পাতা বাহার পর্ব ৫০
বেলা শেখ
শীতের রজনী! ঠান্ডা হীম বাতাস বইছে। টুপটাপ শিশির কনা পড়ছে। ছোট ভোর চিল্লাচিল্লি করছে অনবরত! তাঁর বাবা চাই! চাই মানে চাই এক্ষুনি। কোনো কথাই শুনছে না। ঘুম থেকে উঠে যখন শুনেছে বাবা নেই, বাজে লোকদের শায়েস্তা করতে গেছে তখন থেকেই তার মনে ভয় গ্রাস করেছে।বাবাকে ওই বাজে লোকগুলো আটকে রাখে যদি? ব্যস তাঁর চিল্লাচিল্লির পর্ব শুরু। পাতা বোঝায়, ভোর বোঝে কিন্তু মানে না। বাবাকে আনো! ভোর বাবার কাছে যাবে! আরিয়ান কোলে নিয়ে এটা ওটা বলে কাজ হয় না। ভোর তার জেদে অনড়।
এদিকে ছেলেটার জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সে ওষুধ খাবে না, বাবা না আসলে। শত অনুরোধ কাজে দেয় নি। পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে! তাঁর শরীরটাও ভালো লাগছে না। হাত পা কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছে ব্যথায়। চুলের গোড়া তীব্র ব্যাথায় টনটন করছে। লোকটা তাদের বাড়িতে এনে আরিয়ান ভাইকে তাদের খেয়াল রাখতে বলে চলে গেছে। বলেও নি কখন আসবে! পাতা ভাবনায় ডুবেছিল। আরিয়ান ভাই প্রথমবার তাদের ছোট্ট সংসারে এসেছে কি খেতে দেবে? তবে তার ভাবনার অন্ত হয় লোকটা সব ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার পাঠিয়েছে একজনকে দিয়ে সাথে একজন মহিলা ডাক্তার! সে ভোরের বাহুর ব্যান্ডেজ খুলে নতুন করে ড্রেসিং করিয়ে ওষুধ দেয়। পাতাকেও চেকাপ করে আরিয়ানের কাছে প্রেসক্রিপশন দিয়ে যায়। আরিয়ান ভাই ফ্ল্যাটের পাশের ফার্মেসি থেকে ওষুধ পত্র আনে। পাতা ততক্ষণে খাবার প্লেটে সাজিয়ে ভোরকে ঘুম থেকে তোলে। পাতা তাকে খাবার খাওয়ায়! ঘুমের ঘোরেই ভোর খেয়ে নেয় খাবার। আরিয়ান ওষুধ পত্র দিলেই তার ঘুম গায়েব হয়। বাবার খোঁজে সে দিশেহারা! পাতা ভোরের সামনে দাঁড়ায়। ভোর সোফায় কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে গাল ফুলিয়ে। আরিয়ান তাঁর পাশে বসে। পাতা শান্ত গলায় ভোরের উদ্দেশ্য বলে,
-” ভোর ওষুধ খেয়ে নাও? প্লিজ? তুমি না গুড বয়?”
ভোর নাকচ করে জেদি স্বরে বলে,
-” আব্বুকে না আনলে ভোর ওষুধ খাবে না! না মানে না!”
-” আর তুমি ওষুধ না খেলে তোমার আব্বু আসবে না! এখন তুমিই ডিসাইড করো ওষুধ খাবে কি না?”
ভোরের কপালে ভাঁজ পড়ে। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,
-” তুমি মিথ্যে বলছো! আব্বুকে আসতে বলো! আব্বু আসলেই আমি খাবো! প্রমিজ!”
-” তাঁর মানে খাবে না?”
শান্ত গলায় বলে পাতা। ভোর পিটপিট করে তাকালো। আম্মু রাগ করলো কি? পাতা টেবিলে থেকে ওষুধের সিরাপ তুলে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। ভোরের গাল আরো ফুলে যায়। নাক মুখ কুঁচকে নিয়ে বলে,
-” আচ্ছা দাও ওষুধ! খাচ্ছি তো! ভোর গুড বয় তাই খাবে।”
পাতা মুচকি হাসলো। চামচে নাপা সিরাপ ঢেলে খাইয়ে দিল। ভোর নাক মুখ কুঁচকে তেতো ওষুধ গলাধঃকরণ করে ওয়াক ওয়াক শব্দ করে। পাতা ফ্রিজ থেকে কমলা এনে আরিয়ানের কাছে দিয়ে বলে,
-” ভাইয়া কোষা ছাড়িয়ে ওর মুখে দিন! আর খেতে আসুন জলদি! খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে যে!”
আরিয়ান কমলার খোসা ছাড়িয়ে এক কোয়া ভোরের মুখে চালনা করে বলে,
-” এখানেই আনো!”
পাতা মাথা কাত করে সায় জানিয়ে খাবার আনতে যায়! ট্রে করে খাবার সাজিয়ে এনে টি টেবিলে রাখে। জগ রেখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আরিয়ান লক্ষ্য করে বলে,
-” তুমিও খেয়ে নাও বড় ভাবী! ভাইয়ের আশার ঠিক নেই! আসবে কি না তাঁরও গ্যারান্টি ন..!”
শেষ না করেই পাশে তাকায় আরিয়ান! ভোর রাগে ফুঁসছে অনবরত! আরিয়ান জিভে কামড় বসিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে হেসে বলে,
-” এই তো এসে পড়বে ভোরের আব্বু!”
ভোর কম্বল সহ সোফা থেকে নিচে নামে! কাঁদো কাঁদো জড়ানো গলায় বলে,
-” মিথ্যে বলেছো তাই না? আব্বু আসবে না? কারো সাথে কথা বলবো না। তোমরা সবাই পঁচা! আব্বুও পঁচা। কেউ ভোরকে ভালোবাসে না!”
কথা শেষ করেই ভোর দাঁড়ায় না। থপ থপ শব্দ করে রুমের দিকে অগ্রসর হয়! গায়ে জড়ানো কম্বল ঝাড়ুর ন্যায় কাজ করে। পাতা তাঁর পিছনে যাবে আরিয়ান মানা করে।
-“এখন গেলে আরো জেদ করবে। একা থাক মাথা ঠান্ডা হবে! তুমি খেয়ে নাও!”
পাতা আর যায় না। আরিয়ান খাবারে মনোযোগী হয়! পাতা কিচেনে গিয়ে প্লেটে খাবার নেয়। ক্ষিধে পেয়েছে বেশ! তবে খেতে ইচ্ছে করছে না। কেমন পেট গুড়গুড় করছে! চোখের পাতায় তাজা রক্ত ভাসছে। খাবার গলা দিয়ে না নেমে নাড়িভুঁড়ি সহ যেন বেরিয়ে আসতে চায়। পাতা অনেক কষ্টে দুই তিন লোকমা গলাধঃকরণ করে হাত ধুয়ে নেয়! এঁটো বাসন কোসন ধুয়ে রাখে!
আরিয়ানেরও ততক্ষণে খাওয়া শেষ! পাতা এগিয়ে এসে বলে,
-” ভাইয়া ওই রুমে গিয়ে রেস্ট নিন!”
বলেই এঁটো প্লেট ট্রে সব গুছিয়ে নিয়ে যায়! সেগুলোও ধুয়ে রেখে দেয়। ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখতে পায় আরিয়ান এখনো সেখানেই বসে। পাতা জিজ্ঞেস করে,
-” ভাইয়া কোনো সমস্যা?”
