পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ২২
সাদিয়া আক্তার
নিখুঁত হাতের নকশী কাথায় ফুটিয়ে তুলছে চাদনী বেগম। পরিবারের সবচেয়ে ছোট্ট ও অনাগত বাচ্চার জন্য।
— চাচী এই কাথা গুলো বেশ সুন্দর হয়েছে ভাইয়ের জন্য আমার পছন্দ হয়েছে।
মুচকি হাসে চাদনী বেগম। সেলাই উঠাতে উঠাতে বলে — ভাইই হবে তুই জানলি কেমনে বোনোও তো হতে পারে,,
— আমি প্রত্যেক নামাজের মুনাজাতে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি যেনো এবার আমার মায়ের কোলে আল্লাহ্ একটা ছেলে দেয়। তার মনের আশা পূরণ করে।
চাদনী বেগম দেখলেন পুনমের ঠোটে হাসি চোখে জল। সে মাথায় হাত বুলায়
— অনেক সহ্য করেছিস তাই না মা
— উহু চাচী আমার কপালে ছিলো জন্মসূত্রে নাহলে কি আমি জন্ম নেই। প্রথম সন্তান ভালোবাসা থাকলেও পরের সন্তান আশা ভরসা। প্রথম কন্যা সন্তান জন্মানোর পরই স্বাভাবিক ভাবে বাবা মা চাইবে পরের সন্তান ছেলে হোক। তবে সেই জায়গাই আরেকটা কন্যা সন্তান সেটা সবার জন্যই হতাশা নিরাশা। তার উপর গায়ের রঙ কালো।
চাদনী বেগম পুনমকে বুকে জড়ায়। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে — কে বলেছে আমার মেয়ে কালো উহু সেতো এক মায়াবী কন্যা যার মায়ায় আমরা বাধিত। আর কালো বলছিস নিজেকে ভুলে যাস না ঐ অন্ধকার আছে বলেই আলোর এতো কদর। দোয়া করি আল্লাহ্ আমার মাটাকে এতো বড় করুক যেনো অন্ধকার ছাপিয়ে আলোর রশ্নি হয়ে ওঠে তার জীবনে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চাচীর কথায় মিষ্টি হাসল পুনম। চাদনী বেগম সেই মিষ্টি হাসি মায়াবী চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে ভাবে কিভাবে এই মায়াময় চেহারা দেখেও রোজিনা এই মেয়েটাকে উপেক্ষা করতে পারত।
দরজায় ওপাশ থেকে সবই শুনেছে। সে এসেছিল চাদনী বেগমের কাছে কাথা গুলো দেখতে কেমন হয়েছে মেয়ের কথা শুনে থেমে যায় ভাবতে থাকে কতটা কষ্ট পেলে একটা মেয়ে নিজের জন্মানো নিয়েও কথা বলতে পারে। তারপর ও মেয়েটা তার প্রতি যত্নশীল। এইযে একটা কাজও তাকে এখন করতে হয় না চাদনী বেগম তাদের পুরোপুরি তাদের বাড়িতেই শিফ্ট করেছেন। পুনমও তাকে বিছানা হতে নামতে দেয় না। খাবারের থালাটাও সে বিছানায় বসেই পায়।
আজকে ভর্তি কোচিংয়ের একটা ইংলিশ ক্লাসটা চন্দ্র করাবে তাও আবার ছেলেদের।।
চন্দ্র যখন ক্লাসে ঢোকে হইহুল্লোর লেগে যায় ছেলেদের মুখে বড় বড় হাসি ঝুলছে চন্দ্রের বিশাল বড় ফ্যান তাড়া।
— আসসালামু আলাইকুম স্যার আমরা আপনার অনেক বড় ফ্যান।
সবাই একসাথে হাসি মুখে বলল। চন্দ্র মাথা নাড়িয়ে ক্লাস শুরু করল। সবাই খুব একটা অবাক হলো না কারণ তারা জানে চন্দ্র এমনিই। তবে আজকে সবার ক্লাসটা বেশ ডিফ্রেন্ট ভাবে হয়। একঘন্টার ক্লাস প্রায় দেঢ় ঘন্টায় শেষ হয় লাষ্টে সবাইকে পড়া ধরে চন্দ্র এর মধ্যে পুনমের বন্ধু নয়নও ছিলো সে পাচঁ টা কোয়েশ্চেনের মধ্যে দুইটা পারেনি।
— নয়ন আপনি এই কুয়শশ্যনটা দুইশত বার লিখে আনবেন দুইটা মোট চারশ।
চন্দ্রের কথা শুনে চমকে ওঠে নয়ন ভয়ে ঢোক গিয়ে চারশ বার লেখা কোনো মুখের কথা না রাত পার করেও কালকের দিনেও শেষ করতে পারবে কিনা সন্দেহ কারণ প্যাসেজটা বেশ বড়। তবুও কিছু বলার সাহস করল না কারণ সবাইকেই মোটামুটি শাস্তি দিয়েছে।
ক্লাস শেষে বের হয় চন্দ্র ও পুনম। পুনম আজকেও নয়নকে দেখে ডাক দিলে নয়ন দূর থেকেই সময় নেই বলে চলে যায়। পুনম ভ্রু কুচকে তাকায় কি হলো এই ছেলের
— ভাইয়া বাইক নিবে না আজ আনোনি,,
— নাহ সার্ভিসিং এ আছে কেনো হাটতে সমস্যা হচ্ছে রিক্সা নিব??
পুনম মাথা নাড়ায় তবে মনে মনে বিরক্ত হয়। এখান থেকে হেটে গেলে প্রায় আধঘন্টার রাস্তা এই কড়া রোদে যাবে কিভাবে যদিও শেষের শীত দেখে খুব একটা গায়ে লাগছে না। রাস্তা দিয়ে ব্যাগ কাধে নিয়ে হাটছে পুনম পাশেই চন্দ্র দুই হাত পকেটে গুজে হাটছে।।
পুনম ধীর পায়ে হাটলেও চন্দ্র তার থেকেও ধীর পায়ে হাটছে। তার ঠোঁটের কোণে হাসি যা সূক্ষ্মভাবে না দেখলে বোঝা যাবে না।
চন্দ্ররা যেখানে থাকে সেই এরিয়াটা হাউজিং টাইপ ঢোকার শুরুতেই একটা পার্ক পড়ে।
— ঐখানে বসবি
পুনম ইঙ্গি করা জায়গাটার দিকে তাকায়। আসার দিনেই তার মনটা ঐ পার্কে যাওয়ার জন্য আকুপাকু করছিল তবে যায়নি। বলা চলে সময় হয়নি। আজ চন্দ্র বললে সে না করতে পারল না মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। দুইজন পার্কে একটা বেঞ্চে বসে সামনেই রাউন্ড শেপের একটা পুকুর।। আশেপাশে বাচ্চাদের রাইডস প্লাষ্টিকের ঘোড়া,, ঢেকি,, স্লিপার। পুনমের মন চাচ্ছে ছোটবেলার মতো ঢেকিতে চরতে।
— ঢেকিতে চরবি
পুনম অবাক হয় তার মনোভাব বুঝল কিভাবে।
— যেভাবে লালসা নজরে ঢেকিটাকে দেখছিলি যে কেউই বুঝবে তুই ঐটাতে চড়তে চাস।
চন্দ্রের কথায় মুখ ঘুড়িয়ে ভেংচি কাটে। চন্দ্র ইশারা করে উঠার জন্য একপাশে পুনম অন্য পাশে চন্দ্র। একজন উপরে নামছে তো অন্যজন নিচে নামছে। এই দুলুনিতে খিলখিল করে হাসে তার হাসিতে যে আরেকজনের চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে বোকা রমনী কি তা জানে।
পুনমের রেজাল্ট দিয়েছে গোল্ডেন এ+ পেয়েছে। সবাই তার রেজাল্টে অনেক খুশী তবে এরমধ্যে আরেকটা খুশীর খবর নিয়ে আসে মুক্তি।
— দেখতো এটা
হাত বাড়িয়ে খামটা নিতে নিতে বলল পুনম। খুলে দেখে একবার মুক্তি তো একবার চন্দ্রের দিকে তাকায় আজ পুনমের রেজাল্টের উপলক্ষ্যে সবাই একত্র হয়েছিল রুপশাও তার হাজবেন্ট নিয়ে এসেছে। রুপশা উঠে এসে হাতে পেপারটা পড়ে অবাক হয়ে প্লাস হাসি দিয়ে পুনমকে জড়িয়ে ধরে।
বাকি সবাই অবাক মুক্তিকে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে??
— আব্বু আম্মু চাচা চাচী,, আমাদের পুনম একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলেছিল সেটার মনিটাইজেশন আসছে। গুগল থেকে চিঠি এসেছে।
এক সেলিব্রেশনের মাঝে আরেকটা খুশীর খবর সবার আনন্দ দ্বিগুন করে দেয়।
দেখতে দেখতে কেটে দুই মাস এর মধ্যে পুনমের ভর্তি পরীক্ষাটাও শেষ হয়ে গেছে মেডিকেলে চান্স হয়নি পুনমের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছিল তবে সেখানে পারভেজ সাহেব দেয়নি সাভার থেকে এতো দূরে জার্নি করে ক্লাস করাটা কষ্টকর হয়ে যাবে এই জন্য পুনম এবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আশায় বসে আছে।।
আজকে পুনমের পরীক্ষা আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের।
পারভেজ সাহেব তাকে নিয়ে যাবে। ইদানীং রোজিনা বেগম বেশ আদর করে পুনমকে সবার চোখে পড়ছে সেটা সবাই অবাক হয় তবে চাদনী বেগম অবাক হয়না। সে জানে সেদিন পুনমের বলা সব কথায় রোজিনা শুনেছে এবং নিজের মনে মনে অনুতপ্ত ও সে। রোজিনা বেগমের পাচঁ মাসের পেটটা নিয়ে আস্তে আস্তে পুনমের ঘরে উকি দেয়।
— আর কতক্ষণ পুনম তোর আব্বু রেডী হয়ে বসে আছে,,
পুনম মাথার হিজাবে পিন দিতে দিতে বলল — হয়ে গেছে আম্মু। আজ না রুপশা আপুর আসার কথা কখন আসবে??
— এই তো জামাই সহ আসবে তাই বারোটার দিকেই আসবে
— ওওহ তাহলে আমি এসে পাব তাদের
পুনম ফাইল পত্র গুছিয়ে সোজা হতেই রোজিনা বেগম মুখের সামনে দুধের গ্লাস ধরে। পুনম খেয়ে নিতে রোজিনা বেগম আচলে মুখ মুছতে মুছতে বলল — ঠাণ্ডা মাথায় পরীক্ষা দিবে
পুনম আদর টুকু উপভোগ করে মাথা নাড়ায়। মুচকি হেসে রোজিনা বেগমের হাত ধরে তাকে সাবধানে নামায়।
একে একে সবার থেকে বিদায় নিয়ে পারভেজ সাহেবের সাথে বেড়িয়ে পরল। উপর থেকে একজন দেখল। তার ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি।
পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ২১
পুনমের সাথে আজ মিহিও পরীক্ষা দিবে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাটা দিতে পারেনি। তখন ওর দাদী ভীষণ অসুস্থ ছিলো এজন্য এখানে পরীক্ষা দিচ্ছে পুনমের জোড়াজুড়ির কারণে।