প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ১৫

প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ১৫
অনন্যা

-‘এটা আমার আরেক চাচাতো ভাই যার কথা তোকে কলে বলেছিলাম।রাহুল ভাইয়া ইনি।
রাহুল মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে বললো
-‘হাই…
কুহু এখনো তার দিকে অপলক নজরে তাকিয়ে।আহনাফ খেয়াল করলো ব্যাপারটা।কুহু রাহুলের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে তাকালো।কুহু বুঝতে পারলো না রেনান তার সাথে এমন অপরিচিতদের মত কেন কথা বলছে।আর রাহুল? রাহুল কে? এটা তো তার রেনান।তার! নাহ্ তার তো নয়।রেনানের করা কাজগুলো মনে পড়তেই কুহু নিজেকে আবেগি হওয়া থেকে আটকালো।রোদেলা বলে উঠলো

-‘বেবি, তোর চোখে পানি? কি হয়েছে?
কুহু অন্যদিকে ঘুরে গেল।চোখ মুছে বলতে লাগলো
-‘চোখে কিছু গিয়েছে বোধহয়….
আহনাফ বলে উঠলো
-‘কি হয়েছে দেখি!
সে কুহুর বাহু ধরতে নিলে কুহু ঝাটকা মেরে তার হাত সরালো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘কথায় কথায় গায়ে হাত দেন কেন?মেয়েদের গায়ে পড়েন কেন এতো?অভদ্রতামি না করলেই নয়! পরিবারের শিক্ষার অভাব! চলে যান আমার চোখে সামনে থেকে.. লজ্জা থাকলে আর কোনোদিন আসবেন না….
কুহু রাগান্বিত স্বরে বললো কথাগুলো।আহনাফ হতভম্ব হলো।সাথে রোদেলাও।কুহুর চেঁচানোতে অনেকের নজর এদিকে চলে এসেছে।এভাবে সবার সামনে কথাগুলো বলায় আহনাফ বিব্রত হলো অনেকটা।সে চলে গেল দ্রুত কদমে।আজ আর কিছু বললো না সে।রোদেলা পেছন থেকে ডাকলো—“আহনাফ ভাই..!” আহনাফ শুনলো না।রোদেলা জানে আহনাফের রাগ সম্পর্কে।সে কুহুর দিকে তাকিয়ে বললো

-‘কাজটা ঠিক করলি না বেবি…
কথাটা বলেই আহনাফের পেছন পেছন ছুটলো।কুহু দেখলো আহনাফের স্থানত্যাগ।কিন্তু সে তো আহনাফকে বলতে চায়নি কথাগুলো।সে তো…
কুহু তাকালো তার সামনে দাঁড়ানো যুবকটার দিকে।কুহু আর এক মুহূর্ত এখানে থাকবে না বলে ঠিক করলো।সে চলে যেতে নিলে হঠাৎ পেছন থেকে রাহুল ডেকে উঠলো—“বার্ড!”
কুহু থমকে গেল।চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো সে।গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল। রাহুল এগিয়ে গেল।
-‘আহনাফের সাথে রিলেশনে গিয়েছো?
কুহু হতভম্ব হয়ে তাকালো তার দিকে।রাহুল বললো

-‘এখনও আগেও মতোই আছো।ছিঁচকাদুনে!.. কান্না থামাও, বার্ড।
কুহু কঠোর স্বরে বলে উঠলো
-‘আমার একটা নাম আছে।সেটা বলে ডাকবেন।তানাহলে দরকার নেই ডাকার।সবাই একটা তামাশা পেয়েছে আরকি! যার যেটা খুশি সেটা বলে ডাকে…
রাহুল হাসলো।
-‘প্রশ্নের উত্তরটা পেলাম না।
কুহু বলে উঠলো
-‘আমার লাইফের পার্সোনাল বিষয় সেসব।আপনাকে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না মিস্টার রেনান ..ওহ সরি মিস্টার রাহুল শাহরিয়ার।
রাহুল হো হো করে হেসে উঠলো।এরপর বললো
-‘রেনান শাহরিয়ার রাহুল।দুটোই আমার নাম।
কুহুর একটুও ইচ্ছা করছে না এর সাথে কথা বলতে।এরমতো একটা অ/মানুষের সাথে কথা বলতে তার বিবেকে বাঁধছে।কুহু চলে যেতে নেয়।রাহুল বলে উঠলো

