পাতা বাহার পর্ব ৫৮

পাতা বাহার পর্ব ৫৮
বেলা শেখ 

কুয়াশার চাদরে মুড়ে আছে অন্ধকার রজনী। শীতটাও জমকালো ভাবেই জেঁকে বসেছে। ডিসেম্বরের শেষ দিন! নতুন বর্ষ কে সাদরে বরণ করতে মুখিয়ে সবাই! ঘড়িতে দশটা বেজে এক মিনিট! আর প্রায় দু ঘণ্টা পর নতুন বর্ষ আগমন!
পাতা বিছানায় শাল মুড়িয়ে বসে আছে। তাঁর চোখে টইটুম্বর নোনাজল যে কোনো সময় গরিয়ে পড়বে। মুখটাও কেমন ফ্যাকাসে, রক্তশূন্য! ভোর তাঁর সামনে গালে হাত দিয়ে বসে আছে ফ্যাকাসে মুখে! আম্মুর চোখে পানি থাকবে কেন? আম্মুর কি খুব কষ্ট হচ্ছে? তাহলে বলছে না কেন?
-” ও আম্মু কষ্ট হচ্ছে তোমার? বাবু আবার দুষ্টুমি করছে?”

পাতা ভোরের দিকে চায়। সাথে সাথেই কপোল বেয়ে বারিধারা বইতে শুরু করে। ভোর ঘাবড়ে যায়। পাতা দাঁত দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলে,
-” আমার ভয় করছে ভোর! মনে হয় কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। তোমার আব্বুকে ডাকো ভোর!”
ভোর উঠে এসে পাতাকে জড়িয়ে ভঙ্গুর স্বরে বলে,
-” আমি আছি তো আম্মু!”
বলেই উঁচু গলায় বাবাকে ডাকে। অরুণ ব্যস্ত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে! ভোর বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আম্মু কাঁদছে! ভয় পাচ্ছে!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। সে ভেজা হাত তোয়ালে দিয়ে মুছে দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসে। ভোর পাতাকে ছেড়ে সরে যায়। অরুণ পাতার গালে হাত রেখে নরম সুরে বলে,
-“আছি তো আমি! কি হয়েছে? ভয় কেন পাচ্ছো?”
পাতা কিছু বলে না। শুধু ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে দিলো গুনগুন করে। অরুণ চিন্তিত হয়। সে তড়িঘড়ি পাতাকে টেনে বুকে জড়িয়ে বলে,
-” কি হয়েছে বলবে? পেটে ব্যাথা করছে? খুব বেশি? এই পাতাবাহার?”
-” অল্প অল্প! মনে হয় পেট ফেটে বেরিয়ে আসবে এখুনি!”
অরুণের বুকে মুখ গুঁজে বিড়বিড় করে বলে পাতা। অরুণ হাসবে কিনা বুঝতে পারে না! সে পাতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” আরেকটু সহ্য করো পাতাবাহার! সে আসলে সব ব্যাথা গায়েব হয়ে যাবে!”
পাতা লম্বা শ্বাস টেনে শান্ত‌ হয়ে যায়। এখন ভালো লাগছে একটু। ভয় ভয় অনুভূতি হচ্ছে না।ভয় লাগবে কেন এটা যে তাঁর স্বস্তির জায়গা। অরুণ নিজেও স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। একজন মা কতটা কষ্ট, ব্যাথা সহ্য করে একটা বাচ্চার জন্ম দেয়। দশমাস দশটা দিন একটা প্রাণ নিজের ভিতর ধারণ করে! শত যন্ত্রণা সহ্য করেও বিরক্ত হয় না; বরং হাসিমুখে মেনে নেয় সবটা। প্রসব বেদনা সহ্য করে প্রাণটাকে ভূমিষ্ঠ করে। সদ্য ভূমিষ্ঠ বাচ্চাকে যখন সে বুকে টেনে নেয় সব যন্ত্রনা ব্যাথায় ব্যাথা নাশক ঔষধের প্রলেপ পড়ে যেন।
অরুণ ভোরের দিকে তাকালো। ছোট আদুরে মুখটায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সে আরেক হাত বাড়িয়ে ছেলেকেও টেনে জড়িয়ে নেয়। ভোর বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

-” তোমার দুষ্টু বাবু একটুও ভালো না। আসুক সে ভোর তাকে বকে দেবে। কান মুলে দিবে।”
পাতা মলিন হাসলো। ভোরের গাল টিপে বলে,
-” বাবু তোমার বাবার কি করে হয়? সে তো আমার পেটে!”
-” কিন্তু সে তো বাবার মতো দুষ্টু!”
অরুণ ভোর পাতা দু’জনকেই সরিয়ে বিছানা গুছিয়ে লেপ কম্বল বের করে।‌বালিশ পেতে বলে,
-” হ্যাঁ আমি তো দুষ্টু আর তোমরা তো মা ছেলে দুধে ধোঁয়া তুলসী পাতা! তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো!”
পাতা আড়চোখে অরুণের দিকে চেয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। অরুণ মুচকি হেসে হুডি খুলে তাঁর পাশে গা এলিয়ে ভোরকে ডাকে,
-” এই কলিজা?”
ডাকতে দেড়ি ভোরের আসতে দেড়ি হয় নি। বাবার বুকের উপর শুয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে ভোর। অরুণ লেপ কম্বলে ভালোভাবে মুড়িয়ে ছেলেকে আদর করে ঘুম পারায়! পাতা মাথা কাত করে চেয়ে দেখে। চোখের পলক ফেলে না। দেখতে ভালো লাগে এই বাবা ছেলের ভালোবাসা! দু’জন দু’জনের চোখের তারা। পাতা মাথা সোজা করে চোখ বুজে নেয়। বাড়ন্ত পেটে হাত রেখে কি যেন হাবিজাবি চিন্তায় হারিয়ে যায়! চোখটা আপনে আপ বুজে যায় যেন ঘুম হানা দিচ্ছে!

পাতা যখন চোখ খোলে নিজেকে কেমন ওজন হীন অনুভূত করে। চারপাশে কেমন হাউকাউ শব্দ কানে ঠেকে। কেউ কাঁদছে ‘আম্মু আম্মু’ ডেকে! পাতা একটু নড়াচড়া করার চেষ্টা করে; পারে না। কেউ শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে নিজের সাথে। পাতা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করে! বুঝতে পারে শক্ত পোক্ত এক বলিষ্ঠ বুকে আছে। আর সেটা তাঁর ব্যক্তিগত স্থান! পাতা চোখ তুলে তাকালো! তখনই ব্যাক্তিটা ঝুঁকে তাঁর খসখসে অধর ছুঁয়ে দেয় পাতার কপালে! দূর্বল পাতার চোখ পুনরায় বুজে যায়। অনুভব করে এক স্বর্গীয় ভয়ানক অনুভূতি! পাতা গুঙ্গিয়ে কেঁদে ওঠে শব্দ করে। বলিষ্ঠ বুকের শার্ট খামচে ধরে। ছিঁড়ে যায় শার্টের বোতাম! ভোরের কান্নার বেগ বেড়ে যায়। আম্মু বলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে! অরুণ দ্রুত পা চালায়! আতিকুর ইসলাম ক্রন্দনরত ভোরকে জোর করে কোলে তুলে শান্ত হতে বলে। ভোর শান্ত হয় না মোটেও! সে হাত পা ছুড়ে কাঁদতে থাকে ‘আম্মু আম্মু’ জপে! আতিকুর ইসলাম পারে না ভোরকে সামলাতে! সে দৌড়ে গিয়ে অরুণের শার্টের কোনা চেপে তাঁর সাথে পা মেলায়! লাবনী আক্তার এসে ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও পারে না। অরুণ হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়েছে। পাতাকে সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে । তাঁর গলা ছেড়ে কান্না আর ছটফটানি বেড়ে যাচ্ছে। অরুণ তাকে পাঁজাকোলে ধরে রাখতে পারছে না! এদিকে ভোরের হাউমাউ কান্না। অরুণের মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সে ঢোঁক গিলে ভোরকে বলে,

