্ন সহকারে খাইয়ে দিয়েছিল কি না! কিন্তু কোনো স্মৃতি ক্যাচ করতে পারে না। পাতার চোখ জোড়া আবেগে আপ্লুত হয় না এবার বরং খুশির ঝলকানি দেয়। অন্তঃস্থলের রঙ বেরঙের উড়তে থাকা অসংখ্য প্রজাপতি একই ছন্দপতনের সুরে ডানা ঝাপটিয়ে এক রোমাঞ্চকর তানে নেচে উঠল। অরুণ নিজেও এক লোকমা মুখে পুরে ছেলের মুখে দিয়ে পর্যায়ক্রমে পাতার মুখে দেয়।
-” পর মানুষ নই যে এভাবে আশ্চর্য হবে!”
পাতা বিরিয়ানী চিবোতে চিবোতে জবাব দিলো,
-” তো কি আপন মানুষ?”
অরুণ শান্ত চোখে পাতার দিকে চায়।
-” তুমি যেমনটা মনে করো!”
-” আমি মনে করলেই হয়ে যাবে?”
পাতার কথায় অরুণ কিছু বলে কিন্তু পাতা বুঝতে পারে না। লোকটা মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে বলেছে। পাতা পূনরায় সুধায়,
-” কি বললেন বুঝলাম না?”
-” কিছু না!”
পাতার চোখ মুখ কুঁচকে যায়।
-” কিছু তো বলেছেন?”
অরুণ জবাব দেয় না। অগোচরে এলাচসহ বিরিয়ানী পাতার মুখে পুরে দেয়। পাতা অরুণের দিকে সন্দেহ নজরে চেয়ে চিবোতে থাকে। দাঁতের নিচে এলাচ পড়ায় মুখের আকৃতি চেঞ্জ হয়ে আসে। মুখ বিকৃত করে ওয়াশ রুমে চলে যায়। একটু পরে ফিরে এসে অরুণের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
-” মজায় খাচ্ছিলাম সহ্য হচ্ছিল না, না? দিলেন তো মুখটা নষ্ট করে! নাক উঁচু ম্যানারলেস বদ লোক!”
অরুণ স্বভাব সুলভ গম্ভীর গলায় বলল,
-” আমি কি করলাম?”
-” কি করেছেন? সাধু সাজছেন? আমি জানি আপনি ইচ্ছে করেই এলাচ দিয়েছেন!”
-” আমি তো দিই নি! বিরিয়ানী যে রেঁধেছে সেই শেফ দিয়েছে এলাচ! আর এলাচ ছাড়া বিরিয়ানী হয়?”
-” আশ্চর্য আমি বলছি আপনি আমার লোকমায় এলাচ দিয়ে আমার মুখটা নষ্ট করে দিয়েছেন!”
-” ঠিকও করিয়ে দিতে পারি!”
পাতার কপালে ভাঁজ পড়লো। আগ্রহী গলায় সুধায়,
-” কিভাবে?”
-” মিষ্টি মুখ করিয়ে! করাবো?
অরুণের তাৎক্ষণিক প্রশ্ন। পাতা থতমত খেয়ে যায়। তার বেহায়া অশ্লীল মন! হাতজোড় নিয়ে ঠোঁটের উপর রাখলো। যেন এখানেই আক্রমণ হবে। অরুণ বাঁকা হেসে বলল,
-” আশ্চর্য কেকের কথা বলছিলাম আমি!হেইটস ইউর মাইন্ড পাতাবাহার!”
পাতার জবান বন্ধ হয়ে যায়। লজ্জায় মরি মরি অবস্থা তার। ইচ্ছে করে ভোরের মতো চিল্লিয়ে কাঁদতে। ওদিকে ভোর কেক খেতে খেতে পিট পিট করে চেয়ে হাসিমুখে আব্বু আম্মুর ঝগড়া দেখছে।
গোধূলি লগ্ন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে ধরনীতে। সূর্য মামা অস্তমিত হওয়ার প্রচেষ্টায়। নীল আকাশ হালকা লালীমায় ছেয়ে আছে। সাদা সাদা কালো কালো মেঘের ফালিও সূর্যের লাল আলোয় রঙ্গিন সাজে সেজেছে। গোধূলির আকাশ বিহঙ্গের দখলে। নানা ধরনের বিহঙ্গ দল বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ আপন নীড়ে ফিরতে ব্যস্ত। আতিকুর ইসলাম কাচারি থেকে বাড়ি ফিরেছে একটু আগেই। গোসল সেরে ড্রয়িং রুমে আসতে লাবনী আক্তারের আকুল কণ্ঠস্বর শোনা যায়। তাকে উদ্দেশ্য করেই বলল,
-” পাতাকে আনবেন কবে? অনেক দিন তো হয়ে গেল। ওর শশুর বাড়ির লোকেরা কি ভাববে?”
আতিকুর ইসলাম বিরক্ত হয় খানিক। সব সময় একই ঘ্যানর ঘ্যানর! তিনি বিরক্তিকর সুরেই বলল,
-” আনবো বললেই তো আনা হয় না!মেয়ে মেয়ের জামাই আনতে যাবো শুধু মিষ্টি নিয়ে গেলে মানসম্মান থাকবে? এখানে এনে দু তিন দিন রাখতে হবে না? যেমন তেমন খাবার দেওয়া যাবে? মুখে রুচবে জামাইয়ের? তাছাড়া জামাইকে খালি হাতে পাঠিয়ে দেব! কিছু দিতে হবে না? ওদের পরিবারের প্রত্যেককেই দিতে হবে। বড় ঘরের ওরা যেনতেন উপহার দেয়া কেমন দেখাবে? আবার বড় জামাই, লতাকেও আনতে হবে ওদের সাথে। শোন লাবনী রাজার ভান্ডার নেই আমার। সরকারের কামলা খাটি। যা পাই তাতে নিজেদেরই টেনে টুনে চলতে হয়। আনবো বলেছি আনবো। মাস শেষের দিকে। হাতে একটা কানাকড়িও নেই। কিভাবে চলছি আমি জানি। মাস শেষে বেতন পেলে আনবো ওদের। আর ঘ্যান ঘ্যান করবে না। আমার দায়িত্ব আমি ভুলি নি!”
বলেই লুঙ্গির কোনা হাতে পুরে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। হাতে শুধু পাঁচশ টাকা আছে। এ মাস শেষ হতে দু দিন বাকি এখনো। দু’দিনে পাঁচশ টাকায় চলবে? চলবে না চলাতে হবে। সংসার জীবন যতো সহজ আমরা ভাবি আদতে সেটা নয়। পুরোটা ঝামেলায় ভরপুর! একটা ফুরতে না ফুরোতেই আরেকটা শুরু। টাকা পয়সার সমস্যা যার আছে সেই বোঝে সংসার চালানো কতটা কষ্টকর ব্যাপার। যার রাজার হাল আছে সে সুখে থাকলেও যে রাজার রাজত্বে কাজ করে খায় সে বোঝে টাকার মূল্য।
মাগরিবের আজান দেওয়ার সময় হয়েছে। আসমা বেগম রুপকে কোলে নিয়ে ঘুরছে। ছেলেটা কাঁদছে ‘মা মা’ বলে। মায়ের কাছে যাবে সে। কিছুতেই ভুলিয়ে রাখা যাচ্ছে না। রুবি ব্যাংকে। আরিয়ানটাও নেই বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি করছে বোধহয়, আনিকাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। বাড়িতে সে,পাতা, ভোর ও মিনু। আভারিকে সে বাজারে পাঠিয়েছে। মিনু ও পাতাকে দেখতে পায় না। ‘বড় বউ, মিনু’ বলে কয়েকবার ডাক দিলো কোনো সাড়াশব্দ পেল না তাদের। তিনি বিরক্ত হয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। হঠাৎ কান্নার আওয়াজে পা থেমে যায়। কে কাঁদছে? একটু এগিয়ে যেতেই পরিষ্কার হয়। এতো ভোর! কাঁদছে কেন? তাও এভাবে চিল্লিয়ে হাঁউমাঁউ করে। তিনি ‘ভোর ভোর’ বলে ডেকে এগিয়ে যায়। সিঁড়ি বেয়ে অরুণের ঘরে ঢুকে দেখে ভোর বিছানায় বসে কাঁদছে। সাথে ‘আম্মু আম্মু’ বলে জোড়ে জোড়ে ডাকছে। পাতাকে কোথাও দেখতে পেল না। তিনি এগিয়ে গিয়ে রূপকে বসিয়ে দিলো খাটে। ভোরের কান্না দেখে ছোট্ট রূপের কান্না থেমে গেছে। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখছে সব। ভোর আসমা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-” ও দাদি আম্মু আম্মু..!!”
কান্নার দরূণ বলতেই পারে না। আসমা বেগম চিন্তিত হয়।
-” কি হয়েছে ভোর? তোমার আম্মু গার্ডেনে বোধহয়! কাঁদে না! বলো দাদিকে?”
ভোর বলতে চায়। কিন্তু আম্মু বলার পর গলা দিয়ে আর শব্দ বের হয় না। আসমা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বলে। এরইমধ্যে পাতা দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করে। আসমা বেগমকে জড়িয়ে থাকা ক্রন্দনরত ভোরকে দেখে বুকটা ধ্বক করে ওঠে। ওভাবে কাঁদছে কেন ছেলেটা? ভোর পাতাকে দেখেই আসমা বেগমকে ছেঁড়ে ‘আম্মু’ বলে দু হাত বাড়িয়ে দেয়। পাতা তড়িৎ গতিতে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বলল,
-” কি হয়েছে বাবা কাঁদছো কেন? ব্যাথা পেয়েছো? বাবা বলো? আম্মুকে বলবে না?”
ভোর কাঁদতেই থাকে। পাতা তার পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” বাবা কাঁদে না! বাবা হয়েছে কত কাঁদবে! কেঁদো না!”
বলে চোখমুখ শাড়ির আঁচলে মুছে নাকটাও মুছে দিলো। কপালে গালে ছোট ছোট চুমু দিয়ে আদুরে গলায় শান্ত করলো! ভোর শান্ত হয়ে পাতার বুকে মাথা রেখে ফোপাচ্ছে। পাতা সময় নেয়। ভোর পুরোপুরি শান্ত হয়ে গেলো।
সে একটা খুবই বাজে স্বপ্ন দেখেছে। খুবই বাজে! সে মেরির পেন্সিল ভেঙে ফেলেছিলো তাই মেরি তার আম্মু ও আব্বুকে ডেকে আনে। তারা ভোরকে অনেক বকে! তার আম্মু এগিয়ে আসলে মেরি আম্মুর পেটে ভাঙ্গা পেন্সিলটা ঢুকিয়ে দেয়। তার আম্মু আস্তে করে ঘুমিয়ে পড়ে। আর কথা বলে না। মেরি, তাহসান, টয়া, রবিন সহ সকলে হাসতে হাসতে বলে ‘তোর মা চলে গেছে ভোর!’ ভাবতেই ভোর আবার ফুঁপিয়ে ওঠে।
পাতা ভোরকে আগলে নিয়ে আদর করে বলল,
-” কি হয়েছে বাবা? বাজে স্বপ্ন দেখেছো?”
ভোরের চোখ জোড়া আবার ভরে ওঠে।
-” না! তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে আম্মু? আমি তোমাকে খুঁজছিলাম!”
-” এই গার্ডেনে ছিলাম! মিনু আপা আর আমি! ওই তো মিনু আপা!”
মিনু ঘরে ঢুকে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” ভোর বাবা কাঁদে কেন?”
ভোর কিছু বলে না। শক্ত করে পাতাকে জড়িয়ে রাখে। আসমা বেগম গম্ভীর গলায় পাতাকে বলল,
-” বড় বউ? ছেলেটাকে এভাবে রেখে কোন কাজ উদ্ধার করতে গিয়েছিলে শুনি? কেঁদে কেঁদে দম বন্ধ হবার যোগার! খেয়াল রাখতে জানো না?”
-” আসলে মা ও ঘুমিয়ে ছিল তাই এই বাগানে একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম! আর হবে না!”
রূপ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ভোরের গা ধরে উঠে দাঁড়ালো। পাতার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকে ‘মা আম্মা’ সবাই তার দিকে চায়। পাতা এক হাতে তাকে ধরে, পড়ে না যায়। ভোর আড়চোখে সেটা দেখে ঝটকা মেরে সরিয়ে নেয়। রুপ বিছানায় বসে পড়লো হাসতে হাসতে। সাথে সবাই হাসে। ভোরের ঠোঁটের আগায়ও হাসি ফুটে উঠতে চায় কিন্তু রূপের আবার পাতাকে ‘মা আম্মা’ ডাকায় হাসি বন্ধ হয়ে যায়। পাতার গলা জড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
-” আমার আম্মু! তোমার না! তোমার আম্মুর কাছে যাও রূপ!”
রূপ তার কথা শুনে কেঁদে উঠলো পূণরায়। আসমা বেগম তাকে কোলে তুলে নেয়। রূপ হাত পা ছুড়তে থাকে! পাতার দিকে চেয়ে ‘মা আম্মা’ বলে কাঁদতে থাকে! হাত বাড়িয়ে দেয়, তার কাছে যাবে। ভোর চোখ রাঙায় তাকে। পাতা রূপকে নিতে চাইলে ভোর কিছু বলে না। পাতাকে ছেড়ে কম্ফোর্ট দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে শুয়ে পড়লো। মিনু ডাকে শোনে না। পাতা, আসমা বেগম ডাকে তবুও না। এদিকে রূপ কাঁদছে। আসমা বেগম রূপকে নিয়ে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল,
-” কি হিংসুটে ছেলে তুমি ভোর! রূপ তোমার ভাই হয়! এমন করলে রূপ তোমাকে ভাই ডাকবে না!”
‘না ডাকলো’! তারও ভাই হবে। সে ডাকবে ভোরকে ভাই বলে! হুহ। ভেবে ভোর কম্সোর্ট সরিয়ে উঁকি দেয়। মিনু তার কান্ড দেখে হাসে। পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে ছোট ছোট করে
চায়। ভোর গাল ফুলিয়ে বলল,
-” আমার আম্মুকে ও কেন মা বলবে? বললে ওর ওই একটা দাঁত ফেলে দেবো!”
পাতা হেসে দিলো। পুরো বাবার কার্বন কপি এই ছেলে! বাবার মতোই হবে হয়তো বড় হয়ে। যেন ছোট্ট অরুণ সরকার!! পাতা বিছানায় বসে ভোরের গাল টেনে দেয়। ভোর মিষ্টি করে হেসে পাতার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো!”
-” ভোর লাভস ইয়ু সো মাচ আম্মু!”
পাতা হাসে। অরুণ সরকারের মতো কপি করে গম্ভীর গলায় বলল,
-” মি ঠ্যু বাবা!”
মিনু ও ভোর খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো তার বলার ভঙ্গিমা দেখে। পাতা নিজেও হাসলো!
শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে রুম জুড়ে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। শুধু ঘূর্ণায়মান ঘড়ির কাঁটার টিক টিক টিক শব্দ। রাতের পোকার ডাক শোনা যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে পূর্ণ চাঁদের ম্লান আলো ছড়িয়ে পড়েছে সর্বস্ব। বাদুড়ের পাখা ঝাপটানোর ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছে মাঝে মাঝে। পাতা নিজ ঘরে ভোরের পাশ ঘেঁষে বসে খাতা দেখছে। বিড়াল শাবকটি খাতার উপর শুয়ে পাতাকে পর্যবেক্ষণ করছে। তাকে ছেড়ে দিয়েছে, বকছে না! কাছে ঘেঁষতে দিয়েছে! এতেই যেন সে অবাক!! ভোর হা করে ঘুমিয়ে। ঘরে আর কেউ নেই। ভয়ে পাতার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ঘরে সে, ভোর, আর এই হতচ্ছাড়া বিড়াল! এদিকে রাত এগারোটা পেরিয়ে গেছে।
লোকটা এখনো আসছে না কেন? তখন তো বলেছিল তাকে হেল্প করবে খাতা দেখতে। তাই পাতা ধীরে ধীরে কয়েকখানা খাতা দেখে অরুণ সরকারের প্রহর গুনছিলো! অথচ লোকটা ধোঁকা দিলো! এখনো খবর নেই। এখন এতো গুলো খাতা কিভাবে দেখবে সে? খাতার দিকে তাকিয়েই তার কান্না ও ঘুম একসাথে আসছে। কেন যে আলসেমি করে খাতা দেখলো না। গত একবছরে তার সাথে এমনি হয়েছে। খাতা সাবমিট করার আগের দিন লতা আপু,লুব ভাইকে অনুরোধ করে খাতা দেখে দিতে বলতো। তারা পাতাকে বকেঝকে খাতা দেখে দিতো। মা’ও সাহায্য করতো। এখন তো তারা নেই কে উদ্ধার করবে পাতাকে! ওই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক? যার কিনা খবরও নেই। ফোন দিয়েছিল সে! বলে কি না ‘বিজি আছি!
পড়ে কল করছি’ রাগে দুঃখে পাতা নিজেই খাতা দেখতে বসেছে। সারে এগারোটা বাজে। অনেক গুলো খাতাই দেখেছে পাতা। ক্লাস ফোর, ফাইফ, ট্যু এদের গুলো দেখা শেষ নাম্বার তোলাও হয়ে গেছে। শুধু নার্সারি মানে ভোরদের খাতা দেখা বাদ আছে। এগুলো জলদিই হয়ে যাবে। শুধু একটা শীট তাতেই কোশ্শেন তাতেই আনসার! পাতার কাঁদো কাঁদো মুখশ্রীতে খানিকটা খুশি দেখা মিলে। একটা খাতা দেখা হলেই হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হয়। পাতা ভয়ে কেঁপে উঠলো। হাত থেকে লাল বল পেন পড়ে যায়। অরুণ সরকারকে ঢুকতে দেখে জানে পানি ফিরে পায়। বুকে থু থু দিয়ে পূনরায় খাতা দেখায় মনোযোগ দিলো। কথা বলবে না লোকটার সাথে। অরুণ স্বভাবসুলভ ঘরে ঢুকে ব্লেজার, কটি, টাই, শু, মুজো খুলে ছুঁড়তে থাকে। শার্টটাও খুলে ছুঁড়ে বলল,
-” উফ! আজ সারাটা দিন ব্যস্ততায় কেটেছে। কলিজা ঘুমিয়েছে?”
-” হুম!”
বলে নিজের কাজে মনোনিবেশ দিলো। অরুণ ঘার ফিরিয়ে পাতার দিকে চায়। গাল ফুলিয়ে খাতা দেখছে। অরুণ ব্যস্ত মস্তিষ্কে উদয় হয় পাতাবাহারের খাতা দেখার কথা। সে হেল্প করবে বলেছিলো! মেয়েটা নিশ্চয়ই অপেক্ষায় ছিলো? অরুণ বিছানায় বসে বলল,
-” অনেক ব্যস্ত ছিলাম অফিসে। চাইলেও আসতে পারছিলাম না!”
-” বুঝতে পেরেছি!”
