প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪০

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪০
Writer Mahfuza Akter

সৌহার্দ্য হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তরীকে দেখছে। নিজের ওপর যতটা না অবাক হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি অবাক লাগছে তরীর কান্ড দেখার পর। তরী ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলে বসে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। সৌহার্দ্যের নজর এড়ানোর জন্য এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তবে এরই মধ্যে সৌহার্দ্যের দিকে যতবারই আড়চোখে দেখেছে, তার বিস্মিত অক্ষিগোলক তরীর অস্বস্তির কারণ হয়েছে। লোকটা ওভাবে দেখছে কেন? সে নিজেই তো শুরু করেছিল! শেষটা না-হয় তরীই করেছে! এখানে এতো অবাক হওয়ার কী আছে বুঝতে পারছে না তরী। দীর্ঘক্ষণ হাঁসফাঁস পরিস্থিতির সমাপ্তি ঘটাতে তরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো এবং ভরাট গলায় বললো,

“ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? নিজের ঠোঁট মুছুন! লিপস্টিকের স্টেইন লেগে আছে।”
সৌহার্দ্য তরীর কথা শুনেও শুনলো না। অবাক চাহনি ও বিস্ময়ভরা কন্ঠে বললো,
“আনবিলিভেবল, চাঁদ! ওয়্যারে’ন্ট ইউ টু মাচ প্যাশনেট এন্ড ডেস্পারেট?”
তরী বিরক্ত হলো। এটা জিজ্ঞেস করার মতো একটা প্রশ্ন হলো? বিছানা থেকে নিজের ওড়না নিতেই হঠাৎ মনে হলো, ওড়নাটার রঙ লাল। এটা দিয়ে লাল লিপস্টিক মোছা যেতেই পারে! সে সৌহার্দ্যের দিকে এগিয়ে ওর ঠোঁট নিজের ওড়না দিয়ে মুছে দিতে দিতে বললো, “এজন্যই ঘরে সবসময় টিস্যু রাখতে হয়!”
“ভাগ্যিস টিস্যু শেষ হয়ে গিয়েছে আজ!” বলেই সৌহার্দ্য ঠোঁট প্রসারিত করে ফেললো।
তরী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “ওভাবে হাসছেন কেন আপনি?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সৌহার্দ্য হাসতে হাসতেই বললো, “তোমার ঠোঁটের লিপস্টিক এখনো পুরোপুরি ওঠেনি দেখছি! তাই ভাবলাম……”
সৌহার্দ্য কাছে আসতেই তরী লাফিয়ে কয়েক ধাপ পিছিয়ে গিয়ে বললো, “একদম না! আমি নিজেই মুছে নিবো। আপনার জন্য আজ ক্লাসে যেতে লেইট হয়ে গেল আমার! ধুর!”
তরী নাক-মুখ কুঁচকে টেবিল থেকে ব্যাগ নিয়ে ওড়না দিয়ে নিজের ঠোঁট মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল। পেছনে তাকালে হয়তো দেখতো আর ভাবতো, “সৌহার্দ্য এতো সুন্দরভাবে হাসতে পারে? আগে জানতাম না তো!”

দুপুরের অন্তিম মুহূর্ত হওয়া সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের পথঘাট কুয়াশাঘেরা ও শিশিরসিক্ত। টানা ছয় ঘন্টার ক্লাস শেষে অর্ণব বাস স্টপে এসে দাঁড়ালো। রাস্তাঘাটে আজ তেমন মানুষ নেই। বেশি ঠান্ডা পড়লে তেমন কেউ দিনে ঘর থেকে বের হতে চায় না হয়তো! লং ওভার-কোটটা গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে পকেট থেকে ওয়ালেটটা বের করলো অর্ণব। উদ্দেশ্য হলো পকেটে কত টাকা আছে, তা দেখা। ক্যাশ কম হলে এটিএম বুথে যেতে হবে। যদিও এটিএম কার্ড আর ক্যাশ রাখা একই কথা, তবুও পকেটে পর্যাপ্ত ক্যাশ রাখার অভ্যাসটা হয়তো এ জীবনে যাবে না তার! ওয়ালেট খুলতেই একপাশে তরীর হাস্যোজ্জ্বল মুখটার দিকে নজর গেল তার। অর্ণব ছবিটার ওপর বৃদ্ধাঙ্গুলি বুলালো। এই মুখটা দেখলেই তার মন-প্রাণ প্রশান্তিতে ভরে যায়। মেয়েটাকে নিজের করে পেলে এই অনুভূতিটা কতটাই না স্বর্গীয় হতো! দীর্ঘশ্বাস ফেললো অর্ণব।