-” উঁহু।এই যে ওষুধ! খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি এখানেই ঠিক আছি! শুধু একটা কম্বল এনে দাও বড় ভাবী!”
বলে ওষুধ গুলো বের করে দেয় আরিয়ান। পাতা ওষুধ গুলো হাতে নেয়! ভাবে ডাক্তারের পরামর্শ বিনা ওষুধ খাওয়া ঠিক হবে? সে তো এসব বিষয়ে অনভিজ্ঞ। যদি কোন সমস্যা হয়? পাতা ভেবে নেয় ওষুধ খাবে না। ঘরে নিয়ে রেখে দেবে!
আরিয়ান হয়তোবা বুঝতে পারলো পাতার মনোভাব! তাই শান্ত স্বরে আশ্বস্ত করে বলে,
-” ডাক্তার বলেছে নির্দ্বিধায় খেতে পারো ওষুধ গুলো। কিছু হবে না।”
পাতা গোল গোল করে তাকায়! আরিয়ান মুচকি হাসলো সোফায় আরাম করে বসে বলল,
-” আমার ভাতিজি/ভাতিজা আসছে জানি আমি! তুমি ধরা পড়ে গেছো আম পাতা জোড়া জোড়া!”
বলেই শব্দ করে হেসে ওঠে। পাতার কেমন যেন লজ্জা লাগে। হাশফাশ করে! চোখে মুখে অস্বস্তি! কি ভাবে জানলো আরিয়ান ভাই? ডাক্তার মহিলাটি কি তাকে চেকাপ করে বুঝতে পেরেছে? সেই কি জানিয়েছে?
আরিয়ান হাসি থামিয়ে জ্যাকেটের পকেট থেকে একজোড়া চুরি বের করে! পাতার দিকে বাড়িয়ে বলে,
-” ভাইয়ের মেয়ের খুব শখ! ভোরের বেলায় আশায় ছিলো মেয়ে হবে! মেয়ে রূপে মা আসবে শাসন করতে! ডাক্তাররাও জানিয়েছিলো মেয়ে হবে। মেয়ের জন্য সোনার চুড়ি, নুপুর গড়িয়েছিল শখে। কিন্তু ভোর হয়! চুড়ি নুপুর জোড়া রেখে দিয়েছিলো সযত্নে। আনিকা হলে ওকে দিয়েছিল! আমি কিন্তু সেটা মোটেই ফেরত দিবো না! ভালোবাসা ফেরত দেয়া যায় নাকি? আমি দ্বিগুণ ভালোবাসা জড়িয়ে তোমার মেয়ে হলে তাকে সোনাইমুড়ীয়ে দিবো ইনশাআল্লাহ!”
থামে আরিয়ান! আবেগে আপ্লুত পাতার চোখে মুখে আনন্দানুভূতি ঝলক দেয়। একটু লজ্জাও পায়! লাজুক চোখে আরিয়ানের বাড়িয়ে রাখা হাত থেকে ছোট চুড়ি জোড়া নেয়! সুন্দর! একেবারে পিচ্চি হাতের। চুড়িতে ছোট ছোট ঝুনি! রিমঝিম শব্দ করছে। পাতার অধর জুড়ে দোল নেয় মিষ্টি হাসি। আরিয়ান লক্ষ্য করে নিজেও মুচকি হাসলো।
-” ওষুধ কিনে ফেরার পথে জুয়েলারি শপে নজর পরে! কি মনে করে ভিতরে ঢুকি! প্রথমেই নজরে আসে চুড়ি জোড়া। কিনে নিলাম। মেয়ে হবে নাকি ছেলে জানিনা! তবে আশায় থাকবো তোমার কোলজুড়ে জান্নাত আসুক! ভাইকে শাসনে রাখতে একটা মা আসুক! ভাইয়ের কান টেনে সব ভুল ধরিয়ে দিতে স্বপ্না চৌধুরী আসুক!”
পাতার হাসি বিস্তার হয়! কেমন যেন সুখানুভূতি হচ্ছে। সব ভালো লাগছে। হাত পায়ের অসহ্যনীয় ব্যাথা গায়েব হয়ে গেছে। মাথা ব্যথাও ছুটি নিয়েছে। পেটের ভিতরে যেন অসংখ্য রঙিন প্রজাপতি ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ায়। তনুমন জুড়ে এন ভিন্ন ধরনের শিহরণ খেলে গেল যেন! পাতা মিনমিনে গলায় বলে,
-” ভাইয়া আপনি জানলেন কিভাবে? আমি তো ভোরের বাবাকেই বলিনি এপর্যন্ত! আমিও নিশ্চিতও নই! রিপোর্ট আনার কথা ছিল আজকে বিকালে। তার মাঝেই!”
আকাশসম অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে পাতা। আরিয়ান ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হঠাৎ কেমন যেন লজ্জা লাগছে তার! অস্বস্তি হচ্ছে! মনে হচ্ছে দৌড়ে কেটে পড়তে! ইশ্ কি লজ্জা! আরিয়ান মৃদু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে,
-” ওই ওই ডাক্তার ফারিন বললো তো! ভাইকে জানাও নি?”
পাতা লাজুক মুখে মাথা না বোধক মাথা নেড়ে বলে,
-” ভোর ঘরে একা আমি যাই? আপনি রেস্ট নিন!”
বলেই চলে যাবে বাহানা দিয়ে কিন্তু আরিয়ান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
-” ভয় পাচ্ছো ভাইকে তাই না বড় ভাবী?”
পাতা তড়িঘড়ি মাথা নেড়ে অস্বীকার করে। আরিয়ান মৃদু হেসে সিরিয়াস গলায় বলে,
-” ভয় কেন পাবে তুমি? তুমি কি কোন অপরাধ করেছো? যে আসছে সে ভাইয়ের অংশ! তবে তোমার ভয়ের কারণ কিছুটা যথার্থ! শোন ভাইকে ছোট বেলা থেকেই চিনি! একটু উগ্র মেজাজের; রাগ নাকের ডগায় থাকে তবে মনটা খাঁটি। ভোরকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। বলা চলে ভাইয়ের দুনিয়া ভোর! তুমি ভোরের মা!ভোরকে যথেষ্ট স্নেহ করো! তাহলে ভয় আসে কোথা থেকে? নাকি নিজ বাচ্চা এলে ভোরের প্রতি ভালোবাসা কমে যাবে! সেই ভয় পাচ্ছো?”
পাতা চকিত দৃষ্টিতে তাকায়! চোখের কোনায় ভিড় করতে চায় নোনাজল! পাতা নিজেকে সামলে স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দেয়,
-” রূপ আসার পর আনিকার প্রতি আপনার বা রুবি আপুর ভালোবাসা কমে গেছে?”
আরিয়ান কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-” ওদের কথা আসছে কেন? আমি আমার ছেলে মেয়েকে কেন আলাদা চোখে দেখবো? তবে হ্যাঁ আনিকা আমার প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতি জাগিয়েছে সেক্ষেত্রে ও স্পেশাল!”
পাতা মুচকি হেসে বলল,
-” তাহলে আমি কেন আমার দুই সন্তানকে আলাদা করে দেখবো? ভোর আমার প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি জাগিয়েছে! তাহলে সেও নিশ্চয়ই আমার জন্য স্পেশাল! প্লিজ সৎ সম্পর্কের দোহাই দেবেন না।”
আরিয়ান বিস্তর হাসে। পাতার এমন জবাব তাঁকে প্রমাণ করে দেয় মেয়েটা সৎ/ আপন নয়! সে একজন মা!
