প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪৩

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪৩
Writer Mahfuza Akter

রাত একটা।
মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধতা যেন কুয়াশার মতো জমে উঠেছে ঘরের কোণায় কোণায়। ঘরের এক কোণে আলমারির দরজা খোলা। তরী তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে, বহুক্ষণ ধরে। মাথা নিচু, চোখে অদ্ভুত এক উদ্দীপনার ছায়া। যেন চুপিচুপি কোনো ষড়যন্ত্র চলছে তার ভেতরে।
আজ তার মাথায় ভূত চাপেছে—সে সাজবে!
হ্যাঁ, এই প্রথমবার কারও জন্য নিজেকে সাজাবে সে।
আর সে মানুষটি—সৌহার্দ্য। তরী জানে, সৌহার্দ্য সাধারণত লাইট কালারের শার্ট পরে। অন্য ছেলেদের মতো সে কখনো খুব একটা বাহারী পোশাক পরে না, অথচ তার ব্যক্তিত্বে একটা নিজস্ব গাম্ভীর্য আছে।

মালিহার কাছে একদিন কথা প্রসঙ্গে শুনেছিল—
ছোটবেলায় সৌহার্দ্য নাকি নীল শাড়ি পছন্দ করত।
নীল শাড়ি না পরলে মালিহাকে নাকি জ্বালাতো—একগাদা আবদার, প্রশংসা, আর হুটহাট জড়িয়ে ধরা।
তরী ভাবে—তাহলে কি নীল-ই সৌহার্দ্যের পছন্দের রং? তার মুখে অজান্তেই এক চিলতে হাসি খেলে যায়।
হঠাৎ মনে পড়ে যায়—তার তো নীল শাড়ি নেই!
একটা একটা করে শাড়িগুলো বের করে বিছানায় রাখে তরী। সবগুলোই নিজে কেনা। সৌহার্দ্য তো কখনো তাকে শাড়ি কিনে দেয়নি। তার চোখে খানিকটা হতাশা। নিজের সংগ্রহে নেই একটাও ঠিকঠাক নীল শাড়ি—যেটা পরে আজ সে সৌহার্দ্যর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে।
আলমারির ভিতরে হাত ঢুকিয়ে আবার খুঁজে দেখে।
সফেদ, হালকা গোলাপি, লাইল্যাক, বেবি পিচ—সবই আছে। কিন্তু একটাও নীল নেই। না রয়্যাল ব্লু, না টারকোয়াইজ, না বেবি ব্লু—কিছুই না!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হতাশ চোখে বিছানায় ছড়িয়ে রাখা শাড়ির দিকে তাকায় তরী। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে,
“এতসব রঙ থাকতে একটা নীল নেই! সেই মানুষটার পছন্দের রঙটাই আমার জীবনে অনুপস্থিত…”
তরী আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখে মনে হয়, তার মুখে এক অদ্ভুত আলো ফুটে উঠেছে—
যে আলো প্রেমের, প্রত্যাশার, আর নীরব প্রতিজ্ঞার।
আলমারির দরজাটা নিজের হাতে আবার ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয় তরী। নীল শাড়ি না পেলেও সে জানে—তার হৃদয়ের আবরণে আজ যে সাজ, তা কেবল সৌহার্দ্যর জন্যই।
রাত আড়াইটে।
সৌহার্দ্য ফিরেছে। হাঁটছে ধীর পায়ে, ক্লান্ত ও ভারাক্রান্ত দেহ নিয়ে। তার হাতের মুঠোয় বাঁধা সেই পুরনো, ডার্ক ব্রাউন লেদারের ব্যাগ—দিনের সব ক্লান্তি যেন সেই ব্যাগেই জমে আছে। কনুইয়ের কাছটায় একপাশে গুটিয়ে রাখা এপ্রোন ঝুলে পড়েছে নির্বিকারভাবে। চুলগুলো এলোমেলো, কপালে ঘামের রেখা শুকিয়ে গিয়ে জ্যামিতিক দাগ কেটে বসেছে , চোখের নিচে হালকা কালো ছাপ, আর মুখে এক গভীর অবসন্নতা—যেন শারীরিক ক্লান্তির চেয়েও ভেতরের ক্লান্তিটাই বেশি তীব্র।

সে ফোনে কথা বলছে। কানের সঙ্গে ফোনটা চেপে ধরে নিচু গলায় বলছে কোনো গম্ভীর আলোচনার কথা—ডাক্তারের সুরে নয়, যেন যুদ্ধফেরত এক সৈনিকের স্বরে।
শব্দগুলো নিঃসঙ্গ বাতাসে মিশে যাচ্ছে, আর সৌহার্দ্য তার চাবির গোছা ঘোরাতে ঘোরাতে নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘরের দরজাটা খোলে চেনা ছন্দে। হালকা এক ‘ক্লিক’ শব্দে খুলে গেল সে কক্ষ—যার প্রতিটা দেয়ালে লেগে থাকে তার ফেরার অপেক্ষা।
কিন্তু দরজা ঠেলেই সে হঠাৎ থমকে গেল। এক পা ভেতরে রাখারও সাহস হলো না তার। হাতের মুঠোয় দরজার হাতল ধরা, চোখ স্থির হয়ে গেছে ঘরের নির্দিষ্ট এক কোণে। তাঁর নিজের রুম, কিন্তু যেন আজ অচেনা, অন্যরকম।
আর সেই দৃশ্য…
তরী।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো আয়নার সামনে, অথবা স্রেফ নিজের অস্তিত্বকে নতুন করে সাজাতে চেয়েছিল।

এক মুহূর্তে সৌহার্দ্যর গলার নিচে কিছু একটা আটকে গেল। আলোয় ঝলমল তরীর চেহারায় আজ কিছু একটা আছে—যা আগে ছিল না। হয়তো অভিমান নেই, হয়তো আছে লজ্জা, অথবা অন্যরকম প্রস্তুতি, এক ধরণের নিঃশব্দ সৌন্দর্য তাকে একেবারে স্তব্ধ করে দেয়।
সৌহার্দ্য তার ক্লান্ত কাঁধটা আরও ভারী হয়ে আসতে টের পায়। এই মুহূর্তে তার আর ভেতরে ঢোকার সাহস নেই। হাতলটা শক্ত করে ধরে রাখে, যেন সেটুকুই তার একমাত্র ভরসা।
শ্বাসটা গভীর হয়ে আসে। চোখের কোণ দিয়ে ঝরে পড়তে চাওয়া ক্লান্তির ফোঁটা সে আটকায় না। হয়তো এই মেয়েটার কাছে তার কোনো হিসাব বাকি। হয়তো এই সাজ, এই অপেক্ষা, তার ভেতরকার সব প্রশ্নের জবাব চেয়ে বসে আছে।

কিন্তু আজ… আজ সে কিছু বলতে পারছে না।
সে দাঁড়িয়ে থাকে ঠিক সেখানেই—দরজার মুখে, এক অনুচ্চার দৃশ্যের সামনে। আর ঘরের ভেতর বাতাসে দুলে ওঠে তরীর চুলের ভাঁজ… ঠিক যেমন করে এক সময় নীল শাড়ির পাড় কাঁপতো শৈশবের সৌহার্দ্যর চোখে।
তবে আজ তরী নীল শাড়ি পরেনি। পরেছে সোনালি পাড়ের লাল সুতি শাড়ি—একটি সরল অথচ উজ্জ্বল ঘোষণা যেন। আঁচল মেঝে ছুঁয়ে আছে, রেশমি কাপড়ের প্রতিটা ভাঁজে ছড়িয়ে আছে নিজের মতো করে কারও জন্য সাজবার এক নিরীহ ইচ্ছা। চুলগুলো স্নানধোয়া, খোলা, কোমর ছাড়িয়ে হাঁটু ছোঁয়ার নিষ্ঠ চেষ্টায় ব্যস্ত।
সাজতে সাজতে কখন যেন শাড়িটা একপাশে সরে গিয়ে কোমরের একাংশ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সে খেয়াল করেনি। অথচ এই খেয়াল-না-রাখা সৌন্দর্যের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি প্রলোভন। চোখে মোটা করে টানা কাজল, ঠোঁটে নিঃশব্দ লিপ্সার ছোঁয়া। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকেই জিজ্ঞেস করছিল, “তুমি কি প্রস্তুত?”
ঠিক তখনই—দরজার ফাঁক দিয়ে একজোড়া চোখ তাকে দেখে থমকে গেল।
সৌহার্দ্য।