তরীর ছবির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে কখন যে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, অর্ণব টেরই পেল না। পাশে দাঁড়ানো নারীর স্বগোতক্তি শুনে চমকে উঠলো সে,
“ফোনের ওয়ালপেপার আর ওয়ালেটে তো মেয়েটাকে অনেক দেখলাম! নিজের বাসায়ও মেয়েটার ছবি টানিয়ে রেখেছো নাকি?”
অর্ণবের চমকে ওঠা চোখ দু’টো ছোট হয়ে এলো এই কথা শুনে, “তোমার এই হুটহাট কানের কাছে এসে কথা বলে ওঠার অভ্যাসটা কবে যাবে, অর্থী? ইউ নৌ ইট ইরিটেট’স মি!”
অর্থী নিজের বাদামী চুলগুলোয় আঙুল বুলাতে বুলাতে বললো, “বাট আই এনজয় ইট!”
“ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল!” অর্ণবের গলায় বিরক্তি।

অর্থী হেসে বললো, “আই নৌ! কিন্তু আমার কথার উত্তর তো দিলে না! মেয়েটার ছবি নিজের ঘরেও টানিয়েছো?”
অর্ণব কোনো উত্তর দিলো না। আলগোছে ওয়ালেটটা পকেটে পুরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সেই দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা হাহাকার বুঝতে বেগ পেতে হলো না অর্থীকে। সে বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বললো,
“তোমার এই দীর্ঘশ্বাস গুনতে গুনতে বুঝতে পারলাম, তুমি দিনে শ-খানেক বার দীর্ঘশ্বাস ফেলো৷”
অর্ণব আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “মেইবি! কখনো গুনে দেখিনি।”
অর্ণবের দীর্ঘশ্বাস দেখে অর্থী তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, “আই’ভ নেভার নেভার সিন সাচ আ লুজার লাইক ইউ, ড্যুড! গ্রো সাম শেইম!”

অর্থীর এসব খোঁচা-মারা কথা শুনতে শুনতে অর্ণব অভ্যস্ত। তরীর ব্যাপারে বিস্তারিত শোনার পর থেকে অর্থীর বক্রদৃষ্টি কম দেখেনি অর্ণব। বিগত একবছরের বেশি সময় ধরে অর্থীর এসব কথা হজম করে আসছে সে। তবুও এই ভিনদেশে অর্থীর মতো বন্ধুত্ব অন্য কারো সাথে তৈরি করতে সে পারেনি। অর্ণব হেসে বললো,
“প্রথম প্রথম তোমার কথা গায়ে লাগতো। এখন গায়ের চামড়া একটু মোটা হয়ে গেছে।”
অর্থী অর্ণবের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “তোমার গায়ের চামড়া আগে থেকেই মোটা। ইউ বিট্রেয়েড আ গার্ল! ভুলে গেছো নাকি? প্রতারকদের গায়ের চামড়া বেশ পুরু হয়! রিসার্চ করে দেখতে পারো।”
বাস চলে এসেছে। অর্থী দ্রুত পায়ে বাসে উঠলো। অর্থীর পেছনে পেছনে অর্ণবও উঠলো। একদম লাস্টের দিকে ফাঁকা দুইটি সিটে তারা দু’জন পাশাপাশি বসলো। অর্ণব হতাশ গলায় বললো, “থিসিস শেষে কি তুমি বাংলাদেশে যাবে এইবার? নাকি….. ”

“এখানে থাকার কোনো ইন্টেনশান তো নেই! দেশে যাবো। আমার স্কলারশিপ শুধু মাস্টার্স পর্যন্ত-ই ছিল। তুমি তো বোধ হয় পিএইচডি না করে এখান থেকে যাবে না!”
অর্ণব নিস্প্রভ গলায় বললো, “নাহ্! দেশে তো একবারের জন্য যেতেই হবে। ওকে একবার সামনাসামনি হাসিমুখে দেখার সাধ না মিটলে আমার এই দমবন্ধকর দিনাতিপাত শেষ হবে না। সারাজীবন দীর্ঘশ্বাস ফেলেই বাঁচতে হবে। আমি জাস্ট দেখতে চাই যে, ও সুখে আছে।”

অর্থী প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললো, “এই তোমাদের মতো ছেলেগুলোকে দেখলে আমার এতো রাগ হয়! মানে নিজে একটা মেয়ের জীবনের বারোটা বাজাবে, তার সুখের সব দরজা বন্ধ করবে; আবার মেয়েটার সুখের আশাও রাখবে! কেন? নিজের পাপের বোঝা কমানোর আশায়? সাচ্ আ উইয়ার্ড লজিক, ইজে’ন্ট ইট?”
অর্ণব মলিন হেসে বললো, “পাপের বোঝা তো হালকা হবে না! এটলিস্ট মনের বোঝা তো হালকা হবে!”
অর্থী নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, “কিয়ারার রিসেন্টলি ব্রেকাপ হয়েছে! নাও শি ইজ ডেটিং আ পাকিস্তানি গায়, যেন ওর মনের বোঝা হালকা হয়!”
অর্ণব সহাস্যে বললো, “তো আমিও মনের বোঝা হালকা করার জন্য এখন কাউকে ডেট করবো নাকি? আমার কোনো বিদেশি মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই! আর এই ইউনিভার্সিটিতে তুমি ছাড়া কোনো বাংলাদেশী মেয়ে নেই।”
অর্থী অর্ণবের দিকে তাকিয়ে ভরাট গলায় বললো, “দ্যান ডেট মি!”

সৌহার্দ্য হসপিটালে যাওয়ার আগে মুগ্ধকে দেখতে গেল। মুগ্ধর কেবিনের সামনে যেতেই প্রহরকে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো সে। বললো,
“এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সর! ভেতরে যেতে দে!”
প্রহর ওর পথরোধ করে বললো, “ভেতরে সিনেমা চলছে! এখন কারো প্রবেশ নিষেধ।”
সৌহার্দ্য অবাক হয়ে বললো, “সিনেমা?”
“হ্যাঁ, অরুণী এসেছে! দু’জনের ইমোশনাল আলাপ চলছে।”
প্রহরের কথা শুনে হেসে দিলো সৌহার্দ্য। বললো, “তাহলে মুগ্ধ এখন ভালোই আছে। অরুণী হঠাৎ….. ”
“হঠাৎ না! কালকেও এসেছিল। বাবার সামনে অনেক কান্নাকাটি করেছে। আজও সকালে ওর চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। চোখ ফুলে লাল হয়ে ছিল! ওকে দেখার পরে আমার প্রেম-ভালোবাসা থেকে মনই উঠে গেছে।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “কেন?”

“কারণ মেয়ে মানুষ অসংখ্যবার প্রেমে পড়ে। এইযে অরুণীকেই দেখ! গতবছর পর্যন্ত তোর পেছনে কত পাগলামি-ই না করলো! আর এখন আবার মুগ্ধ! হাও এবসার্ড!”
সৌহার্দ্য হেসে বললো, “মেয়েরা অসংখ্যবার প্রেমে পড়ে না, বন্ধু! তারা মাঝেমধ্যে ইম্যাচিউরের মতো আচরন করে। ভালো লাগাকে ভালোবাসা মনে করে মরীচিকার পেছনে ছোটে আর কষ্ট পায়। শুধু মেয়েরাই না, অনেক ছেলেরাও নিজেদের ফিলিংস এন্ড ইমোশন’স-এর মধ্যকার পার্থক্যটা বুঝতে পারে না। অরুণীর জন্য আমি একটা মোহ ছিলাম, যেটা মুগ্ধ ওকে বুঝতে শিখিয়েছে।

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৯

ওকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। মেয়েদের শেখানোর জন্যও যোগ্যতা লাগে, যেটা তোর নেই। খালি সারাজীবন নাকের ডগায় চশমা বসিয়ে পড়াকুর মতো পড়াশোনা-ই করে গেলি। তোর জীবনে প্রেম আসবে কী করে? আল্লাহ জানে, তোর মতো আনরোমান্টিক একটাছেলে কোন মেয়ের কপালে জুটবে। বেচারির জন্য আফসোস হচ্ছে। নিজের ছোট ভাইয়ের থেকে কিছু শিখতেও তো পারিস! ওর বছরখানেক সিনিয়র মেয়ে ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। আর তুই? নার্ড কোথাকার!”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪১