পারমিতা পর্ব ২৮

পারমিতা পর্ব ২৮
Nabila Ahmed

হঠাৎ করে অরিয়ন এরকম কিছু করবে তা এক মুহুর্তের জন্যও ভাবেনি মিতা। অরিয়নের ঠোঁট মিতার ঠোঁট স্পর্শ করতেই পাগলের মতো চুমু খেতে থাকে অরিয়ন। যেন মিতা সরে গেলেই দম বন্ধ হয়ে আসবে অরিয়নের। মিতাও অরিয়নের চুমুতে সারা দেয়। অরিয়নের এই ডেস্পারেশন দেখলে মিতার মনে হয় অরিয়নও মিতাকে চায়। অল্প করে হলেও মিতাকে চায়। আমরা তো তার জন্যই এরকম ডেস্পারেট হই যার জন্য কিছু হলেও অনুভব করি তাই না?
কতক্ষণ একে অপরকে চুমু খেয়েছে কারও জানা নেই। অরিয়নের যখন মনে হলো মিতার জন্য শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে তখন আলতো করে ঠোঁটে চুমু খেয়ে মুখ সরিয়ে আনে। নিজের মাথা গুজে দেয় মিতার গলায়। বড় বড় করে শ্বাস নেয় কতক্ষণ। মিতা নিজের দু হাত দিয়ে অরিয়নকে জড়িয়ে ধরেছে শক্ত করে। নিজের ভালোবাসার মানুষকে এতোদিন পর সামনা-সামনি দেখাটা সহজ বিষয় না, তা ভালোই জানে মিতা।

–শি ইজ ব্যাক।
আস্তে আস্তে বলে অরিয়ন।
–ওরা…ওরা আফরিনকে..
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলেই মিতা থেকে সরে আসে অরিয়ন।
অরিয়নের চোখেমুখে রাগ ফুটে উঠেছে। সাথে সাথে ফুটে উঠেছে অন্য এক অনুভূতি আফরিনের জন্য। মিতা অন্যকিছু বুঝে উঠার আগেই অরিয়ন রুম থেকে দ্রুত বের হয়ে যায় অরিয়ন।
–অরিয়ন? কোথায় যাচ্ছো?
অরিয়নের পিছন পিছন দৌড়াতে দৌড়াতে বলে মিতা।
অরিয়ন যেন মিতার কথা শুনলোই না। দ্রুত সিড়ি বেয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে হাটতে থাকে।
–অরিয়ন?
আবারও ডাক দেয় মিতা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরিয়ন দ্রুত হেটে চলে যায় ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে স্যুট পরিহিত ব্যক্তিটি। দুধের মতো সাদা ধবধবে তার গায়ের রঙ, চোখগুলো বড় বড়, চুলগুলো জেল দিয়ে পেছনে সেট করা। গলায় আর হাতের কব্জির দিকে ট্যাটু দেখা যাচ্ছে। তার সামনা-সামনি বসে আছে আনিকা চৌধুরী। ওয়াহিদ চৌধুরী ও হাবিব চৌধুরী বসে আছে অন্যপাশে। মায়া চৌধুরীকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অরিয়ন যেতেই সকলে নিজেদের কথা বন্ধ করে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে রইল।
–আপনি?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।
–আমার নাম মাইকেল।
ইংরেজিতে বলে লোকটি।
কন্ঠ শুনে বোঝা যাচ্ছে লোকটি এশিয়ান, ব্রিটিশ বা আমেরিকান একসেন্টে কথা বলছেন না। “রাশিয়ান” মনে মনে ভাবে অরিয়ন।
–আফরিনকে কোথায় পেলেন? আর কীভাবেই পেলেন?
ইংরেজিতে অরিয়ন প্রশ্ন করে।

