পাতা বাহার পর্ব ৬

পাতা বাহার পর্ব ৬
বেলা শেখ

কিড জোনে উপস্থিত প্রায় সকলের নজর পাতার পড়ে যাওয়ার দিকে। বাচ্চারা তো উচ্চ স্বরে হাসছে। বড়রা মিটি মিটি করে হাসছে। যেন কোনো কমেডি সো চলছে। অরুণ দৌড়ে যায় ছেলের কাছে। লাঞ্চ শেষে হাতের কাজ শেষ করে শুভ ও ভোরকে নিয়ে শপিং মলে এসেছে তারা। নিজেদের কিছু কেনাকাটার‌ পরে ভোর বায়না ধরে খেলনা চাই! তাই কিড জোনে আসা। কিড জোনের ভিতরে আসতেই ভোরের নজরে আসে মিস পাতাবাহার! ব্যস ভোরকে আর পায়কে! দৌড়ে যায় তার কাছে!
পাতা ফ্লোরে পড়ে আছে চিৎপটাং হয়ে ভোর তার পাশেই তার উপরে পড়ে গড়িয়ে গেল ফ্লোরে। অরুণ ভোরকে তুলে নিয়ে হাত পা চেক করে গম্ভীর কণ্ঠে ধমকের সুরে বলে,

-” তুমি সুধরাবে না? এ কেমন অভদ্রতা! কোথায় লেগেছে বল? হাতে ব্যথা পেয়েছ?”
তার ধমকে পাতা নিজেও খানিকটা কেঁপে উঠল। কি ভয়ানক কণ্ঠ! যেন আলাদিনের চেরাগের দৈত্য! সে উঠে পড়ল! ভালোই ব্যথা পেয়েছে কোমড়ে কনুইয়েও লেগেছে হালকা! দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করে বাবা ছেলের কান্ড দেখছে। অরুণ ছেলেকে বকছে আর হাত পা চেক করছে কোথাও লেগেছে কিনা! চোখে মুখে উৎকণ্ঠা! অথচ তার ছেলের জন্য সে যে ব্যথা পেল তার দিকে নজরই নেই!
-” আব্বু আয় এম ফাইন!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরুণ তবুও উদ্বিগ্ন হয়! ছেলেটা বকা খাওয়ার ভয়ে না মিথ্যে বলে! ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে!
পাবেল এতক্ষণ ঘোরেই ছিল! ঘোর কাটতেই পাতার কাছে আসে পাতাকে কনুই ধরে ডলতে দেখে এসে কনুইয়ে মালিশ করে বলে,
-” ঠিক আছো তুমি? বেশি লেগেছে?”
পাতা পাবেলের দিকে চায়‌। লেগেছে তো ভালোই! তবে তার থেকে বেশি লাগছে আশেপাশের লোকজনের নজর! বাচ্চারা কেমন করে হাসছে! বড়রাও বাকি নেই। পাবেলের আওয়াজ শুনে অরুণ ভোর সেদিকে চায়! শুভও এসে তাদের পাশে দাড়ায়! ভোর হাসি মুখে বলে,

-” আসসালামুয়ালাইকুম মিস! আই এম স্যরি মিস! আসলে আমি এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম আপনাকে দেখে! তাই! আপনি ব্যথা পেয়েছেন মিস? শুভ আংকেল এই হলো আমার পাতা মিস!”
শেষের কথা শুভকে উদ্দেশ্য করে বলে। শুভ হেসে পাতাকে হাত নাড়িয়ে হাই জানালো। পাতা তড়িঘড়ি করে সালাম দিল শুভকে!
-” আসসালামুয়ালাইকুম স্যার! কেমন আছেন?”
শুভ হেসে সালামের জবাব দিয়ে বলল,
-” আই এম ফাইন! তুমি কেমন আছো পাতা? তোমার স্টুডেন্ট তোমার অন্নেক প্রশংসা করে!!
পাতা হেসে মাথা নাড়ায়। ভালো আছে সে! অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে! ওরা একে অপরকে চেনে! সে প্রশ্নাত্মক চাহনিতে শুভর দিকে চায়! শুভও তার দিকে তাকিয়ে সায় জানায়! ভোর অবাক হয়ে বলে,
-“মিস আপনি আঙ্কেলকে চিনেন?”

পাতা মাথা নাড়ে! পাবেল তার হাত এদিক ওদিক করে নাড়াচাড়া করছে! মচকে টচকে যায় নি তো! অরুণ ভোরের নজর পাবেলের দিকে। পাতা সেটা খেয়াল করে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলে,
-” ভোর তোমার আঙ্কেল আমার স্যার হয়! তোমরা এখানে? শপিং করতে এসেছো বুঝি?”
ভোর অরুণের কোল থেকে নামতে চায় অরুণ ছাড়ে না। ভোর চেষ্টা চালিয়েই পাতার কথার জবাব দেয়,
-” জি মিস! আপনিও খেলনা কিনতে এসেছেন?
-” হুম!”
পাবেল সামনের সকলকে একনজরে পরখ করে নেয়! পাতাকে বলে,
-” এরা কারা তোমার চেনা পরিচিত?”

-” এই পিচ্চি টা ভোর সরকার আমার স্কুলের স্টুডেন্ট! আর উনি ভোরের অব্বু! আর ইনি আমার ভার্সিটির স্যার!”
পাতা একে একে সবাইকে দেখিয়ে বলে পাবেলকে! পাবেল সালাম জানায়! শুভ পাতাকে বলে,
-” আর এই মি. তোমার কি হয়? বয়ফ্রেন্ড?? বলতে পারো আমরা আমরাই তো!”
পাতা পাবেলের চোখ বড় বড় হয়ে যায়! পাতা বড় হলেও প্রথম কেউ দেখলে মনে হবে সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে এমন! অনেকেই আছে যাদের চেহারা বাচ্চা টাইপ! সেরকম! তাই তো স্কুলে শাড়ি পড়া! যেন একটু বড় লাগে!আর পাবেল অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে! গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়েছে! যুবক ভাবটা ছেড়ে পুরুষ পুরুষ ভাইব এসেছে সদ্য! দুজনের চেহারায় ও মিল নেই! তাই যে কারো মনে এ ভাবনা আসা দোষের কিছু না! আর আজকাল ছেলে মেয়ে ঘোরেই জোড়া জোড়া!অরুণ ভোর তীক্ষ্ণ নজরে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে যেন পাতা পাবেল কোনো আসামি!! পাতা পলক ঝাপটিয়ে বলে,

-” আস্তাগফিরুল্লাহ স্যার ভাই হয় আমার! আপন ছোট ভাই!”
পাবেল তিনটি আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে,
-” তিন বছরের ছোট আমি!”
শুভ ইতস্তত বোধ করে! ছিঃ কি ভেবে ছিল সে!
-” স্যরি পাতা! আসলে তোমার এত কেয়ার করছিলো তো তাই! কিছু মনে কোরো না তোমরা!”
-“ইটস ওকে!”

পাতা পাবেল একসঙ্গে বলে ওঠে। দু পাশেই নিরবতা! কে কি বলবে খুজে পাচ্ছেনা! পাতা বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায়! এ কোন মুসিবতে পড়ল সে! এখান থেকে যত জলদি কেটে পড়তে হবে! নইলে এদের সামনে মান সম্মানে ফালুদা হয়ে যাবে। পাবেল বোনের অস্বস্তি বুঝতে পেরে বলে,
-” আমারা যাই তাহলে! আপু চল তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে তো!”
পাতা মনে মনে ভাইয়ের বুদ্ধির ঢের প্রশংসা করে বলে,

-” হ্যা চল! ভোর আসি কেমন! ভালো থেকো কাল স্কুলে দেখা হবে! স্যার আসি!”
পাতা অরুণকে কিছু বলে না! কি বলবে! এই আগা গোড়া এটিটিউডে ভরা নাক উঁচু লোককে কি বলবে! ছেলের কান্ডে সে ব্যথা পেল অথচ তাকে সৌজন্যের খাতিরেও কিছু বলল না! হাই হ্যালো স্যরি টুকু পর্যন্ত না! ম্যানার্সলেস লোক কোথাকার! চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ভোর তাদের ফাসিয়ে দেয় !বলে,
-” মিস আপনি না খেলনা কিনতে এসেছেন? কই খেলনা? আমিও খেলনা কিনব আমাকে চুস করে দিবেন একটু? প্লিজ প্লিজ?”

পাতা ফেঁসে গেছে! পাতার এখন ফ্লোরে গরাগরি খেয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে! পাবেল বোনের দিকে অসহায় চোখে চায়।
-” আসলে আমাদের জলদি যেতে বলেছে মা! স্যরি ভোর!”
ভোরের উজ্জ্বল মুখটা মলিন হয়ে যায়! অরুণ চুপচাপ ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ ভোরের মলিন মুখ দেখে বলে,

-” আরে পাতা বেশি সময় লাগবে না তো খেলনা চুজ করতে! করে দাও তো! নইলে ভোর মুখ ফুলিয়ে থাকবে সারাক্ষণ!”
পাতা কি করবে ভেবে পায় না! মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। অরুণ ,শুভ ভোরকে নিয়ে খেলনা সামগ্রীর সামনে যায়! ভোর বাবার কোল থেকে নেমে পাতার হাত ধরে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলে,
-” আপনি কোন খেলনা কিনেছেন মিস? আমিও সেটাই নিব!”
পাতা একদম গুটিয়ে যায়! কি বলবে সে! সে তো কোনো খেলনা কেনেই নি এতো চড়া প্রাইস দেখে!
-” কিনি তো নি এখনো!”

-” তাহলে চলে যাচ্ছিলেন কেন? কিনবেন না? আচ্ছা কার জন্য খেলনা কিনবেন?”
ইশ এই ছেলে দেখি একদম হাত পা বেঁধে পিছনে লেগেছে। পাবেল বোনকে বাঁচিয়ে দিতে বলে,
-” আমাদের বোনের মেয়ে রুম্পার জন্য কিনতে এসেছিলাম! আপুর কিছু পছন্দ হচ্ছিল না! রুম্পা খুব ছোট ! এখানে সব বড় বড় খেলনা তো তাই!”
ভোর বুঝদার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। অরুণ স্বভাব সুলভ গম্ভীর মুখে বুকে হাত গুজে সব পর্যবেক্ষণ করছে। শুভ পাবেলের কথায় হেসে বলে,

-” আচ্ছা এই ব্যাপার! ভোর তুমি ওই বেবির জন্য পছন্দ করে দাও আর পাতা তোমাকে দেবে! ইকুয়াল ইকুয়াল!”
ভোর খুশি হয়! পাতাকে খেলনা চুস করতে বলে! পাতা অনেক গুলো খেলনা নেড়ে চেড়ে দেখে একটা রেলগাড়ির প্যাকেট চুজ করে!বড় রেল! ছোট ছোট কামড়া বা কেবিন আলাদা আলাদা করে রাখা প্যাকেটের ভিতর। আর চালানোর জন্য রেলের রাস্তাও আছে! ভোরকে সেটা দিলে ভোর খুশি হয়ে পাতার গালে চুমু একে ধন্যবাদ জানায়!
অরুণ চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে ভোরের কান্ড দেখছে। বাহ ছেলেটা এই পাতাবাহারের বেশ ভক্ত! শুভ বলে,
-” এবার ভোর চুস করো বেবির জন্য!”

ভোর খানিক ভেবে রেলগাড়ির প্যাকেটটা অরুণের কাছে দিয়ে কর্ণারে টেডি স্টোরের কাছে গিয়ে পিংক কালারের ছোট সাইজের টেডি এনে পাতার হাতে দিয়ে বলে,
-” বাবুকে এইটা দিও! অবশ্যই পছন্দ হবে!” পাতা হাতে নেয়! টেডির গলায় প্রাইসের লোগো দেখে আড়চোখে! পনেরশো টাকা! এই ছোট্ট টেডির দাম এতো! এর থেকে ভালো নাইন্টি নাইনে কম দামে কেনা টেডি! কিন্তু তার কিছু করার নেই! অরুণ ভোরকে বলে আরো কিছু নেবে কি না! ভোর না করে! পাতা এর ফাঁকে পাবেলের কাছ থেকে চুপিসারে কিছু টাকা নিয়ে তার ব্যাগে রাখে। তারা কাউন্টারে যায় বিল পেমেন্ট করতে! সেখানে একটা অল্পবয়সী মেয়ে বসে আছে! অরুণ টয় দুটো তাকে দিলে মেয়েটি বলে,
-” ফোর থাউসেন্ড টাকা স্যার! ক্যাশ ওর কার্ড?”
অরুণ কার্ড বের করতে নিলে পাতা ঝট করে সামনে গিয়ে ক্যাশ দেয়! মেয়েটি মুচকি হেসে বিল নিয়ে রিসিভ দেয়! অরুণ পাতার আকস্মিক কাজে হতবাক!

-” আমি দিচ্ছিলাম তো! আপনি কেন দিলেন?”
পাতা রিসিভটা নিয়ে বলে,
-” এমনি! কেন কোন সমস্যা? দিতে পারি না?”
অরুণ কাউন্টারের মেয়েটিকে বলে,
-” ওনার টাকা ফেরত দিন! আমি কার্ড দিচ্ছি!”
পাতা না না করে বলে,
-” আশ্চর্য! ফেরত দিবে কেন! আপনি দিবেন না! আর মি. ভোরের আব্বু ওটা আমার তরফ থেকে ভোরের জন্য ছোট্ট গিফট! তাই আমিই দিয়েছি! চলুন সবাই!”
অরুণ কিছু বলে না! ভোরের হাত ধরে সামনে হাটতে থাকে। পাতা পাবেল শুভ তাদের পিছু পিছু।পাতা একটু ঘাবড়ে যায়! বিল পে করায় লোকটার ইগো হার্ট হলো নাতো! হতেও পারে!হু নোস!!একটু এগিয়ে গিয়ে শুভ অরুণকে বলে,

-” ভাই চল আইসক্রিম পার্লারে যাই! গরমে ঠান্ডা হয়ে আসি!”
পাতা বাড়ি যাওয়ার তাড়া দিয়ে বলে,
-” আপনারা যান আমাদের যেতে হবে এখন!”
ভোর পিছনে ঘুরে বলে,
-” প্লিজ মিস! চলুন বেশি সময় লাগবে না!”
পাতা এগিয়ে এসে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” আজ না অন্যদিন। রাগ করে না ভোর! আমরা যাই নইলে বাড়ির লোক বকা দিবে তো! আসি ! আপনারা সবাই ভালো থাকবেন! ”

বলে বিদায় জানিয়ে ভাইয়ের হাত ধরে বেরিয়ে আসে। ভোরদের কাটিয়ে বেশ দূরে চলে আসে। সেখান থেকে শপিং মলের গেট ধরে বাইরে বের হতে নিলে পেছন থেকে ভোর ডাক দেয় পাতাকে!পাতা পিছনে ঘুরে ভোরকে দেখে অবাক হয়ে বলে,
-” তুমি এখানে? তোমরা সবাই না আইসক্রিম খেতে গেলে! তোমার আব্বু কই? দেখছি না যে একা এসেছ?!”
ভোর মিষ্টি হেসে পাতার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে দেয়!পাতার ভ্রু কুঁচকে যায়! টিস্যু দিচ্ছে কেন!
-” আমি টিস্যু দিয়ে কি করবো?”
ভোর মিষ্টি হেসে বলল,
-” আপনি ঘেমে আছেন! টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে নিন মিস!”
-” তুমি টিস্যু দিতে এতদূর এসেছো? তোমার বাবা জানলে বকবে তো!”

বলেই টিস্যু হাতে নেয়। নিলেই বুঝতে পারে শুধু টিস্যু না টিস্যু তো শো অফ! সে টিস্যু পেপার খুলে দেখে হাজার টাকার কয়েকটি নোট মোড়ানো! পাতা বিস্ময়ে ভোরের দিকে চায়! কিন্তু ভোর সেখানে থাকলে তো! পাবেল বলে,
-” চলে গেছে বিচ্ছুটা!”
পাতা টাকা হাতে পুনরায় ভিতরে ঢুকে আশেপাশে তাকিয়ে ভোরকে খোঁজে! সে জানে ভোর আশেপাশেই আছে আর মি. অরুণ সরকারও। ছেলের হাতে টাকা পাঠিয়েছে! ছেলেকে নিশ্চয়ই একা ছাড়ে নি! আশে পাশে অনেক মানুষের আনাগোনা! বিকেল হওয়ায় ভিড়টা একটু বেশিই!

-” ভোর? ভোর? ”
কয়েকবার ডাক দেয় পাতা । ভোরের সারা পায় না। আশেপাশের সকলে তার দিকে চেয়ে। পাতা শান্ত হয়ে দাঁড়ায়! লোকটা এভাবে অপমান করল! সে তো বলল তার তরফ থেকে ভোরের জন্য উপহার!! তারপরও!! পাতা তাদের মত উচ্চবিত্ত নয় বলে কি উপহার নেয়া যাবে না! ইগো হার্ট হয় তাদের। পাতা টাকা গুলো মুচরে ধরে। নতুন কচকচে নোট হওয়ায় মর মর করে উঠে। পাবেল পাতার কাঁধে হাত রাখে ।
-” কি হয়েছে আপু?”
পাতা হেসে বলল,

-” কি হবে?বড়লোক, প্রভাবশালী, অহংকারী নাক উঁচু লোকের ইগো হার্ট হয়েছে!!বাচ্চাটা ভালোবেসে খেলনা চুস করে দিতে বলেছে আমাকে!সেখানে বিল ওর বাবাকে কি করে দিতে দিতাম?”
পাবেল বোনের কাঁধ জড়িয়ে বলে,
-” বাদ দে তো! তুই তো দিয়েছিলি! তারা ফেরত দিয়েছে! সেখানে তোর তো কিছু করার নেই! বড়লোক হলে কি হবে মনটা ছোটই!!মন খারাপ করিস না! বাড়ি চল?”
-” অরুণ কাজটা একজম ঠিক করিস নি!”
-” কোনটা?”

শুভ শান্ত চোখে তাকায় অরুণের দিকে। অরুণ ভাবলেশহীন! তারা এখন আইসক্রিম পার্লারে বসে আছে। ভোর আইসক্রিম খাচ্ছে আপনমনে! খেলনা তার কোলে। সেটা দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। এদিকে মনোযোগ নেই!অরুণ একটু পর পর ছেলের গালে, টি শার্টে লেগে থাকা আইসক্রিম মুছে দিচ্ছে টিস্যু দিয়ে! শুভ ক্ষেপে আছে পাতাকে টাকা ফিরিয়ে দেয়ায়। সে দাঁত কটমট করে বলে,
-” একদম ঢং করবি না! মেয়েটা বিল পে করেছিল তো কি হয়েছিল? ইগোতে লেগেছে?”
অরুণ ভোরের আইসক্রিমের বাটি থেকে এক চামচ আইসক্রিম মুখে পুরে নিল। ভোর হেসে আরেক চামচ তার মুখে দেয়। অরুণ খানিক হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে শুভর উদ্দেশ্যে বলে,

-” মেয়েটার কাছে ওত টাকা ছিল না! ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু নিয়ে বিল পে করেছে!! মেয়েটা মনে হয় না জীবনে নিজের জন্য হাজার টাকার কিছু কিনেছে! আমার ছেলের জন্য চার হাজার খরচ করবে সেটা কি করে হতে দেই? মিডল ক্লাসরা চার হাজার অনেক কষ্টে ইনকাম করে ভাই!”
শুভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” সেটাই তো! কত কষ্টের টাকা তার! ভোরকে ভালোবাসে! মনে মায়া কাজ করে বলে বিল পে করেছিল! বলেওছে পাতার তরফ থেকে ছোট্ট গিফট! তারপরও ফেরত দেয়া একদম ঠিক হয় নি! মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে!”

-” এই টপিক বাদ দে তো!”
-” বাদ দেব মানে? আমার ছাত্রীকে অপমান করেছিস তুই!”
-” আবার?”
-“তোমরা ঝগড়া করছো কেন?”
শুভ হেসে বলে,
-” ঝগড়া করছি না! তোমার আব্বুকে বকছি! একজনকে কষ্ট দিয়েছে তো, তাই!”
ভোর বাবার দিকে চায়! অরুণ শুভকে চোখ রাঙানি দেয়!

গোধূলি লগ্ন! নীল দিগন্ত আবছা লালীমায় ছেয়ে আছে! দিগন্ত জুড়ে ছকড়া ছকড়া কালো মেঘ মল্লার ছড়িয়ে আছে! যেন কোন ছোট বাচ্চা ক্যানভাসে কালি ফেলে নষ্ট করে দিয়েছে! মৃদু বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে অল্প স্বল্প! সারি সারি সবুজ শ্যামল ধানের চারা দুলছে এলোমেলো! ফড়িং সে বাতাসে ডানা মেলে এদিকে ওদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে কখনো শীষের আগায় বসছে। শুকনো ধান ক্ষেতের আড়ালে ব্যাঙ ঘাপটি মেরে বসে সুযোগ পেলেই লাফ দিয়ে জিভ বের করে ফড়িং মুখে পুরে নিচ্ছে! চিল অনেকটা নিচ দিয়ে উড়ে বেড়াতে থাকে! বিভিন্ন পাখির দল উড়ে উড়ে নিজস্ব নীড়ে ফিরে চলেছে! পাতাও নিজের বাড়ি ফিরে! নিজের বাড়ি! মেয়েদের কি আদতে নিজের বাড়ি থাকে? স্বামীর বাড়ি! বাপের বাড়িই তো! আর পাতার ক্ষেত্রে বাবার বাড়ি বলাও সাজে না হয়তো! পাতা স্কুটি উঠিয়ে সিঁড়ির কাছে রেখে দড়জা খটখটায়। পাবেলকে বাস স্টপেজে নামিয়ে দিয়ে সে বাড়ি এসেছে! কেউ দরজা খুলছে না তাই পাতা খানিকটা বিরক্ত হয়ে জোরে জোরে থাপ্পড় লাগায় দড়জায়!এতে কাজ হয় দরজা খুলে যায়! পাতা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে! লুবমান রুম্পাকে কোলে নিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে।

-” এতো দেড়ি হলো যে! আর পাবেলকে নিয়ে আসতি?”
পাতা ক্লান্ত মুখে কষ্টে হাসি ফুটিয়ে বলে,
-” বললাম আসলো না! আর রুম্পার জন্য এইটা কিনতে দেড়ি হলো! খালামুনি? দেখ তোমার জন্য কি এনেছি! পছন্দ হয়েছে তোমার?”
ছোট রুম্পা একবছর দুই তিন মাস হবে! হাঁটা শেখেনি! দুই এক বুলি বলে এই যেমন বা বা মা মা বু ইত্যাদি!! পাতার হাতে পুতুল দেখে হেসে হাত তালি দিয়ে হাত বাড়িয়ে পুতুল চায়!
পাতা দেয় না তার গাল টিপে বলে,
-” দিব আগে পাপ্পাহ দাও ?পাপ্পা দিলে দিব নইলে দিব না?”
পুতুল না দেয়ায়! ছোট রুম্পার মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়! পাতার কথা কিছু না বুঝে ঠোঁট উল্টে কেঁদে দেয়! লুবমান হেসে বলে,

-” এই পাতা আমার মামা টাকে কাদাচ্ছিস কেন? দিয়ে দে বলছি! নইলে বকা দেব কিন্তু! মামা তুমি কেঁদো না তো! খালামুনিকে বকা দিব!”
পাতা হেসে টেডি তার হাতে দেয়! ব্যস কান্না শেষ। টেডি নিয়ে পিট পিট করে দেখতে থাকে।
-” পাতা যাহ ফ্রেশ হয়ে নি! কি গরম পড়েছে! তোর মুখ লাল হয়ে গেছে!”
পাতা ছোট রুম্পার গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” যাচ্ছি। তবে মনে রাখিস এসে কিন্তু আমি কোলে নিব?”
লুবমান মাথা নাড়ে। ছোট্ট রুম্পা সবার আদরের! এ বাড়িতে এলে কোলে কোলেই থাকে সারাক্ষণ! পাতা রুমে যেতে নিয়ে ঘার ফিরিয়ে লুবমানকে জিজ্ঞাসা করে,

-” লতা আপু কোথায়?
-” ঘরেই! কেন?”
-” কিছু না!”
বলে রুমে যায়! উফ যে গরম পড়েছে না!গোসল না করলেই নয়! কিন্তু এই ভর সন্ধ্যায়! ঠান্ডা না লেগে যায়! লাগলে কি করার! এখন গোসল না করলে সে হিট স্ট্রোক করবে বোধহয়!
পাতা চলে গেলে লুবমান ভাগ্নিকে কোলে নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে টিভি অন করে! বসার সাথে সাথেই রুম্পা তার মামাকে ভিজিয়ে দেয়! লুবমান গরম কিছু অনুভব করে রুম্পাকে উপড়ে তুলতেই বুঝতে পারে ভাগ্নি ইউরিন ত্যাগ করেছে!

-” লতা আপু ? আপুরে! জলদি আয় তোর মেয়ে আমায় গোসল করিয়ে দিলো রে!”
লতা নিজের রুমে! ছেলেকে বকছে কথা না শোনার জন্য! লতার স্বামী রাতুল এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করে।লতা নিজেও একজন হাই স্কুল টিচার! সাথে দুই বাচ্চার জননী! বড় ছেলে লাবিব ক্লাস থ্রীতে পড়ে! আর মেয়েটা এক বছরের! বত্রিশ বছর বয়সী লতাকে দেখলে বিশ্বাসই করবে না তার বয়স বত্রিশ! মনে হবে পঁচিশ ছাব্বিশ হবে হয়তো! ওদের মা লাবনী আক্তারকেও দেখে বোঝার অবকাশ নেই বয়স্ক সে! জিনগত বৈশিষ্ট্যের একটি! লতা পাতার মধ্যে লতা দেখতে শুনতে ভালো গুনী মেয়ে! রাধা-বাড়া সব তার নখদর্পণে! সাথে মেধাবীও!লতা ছোট ভাইয়ের চেঁচামেচি শুনে লাবিবকে চোখ রাঙিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। ড্রয়িং রুমে রুম্পাকে উঁচু করে ধরে রাখায় লুবমানকে ঝাড়ি মেরে বলে,

-” একদণ্ড রাখতে পারিস না কেমন মামা হয়েছিস? এই বাচ্চা গুলো আমার হাড় মাংস জ্বালিয়ে খেল! বড়টা কথা শুনবে না! এইটা আবার কি করেছে? আমার মাথা ফেটে যাবে এদের অত্যাচারে!”
লুবমান রুম্পাকে বোনের কোলে দিয়ে বলে,
-” বাচ্চা মানুষ করা ওত সোজা না আপু! আর তোর এতো কিসের পেরেশানি? ওদের তো দুলাভাই ই সামলায়! ভাগ্য করে একটা জামাই পেয়েছিস!! নইলে তোর যে রাগ!! উঠতে বসতে ঝাটার বাড়ি পড়ত!!”
লতা মেয়েকে কোলে নিয়ে রেগে বলে,

-” হ্যা উনি সামলায় আর আমি ঠেং এর উপর ঠেং তুলে বসে থাকি তাই না? রান্না বান্না ভূতে এসে করে দেয়!!”
লুবমান নিরাপত্তা বজায় রেখে দূরে গিয়ে বলে,
-” মজা করছি তো! রাগিস কেন? পাতা এসেছে! রুম্পার জন্য টেডি এনেছে! দেখ সুন্দর না?”
লতা একটু মেজাজি! রাগতে সময় লাগে না! আবার রাগ পড়তেও না! লুবমানের কথা শুনে সোফায় থাকা টেডির দিকে নজর যায়! দেখতে ভালোই লাগছে!

-” ভালোই লাগছে! ও কখন এসেছে? আমার সাথে তো দেখা করলো না?”
-” আরে আপু মাত্রই এলো! ঘেমে নেয়ে একাকার! তাই ফ্রেশ হতে বললাম!”
-” ওহ্!”
-” তুই মামা কে চেঞ্জ করিয়ে দে! শিস দিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে একেবারে!”
লতা মাথা নাড়িয়ে চলে যায়!
পাতা গোসল সেরে রুম থেকে বেরিয়ে আসে ড্রয়িং রুমে। খুব ক্ষিধে পেয়েছে তার! সাথে মাথাও ব্যাথা করছে। সকালে দুই পিস কেক আর দুপুরে অল্প একটু খিচুড়ি মুখে দিয়েছিল! ভোর একটু খেয়েছে! বাকিটুকু বাটিতেই আছে! নষ্ট হয়ে গেছে বোধহয়! মায়ের অগোচরে ফেলে দিতে হবে । নইলে কপালে শনি আছে! পাতা ড্রয়িংরুমে এসে দেখে লতা নিচে ফ্লোরে বসে আর লাবনী সোফায় বসে লতার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। টিভিতে সিরিয়াল চলছে মায়ের পছন্দের। লুবমান আর বাকিদের নজরে পড়ছে না! আব্বু কি আসে নি কাচারি থেকে? সে সামনের সিঙেল বসে বলে,

-” কেমন আছো লতাপু?”
লতা পাতাকে দেখে হেসে বলে,
-” আছি কোনরকম! তুই কেমন আছিস? বাহ স্বাস্থ্যের একটু উন্নতি হয়েছে! এখন বেশি রোগাপাতলা লাগে না! আগে তো মনে হতো স্কেলেটন হেঁটে যাচ্ছে!”
পাতা হেসে বলে,
-” অতটাও রোগা ছিলাম না! লাবিব কোথায়? রুম্পা? দুলাভাই আসেনি?”
-” লাবিব,রুম্পা, আব্বু,ভাইয়ের সাথে বাজারে গেল একটু আগে! আইসক্রিম খাবে বায়না করছিল আব্বুর কাছে! আর তোর দুলাভাইকে নিয়ে আসি নি! আসলেই বাড়ি চল বাড়ি চল বলে ঘ্যান ঘ্যান করবে! তাই বলেছি আমরা যাই তুমি কয়েকদিন পড়ে গিয়ে নিয়ে এসো আমাদের!”
-” ওহ!”

পাতার পেটের ভিতরে গুর গুর শব্দ হচ্ছে ক্ষিদের তারনায়! এখন মাকে কি বলবে কিছু খেতে দিতে? এখন বললেও উঠবে না! বলবে ‘ পারবো না!বেড়ে নিয়ে খা! ঝি নই বাড়ির যে সবার হুকুম খাটবো!’ তাই পাতা বললো না! উঠে নিজেই কিচেনের দিকে অগ্রসর হয়! রেক খুলে হাঁড়িতে ভাত খুঁজে। নেই তো! ফ্রিজ খুলে দেখে সেখানেও নেই! শুধু অল্প মাংসের তরকারি আর দই। দই পাতার পছন্দ নয়! পাতা ড্রয়িংরুমে গিয়ে লাবনী আক্তারকে জিজ্ঞেস করে,
-” আম্মু ভাত নেই? ক্ষুধা লাগছে!”
-” ছিল লতার আব্বু একটু আগে খেল! আর নেই! দুপুরে খিচুড়ি খাস নি?”
পাতা আমতা আমতা করে বলে,
-” খেয়েছি! খিচুড়ি খেয়ে মন ভরে বলো?”

-” একটু ধৈর্য ধর! লতার মাথায় তেল দিয়েই রান্না বসাবো! আম আছে ফ্রিজে কেটে খা একটা ! লতা এনেছে!”
লতার মাথায় তেল ঘসতে ঘসতে বললো লাবনী আক্তার। পাতা ইতস্তত বোধ করে মিনমিন করে বলে,
-” মুড়ি নেই? আম দিয়ে খাই?”
লাবনী মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আছে! তবে লাবিব, লতার আব্বু আম দিয়ে খাবে বলল!”
লতা বলে,

-” আমি আব্বুকে ফোন দিয়ে বলছি আসার সময় মুড়ি নিয়ে আসবে!”
-” না আপু! বলতে হবে না! আমি খাব না মুড়ি! ভাত হলে ভাতই খাব! আর অতটাও ক্ষিধে পায় নি!”
লতা তবুও ফোন দিতে নিলে পাতা ফোন নিয়ে নেয়!
-” আপু বললাম তো ফোন দিও না!”
লতা হেসে উঠলো। পাতাটা আব্বুকে সেই রকম ভয় পায়! যেন আতিকুর ইসলাম বাঘ তাকে খেয়ে ফেলবে! পাতা সোফায় বসে গালে হাত দিয়ে সিরিয়ালে মনোযোগ দিল! লতা পাতার দিকে চায়।
-” এই তুই গোসল করে ভেজা চুল বেঁধে রেখেছিস কেন? এমনিতেই উকুন আছে তোর মাথায়! আরো হবে !!”
পাতা গালে হাত সরিয়ে লতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ভেজা না!চুল ভিজাই নি! এই ভর সন্ধ্যায় গোসল করলে ঠান্ডা লাগবে তাই চুল ভিজাইনি!”
-” তাহলে ওটা গোসল হলো?”
পাতা দাত বের করে একটা বোকা হাসি দিল।
-” হলো একটা!”
-” এখানে আয় চুলে তেল দিবি! আমার হয়ে গেছে!”
পাতা মায়ের দিকে তাকায়! মা কি তাকে তেল দিয়ে দিবে? সে খুশি হয়ে বলল,
-” ওড়না পাল্টে আসি এটাতে তেল লেগে যাবে!”
বলে দৌড়ে রুমে গিয়ে ওড়নাটা চেঞ্জ করে এসে দেখে মা নেই! চলে গেছে! লতা সোফায় বসে!সে লতাকে বলে,
-” আম্মু কোথায়? তেল দিয়ে দেবে না?”

লতা বাটিতে তেল ঢালতে ঢালতে বলে,
-” না। আমি দিয়ে দিব। মা রান্না চড়াবে! আয় বস!”
পাতা মন খারাপ করে বসে পড়ে। মা দিলে ভালো হতো! মায়ের হাতের মালিশের মজাই আলাদা! মাথা ঠান্ডা হয় ! ঘুম চলে আসে! অনেক ভালো লাগে তার! হাতে গোনা কয়েকবার তেল দিয়ে দিয়েছে লাবনী আক্তার তাও অনেক জোড়াজুড়ির পর!
লতা তার মাথায় বিলি কেটে বলে,
-” একা থাকিস তাও মাথায় উকুন হয় কিভাবে শুনি?”
পাতা মলিন হেসে বলে,
-” একা থাকতে ভয় লাগে তাই উকুনকে সঙ্গী হিসেবে রাখি! ”
লতা হেসে বলে,

-” এতো বড় হয়েছিস এখনো একা থাকতে ভয় করে !!”
-” হুম! অন্ধকারে ভয় লাগে! তুমি তো তোমার সাথে থাকতে দিতে না! একা একা রুমে অনেক ভয় করে!”
-” তোর ঘুমানোর অভ্যাস খুব বাজে! হাত পা তুলে দিস তো কখনো লাথিও দিস! তার উপর লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হয়!”
পাতা মুখ গোমড়া করে নেয়!
-” লাথি দেই না! আর লাইট জ্বালিয়ে রাখলে কি সমস্যা?”
-” অনেক সমস্যা!! চোখে লাগে, ঘুম হয় না! আর তোর আর একা থাকতে হবে না ! অন্ধকারের ভয়ও কাটবে!”
পাতা ঘার ঘুরিয়ে হাসি মুখে বলে,

-” কিভাবে?”
লতা তার মাথায় চাটি মেরে বলে,
-” বিয়ে দিব তোকে! জামাইয়ের সাথে থাকবি! তার সাথে থাকলে অন্ধকারেও ভয় পাবি না!”
পাতা হেসে বলে,
-” তখনও লাইট জ্বালিয়েই রাখবো। বুঝলে!”

-” ভালো! বোন জামাইয়ের ভালো হবে!রাতের কার্যক্রমে লাইটের আলোয় সব পরিষ্কার দেখতে পারবে!”
পাতা ঝট করে উঠে দাড়িয়ে লতার সামনে দাঁড়িয়ে তেলা চুলে খোঁপা বেঁধে বলে,
-” কিছু তো লাজ রাখো? ছোট বোন হই তোমার!”
লতা চোখ টিপে দুষ্টু হেসে বলে,
-” লজ্জার কি আছে আমরা আমরাই তো!”
পাতা ঝুঁকে এসে লতার কানে কানে কিছু বলে হাসতে হাসতে চলে যায় রুমে। লতা চোখ গোল গোল করে টিভির সিনে তাকিয়ে থাকে! এই পাতাতো দেখি মেনি বেড়াল নয়!

নিস্তব্ধ রজনী। চারপাশ ঝিঁঝিঁ পোকা ডাক পাখির কলতানে মুখরিত! ঠান্ডা বাতাসে পরিবেশ কিছুটা স্বস্তিদায়ক! বেলকনির দরজা খোলা থাকায় অরুণদের বাড়ির আঙিনার গাছের বাগান থেকে মৃদু বাতাস ঢুকছে রুমের ভিতরে। ভোর ফ্লোরে বসে রেলগাড়ি চালাচ্ছে! ঝক ঝকাঝক শব্দ হচ্ছে যেন সত্যিকারের ট্রেন চলছে! রেল তার লাইনে চড়ে পুরো পথ অতিক্রম করে আবার পর্যাক্রমে ঘুরছে একি পথে! ভোর গালে হাত দিয়ে মুচকি হেসে সেটা দেখছে! অরুণ রুমে প্রবেশ করে ছেলেকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে তুলে নিয়ে বিছানায় বসায়! ভোর বিরক্ত হয় খানিকটা!
-” আব্বু খেলছি তো আমি! ধ্যাত ভালো লাগে না! ডিস্টার্ব কোরো নাতো!”
বলে ভোর নামতে নিলে অরুণ তাকে নিজের কোলে বসিয়ে জড়িয়ে বলে,
-” আব্বু অনেক খেলেছো! এখন স্টাডি টাইম। আজ বিকেলে টিউশনি মিস দিয়েছ দুটোই! হোমওয়ার্ক করতে হবে না?”
ভোর গাল ফুলিয়ে বলে,

-” এতো পড়ে কি হবে? পড়তে একটুও ভালোলাগে না!”
অরুণ ছেলের গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” আব্বু না পড়লে বড় হবে কি করে? হুম? তোমাকে পড়ে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে!”
-” আমি কি তাহলে মানুষ নই? ”
অরুণ অধরকোনে ক্ষিন হাসির রেখা ফুটে ওঠে।

-” মানুষই তো! তবে ভালো মানুষ হতে হবে!আর কথা এই যে বই! হোমওয়ার্ক কোনটা দিয়েছে?”
ভোর দেখায় বাবাকে। অরুণ সুন্দর ভাবে সব বুঝিয়ে ছেলেকে পড়ায়! কোলে রেখেই সব হোম ওয়ার্ক করায়! হাতের লেখাও লিখিয়ে সব পড়া কমপ্লিট করায়! ভোর হাসিমুখে পড়ে বাবার কাছে! মাঝেমধ্যে একটু দুষ্টুমিও করেছে‌! অরুণের শান্ত চাহনি দেখে চুপ করে পুনরায় পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে! পড়া শেষ হতেই ভোর অরুণের কোল থেকে নেমে ফ্লোরে বসে রেলগাড়ি অন করে চালানো দেখতে থাকে। অরুণও বিছানা থেকে উঠে ছেলের পাশে বসে বলে,

-” রেলগাড়ি খুব পছন্দ হয়েছে তোমার?”
-” খুব!”
-” পাতাবাহারকে খুব ভালো লাগে তোমার?”
ভোর বাবার দিকে চায়!
-” পাতাবাহার কে?”
অরুণ ছেলেকে পুনরায় কোলে বসিয়ে বলে,

-” তোমার পাতা মিস! তাকে ভালো লাগে?”
ভোর হাত প্রসারিত করে বলে,
-” এত্তো ভালো লাগে!”
-” আর কোনো মিস কে ভালো লাগে না? তোমাকে বিকেলে পড়ায় যে? কি যেন নাম?”
ভোর হেসে বলে,
-” টুম্পা মিস! ভালো লাগে তো! তবে পাতা মিস বেশি! উনি খুব ভালো সবাইকে আদর করে! আর টুম্পা মিসও আদর করে! জানো আব্বু টুম্পা মিস শুধু তোমার কথা বলে?”
অরুণের ভ্রুদ্বয় কুঁচকে যায়!

-” তাই? কি বলে?”
-” তুমি কি কি পছন্দ কর! কি খেতে ভালোবাসো! বিকেলে বাড়িতে থাকো না কেন! আমার মনে হয় মিসের তোমাকে ভালো লাগে!”
অরুণ চোখ ছোট ছোট করে বলে,
-” ওসব কিছু না! আর কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলবে না কখনো! তারপরও যদি বলে আমায় বলবে নতুন মিস রেখে দেব!”
ভোর মুখ গোমড়া করে বলে,

-” বললে উনি অনেক চকলেট দেন! আর আদরও করেন! আর বলবো না!”
অরুণের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়।
-” এসব কেমন ছোচামি! তোমায় চকলেট কিনে দিই না? কত গুলো বক্স এনে দিয়েছি! আলমারিতে আছেই তো! অন্যের টা খেতে হবে কেন?”
-” আব্বু ছোচামি কি?
অরুণ উঠে ছেলেকে কোলে নিয়ে বের হতে হতে বলে,

-” কিছু না! আর কখনো কারো কোনো কিছু নেবে না! খাওয়া তো দূরের কথা!আর আমার কথার অবাধ্য হলে খুব খারাপ হবে! আদর বেশি করি শাসনও কম হবে না!”
ভোর চুপসে যায় খানিকটা। বাবার গলা জড়িয়ে চুপ করে থাকে।অরুণ ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় বসে। আসমা বেগম ও আনিকা টিভি দেখছে। চিকু বান্টি চলছে!আনিকা আইসক্রিম খাচ্ছে আর দেখছে। ভোর এক পলক সেদিকে তাকিয়ে টিভিতে মনোযোগ দিল! কার্টুন দেখতে কার না ভালো লাগে! অরুণ আনিকাকে বলে,

-” মামনি হোমওয়ার্ক শেষ?”
আনিকা মিষ্টি হেসে বলে,
-” হুম বড় চাচ্চু!”
-” গুড! একটা কথা বলি মামনি?”
-” বল!”
অরুণ ভোরকে সোফায় বসিয়ে আনিকার পাশে বসে তাকে কোলে নিয়ে বলে,

-” আচ্ছা কাল তোমায় ভোর ধাক্কা দিয়েছিল নাকি তুমি দৌড়াতে পড়ে গিয়েছিলে? সত্যি বলবে কিন্তু? বড় চাচ্চু কিছু বলবে না!”
আনিকা চমকে ভোরের দিকে তাকায়! ভোর হেসে মুখ ভেটকায়! অরুণ চোখ গরম করলে ভোর টিভির দিকে তাকায়।
আসমা বেগম তাদের দিকে চায়!

-” অরুণ আনিকা মিথ্যে কেন বলবে? ওর কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার?”
অরুণ শান্ত কন্ঠে বলে,
-” ছোট মা সেরকম ব্যপার না! এমনি বলছি! মামনি বলো?”
আনিকা একটু ভয় পেয়ে বলে,
-” তুমি বকবে নাতো আমায়?”
অরুণ মাথা নাড়ে বকবে না!
আনিকা আশ্বস্ত হয়ে বলে,

-” দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম! ভোর আমাকে রেখেই চলে যায়! তাই মিথ্যে বলেছি যেন সবাই ওকে বকে! তুমিও বকো! ওকে তো কেউ বকেই না! তুমিও না! অথচ আব্বু আম্মু আমাকে সবসময় বকে! তাই বকা শুনাতে বলেছিলাম। তুমি মারবে জানলে বলতাম না! স্যরি চাচ্চু?”
অরুণ তার গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” স্যরি বলতে হবে না! তুমি সত্যিটা স্বিকার করেছো আমি খুশি হয়েছি! আর মামনি? মিথ্যা বলা ভালো না! আল্লাহ অনেক মারে। তাই আর কখনো মিথ্যে বলবে না ঠিকাছে?”

পাতা বাহার পর্ব ৫

-” ঠিকাছে! ভোর? স্যরি!”
ভোর আনিকার কথা শুনে মিষ্টি হেসে বলে,
-” ইটস ওকে!”
আরিয়ান একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। ফোনে কথা বলছে এক ক্লাইন্টের সাথে। ভাই আনিকার কথোপকথন কানে বাজতেই সেদিকে নজর দেয়! সব শুনে গিল্টি ফিল হয়! ভালো করে যাচাই না করেই বাচ্চার কথায় আরেকটা বাচ্চার নামে নালিশ দিল ভাইয়ের কাছে! ভাই কাল কিভাবে মারলো ছেলেটাকে!

পাতা বাহার পর্ব ৭