-” শোন বড় ভাবী ভাইকে ভয় পাও কেন? বরং এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবে যেন ভাই ভয় পায় তোমাকে। পুরুষ ঘরের বাইরে বাঘ হয়ে ঘুরলেও ঘরের রানির কাছে কিন্তু বিড়াল বনে যায়! কিছু টিপস্ দিই তোমাকে! ভাই ধমক দেবে তুমি তাঁর চেয়ে দ্বিগুণ তেজে ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখবে। উঠতে বসতে শাসন করে আঁচলে বেঁধে নিবে! ভাই রেগে থাকলে তাঁর পিছু মোটেও ঘুরঘুর করবে না। বরং ইগনোর করবে! একটু পরে দেখবে ভাই তোমার পেছনে ঘুর ঘুর করছে। ভাই হাসিখুশি থাকলে তুমি মুডি বিহেভ করবে! ভাই তাঁর হাসি ভুলে তোমাকে হাসাতে ব্যস্ত হবে। আজকের জন্য এইটুকুই! বুঝতে পেরেছো?”
পাতা পা নিশপিশ করছে কেটে পড়তে। কি দিন কাল এলো ভাই! দেবরের থেকে জামাইকে বশ করার থিওরি শিখতে হচ্ছে! নাহ্! পাতু তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। তোর তো হিমালয়ে গিয়ে সন্ন্যাস ব্রত পালন করা উচিত। আহম্মক মহিলা! পাতা ব্যাক্কেলের মতো মাথা নাড়িয়ে রুমের দিকে রওনা হয়! ওয়্যাড্রব খুলে মোটা একটা উলের কম্বল বের করে আরিয়ানকে দিয়ে রুমে চলে যায়। আরিয়ান কুঞ্চিত কপালে তার প্রস্থান দেখে। সে জানে তাঁর দেয়া টিপসের টি’টাও মেয়েটা ভাইয়ের উপর ফলাতে পারবে না। ভাই যা বলবে বিনা বাক্যব্যয়ে তাই করবে! সে হতাশ! আজকালকার যুগেও এমন জামাই পাগল মেয়ে আছে?
ভোর ঘুমিয়ে আছে বিছানার মধ্যিখানে। কম্বলে আপাদমস্তক ঢেকে। পাতা তার পাশ ঘেঁষে কম্বলের ভিতরে ঢুকে যায়। ভোরের কপালে হাত রাখতেই ভোর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়। পাতা অবাক হয়! কম্বলসহ ভোরকে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে আদুরে গলায় সুধায়,
-” আমার বাবাটা ঘুমায় নি?”
-” উঁহু! আব্বু আসছে না কেন? আব্বু না এলে ভোরের ঘুমও আসবে না!”
মন খারাপের রেশ স্পষ্ট ভোরের গলায়। তাঁর বাবার জন্য উদ্বিগ্ন সে! পাতা মুচকি হেসে ভোরের কপালে চুমু দিয়ে আদর করে সর্বমুখে। মিষ্টি সুরে বলে,
-” এসে পড়বে তোমার বাবা! তুমি কেন ভয় পাচ্ছো? আমার বাবাটা তো এতো সাহসী। কিভাবে ওই বাজে লোকগুলোকে শায়েস্তা করলে..!”
-” তুমিই তো ওদের সাথে ডিসুম ডিসুম করলে! আমি তো শুধু ওই বাজে লোকটার চোখে মেরেছি!
তাকে থামিয়ে ভোর বলে ওঠে। পাতা হেসে বলে,
-” এটাই তো মোমেন্টাম ছিলো! তুমি সাহস দেখিয়ে লোকটাকে কাবু করে আমার বাঁধন খুলে দিয়েছিলে তবেই না আমি ওদের সাথে লড়তে পেরেছি! তাহলে হিরোটা কে? এই পিচ্চি ভোর! তুমি স্ট্যান্ড নিয়ে আমাকে মুক্ত করলে! আমি তো অবাক হয়ে দেখেছিলাম! এতো সাহস এই পিচ্চি বাবাটার মাঝে!! তোমার সাহস আমাকে সাহসী বানিয়েছে! তোমার প্রেরনা আমার মনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে!”
পাতার চোখে মুখে মুগ্ধতার কীর্তন! আবছায়া অন্ধকারেও যেন চোখ দু’টো জ্বল জ্বল করছে গর্বে! ভোরের চোখে মুখে উপচেপড়া আনন্দ। পাতা আবার বলে,
-” এইটুকুন পিচ্চি ভোর সরকার ওই বাজে ভিলেনদের উপর ভারি পড়েছিল; তাহলে এতোবড় হাত পা ওয়ালা অরুণ সরকার ভিলেন গুলোর কি হাল করবে? ভোরের বাবা তো রিয়েল হিরো তাইনা? হিরো ভিলেনদের ডিসুম ডিসুম করে নাক ফাটিয়ে হসপিটালে পাঠিয়ে দিবে তাই না?”
ভোর মাথা নেড়ে সায় জানালো। চোখে মুখের ভয় ছুট লাগিয়ে খুশির ঝিলিক দেখা দিয়েছে। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে,
-” আব্বু ওই ভিলেনের ডিসুম ডিসুম করে পুলিশের কাছে দিবে! তারপর ভোরের কাছে আসবে তাই না আম্মু?”
-” একদম! এখন ঘুমিয়ে পড়ো? জ্বর কমে যাবে! হাতে ব্যাথা করছে? শীত লাগছে?”
ভোর কিউট ভঙ্গিতে না বোধক মাথা নেড়ে পাতার বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে নেয়!
রাতের নিস্তব্ধতার মাঝেও কারো ক্রন্দন! নাহ্! চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসে। হাঁউমাঁউ পুরুষের কান্নায় ভারী হয়ে আসে পরিবেশ! তবুও কান্না থামে না। অরুণ ফ্লোরে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে। শার্টের বোতাম অর্ধেকের মতো খুলে হা করে তাকিয়ে আছে লোমশ ঘর্মাক্ত বুকটা! এই শীতের কনকনে ঠান্ডার মাঝেও গরমে ঘেমে একাকার হয়ে আছে। ভেজা চুল কপালে লেপ্টে আছে। ঠোঁটের আগায় তীর্যক হাসি! সেই হাসি ভয়ানক! অরুণের হাতে ধারালো ছুরি! সে ছুরি শক্ত করে ধরে সামনে হাত পা বাঁধানো আকাশের গায়ে আঁকিবুঁকি করতে ব্যস্ত! ছুরির আঘাতে আকাশের ফর্ষা শরীরে ক্ষত চিহ্ন দেখা মেলে। অরুণ পাশের বাটি থেকে মরিচ ও লবণের মিশ্রণ ছিটিয়ে দেয় আকাশের আঁকিবুঁকিতে! আকাশ গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে। তাঁর চিৎকারে অরুণের অধরে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। আকাশের চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে! মাথায় ব্যান্ডেজের আবরণ খুলে যায়! তবে চোখের ব্যান্ডেজ এখনো অক্ষত। অরুণ ফিসফিসিয়ে বলে,
-” কষ্ট হচ্ছে? কতটা কষ্ট হচ্ছে? আমার ছেলের কুকুরের কামড়ে যতটা কষ্ট লেগেছিলো ততটা? এই রাসেল গরম পানি নিয়ে আয় তো? ওর কষ্ট হচ্ছে!”
