পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৪২

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৪২
সাদিয়া আক্তার

ঘুমিয়ে আছে রাতের আকাশ নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বল করছে পুনমের বারান্দা। সেখানেই বসে রেলিঙে হ‍্যালান দিয়ে বসে আছে পুনম। বারান্দায় বসে ঐ দূর আকাশে শশীর দিকে তাকিয়ে
বলল — আপনি আমার না পাওয়া অদ্ভুত শূন্যতা যার মোহে আমি নিজেকে হারিয়েছি।
রেলিঙের খুটি গুলো আলতো হাতে ছোয় পুনম এই বারান্দার প্রত‍্যেকটা ইট জানে পুনমের রাত জাগা গল্পগুলো। চিঠি লেখার সময় পুনমের লাজুক রাঙা আদল খনে খনে চিঠি পড়ে মুচকি হাসে সবকিছুর সাক্ষী এই বারান্দার প্রত‍্যেকটা কোণা।

— ভুলে যাব। ভোলা কি এতোই সহজ যদি ভোলার ছিল তাহলে তার প্রতি অনুভূতি জন্মালো কেন আল্লাহ্,,,?? বিড়বিড় করে চোখ বন্ধ করে যদি মন ও দেহের ক্লান্তিতে একটু ঘুম আসে।
উহু ঘুম আসে না ক্লান্তিতে চোখই বন্ধ রাখে পুনম। এভাবেই কতক্ষণ ছিলো জানা নেই পুনমের তবে ফজরের আজানের ধ্বনিতে তার ব‍্যাঘাত ঘটে।
ঢলতে ঢলতে ওয়াশরুমে যায়। শাওয়ার ছেড়ে বসে পড়ে চোখ বন্ধ করে দশ মিনিট এভাবেই থেকে কাপড় ছেড়ে ওযু করে বের হয় নামাজে দাড়ায়। আজ নামাজ শেষে পুনম মুনাজাতটা বেশ দীর্ঘ করেছে প্রত‍্যেকটা সিজদাও দীর্ঘ করেছে বিড়বিড় করে কি বলেছে নিজেও জানে না।
জায়নামাযেই কখন লুটিয়ে পরে টের পায়না।। আজ পুনমের কেনো যানি গভীর ঘুম হচ্ছে এই বাবা চাচারা নামাজ থেকে ফিরে এসেছে টের পাচ্ছে পুনম। বাবাকে জৈন ভিজানো পানি দেওয়া লাগবে ভেবেই উঠে দাড়ায়।
— আব্বু পানি,,,,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন

পারভেজ সাহেব মেয়ের দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে পানি নেয়। বাসায় কেউ এখনো উঠে নাই মহিলারা ছাড়া তারা সকালে রান্নার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। আজ পারভেজ সাহেব পানি নিয়ে মেয়ের ললাটে চুমু খেলো না। পুনম বুঝে বাবা রেগে আছে তা দেখে ঠোট কামড়ে কান্না আটকায়। কামরুল সাহেব ও মিরাজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল — চাচ্চু,, বড় চাচা চা দিব,,
— নাহ চা খাব না,,,যেই মেয়ে হবু শশুরকে বড় চাচা ডাকে তার হাতে চা আমি খাব না।।
ঢোক গিলে পুনম সবাই নিজ নিজ সম্পর্ক তার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে এই দিকে সে কোন যন্ত্রণায় আছে তা কাউকে দেখাতে ও বুঝাতে পারছে না। পুনমকে চুপ করে নত মস্তকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মিরাজ সাহেব বলল — আহ ভাইজান দেখেন মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে আর এতোদিন চাচা ডেকেছে হঠাৎই সম্মোধন পরিবর্তন করা যায় নাকি,, আবার পুনমের দিকে তাকিয়ে বলল — তুই যা মা!!
পুনম রান্নাঘরে চলে যায়। চাদনী বেগম পুনমকে দেখে হেসে বলল — চা বানাবি
পুনম জোড় করে হেসে মাথা নাড়ায়। পুনম সামনে এগোলে চাদনী বেগম দেখে পুনমর ভেজা চুলে হিজাব ভিজে গেছে।

— পুনম সকাল সকাল গোসল করেছিস মা??
— জ্বি চাচী কেমন জানি অস্বস্তি লাগছিল হলুদের কারনে তাই,,,
— আচ্ছা সমস্যা নেই তবে চুল গুলো তো মুছবি!! বলে পুনমকে বসিয়ে পুনমের কোমরের থেকে একটু নিচে পড় চুলগুলো মুছতে থাকে নিজের শাড়ির আচল দিয়ে। ততক্ষণে পুনম পানি চরিয়ে দিয়েছে চুলায়।
পানি বলক আসলে চাদনী বেগম তাকে আবার ছেড়ে দেয়।
চা নিয়ে যেতে নিলে চাদনী বেগম পিছন থেকে বলে — চা দিয়ে ঘরে যেয়ে রেষ্ট নিবি সারাদিন অনেক ধকল যাবে।
পুনম সামনের দিকে ফিরেই মাথা নাড়ে। সত্যিই চা দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।।

