প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৯
Writer Mahfuza Akter
সৌহার্দ্যের কথায় তরীর শিরদাঁড়া দিয়ে যেন উষ্ণ স্রোতের প্রবাহ শুরু হলো। ভীত মুখে কপাল কুঁচকে বন্ধ চোখে শুয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কিন্তু সৌহার্দ্যের দিক থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না আসায় সে এক চোখ হালকা খুলে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্য ঘুমঘুম চোখে অদ্ভুত চাহনিতে তাকেই দেখছে। তরী হকচকিয়ে গিয়ে তৎক্ষনাৎ তার বুকে মুখ লুকালো। সৌহার্দ্য হালকা শব্দে হেসে উঠলো।
ঘড়িতে এলার্ম বাজছে। শোয়া থেকে উঠে বসে ঘড়ির এলার্ম বন্ধ করতে করতে সে বললো,
“বাসি মুখে চুমু খেলে তোমার বদহজম হতে পারে। ফার্স্ট কিসটা মিষ্টিমুখে করবো। তাই আপাতত পেন্ডিং রাখলাম।”
সৌহার্দ্য ওয়াশরুমে চলে গেল। ওয়াশরুমের দরজায় খট করে আওয়াজ শুনে তরী ঝটপট শোয়া থেকে উঠে বসলো। এই মুহুর্তে এই ঘর থেকে না পালালেই নয়!
সকালে জানালার ফাঁক গলিয়ে আসা এক ফালি রোদ ও ফোনের রিংটোন— দু’টোর একত্রে আগমনে অরুণী কপাল কুঁচকে ধীর গতিতে চোখ মেলে তাকালো। মেঝেতে এলোমেলোভাবে বসে খাটের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ায় এখন ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে। বিরক্তি নিয়ে ভালোভাবে মেঝেতে বসতে বসতেই ফোনটা কেটে গেল। অরুণীর রুমমেট নীলা বললো, “কে যেন কল দিচ্ছে তোমায়!!”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
অরুণী ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বললো, “ধরার আগেই তো কেটে গেল! প্রহর কল দিচ্ছিল মনে হয়!”
নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “কথা বলে কিছু খেয়ে নাও। কাল রাতটা তো কিছু না খেয়ে মেঝেতে বসে কাঁদতে কাঁদতেই কাটিয়ে দিয়েছো! চোখ মুখ ফুলে ভয়াবহ অবস্থা এখন তোমার!”
নীলার কথা অরুণীর কানে গেল কি না কে জানে! সে চিন্তিত ভঙ্গিতে ফোনে প্রহরকে কলব্যাক করায় ব্যস্ত। দু’বার রিং হতেই প্রহর রিসিভ করলো,
“সেই কখন থেকে কল দিচ্ছি। ফোন ধরছিস না কেন?”
অরুণী ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললো, “এতো সকালে কেন কল দিয়েছো? মুগ্ধ ঠিক আছে তো?”
প্রহর গম্ভীর গলায় বললো, “মুগ্ধর কথায় পরে আসছি। আগে তুই বল, তুই কাল হসপিটালে কেন এসেছিলি?”
“মুগ্ধ অসুস্থ শুনে দেখতে গিয়েছিলাম।”
“আচ্ছা? তো দেখতে এসে এতো কান্নাকাটি কেন করেছিস? আমার বাবা ব্যাপারটাকে একদম ভালো চোখে দেখছেন না। আর সত্যি বলতে, বিষয়টা আমারও তেমন পছন্দ হয়নি।”
অরুণী ভ্রু কুঁচকে বললো, “কেন পছন্দ হয়নি?”
“একটা মেয়ে আমার ভাইয়ের জন্য কান্নাকাটি করবে যে কি না আমার ভাইয়ের চেয়ে বয়সে বড়, আর তার সাথে আমার ভাইয়ের তেমন কোনো সম্পর্কও নেই। এটা আমার কিভাবে পছন্দ হবে? আমি অবাক হবো না?”
অরুণী বিরক্ত হয়ে বললো, “তুমি হয়তো ভুলে গেছো যে, তোমার ভাই আমাকে ভালোবাসে!”
“ও না-হয় তোকে আসলেই ভালোবাসে। তুই তো আর বাসিস না! তাহলে ওর জন্য…… ”
প্রহরের কথা শেষ হওয়ার আগেই অরুণী ফুঁসে উঠে বললো, “তোমাকে কে বলেছে যে, ওকে আমি ভালোবাসি না? আমি একবারও তোমাকে এরকম কিছু বলেছি?”
