পাতা বাহার পর্ব ৪৯ (২)
বেলা শেখ
ভোর তার এক্সাম শীট জমা দিয়ে ক্লিপ বোর্ড, পেন্সিল বক্স, রং পেন্সিল বক্স নিয়ে হাসিমুখে বের হয়। সঙ্গে টুটুল। তার সাথেই গল্প করতে করতে হাঁটছে বারান্দা ঘেঁষে। হঠাৎ একটা বাচ্চার সাথে ধাক্কা লাগে। ভোর বিরক্তিকর মুখে বলে,
-” দেখে হাঁটতে পারিস না।”
বলেই পেন্সিল বক্স হাতে তুলে হাঁটা দেয়। রোহান দৌড়ে গিয়ে ভোরের হাত ধরে আটকায়। ভোর গম্ভীর মুখে আশেপাশে দেখে নিয়ে বলে,
-” কি হয়েছে? তোর মা দেখলে বকবে তো!”
রোহান ভিতু মুখে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখে মা আছে কি না! দেখতে না পেয়ে বলে,
-” ভোর তুই আমার ফ্রেন্ড। তাহলে টুটুলের সাথে কেন খেলিস!”
ভোর টুটুলের দিকে একবার তাকিয়ে রোহানের হাত ছেড়ে টুটুলের হাত ধরে বলে,
-” ও আমার বন্ধু। তোর মা বলেছে তোর সাথে যেন না মিশি। আর আমার আব্বু বলেছে টুটুলের সাথে মিশতে।”
বলেই ভোর টুটুলকে একপ্রকার টেনে নিয়ে হাঁটতে থাকে। টুটুল গোমড়া মুখে বলে,
-” আমি কি ছাগল যে টানছিস?”
ভোর হেসে বলল,
-” না তো! তুই হলি মানকি! এই বলতো মানকি মানে কি?”
-” ভোর বানর!”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বলেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। ভোর গাল ফুলিয়ে তার পিঠে কিল বসিয়ে জিভ বের করে ভেংচি কেটে দৌড় লাগায়। টুটুল ‘এই ভোর দাঁড়া!’ বলে ভোরকে ধাওয়া করে। ভোর দাঁড়ায় না। হাসতে হাসতে এলোমেলো দৌড়াতে থাকে রৌদ্র উজ্জ্বল স্কুল মাঠে। মাঠে আরো অনেক ছোট বড় বাচ্চারা, তাদের গার্ডিয়ানদের ভিড়। আজ শেষ এক্সাম, পুরো স্কুলই যেন হইহুল্লোড়ে মেতেছে। নিত্যদিনের তুলনায় স্কুলে ভিড় দেখার মতো। সাথে ঝালমুড়ি, হাওয়াই মিঠাই সহ নানা দিনমজুরের ভিড় ভাট্টা। বাচ্চাদের আকর্ষণীয় খাবার সরঞ্জাম এনে নজর কাড়ছে। ভোর ভিড় ঠেলে দৌড়ায় আর খিলখিলিয়ে হেসে পেছনে মুড়ে টুটুলকে জিভ দেখিয়ে ভেঙায়।একসময় টুটুল ভোরকে হারিয়ে ফেলে। কোথায় গেল ঠাহর করতে পারে না। অনেক খুঁজে টিচার্স রূমের দিকে এগোয়। নিশ্চয়ই তার আম্মুর কাছে।
এদিকে ভোর এখনো লুকিয়ে লুকিয়ে এদিকে ওদিকে খুঁজছে টুটুলকে। হঠাৎ একটু দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে ভোর ভয় পেয়ে যায়। আশেপাশের সব বাচ্চারাই ভয়ে দৌড়াতে শুরু করে। ভোরও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। সে ঘাবড়ে যায়। কুকুরটাকে চিনতে ভুল হয়নি তাঁর। সেদিন যে কুকুর দুটো তাঁর উপর আক্রমণ করেছিলো তাঁরই একটা! ভোর তাঁর সর্বোচ্চ বেগে দৌড়াতে থাকে! একটু দূরে যেতেই ছোট ছোট সবুজ ঘাস আচ্ছাদিত মাঠে মুখ থুবড়ে পরে যায়; ব্যথা পায় বেশ। সেখানে উপস্থিত বাচ্চারা হেসে ওঠে। গার্ডিয়ানরা অবশ্য হায় হায় করে।এক গার্ডিয়ান ভোরকে তুলে গায়ের ময়লা ঝেড়ে দেয়।ভোর উঠেই মাঠে পড়ে থাকা ক্লিপ বোর্ড, পেন্সিল বক্স, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা রং পেন্সিল তুলতে নিলে এক মহিলা সব তুলে ভোরের হাতে দিয়ে বলে,
-” ব্যাথা পেয়েছো বাবু?”
ভোর নাকে হাত দিয়ে না বোধক মাথা নাড়ে। অথচ নাকটা রক্তবর্ণ হয়ে আছে যেন টোকা দিলেই রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আসবে। ভরে ওঠে তাঁর চক্ষু যুগল। মহিলাটি বুঝতে পারলো ব্যথা পেয়েছে। সে ভোরের হাত ধরে বললো,
-“মিস পাতা তোমার আম্মু না?”
ভোর এবারও মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে ‘থ্যাংক ইয়ু’ বলে সামনে হাঁটতে থাকে। একটু পর পর পেছনে তাকাতে ভোলে না!
দূর থেকে একজন বাঁকা হাসে। বুক পকেটে ঝুলিয়ে রাখা কালো চশমাটা চোখে দিয়ে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসে। ঠিক ভোরের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে বলে,
-” হ্যালো অরুণাভ ভোর সরকার! মাইসেল্ফ আকাশ!”
ভোর ভ্রু কুঁচকে চায়। হাত মেলায় না; হাতের সরঞ্জাম বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে। কিছু বলে না। আকাশ হেসে ভোরের মাথার চুল এলোমেলো করে বলে,
-” কি কিউট তুমি! মনে হয় আদর করে গাল টিপে দিই! দিই?”
ভোর না বোধক মাথা নেড়ে আকাশের হাত ঝটকায় সরিয়ে দেয়। আকাশ নিজের হাত গুটিয়ে বলে,
-” ওকে বয়। রেগে যাচ্ছো কেন? রাগলে তোমায় আরো কিউট লাগে।বায় দা ওয়ে আমি তোমার আরিয়ান চাচ্চুর ফ্রেন্ড! তোমার চাচ্চুও এসেছে । আনিকা বায়না করেছিল তাই ওই হাওয়াই মিঠাই কিনতে গেছে। আমাকে বলল তোমাকে নিয়ে ওই গাড়িটার সামনে দাঁড়াতে!”
ভোর আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
-” মিথ্যে কেন বলছো? চাচ্চুর সব ফ্রেন্ডকে আমি চিনি। আর চাচ্চু সত্যিই আসলে আমাকে নিতে নিজেই আসতো। তাঁর বন্ধুকে পাঠাতো না। তুমি কি ছেলেধরা?”
আকাশ মনে মনে বাহবা দেয়! একে বোকা বানানো সহজ হবে না! ভোর উল্টো দিকে পা চালিয়ে চলে যাবে; আকাশ তাকে থামিয়ে বলে,
-” আরিয়ান ঠিক! ও বলেছিলো তুমি এটাই বলবে। আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলো তুই যদি ভোরকে আনতে পারিস তাহলে ও নাকি তোমার বাবার পায়ে ধরে হলেও তোমাদের সরকার বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে!”
ভোর পিটপিট করে তাকালো। তারপর বাবার মতো হঠাৎ গম্ভীর মুখ বানিয়ে বলে,
-” এটাও মিথ্যে কথা। আমি যাবো না আপনার সাথে। আপনাকে আমি চিনি না!”
আকাশ এবার শয়তানী হাসে। ভোরের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে,
-” ঠিক আছে। তবে তোর..ওই কি যেন ডাকিস? আম্মু! সে আমাদের কব্জায়। হাত পা মুখ বেঁধে গাড়ির ডিকিতে আটকে রেখেছি।তুই যাবি না; তোর মায়ের গলায় ছুরি চালিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিবো এখনি!”
ভোরের চোখে মুখে ভয় ফুটে ওঠে। সে আশেপাশে তাকায়। অনেকেই আছে বড় মানুষ ছোট মানুষ! ভোর জোরে জোরে শ্বাস টেনে দুই কদম পিছিয়ে যায়। গলা দিয়ে শব্দ বেরোতে চায় না তবুও হালকা উঁচু গলায় বলে,
-” মিথ্যে বলছো কেন? আম্মু টিচার্স রুম..!”
তাকে থামিয়ে আকাশ এগিয়ে আসে। ভোরের চুল ঠিক করে দিতে দিতে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” বিশ্বাস হচ্ছে না তাই তো? ইটস ওকে। এখনি দৌড়ে যা! দেখে আয় আছে কি না! আমরা ততক্ষণে গলা কাটার ব্যবস্থা করি! হুম? তবে হ্যাঁ মনে রাখিস তুই চাইলেই তোর মা’কে বাঁচাতে পারতি। কিন্তু তুই তো চাস না। সৎ মা তো! ওত টান আসে না। কিন্তু তোর বাপের তো আপন বউ! তুই মা কে বাঁচানোর জন্য যাস নি তাই তোর আব্বু তোকেও ছেড়ে দেবে রাস্তায়। আর হ্যাঁ চিল্লাচিল্লি করবি না এখানে! করলে তোর মায়ের জবাই হবে ওখানে!”
ভোর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। আশেপাশে সবার দিকে তাকায় সাহায্যের উদ্দেশ্যে। অথচ বাকি সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। ভোরের হাত পায়ের শক্তি কেমন ফুরিয়ে যায়। আকাশ শয়তানী হেসে কোলে তুলে নেয় ভোরকে।
অপরদিকে পাতা স্টুডেন্টদের এক্সামের খাতা গুছিয়ে ক্লাস রুম থেকে বেরোয়। বড় বড় পা ফেলে টিচার্স রুমে যায়। ভোর নিশ্চয়ই সেখানেই আছে তার অধির অপেক্ষায়। পাতা মুচকি হেসে আগাতে থাকে। হঠাৎ একটা লোক এগিয়ে এসে পাতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
-” ম্যাম? ভোর আছে আপনার কাছে? খুঁজে পাচ্ছি না!”
পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে লোকটার আপাদমস্তক দেখে বলে,
-” কে আপনি? আর ভোরকে খুঁজে পাচ্ছেন না মানে কি?”
লোকটি কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘাম মুছে নেয়। এই শীতের দিনেও সে ঘেমে গেছে। যাবে না কেন? এতো বড় ঘটনা ঘটে গেছে বস তাকে শুলে চড়াবে। গর্দান নেবে নিশ্চিত!
পাতা হন্যদন্য হয়ে খুঁজতে থাকে ভোরকে। টিচার্স রুম, ওয়াশ রুমে সব খুঁজে দেখেছে। প্রিন্সিপাল ম্যামের কাছেও খবর পাঠিয়েছে সৈয়দ কে দিয়ে। পাতা খুঁজতে খুঁজতে শহীদ মিনারের দিকে যায়। সেখানে এক লোককে দেখতে পায়।স্যুট ব্যুট পরা; দেখে ভদ্রলোক মনে হলো। চোখে মুখে হাসি লেপ্টে আছে। অদ্ভুত তো! একাই হাসছে কেন? পাতা এগিয়ে যায়। এদিকটায় জনমানব খুব একটা নেই। সে এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে জিজ্ঞেস করে একটা বাচ্চাকে দেখছে কি না। ছয় বছরের; এই স্কুলেরই।
আকাশ সানগ্লাস খুলে মুচকি হেসে পকেট থেকে ফোনটা বের করে পাতার দিকে বাড়িয়ে দেয়। পাতা ভ্রু কুঁচকে ফোন হাতে নেয়। ভিডিও কলে কেউ আছে ফোনের ওপাশে। পাতার চেনা পরিচিত মুখ! সাথে জ্ঞানহীন ভোর! ভোরের গলায় ছুরি ধরে ওপাশের লোকটা বিশ্রী ইঙ্গিত করে হাসে। ঘৃণায় পাতার গা গুলিয়ে আসে। হাত থেকে ফোনটা পড়ে যেতে নেয় আকাশ ধরে ফেলে। পকেটে পুরে বলে,
-” মিসেস অরুণ সরকার! আপনি বুদ্ধিমান। আশাকরি কিছু বলতে হবে না। টু শব্দ করবেন তো আপনাদের কলিজার টুকরা স্যরি কলিজার গলা আলাদা হয়ে যাবে ঘার থেকে!”
পাতার গা শিউরে ওঠে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগে।কি করবে সে? ভোরের বাবাকে কল করবে একটা? মেসেজ দেবে?ভোর ওদের কাছে গেলো কি করে? পাতা যেন জ্ঞানবোধ হারিয়ে ফেলে। কি করবে বুঝতে পারে না। আকাশ হাঁটতে থাকে। পাতা রোবটের ন্যায় পিছু পিছু। যাওয়ার পথে সদ্য চেনা লোকটাকে দেখতে পায়। লোকটা এগিয়ে আসছে। হঠাৎ পাতার মস্তিষ্ক সচল হলো যেন। সে লোকটাকে কিছু ইশারা করে আকাশের পিছনে হাঁটে! স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে বাইরে আসে। ব্যস্ত রাস্তার পার্কিং জোনে একটা দন্ডায়মান কালো গাড়ির সামনে দাঁড়াতেই। দরজা খুলে গেল। পাতা দেখতে পায় ভেতরে শুক্লা , তাঁর ছেলে শামীম ও আরো দুইজন অপরিচিত লোক! সবার চাহনি বিশ্রী। পাতা আশেপাশে তাকায়। ব্যস্ত রাস্তা। লোক সমাগমও চোখে পড়ার মতো। সে কি সবার থেকে হেল্প চাইবে? চিল্লিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ভোরকে বাঁচাতে পারবে? ওরা পাতার চিল্লানো শুনে ভোরের কোনো ক্ষতি করবে না তো?আকাশ তাঁর মনোভাব বুঝতে পেরে পাতাকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিসিয়ে বলল,
-” চিল্লাবে? কেরি ওন! বাট সাবধান হ্যাঁ ছেলেটার গলায় ছুরি চালাতে সেকেন্ড সময় লাগবে না। তুমি লোক জড় করবে আমরা ওকে….! তারপর কি হবে? আমরা পালাতে পারবো না ভেবে হেসে লাভ নেই। পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে আবার ছেঁড়েও দিবে! কিন্তু ছেলে হারালে ছেলে পাবে?”
পাতা গমগমে গলায় হিসহিসিয়ে বলে,
-” আমার ছেলে কোথায়?”
শুকলা তার গায়ের চাদরটা একটু সরিয়ে ভোরের একাংশ দেখিয়ে বলে,
-” মামনি জলদি এসো? দেড়ি করলে কিন্তু…”
হাতের ধারালো ছুরি ভোরের বাহুতে বসিয়ে পরনের ব্লু জ্যাকেট ছিঁড়ে নরম ফর্সা হাতে ছুঁড়ি দাবিয়ে সরিয়ে আনে। গলগলিয়ে তাজা রক্ত বেরিয়ে পরে! পাতা সেকেন্ডের মাঝে গাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। আকাশ মুচকি হেসে ফ্রন্ট সিটে বসে ড্রাইভারকে গাড়ি চালানোর নির্দেশ দেয়।
দূরে রাস্তার অপর পাশের ফুটপাতে সেই লোকটা ঘাম মুছে ফোন বের করে কল লাগায়! কানে ব্লুটুথ ডিভাইস সেট করে নিজ বাইকে বসে স্টার্ট দেয়! কল রিসিভ হওয়া মাত্রই এ টু জেড গড়গড় করে বলে দেয়।
-” বস? কিছু বলুন? চুপ করে আছেন কেন?”
পরপর কিছু ভাঙ্গার শব্দ ভেসে আসে ওপাশ থেকে। ঝন ঝন কাচ ভাঙার শব্দ। দিদার ভয় পায়! বস ক্ষেপেছে! সে বস ডেকে উঠতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে,
-” তোমাকে পড়ে দেখছি! ফলো দেম! আ’ম অন দা ওয়ে। ওদের দুজনের গায়ে তিল পরিমাণ জখমের অস্তিত্ব মিললে ওদের কবরের সাথে তোমার কবর কনফার্ম!”
শান্ত গলায় বললেও মনে হলো সিংহের গর্জন শুনলো দিদার। ঢোক গিলে দক্ষ হাতে বাইক চালিয়ে ফলো করে কালো গাড়িটিকে।
চাপা হাসির শব্দে গমগমে অবস্থা বিরাজমান গাড়িতে।ছোট জ্ঞানহীন ভোরকে বুকে জড়িয়ে পাতা গুটিসুটি মেরে বসে আছে। গাড়ি স্টার্ট করার পরপরই সে শুকলার কোল থেকে ভোরকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়েছে।
তার পাশে বসে শুকলা মন্ডল। সামনে আকাশ ও ড্রাইভার।পেছনে শামীম সহ আরো দুজন লোক। তারা সবাই নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করছে। পাতা সব শুনেও চুপচাপ বসে আছে।একটা কথাও বলে নি। কু*ত্তার বাচ্চাদের সাথে ঘেউ ঘেউ করার মানে নিজ বিপদ ডেকে আনা। সে শুধু সুযোগের অপেক্ষায়! শুকলা মুচকি হেসে নিজ পাকা ছোট ছোট দাড়িতে হাত বুলিয়ে পাতার ওড়না হাতে নেয়। পাতার কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া শ্বেতজল সেই ওড়নার কোনা দিয়ে মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,
-” ইশ্! মামুনি শীতের ভিতরেও ঘামছে! দেখো দেখি কান্ড ভয় পাচ্ছো কেন? আমরা কি তোমার পর? শা*লী এখন ভয় পাচ্ছিস কেন? তখন লাগে নাই! **** ভরা শালিশে যেভাবে অপমান হইছি তাঁর চেয়ে ও ভয়ঙ্কর অপমান বোধ তোরে না করাইছি তো আমার নাম শুকলা না।”
পাতা মুখ বুজে সহ্য করে। ভোরকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে চুমু দেয় কপালে। শুকলা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-” কিরে পাতা? তোর সেই তেজ কই গেলো? এতো কিছু বললাম এখনো চুপ! আগে না সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে তেড়ে আসতিস হুম? তোর বুইড়া জামাই তে*জ কমাইছে? *** এতো পাওয়ার! আমারো কিন্তু কম না রে! অতি শিগগিরই দেখতে পারবি! তোর জামাইয়ের থাইকাও বেশি সু*খ দিমু! তুই খুশি হইয়া আর জামাইয়ের নাম মুখেই নিবি না। খালি শুকলা কাকু কাকু করবি! ভয় পাইস না!”
পাতা তাচ্ছিল্যের চোখে চায়। অধর বাঁকিয়ে হাসেও অল্প।
-” ভয় হচ্ছে! তবে তোদের জন্য। অরুণ সরকারকে পুরোপুরি জানিসই না তোরা! সব কটা শু*য়োরদের কলিজা ভুনা করে কুত্তাকে খাওয়াবে। তোদের ***** তেজ ছুটিয়ে দেবে। জীবনে আর বারো***র দরকার হবে না।”
শুকলার চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে। মাথার স্কার্ফের উপর দিয়েই পাতার চুলের মুঠি টেনে ধরে শক্ত করে। পাতা ব্যাথা পায় তবে তাঁর চোখ মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। শক্ত চোয়ালে এ যেন তেজস্বী রূপ। শুকলার দিকে এমন ভাবে তাকিয়েছে যেন নজরেই ভস্মীভূত করে দেবে। আকাশের ভালো লাগলো বেশ। সে পেছনে ঘুরে তাকিয়ে থাকে পাতার দিকে পলকহীন। শুকলাকে ইশারায় ছেড়ে দিতে বলে। শুকলা দাঁতের কপাটি পিষ্ট করে পাতাকে খি*স্তি দেয়। পাতা এক রাশ ঘৃণায় তার মুখের উপর থুতু ফেলে। শুকলা সহ শামীম রেগে তেড়ে আসবে আকাশের হুকুমে শান্ত হয়। আকাশ পাতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
-” ইউ আর টোটালি আ আইটেম! আ’ম ইমপ্রেসড! ফুপা? স্যরি হ্যাঁ এটা আমার!”
শুকলা কিছু বলবে আকাশ তোয়াক্কা না করে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,
-” কি যেন বললে অরুণ সরকার কি করবে? আমি বলছি তোমায়! ওই ***** বা** কিচ্ছুটি করতে পারবে না। তোমার এই আদরের সৎ ছেলের উপর যে কুকুর হামলা হয়েছিল এই আমরাই করেছিলাম। কি করেছে তোমার অরুণ সরকার? বা** টাও ছিঁড়তে পারে নি।”
বলেই হো হো করে হেসে ওঠে। তার সাথে যোগ দেয় বাকি সবাই। শুধু শুকলার চোখে মুখে বিরক্তি। আর পাতার চোখে মুখে আকাশসম অবাকতা।
অরুণ হেলে পড়েছে পশ্চিম দীগন্তে। বেলা চারটা দশ/কুড়ি ঘড়িতে। শীতকালের রজনী দীর্ঘ এবং দিবাকাল পরিসরে ছোট। তাইতো বিকেল গড়ানোর সাথে সাথেই পশ্চিম দীগন্তের অরুণের তেজ কমতে শুরু করেছে। ধোঁয়ার ন্যায় কুয়াশার আগমন ঘটছে ক্ষীণ পরিসরে। জনমানবশূন্য এক নিরিবিলি পরিবেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একতলা বাড়িটি। বাড়িটির আশেপাশে কোনো বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে না! বাঁশের ছোপ ও নিমগাছের আড়ালে ঢেকে আছে বাড়িটি। ভিতরের পরিবেশ গমগমা! সেদিনের ন্যায় আজকেও মহল জমেছে ঢের। বিদেশী ড্রিঙ্কসের সাথে চানাচুর ও বাজার থেকে কিনে আনা গরম গরম পেঁয়াজি! ঢক ঢক করে ড্রিঙ্কস গলা দিয়ে কোনো মতে নামিয়ে মুখ কুঁচকে ন্যায় আকাশ! একটু দূরে হাত মুখ বাঁধা পাতার দিকে তাকিয়ে চুমুর ভঙ্গিমা করে। পাতা রক্তিম চোখে চায়। চোখে তার পানি টলমল করলেও সেই পানি দূর্বলতার নয় মোটেও! চোখের সামনে ভাসমান মানুষরূপী উগ্র জা*নোয়ারদের প্রতি আকাশসম ক্ষোভ! শীতে কম্পমান ভোরের উদাম দেহ! করুণ চোখের চাহনিতে পাতার বুকটা জ্বলছে দাউদাউ করে। সেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনের লেলিহান শিখায় পাতা ছটফট করতে থাকে। তাঁর সামনে তাঁর ছেলেকে এক প্রকার টর্চার করছে কু*ত্তার দল!
ভোরের গায়ের ব্লু ব্লেজার, শার্ট খুলে রেখেছে।পরনে স্কুল ইউনিফর্মের প্যান্ট শুধু।ছেলেটা শীতে কাঁপছে তাঁর উপর ছেলেটার গায়ে বরফ মাখছে শুকলা; সাথে তার বিশ্রী চাহনি। ভোরের চোখেও পানি টলটল করছে তবে কাঁদছে না সে। দাঁতে দাঁত চেপে ফোঁস করছে। ভোরের ফর্সা গায়ে নীল নীল দাগ দেখা যাচ্ছে।পাতা পারে না ছুটে এসে ভোরকে বুকের মাঝে লুকিয়ে ফেলতে। তাঁর হাত পা মুখ বাঁধা। পাতার ছটফটানি বেড়ে যায়। চিল্লানোর চেষ্টা করে; মুখে কাপড় বাঁধা থাকায় শুধু গোঙানির শব্দ বেরোয়। ভোর সেই শব্দে ফুঁপিয়ে ওঠে। বাকি সবাই হেসে ওঠে। শুকলা বরফ টুকরো ফেলে ভোরের চুল মুঠোয় ভরে পেছন দিকে টেনে ধরে। ব্যথায় ভোরের মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের হয়। পাতা জ্বলে উঠলো। শুকলা হেসে তাঁর উদ্দেশ্যে বলে,
-” এখনো সময় আছে রাজি হয়ে যা! বাচ্চাটার কষ্ট চোখে পড়ছে না? নাকি সৎ ছেলে দেখে বুকে লাগছে না! ইশ্ কি কষ্ট!”
পাতা হাত পা ছোটানোর চেষ্টা করে হিসহিসিয়ে কিছু বলে। মুখে কাপড় বাঁধা থাকায় তা অস্পষ্ট। তবে শুকলা, আকাশসহ বাকি সবাই অনুমান করতে পেরে হেসে কুটিকুটি। শামীম উঠে পাতার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
-” আকাশ ভাই কি নাটক শুরু করলে? জোরজবরদস্তির মজাই আলাদা! কিন্তু তোমার তো আবার অনুমতি চাই! ওই অরুণ সরকার একবার খোঁজ পেলে তখন আঙ্গুল চু*ষিও!”
বলেই পাতার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর গালে হাত বুলাতে থাকে। পাতা যেন ক্ষ্যাপা বাঘিনীর ন্যায় গর্জে উঠলো। আকাশ মজা পায় বেশ! সে সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে সুখটান দিয়ে বলে,
-” আপোষেই তো আসল সুখ ভাই! আর অরুণ সরকারের ভয় পাচ্ছিস? শা** এতো দিন চিরুনি অভিযান চালিয়েও ছায়া মাড়াতে পারলো না! আজ চলে আসবে? হোয়াট আ জোক?”
হেসে উঠলো সে। তবে ভোরের চাহনিতে তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ে। সিগারেটের ধোঁয়া ভোরের মুখের উপর ছেড়ে বলে,
-” কি বেটা?”
পরবর্তী ঘটনায় সবাই বাক হারা। আকাশ চোখ চেপে ধরে আছে একহাতে। অসহ্যনীয় ব্যথায় সে চেঁচিয়ে ওঠে। ভোরের চোখ মুখ রক্তিম!হাতে জলন্ত সিগারেট ফেলে দৌড়ে যায় পাতার কাছে; মুখের বাঁধন খুলে দেয়। শামীম শুকলা সবাই আকাশকে নিয়ে ব্যস্ত হয়। আকাশ ব্যাথায় কাতর! ভোরকে উদ্দেশ্য করে ভয়ঙ্কর গালির বর্ষণ করছে। শামীম আকাশের চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দেয়! আকাশের বন্ধ চোখ বেয়েই তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুর ন্যায়। আকাশ ব্যাথায় চিল্লিয়ে বলে,
-” শু*য়োরের বাচ্চাটারে ধর! ওর হাত কে*টে নেব আমি!”
শামীম ক্ষিপ্র গতিতে ভোরের দিকে এগিয়ে যায়। ভোর ততক্ষণে পাতার হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছে। শামীমকে তেড়ে আসতে দেখে ভয় পায় সে। পাতাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে ‘আম্মু আব্বু’ বলে কাঁদতে শুরু করে। পাতা ভোরকে জড়িয়ে ধরে না। সে পায়ের বাঁধন খোলার চেষ্টায়। শামিম এসে ভোরের বাহু ধরে টানতে থাকে সর্বশক্তি দিয়ে; সাথে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ। ভোর একহাতে পাতার গলা শক্ত করে ধরে করুণ চোখে চেয়ে ‘আম্মু’ বলে কাঁদে! পাতা চোয়াল শক্ত করে; ভেঙে পড়ে না। ঠান্ডা মাথায় পায়ের রশি খুলে ভোরকে একহাতে আগলে নেয়। শামীম যে হাতে ভোরের বাহু শক্ত করে ধরে রেখেছে সেই হাতে কামড় বসিয়ে দেয় সর্বশক্তি দিয়ে। শামীম হাত ঝটকায় ছাড়িয়ে নেয়। মাংস তুলে নিয়েছে একবারে!
সে হাত বাড়িয়ে পাতার চুলের মুঠি ধরে টেনে তোলে। পাতা ভোরকে ছাড়িয়ে পেছনে লুকিয়ে রাখে। উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষ্যাপা দুর্বাসার ন্যায় শামীমের দিকে চায়! শামীমের গোপনাঙ্গ বরাবর হাঁটু দিয়ে আঘাত করে। পাতাকে ছেড়ে ব্যাথায় গুঙ্গিয়ে উঠে ফ্লোরে বসে পড়লো সে। বাকি সবাই এদিকে তাকায়! আকাশ হুকুম দেয় পাতা ভোরকে ধরার! শুকলা অকথ্য ভাষায় খি*স্তি দিয়ে পাতাকে ধরার জন্য এগিয়ে আসে। পাতা পালায় না। ভোরের একহাত শক্ত করে ধরে সেও এগিয়ে আসে। ফ্লোর থেকে বিদেশী মদের বোতল তুলে শুকলার মাথায় আঘাত করে নিমিষেই। বোতল ভেঙে শুকলার মাথা থেঁতলে যায় কিছুটা। বোতলের ভিতরের পানীয়তে মেখে যায় শুলার শরীরের কিছু অংশ!সেও ফ্লোরে বসে পড়লো। বাকি দু’জন আকাশকে ছেড়ে এগিয়ে আসলে পাতা ভাঙ্গা বোতলের অংশ টুকু তাদের দিকে তাক করে ঠান্ডা গলায় বলে,
-” মেয়ে বলে কম ভাবিস না! এগোবি তো জান হারাবি! আমি নারী কোমলমতি! তবে তোদের মতো জা*নোয়ারদের সামনে আমি নারী হিংস্র পশুর চেয়েও ভয়ঙ্কর!”
শুকলা মাথায় আঘাত প্রাপ্ত স্থানে হাত দিয়ে চেপে ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-” শা** বারো**** তোর হিংস্রতার মায়েরে ***! এই ধর মা***!
পাতা ভোরকে নিজের পেছনে লুকিয়ে নিরাপদ দূরে সরিয়ে দেয়। ভোর ‘ও আম্মু’ বলে কাঁদতে থাকে। পাতা শুকলার ভুরি ওয়ালা পেটে লাথি দেয় সর্বশক্তি দিয়ে। শুকলা পড়ে যায় ফ্লোরে।বাকি লোক দুটো পাতার দিকে তেড়ে আসলে পাতা ভাঙ্গা বোতল তাক করে ভয় দেখায় লোক দুটোকে। এগিয়ে এসে আরেকটা বোতল তুলে দৌড়ে আকাশের সামনে গিয়ে তৎক্ষণাৎ তার মাথায় আঘাত করে। আকাশ যেন বুঝে উঠতে পারছে না কি হচ্ছে! চোখে অসহ্যনীয় জ্বালায় তার মাথার আঘাত কিছুই মনে হয় না। সে হাত বাড়িয়ে পাতার গলা চেপে ধরে। পাতা ঘাবড়ে যায়। আঘাতে জর্জরিত এই জা*নোয়ার তাকে আক্রমণ করবে বুঝতে পারে নি। ভোর ‘আম্মু’ বলে এগিয়ে আসতে নিলে পাতা নিষেধ করে দূরে যেতে বলে। ভোর আসে না আবার দূরেও যায় না।
বাকি দুটো লোক এগিয়ে এসে পাতাকে ধরে।দুই বাহু ধরে ফ্লোরে ঘার ঠেসে বসিয়ে দেয়। পাতা চুপচাপ বসে। এখন ঘাবড়ানো যাবে না। মাথা ঠান্ডা রেখে চাল চালতে হবে। পরিস্থিতি অনেকটাই তার নিয়ন্ত্রণে! শুকলা, শামীম আর আকাশ নামক লোকটা জখমিত! তাঁরা ক্ষেপে ওঠার আগেই পাতাকে কিছু করতে হবে! পাতা চোখ তুলে ভোরের দিকে এক নজর চায়। মাথায় কিছু আসতেই ফ্লোরে তাকায়! ওই তো আধ পোড়া জলন্ত সিগারেট তার পাশেই দামি লাইটার। পাতার কিছু প্ল্যান করে। তবে দুজন পুরুষের সাথে পাতা পেরে উঠবে না কখনো! কি করবে পাতা? ওদিকে শামীম ফ্লোর থেকে উঠে বিকৃত মুখে এগিয়ে আসছে! শুকলা ফ্লোরে শুয়ে আছে। জ্ঞান হারিয়েছে নিশ্চয়ই! আকাশ নামক লোকটাও সোফা ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক হাতে চোখ চেপে। তার মাথা বেয়ে তাজা রক্ত পড়ছে যেন কেউ ঢেলে দিচ্ছে। রক্ত দেখে পাতার পেট গুলিয়ে আসে! পাতা শ্বাস নিতেও ভুলে যায়!
পাতাকে ধরে রাখা দুজন লোকের মধ্যে একজন পাতাকে ছেড়ে রশি আনতে যায় বাঁধার জন্য। পাতা আটকে রাখা শ্বাস ছাড়ে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুলে না। দূর্বল পাতার মাঝেও যেন এক ক্ষ্যাপা সিংহীর আবির্ভাব ঘটে! পাতা এক দুই তিন কাউন্ট করে পাশের লোকটাকে ঝটকায় সরিয়ে ধাক্কা দেয়। লোকটা কয়েক কদম পিছিয়ে যায়! পাতা ফ্লোর থেকে লাইটার তুলে আকাশের দিকে তেড়ে যায়। আকাশ হাত তুলে, কষে থাপ্পড় মারার উদ্দেশ্যে । পাতা তড়িৎ বেগে লাইটার জ্বালিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারে! মদে ভেজা শার্টটায় আগুন জ্বলে উঠলো দাউদাউ করে! আকাশ গলা কাঁটা মুরগির ন্যায় ছটফট করতে করতে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো। শুকলার নড়চড় নেই! শামীম আকাশকে নিয়ে ব্যস্ত। বাকি দুই লোক পানি আনতে গেল বোধহয়! পাতা ভোরের কাছে এগিয়ে এসে কোলে তুলে নেয়! দরজার দিকে এগোবে শামীম সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলে,
-” শা*** পালাবি? তোরে জীবন্ত দগ্ধ করবো!”
পাতা ঢোক গিলে পিছু হটে। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে একটা খোলা ঘরের দিকে ছুটে যায়। শামীম খুঁড়তে খুঁড়তে তাঁর পিছনে যায়। হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। মা*** জায়গা মতো বসিয়েছে!
পাতা একটা ঘরে ঢুকে ভোরকে নামিয়ে দরজায় ছিটকিনি আটকাবে শামীম ঠেলে ভিতরে ঢুকতে নেয়। পাতা কাঁধ দিয়ে দরজা ঠেলে দেয়; হাত দিয়ে ছিটকিনি আটকানোর প্রচেষ্টায়। ভোরও সহায়তা করে। পাতা সফলকাম হয়। ছিটকিনি দুটো আটকে কাঠের টেবিল টেনে দরজার সম্মুখে রাখে। জানালার গ্লাস আটকে পর্দা টানিয়ে দেয়। বড় বড় শ্বাস ফেলে হাঁপাতে থাকে। ওপাশে শামীম দরজা আঘাত করে গালিগালাজ করতে ব্যস্ত। ভোর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে পাতার পাশে দাঁড়িয়ে। পাতার চোখেও নোনাজল ভিড় জমায়। ধপাস করে ফ্লোরে বসে। দুই হাত মেলে ভোরকে ডাকে। ভোর দেড়ি করে না ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাতা আগলে ন্যায় ভোরকে। বরফ শীতল শরীরটাকে বুকে শক্ত করে চেপে ধরে। পাশে বিছানার চাদর টেনে নামিয়ে ঢেকে নেয়। ভোরের গালে মুখে এলোপাথাড়ি চুমু দেয়। ভোরের কান্না থেমে যায় ধীরে ধীরে। তবে তার শরীর কম্পমান। ক্ষণে ক্ষণে ফুঁপিয়ে উঠছে। পাতা ভোরের মাথায় চুমু দিয়ে বলে,
-“আমার ছেলেটা কতটা সাহসী ভাবা যায়!! ওই লোকটার চোখে জলন্ত সিগারেট চেপে ধরেছে! ভয় লাগে নি? এই বুদ্ধি আসলো কিভাবে এই ছোট্ট মাথায়?”
ভোর জবাব দেয় না। চুপচাপ থাকে। পাতা আবার চুমু দিয়ে বলে,
-” আমার বাবা ভয় পাচ্ছে?
ভোর নাক টানার শব্দ হয়! পাতার বুকের মাঝে লুকিয়ে গুটিসুটি মেরে বিড়বিড় করে বলে,
-” উঁহু! ভোরের আম্মু আছে তো!”
পাতা এপর্যায়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। গুনগুনিয়ে করে কেঁদে দেয় হালকা স্বরে। সব তাঁর জন্য!! সব দোষ তার! তাঁর দোষে অরুণ সরকারকে জুড়ে তাঁর নামে কুৎসা রটানো হলো। ভরা শালিশে হেন্যস্থ হয়ে কি দরকার ছিলো অরুণ সরকারকে কল করার? নিজে লড়তি নিজের লড়াই! না পারলে মাথা নত করে ক্ষমা চাইতি! চুন কালি মাখিয়ে লুকিয়ে থাকতি ঘরের এক কোনায়। লোকটাকে ডেকে তার সাথে নিজ নাম জড়ানো পাতার ভুল ছিলো! সেই ভুলের খেসারত এই নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে দিতে হচ্ছে বারংবার!
দিদার দরজা ধাক্কায় অনবরত! দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করে। এখানে এসেছে প্রায় ঘন্টা খানিক। বসের ওয়াইফ ও বাচ্চাকে নিয়ে জা*নোয়ারের দল ভিতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে; আর কেউ বের হয় নি, না ভেতরে কেউ প্রবেশ করেছে। সে ভেবেছিল ভিতরে ঢুকে একটা ব্যবস্থা করবে কিন্তু বস মানা করে দেয়! সে আসবে তাঁরপর। তবুও সে পুরোটা সময় সজাগ ছিলো। পুরো বাড়ি ঘুরে কান পেতে ছিলো। কোনো প্রকার গন্ডগোলের আভাস পেলেই সে ভিতরে ঢুকে যাবে। ইশ্ বন্দুক টা কেন সাথে রাখলো না আজ! তাহলে এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হতো না।
হঠাৎ চিল্লাচিল্লির আওয়াজে দিদার দরজা ধাক্কানো শুরু করে। কান খাঁড়া করতেই বুঝতে পারে আওয়াজ পুরুষালী গলার! কি হচ্ছে ভেতরে? সে দরজায় লাথি মেরে ভাঙার চেষ্টা করে যায়। কাঠের শক্ত দরজা হওয়ার দরুণ খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। তবে চেষ্টায় বহাল সে। গাড়ির গর্নের আওয়াজে থামে সে। তিনটে গাড়ি এসে থামলো।দুটো সেনা গাড়ি থেকে বের হয় পোশাকধারী সৈনিকদের দল। অপর জিপ থেকে দুজন লোক! দিদার চেনে একজনকে। বসের বন্ধু। সে এগিয়ে যায়।
রাসেল গম্ভীর মুখে কিছু সেনাকে আদেশ করে বাড়ি ঘেরাও করতে। বাকি গুলোকে দরজা খুলতে বলে এগিয়ে এসে দিদারকে জিজ্ঞেস করে,
-” পরিস্থিতি কেমন? সব ঠিকঠাক?”
দিদার জবাবে বলে,
-” কিচ্ছু ঠিক নেই স্যার! ভিতর থেকে পুরুষের চিল্লানোর আওয়াজ ভেসে আসছে। আমি দরজা ভাঙার ট্রাই করেছি পারি নি। এদিকে আমার হাত ফাঁকা! বস কতদূর?”
-” এই তো এলো বলে!”
তখনই আরেকটা গাড়ি এসে থামে রাস্তার ধারে। গাড়ি থামতেই যেন ছুটে বেরিয়ে আসে অরুণ সরকার। পেছনে আরিয়ান, মুস্তাকীম, শুভ ও ফয়সাল! রাসেল ফোন করে জানিয়েছে ক্ষ্যাপাটে ষাঁড়কে একা না ছাড়তে। তাই তাদের আগমন! অরুণ ক্ষিপ্রতার সাথে এগিয়ে এসে দিদারের গালে সপাটে চর মেরে ধমক লাগালো তার গাফিলতির কারণে। দিদারুল আহসান চুপচাপ সয়ে নেয়। এটা তাঁর প্রাপ্য ছিল বোধহয়। আরিয়ান এসে ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে শান্ত হতে বলে। অরুণ শান্ত হয় না, এগিয়ে যায় দরজার দিকে। ততক্ষণে দরজা খুলে ফেলেছে এক দক্ষ সেনা! রাইফেল তাক করে সশস্ত্র তাঁরা ভিতরে প্রবেশের প্রস্তুতি নেয়। অরুণ তাদের টপকে এগিয়ে যায়! চোখ বুলায় পুরো ড্রয়িংরুমে। ভাঙ্গা মদের বোতলের টুকরো ফ্লোর জুড়ে। একপাশে পেটমোটা লোক পড়ে আছে। অরুণের চিনতে অসুবিধা হয় না ওটা শুকলা মন্ডল! সোফার উপর বসে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে আকাশ! তার তাজা রক্ত বেয়ে পড়ছে কপোল ঘেঁষে। কাঁধের দিকটায় কালচেভাব! পুরে গেছে!! এদের এই অবস্থা কে করেছে? এই দু’জনেই? আর সবাই কই? অরুণ এদিকে ওদিকে তাকিয়ে ভোর, পাতাকে খোঁজে। দেখতে পায় না। সে সোফায় কাতরাতে থাকা আকাশকে টেনে ফ্লোরে ছিটকে ফেলে পেট বরাবর লাথি লাগায় লাগাতার! গলায় পারা দিয়ে ক্ষোভে ফেটে গর্জে ওঠে,
-“এই কু***বাচ্চা! ওরা কই?”
রাগে কথা জড়িয়ে আসছে। চোখ মুখের আদল ভয়ঙ্কর!যেন কোনো অসুর ভর করেছে! অরুণ পা পিষতে থাকে। আকাশের মুখটা রক্তিম হয়ে উঠছে। যেকোনো সময় জান পাখি বেরিয়ে যাবে। সে কোনমতে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বন্ধ ঘরের দরজার দিকে। অরুণ এক নজর সেদিকে তাকালো। আকাশের গলা থেকে পা সরায় না। ওদিকে আকাশের চোখ উল্টে গেছে। এক সেনাসদস্য এসে অরুণকে সরিয়ে দেয়। আকাশ ছাড়া পেতেই জোড়ে শ্বাস টানে। নাক মুখ দিয়ে রক্ত উঠে আসে। অরুণ আবার তেড়ে আসে, সেনা সদস্য আটকায়! অরুণ শুকলার দিকে এগিয়ে যায়! চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা ভুরিটায় লাত্থি দেয় সজোরে। শুকলা দূর্বল চোখে তাকিয়ে থাকে। হাঁউমাঁউ করে কেঁদে অরুণের পা জড়িয়ে ধরে। অরুণ তার ছোট চুল মুঠোয় ভরে গর্জন করে বলে,
-” আমার ছেলে কই? এই শু*য়োরের বাচ্চা? পাতা কই?”
শুকলা মাথা নেড়ে বোঝাতে চায় সে জানে না! ক্ষ্যাপাটে অরুণ বুঝলে তো!চুল টেনে মুঠ পেতে শক্ত হাতে নাক বরাবর ঘুষি মারে। শুকলা ছিটকে পড়ে ফ্লোরে। ব্যাথায় বাচ্চাদের মতো কেঁদে দেয়।
সেনা সদস্যরা বাড়িতে উপস্থিত আরো তিনজনকে খুঁজে বের করে বাথরুম থেকে। তাদের টেনে বের করে ড্রয়িংরুমে আনে। অরুণ শুকলার থেকে দৃষ্টি তুলে শামীমের দিকে তেড়ে যায়! নাক বরাবর পরপর এলোপাথাড়ি ঘুষি মেরে চুলের মুঠি ধরে টেনে দেয়ালে মাথা ঠুকে দেয়। শামীম চিল্লিয়ে ক্ষমা চায়! অরুণকে বাপ বাপ বলে ডাকে। অরুণ ছাড়ে না। পরপর তিনবার শামীমের মাথা দেয়ালে মাথা সজোরে আঘাত করে! দাঁত কপাটি পিষে রাশভারী গলায় বলে,
-” অরুণ সরকার শুদ্ধ পুরুষ! নিজ ঘর ব্যাতিত অন্য ঘরে যায় নি যে তোর মতো কুলাঙ্গার বাপ বলে ডাকবে! আরেকবার ডাকলে জিভ কেটে নিবো!”
বলেই শামীমকে ছিটকে ফেলে ফ্লোরে। বাকি দু’টোকেও উত্তম মধ্যম দেয়। রাগে তার মুখাবয়ব রক্তিম! কপালের নীল রাঙা শীরা উপশীরা দেখা যায়।হাতের রগ ফুলে আছে। যে হাতে মারছে সেই হাত লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তবুও থেমে নেই অরুণ! একটাকে ছাড়ছে তো আরেকটাকে ধরে মারছে। কেউ থামাতে পারছে না তাকে। অরুণের বন্ধুরাও নয়! এ যেন খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসা হিংস্র সিংহের তান্ডব! তাই তাঁরা সিংহকে থামানোর জন্য তাঁর শাবক ও সিংহীর খোঁজ চালায়। পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজে;পায় না। তখন সবার নজর কাড়ে বন্ধ ঘরটা! সবাই গিয়ে দরজা ধাক্কায়। ‘ভোর’ বলে ডাকে অনবরত। দরজা খোলার নাম গন্ধও নেই। সবাই চিন্তিত হয়! সিদ্ধান্ত নেয় দরজা ভাঙার। উদ্যত হয় কিন্তু তার আগেই দরজাটা খুলে যায়। বেরিয়ে আসে পাতা! তার গলা জড়িয়ে ভোর সরকার! সবাই স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো পাতা, ভোরকে সুস্থ অবস্থায় দেখে। শুভ এগিয়ে পাতার মাথায় হাত রেখে সুধায়,
-” আর ইয়ু ওকে?”
পাতা মাথা নাড়ল। কিছু বলবে এর আগেই কারো আক্রমণের স্বীকার হয়! পাতা ভোরকে শক্ত করে ধরে দুই কদম পিছিয়ে যায়। পড়তেই নিবে সামলে নেয় একজন! অরুণ জাপটে ধরেছে দু’জনকে। কখনো ভোর তো কখনো পাতার গালে চুমু দিতে থাকে এলোমেলোভাবে। বিড়বিড় গলায় থেমে থেমে বলে
-” ঠিকাছো তোমরা? আমি এসে গেছি তো। ভয় পেয়েছিলে? আমি থাকতে কিছু হবে না তোমাদের! আমি আছি তো!”
পাতা ক্ষীন গলায় ‘হুম’ বলে! অরুণ আশ্বস্ত হয় তবে থামে না। ভোরকে কোলে নিতে চায়; ভোর আসে না,পাতার কোলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। অরুণ উদ্ভ্রান্তের মতো একবার ভোরের গালে মুখে ঠোঁটে চুমু দেয় তো একবার পাতার! পাতার এবার অস্বস্তি হয়। আড়চোখে অরুণের বন্ধুদের দিকে তাকালো। সবার চোখে মুখে চাপা হাসি! উপস্থিত সেনাসদস্যরাও বাদ যায় নি। এতক্ষণ যাকে একশন সিনে থামানো যাচ্ছিলো না এখন সে রোমান্টিক মুডে। পাতা উশখুশ করে সরে আসতে চায়! অরুণ ছাড়ে না। ভোরের কপালে ছোট্ ছোট চুমু দিয়ে পাতার থুতনি অধর ছুঁয়ে দেয়! পাতা চাপা স্বরে আতঙ্কিত সুরে বলে,
-” কি হচ্ছে টা কি ভোরের বাবা! সবাই দেখছে!”
অরুণ থেমে যায় মুহুর্তের জন্য আবারো পাতার কপালে চুমু দিয়ে ভোরের চোখে মুখে চুমুর বন্যা বইয়ে দেয়।
শুভ বাদে অরুণের বাকি বন্ধুরা আর চুপ করে থাকে না। সমস্বরে চেঁচিয়ে বলে,
-” কি হচ্ছে টাকি ভোরের বাবা? আমরা সবাই দেখছি তো!”
বলেই হেসে দেয়। অরুণ সরে এসে পায়ের শু খুলে তাদের দিকে ছুঁড়ে বলে,
-” দেখছিস কেন? বেরিয়ে যেতে পারছিস না? কতটা ভয় পেয়েছিলাম আমি! আরেকটু হলে হার্ট অ্যাটাকে পগারপার যেতাম। কেউ নেই তো আমার। এই দুটোই বেঁচে থাকার সম্বল। ওদের কিছু হলে কিভাবে বাঁচতাম? বাড়াবাড়ি লাগে তাই না? ন্যাকামি! একা থাকা খুবই যন্ত্রণার বুঝলি! আমি আর একা থাকতে চাই না। না কাউকে হারাতে চাই!”
থামে অরুণ! শার্টের হাতার কোনা দিয়ে অল্প জমা চোখের জল মুছে নেয়। পাতার দিকে ফিরে ভোরকে বুকে টেনে নেয়। পাতার চোখের পানি মুছে দিতে হাত বাড়ায়!
পাতা বাহার পর্ব ৪৯
পাতা টলমলে চোখে যায়! সবকিছু কেমন ঝাপসা ঝাপসা লাগে। পেট গুড়গুড় করে। বেরিয়ে আসতে চায় নাড়িভুঁড়ি! পাতা গলগলিয়ে বমি করে দেয়! অরুণ ভোরকে নামিয়ে পাতাকে ধরে। ভোর ‘আম্মু আম্মু’ ডাকে। অরুণও ডাকে! পাতার কানে বাজে সব কিন্তু প্রতিত্তর করতে পারে না। শরীর কেমন অসাড় হয়ে যায়। পেটে চিনচিনে ব্যথা হয়। চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। বসে পড়ে পাতা; অরুণের বাহুতে মাথা এলিয়ে চোখ বুজে নেয় নিমিত্তে। আর তো ভয় নেই! এখন আছে ভরসা! স্বস্তির জায়গা!