পূর্ণতা পর্ব ৩৮

পূর্ণতা পর্ব ৩৮
নন্দিনী নীলা

‘ডায়েরী হতে অতীত’
পূর্ণতা নিজের রুমে বসে আছে। একটু আগেই বিষন্ন চিত্তে বাসায় এসে পৌঁছেছে। আম্মু আব্বু এখনো বাসায় ফিরে নাই। ও শাড়ি পরেই থম মেরে বসে আছে।
পূর্ণতার আঁখি পল্লব বেয়ে অশ্রুর ধারা নামতে লাগল। সবার সামনে ঝামটা মেরে প্রভাত পারল ওর হাত ছাড়িয়ে নিতে? অভিমানে পূর্ণতার চোখ জলে টলমলিয়ে উঠল।‌ অশ্রুসিক্ত নয়নে আড়চোখে পূর্ণতা তাকাল আশেপাশে ঘুরতে থাকা যুবক, যুবতীর পানে। তারা ঘুরে ঘুরে ওদের দিকে তাকাচ্ছে। শাড়ি পরিহিত এক মেয়েকে এক ছেলের পাশে দেখে তারা তামাশা নিচ্ছে।

প্রভাত সবার দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“ পূর্ণতা দেখো সবাই কেমন বাঁকা দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তোমার ছেলেমানুষী আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। বিন্দুমাত্র সেন্স কি তোমার মধ্যে নেই? তুমি কি জন্য এভাবে এখানে এসেছ? আমার পরিচিতি অপরিচিত সবাই আমাকে দেখছে এখানেই আমাকে থাকতে হবে‌। তাদের সাথে চলতে হবে। সবার সামনে আমাকে অস্বস্তিতে ফেলতে তোমার কি খুব ভালো লাগছে?”
পূর্ণতা নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিল। ও জানত প্রভাত চমকাবে, বিস্মিত হবে, রাগ করবে। তাহলে এখন কেন কষ্ট লাগছে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সব জেনেই তো ও এসেছে।
পূর্ণতা নিজের কষ্টার্জিত মনটা লুকিয়ে মুখে হাসি এনে বলল,“ দেখো আমি আম্মুর বিয়ে শাড়ি পরে এসেছে আমাকে কেমন লাগছে?”
প্রভাত রাগ তখন আকাশচুম্বী। পূর্ণতা কে এইভাবে ব্যাগ নিয়ে ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে।

প্রভাত রাগে চিৎকার করে উঠল,“ ভালোবাসি বলেছি বলে এতোটা বাড়াবাড়ি করবে জানলে কখনোই তোমাকে বলতাম না। তুমি কোন সাহসে এই সিদ্ধান্ত নিলে? আমি তোমাকে এখন কেন আগামী তিন বছরের আগে বিয়ে করতে পারব না। কথাটা মাথায় ভালো করে ঢুকিয়ে নাও। যেভাবে এসেছ ওভাবেই বাসায় ফিরে যাবে। আমি আর এক সেকেন্ড ও তোমায় মুখ দেখতে চাই না‌। আমি নিজের পড়াশোনা নিয়ে কোন গাফেলতি করতে চাই না। তোমাকে বিয়ে করে এখন আমি ক্যারিয়ান নষ্ট করতে চাই না। তুমি ভাবলে কি করে আমি তোমায় এভাবে গ্রহণ করব? নিজে তো পড়াশোনার মনোযোগী না এখন আমাকেও তেমন বানাতে চাইছ?”

