প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৭
Writer Mahfuza Akter
সৌহার্দ্য এক চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে বাড়ি ফিরলো। তরী দরজা খোলার পর সৌহার্দ্যের বিমর্ষ মুখাবয়ব দেখে কিছুটা বিচলিত হলেও তা প্রকাশ করলো। সৌহার্দ্য ভেতরে ঢুকে সোজা নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। পেছন থেকে তরী হঠাৎ বলে উঠলো,
“আপনাকে একটা কথা জানানোর ছিল!”
সৌহার্দ্যের পা থেমে গেল। তবে সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো না। ডক্টর আরমানের ব্যাপারটা তাকে এতটাই নাড়া দিয়েছে যে, তরীর দিকে তাকাতেও এখন ভয় হচ্ছে। কী সম্পর্ক আছে তরীর সাথে ডক্টর আরমানের? কোনো না কোনো কানেকশান তো অবশ্যই আছে! সৌহার্দ্য নিস্প্রভ গলায় বললো,
“জানাও!”
তরী কিছুক্ষণ নীরব থেকে শান্ত গলায় বললো, “আমি ইউনিভার্সিটির হলে সিট পেয়েছি। পরশু শিফট হবো।”
সৌহার্দ্য যেন আকাশ থেকে পড়লো! তার কপালে গভীর ভাজ পড়লো। সে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালো তরীর দিকে,
“সরি! হোয়াট ডিড ইউ স্যায়?”
তরী ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “পরশু আমি হলে উঠবো। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে এনেছি আজকে। আপনাকে যাওয়ার দু’দিন আগেই জানিয়ে দিলাম!”
সৌহার্দ্য দাঁতে দাঁত চেপে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। পরমুহূর্তেই তরীর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“ডিসিশন নেওয়ার আগে যখন আমাকে জানানো প্রয়োজনীয়তা বোধ করোনি, তাহলে এখন জানাচ্ছো কেন? না জানিয়ে-ই চলে যেতে!”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
তরী স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো, “আমি এতোটাও অকৃতজ্ঞ না। আপনার অনেক অনুগ্রহ আছে আমার প্রতি!”
সৌহার্দ্য হতভম্ব হয়ে বললো, “কৃতজ্ঞতা? অনুগ্রহ? সিরিয়াসলি!”
তরী অবুঝের মতো তাকাতেই সৌহার্দ্য ওর হাত ধরে টেনে ওকে নিজের ঘরে নিয়ে এলো। তরীকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সৌহার্দ্য প্রশ্ন করলো, “এখন বলো! সমস্যা কোথায় তোমার?”
“কোনো সমস্যা নেই।”
“তাহলে হলে কেন যাবে? এতো বড় ফ্ল্যাটে কি তোমার জায়গা হচ্ছে না? আরো বড় ফ্ল্যাট লাগবে? তাহলে এরচেয়ে বড় সাইজের নতুন ফ্ল্যাট কিনে নিচ্ছি।”
তরী অবাক হয়ে বললো, “আমি কখন বললাম যে, এই ফ্ল্যাটের চেয়ে বড় ফ্ল্যাট লাগবে?”
“তাহলে চলে যেতে চাইছো কেন?”
“আমি এই বাসায় থাকলে হয়তো আপনার সমস্যা হয়!”
সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বললো, “মাথা খারাপ হয়েছে তোমার?”
তরী বিড়বিড় করে বললো, “নিজে ঘর আলাদা করে এখন আমাকে কথা শোনাচ্ছে! আমার নাকি মাথায় সমস্যা? এ্যাহহহ!!”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “কী বিড়বিড় করছো?”
“কিছু না!”
“কিন্তু আমি তো সবটাই শুনলাম! স্পষ্টভাবে বললেই পারতে! এই ভাবে বিড়বিড় করে বলার কী আছে?”
তরী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো, “কী শুনেছেন আপনি?”
“সবটাই! আমার ঘর বদলে তোমার তো কোনো সমস্যা থাকার কথা না! তোমার পড়াশোনায় যেন কোনো অসুবিধা না হয়, সেজন্যই আমি আলাদা ঘরে চলে গিয়েছি!”
তরী মুখ বাকিয়ে বললো, “কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন, আপনার রিসার্চের সুবিধার জন্য আপনি আলাদা ঘরে গিয়েছেন!”
সৌহার্দ্য স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো, “হ্যাঁ, ঘর আলাদা হলে দুজনের-ই সুবিধা হয়। তোমার পড়াশোনা, আর আমার রিসার্চ! সিম্পেল!”
তরী সৌহার্দ্যের দিকে কিছুক্ষণ রাগী চোখে তাকিয়ে থেকে বললো, “তাই না? তাহলে আমি না থাকলে তো আপনার আরও বেশী সুবিধা হয়! আপনার সব অসুবিধার কেন্দ্রবিন্দু-ই তাহলে আমি!”