বলে উঠে দাঁড়ালো! আকাশ চিৎকার করে কাঁদতে থাকে; সাথে অনুনয় বিনয় করে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আকাশের দুই পাশে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে শুকলা ও শামিম! দুজনেই সেন্সলেস হয়ে আছে। এমনি এমনি হয় নি। কাঁটা তাজা ঘায়ে লবণ লঙ্কা গুঁড়োর ছিটার অসহ্যনিয় ব্যাথা টর্চারে সর্বোচ্চ আওয়াজে চিৎকার করছিলো। অরুণ তাদের চিৎকারে বিরক্ত হয়ে মুখের ভিতর লঙ্কা গুঁড়ো পুরে দিয়েছে। বেচারারা আর সহ্য করতে পারে নি; সেন্স হারিয়েছে। ওদের পর আকাশের উপর আক্রোশ মেটাতে থাকে অরুণ সরকার।
রাসেল উঠে যায় রুমের বাইরে। উদ্দেশ্য গরম পানি! অরুণ এগিয়ে এসে রাসেলের জায়গায় বসে। কাঠের টেবিলে রাখা বি*য়ারের বোতল তুলে ঢক ঢক করে গলায় চালনা করে। সম্পূর্ণ শেষ করে শব্দ করে খালি বোতল টেবিলে রেখে গম্ভীর গলায় বলে,
-” এই তোদের জন্য অরুণ সরকারের ভালো হওয়া হলো না! তোরা একেকটা হারামখোর! নিজেরা তো উচ্ছন্নে ডুবেছিস সাথে আমাকেও ডুবিয়েছিস!”
বলে আরেকটা বোতলের দিকে হাত বাড়াবে ফয়সাল কেড়ে নেয়! মুস্তাকীম হে হে করে হেসে বলে,
-” সব দোষ বন্ধু ঘোষ তাই না? এসব বড়লোকি স্বভাব কে শিখিয়েছে? বাবার পকেট মেরে এতো দামী ওষুধ সেবন করানো শিখিয়েছে কে? জাতি জানতে চায়!”
শুভ অরুণের দিকে আঙুল তাক করে দেখিয়ে নিজেও সেবন করে ওষুধ! ফয়সাল মিটমিট করে হেসে বলে,
-” শা*লা! সবের নাটের গুরু তুমি অথচ গা উড়িয়ে ঘুরে বেড়াও! তোর জন্য অনিক আঙ্কেলের হাতে দাবাং মার্কা চড় খেতে হয়েছিল আমাকে! নিজে সিগারেটের সুখ টান দাও আর আঙ্কেলকে দেখে কিভাবে কৌশলে আমার হাতে দিয়েছিলো! আঙ্কেল মারলো তো মারলো বাবার কাছেও নালিশ জানায় আমি রাস্তা ঘাটে মদ গাঁজা সেবন সরি! আহা! বাবা সেবার যা মেরেছিলো! তারপর আর সিগারেটের শলাকাও ছুঁয়ে দেখিনি!”
অরুণ হাসে শরীর দুলিয়ে। ফয়সালের গালে আলতো চড় দিয়ে বলে,
-” আব্বু কি আমাকে চুমু খেয়েছিলো নাকি? আমারও পিঠে গালে পড়েছিলো! পুরো একদিন ঘরবন্দি করে রেখেছিলো খেতে দেয় নি; না আব্বু নিজে খেয়েছে! শাসিয়েছে আর এই হাতে সিগারেট দেখলে হাত কেটে নেবে বলে হুমকি দিয়েছে। আমি আর এই হাতে সিগারেট ছুঁয়ে দেখিনি!”
শুভ তাচ্ছিল্যভাবে বলে,
-” সিগারেট না খেলেও তার বাপ দাদাকেই গিলছিস!”
মুস্তাকীম ফোড়ন কেটে বলে,
-” তো তুই কাকে গিলছিস? সিগারেটের সুন্দরী বউকে?”
শুভ খালি বোতল তাঁর উদ্দেশ্যে ছুড়ে মারে। অরুণ চেয়ারে গা এলিয়ে সিরিয়াস গলায় বলে,
-” এসব তো উঠতি বয়সে আবেগের বশে খেতাম! তখন পিছুটান ছিলো কম! এখন আর ঝুঁকতে চাই না এসবে। বয়স বাড়ছে! আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদিহি দিতে হবে না? কিন্তু তোদের জন্য ঝুঁকতে বাধ্য হই! আমি আমার বাচ্চা কাচ্চার সাথে অনেক বছর বাঁচতে চাই ভাই! এসব খেয়ে নিজেকে আর ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাই না। প্লিজ এসব আর আনবি না আমার সামনে।”
শুভ আধ খাওয়া বোতল টেবিলে রেখে বলে,
-” আমিও এসব থেকে দূরে ভাগতে চাই! অরুণ আ’ম ওন ইয়র সাইড!”
ফয়সাল ঢোক গিলে সেও বোতল রেখে অরুণের উদ্দেশ্যে বলে,
-” ভাই তোকে জোড় করে খাওয়াই? নিজেই তো দেখে লোভ সামলাতে পারিস না। আচ্ছা আর আনবো না! আমরাও আর ছুঁয়ে দেখতে চাইনা!”
পরপর মুস্তাকীমও একই কথা বলে। অরুণ মুচকি হাসে। এরমধ্যে রাসেল কুকারে গরম পানি এনে রাখলো ফ্লোরে। অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ভাই যাই কর শুধু জানে মারিস না জা*নোয়াদের! তুই তো কেস খাবিই সাথে আমরাও! আমার পুরো টিম বাইরে গুসুর ফুসুর করছে যে তুই কোনো ক্রিমিনাল বা মাফিয়া টাফিয়া নস তো! ভাই সাবধান হ্যাঁ?”
অরুণ উঠে আসে। গরম পানির কুকার তুলে নিয়ে অর্ধেক আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারে বাকি অর্ধেকটা শুকলা শামিমের উপর! আকাশ হাত পা বাঁধা অবস্থায় ফ্লোরে গড়াগড়ি দিয়ে চিল্লাতে থাকে। শুকলা শামিম সেন্সে ফিরে কাঁদতে কাঁদতে অরুণের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চায়। অরুণ চুপচাপ। তাঁর চোখে ভাসে কুকুরের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত আদুরে দেহখানা!ছেলের কান্না আহাজারি! ক্ষতদেহ স্যাভলন জলে পরিষ্কার করার সময় ছেলের গোঙানি! ক্রন্দনরত ছেলের আকুতি ‘ভোর মরে যাবে আব্বু’! অরুণ আকাশের দিকে তাকায়! গলা কাঁটা মুরগির ন্যায় ছটফট করছে! দাপাদাপি করছে! অরুণের মায়া হয় না। এরকম অমানুষ, কুলাঙ্গার রেপিস্টদের জন্য মায়া হওয়া উচিত? মোটেও না! অরুণ লাথি লাগায় আকাশের পিঠ বরাবর। আকাশ উল্টে যায়। ধীরে ধীরে তাঁর নড়চড় বন্ধ হয়ে আসে। অরুণ শুকলা শামিমকে এলোপাথাড়ি লাথি মারতে থাকে। শুভ মুস্তাকীম সবাই এগিয়ে এসে অরুণকে থামায়। এভাবে মারতে থাকলে মরে টরে না যায়! রাসেল নিচে বসে আকাশের পালস রেট চেক করে। স্লো! চোখের ব্যান্ডেজ লাল হয়ে আসছে। সে ডাক্তারকে কল লাগায়! পাশের রুমেই আছে! সেই ওদের চিকিৎসা করিয়েছিলো!
রাসেল দাঁড়িয়ে অরুণের কাঁধে হাত রেখে বলে,
-” যথেষ্ট হয়েছে অরুণ! এবার বাড়ি যা! এই তোরা নিয়ে যা। আমি এখানে আছি!”
অরুণ আক্রোশে হিসহিসিয়ে বলে,
-” আমি যাবো না। আমার ক্ষোভ মেটে নি। কু*ত্তার বাচ্চাদের চামড়া তুলে নিবো! চোখে লঙ্কা গুঁড়োর প্রলেপ লাগাবো। ****দের কত সাহস আমার কলিজায় হাত লাগায়! আমার রাণির দিকে চোখ তুলে তাকায়!”
শুভ ফয়সাল টেনে নিয়ে যায় অরুণকে। অরুণ ক্ষোভে চেঁচাতে থাকে। মুস্তাকীম রুমাল দিয়ে তাঁর মুখ বেঁধে দেয়!অরুণের হাতের গ্লাভস খুলে দেয়। টেবিলের উপর থেকে রশি এনে হাতটাও বেঁধে দেয়! অরুণ চেঁচামেচি ভুলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে! এরা কারা? কোত্থেকে এসেছে।এরা কি তাঁর বন্ধু?
মুস্তাকীম নিজ আঙুলের ডগায় চুমু দিয়ে অরুণের কপালে ছুঁয়ে বলে,
-” বাবুটা চুপচাপ থাকো! ললিপপ খাওয়াবো তাহলে!”
শুভ, ফয়সাল হেসে অরুণকে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। গাড়িতে বসিয়ে নিজেরাও উঠে বসে। অরুণ মুস্তাকীম পেছনে। শুভ ফ্রন্ট সিটে ও ফয়সাল ড্রাইভ করে। এর মাঝেই হঠাৎ ভেসে আসে রিনরিনে সুর ‘বাবা আব্বু’! অরুণ উম উম শব্দ করে। মুস্তাকীম অরুণের পকেট থেকে ফোনটা বের করে। এটা এই পাগলের ফোনের রিংটোন! ভোরের ভয়েস রেকর্ড করে রিং টোন হিসেবে সেট করে মাঝে মাঝে! মুস্তাকীম কল রিসিভ করে বলে,
-” জানটুস? বাবু ভালো আছো?”
অরুণ বাঁকা চোখে চায়! মুস্তাকীম চুমুর ভঙ্গিমা করে! অরুণ চোখ পাকিয়ে চায়! মুস্তাকীম তাঁর চাহনিকে অবজ্ঞা করে আবার বলে,
-” বেবস কথা বলছো না কেন?”
-” মুস্তাকীম ভাই? তুমি খুবই জঘন্য! আমার ছেলেদের প্রতি ইন্টারেস্ট নাই। তাছাড়া আমার বউ আছে! ভাইয়ের কাছে দাও? জরুরী কথা আছে!”
মুস্তাকীম ভেংচি কেটে বলে,
-” আমারো তোর প্রতি বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নাই। আমার ঘরেও বউ বাচ্চা আছে। আমি তো শুধু চেক করছিলাম তোর আবার আছে টাছে নাকি!”
-“ফাও কথা বাদ দাও! ভাইকে বলো ভোরের জ্বর। ‘আব্বু যাবো’ বলে বায়না করছে। জলদি ফিরতে বলো তোমাদের গুনধর বন্ধুকে! আমি রাখছি!”
বলেই খট করে কল কেটে দেয় আরিয়ান। মুস্তাকীম চিন্তিত মুখে অরুণের দিকে তাকায়! অরুণ শুনেছে সবটা। ফোন লাউডে ছিলো! মুস্তাকীম অরুণের মুখের বাঁধন খুলে দেয়! অরুণ সাথে সাথে আদেশ বানী দেয়,
-” ফাস্ট চালা গাড়ি!যতো দ্রুত পসিবল! তবে সাবধান!”
অরুণ কলিং বেল বাজায় না। আরিয়ানকে কল করে বলে দরজা খুলতে। আরিয়ান দরজা খুললে অরুণ হন্ন হয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। ছেলের হালচাল জেনে আরিয়ানকে রুমে ঘুমাতে বলে ঘরে যায়! বিছানায় পাতা, ভোরকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে স্বস্তি পায়! ওয়াশ রুমে যায়! গোসল সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কম্বল সরালে তাঁর কপাল কুঁচকে যায়! পাতাবাহার কই? তখনি মিও মিও করে ওঠে বিড়াল শাবক! বিছানার কিনারে শুয়ে ছিল সে। অরুণকে দেখে উঠে এসে কম্বলের ভিতর ঢুকে পা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে আরামে! আহ্! শান্তি! অপেক্ষায় ছিলো তো সে!
পাতা খাবার হাতে রুমে প্রবেশ করে। দরজা ভিজিয়ে দিয়ে বলে,
-” উঠুন? খেয়ে তারপর ঘুমোবেন!”
অরুণের অধর জুড়ে খেলা করে মিষ্টি হাসি। এতো টুকু যত্নই তো চায় অরুণ! তাঁর অপেক্ষায় কেউ প্রহর গুনুক! সে উঠে আসে তবে বিছানা থেকে নামে না। খালি গায়ে কম্বল মুড়িয়ে বিছানার কিনারায় বসে বলে,
-” আমি ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে পড়েছো!”
পাতা কিছু বলে না। খাবারের প্লেট বিছানায় রাখে। অরুণ ভ্রু কুঁচকে বলে,
-” এখানে রেখেছো কেন? তোমার হাতেই রাখো! আর খাইয়ে দাও!”
পাতা কিছু না বলে প্লেট তুলে গরম বিরিয়ানী অরুণের মুখে চালনা করতে থাকে চুপচাপ! অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। মেয়েটা চুপচাপ কেন? সে হাত বাড়িয়ে পাতার কপালে গলায় হাত রেখে বলে,
-” গায়ে তো জ্বর! ওষুধ খাওনি?”
-” খেয়েছি!”
ছোট জবাব পাতার। অরুণের ভালো লাগে না। তবে কিছু বলে না। চিন্তিত ভঙ্গিতে সবটুকু খাবার খেয়ে নেয়। পাতা জিজ্ঞেস করে,
-” আরেক প্যাকেট আছে বিরিয়ানী আনবো?”
-” রাক্ষস নই আমি! এই টুকুনি বেশি ছিলো।”
পাতা চোখ ছোট ছোট করে চায়! বেশি ছিলো? বেশিই তো! লোকটা সবসময় মেপে মেপে খাবার খাবে। রুটি দুটো খুব বেশি হলে তিনটে! ভাত একপ্লেটের একচামচও বেশি নেবে না। তৈলাক্ত, চর্বিযুক্ত খাবার পারতপক্ষে অ্যাভোয়েড করে। তাই তো শরীরে মেদ জমে না। অথচ পাতা একটুখানি খেলেই যেন মুটিয়ে যায়! কই আগে তো এমন হতো না! পাতা সব গুছিয়ে রেখে বিছানায় ভোরের অন্যপাশে গা এলিয়ে দেয়! অরুণ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে চিন্তিত মুখে পাতার দিকে তাকায়। মেয়েটার হলো কি? বিকেলের ব্যাপারটায় এখনো আপসেট? অরুণ হাত বাড়িয়ে পাতাকে কাছে টেনে আনে! গালে হাত রেখে নরম সুরে বলে,
-” পাতাবাহার? মন খারাপ কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”
-” উঁহু! আ’ম ফাইন!”
অরুণ পাতার গাল ছেড়ে ভোরকে ওপাশে রেখে। মাঝখানে অবস্থান নেয়। পাতাকে টেনে বুকে জড়িয়ে বলে,
-” তাহলে যে ওষ্ঠাধর মিষ্টি হাসির গল্প বলে সে ওষ্ঠাধরে কেন বিষন্নতার মেঘ?”
পাতা অরুণের পিঠ জড়িয়ে বুকে মুখ গুঁজে দেয়। আস্তে করে বলে,
-” এতো দেড়ি হলো কেন ফিরতে? ভোর পাগলামি করছিল আপনার জন্যে! বাবাকে চাই বাবাকে আনো!”
কথা ঘুরাচ্ছে মেয়েটা! কেন? কি লুকাচ্ছে? তার মুখের আদল পরিবর্তন হয়! পাতাকে ছাড়িয়ে ভোরকে বুকের উপর টেনে নেয়! পাতা মলিন চোখে চেয়ে দেখে। এগিয়ে অরুণের বুকের একপাশে মাথা রেখে বলে,
-” কিছুই হয়নি। শুধু ক্লান্ত লাগছে। ঘুম উধাও হয়ে গেছে চোখ থেকে। চোখ বন্ধ করলেই রক্ত ভেসে আসে। পেট গুলিয়ে আসে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়!”
অরুণের চোখে মুখে উদ্বেগ। পাতার চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে আস্তে করে বুলিয়ে দেয়। কিছু সময় চুপ থেকে বলে,
-” কি হয়েছিলো ওখানে? ওদের ওই অবস্থা কে করেছিল?”
পাতা অরুণের বুক থেকে মাথা তুলে উঁচু হয়! হালকা হেসে বলে,
-” এক সাহসী বাবার সাহসী ছেলে করেছে!”
অরুণের কপালে গাঁড় ভাঁজ পড়ে। নাকটা উঁচুতে উঠে যায়। পাতা তাঁর নাকের ডগায় চেপে ধরে বলে,
-” আপনার সাহসী ছেলে করেছে। এইটুকুন ছেলের বুকে এতো সাহস! আপনি জানেন কি হয়েছে? আমাদের সাহসী ভোর আকাশ নামক লোকটার চোখে জলন্ত সিগারেট চেপে ধরেছে।”
অরুণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে গম্ভীর মুখে। পাতার মলিনতা উবে যায়। আগ্রহী মনে প্রত্যেকটা ঘটনার বর্ণনা দেয়। কিভাবে কি হয়েছে সব! অরুণ সব শোনে। বুকটা তার ভারী হয়! ছেলের সাহসীতায় কেন যেন সে খুশি হয়েও হতে পারে না। বরং বুকটা কেঁপে ওঠে যদি উনিশ বিশ কিছু হতো! মা ছেলের সাহসীকতা যদি ফেবারে না থাকতো! তাহলে যা কিছু হতে পারতো ভেবেই অরুণের বুকটা খাঁ খাঁ করে। ভোরকে বুকের একপাশে শক্ত করে চেপে ধরে। মাথা উঁচিয়ে তাঁর উপর ঝুঁকে থাকা পাতার গালে চুমু দেয়। অধরে অধর ছুঁয়ে পাতাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিজের সাথে জড়িয়ে উপর ওয়ালার শুকরিয়া আদায় করে মন থেকে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
-” ঘুমাও পাতাবাহার! ভয় নেই আমি আছি তো তোমাদের ঢাল হয়ে। আশাকরি আর এমন পরিস্থিতিতে পরবে না কখনো! এই অরুণ সরকার এমন হতে দেবে না ইনশাআল্লাহ। যতদিন বেঁচে আছি আমি আছি! আমি না থাকলেও তোমরা সুরক্ষায় কমতি হবে না।”
পাতা অরুণের বাহু থেকে মাথা তুলে গালে গাল ঘষে বিড়বিড় করে বলে,
-” আমার আয়ু আপনার হোক। পাতার জামাই দীর্ঘজীবী হোক!”
অরুণের স্পষ্ট শুনতে পায় কথাগুলো। হাসি পায় তাঁর। পাতাকে সরিয়ে দিয়ে ভোরকে বালিশে শুইয়ে আদর করে। কম্বলের ভিতর মাথাসহ নিজেকে আড়াল করে নেয়! পাতার কপালে ও ভ্রু কুটিতে ভাঁজ পড়ে। একটু পর অনুভব করে কম্বলের ভিতরে কেউ তাকে গভীর ভাবে জড়িয়ে নিয়েছে। পাতার গলা শুকিয়ে আসে। সরে যাওয়া কম্বল গলা অবধি টেনে শক্ত করে চেপে রাখে। অরুণ নিজেকে শান্ত করে পাতার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকে কিছু পল! তাঁরপর নিচে নামতে থাকে তার মুখশ্রী। পাতার লেডিস শার্টের বোতাম খুলে যায়! উন্মুক্ত পেটে মুখ গুঁজে পরপর ছোট ছোট চুমু দেয়! পাতার চোখের আকার বড় হয়! তনু জুড়ে নতুন এক শিহরণ খেলা করে। শিরায় উপশিরায় ভাসমান রক্ত কনিকা সাথে অজানা এক আনন্দানুভূতি ভেসে বেড়ায়। লোকটা কি জানে? পাতা ঘন ঘন শ্বাস ফেলে অরুণের মাথার চুল খামচে ধরলো!
-” ভোরের বাবা কি করছেন ছাড়ুন! জ্বলছে!”
অরুণ নাক মুখ ঘষে দেয় আবার। মুখ গুঁজে বলে,
-” পাতাবাহার বালিশ শক্ত লাগছে। ইটস ঠ্যু মাচ সফট! ওলসো অ্যাট্রাকটিভ !”
পাতা অরুণের মাথার চুল শক্ত করে চেপে টান দেয়। অরুণ সরে এসে পাতার গলায় মুখ গুঁজে বলে,
-” ঘুমোবো আমি ডোন্ট ডিস্টার্ব মি পাতাবাহার!”
-” আমি ডিস্টার্ব করেছি?নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য লোক! সরুণ তো?”
অরুণ সরে না। হাত বাড়িয়ে ভোরকে কাছে টেনে আনে! পাতার মাথার ওপাশে মাথা রেখে ভোরকে বাহুতে আটকে নেয়; পাতার উপর থেকেও সরে না। গালে অধর ছুঁয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” ডিস্টার্ব করছোই তো! আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছো!”
-” মানে?”