দরজার ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লান্ত, অবসন্ন, অথচ একঝলক হতভম্ব পুরুষটির চোখ আটকে গেল সেই দৃশ্যপটে—যেখানে নারীত্ব আত্মবিশ্বাসে দীপ্ত, সাজে কোমল, আর অভিপ্রায়ে বিপজ্জনক।
তরী মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। তার ঠোঁটে প্রশস্ত, স্পষ্ট এক হাসি। কণ্ঠে মিষ্টি ছলনা মেশানো আবদার—
“শাড়িটা কেমন হয়েছে বলুন তো?
আমায় মানিয়েছে?”

সৌহার্দ্য এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। সে তরীর ভাবসাব বেশ বুঝতে পারছে। মেয়েটা ইদানীং সর্বনাশ ডাকার পুরোদমে চেষ্টায় আছে। সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস নিয়ে একটানে ঘরের দরজা টেনে লাগিয়ে বাইরে চলে গেল। এই মুহুর্তে ভেতরে ঢুকলে বিধ্বংসী এক কান্ড ঘটবে যেটা সৌহার্দ্য চাইছে না। কিন্তু নিজের ভেতরের ঝড়কে সে কতদিন এভাবে দমিয়ে রাখবে জানা নেই।
সৌহার্দ্য ঠোঁট চেপে ধরল। একটা গভীর, হিমশীতল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর কোনো কিছু না বলে, একটানে ঘরের দরজাটা টেনে লাগিয়ে সরে গেল। না তাকিয়ে, না থেমে—চলে গেল পাশের রুমে। দরজা বন্ধ করার শব্দ যেন তরীর বুকের ভেতরেও একধরনের দরজা বন্ধ করে দিল।
তরী বিছানায় বসে রইল। রাগে, অভিমানে, বিষণ্ণতায়।
চোখে পানি নেই, কিন্তু গলায় কী যেন আটকে আছে।
একবার আয়নায় তাকাল— এই মুখটাই কি তাকে এতটা উপেক্ষা করার মতো হয়ে গেছে?
নিজেকে প্রশ্ন করল সে—

“আমি কি সত্যিই কিছুটা বেশি চেয়ে ফেলেছি? একটু প্রশংসা, একবার তাকানো… সেটুকু কি খুব বেশি?”
তার ভেতরের স্বর মুখ ফুঁড়ে বেরিয়ে এল,
“এই মুহূর্তে ওর মাথার সব চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে! আমি এত কষ্ট করে সেজেছি… আর লোকটা একটাও কথা না বলেই চলে গেল?”
বিছানার কোল চাপড়ে বসে পড়ে সে। আঁচলটা এলোমেলো হয়ে আছে, কিন্তু সে ঠিক করে না। নিজের সাজটা এখন হাস্যকর মনে হচ্ছে। যে সাজ কাউকে নাড়া দিতে পারল না— সে সাজ কি সাজই?
এক ফোঁটা দীর্ঘশ্বাস বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে এল।
চোখ বন্ধ করে বলল তরী— “সৌহার্দ্য… তুমি কি সত্যিই কিচ্ছু অনুভব করো না? নাকি আমার অনুভবই এত দুর্বল যে, সেটা তোমার মতো শক্ত মানুষের কাছে পৌঁছায় না?”

ঘরের বাতাস থমকে রইল। শাড়ির ছায়া মেঝেতে পড়ে রইল—যেন তার অপেক্ষা এখনো শেষ হয়নি।
সৌহার্দ্যের রাতটা কেটেছে সম্পূর্ণ নির্ঘুম। ক্লান্ত শরীর বিছানার সংস্পর্শ পায়নি একবারও, মন ছুটে বেড়িয়েছে অদ্ভুত এক দ্বন্দ্বের অলিন্দে। একদিকে তরীর অবিরাম ‘অত্যাচার’—তার সাজ, দৃষ্টিভঙ্গি, চুপিসারে উপস্থাপিত আবেগ— অন্যদিকে সৌহার্দ্যের নিজের ভিতরের যুদ্ধ।
ভোর ছয়টা।
বাইরের আকাশে সূর্যের লালচে ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে, আলো ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকছে জানালার ফাঁক গলে। সৌহার্দ্য নিরব পায়ে নিজের ঘরের দিকে এগোল।
আজ তাকে হাসপাতালে যেতে হবে, আর তার প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র রয়েছে এই ঘরেই—তরীর ঘরেই। চাই বা না-চাই, এ ঘরে ঢোকা ছাড়া উপায় নেই।

দরজাটা আলতো করে ঠেলে খুলতেই প্রথম চোখে পড়ল তরীকে। বিছানার এক কোণে, বেডের গায়ে হেলান দিয়ে মেঝেতে ঘুমিয়ে আছে সে। শাড়ির ভাঁজ এলোমেলো, আঁচল মেঝেতে গড়াচ্ছে। চুলগুলো খোলা, মুখের ওপর ছায়া ফেলে রেখেছে। কাজল লেপটে গেছে চোখের কিনারায়—ক্লান্তি আর কান্নার পরস্পর মিশ্র ছাপ যেন।
এই দৃশ্যটুকু সৌহার্দ্যর হৃদয়ে কেমন যেন নরম এক কাঁপন তুলল। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে তরীর সামনে বসে পড়ল। একটানা তাকিয়ে রইল তার দিকে। এই এলোমেলো অবস্থা, বিশৃঙ্খল সাজ—তবু মেয়েটাকে এতো সুন্দর লাগছে কেন?
সৌহার্দ্য আলতো করে তার কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিতে গিয়েছিল মাত্র— ঠিক তখনই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল। তরী হঠাৎই চোখ খুলে ফেলল।

রক্তিম চোখ, ঝাঁঝালো দৃষ্টি— সে চট করে সৌহার্দ্যের শার্টের কলার চেপে ধরল আর এমনভাবে টেনে নিল নিজের কাছে যেন বহুদিনের অভিমান ঝরে পড়ছে সেই টানটান বাঁধনে।
“কি ভেবেছেন আপনি? আমি ঘুমিয়ে পড়েছি বলে আপনি নিশ্চিন্ত? রাতভর ঘুমানোর মতো পরিস্থিতি আপনি রেখেছেন আমায়? আপনার জন্যই নিজেকে সাজালাম, আর আপনি কী করলেন? একবার তাকালেনও না, একটাও কথা বললেন না! আমায় উপেক্ষা করলেন, উপহাস করলেন—যেন আমি কিছুই না! আমি বুঝেছি, আপনার কাছে আমি আর আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ নই। ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে, তাই না?”
কণ্ঠ ফেটে যায়নি, কিন্তু ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। এই কথা বলেই সে ধাক্কা দিয়ে সৌহার্দ্যকে সরিয়ে দিল। এক মুহূর্ত দেরি না করে উঠে দাঁড়িয়ে সোজা ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল। পায়ের শব্দ যেন ভেঙে দিল সৌহার্দ্যের সমস্ত প্রতিরক্ষা প্রাচীর।

ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেল, সে কিছুই বলার সুযোগ পেল না। শুধু হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইল দরজার দিকটায়, যেখানে কিছু সেকেন্ড আগেও তরীর আগুনজ্বলন্ত চোখ তাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল।
সৌহার্দ্য জানে না—সে ঠিক কবে, কোন সময়ে তরীর মনে এতটা গভীর জায়গা করে নিয়েছে। তবে আজকের এই আচরণ তাকে বলে দিচ্ছে, সে জায়গাটা আর ছোট নেই। তরীর ভেতর সে এতটা ভর করে আছে যে, একটুখানি উদাসীনতা মানেই তার কাছে ধ্বংস। মেয়েটাকে আর দূরে রাখা সম্ভব নয়।
তাকে কাছে টেনে নেওয়া ছাড়া সৌহার্দ্যের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল এক অস্পষ্ট হাসি—ক্লান্ত, কিন্তু শান্ত। আলমারি খুলে একটানা গাঢ় কালো শার্ট আর হালকা ধূসর প্যান্ট টেনে বের করল। পাশের ঘরে গিয়ে নিঃশব্দে নিজেকে গুছিয়ে নিলো।
দশ মিনিট পর আবার ফিরল নিজের ঘরে— এপ্রোন আর ঘড়ি হাতে নিতে। কিন্তু দরজা খুলেই দেখলো তরী দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। আলতোভাবে চুল আঁচড়াচ্ছে, মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে—অমনোযোগী, উদাসীন, তবু তার শরীরজুড়ে এক অদ্ভুত তীব্রতা। তার গায়ে এখনো সেই লাল সুতি শাড়ি। এলোমেলো আঁচল, কাজল-লেপা চোখ, আর ঠোঁটে গভীর লিপস্টিক।

