পাতা বাহার পর্ব ৪০
বেলা শেখ
ভোর বাধ্য ছেলের মতো তার আম্মুর কথা মেনে নেয়। অরুণ এটা ওটা বলে ভোলানোর চেষ্টা করে ভোর ভোলে না। তার কাজে অটল সে। অরুণ হার মানে। শান্ত স্বরে বলে,
-” স্যরি পাতাবাহার! আর এমন হবে না। ভোরকে ছাড়তে বলো? ইটস হার্টিং!”
পাতার কর্ন গহ্বরে মনে হয় এক রাশ শান্তি বাক্য প্রবেশ করলো! হামি তুলে অরুণের উদ্দেশ্যে বলল,
-” কি বললেন ভোরের বাবা? শুনতে পাই নি! একটু জোড়ে বলুন? আর কণ্ঠে আরেকটু নমনীয়তা ঢেলে! ঠিকাছে?”
অরুণ চোখ রাঙায়। পাতা ভেংচি কাটলো তাকে। ভোর অরুণের চুল আরেকটু জোড়ে টেনে বলল,
-” আব্বু? মিষ্টি করে বলো? তুমি না গুড বয়?”
অরুণ শান্ত চোখে ছেলের দিকে তাকায়।
-” বলব না। তুমি বরং আরো জোড়ে টানো আব্বু! ভোরের আব্বু কি ব্যাথা পায় নাকি হুম?”
বলে নড়াচড়া বন্ধ করে দেয়। চুলের টান ধীরে ধীরে কমে আসে। একসময় ছেড়েই দেয় ভোর। এভাবে টানলে তো আব্বু অনেক ব্যথা পাবে। আব্বু ব্যাথা পেলে তার বুকটা কেমন করবে!পাতা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। এই লোক তো মানুষ বশীভূত করতে ওস্তাদ। কিভাবে এক পলকেই পরিস্থিতি সামলে নিলো। পাতা হতাশ হয়ে পুনরায় বালিশে মাথা রাখলো।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
এ জম্মের ঠ্যাঠারু লোক। অরুণ ছাড়া পেয়ে পাতার দিকে একনজর তাকিয়ে ভোরকে আদর করে বুকে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ভোর বাবার গলা জড়িয়ে আরাম পেয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে।অরুণ ছেলের মাথা বালিশে রেখে কপালে চুমু দিয়ে সরে আসবে কিন্তু ভোর বাবাকে ছাড়ে না। গলা মুখ হাতরিয়ে আব্বু আব্বু বিড়বিড় করে। অরুণ সময় নেয়। ছেলের ঘুম গাঢ় হলে সরে আসে। ছেলেকে ডিঙিয়ে ওপাশে দুজনের মাঝে কম্ফোর্টে ঢুকে পড়ে। ডানপাশে ছেলের ঘুমন্ত মুখটা দেখে বামপাশ হয়। পেটে হাত রেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে পাতাকে। ঘুমে কাতর পাতা একটু কেঁপে উঠল। তবে ঘুম ভাঙ্গে না। অরুণ যেন সুযোগ পেলো। বিড়বিড় করে বলে,
-” ইউ উইল বি গন পাতাবাহার।”
সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অরুণ অগ্রসর হয় তার কাজে। হালকা দুষ্টুমির জন্য এগোলেও অরুণ পিছিয়ে আসতে পারে না। হারিয়ে যায় স্বর্গীয় সুখ অনুভুতিতে। পাতার ঘুম ছুটে যায়। মস্তিষ্ক সচল হতেই হাত পা শিথিল হয়ে আসে। অজানা ভয়, আশংকা ও উত্তেজনায় পাতা শিউরে ওঠে বারংবার। বক্ষস্থল কেঁপে কেঁপে উঠছে; ধ্বক ধ্বক শব্দ যেন কানে বাজছে। মুখ দিয়ে মৃদু স্বরে ব্যাথাত্নক আওয়াজ বের হয়। এতেই যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। অরুণ সরকার আগ্রাসী হয়; নিবিড়ভাবে বক্ষস্থলে আধিপত্য বিস্তার করে। পাতা ছটফটিয়ে ওঠে। হাত দিয়ে সরাতে চায়। অরুণ আঙুলের ভাঁজ আঙ্গুল দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে মাথা তোলে। চোখে চোখের মিলন হয়।
অরুণ পাতার চোখের ভাষা নিমিষেই পড়ে নিল। কিন্তু সেটা আমলে নিল না। এমন একটা জায়গায় সে আছে সেখান থেকে বের হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব বলা চলে। সে এগিয়ে আসে! পাতার গালে দাড়িযুক্ত গাল ঘষে। ছোট ছোট চুমু দেয়। কানের কাছে অধর বসিয়ে কামড় দেয় অল্প। অধরের কিনারায় গভীর ভাবে হারিয়ে যায়। থুতনি মুখে পুরে কামড় বসায়। চুমুতে ভরিয়ে তোলে মুখশ্রী। অধরে অধর বসিয়ে ছোট ছোট চুমু দেয়। গভীর চুম্বনে মত্ত হবে পাতা ঢোক গিলে মুখ সরিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে নিমিষেই। অরুণের লালিমায় ছেয়ে যাওয়া চোখ জোড়া জ্বলে ওঠে নিমিষেই। গম্ভীর মুখে বলে,
-” আই এম ইয়্যর হাসবেন্ড পাতাবাহার!”
পাতা অরুণের হাতের মুঠো থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ মুছে নিল। নাক টেনে মাথা নাড়িয়ে হুম বলে মাথা সোজা করে। অরুণ নিচু করে রাখা চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে সরে যায়। বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমে গিয়ে ধরাম করে দরজা লাগায়। পাতা কেঁপে ওঠে সেই শব্দে। ভোর ঘুম থেকে লাফ দিয়ে ওঠে। পাশ হাতরিয়ে বাবাকে না পেয়ে আব্বু আব্বু বলে জোড়ে জোড়ে ডাকে।পাতা নিজেকে সামলে ঠিকঠাক হয়ে ভোরকে শান্ত করায়।
ভোরের অরুণ মেঘলা দীগন্তে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে অল্প স্বল্প। গতরাতে মেঘের গর্জন শোনা গেলেও বর্ষিত হয় নি তেমন। শুধু ঝিরিঝিরি কয়েক ফোঁটা পড়েছে । সেই ফোঁটায় জমিনে শুয়ে থাকা তৃণ ভিজে আছে। রাস্তা ঘাটও কিছু কিছু জায়গায় ভিজে। সরকার বাড়ি সকাল ভোরে নিত্যদিনের মতোই পাখির কলতানে মুখর হয়ে আছে। পাখির দল ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে এ গাছ ও গাছের ডালে।ফলে গাছের পাতার উপর জমে থাকা অল্প পানি ঝড়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটার মতো। আভারি বাগানের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে। আজ মালি এসেছে বাগান পরিষ্কার করতে। আভারি তাকেই সাহায্য করছে। কিছু কিছু ফুল গাছের ডালপালা ছেঁটে দিচ্ছে । সাথে মালির সাথে এটা ওটা আলাপের ঝুড়ি খুলে বসেছে। হঠাৎ আদুরি আসে বাগানে। বয়স্ক গোছের মালি’কে দেখে মুচকি হেসে সালাম জানায়। মালি প্রতিত্তরে হেসে সালামের জবাব দিয়ে বলে,
-” ভালো আছো মামুনি? পড়াশোনা কেমন চলছে?”
আদুরি প্রতিত্তরে মুচকি হেসে বলে,
-” ভালো। আপনি কেমন আছেন কাকা?”
-” খুব ভালো। ফুল নিবে?”
-” আমি ফুল নিয়ে কি করবো? একটা বয়ফ্রেন্ডও নাই যে তাকে গিফট করবো।”
বলে গাল ফুলিয়ে নেয়। আভারি সহ মালি হেসে উঠলো। অরুণ কাছেই ছিল। হেঁটে এলো মাত্র। আদুরির কথা শুনে এগিয়ে আসে। গম্ভীর গলায় বলে,
-” বয়ফ্রেন্ড লাগবে? বিয়ের ব্যবস্থা করি?”
আদুরি চমকে পিছনে তাকায়। বড় ভাইকে দেখে জিভে কামড় দিলো। হে হে করে হেসে বলল,
-” মজা করছিলাম তো! আমার কি বয়ফ্রেন্ড পালার বয়স হয়েছে নাকি। আমি তো এখনো ছোট্টটি আছি!”
অরুণ চোখ রাঙায়। আদুরি হাসি থামিয়ে বলে,
-” আরে বড় ভাইয়া সব সময় সিরিয়াস মুডে থাকো কেন? একটু হাসিখুশি থাকলে কি তোমার দুই একটা সোনার হার গপচা যাবে? বিয়ে করেছো। নতুন সুন্দরী ছোট বউ আছে তোমার। একটু হাসিখুশি থাকবে তা না! এভাবে থাকলে এই বউও টিকবে না বলে..”
কথা শেষ করে না। অরুণের দিকে তাকায়। মুখের আদল বোঝা যাচ্ছে না। বড় ভাইয়া কি তার কথায় কষ্ট পেল নাকি? সে তো মজা করে বলছিল! সে তড়িঘড়ি করে সামলে বলল,
-“স্যরি ভাই। ওভাবে বলতে চাই নি!”
-” হুম”
বলে অরুণ পা চালায়। আদুরি ভাইয়ের হাত ধরে টেনে ধরে। সে বুঝতে পারে ভাই তার কথায় কষ্ট পেয়েছে।
-” ভাই স্যরি বললাম তো! কাকা ফুল দিন তো! ওই টকটকে লাল গোলাপ। একটা না অনেক গুলো দিন!”
অরুণকে ধরে রেখেই মালি’র উদ্দেশ্যে বলে। মালি’ আচ্ছা বলে লাল গোলাপ কাঁচি দিয়ে কেটে নিলো গোটা দশেক। একটা একটা করে গোলাপের কাটা ও পাতা কেটে নিল। গোলাপ গুলো আদুরির হাতে দিয়ে বলল
-” আজই ফুটেছে এই গোলাপ। একদম সতেজ। সুন্দর লাগছে!”
আদুরি ফুলগুলো নিয়ে অরুণের দিকে বাড়িয়ে বলল,
-” স্যরি ভাই। প্লিজ আমার কথায় কষ্ট পেও না। ”
অরুণ ফুল গুলো হাতে নিয়ে মুচকি হাসলো। আদুরির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” স্যরি বলতে হবে না। আমি কিছু মনে করি নি। ”
-” থ্যাংক ইয়ু ভাই!”
অরুণ তার গাল টিপে দিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল। মিষ্টি সকালের মুহুর্তটা যেন নিমিষেই বিষণ্নতার চাদরে ছেয়ে গেল। হয়তোবা তারই দোষ। অরুণ সরকার খোদ নিজেই দোষে ভরপুর মানুষ। ড্রয়িং রুমে বসে থাকা আরিয়ান অরুণের হাতে গোলাপ ফুল দেখে টিপ্পনী কাটলেও ফিরে তাকায় নি।অরুণ সোজা নিজের রুমে চলে যায়। রুমে প্রবেশ করতেই যেন বিষন্নতার রেশ কেটে যায়। পাতা ও ভোর বিছানায় বসে। দুই চড়ুই আজ ঘুম থেকে উঠে পড়েছে তাহলে!! অরুণকে আসতে দেখেও পাতা ভোর কারোর মধ্যেই কোনো ভাবান্তর দেখা যায় না। দুজনে নিজ কাজে গভীর মনোযোগী। পাতা ভোরকে পড়তে বসিয়েছে। ভোর বিড়বিড় করে পড়ছে ও খাতায় লিখছে। পাতা তাকে সাহায্য করছে। অরুণ ফুলগুলো টি টেবিল রেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
-” বাহ্ আজ দুজনে জলদি উঠেছে! আমি তো ভেবেছিলাম এসে টেনে তুলবো!”
পাতা ভোর দু’জনেই মাথা তুলে অরুণের দিকে তাকিয়ে নিজ কাজ করতে থাকে। অরুণের ভ্রু কুঁচকে যায়। সে ওয়াশরুম থেকে একবার ঘুরে এসে সোফায় বসে। নাহ কেউ তাকে গ্রাহ্যই করছে না। অরুণ উঠে দাঁড়ালো। পকেটে হাত গুঁজে বিছানায় দাঁড়িয়ে ভোরের খাতায় উঁকি ঝুঁকি দিয়ে বাইরে চলে গেল।ভোর আড় চোখে সেটা দেখে লেখা বন্ধ করে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আমরা কথা বলি নি তাই আব্বু মনে হয় কষ্ট পেয়েছে আম্মু!”
পাতা ভোরের নাক টেনে বলে,
-” কথা বলো নি কেন? আমি তোমাকে মানা করেছি কথা বলতে?”
-” না! তুমি বলো নি তাই আমিও বলি নি।”
গাল ফুলিয়ে বলে ভোর। পাতা মুচকি হেসে তার গাল টেনে বলে,
-” ওলে আমার সোনা ছেলেটা!”
বলেই হাসে। কিন্তু ভোর হাসে না।
-” আমার আব্বু চুপচুপ থাকে বেশি সময়। আব্বুর মন খারাপ থাকলে একদমই কথা বলে না।আবার যখন মন খারাপ গায়েব হয়ে যায় নিজে এসে কথা বলে, অনেক আদর করে।”
বলে লেখায় মনোযোগ দেয়। পাতা খানিক ভাবনায় পড়ে। কাল কি তাহলে লোকটার মন খারাপ ছিল? সে যাই থাকুক হু হা ভদ্রতার খাতিরে বলাই যায়। ইগনোর করার মানেই হয় না। পাতার ভাবনার মাঝেই অরুণ আসে রুমে; হাতে ট্রে। ট্রেটা বিছানায় রেখে দেয়।
-” কলিজা এই গরম দুধ চকলেট হরলিক্স দিয়ে এনেছি। ঝটপট খেয়ে নাও তো?”
ভোর মিষ্টি হেসে বাবার হাতে পুরো হরলিক্স খেয়ে নেয় বিনা বাক্যে। অরুণ টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে দেয়। ব্রেডে জেল মাখিয়ে দেয়। গরম ধোঁয়া ওটা দুধ চায়ের কাপ পাতার দিকে বাড়িয়ে বলে,
-” ধরো!”
পাতা নেয় না। চুপচাপ ভোরের বই উল্টে পাল্টে দেখে। অরুণ কতক্ষণ কাপটা ধরে রাখে পাতার সম্মুখে । পাতা আড়চোখে লক্ষ্য করে সব। একবার ভাবে নেবে পরক্ষনেই মন পাল্টায়। সে নেবে না। অরুণকে ওভাবে কাপ ধরে রাখতে দেখে জামাই পাগল পাতার মনটা নরম হয়ে আসে। সে ভাবে নেবে হাত বাড়াবে সেই মুহূর্তে অরুণ কাপটা নিয়ে সোফায় বসে পড়ে। পাতা ভেংচি কাটলো। ট্রেতে আরেকটা কাপ আছে। পাতা ভাবলো নিবে কিন্তু নেয় না। অরুণ চা’ য়ে চুমুক দিয়ে লক্ষ্য করে পাতাকে। গোমড়া মুখে বসে ভোরকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে। অরুণ চা রেখে গোলাপ ফুলগুলো নিয়ে পাতার কোলে রাখে। শান্ত গলায় বলে,
-” কাল রাতের জন্য আই এম স্যরি পাতাবাহার! তোমাকে ইগনোর করার জন্য সাথে ওই ঘটনা! আই এম এক্সট্রিমলি স্যরি ফর মাই বিহেভিয়ার। আমি মানুষটা একটুও ভালো নই; দোষে ভরপুর। যখন আমার মুড ঠিক থাকে না আমি চুপ করে যাই। কারণ আমি জানি কথা বললে সেটা ধমক অথবা ঝাড়ি হবে। প্লিজ এক্সেপ্ট মাই এপোলোগাইজ?”
পাতা এমন ভান করে যেন সে শুনতেই পায় নি। ভোর খুশি হয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়ে। আব্বু স্যরি বলেছে তাহলে আম্মু নিশ্চয়ই আর রেগে থাকবে না। কিছু পাতা নিরুত্তর। সে ভোরের বই খাতা পেন্সিল গুছিয়ে ব্যাগে ভরতে থাকে। অরুণের মেজাজ খারাপ হলো। তবুও শান্ত গলায় বলল,
-” আমি কিছু বলছি তোমায়! পাতাবাহার?”
পাতা ব্যাগ গুছিয়ে অরুণের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
-” আমার নাম পাতা! পাতা! পাতাবাহার নয়! সেটা আপনার ওই ছা পোষা বিড়ালের নাম। তাই ওই নামে ডাকবেন না। আর স্যরি? যখন আপনার মুড ভালো থাকবে আমার সাথে মজা করবেন মুড খারাপ থাকলেই ধমকের উপর রাখবেন। ইচ্ছে হলে কাছে টানবেন নয়তো ফিরেই তাকাবেন না! খুব বেশি যত্ন করে আবার অবহেলা করতেও ভুলবেন না। আমিও মানুষ আমারও মুড আছে। আমার আপনার কথা এখন শুনতেই ইচ্ছে করছে না। সো উইল ইউ প্লিজ সাট ইয়্যর মাউথ?”
অরুণের মুখ থমথমে। ভোরের মুখটাও সুবিধার নয়। পাতা অরুণের দেয়া গোলাপ ফুল পাশে রেখে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়।
ভোর গোমড়া মুখে বাবার দিকে চায়। অরুণ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে মুচকি হাসার চেষ্টা করে। কিন্তু হাসিটাও যেন বেইমানি করে। বেরোতেই চায় না।ভোর বাবার গলা জড়িয়ে ঝুলে পড়ে।
-” আব্বু আমি আম্মুকে বুঝিয়ে বলবো হ্যাঁ? আম্মু তোমার সাথে কথা বলবে। তুমি একটুও কষ্ট পেও না।”
এবার অরুণের অধরকোনে হাসি ফুটতে সক্ষম হয়। ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
-” আমার কলিজাটা এতো আদুরে কেন? মনে হয় বুকের ভিতর ঢুকিয়ে নিই।”
ওয়াশরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাত; মুখশ্রী গম্ভীর। আয়নায় নিজের গম্ভীর মুখশ্রী দেখে একটু আগে অরুণের উদ্দেশ্যে বলা কথাগুলো আওড়াতে থাকে। কথা শেষ করে কিছুপল নিজেকে দেখে। হঠাৎ ফিক করে হেসে দেয়। লোকটার মুখ দেখার মতো হয়েছিল। পেঁচা মুখো লোক! সবসময় শুধু ধমক আর ঝাড়ি দিবে এখন ঝাড়ি খেয়ে কেমন লাগে একটু বুঝুক। পাতা হাসি থামিয়ে শান্ত হয়ে বেসিনের কলের নব ঘোরায়। ঠোঁটের আগায় মুচকি হাসি এখনো সরে নি। লোকটা স্যরি বলেছে এটাই এনাফ ছিল তার কাছে। সেখানে এতো গুলো গোলাপ দিয়ে এতো মিষ্টি করে স্যরি বললে জামাই পাগল পাতা গলবে না? তবে একটু নাকানিচোবানি খাওয়ানোই যায়।
এটা তার বউগত অধিকার হুম। তবে বেশি খাওয়াবে না। পাতা ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে পুরো রুমে চোখ বুলায়। কেউ নেই। পাতা বিছানায় রাখা ফুলগুলো নিয়ে ফুলদানিতে রাখে। আলমারি থেকে সালোয়ার স্যুট বের করে বিছানায় রাখে। নিমিষেই চেঞ্জ করে। তবে পরনের লং ঘেরের স্যুটটার জিপ আটকাতে বেগ পোহাতে হয়। পাতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আটকানোর চেষ্টা করে। হঠাৎ দরজার নব ঘোরার শব্দ কানে বাজে। পাতা সচকিত দৃষ্টিতে দরজায় চায়। অরুণ সরকারকে দেখে খানিকটা স্বস্তি পেলেও সেই স্বস্তি বোধ বেশি দের থাকে। গায়ে ওড়না নেই। তবে এটা বেশি ফ্যাক্ট না। এর আগেও লোকটার সামনে ওড়না ছাড়া ছিল সে। কিন্তু লোকটা কপালে ভাঁজ ফেলে এদিকেই এগিয়ে আসছে। তখন সে এতগুলো কথা শুনালো। ছেলে সামনে ছিল তাই হয়তোবা চুপ করে ছিল। এখন তো কেউ নেই। পাতা অরুণের দিকে মুখ করে দুহাত পিঠের দিকটায় নিয়ে জিপ লাগানোর চেষ্টা করে।
-” চেঞ্জ করছিলাম আমি নক করে ঢুকতে পারেন না?”
-” ইটস মায় রুম, মায় ওমেন!
বলে অরুণ গম্ভীর মুখে এগিয়ে আসে। কথাটা যেন পাতার বুকে লাগলো! আহ্! মাই ওমেন! কথাটায় কতটা অধিকারবোধ! অরুণ কাঁধে দুহাত রেখে পাতাকে ঘুরিয়ে দেয় আয়নার সম্মুখে। নিজে পেছনে দাঁড়িয়ে জিপে হাত রাখে। পিঠে আলতো হাত ছুঁয়ে একটানে জিপ আটকে দিল। পাতার শ্বাস আটকে যাবার যোগাড়। এই লোক ভয়ংকর পাতু! তুই কি নাকানিচোবানি খাওয়াবি! এই লোক তোকে মাঝসমুদ্রে ফেলে হাবুডুবু খাওয়াচ্ছে। অরুণ পাতার পিঠ নিজের বলিষ্ঠ পিঠের সাথে মিশিয়ে আয়নায় পাতার প্রতিবিম্বের সাথে নজর মিলায়! অরুণের নয়নে নয়ন পড়তেই পাতা শান্ত হয়ে যায়। তাকিয়ে থাকে অবিকল ওই মায়ায় ভরপুর ছোট ছোট চোখের গভীর সমুদ্রে। ডুবে যায় ঘোরে। যেন বশীভূত হয়ে যায়। এ কেমন মায়ায় ঘেরা লোকটা? অরুণ পলক ঝাপটিয়ে শান্ত স্বরে গলায় খানিক নমনীয়তা ঢেলে বলে,
-” মিসেস পাতা অরুণ সরকার! আমি আগেই সাবধান করেছিলাম যে আমি লোকটা মোটেও ভালো নই। মেজাজের ঠিকঠিকানা নেই। আমাদের মাঝে পুরো জেনারেশন গ্যাপ আছে। আমাদের চিন্তা ধারনা অন্যরকম। তবুও আমি সর্বদা চেষ্টা করছি একসাথে পথ চলার।”
থামে অল্প। পরপরই গম্ভীর মুখে বলে,
-” আপনার অভিযোগ শুনলাম! এখন আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন! আপনি অভিযোগ করেছেন আমি আমার জবানবন্দি দিচ্ছি। আমি বিনা কারণে ঝাড়ি ধমক দিই না; অতি আপনজন ব্যাতিত কাউকেই ধমক দিই না। আমার কাছে যখন কোনো ব্যাপার ভালো লাগে না ,আমি ধমক দেই শাসন করি ভবিষ্যতেও করবো। আর হ্যাঁ কাছে টানি কিন্তু কখনো দূরে ঠেলে দিই নি। মিথ্যা অভিযোগ মানবো না। দিয়েছি কখনো দূরে ঠেলে?বরং আমি অভিযোগ করতে পারি যে আপনি কখনও আমাকে কাছে টানেন নি।খুব যত্নে না রাখলেও কখনো অবহেলা করি নি। সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি, এফোর্ড দিয়েছি। কিন্তু আমার মনে হয় সর্বচ্চটা আপনি দেন নি! কাল দিনটা খুবই বাজে গিয়েছিল আমার। মেজাজটা খুব একটা সুবিধার ছিল না। সেবারের মতো গ্লাস ভেঙ্গে কোনো সিনক্রিয়েট সৃষ্টি না করি তাই চুপ ছিলাম। ভোরের সাথেও একটা কথা বলি নি। ও কিন্তু কোনো অভিযোগ করে নি! কারণ সে জানে কিছু সময় দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সেই ধৈর্য্য টুকু আপনার ছিল না।”
কথাগুলো কতটুকু সত্য ছিল বা সঠিক পাতা জানে না। তবে লোকটার কথা শুনে মনে হলো লোকটার দোষ নেই। একটু গম্ভীর, মেজাজি কিন্তু তার সর্বোচ্চ খেয়াল রাখে যত্ন করে, আদর করে; মাঝে মাঝে মনে হয় তাকে ভালোও বাসে। সেই হয়তো একটু বেশি বেশি করে মাঝেমধ্যে। পাতা নজর নামিয়ে নেয়। অরুণ বলে,
-” শেষ হয় নি কথা? শুনুন পাতা?”
পাতা মাথা তুলে চায়। পাতাবাহার নামটা তার খুব একটা পছন্দ না হলেও লোকটার মুখে শুনতে শুনতে ভালোলাগা কাজ করে। সেই মুখে পাতা বড্ড বেমানান লাগছে। অরুণ বলে,
-” মন খারাপ করবেন না পাতা। আপনার অভিযোগ ভালো লেগেছে আমার। ভবিষ্যতে কখনো অভিযোগ জমা হলে শুনাবেন কিন্তু? মনে মনে পুষিয়ে রাখবেন না।”
পাতা ঘুরে দাঁড়ায়। অরুণের পিঠে হাত গলিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকটায় মাথা গুঁজে দিলো।
-” হয়েছে! ওত ফুটেজ খেতে হবে না। সব দোষ আমার হ্যাঁপি? আপনার মেজাজকে বলে দিবেন পাতার উপর তার মেজাজ চলবে না একদম!”
অরুণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। পাতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” হয়েছে চলুন খেয়ে নিবেন? স্কুলে যেতে হবে!”
পাতা মাথা তুলে তবে ছাড়ে না। কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-” কি আপনি আপনি শুরু করেছেন?”
-” আচ্ছা তুমি তুমি শুরু করলাম! চলো?”
-” পাতাবাহার বলুন?”
-” না!”
-” কেন?”
-” মানা করেছিলেন আপনি!”
পাতা ছোট ছোট করে চায়। অরুণকে ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। আঙুল উঁচিয়ে বলে,
-” খুব বাধ্য স্বামী আপনি? দেখি চোখ বন্ধ করুন একটু?”
পাতা বাহার পর্ব ৩৯
অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। পাতা আবার বলে। অরুণ বিরক্ত মুখে বন্ধ করে চোখ। পাতা এগিয়ে যায়। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয় কিন্তু নাগাল পায় না। এই লোকটা এতো লম্বা! মনে হয় তাল গাছ। পাতা যত টুকু নাগাল পায় তাতেই কাজ চালিয়ে নেয়। ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা থুতনিতে চুমু বসিয়ে দৌড় লাগায় ঘরের বাইরে। অরুণ তড়িৎ গতিতে চোখ খুলে। পাতাকে না দেখতে পেয়ে পুনরায় চোখ বুজে। থুতনিতে হাত রেখে খানিকটা মুচকি হাসলো। তবে বিছানায় ওড়না দেখে ভ্রু কুঁচকে যায়। ওড়নাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে। পাতা কাঁচুমাচু করে দরজায় লুকিয়ে আছে। অরুণ পাতাকে অস্বস্তিতে না ফেলে ওড়না দিয়ে জড়িয়ে দেয়। হাত ধরে ড্রয়িং রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দেয়।