সৌহার্দ্য হতভম্ব চাহনিতে তাকিয়ে বললো, “আমি সেটা কখন বললাম? আমি তো আমাদের…. ”
তরী সৌহার্দ্যকে থামিয়ে দিয়ে কর্কশ গলায় বললো, “অনেক হয়েছে! আমাকে বিয়ে করে যে আপনি মহাবিপদে পড়েছেন, তা আমি ভালো করেই জানি। সেজন্য আমি নিজেই এই বাড়ি থেকে চলে যাবো। আপনার তাহলে কোনো সমস্যা-ই থাকবে না।”
তরী সৌহার্দ্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে-ই গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা দিনদিন কেমন বউ-বউ আচরণ করতে করেছে! তবে তরীর এমন বদমেজাজি ও ঝগড়ুটে আচরণ সৌহার্দ্যের বেশ পছন্দ হয়েছে। মেয়েটার মুখে কথা ফুটেছে তাহলে! ভাবতেই মিটমিটিয়ে হেসে ফেললো সৌহার্দ্য।
একটা গোটা সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরও মুগ্ধর দেখা পেল না অরুণী। কয়েকবার ফোনেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছে সে। তবে তার ফোন বারবারই সুইচড-অফ শোনাচ্ছে। এদিকে ক্যাম্পাসে মুগ্ধকে একবারও দেখতে পায়নি অরুণী। কলেজে এলে ওকে দিনে তিন-চারবার নিজের আশেপাশে দেখতে পায় সে। কিন্তু সপ্তাহখানেক মুগ্ধর কোনো খোঁজ-খবর নেই।
চিন্তিত অরুণী মুগ্ধদের ব্যাচের অ্যাটেন্ডেন্স শিটও চেক করলো। মুগ্ধ প্রায় নয়দিন যাবৎ এবসেন্ট। ব্যাপারটা অতি আশ্চর্যজনক! মুগ্ধর বাবা নিয়মিতই তাদের ক্লাস নিচ্ছেন! তাহলে মুগ্ধ অনুপস্থিত কেন?
অরুণী বাধ্য হয়ে মুগ্ধর বন্ধু সায়েমের সাথে দেখা করলো। সায়েম বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেছে নিজের সামনে অরুণীকে দেখে। বিস্মিত কন্ঠে-ই প্রশ্ন করলো, “কলেজের অন্যতম সুন্দরী সিনিয়ার আপু আমাকে কীভাবে স্মরণ করলেন? কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি জানিয়ে আমাকে বাধিত করুন!”
অরুণী বিরক্ত হয়ে বললো, “চিপ ডায়লগস্!”
সায়েম অরুণীর কথা গায়ে না মেখে বললো, “আপনার মুখের গালিও আমার জন্য তালি!”
অরুণী রাগী চোখে তাকিয়ে বললো, “এই ধরনের কথা আরেকবার বললে গাল বরাবর ঠাটিয়ে দুটো তালি বাজিয়ে দিবো।”
অরুণীর রাগী আওয়াজে সায়েম কিছুটা চুপসে গিয়ে বললো, “আচ্ছা, আর বলবো না।”
“গুড! তা তুমি এখানে একা কেন? তোমার সঙ্গী কোথায় যার আগেপিছে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াও তুমি?”
সায়েম অবুঝের মতো তাকিয়ে বললো, “আপনি কি মুগ্ধর কথা জিজ্ঞেস করছেন?”
“জি।”
সায়েম অবাক হয়ে বললো, “সে কী! আপনি জানেন না? মুগ্ধর তো ডেঙ্গু হয়েছে! হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে তিন-চারদিন আগে। ওর অবস্থা খুবই খারাপ!”
অরুণী বজ্রাহতের মতো তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বিচলিত কন্ঠে বললো, “ডেঙ্গু! হসপিটাল! কোন হসপিটাল?”
“ডক্টর শাহরিয়ার স্যারের নিজের হসপিটালেই এডমিট করেছে। ওর অবস্থা……. ”
অরুণী সায়েমের কথা আর শুনলো না। ছুটে বেরিয়ে গেল কলেজ থেকে। তার দৌড়ের গতি যেন ক্রমশ বাড়ছে! দুরন্ত পদযুগল এতো দ্রুত চলছে যেন এই মুহুর্তে হসপিটালে পৌঁছাতে না পারলে তার পৃথিবী থেমে যাবে, আর সে হারিয়ে ফেলবে অমূল্য কোনো কিছু!
রাতের খাবারের সময়ও তরীকে দেখতে পেল না সৌহার্দ্য। মেয়েটা তাকে মারাত্মক প্রেশার দিচ্ছে। আর সুযোগ দেওয়া যাবে না ওকে। পরে দেখা যাবে কালই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে!
ডিনার শেষে সৌহার্দ্য নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তরীর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। তরী পড়ার টেবিলে বসে ঝিমোচ্ছিল। সৌহার্দ্যকে দরজার সামনে দেখে সে তড়িৎ গতিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বিস্মিত কন্ঠে বললো,
“আপনি? আপনি এখানে কী করছেন?”
সৌহার্দ্য ঘরের ভেতরে এসে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললো,
“আমি এই ঘরে শিফট হচ্ছি আবার। তোমায় আর সুযোগ দেওয়া যাবে না। চোখে চোখে রাখা লাগবে। নয়তো আবার গায়েব হয়ে যাবে। এমনিতেই মাথায় হলে ওঠার ভুত চেপেছে।”
তরী নিস্পৃহ গলায় বললো, “আপনার সুমতি হয়েছে দেখে ভালো লাগলো।”
প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৬(২)
সৌহার্দ্য সবকিছু গোছানো শেষে বললো, “আমার সুমতি হওয়া মানেই তোমার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া!”
তরী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “মানে?”
সৌহার্দ্য তরীর কানে ফিসফিসিয়ে বললো, “আ’ম গোয়িং টু ডু সামথিং টুনাইট!”