অরিয়নের পিছনে এসে দাঁড়ায় মিতা। সকলেই অধীর আগ্রহ নিয়ে অরিয়ন আর মাইকেলের দিকে তাকিয়ে আছে। অরিয়নের চোখমুখে এখন গাম্ভীর্যতা ফুটে উঠেছে। আনিকা চৌধুরীর সাথে মিতার চোখাচোখি হতেই যেন ব্যঙ্গাত্মক এক হাসি ফুটে উঠলো আনিকা চৌধুরীর মুখে।
–আফরিনকে আমাদের মেনশনে আনা হয়েছিলো একজন র*ক্ষিতা হিসেবে, আমার বসের জন্য।
জবাব দেয় মাইকেল।
–কিন্তু বসের কোনো র*ক্ষিতার প্রয়োজন ছিলো না। তাই আফরিনকে আবারও পতি*তালয়ে পাঠিয়ে দিতে বলে।
আবারও বলে মাইকেল।
মাইকেলের কথাগুলো যতো শুনছে, অরিয়নের মাথায় যেন ততোই আগুন জ্বলতে শুরু করছে। মিতা অরিয়নের কাছাকাছি এসে অরিয়নের হাত নিজের হাতে নিয়ে নেয়। মিতার স্পর্শ অনুভব করতেই নিজের হাত দিয়ে মিতার হাত শক্ত করে ধরে অরিয়ন।
–বসের আফরিনের প্রতি কোনো আকর্ষন ছিলো না তা আফরিন বুঝতে পারতেই বসকে জানায় সে পতি*তালয়ে ফিরে যেতে চায় না। মেনশনে কাজের লোক হয়ে থাকতেও রাজি আছে। কারণ কি জানতে চাইলে সব খুলে বলে আফরিন।

মাইকেলের কথা যতো শুনছে মিতার হাতের উপর ততোই শক্তি প্রয়োগ করছে অরিয়ন। এতোক্ষণ শক্ত করে হাত ধরে রাখলেও এখন একটু একটু হাতে ব্যাথা অনুভব কর‍তে শুরু করেছে মিতা। নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য যতোই মোচড় দিচ্ছে অরিয়ন যেন ততোই শক্ত করে মিতার হাত ধরে রাখছে।
–আফরিন কি সত্যি বলছে নাকি মিথ্যে তা যাচাই করতে স্যার আমাকে পাঠায় ভা*রত। তদন্ত করে জানতে পারি আফরিন সত্যি বলছে। ওর বন্ধু আর ড্রাইভারকে এপারে আনতেই মে*রে ফেলা হয়েছিলো।
–একজন পতি*তার জন্য একজন মা*ফিয়া বসের এতো মায়া? কারণ কি?

কথাটা বললেও কতটা বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করেছে তা আর কেউ না বুঝলেও মিতা ঠিকি বুঝতে পারছে। হাতের ব্যাথাটা বেড়েই চলেছে,মনে হচ্ছে এক্ষুনি হাড্ডি ভেঙ্গে যাবে। চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে মিতার।
–আমরা মাফিয়া হলেও আমাদের একটা নীতি আছে। আমরা নারী ও শিশুদের উপর এটার্ক করি না। হিউম্যান ট্রা*ফিকিংয়ের বিরুদ্ধে আমরা।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে বলে মাইকেল।
–কোথায় আর কে আফরিনকে নিয়ে গিয়েছিলো আমরা তা জানতে চাই। এদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতেই হবে।
ওয়াহিদ চৌধুরী বলে উঠে।

–হাহাহাহাহহা।
শব্দ করে হাসে মাইকেল।
–হাসছেন কেনো?
প্রশ্ন করে হাবিব চৌধুরী।
–সাধারণ মানুষের জন্য এসব এতো সহজ? ওদের কেউ ধরতে পারবে না। আর ভিন্ন দেশ হলে তো কথাই নেই। আর আইন কিছুই কর‍তে পারবে না। কারণ আইন চোখে দেখেও অন্ধ।
অনায়াসে কথাগুলো বলে মাইকেল।
–সব কিছু জানার পরও আমরা চুপ করে থাকবো? আফরিন কোনোদিন বাড়িতে নাও ফিরতে পারতো। এরকম হাজারো মেয়ে নিখোঁজ হয়ে আছে। যারা তার নিজের বাড়িতে ফিরতে পারেনি।
রেগে বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–উনার থাকার ব্যবস্থা করো। আর কুমিল্লা বর্ডারের ব্যাপারটা আমি দেখছি। কীভাবে ওদের সামনে দিয়ে মানুষ পা*চার করা হয় সেটাই এখন ওদের বোঝাবো।
আনিকা চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলে অরিয়ন।
–সরি, কিন্তু আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। আমাকে এক্ষুনি ফিরতে হবে।
বলে উঠে মাইকেল।
–অহ, আচ্ছা।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–তবে..
একটু বলে থামে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–তবে আপনার বসের নামটা জানতে পারি? যার জন্য আমার মেয়ে ফিরে এসেছে তার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
আবারও বলে উঠে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–ওয়াহিদ ঠিক বলেছে।
সায় দেয় হাবিব চৌধুরী।
–সাদমান। বসের নাম সাদমান। এর বেশি আর কিছু বলতে পারবো না।
জবাব দেয় মাইকেল।
–ধন্যবাদ। আপনার বসকে বলবেন, তার কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ।
বলে হাবিব চৌধুরী।
–জ্বি, এখন তাহলে যাই।
বলেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় মাইকেল।
–জ্বি।
কথাটা বলেই মিতার হাত ছেড়ে দিয়ে মাইকেলের সাথে হাটা শুরু করে অরিয়ন।

আলমারি থেকে মিতার একসেট জামা বের করে এনেছে মায়া চৌধুরী। বিছানায় শুয়ে আছে আফরিন। তাকিয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে। জামা নিয়ে আফরিনের কাছে আসতেই লক্ষ্য করেন আফরিনের চেহারা অনেকটাই বদলে গেছে। সেই মাধুর্যতা কিছুই দেখা যাচ্ছে না চেহারায়। মনে হচ্ছে মেয়ে তার অনেক বড় হয়ে গেছে হঠাৎ করেই। বিছানার কাছে জামা নিয়ে আসতেই মায়া চৌধুরীর দিকে তাকায় আফরিন। নিজের মাকে এতোদিন পর সামনা সামনি দেখে যেন নিজের বিশ্বাস হচ্ছে না। আলতো করে এক মিষ্টি হাসি দেয় আফরিন।
–জামাটা পড়ে নে।
জামা এগিয়ে দিয়ে বলে মায়া চৌধুরী।
আফরিন কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে মায়া চৌধুরীর হাত থেকে জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। বিছানায় বসে অপেক্ষা করতে থাকে মায়া চৌধুরী।
–মা,ভিতরে আসবো?
বাইরে থেকে দরজায় নক করে অনুমতি চায় মিতা।

–আয়।
আনমনে জবাব দেয় মায়া চৌধুরী।
ধীরপায়ে মায়া চৌধুরীর কাছে গিয়ে বসে মিতা। নিজের দু হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। মিতা জড়িয়ে ধরতেই যেন কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মায়া চৌধুরী।
–কি এমন পাপের শাস্তি আমার মেয়েটা পেলো মিতা? কি এমন পাপের শাস্তি।
কান্না করতে করতে বলে মায়া চৌধুরী।
–কোনো পাপের শাস্তি না মা। এভাবে কেঁদো না। আপু ফিরে এসেছে, তুমি এভাবে কাঁদলে আপু আরও ভেঙ্গে পড়বে।
মায়া চৌধুরীর মাথায় ও পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে মিতা। মায়া চৌধুরীকে ভরসা দিলে কি হবে, নিজের চোখ দিয়েও অনবরত পানি পড়ছে মিতার।
ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ বন্ধ হতেই মিতাকে ছেড়ে আগের মতো করে বসে মায়া চৌধুরী। তাড়াতাড়ি করে দু জনেই চোখের পানি মুছে নেয়।

–মা, চেইনটা লাগিয়ে দেও।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বলে আফরিন।
আফরিনকে দেখে আলতো এক মলিন হাসি দেয় মিতা। আফরিনও বিনিময়ে এক মিষ্টি হাসি ফিরিয়ে দেয়।
–আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।
বলেই এগিয়ে যায় মিতা।
মিতাকে এগিয়ে আসতে দেখেই ঘুরে দাঁড়ায় আফরিন। মিতা চেইন ধরতে এগিয়ে যেতেই দু পা পিছিয়ে পড়ে। হাত পা যেন ঠান্ডা হয়ে এলো মিতার। দু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল আফরিনের পিঠের দিকে। দু কদমে আফরিনের কাছাকাছি গিয়ে নিজের দু হাত দিয়ে জামা টেনে পিঠ বের করতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মিতা।
আফরিনের পুরো পিঠ জুরে কাঁটা কাঁটা দাগ। কয়েক জায়গায় দাঁতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে ক্ষত গুলো বেশি নতুন না আবার বেশি পুরাতন ও না। মিতার কান্না দেখে দৌড়ে আসে মায়া চৌধুরী। আফরিনের পিঠ দেখে নিজেও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। দু জনের কান্নার শব্দ আফরিনের কানে যেতেই ঘুরে তাকায় আফরিন। নিজের চোখেও পানি জমেছে।