কাল রাতে হইহুল্লোর করে ঘুমাতে ঘুমাতে সবার দেরী হয়ে যায়। তার দারুন উঠেও সবাই দেরীতে। শিহাব রিশানকে উঠিয়ে রমিজ সাহেব পাঠিয়ে দেয় হাউজিং এর ক্লাব ঘর সাজাতে। রিমি ঝিনুক রুপশা মুক্তি অন‍্যান‍্য কাজ হাত বাটাচ্ছে। সবাই কিছুনা কিছু কাজ করে চলেছে।
পুনমকে হলুদ গোসলের জন‍্য তৈরী করতে আসে তার বোনেরা কাল রাতের শাড়ি পড়িয়ে দেয় আজ আর সাজায়নি একটু পরেই হলুদে মুখ মাখামাখি হবে তাই।
রোজিনা বেগম কাদতে কাদতে আচল ধরে আছে। তার আচলের নিচেই চুপচাপ বসে আছে পুনম সকলে কত প্রকার কথা বলে চলেছে আজ সেদিকে কোনো ধ‍্যান নেই পুনমের। গোসল শেষ হতেই পুনমকে রুপশ ও একজন প্রতিবেশী ভাবি নিয়ে যায় পুনমের ঘরে। পুনমের হাতে ব্লাউজ পেটিকোট দিয়ে বলল গোসল করে পড়ে আসতে। পুনম সেই অনুযায়ী কাজ করে শাড়ি পড়াতে পড়াতে ভাবীটা বলল
— আমাদের চন্দ্র ভাই তাহলে পুনমকে বেশ ভালোবাসে
— কিভাবে বুঝলে ভাবী তুমি চন্দ্র ভাই আর পুনমের বিষয়ে জানো।
মাথা নাড়ে তিনি বলল — আরে দেখো না পুনমের হাতের মেহেদী রঙ বেশ গাঢ় হয়েছে চন্দ্রের নামটা যেনো জ্বলজ্বল করছে,,,,,
রুপশা সহ পুনমও নিজের হাতের দিকে তাকায় হলুদবর্ণ হাতের তালুতে চন্দ্রের নামটা উজ্জল চাদেঁর মতই জ্বলজ্বল করছে

— তা বেশ বলেছো ভাবী আসলেই চন্দ্র ভাই আমার বোনটাকে অনেক ভালোবাসে।
এভাবেই তাদের অনেক কথোপকথন চলতে থাকে সেদিকে পুনমের ধ‍্যান নেই সেতো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হাতের দিকে চন্দ্র নামটার দিকে।।
একটার দিকে যোহরের নামাজ পড়েই বর যাত্রী বের হবে সেই জন‍্য পুনমকে বারোটা বাজেই ক্লাবঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। একজন মেকআপ আর্টিষ্ট সেখানেই পুনমকে সাজাবে।।
ভারী লেহেঙ্গা হালকা ব্রাইডাল সাজ গায়ে সোনার গহনা সব মিলিয়ে পুনমকে বেশ রাজকীয় লাগছে।
দুপুর দুইটা নাগাত বর যাত্রী বের হলে থেকে যায় শুধু রোজিনা বেগম ও চাদনী বেগম। পূর্বকে মুক্তি আজ সারাদিন নিজের কাছে রেখেছে।। তাই পূর্বকে মুক্তি নিয়ে যায় ক্লাব ঘরে।
পূর্বকে নিয়ে যখন মুক্তি পুনমকে যেই ঘরে রাখা হয়েছে সেখানে যায় দেখে একটা মুর্তীয়মান বধূ বসে আছে যার মুখে কোনো হাসি নেই। মুক্তি দেখে ভাইয়ের নামের নাকফুলে একদম মানিয়েছে পুনমের মোটা নাকে।
— আপুর উপরে রাগ পূর্ণ,,