অরুণ কিছু বলে না। মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলে ‘ঘুমাও জলদি নইলে..’ বাক্য শেষ করে না। পাতা চোখ মুখ খিঁচে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে।
সকাল বেলা! অরুণ সরকার কিচেনে ব্যস্ত সময় পার করছে। পাতা তাঁর হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছে। যেটা বলছে বাধ্য মেয়ের মতো করছে। আরিয়ান সোফায় বসে দুজনের কান্ড কারখানা দেখছে। সাথে হতাশও! আম পাতা জোড়া জোড়াকে বলেছিলো যে ভাইয়ের পেছনে ঘুরঘুর না করতে একটু ভাব নিয়ে চলতে! অথচ মেয়েটা ভাই যা বলে তাই করবে! ভাই যদি বলে মোরগের ডিম নিয়ে আসো এই মেয়ে মোরগের গলায় পারা দিয়ে বলবে,
-” এই মুরগির বাচ্চা মোরগ? ডিম পাড়!”
আরিয়ান ঠোঁট চেপে হাসে! ভোর কপাল কুঁচকে চাচ্চুর হাসিমুখের বদনখানা দেখে বলে,
-” চাচ্চু তুমি হাসছো কেন? আমি কি জোকস বলছি তোমাকে?”
আরিয়ান দুঃখি দুঃখি ফেস বানিয়ে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে ভোরকে তাঁর স্টোরি কন্টিনিও করতে বলে! ভোর আগ্রহী মনে সব বলতে থাকে সাথে অঙ্গ ভঙ্গি করে বুঝিয়ে দেয়। কাল বিকেলে কি কি হয়েছিল! কিভাবে সে এক ভিলেনের চোখে সিগারেট চেপে ধরেছিল। আম্মু কিভাবে ডিসুম ডিসুম করে ওই বাজে লোকদের পানিশড করেছে! আরিয়ান সব শুনে মাথা নেড়েচেড়ে বলে,
-” ভোর ব্রাভো! বাট তোমার আম্মু খুবই ভিতু! তাঁর উচিত ছিলো কাচের বোতল মাথায় ভেঙে ভাঙ্গা অংশ ওদের পেটে ঢুকিয়ে দেওয়া!”
ভোর তার কথার তীব্র প্রতিবাদ করে। তার আম্মু মোটেও ভিতু না। বরং স্ট্রংগেস্ট সুপার হিরোইন! তাকে ভিলেনদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে! আরিয়ান এটা ওটা বলে ভোরকে ভরকিয়ে দেয়! ভোর গাল ফুলিয়ে কোমড়ে হাত রেখে চাচ্চুর সাথে তর্কে করে। পাতা, অরুণ কিচেন থেকে সবটা শুনে হাসে। সাথে হাত চালিয়ে রান্না করতে থাকে। আরিয়ান প্রথমবার তাদের এই ছোট্ট সংসারে! শাহি দাওয়াত তো বানাতেই হবে।সব রান্না কমপ্লিট হলে অরুণ টেবিলে সাজিয়ে রাখে। পাতাকে প্লেট লাগাতে বলে সে ঘরে যায়। পাতা প্লেট সাজিয়ে জগ ভরে আনলো ! আরিয়ান এসে চেয়ার টেনে ভোরকে বসিয়ে নিজেও বসে। পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” বড় ভাবী? ভাই আপন না ভাবলেও ভাইকে আপন ভাবি আমরা। ভালোবাসি তাকে। ভাই ভোর, তোমাকে ছাড়া বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মিস করি তোমাদের সবাইকে। আনিকা প্রত্যেকটা দিন বলবে ভোর, চাচ্চু,চাচি মনিদের আনো! আদু কাঁদে। মা মনমরা হয়ে বসে থাকে সবসময়।প্লিজ তোমরা চলো আমার সাথে! আমি প্রমিজ করছি রুবি আর কখনো এমন আচরণ করবে না। সে অনুতপ্ত। ভাইয়ের কাছে কতবার ক্ষমা চেয়েছে। ভাই দেখে শুনেও অগ্রাহ্য করে। তুমি ভাইকে বুঝিয়ে বললে ভাই মানা করবে না।”
পাতা আরিয়ানের দিকে তাকায়। সে তো কত করে বলে লোকটা কানেই তোলে না। জেদে অটল! পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” ভাইয়া কত করে বলি! ভোর জেদ ধরে ওবাড়ি যাবে। উনি ধমকে বসিয়ে রাখে। চেনেনই তো আপনার ভাইকে সে যা বলবে তাই! তবুও আমি আবার চেষ্টা করবো! ”
আরিয়ান আর কিছু বলে না। নিজেই টেবিলে সাজানো হরেক পদের খাবার বেড়ে নিয়ে খাওয়া শুরু করে। অরুণ একটু পরে আসে।তার মুখের আদল গম্ভীর। একটু আগের সব কথাই শুনতে পেয়েছে সে।
পাতা সোফায় বসে আছে। ভোর তার পাশে বসে টিভিতে কার্টুন দেখছে আর হাসছে খিলখিলিয়ে। একটু পর পর পাতাকে বলছে দেখো আম্মু টম কত দুষ্টু! জেরি কত মিষ্টি! তার ফেবারিট কার্টুন টম এন্ড জেরি। পাতার কার্টুন দেখতে ভালো না লাগলেও এবাড়িতে এসে দেখে দেখে সয়ে গেছে। পাতা ভোরকে ‘তুমি দেখ আমি আসি’ বলে রুমে চলে যায়। ভোর আপন মনে টম জেরী দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
পাতা রুমে গিয়ে দেখে অরুণ সরকার বিছানায় বসে ল্যাপটপে কিছু করছে। পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। বাড়িতে কেন কাজ করবে? বাড়িতে বউয়ের সাথে আহ্লাদ করবে। বাচ্চার সাথে খেলবে; ঘুরতে নিয়ে যাবে! তা না। ল্যাপটপের ভিতর মুখ গুঁজে বসে আছে। পারে না লোকটা ঢুকে যায়। নাক উঁচু ম্যানারলেস রসকষহীন লোক! পাতা ল্যাপটপের সাটার অফ করে কেড়ে নেয় অরুণের কোল থেকে। পেছনে লুকিয়ে বলে,
-” আমি সকাল থেকে আপনার পিছু ঘুরঘুর করছি কিছু বলবো বলে। অথচ আপনি আমার কথা শোনা তো দূর আমাকেই গ্রাহ্য করছেন না! নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক কোথাকার! আপনার নাক আমি ফাটিয়ে দেবো বলে দিলাম!”
অরুণ বিরক্তিকর ভঙ্গিতে তাকায়। গম্ভীর হুকুম তামিল করে,
-” পাতাবাহার কাজ করছি আমি বিরক্ত করবে না। ল্যাপটপ দাও?”
-” দেব না! কি করবেন? আগে আমার কথা ভদ্রলোকের মতো শুনুন তবেই দিবো!”
-” আচ্ছা বলো?”
শান্ত গলায় বলে অরুণ! পাতা লম্বা শ্বাস টানে। ল্যাপটপ বিছানায় রেখে দেয়। এবার সে বলেই দেবে লোকটাকে।পাতা গলা পরিষ্কার করে। কথা গুছিয়ে নেয়। কিন্তু গলা দিয়ে কথা বেরোতে চায় না। লজ্জা লাগে, অস্বস্তি হয় ঢের! কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়!
