পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ২১

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ২১
সাদিয়া আক্তার

সন্ধ‍্যা সাতটা পারভেজ সাহেব কামরুল সাহেব তড়িঘড়ি করে কোথাও বেরোতে নিলে তখন চন্দ্র বাড়িতে ঢোকে। তাদের দেখে ভ্রু কুচকে বলে
— কোথায় যাও আব্বু চাচ্চু??
— আর বলিস না চন্দ্র বিকালে তোর আম্মু ফোন দিয়ে বলল রোজিনার শরীর খারাপ তাই আমি আর পারভেজ বাসায় যাই দ্রুত যেয়ে শুনি আরেক কথা নিশা নাকি আজ তিনদিন ধরে হোষ্টেলে যায় না তাই ওয়ার্ডেন ফোন দিয়েছে। পরিচিত সব জায়গায় ফোন দিয়েছি পারভেজের শালি সমন্দি সবাইকেই জিজ্ঞাসা করেছি তারা কেউ জানে না,,,
— তারা জানে এবং তাদের প্ররোচনায় নিশা এতোটা সাহস দেখিয়েছে,,
চন্দ্রের কথা পারভেজ সাহেব ও কামরুল সাহেব অবাক হয়। পারভেজ সাহেব অবাক স্বরেই বলে

— কি বলছিস চন্দ্র
— হ‍্যা চাচ্চু রুবি আন্টি সব জানে সেই এই সকল কিছু নাটিগুটি। সেই এতোদিন চাচীকে নিজের আঙ্গুলের মাথায় ঘুড়িয়েছে এখন নিশাকে।
— মানে
চন্দ্র হেয়ালি করে বলল — কাল সকালেই সব জানতে পারবে এখন বাসার ভিতর যাও,,,
— কি বলছিস চন্দ্র বাড়ির মেয়ে নিখোঁজ আর আমরা জেনেও হাত গুটিয়ে বসে থাকব
— হ‍্যা থাকবে আর কেনো থাকবে সেটা কাল সকালে টের পাবে
বলেই চন্দ্র তাদের দুইজনকে নিজেদের বাসায় বসিয়ে যায় পুনমদের বাসায় সে জানে তার বোকারানী এখন সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে বসে বসে কাদছে। সেই খবর পেয়েই তো এতো দ্রুত বাসায় আসা।
রোজিনা বেগম নিজের ঘরে বসে কাদছে তার পাশে বসে শান্তনা দিচ্ছে চাদনী বেগম।
— পুনম ও মায়ের পাশে বসে গুনগুনিয়ে কাদছে। মুক্তি অনেক বলে কয়েও থামাতে পারছে না তার এককথা তখন যদি সে নিশাকে না যেতে বলত নিশা নিশ্চয়ই যেতো না।
চন্দ্র ঘরে ঢুকে সবার আগে পুনমের দিকে তাকায়। পরে রোজিনা বেগমের পাশে বসে তার হাতগুলো নিজের হাতে নেয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— নিশাকে কাল সকালে তোমার কাছে এনে দিব চাচী এখন কেদো না,,
চন্দ্রের কথা রোজিনা তরাক চোখে চন্দ্রের দিকে তাকায়।
— তুই কই পাবি বাপ
চন্দ্র একপলক মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখের আশ্বাস দিয়ে আবার রোজিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল — কাল সকাল বেলায় নিশা এসে তোমার সামনে হাজির হবে কেদো না।
বলেই আবার যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে যায়। পুনম কান্না ভুলে নাকমুখ কুচকে বলে
— আপু তোমার ভাইকি একটু সহানুভূতি দিয়ে কন্ঠটা নরম করে বলতে পারে না। কথা বলে না যেনো একেকটা মিসাইল ছুড়ে মারে
মুক্তি মিটমিট হেসে বলল — আমার ভাই একজনের ক্ষেত্রেই নরম বাকী সবার সাথে গরম।
মুক্তির কথায় পুনম আগ্রহ নিয়ে বলে — কে সে??
মুক্তি চোখ টিপ দিয়ে বলল — আছে আমাদের ফ‍্যামিলির স্পেশাল কেউ,,

পুনম মুক্তির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল — হাহ স্পেশাল কেউ। যেনো তার স্পেশাল কাউকে আমি দেখার জন‍্য মরে যাচ্ছি। ঐ গম্ভীর মার্কা চাদের উপর আমার একটুও ইন্টারেস্ট নাই।
রাতে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রোজিনা বেগমকে খায়িয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। সবাই থমথমে পরিবেশে খেয়ে নিয়েছে কোনো রকম চন্দ্রের কথা অনুযায়ী পারভেজ সাহেব বেশ ভয়েই আছে নাজানি মেয়েটার কি হলো।
পুনম আজ কিছুতেই ঘুমাতে পারে না কেনো যেনো মনটা খারাপ বেশ খারাপ মন খারাপের কারণ হিসেবে ধরে নেয় বোনের নিখোঁজ হওয়া। বাইরে মৃদু হাওয়া বইছে। পর্দা উড়ে সেই হাওয়া ঘরে প্রবেশ করে।
পুনম উঠে বারান্দায় দাড়ায়। পুনমের ঘরের বারান্দা দিয়ে চন্দ্রের পুরো ঘরটা দেখা যায়।
চন্দ্রের ঘরের লাইট জ্বলছে। চন্দ্র কাউচে বসে কারো সাথে ফোনের কথা বলছে পুরো মুখস্রী লাল টকটকে হয়ে আছে মনে হচ্ছে ভীষণ রেগে আছে।

চন্দ্র কথা বলতে বলতে হঠাৎই তার নজরে আসে একটা আবছায়া। চন্দ্র জানে কার ছায়া এটা হঠাৎই মনে প্রবেশ করে অদ্ভূত শীতলতা। ঠোটের কোণে ফুটে স্নিগ্ধ হাসি যার প্রেমে পরে যাবে কেউ। তবে সেকেন্ডই তা মিলিয়ে যায়। ফোনের অপর পাশ থেকে কেউ ডাক দিলে বিগড়ে যাওয়া মেজাজটা ফিরে আসে তবুও শান্ত কন্ঠে বলল
— আ”ল কল ইয়‍্যু লেটার
অপর পাশের কোনো কথার অপেক্ষা করে না নিজের মতো কেটে ফোনটা কাউচে রেখে দেয়ালের একপাশে হ‍্যালান দিয়ে দেখতে থাকে পুনমকে।
পুনম চন্দ্রের দিকে আর তাকায় না তাকিয়ে আছে ঐ দুর আকাশে। ভালো লাগে দেখতে এই থালার মতো গোল রুপালি চাদঁ খানা সমগ্র পৃথিবীকে আলো দিয়ে চলছে সেদিকেই তাকিয়ে আছে পুনম।

পুনমের নজর লক্ষ‍্য করে হাসে চন্দ্র বিড়বিড় করে বলে — ঐ দূর আকাশের চন্দ্রের দিকে যখন এভাবে তাকিয়ে থাকিস তখন আমার কেমন লাগে জানিস উহু জানিস না,,,
হিংসে হয় ঐ চন্দ্রের মতোই তো আমিও চন্দ্র তাহলে আমার দিকে এরকম করে মোহিতো চোখে তাকাস না কেনো তুই?? মনে চায় ঐ চন্দ্রকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিন্ন করে দেই তবে কি করব বল অনেক কিছু চাইলেও করা যায় না। তবে চিন্তা করিস না যখন এই চন্দ্রের তোর উপর আধিপত্য বিস্তার করবে তখন থেকে ঐ মোহনীয় চোখ গুলি শুধু এই চন্দ্রকেই দেখবে।
ভেবেই ঠোট বাকিয়ে হাসে চন্দ্র। পুনম বারান্দা থেকে চলে যেতেই ঘোর ভাঙ্গে চন্দ্রের।

সকাল সাতটা নীড়বাসি বাড়িতে কলিং বেল বাজে। আজ চন্দ্র সকাল সকালই উঠেছে তাকে দেখে এতোক্ষণ কামরুল সাহেব তার বিশিষ্ট কাজ চা খাওয়া ও পেপার পড়া ছেড়ে ড‍্যাবড‍্যাব করে তাকিয়ে আছে।
চন্দ্র ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে ছিল এতোক্ষণ তবে বেল বাজতেই ঠোট বাকিয়ে হাসে চন্দ্র। কাজের মেয়ে মিনু তড়িঘড়ি করে আসতেই চন্দ্র তাকে ইশারায় বলল ভিতরে যেতে। আঠারো বছর বয়সী মিনু বেশ ভয় পায় চন্দ্রকে। তাই দৌড়ে আবার রান্নাঘরে চলে যায়।
গেট খুলতেই প্রবেশ করে নিশা রুবি ও রিয়াজ সাহেব। তার সাথে একজন লোক।
কামরুল সাহেব অবাক হয় তাকায় তাদের দিকে আবার তাকায় চন্দ্রের দিকে।
রিয়াজ সাহেব কামরুল সাহেবের দিকে তেড়ে এসে — ভোর বেলা আমাদের এভাবে উঠিয়ে আনার মানে কি??

— এখানে নিশ্চয়ই কোনো কারণে আপনাদের আনা হয়েছে বিনা কারণে আনা হয়নি,,
চন্দ্রের গম্ভীর স্বরে থেমে যায় রিয়াজ সাহেব। এর মধ‍্যে প্রবেশ করে পুনম রোজিনা পারভেজ সাহেব। নিশাকে দেখে রোজিনা তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে নিশা তার হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয়।
রোজিনা বেগম পরতে নিলে তাকে পুনম পিছন থেকে ধরে ফেলে। তবুও রোজিনা বেগম নিশার মুখে চুমু দিতে দিতে বলে — এই কয়দিন কোথায় ছিলি মা??
— তোমার বোনের বাসায় ছিল চাচী,,
— মানেহ,, কি বলছ চন্দ্র আমি কালকেও রুবির কাছে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি সে সাফ মানা করে দিয়েছে সেখানে নিশা নেই।
পারভেজ সাহেবের কথায় পাত্তা না দিয়ে চন্দ্র হেয়ালি স্বরে বলল

— কি মি. শশুর শাশুড়ির সাথে পরিচয় হবেন না,,
চন্দ্রের কথায় পুরো ড্রয়িং রুমে বিষ্ফোরণ ঘটে।
— কিহ
বলে রোজিনা ঢলে পরতে নিলে তাকে আগলে নেয় পারভেজ সাহেব।
— এগুলো কি বলছিস চন্দ্র
পারভেজ সাহেবের রাগী স্বর।।
— কি নিশা আমি সত‍্যি বলছি কিনা মিথ্যা বলছি বলোত।
নিশা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকে পারভেজ সাহেবকে রেগে যেতে দেখে নিশা ভয় পায়। তাই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। নিশার নিশ্চুপতা দেখে পারভেজ সাহেব নিশার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল — জবাব দাও নিশা চন্দ্র যা বলছে তা কি সত‍্যি
পারভেজ সাহেবের কথায় কেপে ওঠে নিশা পিছনে দাড়ানো লোকটা নিশাকে ধরে বলল

— হ‍্যা নিশা আমার স্ত্রী আমরা গত পরসু বিয়ে করেছি,,
রাশেদের কথায় পারভেজ সাহেব অবাক চোখে তাকিয়ে রোজিনাকে সোজা করে দাড় করায়।
— এতো বড় সাহস হয়ে গেছে যে বিয়ে পযর্ন্ত চলে গেছো
বলেই একটা সপাটে চড় বসিয়ে দেয়। আরেকটা মারতে নিলে তাকে আটকায় কামরুল সাহেব
— আমাকে ছাড়েন ভাইজান এই মেয়েকে আমি মেরেই ফেলব।
— পারভেজ শান্ত হ এভাবে উত্তজিত হয়ে কিচ্ছু হবে না।
পারভেজ সাহেব আবার রুবির দিকে তেড়ে যায়।
— তাহলে বদলাটা এভাবেই নিলে,,,
— বদলাহ
রোজিনা অস্ফুট স্বরে বলল। — হ‍্যা প্রতিশোধ নিশা গ্রামে ফিরে যাওয়ার দিন আমি রুবিকে কল দিয়ে বলেছিলাম ওর খেয়াল রাখতে রুবি কারণ জিজ্ঞাসা করলে আমিও বলি। তখন রুবিও আমাকে অনেক কথা শুনায় আমিও ছাড় দেইনি। কথায় কথায় রুবির পালিয়ে বিয়ে করার কথাও বলি। সেই কথার জের ধরেই ও আজ আমার মেয়ের সাথে সেই কাজটাই করল।
কথাটা শুনে রুবিও তেজী স্বরে বলল — হ‍্যা হ‍্যা করেছি তো কি করবা তোমরা?? তোমার মেয়েকে আমিই ফুসলিয়ে তার বয়সের দ্বিগুন লোকের সাথে বিয়ে দিয়েছি।
কথার সাথে সাথে গালে ঠাসসস করে থাপ্পড় মারে।। সাথে সাথে আরেকটা গালেও থাপ্পড় মারে। রুবি ফুসফুস করে উঠলে

— একদম চুপ কোনো আওয়াজ করবিনা। দশ বছরের ছিলি তখন থেকে মানুষ করে বড় করেছি। নিজের সংসারের দিকেও তাকিয়ে দেখিনি আজ তার প্রতিদান এভাবে দিবি তা কোনো দিনেও ভাবতে পারিনি।
আজ থেকে মনে করব আমার কোনো ভাই বোন নেই এখুনি আমাদের বাড়ি থেকে বের হ।।
রিয়াজ থমথমে মুখে কিছু বলতে নিলে রোজিনা বেগম তাকে থামিয়ে দেয় হাত উচু করে। রিয়াজ সাহেব রুবিকে নিয়ে চলে যায়।
রোজিনা বেগম নিশার দিকে তাকিয়ে বলে — নাড়ীছেরা ধন তুমি তোমাকে ভুলতে পারব না তবে মনে রেখো আজ থেকে তুমি আমাকে মা বলে ডাকার অধিকার হারালে।
বলেই হাপাতে লাগল। চাদনী বেগম দ্রুত এসে তাকে ধরে নিজেদের ঘরে নিয়ে যায়।
— আমি জানতাম নিশার কেউ নেই ও এতিম খালার কাছে থাকে তাই এভাবে বিয়ে করেছি,,
আমতা আমতা করে বলে রাশেদ। রাশেদের কথায় কেউ কিছু বলে না কামরুল সাহেব তাকে বসতে বলে। পারভেজ সাহেবকে নিয়ে সাইডে যায়। বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে সব মেনে নিতে বলে।।। পারভেজ সাহেব আর কিছু বলে না। কামরুল সাহেব চাদনী বেগমকে বলে নিশাদের আপ‍্যায়নের কথা বলে। চাদনী বেগম তাদের জন‍্য রান্না শুরু করে। তবে নিশা কারো সাথে কথা বলে না এবং সেখানে থাকেও না। সে জোর করেই সেখান থেকে চলে যায়।

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ২০

— অ‍্যাই পুনু
ক্লাস শেষে চন্দ্র পুনম একসাথে আসছিল। কারো ডাকে সে ফিরে তাকায় পিছনে ফিরে দেখে নয়ন।
— নয়ন তুই এখানে,,??
— হ‍্যারে এই সাহরান” স কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছি,,
— কবে ভর্তি হয়েছিস আর আমি জানিনা কেনো আমিও তো ঐ খানেই ভর্তি হয়েছি,,
— দেখবি কিভাবে ছেলে আর মেয়েদের তো আলাদা ক্লাস হয় বলদি এতোদিনে তাও জানিস নি
নয়ন হেসে পুনমের মায়ায় ঠুয়া দিয়ে বলল। নয়নের ভাজ করা আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে আছে চন্দ্র নাহ এখন তার এই আঙ্গুলটা কেটে ফেলতে মন চাচ্ছে। হাতের মুঠো শক্ত করে এদিক ওদিক তাকায়। পুনমের আপাতত কোনো স্থানে ধ‍্যান নেই সে বন্ধুর সাথে আলাপে ব‍্যস্ত।

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ২২