অরুণের মনটা খারাপ হয়। মেয়েটা অভিমান করে বসে আছে। কিন্তু সত্যিই তার কিছু করার ছিল না। গয়না ডেলিভারী নিয়ে গন্ডগোল বেঁধেছিল। এখনো সল্যুশন হয় নি। ব্যাপারটা পুলিশ অবধি গড়িয়েছে। অরুণ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। শরীরটা চলছে না তাঁর! অনেকটা ক্লান্ত সে। খিদেয় পেট চু চু করছে। সে টি শার্ট ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশ রুমে যায়। গোসল করে বেরিয়ে আসে। মাথায় তোয়ালে চালাতে চালাতে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,
-” খেয়েছো?”
পাতা মাথা উঁচিয়ে চায়।
-” হুম! সবার সাথেই!”
-“ওহ্ আচ্ছা!”
বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মলিন মুখে। আঁকুপাঁকু মনটা কোথাও একটু ভেবেছিল কেউ তার অপেক্ষায় আছে না খেয়ে! কিচেনে ঢুকে ফ্রিজ থেকে রুটি, ভাজি বের করে ওভেনে দিলো। চুলা জ্বালিয়ে একটাতে দুধ গরম ও অন্যটায় কড়াই বসিয়ে তেল দিলো।একটা ডিম বের করে করে অল্প দিয়ে লবণ পোচ করে নিলো। প্লেটে রুটি, ডিম, ভাজি নিয়ে কেবিনেটের উপর বসলো। রুটি ছিঁড়ে যেই না মুখে তুলবে! কেউ ডাকলো! অরুণ খানিকটা হেসে অল্প রুটি ও ডিম ছিঁড়ে কেবিনেটের উপর রেখে বলল,
-” খাও পাতাবাহার! আজ তুমি আর আমি ডিনার করবো একসাথে!”
বিড়াল শাবকটি মিও মিও করে অরুণের গা ঘেঁষে বসে রুটি, ডিমের টুকরো শুঁকে চাটতে লাগলো! অরুণ মলিন হাসে। বিড়ালটির সাথে টুকটাক কথা বলে খাওয়া শেষ করলো। এঁটো প্লেট ধুয়ে রেখে দিল। একটা গ্লাসে গরম দুধ ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো পুরোটা! গ্লাসটা আবার ভরে কিচেনের লাইট অফ করে চলে গেল নিজের ঘরে। পাতাকে আগের মতো কাজ করতে দেখে দুধের গ্লাসটা বাড়িয়ে বলল,
-” দুধটুকু খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো! বাকি টুকু আমি করে দিচ্ছি!”
পাতা অরুণের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
-” আমিই পারবো। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না! বলেছেন এই অনেক! আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন আপনাকে ক্লান্ত লাগছে!”
অরুণের মেজাজ বিগড়ে যায়। ধমকে বলল,
-” চুপচাপ দুধটুকু খেয়ে ঘুমিয়ে নাও! আর একবার যেন বলতে না হয়। মেজাজ ঠিক নেই!”
পাতা মুখ গোমড়া করে চায়। একে তো কথা দিয়ে কথা রাখে নি। স্যরিটাও বলল না। তার উপর ঝাড়ি দিচ্ছে। পাতা দুধটুকু এক ঢোকে গিলে নিলো। খালি গ্লাস অরুণের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ওমনি শুয়ে পড়লো কম্ফোর্ট জড়িয়ে। অরুণ খাতাগুলো একে একে নিয়ে সোফায় বসলো। পাতা শুয়ে থেকেই অরুণের উদ্দেশ্যে বলল,
-” ভালোভাবে দেখবেন। ভূল যেন না হয়! আর হ্যাঁ দেখা শেষে খাতা সিরিয়াল মোতাবেক গুছিয়ে রাখবেন। পাশের শীটে নাম তুলে নাম্বার তুলতে ভুলবেন না!”
অরুণ শীটটা হাতে নেয়। শুধু রোল লেখা আছে। সে টেবিলের উপর পা তুলে বসে চোখে চশমা পড়ে লাল বল পেন হাতে নিয়ে শুরু করে দিলো খাতা দেখা। ধীরে ধীরে মনোযোগ সহকারে খাতাগুলো দেখে নাম্বার কালেক্ট করে শীটে বসিয়ে দিলো। সব খাতার ভিড়ে ছেলের খাতাটাও চলে আসলো। অরুণ ভালোকরে সবটুকু দেখলো। ভাঙা ভাঙা হাতে ভালোই লিখেছে। শুধু রাইম টা লিখে নি! অরুণ আর সব খাতাগুলোর মতো ছেলের খাতাটাও দেখলো, নাম্বার দিলো! পঞ্চাশের ভিতর ঊনচল্লিশ পেয়েছে সে। যেখানে অধিকাংশ ছেলেমেয়েই পঞ্চাশ ঊনপঞ্চাশ! পঁয়তাল্লিশের নিচে খুব একটা কেউ নেই! হাতেগোনা কয়েকজন। অরুণ সব গুলো খাতা ধৈর্য্য সহকারে দেখলো! সিরিয়াল মোতাবেক গুছিয়ে বেঁধে নিলো। শীটটা তার উপরেই রাখলো। বার বার হামি উঠছে তার। ঘুমে চোখ ছোট ছোট হয়ে এসেছে। মাথাটাও বেশ ধরেছে। অরুণ টাফনীল খেয়েনিলো।
ওয়াশ রুম থেকে ফিরে ঘড়ির দিকে চাইলো! প্রায় একটার ঘরে। অরুণ টি শার্ট খুলে ঢিল ছুড়ে বিছানায় যায়। ছেলের কপালে গালে চুমু দিয়ে দুজনের মাঝখানে গা এলিয়ে দিলো। কম্ফোর্ট নেই একটারও শরীরে। অরুণ কম্ফোর্ট গায়ের দেয়ার সময় খেয়াল করলো পাতার পড়ণে শাড়ি। মেয়েটা শাড়ি পড়েই ঘুমিয়ে পড়েছে!! আর শাড়ির অবস্থাও শোচনীয়! মেয়েলি কায়া উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। আঁচল আঁচলের জায়গায় নেই! অরুণ নজর সরায় না। না নিজ মনের অবাধ্য বেহায়া ইচ্ছেটাকে অপূর্ণ রাখে। এতো কষ্ট করে ক্লান্ত শরীরে এতো গুলো কাজ করে দিয়েছে এটুকু পারিশ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা। আর অরুণ সরকার তার পাওনা আদায় করে নিতে জানে। অরুণ লাইট ওফ করে দিয়ে ঘুমন্ত পাতার দিকে ঝুঁকে আসে। কপালে, গালে চুমু দিয়ে গলায় নামলো!
পাতা বাহার পর্ব ৩২(২)
অবাধ্য বেহায়া হাত উদর জুড়ে খেলা করে। পাতা ঘুমের ঘোরেই কেঁপে কেঁপে উঠলো। ঘুমের ঘোর কাটতে নিলে অরুণ থেমে যায়। পিঠে হাত গলিয়ে উঁচুতে তোলে। গলায় বেশ খানিকটা নিচে দন্তপাটি বসিয়ে সরে আসে। ছেলের দিকে ফিরে শয্যায় শায়িত হয়। মিনিটের মাঝেই ঘুমে তলিয়ে যায়। পাতা পিট পিট করে চোখ জোড়া অল্প খুলে কম্ফোর্টে নিজেকে জড়িয়ে সাথে সাথেই ঘুমে কাতর হয়ে পড়ে। পাতার চোখ বুজে যায়। ঘুমের অতল সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকে। আর বিড়াল শাবকটি টি টেবিলের খাতার বান্ডিলের উপর দাঁড়িয়ে। একটু আগের ঘটনার প্রতক্ষ্য সাক্ষী সে।