মুক্তি পাশে বসতেই পুনম ভাইকে কোলে নিল। মাথা নাড়িয়ে না সম্মোধন করল। মুক্তি তা দেখে মাথায় হাত বুলায় রুপশা এসেই পুনমকে ঝাপটে ধরে কেদেঁ দেয়। কান্না একটা ছোয়াছুয়ি রোগ রুপশার কান্না দেখে পুনম ও মুক্তিও কেদেঁ দেয়।
সমান তালে তিনবোনের কান্না চলছে তাদের কান্না দেখে ছোট্ট পূর্বও ঠোট ফুলিয়ে কেদেঁ দেয়।।
তখনই ঝিনুক রিমি আসে আপু বর এসেছে বর এসেছে বলেই তারা চলে যায় গেট আটকাতে।
গেটে দাড়ানো রিমি মিহি ঝিনুক আরো কয়েকজন পাড়া প্রতিবেশী মেয়েরা উকি ঝুঁকি দিচ্ছে — এই শিহাব ভাই চন্দ্র ভাই কই??
রিমির কথায় শিহাব নাক কুচকে বলল — ঐ চাঁদ মামার কথা কইস না গাড়ি থেকে বেরই হইল না বলল তোরা এই গ‍্যাঞ্জাম সেট কর।
শিহাবের কথা শুনে সবাই হতাশ তবুও লিমন বলল — শালিকারা দ্রুত গেট খুলার দরদাম শুরু করো আমাদের দুলা অধৈর্য‍্য হয়ে যাচ্ছে।।
লিমনের কথা শুনে একদফা হাসির রোল পড়ে গেলো যাই হোক কোনো দামাদামি হয়নি মেয়েদের চাওয়াই পূরণ করেছে লিমন। বীনা বিগ্নে ঢুকে পড়ে তারা চন্দ্র যখন নামে তখনই লিমন বক্সে গান সেট করে
_!পিছে বারাতি আগে ব‍্যান্ড বাজা
— আয়‍্যে দুলহে রাজা
“” গোরী খোল দারওয়াজা
গানটা শুনে মুক্তির হঠাৎই কেনো জানি হাসি পেলো। বর্তমানে পুনমের অবস্থা গানের ঐশ্বরিয়া রায়ের মতো আর চন্দ্রের অবস্থা সানজেয় দাট্টের মতো। — ইশশ ঐ শের না বাঘ যদি উপস্থিত থেকে যদি আজেয় ডেবগান গ‍্যাপটা ফিল করে দিতো।

পরেই আবার ভাবে — না বাবা না উপস্থিত নাই ভালো হয়েছে নাহলে আমার ভাই ভিলেন হয়ে যেতো। আমার হিরো মার্কা ভাই ভিলেন কেন হবে।।
মুক্তি তো আর এসবই তার ভাইয়ের কারসাজি।
— এই মুক্তি কখন থেকে ডাকতেছি কি বিড়বিড় করে চলেছিস চোখ বন্ধ করে।
— হু,,, হে হে কিছু না
— চল বিয়ের কাজ শুরু হবে।
দেনমোহর ধার্য করে সব লেখালেখি শেষ করে কাজী চলে যায় পুনমের কাছে অধৈর্য‍্য বসে থাকে চন্দ্র।।
— টেক ইট স্লো ব্রো দিনের এখনো অনেক বাকি,,, বাসর রাত পন্ড হবে না তোর
বলেই মিচকে হাসে শিহাব।
— তোরা ভাই ব্রাদার তোর সব ঠিক করবি না তো কে করবে,,, চন্দ্র ভ্রু নাচায়।। — কিরে কাজী এখনো আসল না ক‍্যান?? মিনিট পাচেঁর পর চন্দ্র অধৈর্য‍্য হয়ে বলল।

— থাম ভাই মেয়ে মানুষ কবুল বলতে একটু সময় নেয়।
— তাই বলে এতো সময় পাঁচ মিনিটে পঞ্চাশ বার কবুল বলা যায় তাও আবার থেমে থেমে।
রিশান লিমনের দিকে তাকিয়ে বলল — ভাই এরে বুঝান তো
— শালা বাবু তোমার থালায় যদি আস্তো খাশি না থাকে তাহলে কিন্তু আজকে তোমার বাসর পন্ড।
লিমনের কথায় শিহাব রিশান হতাশ আর চন্দ্র বিড়বিড় করে বলল — এরা সবাই আমার বাসর নিয়ে পড়ে আছে কেনো আমি এমনিতে ভয়ে আছি সত‍্য জানতে পারলে আবার ঘরে জায়গা হবে কিনা এরা আছে বাসর পন্ড করার পায়তারায়। আরে বাসর এমনিতে লন্টভন্ট হয়ে যাবে। ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এরমধ্যেই ভিতর থেকে খবর এলো কনে এখনো কবুল বলছে না।

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৪১

দম যেনো গলায় আটকে গেলো চন্দ্রের। পারভেজ সাহেবের কানে যেতেই তিনি দ্রুত মেয়ের কাছে যান।।
বাবাকে দেখেই তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে পুনম। পারভেজ সাহেব মাথায় হাত বুলায় বুঝায় কবুল বলতে ।। পুনমও বাবার বুকে থেকে কবুল বলল।
কাজী সাহেবকে হাসি মুখে ফের চন্দ্রের সম্মতি চাইতেই চন্দ্র এতোক্ষণ আটকে রাখা দম ফূসস করে ছেড়ে কবুল বলল।

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৪৩