-” কলিজা শান্ত হও! কেঁদো না আম্মুর জন্য দোয়া চাও আল্লাহর কাছে! আর এই পাতাবাহার? আরেকটু ধৈর্য ধরো!”
ভোরের কান্নার গতি কমে গেলেও থেমে যায় না। পাতা মুচড়ে অরুণের বুকে মুখ গুঁজে বিড়বিড় করে বলে,
-” ভোরের বাবা আমি আপনার উপর রেগে আছি। অনেক রেগে আছি!”
অরুণ ব্যস্ত করুন স্বরে জবাব দেয়,
-” আমি তোমার সব রাগ মাথা পেতে নিলাম পাতাবাহার! তুমি আমার মা’কে নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আসো! তোমাকে তোমার মতো করে ভালোবেসে রাগ কমিয়ে দিবো।”
-” আর যদি না আসি?”

বলেই বাচ্চাদের মতো ঝরঝরিয়ে কেঁদে দেয় পাতা! অরুণ সামনে দৃষ্টি স্থির রেখে কড়া গলায় জবাব দেয়,
-” না আসলে আর কি? আরেকটা গুলবাহার খুঁজে নিবো বেয়াদব!”
পাতার কান্নার মাত্রা বেড়ে যায়। সাথে ছটফটানি! অরুণ পৌঁছে যায় গন্তব্যে। অরুণ গাড়িতে থাকাকালীন ডাক্তার সাবিনার সাথে কথা বলে সব রেডি রাখতে বলেছে! ডাক্তার সাবিনা এগিয়ে এসে বলে,
-” স্ট্রেচারের অভাব ছিলো বুঝি? হুইল চেয়ারেও আনা যেতো!”
অরুণ কিছু বলে না! পাতাকে বুক ছাড়া করতে ইচ্ছে করছিলো না। ডাক্তার সাবিনা বলে,
-” ওটিতে নিয়ে যাও! সব রেডি আছে। রিসেপশন থেকে ফরম পূরণ করে নিও!”
অরুণ ওটিতে নিয়ে যায়। সেখানে গোটাকয়েক নার্স সহ আরো কিছু মহিলা ডাক্তার! পাতাকে নিয়ে যেতেই তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে । পাতা ব্যাথায় দিশেহারা! সে অরুণকে ছাড়ে না। বিড়বিড় করে,
-” ভোরের বাবা আমি পারবো না। আপনি থাকুন না আমার সাথে! এই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক শুনতে পাচ্ছেন না?”

চিৎকার করে ওঠে পাতা। অরুণ অসহায় চোখে চায়। পাতার গালে মুখে অসংখ্য ছোট ছোট চুমু দিয়ে শুইয়ে দেয়। পেটে হাত বুলিয়ে বলে,
-” পাতাবাহার ভেঙে পড়ছো কেন? বি স্ট্রং! আমি সবসময় তোমার সাথে আছি! এই এখানে আছি তো!”
পাতার বুকের বা পাশে হাত রেখে বলে অরুণ। পাতা ঠোঁট কামড়ে ঘন ঘন শ্বাস টানে। অরুণ তাঁর কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে যায়। পাতা চিৎকার করে ডাকে অরুণ ফিরে না। নার্স তাকে সামলায়। অরুণ বেরিয়ে আসতেই ভোর ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-” আম্মুকে কোথায় রেখে এলে? আম্মু কাঁদছে তো! ডাক্তারকে বলো দুষ্টু বাবুকে বের করে আম্মুকে ঠিক করে দিতে!ফাস্ট ফাস্ট!”

অরুণ ছেলেকে বুকে টেনে নেয়। মাথায় চুমু দিয়ে শান্ত হতে বলে। ডাক্তার সাবিনার কাছে দাঁড়াতেই তিনি জিজ্ঞেস করেন কখন থেকে ব্যাথা শুরু হয়েছে! অরুণ নিজেকে সামলে শান্ত গলায় বলে,
-” ঘুমিয়ে পড়েছিলো। হঠাৎ খেয়াল করি কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে ! ডাকি শোনে না। ওয়াটার ব্রেক হয়েছে! সারাটা রাস্তা ডেকেছি। নড়াচড়া করে পিটপিট করে চোখ খোলে। আবার জ্ঞান হারায়! হসপিটালে এলে জ্ঞান ফিরে, ব্যাথায় ছটফট করছে!”
ডাক্তার সাবিনা মনোযোগ দিয়ে শোনে। ওটি থেকে পাতার চিৎকার শোনা যায়। ভোর এদিকে মিনমিন সুরে কেঁদে বাবাকে ডেকে বলছে,
-” আম্মু কাঁদছে একা একা। ডাক্তারকে ফাস্ট যেতে বলো না?”
অরুণ ছেলেকে শান্ত হতে বলে। ভোর এদিকে নাছোড়বান্দা! আক্তার সাবিনা ভোরের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলে,

-” তোমার আম্মুকে রেডি করাচ্ছে ভেতরে! আমিও যাচ্ছি! একটু পরেই তোমার বোন এসে পড়বে। কেঁদো না। কাঁদলে ভোরকে পঁচা লাগে! তখন বোন এসে যদি পঁচা ভাইয়ের কোলে না যায়?”
ভোরের কান্না কমে আসে তবে থামে না।ফোপাতে থাকে‌। ডাক্তার সাবিনা অরুণকে জিজ্ঞেস করে,
-” পাতা খুবই ভিতু প্রকৃতির! তুমি চাইলে ওটিতে আসতে পারো! ও সাহস পাবে!”
-” আমি নিজেই সাহস পাচ্ছি না ওকে কিভাবে সাহস দেবো। আমি এখানেই ঠিক আছি। আমি গেলে ও আরো বাচ্চামো করবে!”
অরুণ মলিন হেসে বলে! ডাক্তার সাবিনা তাকে ভরসা দিয়ে ভেতরে চলে যায়। অরুণ দু এক পা করে পিছিয়ে ভোরকে কোলে নিয়েই দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে ফ্লোরে। আতিকুর ইসলাম, লুব, লাবনী আক্তার ছুটে আসে! অরুণকে তোলার চেষ্টা করে। অরুণ ওঠে না। পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে ভোরকে নিজের সাথে আরেকটু চেপে ধরে বলে,
-” আ’ম ফাইন! আ’ম ফাইন!”

বললেও অরুণ কেমন যেন অস্বাভাবিক রকম শান্ত হয়ে যায়। চোখের কোনে চিকচিক করা নোনাজল সবার কাছেই ধরা পরে! এমনকি ছোট্ট ভোরের চোখেও পড়ে। ভোর নিজের কান্না গিলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শ্বাস টানে। বাবার গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” আব্বু কলিজা কাঁদলে ভোর কিন্তু জোরে কেঁদে দিবে!”

অরুণ ছেলের দিকে চায়। আগে তাঁর জীবনটা শুধু ভোর কেন্দ্রিক ছিলো! এখন আরো কিছু অক্ষ রেখা জুড়ে আছে! অরুণ উপর ওয়ালার কাছে নিত্যদিনের মত ফরমাইশ জারি করে তাঁর চড়ুইয়ের দল সুস্থ থাকুক সুখী থাকুক!
দূরে এক চৌদ্দ পনেরো বছরের কিশোর দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে কৌতুহল! ওটি থেকে মেয়েলী কান্না চেঁচামেচি শোনা যায় ক্ষীণ! এই লোকের ওয়াইফ ওটিতে? আপুর মতো এর বউয়েরও বাচ্চা হবে? কিশোর ছেলে পকেটে হাত গুজে এগিয়ে যায়। হাত ঘড়িতে সময় দেখে রাত একটা বেজে! নতুন বর্ষ শুরু হয়ে গেছে! বাহ্ যেই আসুক নতুন বর্ষে আসবে! নতুন বর্ষ, নতুন মুখ, সব নতুনত্ব! কিশোরটি কাছাকাছি গিয়ে কান পেতে রয়! লোকটা এই শীতে ফ্লোরে বসে পড়লো? সে লোকটার কোলে বসা মোটাসোটা বাচ্চা ছেলের দিকে তাকালো! লোকটার ছেলে হবে। বেশ আদুরে দেখতে! কান্নাকাটি করে চোখ মুখ ফুলিয়ে কুমড়ো পটাশ হয়ে গেছে। কিশোরটি মনে মনে হাসে।
সে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে কি মনে করে!

সময় গড়ায়! সবার চোখে মুখেই আতঙ্ক বিরাজ মান! সেই আতঙ্ক কেটে নতুন ভোরের সূচনা হয়। অতিশয় অপেক্ষমান কর্ণ গহ্বর আকাঙ্ক্ষিত ক্রন্দনরত সুর শুনতে পায়। নবজাতকের আওয়াজ শুনেই সকলের মুখে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ধ্বনি শোনা যায়। অরুণ যেন কিনারা খুঁজে পায়! শুধু সাঁতরে ডাঙায় উঠার পালা! অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়ে যায় টিক টিক টিক। এক মধ্যবয়সী নার্স বেরিয়ে আসে; কোলে সাদা তোয়ালে মোড়ানো নবজাতক! অদূরে দাঁড়ানো কিশোর ছেলের চোখে অদম্য কৌতূহল! সে দু এক পা করে এগিয়ে আসে বাচ্চাটাকে দেখার অভিপ্রায়! লুবমান, লাবনী আক্তার হাসিমুখে এগিয়ে এসে হাত পাতে বাচ্চা কোলে নেওয়ার জন্য! নার্স মুচকি হেসে মানা করে, দিবে না। অরুণ দেয়াল ঘেঁষে বসা অবস্থায় ঘার বাঁকিয়ে তোয়ালে মোড়ানো নবজাতকের দিকে চায়। দেখতে পায় না। সে ভোরকে ইশারা করে বলে,

-” দেখো দুষ্টু বাবু এসে গেছে!”
ভোর চমকপ্রদভাবে ঘার ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে চায় । মধ্যবয়সী নার্স মিষ্টি করে হেসে বলে,
-” আলহামদুলিল্লাহ! বাবুর মা সুস্থ আছে।বাবু আমার কানে কানে বলেছে তাঁর ভাইয়ের কাছে যাবে! তাই দেখা করাতে আনলাম। ভাই কে?”
ভোর চোখ বড় বড় করে বাবার দিকে চায়। অরুণ হেসে আশ্বস্ত করে। ভোর বাবাকে ছেড়ে দৌড়ে যায়। আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে নার্সের কোলে থাকা বোনকে দেখে নেয়। পরপর নার্সের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ছোট বাবু কথা বলে না আমি জানি!”
নার্স ফিসফিসিয়ে বলে,

-” তুমি ভুল জানো! বাবু তাঁর মায়ের কানে কানে বলেছে সে প্রথমে ভাইয়ের কাছে যাবে!”
ভোর সন্দেহ ভাজন চোখে চায়! নার্সের মিথ্যে কথা ভোর বিশ্বাস না করলেও খুশি হয়। গায়ে থাকা সোয়েটারে হাত মুছে নিয়ে হাত পেতে বলে,
-” দাও বনু’কে?”
নার্স যত্নের সাথে বাড়িয়ে দেয়। বাচ্চাটা যতো এগিয়ে আসে ভোরের চোখের আকার বড় হয়। বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করে। এই টুকুন বাবু? যদি পড়ে যায়? তবুও সাহস করে সে কোলে নেয়। নবজাতক বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে ভোর বিড়বিড় করে কিছু বলে। অল্প ঠোঁট ছুঁয়ে চুমু দেয় কপালে যেন ব্যাথা না পায়! বাচ্চাটা ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে দেয়। ভোর ভয় পায়; কাঁদছে কেন? সেও অনুরূপ ভঙ্গিতে ঠোঁট উল্টিয়ে ফোপাতে ফোপাতে বলে,

-” বোনু কাঁদে কেন? ভোর কি তাকে বকেছে নাকি? ও আব্বু?”
তখনই তাঁর হাতের নিচে এক উষ্ণ কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে বাচ্চাকে নিজ কোলে নেয়। হেলিয়ে দুলিয়ে তাঁর কান্না থামিয়ে বলে,

-” মা কাঁদবে কেন? আমার মায়ের টকটকে লাল ঠোঁট জোড়া সবসময় মিষ্টি হাসির গল্প বলুক! তাঁর ঝুলিতে বারো মাসী সুখের পুষ্প ফুটুক! তাঁর আগমনে ধরনীর প্রতিটি অন্ধকার কোণায় সুখের প্রদীপ জ্বলুক!”
মা বললো? তাঁর মানে মেয়ে হয়েছে নিশ্চয়ই? এইটুকুন বাচ্চা দেখে বোঝার উপায় নেই ছেলে না মেয়ে! সে হামি তোলে! বাচ্চা দেখে নিয়েছে এখন ঘুমোনো যাক! সে উল্টো পথে পা চালিয়ে চলে যায়! ভোর ব্যাতিত কারোর নজরেই পড়ে না কিশোর হ্যাংলা পাতলা ছেলেটা! ভোর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কিশোর ছেলের প্রস্থান দেখে। ওটা কি ছেলে ধরা? তার বোনকে চুরি করতে এসেছিলো?”

পাতাকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে! ডাবল বেডের কেবিনে সবাই অপেক্ষায় আছে প্রসূতি’র জ্ঞান ফেরার! ছোট ভোর অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে অপর বেডে। বাকি সবাই জেগে! অরুণ মেয়েকে উষ্ণ কম্বলে মুড়িয়ে কোলে নিয়ে পুরো রুম জুড়ে শব্দহীন পায়চারী করছে। আতিকুর ইসলাম ভোরের পাশে গা এলিয়ে দিয়েছে তবে ঘুমায় নি। লুবমান সোফায় বসে ফোনে ব্যস্ত। সকলের কাছে ভাগ্নির আগমনের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে মিটমিট করে হাসছে। অরুণ আড়চোখে চাইতেই তাঁর হাঁসি জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। লাবনী আক্তার মেয়ের শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে! গায়ে থাকা মোটা কম্বল দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিচ্ছে। বেশ শীত পড়েছে; ঠান্ডা না লাগে! এর মাঝেই ডাক্তার সাবিনা ও সেই মধ্যবয়সী নার্সের আগমন হয়। এসেই জিজ্ঞেস করে,

-” এখনো জ্ঞান ফেরেনি?”
লাবনী আক্তার উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-” আপনি দেখুন না? এতক্ষণ তো জ্ঞান ফেরার কথা!”
ডাক্তার সাবিনা চেয়ার টেনে পাতার কাছে বসে। স্যালাইন ফুরিয়ে যাওয়ার পথে! সে পাতার হাত থেকে স্যালাইন খুলে রাখে। পালস রেট চেক করে! পাতার গালে আলতোভাবে চাপড় দিয়ে ধীমান সুরে ডাকে। কয়েকবার ডাকার পর পাতা চোখের পাতা নড়ে! হঠাৎ চোখ খুলে চায়। চোখে মুখে আতংক ফুটে ওঠে। ঘনঘন শ্বাস টেনে নিতেই মুখ দিয়ে ব্যথাতুর ধ্বনি বের হয়। চোখ মুখ খিঁচে নেয়। ডাক্তার সাবিনা কিছু বলার জন্য উদ্যত হয়; তবে তার বলার আগেই গম্ভীর সুরে আশ্বাস বানী শোনা যায়,

-” এই পাতাবাহার? রিল্যাক্স! এভরিথিং ইজ ফাইন! উই আর হেয়ার হেয়ার, সি?”
পাতা চোখ খুলে পাশে চায়! অরুণের অগোছালো মুখে মিষ্টি হাসি দেখে পাতা হাসে। অরুণ একটু ঝুঁকে ইশারায় তাঁর কোলে হালকা মিষ্টি রঙের উষ্ণ কম্বলে মোড়ানো বাচ্চাকে দেখায়! পাতার অধরকোণে হাসি ধীরে ধীরে বিলীন হয়। একহাত পেটে রাখে। যাকে প্রায় দশমাস নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখেছিলো! যে তাঁর প্রতিটা প্রশ্বাসে শ্বাস টেনেছে! যার সঙ্গ পাতা প্রতিটি ক্ষণ নিজের অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করেছে। সে এখন তাঁর সঙ্গে নেই! সে দিন দুনিয়ার সাথে পরিচিত হয়েছে! মায়ের ছোট্ট দুনিয়া থেকে তাঁর আগমন ঘটেছে এই বিশাল পৃথিবীতে! পাতা হাত বাড়িয়ে মেয়েকে চায়। অরুণ এগিয়ে আসে মেয়েকে নিয়ে! নার্স বেডটা ব্যাকরেস্ট পঁচাত্তর অ্যাঙ্গেলে করে দেয়। অরুণ পাতার কাছে দেয়। পাতা কেঁপে ওঠে অজানা অনুভূতিতে। মেয়ের কপালে অধর ছুঁয়ে হাসতে হাসতেই হু হু করে কেঁদে ওঠে। কেউ তাঁকে সান্ত্বনা দেয় না। না তাঁর কান্না থামায়। কাদুক একটু! এ যে এক মায়ের প্রাপ্তির কান্না! যুদ্ধে জয়ী এক যোদ্ধার বিজয়ী কান্না! পাতার কান্নায় অবুঝ বাচ্চাটা কেঁদে ওঠে শব্দ করে! পাতা মেয়ের কান্না দেখে কান্না ভুলে তাঁকে চুপ করানোর চেষ্টায় লেগে যায়! আধো আধো ভেঙে আসা গলায় বলে,

-” আমার সোনা মেয়ে কাঁদে না! এই তো আম্মুর বুকে আছো তুমি!”
বাচ্চাটা পাতার বুকে উষ্ণতা খুঁজে চুপটি করে যায়। পিটপিট করে চেয়ে দেখে সব! পাতা হাতের উল্টো পিঠে চোখ গাল মুছে মেয়েকে প্রাণ ভরে দেখে নেয়! মাথা ভর্তি চুল! লাল লাল মুখ! চোখের পাপড়ি গুলো ঘন ও বড় বড়! কিন্তু চোখদুটো ছোট ছোট! নাকটা একটু বোচা। বাবার মতো নাক সিকায় তুলে রেখেছে! পাতা নাকটায় চুমু দিয়ে অরুণের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
-” আপনার মতো কেন হবে?”
অরুণের হাসিমুখে বিরক্তি প্রকাশ পায়। এটা কেমন ধারার প্রশ্ন। মেয়েটার মাথার তাঁর ছিঁড়ে গেছে নাকি! অরুণ ত্যাক্ত গলায় বলে,
-” আশ্চর্য! আমার মেয়ে আমার মতো হবে না? তুমি প্লিজ তোমার মুখটা বন্ধ রাখো। এতো বড় মেয়ে ঘটে বুদ্ধি সুদ্ধি কিছুই নেই!ইডিয়েট!”

ধমকে পাতার মুখ খানি চুপসে যায়। একটু খারাপও লাগে। এভাবে কেউ ধমক দেয়! তবে মেয়ের টুলু মুলুক চাহনি দেখে পাতার খারাপ লাগা উবে গেল! মেয়ের গাল মুখ ছুঁয়ে দেয়। শারীরিক ব্যাথা পাতা ভুলে গেছে। ব্যাথার পর যদি এরকম সুখের খোঁজ মিলে তো ব্যাথাকে সুস্বাগতম! পাতা আশে চেয়ে ভোরকে খোঁজে,
-” ভোর কই? আমি কিন্তু বলেছিলাম বাচ্চা সবার আগে যেন তাঁর ভাইয়ের কাছে যায়!”
ডাঃ সাবিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

-” সত্যিই তো! ভোর কই? সে কি কান্না তাঁর! বলে কিনা দুষ্টু বাবুকে বের করে আম্মুকে ফাস্ট ফাস্ট ঠিক করে দাও!”
অরুণ বিছানায় ইশারা করে। ঘুমিয়ে আছে। পাতা একটু উঁচু হয়ে দেখার চেষ্টা করে। পেটে টান লাগায় ব্যাথায় কুঁকিয়ে যায়। অরুণ এগিয়ে এসে আরেকটা ধমক দেয় চাপা স্বরে! এই মেয়ে বাচ্চা সামলাবে কি করে? পাতা নাকের পাটা ফুলিয়ে নেয়। এ যেন সেই আগের নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক। যে কথায় কথায় ধমক দিতো! কি বলেছিলো ডেলিভারীর আগে? তাকে তাঁর মতো ভালোবেসে রাগ ভাঙাবে! এই তাঁর নমুনা? আর গুলবাহার! সে ভুলে নি কিছুই। সময় আসুক সব উসুল করবে! সে চুপ করে যায় মেয়েকে নিয়ে। লাবনী আক্তার এগিয়ে এসে নাতনিকে কোলে নিতে চায়। পাতা দেয় না। থাক তাঁর কাছে একটু! তিনি হেসে বলে,

-” সাবধানে নড়াচড়া করবি পাতু! সবাইকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। বিশেষ করে ভোর। তোর চেয়ে বেশি ভোর কান্নাকাটি করেছে আজ! সারাটা রাস্তা আম্মু আম্মু ডেকে কেঁদেছে।”
পাতা মুচকি হাসলো। ছেলেটা তাকেও চোখে হারায়! সে মাকে বলে,
-” ওকে একটু এখানে আনো? আমি একটু দেখি আমার ছেলেকে!”
-” না! তোমার কন্ডিশন ভালো নয়! একটু এদিক সেদিক হলে লেগে যাবে। পরে দেখো!”

অরুণের স্বাভাবিক গলা। পাতা আর কিছুই বলে না। নার্স মহিলাটি লাবনী আক্তারের কাছে গিয়ে বলে বাচ্চাটাকে ফিডিং করাতে হবে। পুরুষ দের বাইরে পাঠিয়ে দিতে। লাবনী আক্তার বাইরে যেতে বললে লুবমান বোনের গাল টেনে ভাগ্নিকে আদর করে চলে যায়। আতিকুর ইসলাম মুচকি হেসে পাতার মাথায় বুলিয়ে চলে যায়। অরুণ দ্বিধায় পড়ে সেও কি বেরিয়ে যাবে? তাকে তো বেরিয়ে যেতে বলে নি! ঘারে হাত ডলে একটু পর সেও চলে যায় গটগট করে! আরেকটু পরেই ফজরের আজান পড়বে!

নতুন বছর, নতুন ভোর নতুন দিনের সূচনা! বছরের এই প্রথম ভোর হাসপাতালের কেবিনেই কেটে গেলো। শীতের সকাল ঘড়িতে সাতটা বেজে পঁচিশ! ভোর আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে ওঠে।দুই হাতে চোখ ডলে। হামি তুলে আশেপাশে চাইতেই কপালে ভাঁজ পড়ে! কিছু মনে পড়তেই চোখের আকার বড় হয়! তড়িৎ বেগে মাথা ঘুরিয়ে এদিকে ফেরে!

পাতা মুচকি হেসে হাত নাড়িয়ে কাছে ডাকে। ভোরের চোখে মুখে বাঁধ ভাঙা হাসি। সে তড়িঘড়ি নামতে নিবে খেয়াল করে পাশে কেউ আছে? এ তো নানু! ভোর তাকে ডিঙিয়ে বেড থেকে নামে! বড়‌ বড় পা ফেলে পাতার বেডের কাছে যায়! পাতা হাত বাড়িয়ে ভোরের গালে মাথায় হাত বুলিয়ে কাছে আসতে বলে। ভোর মাথা এগিয়ে নিতেই পাতা তাঁর গালে মুখে ছোট ছোট চুমু দেয়।
-” বাবাটা কাল অনেক কেঁদে ছিলো তাই না? আজ অনেক আদর করে দিলাম!”
ভোর লাজুক হাসে। পাতার পাশে ঘুমন্ত বোনকে দেখে বলে,

-” আম্মু ভাবনা কার মতো দেখতে? কারো মতোই তো লাগে না!”
বলেই বাচ্চার হাত ছুঁয়ে দেয়। ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় ছোট ভাবনার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখের পাতা খুলে চায়। তারপর ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিবে ভোর চোখ বড় বড় করে চায়। আবার কাঁদবে? পাতা মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে বুকের উপর টেনে নেয়। ভাবনা আর কাঁদে না। ভোর হেসে আবদার করে,
-” আমার কাছে দাও না আম্মু?”
পাতা দেয় তাঁর কোলে। ভোর কোলে নিয়ে হাঁটে। বিড়বিড় করে কিছু বলে। পাতা জানতে চাইলে ভোর মিষ্টি করে হেসে বলে,

-” বকছি ওকে। তোমার টাম্মিতে থেকে কেনো এতো দুষ্টুমি করেছে তাই!”
পাতা হেসে দেয়। ছোট ভাবনা কুটুর মুটুর করে তাকিয়ে থাকে শুধু! ভোর তাকে পাতার কাছে দিয়ে বলে,
-” আব্বু কোথায়?”
-” নামাজ পড়ে হাঁটতে বেরিয়েছে বোধহয়। এসে পড়বে। কেন কি হয়েছে?”
-“কিছু না আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি!”

বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। পাতা ডাকে, মানা করে যেতে ভোর শোনেই না। ভোর ভালো করে নিজেদের কেবিন নম্বর দেখে নিয়ে বামদিকে চলে যায় হাঁটতে হাঁটতে। পড়নে ধূসর রঙের সোয়েটার ও জিন্স প্যান্ট। সোয়েটারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভোর আপনমনে হাঁটে আর এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে দেখে আব্বুকে কোথায়ও পাওয়া যায় কি না। কিন্তু পায় না। ফিরতি পথে ভোর খেয়াল করে পিছু পিছু কেউ আসছে। কালকের ওই ছেলে ধরাটা। তাকে কি ধরে নিয়ে বিক্রি করে দিবে? ভোর দ্রুত পা চালায়! ছেলে ধরাটা ‘কুমড়ো পটাশ’ বলে কাকে ডাকছে? ভোর দৌড় লাগালো। কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। ছেলে ধরাটা তার সামনে দাঁড়িয়ে!! কিভাবে এলো? ভোর পিটপিট করে চায়। আসুক তাকে ধরতে? সেও ভোর সরকার! তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া ওতোই সোজা নাকি!
-” কি রে কুমড়ো পটাশ? সাপের মতো‌ ফোঁস ফোঁস করছিস ক্যান? আর কখন থেকে ডাকছি শুনে দৌড় দিলি ক্যান?”

ভোর ড্যাবড্যাব করে চায়। তাকে কুমড়ো পটাশ বললো? কুমড়ো কি জিনিস? ভালো নাকি পঁচা জিনিস? তবে সে উত্তর দেয় না। আশেপাশে তাকায় । সামনের ব্যাক্তিটি ভোরের মাথায় চাটি মেরে বলে,
-” কথা বলছিস না ক্যান? এই মটু?”
ভোর এবার রেগে যায়। একে তো তাকে মারলো তার উপর মটু বলছে! সে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
-” আমি মটু নই। না কুমড়ো পটাশ! তুমি কে? ছেলে ধরা? আমি আব্বুকে কল করেছি এক্ষুনি পুলিশ এনে ধরে নিয়ে যাবে তোমাকে!”
কিশোর ছেলেটি হ্যাংলা পাতলা শরীর দুলিয়ে হেসে ওঠে শব্দ করে। ভোরের গাল জোড়া টেনে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
-” পুলিশ? পুলিশের বাপেরও ক্ষমতা নেই আমাকে ধরার। আর তোর মতো কুমড়ো পটাশকে ধরে আমি কি করবো? তোর বোন আছে না তাকে নিয়ে যাবো! এই তোর নাম কি রে?”
ভোর হাত ছোটানোর চেষ্টা করে পারে না। কিশোর টির হাতে দাঁত বসিয়ে দেয় শক্ত করে। কিশোরটি ভোরকে ছেড়ে ব্যাথায় মুখ কুঁচকে নেয়। ভোর দৌড় লাগালো। একটু দূরে গিয়ে পেছন ফিরে গলা উঁচিয়ে বলে,
-” আমার নাম ভোর সরকার! আমাকে কুমড়ো পটাশ বললে তোমার নাক ফাটিয়ে দিবো বেয়াদব ছেলে!”
কিশোরটি গোল গোল করে চায়। ভোর ভেংচি কেটে চলে যায় দৌড়ে। এক দৌড়ে নিজ কেবিনে ঢুকে হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতে থাকে। পাতা চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞাসা করে,

-” এই ভোর? কি হয়েছে? এভাবে দৌড়ে এলে কেন?”
ভোর গিয়ে পাতার বেডে উঠে বসে।
-” কিছুই হয় নি। একটা পাগল ছিলো!”
পাতা বিশ্বাস করে না তাঁর কথা!চোখ মুখ খিঁচে উঠে বসে বিছানায়! ভোরের মাথার এলোমেলো চুল ঠিক করে আবার জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে! ভোর কিছু বলবে এর আগে দরজায় নক করে কেউ! পাতা পাশ থেকে শালটা তুলে গায়ে জড়িয়ে নিলো। মেয়ের গায়ে কম্বলে দিয়ে ঢেকে দেয়। ভোর জোরে বলে,
-“কে? ভেতরে আসো!”

সবার আগে অরুণ সরকারের আগমন ঘটে। পাতা ভ্রু কুঁচকে চায়। লোকটা সভ্য হলো কবে? অরুণের পেছনে দুজন নতুন মুখের আগমন ঘটে। বয়স্ক গোছের হাট্টাগোট্টা লোক; ধার্মিক গোছের। সাথে এক কিশোর ছেলে! পাতা সালাম দিলো। ভোর কিশোর ছেলেকে দেখে চোখ বড় বড় করে চায়। এ যে ছেলে ধরা? কিশোর ছেলেটি ভোরের দিকে তাকিয়ে আড়ালে চোখ রাঙায়। বয়স্ক গোছের লোকটা হেসে সালামের জবাব নিয়ে পাতাকে জিজ্ঞেস করে,

-” কেমন আছেন? বাচ্চা সহি সালামত আছে তো?”
-” আলহামদুলিল্লাহ! আপনি কেমন আছেন?”
বলে পাতা অরুণের দিকে চায়। কারা এনারা? পাতা তো চেনে না! বয়স্ক লোকটি আবারো হেসে জবাব দেয়,
-” আলহামদুলিল্লাহ! অরুণ এই বুঝি তোমার ছেলে? মাশাআল্লাহ বাপের মতো হয়েছে ছেলে। তা ঘরের জান্নাত কই?”
ভোর ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে সবার দিকে।অরুণ এগিয়ে এসে মেয়েকে কোলে নেয়। লোকটিকে সোফায় বসতে বলে। তাঁরা বসলে অরুণ মেয়েকে দেখায়,
-” এই যে আঙ্কেল! আর পাতা ইনি আম্মু’র খালাতো বোনের ভাসুর! আঙ্কেল হয় আমার! ওনার মেয়ে হাসপাতালে এডমিট আছে গত পরশু তারও ডেলিভারী হয়েছে। তাকে দেখতেই এসেছে। ভোরে মসজিদে দেখা হলো‌। সম্পর্ক দূরের হলেও ওনার সাথে ওঠা বসা ছিলো এককালে!”
পাতা ঠোঁট গোল করে ‘ওহ্’ বলে। কিন্তু সে ছাতার মাথা কিছুই বুঝলো না। তাঁর শাশুড়ির খালাতো বোনের ভাসুর!! কতো দূরের সম্পর্ক।

বয়স্ক লোকটি অরুণের কাছ থেকে ছোট ভাবনাকে কোলে তুলে নিলো! কয়েকবার ‘মাশাআল্লাহ’ আওড়িয়ে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” অরুণকে ওঁর খালার বিয়ের সময় দেখেছিলাম। তখন চার কি পাঁচ বছরের ছিলো। অবিকল ওর ছেলের মতো! বিয়ের এক মাস গত হওয়ার পরে শুনি সালমা’র ( অরুণের খালা) খালাতো বোন মারা গেছে। আল্লাহ পাক তাকে জান্নাত নসিব করুন! সেদিন ছেলেটার কান্না বুকে লেগেছিলো এতটুকু বাচ্চা মা ছাড়া কিভাবে থাকবে? তারপর অনেক বছর দেখা হয় নি! আমি টুকটাক রাজনীতি করি! সেই সুবাদে স্বাধীন চৌধুরীর সাথে সম্পর্ক ভালো। অরুণ উঠতি বয়সে মামার কিছু কিছু কাজে হাত বাটাতো। তখনই টুকটাক পরিচয় হয়েছিলো!”
পাতা এবার বুঝতে পারলো! সে আড়চোখে অরুণের দিকে চায়। ওহ্ রাজনীতিতেও টুকটাক হাত লাগিয়ে ছিলো বদমেজাজি লোক!

কিশোর ছেলেটি তাঁর বাবার কোল থেকে ভাবনাকে নিজ কোলে তুলে নেয়। ভোর এবার ফুলে ঢোল! পঁচা ছেলে তাঁর বোনকে কেন কোলে নিবে? ভাবনা পিটপিট করে চায়। কিশোর ছেলেটা হেসে বলে,
-” এর তো নাকটা বোচা! এই বুচি?”
বয়স্ক লোকটা ছেলেকে চোখ রাঙায়। ছেলেটা তাতে ভয় পেলো না বোধহয়। অরুণের চোখে মুখে অসন্তোষের ছাপ! বয়স্ক লোকটি ছেলের পিঠ চাপড়ে বলে,
-” পাঁচটা মেয়ের পর একটা ছেলে দিয়েছে খোদা তায়ালা! সবার চোখের মনি। অতি মাত্রায় আদর ভালোবাসা পেয়ে বাঁদর বনে গেছে!”
পাতা মুচকি হাসলো। পাঁচটা বোনের পর এক ভাই! তাহলে সেই ভাইটা সকলের কতটা আদরের তাতে সন্দেহ নেই! পাতা কিশোর ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে,

-” নাম কি তোমার?”
-” সোহরাব শেখ!”
কিশোর ছেলেটি উচ্ছ্বসিত হয়ে জবাব দেয়। ভোর ভেংচি কাটলো। অরুণ পাশ থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
-” আঙ্কেলের নাম রুস্তম শেখ!”
পাতা অবাক চোখে চায়। ‘সোহরাব রুস্তম’ পারস্য গাঁথা। যেখানে রুস্তম তাঁর ছেলের বুকে ছুড়ি চালিয়ে হত্যা করে! তাঁর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে লোকটার স্ত্রীর নাম কি তাহমিনা? পাতা বয়স্ক লোকটার দিকে চায়। কালো দাঁড়ি পাকতে শুরু করেছে। বয়স্ক রুস্তম শেখ নামক লোকটি হেসে ওঠে পাতার অবাকতায়!
-” ছেলে আমার সাত রাজার ধন! তাঁর বুকে ছুরি চালানোর আগে নিজের বুকে ছুরি চালিয়ে সারে তিন হাত মাটির তলে যাবো!”
-” আব্বা?”

সোহরাব হালকা ধমকের সুরে ডাকে। রুস্তম শেখ ছেলের মাথার চুল এলোমেলো করে দিলো। সোহরাব তার বাবাকে কিছু ইশারা করে। রুস্তম শেখ ছেলের ইশারা বুঝতে পেরে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একজোড়া স্বর্ণের বালা বের করে ছোট ভাবনার ছোট হাতে পরিয়ে বলে,
-” আমার মেয়ের ছেলে হয়েছে। ডাক্তার বলেছিলো মেয়ে হবে। তাই সোহরাব চুড়ি জোড়া এনেছিলো। কিন্তু হলো ছেলে। রেগে মেগে ডাক্তারকে তো ঝেড়েছেই বাচ্চাকটাকেও কোলে নেয় নি। এখন চুড়ি জোড়ার আসল মালকিন পেয়ে গেলাম!”
অরুণ বাঁধ সাধলো।
-” আঙ্কেল? শুধু দোয়া করে দিন। এটা নিতে পারবো না।”
রুস্তম শেখ ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর গলায় বলে,
-” তোমাকে দেই নি! ভালোবেসে দোয়া করে দিচ্ছি না নিলে আমি মন খারাপ করবো অরুণ!”
অরুণ তবুও নিতে নারাজ। ছোট্ট ভাবনা হঠাৎ কেঁদে ওঠে গলা ফাটিয়ে! ভোর এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার চিল্লিয়ে বলে,

-” দিলে তো বোনটাকে কাঁদিয়ে!”
সোহরাব ভাবনাকে দুলিয়ে বলে,
-” ও লে লে বুচি কাঁদে ক্যান?”
ভোর নেমে এসে তাঁর হাত টেনে ধরে বলে,
-” আমার বোনের নাম ভাবনা। বুচি না। দাও ওকে?”
সোহরাব দেয় না। উঁচুতে তুলে হেসে বলে,
-” দেবো না। ভাবনা বুচি’কে আমরা নিয়ে যাবো! তাই না আব্বা?”
রুস্তম শেখ হেসে ওঠে। অরুণের মুখে অবশ্য হাসি নেই। মেয়েটা কাঁদছে! আর এই বাঁদর ছেলেটা দিচ্ছেও না। সে তিন-চার বার নেওয়ার চেষ্টা করছে দেয় নি। কিছু বলতেও পারছে না। ভোর এবার রেগে আগুন। সে সোহরাবের সোয়েটার টেনে কয়েকটি কিল ঘুষি বসিয়ে বলে,
-” ছাড়ো আমার বোনকে। দাও বলছি? ও আব্বু দিতে বলো ওকে?”
অরুণ ছেলেকে ছাড়িয়ে নেয়। সোহরাব ভ্রু কুঁচকে বাচ্চাটাকে তাঁর মায়ের কাছে দেয়। পাতার জানে প্রাণ ফেরে। মেয়েকে বুকের মাঝে লুকিয়ে নেয়। অরুণ ক্ষ্যাপাটে ভোরকে কোলে নিয়ে সোহরাবের উদ্দেশ্যে বলে,

-” স্যরি সোহরাব! কিছু মনে কোরো না।”
সোহরাব হাসে। তবে মনে মনে ভোরের পিন্ডি চটকায়। কুমড়ো পটাশ কোথাকার! রুস্তম শেখ এসে ছেলের কাঁধ জড়িয়ে অরুণের উদ্দেশ্যে বলে,
-” আরে বাচ্চা ছেলে! কি মনে করবে? আর তোমার ছেলের চেয়ে আমার ছেলে বেশি বাচ্চামো করে। একেবারে লেজ কাটা বাঁদর!”
সবাই হেসে ওঠে তাঁর কথায়। সোহরাব মাথা চুলকিয়ে লাজুক হাসে। একটু পরেই বিদায় নিয়ে বের হয়ে যায় তাঁরা! তাঁরা বেরিয়ে যেতেই ভোর বাবার কোল থেকে নেমে কোমড়ে হাত রেখে বলে,
-” পঁচা লোকদের কেন এনেছো তুমি?”
অরুণ হেসে তাঁর নাক টেনে সোফায় হাত পা ছড়িয়ে বসে।

নতুন বর্ষের তৃতীয় তম দিন চলমান! রৌদ্র উজ্জ্বল একটা দিন। সকালের ঘন কুয়াশা ছাপিয়ে সূর্য মহাশয়ের তেজস্বী রূপে উত্তপ্ত ধরনী! শীতের রুক্ষতায় একটু স্বস্তির নিশ্বাস। পাতা নিজ নীড়ে বেলকনিতে বসে আছে মেয়েকে নিয়ে। দোলনায় বসে মেয়েকে নিয়ে দোল খাচ্ছে। কখনো আধো আধো বুলিতে কথা বলছে তো খিলখিলিয়ে হাসছে। ছোট্ট ভাবনা প্রতিক্রিয়া শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে মায়ের হাসি। কখনো হাত দিয়ে পাতার পরনের ফ্রকের ফিতা টেনে ধরে তো কখনো আঙুল চুষে। পাতা মেয়ের লাল টকটকে অধরজোড়ায় চুমু দিয়ে তাকে ফিডিং করায়। কাল সকালে এসেছে তাঁরা এবাড়িতে। এসেছে বলতে আনা হয়েছে। জেদি অরুণ সরকার একপ্রকার তুলে এনেছে। কেউ বারণ করার অবকাশ পায় নি। সেও বারণ করে নি। খুশি খুশি চলে এসেছে। এই বিরহে সবচেয়ে বেশি তাঁর হৃদয়টাই পুড়েছে। প্রতিটা মুহূর্ত পাতা বিরহের যন্ত্রণায় ছটফট করেছে। সে চাইতো লোকটা তাঁর জন্য ছটফট করুক; একটু পাগলামি করুক! লোকটা ছটফট করেছে কি না জানে না; বাট পাতা গত সাতদিন লোকটার মুখ দর্শন না করে হাসতে ভুলে গিয়েছিলো। কেমন পাগল বনে গিয়েছিলো। না ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া না যত্ন! কেমন বিষন্নের চাদরে মুড়ে গিয়েছিল! সে বুঝতে পেরেছে! অরুণ সরকারের তাকে দরকার না হলেও পাতার লোকটাকে ছাড়া এক মুহুর্ত চলবে না। লোকটা পাতার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর পাতা চায় তার এই অভ্যাস সারাটা জনম চলুক। পাতার ধ্যান ভঙ্গ হয় চেনা পরিচিত কন্ঠে। পাতা গলা উঁচিয়ে বলে,

-” আমি এখানে!”
বাবা ছেলের আগমন ঘটে বেলকনিতে!অরুণ পাতার কোল থেকে মেয়েকে তুলে নিয়ে আদর করে। ছোট ভাবনার খাওয়ার মাঝে বাঁধা দেয়ায় কেঁদে দিলো! অরুণ তাকে জলদি করে হস্তান্তর করে। পাতা মেয়েকে বুকে রেখে বলে,
-” আধা ঘন্টার কথা বলে আড়াই ঘন্টা লাগিয়ে দিলেন! একা একা ছিলাম তো!”
অরুণ হাতে থাকা আইসক্রিম মুখে নিয়ে বলে,
-“রেজাল্ট দেখলাম! ভর্তি করালাম একটু দেড়ি হবে না!”
ভোর হাসিমুখে রেজাল্ট শিট দেখায় পাতাকে! পাতা হাতে নিয়ে দেখে,
-” বাহ্ ম্যাথে হান্ড্রেড! ইংলিশ এইট্টি এইট! সব সাবজেক্টে ভালোই করেছো। বাংলাতে এতো কম কেন? মাত্র সেভেন্টি ফাইভ!”
অরুণ রেজাল্ট শিট হাতে নিয়ে বলে,
-” ফাস্ট আর সেকেন্ড গার্ল সবেতে হান্ড্রেড পেয়েছে! ইনি এই মার্ক তুলে ফিফটিন্থ পজিশনে আছে! আনিকা ওর স্কুলে ফাস্ট এসেছে!”

ভোর ভ্রু কুঁচকে চায়। পাতা হাসি মুখে তাঁর গাল টেনে বললো,
-“আলহামদুলিল্লাহ ! অনেক ভালো করেছে আমার ছেলে! সামনে আরো‌ ভালো করবে। আপনি আবার বকেন নি তো বাবা টাকে?”
অরুণ আইসক্রিম খাওয়া বাদ দিয়ে ভোরের দিকে চায়। ভোর মিষ্টি করে হেসে বলে,
-” একটুও বকে নি! তিনটে আইসক্রিম খাইয়েছে।”
পাতা অরুণের দিকে চায়। লোকটার হাতেও একটা কোন আইসক্রিম! বুড়ো বয়সে আইসক্রিম খাওয়া হচ্ছে! পাতা শাসনের সুরে বলে,
-” এই শীতে আইসক্রিম? ঠান্ডা লাগুক দু’জনকেই পুকুরে চুবিয়ে আনবো বলে..উমম.”
আর বলতে পারে না পাতা। তাঁর মুখে আইসক্রিম ঠুসে দেওয়া হয়েছে! পাতা কটমট করে চায়! অরুণ হেসে পাতার পাশে বসে। মেয়ের ঠান্ডা পায়ে তালু ঘঁষে গরম করে। ভাবনা উঁকি দিয়ে দেখে। ভোর হাতের সব জিনিসপত্র ফেলে বায়না করে,

-” বনু’ কে দাও?”
অরুণ ছেলেকে টেনে কোলে বসিয়ে বলে,
-” খাচ্ছে তো! পরে নিও কলিজা!”
ভোর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” ভোরেরও খিদে পেয়েছে!”
-” তাই? আমার আব্বু কি খাবে? ফরমায়েশ জারি করুন!”
-” পাস্তা উইথ চিকেন ফ্রাই! সাথে সেমাই !”
-” বাবার আদেশ শিরধার্য!”

কিচেনে অরুণ দক্ষ হাতে রান্না করতে ব্যস্ত। ছোট ভোর তাকে হাতে হাতে সাহায্য করছে। পাতাবাহার কেবিনেটের উপর বসে সসের বোতল দখলে নিয়েছে। দেবে না সে! পাতা মেয়েকে নিয়ে পাশে বসে আছে! মেয়ে ঘুমিয়ে আছে! বিছানায় শুইয়ে দিলে উঠে যায়। কোলেই ঘুমাবে সে! পাতা চুপচাপ বাবা ছেলের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করে। কি সুন্দর করে রান্না করছে বাবা ছেলে। বাবা হুকুম করছে ‘ভোর এটা আনো ওটা আনো?’ ভোর উৎসাহের সঙ্গে এনে দিচ্ছে। পাতার ভালোলাগে। মেয়েটা বড় হলে সেও বাবার হাতে হাতে কাজ করে দিবে। আর পাতা আছে তো তাদের রান্না করা খাবার খেয়ে প্রশংসা করে বাহবা দিতে! পাতা হাসে। হঠাৎ কিছু মনে‌ পড়তেই পাতার হাসি চওড়া হয়। হে গলা পরিষ্কার করে ভোরকে ডেকে বলে,
-” ভোর তুমি জানো তোমার বাবা একটা ঘোর ষড়যন্ত্র রচনা করেছে?”
ভোর অবুঝ চোখে চায়। না সে আম্মুর প্রশ্ন বুঝতে পেরেছে! না সে বাবার রচনার কথা জানে! সে অবুঝ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। অরুণ পেঁয়াজ কুচি কড়াইয়ে ফেলে পাতার দিকে চায়। ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা! পাতা তাকে ভেংচি কেটে ভোরকে বলে,

-” তোমার বাবা একটা গুলবাহার খুঁজে বেড়াচ্ছে!”
ভোর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আব্বু গুলবাহার কি? তুমি ওটা খুঁজে কি করবে?”
-” কি আর করবে! তাঁর সাথে সংসার পাতবে। আমরা তো পুরনো তাই না?”
পাতা ত্যাড়া গলায় বলে! অরুণ ছোট ছোট চোখে চায়। এই না হলে মেয়ে মানুষ! ভালোবাসার কথা বলেছে সেটা মনে রাখে নি একটু বাঁকা কথা বলেছে সেটাই টেনে হিঁচড়ে বড় করছে! ভোর হা করে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। অরুণ ছেলের মুখটা বন্ধ করে দিয়ে বলে,

পাতা বাহার পর্ব ৫৭

-” ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়ালে একটা দুষ্টু মিষ্টি সারপ্রাইজ পাবে! জলদি দৌড়াও!”
পাতা চোখ বড় বড় করে চায়! ভোর সারপ্রাইজের কথা শুনে এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না। চলে যায় এক দৌড়ে! তাঁর পেছনে পাতাবাহারও দৌড় লাগালো! ভোর ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়ালে আয়নায় নিজ প্রতিবিম্ব ব্যাতিত কোনো সারপ্রাইজ দেখতে পারে না। আব্বু তাকে বোকা বানালো?

পাতা বাহার পর্ব ৫৯