সৌহার্দ্য কণ্ঠ পরিষ্কার করে হালকা কাশল।
তরী চমকে তাকাল তার দিকে। তাকানোর পরেই আবার মুখ ফিরিয়ে নিলো—চোখে পরিষ্কার বিরক্তি, ঠোঁটে ক্ষীণ অনীহা।
সৌহার্দ্য নিজের হাসি চেপে রেখে গম্ভীর গলায় বলল, “তুমি তো আর ছোট নেই! তোমাকে এখন ‘চাঁদ’ বলে ডাকবো? নাকি ‘তরী’ই বললে চলে?”
তরী চোখ ছোট করে তাকিয়ে নাক ফুলিয়ে বলল,
“‘অরিত্রী আফনাদ’ বলে ডাকবেন!”

সৌহার্দ্য হেসে ফেলল—এই মেয়েটার যুক্তিহীন যুক্তিগুলো কখনো হাসায়, কখনো গলিয়ে দেয়।
“হোয়াট? তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি আমাকে ইদানীং খুব জ্বালাচ্ছো?”
তরী ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল। চোখে তীব্রতা, কিন্তু গলার সুরে একটুখানি কাঁপুনি।
“তাহলে… আপনি বিরক্ত আমার ওপর?
আপনি কি তাহলে চাইছেন…..”
কথাটা শেষ করার আগেই সৌহার্দ্য তার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। এক ধরণের গাঢ় দৃষ্টি, হালকা হেঁটে আসা—কিন্তু তার ভেতরে যেন আগুন ছড়িয়ে পড়ছে।
“তুমি আমাকে অনেক জ্বালিয়েছো, চাঁদ,”
সৌহার্দ্য শান্ত গলায় বলল।
“এখন তোমাকেও পুড়তে হবে।”

তরীর বুক কেঁপে উঠল। সে একপা পেছাল। তার কণ্ঠে এখন ভয় আর উত্তেজনার মিশেল—
“এইভাবে… এইভাবে এগোচ্ছেন কেন আপনি?”
সৌহার্দ্য উত্তর দিল না। শুধু এগিয়ে আসতে থাকল—ধীরে ধীরে, স্থির চোখে, গাঢ় অভিপ্রায়ে। তরীর পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেল। সে থমকে গেল একদম। শরীরের সমস্ত স্নায়ু যেন এক মুহূর্তে থেমে গেল।
সৌহার্দ্য দেয়ালে এক হাত রেখে তার দিকে ঝুঁকে তাকাল। চোখে ছিল গভীরতা, সংকল্প ও একধরনের আশ্বাস।
“আমি একজনকে কথা দিয়েছি, চাঁদ!তুমি আমার দিকে এক পা এগিয়ে এলে—আমি তোমার দিকে শত ধাপ এগিয়ে যাবো। সো… আই হ্যাভ নো আদার অপশন!”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪২

বলেই অন্য হাতে তরীর কোমর জড়িয়ে ধরল সে! আলতো, অথচ অনড়।
তরীর শরীর কেঁপে উঠল মুহূর্তেই। তার নিঃশ্বাস ধরা পড়ল, হৃদয়ের গতি যেন অনিয়মিত হয়ে গেল।
সৌহার্দ্য তার ঠোঁটের লিপস্টিক-রাঙা দাগ একবার স্পর্শ করল আঙুলের মাথায়। ধীরে মুছে দিলো সেই কৃত্রিমতা। তারপর গভীরভাবে তরীর চোখে তাকিয়ে বলল—
“আমি কোনো কৃত্রিম জিনিসের স্বাদ নিতে প্রস্তুত নই।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪৪