প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৮
Writer Mahfuza Akter
সৌহার্দ্য বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছে, হাতে মোটা একটা বই। চশমার আড়ালে থাকা তার অক্ষিদ্বয় আপাতত বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ। তরী সারা ঘরে পায়চারী করছে আর দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। ইদানীং এই বদঅভ্যেসটা তার হয়েছে। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর সৌহার্দ্য নাক কুঁচকে বলে উঠলো,
“তুমি নখ খাওয়া বন্ধ করবে? খিদে পেয়ে থাকলে খাবার খাও গিয়ে। ঘরে খাবারের অভাব নেই আমার!”
তরী বিরক্ত হয়ে বললো, “আপনার তো কোনো কিছুর-ই অভাব নেই! শুধু আমার জন্য সময়ের অভাব!”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে ফেললো। বই থেকে চোখ সরিয়ে তরীর দিকে তাকালো। তরীর কথার ইঙ্গিত বুঝেছে সে। তাই ভরাট গলায় বললো,
“বড্ড জ্বালাচ্ছো কিন্তু এবার! লাজলজ্জা সব ভুলেছো ভালো কথা! কিন্তু এতো ডেস্পারেট হওয়া ভালো না।”
সৌহার্দ্যের এহেন কথায় তরীর চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের গম্ভীর মুখটার দিকে। সৌহার্দ্যও তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছে। হুট করে তরী কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশে তাকাতে তাকাতে দরজার দিকে পা বাড়ালো। তবে সৌহার্দ্যের গম্ভীর আওয়াজ আবারও তাকে থামিয়ে দিলো,
“আমরা বিয়ে করেছি। তোমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে তোমার একজনকে প্রয়োজন ছিল, এটা সত্য। কিন্তু বিয়ে করে তোমায় আমি কোনো প্রকার অনুগ্রহ বা সাহায্য করিনি। বরং বিয়েটা আমি আমার নিজের জন্য করেছি। তোমায় বিয়ে করার পেছনে আমার নিজের স্বার্থ ছিলো।”
তরী অবাক গলায় প্রশ্ন করলো, “স্বার্থ? কিসের স্বার্থ?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
সৌহার্দ্য নিজের চোখ থেকে চশমা সরিয়ে শান্ত গলায় অকপট স্বীকারোক্তি দিলো, “বেঁচে থাকার স্বার্থ। তুমি আমার না হলে এখনও বেঁচে থাকতাম নাকি আমি? হয়তো দেহে প্রাণ থাকতো! তবে সেই প্রাণ থাকার চেয়ে মরণও ভালো। তুমি আমার আছো বলেই আমি ভালো আছি এখনও। নয়তো তোমার যখন অর্ণবের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল, আমার করুণ অবস্থা হয়ে গিয়েছিল তখন। তুমি যদি তখন আমায় দেখতে, মায়ায় পড়ে যেতে হয়তো!”
তরীর বিস্ময় ধীরে ধীরে লজ্জায় পরিণত হলো। সে কী বলবে ভেবে পেল না। সৌহার্দ্য এতো খোলামেলা স্বীকারোক্তি দিবে, এটা সে প্রত্যাশা করেনি। তরীর অপ্রস্তুত চাহনির দিকে তাকিয়ে হাসলো সৌহার্দ্য। ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
“হলে শিফট হওয়ার ভুত নেমেছে মাথা থেকে? নাকি আরো কিছু করতে হবে আমায়? তোমার পাগলামি সহ্য করছি কয়েকদিন ধরে। আমি পাগলামি শুরু করলে তুমি সহ্য করতে পারবে তো?”
তরী কিছু বলতে পারলো না। মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না। এরকম বাকরুদ্ধ সে জীবনে
কখনো হয়নি।
সৌহার্দ্যের ভয়ে তরী রাতটা মালিহার ঘরে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলো। রাতের খাবার কোনোমতে খেয়ে মালিহার ঘরে আসতেই দেখলো, মালিহা শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তরী মালিহার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
“আজ আমি তোমার সাথে ঘুমাবো, ছোট মা!”
মালিহা ঝাড়া দিয়ে তরীর হাত নিজের গলা থেকে ছাড়িয়ে বললো, “একদম না! সৌহার্দ্য যেহেতু তোর ঘরে আবার ফিরে গেছে, সেহেতু তুই ওর সাথেই থাকবি। ও ঘর আলাদা করেছে বলে এতো দিন কত কাহিনী করলি! আর আজ যখন ও নিজে থেকেই তোর কাছে গেছে, তুই পালাচ্ছিস?”
তরী অবাক গলায় বললো, “তার মানে তুমি আগে থেকে সব জানতে?”
” এতো দিন দেখেও না দেখার ভান করেছি। কারণ এটা তোদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এখন আর মুখ বন্ধ রাখতে পারছি না। তুই এই ঘরে থাকতে পারবি না। সোজা নিজের ঘরে যাবি।”
মালিহার রাগী চাহনি দেখে তরী ভয় পেয়ে গেল। যদি চড়/থাপ্পড় মেরে দেয়! তাই দ্রুত গতিতে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
তরী ঘরে ঢুকে দেখলো, সৌহার্দ্য বিছানার একপাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। তার ঘনঘন নিঃশ্বাসের শব্দে তরী নিশ্চিত হলো, সৌহার্দ্য গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে নিজেও আলো নিভিয়ে সৌহার্দ্যের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। তরীর ভাবভঙ্গি বুঝতে পেরে সৌহার্দ্য মিটমিট করে হেসে ফেললো চোখ বন্ধ রেখেই। তার দূরত্বে মেয়েটা কত কান্ড-ই না ঘটালো! এখন কাছে আসায় আবার ভয় পাচ্ছে। মেয়েটা যে কী চায়, নিজেও জানে না হয়তো!
অরুণী হসপিটালের করিডোরে বসে আছে। তার দু’টো জলে পরিপূর্ণ। অরুণী কোনোভাবেই নিজের কান্নাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তার সামনেই ড. শাহরিয়ার পায়চারী করছেন আর আড়চোখে অরুণীর দিকে তাকাচ্ছেন। মেয়েটা তাঁর ছেলের জন্য এভাবে কাঁদছে— ব্যাপারটা হজম করতে পারছেন না তিনি। অরুণী মুগ্ধর একবছরের সিনিয়র, তাদের মধ্যে কোনো বন্ধুত্বের সম্পর্ক তো হতে পারে না! তাহলে মেয়েটা এভাবে কাঁদছে কেন?
ড. শাহরিয়ার গলা ঝেড়ে বললেন, “অরুণী, তুমি বাসায় চলে যাও। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রহরের মা চলে আসবে।”
অরুণী চোখের পানি মোছার চেষ্টা করে বললো, “স্যার, আমি মুগ্ধর সাথে একবার কথা বলতে চাই। আই প্রমিস, আমি জাস্ট দুই মিনিট ওর সাথে কথা বলবো। আমি বলবো, আর ও শুনবে।”
ড. শাহরিয়ার হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “মুগ্ধ এখন কথা বলা বা শোনার মতো সিচুয়েশনে নেই। ওর প্লাটিলেট অনেক কমে গেছে, এখনও কমছে। ও বাঁচবে নাকি মরবে, তাও জানি না। ব্লাড দেওয়া হচ্ছে। তুমি দোয়া করো, ও যেন বেঁচে যায়!”
ড. শাহরিয়ার কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছেন না। পুরুষ মানুষের চোখে জল মানায় না— হয়তো এজন্য নিজের আবেগকে তিনি নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন! অরুণী কোনোমতে চোখের পানি মুছতে মুছতে দূর থেকেই মুগ্ধকে একবার দেখে এলোমেলো পায়ে হসপিটাল থেকে চলে গেল।
প্রহর নিজের বাহু চেপে মুগ্ধর কেবিন থেকে বের হতেই অরুণীর পৃষ্ঠদেশে দেখে ওকে চিনে ফেললো। অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, “অরুণী! ও এখানে কেন?”
ড. শাহরিয়ার শুনেও শুনলো না যেন! অধৈর্য্যের ন্যায় প্রহরকে জিজ্ঞেস করলো, “রক্ত দিয়েছো? ডক্টর কিছু বলেছে?”
“আরও রক্ত লাগবে। ওর অবস্থা জানার এতো ইচ্ছে থাকলে তুমি নিজেও তো ওকে একবার দেখে আসতে পারো!”
ড. শাহরিয়ার নিস্প্রভ গলায় বললেন, “নিজের ছেলের মৃত্যুর প্রহর নিজ হাতে পরখ করার সাহস পাচ্ছি না।”
অরুণী হসপিটালের বাইরে বাসস্ট্যান্ডে এসে বসেছে। জলসিক্ত চোখ থেকে অশ্রুধারা থামছেই না যেন! মুগ্ধর প্রতিটা স্মৃতি আজ একে একে মনে পড়ছে। নিজের প্রতি অবাক লাগছে তার। আজ সকালেও মুগ্ধ তার কাছে তেমন অসাধারণ কেউ ছিল না। কিন্তু সাধারণ কেউও তো ছিল না! সাধারণ কেউ হলে এক সপ্তাহ ধরে ওর অপেক্ষায় প্রহর গুনতো না অরুণী! তবে সে ভাবতেও পারেনি, মুগ্ধর প্রতি সে এতোটা দূর্বল হয়ে পড়বে! সবকিছু যেন মুহূর্তেই ওলট-পালট হয়ে গেছে। সৌহার্দ্যকে সে ভোলেনি। মুগ্ধ-ই তাকে শিখিয়েছিল, সৌহার্দ্য তার অপ্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তিকে ভুলতে নেই। এখন মুগ্ধ নিজেও কি অরুণীর জীবনের অপ্রাপ্তি হতে চলেছে? কিছু কিছু মানুষের জীবনে প্রাপ্তির ঝুড়ি হয়তো শূন্য-ই থাকে! অরুণীও তাদের মধ্যে একজন।
ভোরে পাখির কিচিরমিচির শব্দে তরীর ঘুম ভেঙে গেল। কপাল কুঁচকে ধীর গতিতে চোখ খুলতেই নিজেকে কোথাও আবদ্ধ মনে হলো। নড়াচড়ার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না। ভালোভাবে চোখ খুলতেই সে বুঝতে পারলো, সৌহার্দ্য তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে শুয়ে আছে।
প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৭
তরী কোনোমতে সৌহার্দ্যের বুক থেকে মাথা তুলে ওর মুখের দিকে তাকালো। মুহূর্তেই চোখ দু’টো বড়বড় হয়ে গেল তার। সৌহার্দ্য চোখ মেলে শুয়ে আছে। তার মানে, সে এতক্ষণ ঘুমায়নি। তরী নড়াচড়া বন্ধ করে ঘুমের ভান করে বন্ধ চোখে সৌহার্দ্যের বুকে আগের ন্যায় মুখ গুঁজে শুয়ে রইলো। সৌহার্দ্য ক্ষীণ স্বরে বললো,
“এক্টিং করে লাভ নেই। কাছে আসতে বাধ্য করে এখন আবার লজ্জা পাচ্ছো! লাভ নেই। সহ্য করতে হবেই।”
তরী ঘুমঘুম গলায় বলার চেষ্টা করলো, “আমি ঘুমোচ্ছি।”
সৌহার্দ্য তাকে নিজের সাথে আরো জড়িয়ে নিয়ে বললো, “গেট রেডি ফর আ ডিপ মর্নিং কিস!”