অরুণের বিরক্তের মাত্রা তরতরিয়ে বেড়ে যায়। গাধা মেয়ে। সামান্য একটা কথা বলতে এতো কেন হেজিটেশন? সে কি পর কেউ? তাহলে কেন জড়তা! লজ্জা এসে ভিড় জমাবে? এই নিয়ে তিনবার মেয়েটা বলতে নিয়েও বলতে পারে নি। সে বিরক্ত হবে না? কথাটা শোনার জন্য অরুণের কান তর পাচ্ছে। বুকটা দুরুদুরু করছে। অথচ গাধাটা বলছেই না। এখন থেকে ভোরের মতো মেয়েটাকেও রোজ হরলিক্স খাওয়াবে। যদি একটু সোধবুদ্ধি হয়! অরুণ বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে যায়। দরজা লাগিয়ে দিয়ে টেবিল থেকে ভোরের স্কেল হাতে তুলে নেয়! পাতার দিকে তাক করে গমগমে গলায় বলে,
-” জলদি বলো কি বলবে? এই নিয়ে তিনবার! কি ঢং শুরু করে দিয়েছো? তোমার ঢং দেখার সময় তর কোনটাই নেই! স্পিক আউট! নইলে এই স্কেল তোমার পিঠে ভাঙবে আজ!”
পাতার চোখের আকার বড় হয়! ফোঁস ফোঁস করে বলে,
-” আপনি মারবেন আমায়? আপনার এতো বড় স্পর্ধা! বলবো না আমি! দেখি মারুন! চলে যাবো আমি সরকার বাড়ি, ভোরকে নিয়ে। আপনি আপনার ছা’পোষার সাথে সুখের সংসার করিয়েন!”
বিড়াল শাবক তার নাম শুনতে পেল বোধ করি। বেলকনি থেকে নাচতে নাচতে বেরিয়ে আসে মিষ্টি সুরে মিও মিও করে ডাকে। পাতার গা জ্বলে ওঠে। দাঁত কপাটি কটমট করে নাকের পাটা ফুলায়! অরুণ প্লাস্টিকের স্কেলটা দিয়ে ঠাস করে মারে! পাতাকে না টেবিলের উপর! পাতা গোল গোল করে তাকায়। পাতাবাহার মিও মিও করে আবার বেলকনিতে চলে যায় দৌড়ে। অরুণ শান্ত গলায় বলল,
-” এই লাস্ট বার বলছি বলো! নইলে এই অরুণ সরকার কি করবে নিজেও জানে না। স্পিক পাতাবাহার!”
পাতা ঢোক গিলে! আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে। অরুণের হাত থেকে স্কেলটা নিয়ে একহাতে অরুণের হাত মেলে ধরে সেই হাতে স্কেলটা দিয়ে একটা বারি মারে আলতো করে। মিনমিন করে বলে,
-” শুনুন নাক উঁচু ম্যানারলেস অরুণ সরকার আপনাকে ঠিক এভাবে শাসন করার জন্য কেউ আসছে! এই যে এখানে!”
বলে নিজ পেটে হাত রাখে। নজর তাঁর অরুণ সরকারের গম্ভীর মুখশ্রীতে! লোকটা কি খুশি হবে? নাকি রেগে যাবে? নাকি নির্লিপ্ত আচরণ করবে! অরুণ হাত বাড়িয়ে পাতার চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরে। ফলে ফুলো অধরজোড়া আরো ফুলে যায়! অরুণ সরকার তার ধারালো দাঁতের সাহায্যে কামড়ে ধরে। পাতা ব্যথায় নাক মুখ কুঁচকে নেয়! অরুণ তাকে ছেড়ে দিয়ে ল্যাপটপ তুলে নিতে উদ্যত হয়! পাতা তাঁর হাতজোড়া দখল করে বলে,
-” কিছু বলুন ভোরের বাবা? আপনি কি রেগে আছেন? আমি সবসময় সজাগ থেকেছি তবুও কি করে হলো আমি জানি না। আপনি প্লিজ ভুল বুঝবেন না আমাকে। আমার দম আটকে আসে তো!”
অরুণ শান্ত চোখে পাতার দিকে তাকায়। মেয়েটার চোখে অশ্রু কণা! কেন? সে পাতার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়! পাতার শ্বাস ঘন হয়ে আসে। চোখের অশ্রু বাঁধ ভাঙতে চায়! পাতা ভাঙতে দেয় না। শেষ বারের মতো নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-” ভোরের বাবা? আপনি কি চান না ওকে?”
নিজ পেটে হাত রেখে বলে পাতা! অরুণের মাথা দপ করে জ্বলে ওঠে। হিংস্র হয় চোখের চাহনি। এগিয়ে আসে এক কদম! পাতা পিছিয়ে যায় তিন কদম!
-” আপনার নিরবতাকে সম্মতি ভেবে নেবো?
পাতার থমথমে গলা! অরুণ এগিয়ে এসে পাতার ঘার শক্ত করে ধরে নিচু মুখ উঁচু করে! হিসহিসিয়ে কন্ঠে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে,
-” তুমি কি ভাবো টা কি আমাকে হুম? এই বলো কবে জেনেছো যে কেউ আসছে? বলেছো আমাকে? আমি কতবার জিজ্ঞেস করেছি আমাকে বলো! অথচ মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলে কেন? ভরসা নেই আমার উপর?”
পাতার মাথা শূন্য হয়ে যায় যেন। কি বলছে লোকটা? তাঁর মানে সে আগে থেকেই জানতো? পাতা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে! হাত বাড়িয়ে অরুণের গলা জড়িয়ে কেঁদে দেয় গুনগুন করে। বিড়বিড় করে বলে,
-” আছে ভরসা! তবে ভয় পাই আমি! হারানোর ভয়! আমিও আর কিছু হারাতে চাই না ভোরের বাবা!”
পাতা অরুণের কাঁধে মুখ লুকিয়ে রাখে। সময় পেরিয়ে যায়। অরুণ বাহুবন্ধনে জড়িয়ে নেয় সযত্নে। পাতার কান্না থেমে যায়! সে লোকটাকে অসম্ভব ভালোবাসে। সেই ভালোবাসার গভীরতা এত যে পাতা নিজেও খেই হারিয়ে বসেছে অথৈ সাগরে। না কুল না কিনারা। শুধু খোলা নীলাম্বরের ন্যায় একবুক আশা! সাথে হারিয়ে যাবার ভয়!
অরুণ পাতার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় ডাকে,
-” পাতাবাহার?”
-” হুম!”
-” আলহামদুলিল্লাহ! আমি কতটা খুশি আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। আমি আগেই জেনেছি সব। আমি শুধু আশায় ছিলাম কখন তুমি বলবে আমি আমার আনন্দ প্রকাশ করবো। অথচ তুমি বলছিলে না। আমাকে ভয় পাচ্ছিলে! আমার খুব রাগ হচ্ছিল! ”
পাতা অরুণের গলা ছেড়ে মুখোমুখি হয়! শান্ত সমুদ্রের ন্যায় ছোট গভীর চোখজোড়ার খুশির ঝিলিক কি দেখতে পেলো পাতা? কি জানি! তবে পাতা অরুণের কপোল জোড়ায় হাত রেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
-” আ’ম স্যরি! আসলে…”
পাতা বাহার পর্ব ৪৯ (৩)
আর বলতে পারে না পাতা! অরুণ সরকার শুনতেই চায় নি পাতা বলবে কিভাবে? নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটা তো গভীর আশ্লেষে নিজ মধ্যকার উদ্বেগ আনন্দ সুখের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে অভিনব কায়দায়!