পূর্ণতার বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। প্রভাত এভাবে ওকে বলতে পারল? আমি ওর ক্যারিয়ার নষ্ট করছি!
পূর্ণতা চোখ মুছে নিল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে অতঃপর একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,“ তুমি খুব রাগ করেছ তাই না? সরি এভাবে তোমায় অস্বস্তিতে ফেলার জন্য।”
পূর্ণতা দেখল প্রভাত রাখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। পূর্ণতা তাচ্ছিল্য হেঁসে হাতের বড়ো ব্যাগটার চেইন খুলে সামনে এসে দাঁড়াল প্রভাতের।

তারপর বলল,“ আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে আসিনি প্রভাত। আমি শুধু একটু তোমার সাথে দুষ্টুমি করতে এসেছিলাম। আমি চাইনা তুমি পড়াশোনা ফেলে আমায় নিয়ে ব্যস্ত হ‌ও। আমি তোমার যোগ্য নয় জানি ক্ষমা করো আমায়। এই ব্যাগ দেখেই এতো ভয় পেয়েছিলে তাই না? পাগলি মেয়েটা তোমার কাছে সব ছেড়েছুড়ে ছুটে এসেছে! হাহাহা তোমার জায়গায় অন্য কোন পুরুষ হলে হয়ত আনন্দ পেতো কিন্তু আমার কপাল তেমন না। আমি প্রথমবার তোমার জন্য শাড়ি পরে এলাম তুমি আমায় চেয়ে ও দেখলে না। ব্যাগ হাতে তোমায় নিয়ে পালিয়ে যেতে এসেছি শুনেই রেগে আগুন হয়ে গেলে। কিন্তু আমার ভালোবাসাটা তুমি অনুভব করলে না!”

চোখ বেয়ে অঝোর শ্রাবণ ধারায় পানি পরছে পূর্ণতা পানিকে সামলাতে চাইছে কিন্তু অবাধ্য চোখ পানি ঝরিয়ে‌ই যাচ্ছে। নিজের চোখ তবুও নিজের কথায় শুনছে না।
পূর্ণতা দম নিয়ে বলল,” আমার ছেলেমানুষী পাগলামি গুলো তোমার এতটা বিরক্ত প্রভাত। আমি তোমায় এতো ভালোবাসি তার বিনিময়ে ও তুমি এই পাগলামি গুলো আপন করতে পারছ না। সবাই কি ভাববে সেই জন্য আমার বুকের অনুভূতি গুলো তুমি বেদনায় নীল করে দিলে?”
প্রভাত বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বেসামাল হয়ে চোখের জল মুছে নিল পূর্ণতা। ওর ফরসা মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। চোখে কাজল লেপ্টে গেছে। কান্না থামাতে পূর্ণতা ঠোঁট কামড়ে ধরে ছিল‌।

“ আব্বু আম্মু গ্রামে গিয়েছে। কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। মাথায় এই দুষ্টু শয়তানি বুদ্ধি চলে এলো। খুব ইচ্ছে হলো শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজেগুজে তোমার নজর কাড়তে। আমায় দেখে তুমি বিস্মিত হবে,রাগ করবে জানতাম কিন্তু এতোটা অস্বস্তিতে পড়বে জানতাম না গো। তোমার অস্বস্তি, লজ্জার কারণ আমি কখনো হবো জানলে, আমি এখানে এসে তোমার সম্মান ক্ষুন্ন করতাম না।”
প্রভাত পূর্ণতার চোখে চোখ মিলাতে পারছে না।
পূর্ণতা বলল,“ প্রভাত আমি কতটা অযোগ্য। তুমি আমায় নিজের ভার্সিটির মানুষের সামনে দেখে বিব্রতবোধ করো।”

“ পূর্ণতা আমি…”
পূর্ণতা হাত উঁচু করে বলল,“ থাক বাদ দাও প্রভাত। আমি একটু বেশিই করি। আমার এই কষ্টটা পাওয়া দরকার ছিল না হলে আমি নিজেকে পরিবর্তন করতে পারতাম না।”
পূর্ণতা প্রভাতের আর কোন কথা শুনল না। তপ্ত দূর্বল পায়ে হেঁটে রিকশায় উঠে বসল। প্রভাত আসতে চাইলে পূর্ণতা ওকে সেই সুযোগ দিল না। পূর্ণতা শাড়ি পরেই বাসার সামনে এসে নামল। আশেপাশের অনেকে সন্ধ্যায় শাড়ি পরে আসতে দেখে নিল। পূর্ণতা জানেই আম্মুর কানে এই খবর চলে যাবে।
পূর্ণতা তাড়াতাড়ি বাড়িতে ঢুকে গেল। দাড়োয়ান চাচা যাওয়ার সময় ওকে বোরকা আর আসার সময় শাড়ি পরা দেখে চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে র‌ইল। তার চোখে নানান প্রশ্ন মেলা।

প্রভাতের ব্যবহার আমাকে এতোটাই বিস্মিত করেছে আমি বাসায় এসে পাথর হয়েই বসে আছে। আম্মু আব্বু এসে পড়ল একটু বাদেই। আম্মু এসেই আমার খোঁজ নিল।
তিনি রুমে এসে যখন দেখল পূর্ণতা তার বিয়ের লাল বেনারসী পরে বসে আছে তখনি কপাল কুঁচকে নিল।
“ শাড়ি পরে বসে আছিস কেন?”
পূর্ণতা আলগোছে চোখ মুছে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,“ বাসায় একা একা ভালো লাগছিল না। তাই আকাম করেছি তোমার আলমারি থেকে শাড়ি পরে সময় কাটিয়েছি।”
“ বাহ বেশ গুছিয়ে পড়েছিস তো। কিন্তু কাজল লেপ্টে তো মুখের অবস্থা শেষ। কেঁদেছিস নাকি?” সন্দেহ কন্ঠে বললেন রোজিনা বেগম।

পূর্ণতা বলল,“ কাজল দিতে গিয়ে চোখে খোঁচা খেয়েছিলাম এজন্য পানি পরে চোখের এই বারোটা বেজেছে।”
“ আচ্ছা এখন যা এসব খুলে হাত মুখ ধুয়ে আয়।”
রোজিনা বেগম চলে গেলেন। পূর্ণতা শাড়ি খুলে হাত মুখ ধুয়ে নিল‌।
অতঃপর উদাস হয়ে পূর্ণতা বিছানায় বসে র‌ইল।
এক সপ্তাহ পরের কথা,

পূর্ণতা সেই দিনের পর আর প্রভাত কে কল দেয়নি। ওদের সম্পর্ক শেষ করে দিতে নয় প্রভাতের ক্যারিয়ারে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন না হতে। ও চায়না প্রভাত যা সব চায়না সেসব করে ও প্রভাত কে কষ্ট দিতে। ও প্রভাত কে পাগলের মতো ভালোবাসে। ভালোবাসায় মানুষ বেহায়া হয়ে উঠে। প্রভাত ওর পাগলামী পছন্দ করে না। তাই ও নিজের পাগলামী বাদ দিয়েছে। নিজেকে অবুঝ থেকে বুঝদার করতে মাঠে নামিয়েছে। ও চায় না প্রভাত ওর জন্য কারো সামনে অস্বস্তিতে পড়ুক। ও শুধু প্রভাত কে চায় কিন্তু ওর বিরক্তির কারণ হতে চায়না।
এক সপ্তাহে পূর্ণতার এমন নিজেকে গুটিয়ে নেওয়াটা প্রভাত কে বিস্মিত করে তুলেছে।

কিছুতেই এই পূর্ণতা কে ও চিনতে পারছে না। খুব মিস করছে সেই চঞ্চল পূর্ণতাকে। পূর্ণতা লুকিয়ে চুরিয়ে কল দেওয়াটা সর্বক্ষণ মিস করছে। অজান্তেই পূর্ণতার কলের অপেক্ষা বাড়ছে প্রভাত এর। কিন্তু এক সপ্তাহ হয়ে গেল পূর্ণতা নিশ্চুপ। কেমন যেন শান্ত হয়ে গেছে। পূর্ণতার এই নীরবতার প্রভাত শান্তি কেড়ে নিয়েছে। ভেবেছিল পূর্ণতা নিজেকে পরিবর্তন করলে ও শান্তি পাবে কিন্তু পাচ্ছে না। আরো অশান্তি ওকে চারি পাশ থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।

প্রভাত নিজে থেকে কল ও দিতে পারছে না এদিকে পরীক্ষার জন্য দেখা করার টাইম ও পাচ্ছে না। আজকেও একটা এক্সাম আছে ও সেটা শেষ করে হোস্টেলে না ঢুকে সোজা চলে এলো পূর্ণতার কলেজের সামনে। পূর্ণতার সেই লাল টুকটুকে শাড়ি পরা অভিমানী মুখটা বারবার ভেতরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে। কতটা আঘাত পেয়েছিল পূর্ণতা যে এক সপ্তাহ ধরে দেখা নেই কথা নেই তবুও কেমন শান্ত নদী হয়ে উঠেছে। আচ্ছা ওইদিনের আঘাতে পূর্ণতা ওকে ছেড়ে দিবে না তো?

বুক ধক করে উঠল প্রভাতের। পূর্ণতা ওকে ছেড়ে দিলে ও কীভাবে বাঁচবে? যত‌ই রাগ দেখাক ওর চিত্তে পূর্ণতার জন্য বেশামাল ভালোবাসা। ও কীভাবে পূর্ণতা কে ছাড়া থাকবে ভয়ে প্রভাতের গলা শুকিয়ে এলো।
পূর্ণতা মলিন মুখে গেইটের বাইরে আসতেই প্রভাত ওর হাত ধরে টেনে এক সাইটে চেপে দাঁড়াল।
পূর্ণতা চমকে উঠল,“ তুমি এখানে কি করছ? তোমার তো আজ এক্সাম ছিল।”
“ তুমি আগে বলো আমাকে কল দিচ্ছ না কেন?” পাল্টা প্রশ্ন করে বলল প্রভাত।
পূর্ণতা বলল,“ কল দেব কেন? তুমি আমার কল পেলে বিরক্ত বোধ করো। আমি চাইনা আমার জন্য কেউ বিরক্ত হোক। আর না চাই আমার জন্য কারো পড়াশোনা নষ্ট হোক।”

প্রভাত অসহায় কন্ঠে বলল,“ রাগের মাথায় দুটো কড়া কথা শুনিয়েছি সেটা বুকে চেপে বসে আছো? জানো না তোমার সাথে কথা না বললে আমার বুকে ব্যথা করে। নিঃশ্বাস নিতে পারি না তখন। যত‌ই বিরক্ত দেখাই তুমি কল দিলেই আমার প্রশান্তি লাগে। সেদিন তোমায় লাল শাড়ি পরা অবস্থায় দেখে আমার বুকের ভেতর কেমন ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছিল আন্দাজ করতে পারবে না। হার্টবিট থেমে গিয়েছিল আমার। কিন্তু ভয় ও পেয়েছিলাম তোমার দুষ্টুমি আমি তো সত্যি ভেবে নিয়েছিলাম এজন্য ভয় পেয়েছিলাম। ওটা যদি সত্যি হতো ভাবো আমি কি করতাম? কিভাবে কি করতাম? সেই সব ভেবেই পাগল পাগল লাগছিল! রাগের মাথায় ওতো কথা শুনিয়েছি।”
“ রাগের মাথায় মানুষ সত্য বলে। ভালো হয়েছে আমি সত্যি টা জানতে পেরেছি।” শক্ত কন্ঠে বলল পূর্ণতা।
“ আগেও তো কত রাগ দেখিয়েছি কখনো তো এতোটা সিরিয়াস হ‌ও নাই। তুমি এতো বুঝদার হয়ে উঠলে কবে?” বিস্মিত কন্ঠে বলল প্রভাত।

পূর্ণতা পর্ব ৩৭

“ আগে বাচ্চামো করতাম তাই সব কিছু খামখেয়ালি ভাবে নিতাম। এখন আমি নিজেকে তোমার মনের মতো করতে চাই। বাচ্চামো, ছেলেমানুষী নিজেকে বিসর্জন দিয়েছি।”
প্রভাত পূর্ণতার দু গালে হাত রাখল শক্ত করে তারপর বলল,“ না আমার আগের পূর্ণতাই ঠিক আছে। তার কোন পরিবর্তন লাগবে না।”

পূর্ণতা পর্ব ৩৯