প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৬ (২)

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৬ (২)
Writer Mahfuza Akter

এক বসন্তের পর আরেক নতুন ফাগুনের আগমন ঘটলো। বছরের ঘূর্ণনে বদলেছে অনেককিছুই। তরী এবং মধুকে এক তুমুল প্রতিযোগিতামূলক ভর্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তরীর পাশাপাশি মধুকেও হঠাৎ পড়াশোনায় এতো মনযোগী ও নিয়মিত হতে দেখে অবাক হয়েছে সৌহার্দ্য ও মালিহা। তরী নিজেও হতভম্ব হয়েছে বারংবার। মধুর মধ্যে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন দেখেছে তারা। যেই মেয়েকে সবসময় পড়াশোনা থেকে দূরত্ব রাখতে দেখেছে, তাকেই হঠাৎ এভাবে দিনের পর দিন বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতে দেখাটা অস্বাভাবিক বটে।

প্রচুর পরিশ্রম ও সাধনার পরেও সরকারী মেডিকেলে তরীর চান্স হলো না। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন থেকে এক ধাপ পিছিয়ে গেলেও তরীর মধ্যে তেমন বিষাদ দেখা গেল না। অনেকটা নিশ্চিন্ত ও নিস্পৃহ হয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলো। তরীর এমন গা-ছাড়া ভাব দেখে মধু হয়ে একদিন বললো, “কী রে? আমার পুরোনো আত্মা তোর ওপর ভর করেছে নাকি?”
তরী সেদিন হেসে বলেছিল, “স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলেই কি জীবন থেমে যায়? এক স্বপ্ন পূরণ না হলে নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করতে হয়।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তরী এবং মধু দুজনেরই চান্স হয়ে গেল। তরীর সরকারী মেডিকেলে চান্স না হওয়া নিয়ে সৌহার্দ্য কিছু না বললেও এইবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য তরীর আগ্রহ দেখে অবাক হলো। বহুদিন পর সেদিন সৌহার্দ্য তরীর সাথে মুখোমুখি বসে কথা বললো,
“পাবলিকে চান্স হয়নি বুঝলাম! কিন্তু আমার সামর্থ্য আছে তোমায় প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে পড়ানোর।”
তরীর ভাবলেশহীন জবাব, “কিন্তু আমার আর ডাক্তার হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই।”
সৌহার্দ্য অবাক হয়ে বললো, “কিন্তু এটা তো তোমার স্বপ্ন ছিল!”
“স্বপ্ন ছিল, কারণ তখন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এখন আমার ঘুম ভেঙে গেছে।”
“মানে?”

“মানে আমি ডাক্তার হতে চাই না। আমি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করবো, মাস্টার্স করবো, সম্ভব হলে হায়ার স্টাডিজ-এর জন্য বিদেশ যাবো। কিন্তু আমি ডাক্তার হবো না। যেই প্রফেশন আমাকে কাছের মানুষ থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করে, সেই পেশা আমি কেন গ্রহন করবো?”
শেষ বাক্যটা যে তরী সৌহার্দ্যকে উদ্দেশ্যমূলক বিদ্রূপ করে বলেছে, সেটা সৌহার্দ্য বেশ ভালো করে বুঝতে পারছে। সে মলিন হেসে বললো, “ডক্টরেরা কাজ ও পারিবারিক দায়িত্ব দুটোতেই ব্যালেন্স রাখে। সবাই আমার মতো না।”
তরী ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে বললো, “কারণ সবাই তো আপনার মতো রিসার্চার না। যাই হোক, আমার এসব কিছু বলার বা করার কোনো ইচ্ছে নেই। আপনার মতো অসাধারণ ব্যক্তি হওয়ারও কোনো দরকার নেই আমার। আমি সাধারণ মানুষের মতোই থাকতে চাই।”

সৌহার্দ্যের কথার পরোয়া না করেই তরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগে ভর্তি হয়ে গেল। তরীর সিদ্ধান্তের বিপরীতে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ব্যতীত সৌহার্দ্যের আর কিছুই করার রইল না।
মধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে শুনে প্রহর ততটা অবাক হয়নি যতটা না মধুকে নিজের ডিপার্টমেন্টে দেখার পর হয়েছিল। বিড়বিড় করে আনমনে বলেছিল, “তার মানে এখন থেকে রোজ দেখা হবে। মহা ঝামেলায় পড়ে গেলাম মনে হচ্ছে!”

আজ তরীর ভীষণ মন খারাপ। দুপুরের কাঠফাটা রোদে টিএসসির পাশ দিয়ে ধীর গতিতে হেঁটে যাওয়ার সময় তরী অনুভব করলো, সে আজ ভীষণ ক্লান্ত। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে একটা গাছের নিচে বসে মধুকে কল দেওয়ার জন্য ফোন বের করলো। তৎক্ষণাৎ মধু কোত্থেকে যেন ছুটে এসে তরীর পাশে বসে পড়লো। তরী মধুকে দেখে অবাক হলো যেন,
“তুই এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি যে? ক্লাস শেষ?”
“একটা ক্লাস শেষ হয়েছে।”
“নেক্সট ক্লাস কখন?”

মধু বিরক্ত হয়ে বললো, “বিকেলে। কিন্তু আমি আজকে বিকেলের ক্লাসটা করছি না।”
তরী মিটমিটিয়ে হেসে বললো, “বিকেলের ক্লাসটা মনে হয় প্রহর ভাইয়ার?”
মধু ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তরীর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, “ঐ অভদ্র লোকটার কথা উঠলেই তুই এইরকম অদ্ভুত ভাবে হাসিস কেন বল তো?”
“অদ্ভুত ভাবে কখন হাসলাম?”
“স্বাভাবিক হাসি তো না এটা!”

মধুর সন্দিগ্ধ চাহনির বিপরীতে তরী হাসতে হাসতেই বললো, “তোর জ্বালায় কি একটু হাসতেও পারবো না আমি?”
মধু নাক-মুখ কুঁচকে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করলো। রোদের তপ্ততায় গলা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম এখন। কিন্তু তরীর কথা শুনে আর পানি মুখে তোলা হলো না মধুর,
“একটু হলে যেতে হবে। কিন্তু এই রোদে কীভাবে যাবো, সেটাই ভাবছি!”
মধু অবাক হয়ে বললো, “হলে কেন যাবি?”
“হলে সিটের জন্য আবেদন করতে যাব।”
মধু হতভম্ব হয়ে বললো, “মানে তুই হলে থাকবি?”
তরী ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
“তো কোথায় থাকবো? তোর ভাইয়ের বাসায়? ওনার সাথে আমার সম্পর্ক যে ভালো যাচ্ছে না, সেটা তোর অজানা নয়।”

“সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না বলে তুই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি?”
তরী মলিন মুখে হেসে বললো,
“উনি ঘর আলাদা করতে পারেন, আর আমি বাসা আলাদা করতে পারি না? আমি একটা টিউশনও পেয়েছি। সামনের মাস থেকে পড়ানো শুরু করবো।”
মধু হতবিহ্বলের মতো তাকিয়ে থেকে বললো, “তুই পাগল হয়েছিস? তোর মনে হচ্ছে না যে, তুই এবার বাড়াবাড়ি করছিস?”
“বাড়াবাড়ির বিপরীতে বাড়াবাড়ি-ই করতে হয়। তোর মহান ভাইয়ের এবার একটু শিক্ষা হওয়া উচিত। জনাব প্রায় এক বছর ধরে আমার থেকে বাড়াবাড়ি রকমের দূরত্ব রাখছেন। এবার আমার কাউন্টার অ্যাটাকের পালা!”
তরীর ঠোঁটের কিনারায় ক্ষীণ হাসির রেখা। মধুর তার মুখের দিকে অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো।

সৌহার্দ্য ডিউটি শেষে নিজের চেম্বারেই বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। তার দৃষ্টি জানালার বাইরে। বহুতল ভবনের বেশ উপরের তলায় তার চেম্বার বলে এখান থেকে সরাসরি শুধু আকাশ দেখা যায়। আর এখন গোধূলি লগ্নের রক্তিম আকাশ দেখতে দেখতে সৌহার্দ্য শুধু একটা কথা-ই ভাবছে, “তরী এতক্ষণে বাসায় চলে গেছে হয়তো! দিনশেষে ক্লান্ত শরীরে মেয়েটা একটু বিশ্রাম নিচ্ছে তো? নাকি আবার পড়তে বসে গেছে? কে জানে?”

তরীর সাথে তার কথা হয় না বহুদিন, বহুমাস যাবৎ। সে বাড়ি ফেরার সাথে সাথেই মেয়েটা দরজা লাগিয়ে নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলে, কখনো দেখা হয়ে গেলে সাথে সাথেই মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। সৌহার্দ্যের তখন এক অসহনীয় অনুভূতি জেগে ওঠে। সারা দেহের শিরা-উপশিরা ফুলে উঠে নীলচে বর্ণ ধারণ করে। তরী হয়তো কখনো সেটা দেখেনি। দেখলে নিশ্চয়ই ভয় পেত!

সৌহার্দ্য চিন্তাজগৎ থেকে বেরিয়ে এলো তার পিয়নের আগমনে। পিয়ন ছেলেটার নাম রাফি। ছেলেটা সবসময় হাসি হাসি মুখে থাকলেও সৌহার্দ্যকে দেখা মাত্র তার হাসির মাত্রা যেন আরো বেড়ে যায়। সৌহার্দ্যের সকল কার্যকলাপের তথ্য সে রাখে। রাফিকে দেখেই সৌহার্দ্য একহাতে দু-চোখ ঘষে বললো,
“আজ আর কোনো পেশেন্ট আছে?”
“নো, স্যার।”
“কোনো ক্রিটিক্যাল সার্জারী?”
“নেই, স্যার।”
“আমি তাহলে রিসার্চ সেন্টারে যাবো এখন। তুমি কিছু বলবে?”
রাফি পকেট থেকে একটা খাম বের করে সৌহার্দ্যের দিকে দিয়ে বললো,
“কালকের শিপমেন্টের সময় এই ছবিগুলো তুলতে পেরেছি।”

সৌহার্দ্য খাম থেকে ছবিগুলো বের করলো। মনযোগী ভঙ্গিতে ছবিগুলো দেখতে দেখতে বললো, “ড. আরমানকে তো দেখাই যাচ্ছে না কোনো ছবিতে!”
“উনি কালকে রিসার্চ সেন্টারে ছিলেন না, স্যার।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে ফেললো। ড. আরমান শিপমেন্টের সময় কখনো অনুপস্থিত থাকেন না। তাহলে কালকে ছিলেন না কেন? চিন্তিত ভঙ্গিতে সৌহার্দ্য বললো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৬ 

“এই ছবিগুলো কাজে লাগবে না, রাফি। ড. আরমানের প্রেজেন্স থাকতে হবে ছবিতে।”
“স্যার, নেক্সট শিপমেন্টে চেষ্টা করবো। কিন্তু একটা ব্যাড নিউজ ছিল।”
সৌহার্দ্য প্রশ্নোক্ত চোখে তাকাতেই রাফি বললো, “ড. আরমানের আরও একটা অবৈধ কারবারের সন্ধান পেয়েছি। আর তার সাথে খুব সম্ভবত আপনার ওয়াইফের কানেকশন আছে।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৭