–কান্না করছো কেনো তোমরা? আমি ফিরে এসেছি তো।
দু জনকে জড়িয়ে ধরে বলে আফরিন।
–তোমার উপর দিয়ে কি গিয়েছে তা ভাবতেও পারছি না আপু।
কান্না করতে করতে বলে মিতা।
–যা হবার তা হয়ে গেছে। সবার কাছে আমি ফিরে এসেছি তাই অনেক, তুই, মা-বাবা, আফনান সবাইকে ফিরে পেয়েছি আর কি চাই আমার?
কাঁদতে কাঁদতে বলে আফরিন।
“আফনান”। আফরিনের মুখে অরিয়নের নাম শুনে মিতার কষ্ট লাগার কথা ছিলো কিন্তু কষ্ট না লেগে মিতার মধ্যে হঠাৎ করে অপরাধবোধ কাজ করছে। নিজেকে হুট করেই খুব সেলফিশ মনে হচ্ছে মিতার। ছোট বোন হিসেবে কি করেছে মিতা? তাকেই ভালোবেসে ফেলেছে যাকে আফরিন ভালোবাসে, তার সাথে সংসার দেখার স্বপ্ন দেখছিলো যাকে উদ্দেশ্য করে বেঁচে ছিলো আফরিন। ছোটবেলা থেকে নিজের মা-বাবার ভালোবাসা ভাগ করেছে আফরিন, নিজের সব খেলনা, জামাকাপড় শেয়ার করেছে আফরিন। শেষমেশ আফরিনের ভালোবাসার মানুষকেও চেয়ে বসলো মিতা? তাহলে কি আনিকা চৌধুরী ঠিক ই ভাবেন মিতা সম্পর্কে ?

আফরিনের জামায় চেইন লাগানো শেষ হতেই বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে আফরিন। মায়া চৌধুরী আর মিতা আফরিনের পাশেই বসে আছে। আফরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মায়া চৌধুরী।
–ঘুমানোর একটু চেষ্টা কর, আফরিন।
মায়া চৌধুরী বলে।
–ঘুম তো আমার সেদিনই শেষ যেদিন আর বাড়িতে ঢুকতে পারিনি, মা।
এক দৃষ্টিতে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলে আফরিন। দু চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে আফরিনের।
মিতা আর মায়া চৌধুরীর চোখ দিয়েও পানি পড়তে শুরু করেছে।
–আফনান কোথায় মা?
মায়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আফরিন।
আফরিনের কথা শুনেই মায়া চৌধুরী তাকিয়ে থাকে মিতার দিকে। মিতাও তাকিয়ে আছে মায়া চৌধুরীর দিকে।
–আছে এখানেই।
মাথা নিচু করে জবাব দেয় মায়া চৌধুরী।
–মায়া, চলো খাবার খাবে।
রুমে প্রবেশ করে বলে আনিকা চৌধুরী।

আনিকা চৌধুরীর পিছন পিছন অরিয়নও রুমে প্রবেশ করে। দরজার এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অরিয়ন। আনিকা চৌধুরীর কথা শুনে সেদিকে তাকাতেই আফরিনের চোখ যায় অরিয়নের দিকে। মুহুর্তেই আফরিনের চোখে আনন্দ ফুঁটে উঠে। মিতা আফরিনের দিকে তাকিয়ে সবটাই লক্ষ্য করছে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অরিয়ন আফরিনের দিকে তাকিয়ে আছে মন খারাপ করে। কয়েক ঘন্টা আগেও হাসিখুশি থাকা মিতার সেই রিয়ন কোথায় চলে গেলো মিতা জানেনা। শুধু জানে এতো মানুষের সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে মিতার রিয়ন নয়। সে মিতার অরিয়ন নয়। সে মিতার অনিয়ন ভাইয়াও নয়। সে শুধুই আফরিনের আফনান।
–আমি খাবো না আপা, আপনারা খেয়ে নেন।

মায়া চৌধুরীর কথা শুনে সকলের ঘোর কাটে। আফরিন নিজের চোখ সরিয়ে নেয়। অরিয়ন নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিতা তাকিয়ে থাকে নিজের কাঁপতে থাকা হাতের দিকে।
–খেয়ে নেও মা। আমি ঠিক আছি। সত্যি।
মায়া চৌধুরীর হাত ধরে বলে আফরিন।
–কিন্তু..
–কোনো কিন্তু না মা, খেয়ে নেও তুমি।
বলে মিতা।
–হ্যাঁ মায়া, খেয়ে এখানেই আফরিনের সাথে শুয়ে থেকো তুমি।
বলে আনিকা চৌধুরী।
–আমি এখানে শুলে মি…
–অরিয়ন আবরারের রুমে শুবে, আর ও গেস্ট রুমে।
মায়া চৌধুরীর কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে আনিকা চৌধুরী।
–হ্যাঁ মা, আন্টি ঠিক বলছে। তুমি এখানে ঘুমাও।
বলে মিতা।

–এখন তো সব ঠিক, এখন চলো খেতে।
মায়া চৌধুরীকে বলে আনিকা চৌধুরী।
আনিকা চৌধুরী আর মায়া চৌধুরী রুম থেকে বের হয়ে যায়। বিছানায় শুয়ে থাকা আফরিন একটু পর পর আড় চোখে অরিয়নকে দেখছে। রুমের মধ্যে যেন হঠাৎ করেই পিনপতন নীরবতা ছেয়ে গেছে।
–আমি গিয়ে রুম গুছিয়ে নিচ্ছি।
কথাটা বলেই বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় মিতা।
মিতার কথা শুনতেই চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে অরিয়ন। মিতা অরিয়নের দিকে তাকালো না। হেটে দরজার পাশে অরিয়নের সামনা-সামনি দাঁড়ায় মিতা।
–মিতা?
ডাক দেয় আফরিন।
–জ্বি আপু?
আফরিনের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয় মিতা।
–দরজা আটকিয়ে যাস।
বলে আফরিন।
মিতা কিছু না বলে অরিয়নের দিকে তাকায়। অরিয়নও তাকিয়ে আছে মিতার দিকে। বুকের মধ্যকার সেই যন্ত্রণা আবার অনুভব করছে মিতা। কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে দরজা লাগিয়ে দেয় মিতা। দরজা লাগতেই চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে শুরু হয়েছে মিতার। হেটে চলে যায় গেস্ট রুমের দিকে।

মিতা চলে গেলেও অরিয়ন নিজের জায়গায় ই দাঁড়িয়ে আছে। আফরিন ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে বসে। কিছুক্ষণ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে অরিয়নকে।
একটু আগেও সবাইকে সামাল দিতে থাকা আফরিন ছোট বাচ্চার মতো কাঁদতে লাগলো।
কাঁদতে থাকা আফরিনকে জড়িয়ে ধরে অরিয়ন।
–আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, হচ্ছে না যে আমি ফিরে এসেছি আফনান। ওদের সব অত্যাচার সহ্য করেছি, শুধুমাত্র এই আশায় যে একদিন আমি তোমাদের মাঝে ফিরে আসবো।
অরিয়নের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে আফরিন।
–আমি, আমি ভেবেছিলাম তোমাকে আর দেখা হবে না। আমি ভেবেছিলাম আমার আফনানকে আমি হারিয়ে ফেলেছি।

অরিয়নের বুক থেকে মাথা তুলে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে বলে আফরিন।
–তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি তাই না? আমি নিজেও যে তোমাকে ছাড়া ভালো ছিলাম না।
আলতো এক হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে বলে আফরিন।
অরিয়ন এক নজরে তাকিয়ে আছে আফরিনের দিকে। মন চাচ্ছে সব কিছু তছনছ করে দিতে। আফরিনকে এভাবে কোনোদিন দেখবে তা ভাবতেও পারছে না অরিয়ন।
–হয়তো তোমার সাথে প্র‍্যাংক করতে চেয়েছিলাম বলেই তার শাস্তি পেয়েছি। আর করবো না। প্রমিস।
অরিয়নের গাল নিজের দু হাত দিয়ে ধরে কথাটা বলেই নিজের মুখ এগিয়ে নেয় অরিয়নের দিকে। আফরিনের ঠোঁট অরিয়নের ঠোঁটের কাছাকাছি আসতেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় অরিয়ন। আফরিন স্থির হয়েই দাঁড়িয়ে রইল। অরিয়নের গাল ছেড়ে দিয়ে দু পা পিছিয়ে যায়।

–সরি, ভুলে গিয়েছিলাম আমি আর আগের মতো নেই। আমি অপবিত্র হয়ে গেছি ওদের স্পর্শে।
বিষন্ন এক হাসি দিয়ে কথাটা বলেই বিছানার দিকে চলে যেতে নেয় আফরিন।
এক পা এগিয়ে দিতেই আফরিনের হাত ধরে অরিয়ন। ঘুরে অরিয়নের দিকে তাকায় আফরিন।
–তুমি ভালোই জানো এসবে আমার কিছুই যায় আসে না,আফরিন।
নিচের দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।

পারমিতা পর্ব ২৭

–তাহলে?
প্রশ্ন করে আফরিন।
–আমি বিয়ে করে নিয়েছি।
কথাটা বলে একটু থামে অরিয়ন।
–পরীকে।
মাথা তুলে আফরিনের দিকে তাকায় অরিয়ন।

পারমিতা পর্ব ২৯