প্রহর অবাক গলায় বললো, “তার মানে তুইও ওকে ভালোবাসিস?”
অরুণী বিরক্ত হয়ে বললো, “আমি সেটাও বলিনি। তবে তোমাকে আমি এসব কেন বলবো? আমি যা বলার মুগ্ধকে বলবো।”
“এই! তুই না সৌহার্দ্যকে ভালোবাসতি? ওর জন্য কত বেহায়াপনা করতে দেখেছি তোকে? কতো পাগলামি করেছিস!”
অরুণীর বিরক্তির মাত্রা যেন আকাশ ছুঁতে চলেছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “তুমি আমাকে এটা বলো যে, মুগ্ধ এখন কেমন আছে?”
“কাল পর্যন্ত অবস্থা অনেক বেশি খারাপ ছিল। আজ ভোর থেকে ডক্টর বলছে যে, এখন আর ভয়ের কিছু নেই।”
অরুণী এবার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ওপাশে প্রহর তাকে একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছে। অরুণী কোনো পরোয়া না করেই কল কেটে দিলো। প্রহর হতভম্ব হয়ে বিড়বিড় করলো, “মানুষ এতো তাড়াতাড়ি একজনের প্রেমে কীভাবে পড়তে পারো? মিস্ট্রিয়াস!”
প্রতিদিনের মতো আজও সৌহার্দ্য সবার আগে নাস্তা শেষ করে ঘরে ঢুকে পড়েছে। খাবার টেবিলে মালিহা আর মধুর সাথে গল্প করতে করতে তরী সকালে সৌহার্দ্যের বলা কথা একেবারেই ভুলে গেল। খাওয়া শেষে মধু বললো,
“আমি আরেকটু ঘুমাবো এখন!”
তরী ভ্রু কুঁচকে বললো, “তুই আজকে ভার্সিটি যাবি না? ক্লাস নেই? ”
মধু মুখ বাকিয়ে বললো, “ভাইয়ার ঐ খাটাশ বন্ধুটার ক্লাস ছিল। কোনো কারণে ক্যান্সেল করেছেন। এই লোক বোধ হয় এই জীবনে প্রথম ক্লাস ক্যান্সেল করলেন!”
তরী বুঝতে না পেরে বললো, “খাটাশ বন্ধু? কার কথা বলছিস?”
মধু বিরক্ত হয়ে বললো, ” জনাব অভীক শাহরিয়ার ওরফে প্রহর!”
মধুর কথা বলার ভঙ্গি দেখে তরী আর মালিহা, দুজনেই হেসে ফেললো। তরী হাসতে হাসতে বললো, “আস্তে বল! তোর ভাই শুনলে পেটাবে তোকে।”
মালিহা হাসি থামিয়ে মধুর দিকে তাকিয়ে বললো, “প্রহর ছেলেটা কত ভালো! কত ভদ্র! তুই ওকে দেখতে পারিস না কেন?”
মধু মুখ বাকিয়ে বললো, “ভালো? ভদ্র? ওনার আসল রূপ তো দেখোনি! তাই এসব বলছো। এ্যাহ্! ভদ্র ছেলে! কচুর ভদ্রলোক!”
মধু বিড়বিড় করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেল। তরীও ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হতে নিজের ঘরে চলে এলো। বারান্দা থেকে সৌহার্দ্যের কন্ঠ ভেসে আসছে। তরী বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলো, সৌহার্দ্য কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। পরনে স্কাই ব্লু শার্ট ও ব্ল্যাক ডেনিম প্যান্ট দেখে তরী বুঝতে পারলো যে, সৌহার্দ্য হসপিটালে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেছে।
তরী নিজের জন্য একটা কালো থ্রিপিস বের করলো। থ্রিপিসের ওড়নাটা লাল রঙের। ওড়নাটা বিছানার ওপর রেখে তরী বাকি কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। ড্রেস চেঞ্জ করে বাইরে এসে দেখলো, সৌহার্দ্য এখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তরী কিছুটা বিরক্ত হলো। এতো কথা কার সাথে বলছে সকাল সকাল?
ভাবনাচিন্তা সাইডে রেখে তরী আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দেওয়া শেষে দরজায় তাকিয়ে দেখলো, সৌহার্দ্য বারান্দা থেকে ভেতরে আসছে। তরী সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করলো, “এতোক্ষণ কার সাথে কথা বলছিলেন?”
সৌহার্দ্য নিজের চোখ ফোনে নিবদ্ধ রেখেই তরীর পাশে আয়নার সামনে দাড়ালো। হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষে ফোনটা পকেটে রেখে আয়নায় তাকিয়ে নিজের চুল ঠিক করতে করতে বললো, “প্রহরের সাথে। মুগ্ধর ডেঙ্গু হয়েছে বলে বেশ চিন্তিত ছিল এতোদিন!”
তরী বিস্মিত চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো, “কীহ্!! মুগ্ধর ডেঙ্গু হয়েছে? এজন্যই হয়তো প্রহর ভাইয়া মধুদের ক্লাস ক্যান্সেল করেছেন বলছিল। এখন কেমন আছেন উনি?”
“হ্যাঁ, এখন অনেকটাই সু…….”
কথাটা বলতে বলতে তরীর দিকে তাকাতেই থেমে গেল সৌহার্দ্য। কপালে পড়লো গভীর ভাজ! কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বিরস মুখে বললো, “লিপস্টিক কেন লাগিয়েছো তুমি? তার ওপর লাল লিপস্টিক!”
তরী আয়নায় নিজেকে একবার পরখ করে বললো, “কেন? ভালো লাগছে না?”
সৌহার্দ্য অসন্তোষ নিয়ে বললো, “ড্রেসের সাথে একটু বেশি মানিয়ে গেছে! সবাই তোমার ঠোঁটের দিকেই তাকিয়ে থাকবে, এতো এবসার্ড লাগছে!”
তরী কিছুক্ষণ ঠোঁট উল্টে আয়নায় তাকিয়ে রইলো। গোমরা মুখে টিস্যু খুঁজতে খুঁজতে বললো, “মুছে ফেলি তাহলে! কিন্তু টিস্যুর বক্সটা কোথায় যে রেখেছি!”
তরী টিস্যু খোঁজায় ব্যস্ত। এদিকে সৌহার্দ্য অপলক দৃষ্টিতে তরীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা টিস্যু খোঁজায় ব্যর্থ হয়ে বারবার হয়ে ঠোঁট কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে ফোলাচ্ছে! সৌহার্দ্য হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কিন্তু রুদ্ধশ্বাসে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
এক পর্যায়ে তরী ব্যর্থ বদনে বললো, “টিস্যু খুঁজে পাচ্ছি না….”
সৌহার্দ্য ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো এবার। তরীকে সজোরে কাছে টেনে নিলো। এতোটাই কাছে যেন কোনো দূরত্ব অবশিষ্ট না থাকে। ধীর গলায় বললো, “আমিই মুছে দিচ্ছি।”
প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৮
এরপরের অঘটনের জন্য তরী একদমই প্রস্তুত ছিল না। হৃদকম্পন বেড়ে গেল তুমুল গতিতে। হৃদপিণ্ড যে বুক চি*রে বেরিয়েই আসবে। তরী বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ সৌহার্দ্যের বদ্ধ চোখের দিকে। এতো সুন্দর নেত্রপল্লবে আবৃত অক্ষিপট যেন সে কখনো দেখেনি। কিন্তু বেশিক্ষণ চোখ মেলে রাখা অসম্ভবপর মনে হচ্ছে। তার অধরযুগলে যেন ঝড় উঠেছে! শতসহস্র যুগের তৃষ্ণা নিবারনেও স্পর্শের প্রগারতা এতো গভীর হওয়ার কথা না। তরীর হঠাৎ মনে হলো, এতো দিন সে সৌহার্দ্যের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করে ঠিক করেনি। ভালো তো সেও বাসে! তাহলে এতো প্রহর দূরত্বে কেন কেটেছে? তরী এবার নিজের চোখদ্বয় বুজে ফেললো। নিজ উদ্যোগে দূরত্বের মাত্রা শূন্যতে আনল। কয়েক মুহূর্তেই সৌহার্দ্য দূরে সরে আসতে চাইলেও তরী ছাড়লো না। বরং সৌহার্দ্যের কলার চেপে ধরলো। সৌহার্দ্যকে হতবাক করে দিয়ে সে নিজেই অঘটন সৃষ্টিতে মগ্ন হলো।