-‘পালিয়ে যেতে চাইছো?
কুহুর রাগ আকাশ ছুঁলো।ইচ্ছা তো করছে থু মেরে ছোটবেলার মতো দৌঁড় দিতে।সে তাকালো রাহুলের দিকে।রাহুল বললো
-‘কান্নাটা কি আমাকে দেখে করলে?
কুহু যেন নিজের রূপে ফিরে এলো।
-‘না..তোর নানিরে দেখে করছি, বাঙ্গির পোলা! একে তো ধোকা দিয়েছিস এখন আবার নাটক মারাস! এই তুই এখানে এসেছিস কেন?বিন বাজালো কে যে এখানে এসেছিস?ইচ্ছা তো করছে তোরে আমি..তোরে আমি…
কুহু আশেপাশে কিছু খুঁজতে লাগলো। দেখলো পাশেই একটা গাছের শুকনো ডাল পড়ে আছে।রাহুল চমকালো খানিকটা।মেয়েটার মুখের ভাষা তো কখনো এমন ছিল না।কুহু হঠাৎ ডালটা হাতে নিয়ে তেড়ে এলো রাহুলের দিকে।রাহুল সানগ্লাস খুলে”শিট্” বলে দৌঁড় লাগালো।কুহু শাড়ি পড়ায় দৌঁড়াতে পারলো না।লাঠিটা ওর দিকে ছুঁড়ে মারলো।
-‘শা/লা জানুয়ারি , বানিকচন্দ্রের সমন্ধী..!
ওখানকার মানুষজন হাসতে লাগলো ওদের দেখে।

-‘আহনাফ শান্ত হ….আহনাফ..
আহনাফ অনবরত দেয়ালে ঘুষি মেরেই চলেছে।হাত কেটে রক্ত পড়ছে তাও সে থামছে না।আদিত শেষে বাধ্য হয়ে নিজের হাত দিল।আহনাফের ঘুষিটা ওর হাতে লাগতেই ও চেঁচিয়ে উঠলো–“ও আল্লাহ!” আহনাফ থেমে গেল।জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে।চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করেছে ছেলেটার।আদিত একা সামলাতে পারছে না তাকে।আরিফকে সেই কখন আসতে বলছে শা/লা বোধহয় বউয়ের সাথে চিপকে রয়েছে।হঠাৎ তখন আরিফ এসে উপস্থিত হলো।আহনাফ লাথি দিয়ে একটা বেঞ্চ ফেলে দিল।আরিফ বলে উঠলো

-‘হুয়াটস্ রং, আহনাফ?
আহনাফ চেঁচিয়ে উঠলো
-‘আহনাফ শাহরিয়ার মেয়েদের গায়ে পড়ে কথা বলে! আহনাফ শাহরিয়ার মেয়েদের সাথে ঘেষাঘেষি করে!!! ওর সাহস কি করে হয় আমাকে এই কথাগুলো বলার!!
ওরা দুজন একে অপরের দিকে তাকালো।এরপর বলে উঠলো
“এই ঠাডা পড়া মিথ্যাটা কে কইলো ভাই?”
আহনাফের রাগে পুরো শরীর কাঁপছে।ইচ্ছা করছে কুহুকে চিবিয়ে খেতে।ঠিক তখন প্রবেশ করলো রোদেলা।মেয়েটা তখন ওর পেছন পেছন আসলেও হারিয়ে ফেলে।কি জানি কি করে! রোদেলা এসে বলতে লাগলো

-‘আহনাফ ভাই, ও বুঝে বলেনি।আপনি…
রোদেলা কিছু বলার আগেই আহনাফ চেঁচিয়ে উঠে
-‘তুই কি করছিস এখানে? ঢং দেখাতে এসেছিস? আদিত, বের কর এটাকে…গেট লস্ট…
রোদেলা কেঁপে উঠলো।আদিত বলে উঠলো
-‘বোন তুমি একটু প্লিজ….ওকে ঠাণ্ডা হতে দাও…
রোদেলা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল।কাজলকালো চোখদুটো টলমল করছে।আহনাফ ভাই এই প্রথম তাকে এমন ধমক দিল।কষ্টে মেয়েটার বুক ফেটে যাচ্ছে।কষ্টে ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ছুট লাগালো মেয়েটা।চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।হঠাৎ’ই কারো সাথে ধাক্কা লাগে তার।পড়ে যেতে নিলে তাকে ধরে ফেললো সে।যুবকটার একটা হাত রোদেলার কোমড় ছুঁয়েছে।রোদেলা চোখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে।পড়ে নাও যাওয়ার কারণ দেখতে চোখ মেলে তাকালো সে।
তাকাতেই হতবাক।রাফি! সেও ঠিক তার দিকেই তাকিয়ে।দুজন যেন দুজনকে আজ ভিন্নরূপে দেখে হতবাক।ঝগড়া কি করবে! দুজনের কারোর’ই যে নজর সরছে না।হঠাৎ তখন কেউ একজন এসে রোদেলার হাতের বাহু ধরে তাকে ঝাটকা মেরে ছাড়িয়ে নেয়।
দুজনে হুশে ফিরে আসে।রাহুল রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলো

-‘মেয়ে দেখলেই গায়ে ঢলে পড়তে ইচ্ছা হয়?ইউ..
রাফি বলে উঠলো
-‘আব্বে ওই! না জেনে শুনে কথা বলছেন যে! আমার তো ঠ্যাকা যে এই চোরনির সাথে ঘষাঘষি করবো!
রাহুল রেগে কিছু বলতে নিলে রোদেলা থামিয়ে দিল।
-‘ওনার দোষ নেই।বরং আমিই না দেখে…বাদ দিন।আই’ম সরি।
রাফি হা হয়ে গেল।চোরনি তাকে সরি বললো! রাহুল রাফিকে চোখ দিয়ে শাসালো।রাফি ভেঙালো তাকে।রাহুল হতবাক।এখানকার কারোর’ই কি কোনো মেনার্স নেই! জঘন্য! রাফির হঠাৎ মনে পড়লো সে তো বিস্কুট খাচ্ছিল।হায়হায়! বিস্কুট গেল কই? নিচে তাকাতেই দেখলো বিস্কুটের প্যাকেটটা পড়ে রয়েছে।বিস্কুটগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে।রাফি বলে উঠলো

-‘আমার বিস্কুট! এই চোরনি এই! আমার বিস্কুটের সাথে তোমার কিসের শত্রুতা বলোতো! অ্যা..অ্যা..আমার বিস্কুট…!
রাফি বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগলো।রাহুল বিরক্তমিশ্রিত নয়নে দেখছে তাকে।সে ধমক দিয়ে উঠলো
-‘এই ছেলে! সামান্য বিস্কুটের জন্য এমন করছো কেন?আর চোরনি মানে? যত্তসব বস্তির ছেলে!
রাফি চুপ হয়ে গেল।কথাটা গায়ে লেগেছে তার।বরং অনেকটাই লেগেছে।
-‘চুপ করবেন আপনি?
রোদেলার চেঁচানোতে থেমে গেল রাহুল।সে বললো

-‘আসুন আমি কিনে দিচ্ছি।
রাফি বলে উঠলো
-‘লাগবে না।ঐ টাকা দিয়ে আপনার বয়ফ্রেন্ডের মুখের ভাষাটা ঠিক করাবেন।
-‘বয়ফ্রেন্ড!
রোদেলা হতভম্ব হলো।এই লোক থার বয়ফ্রেন্ড হতে যাবে কেন?
-‘আমার বয়ফ্রেন্ড নয়।
-‘যাই’ই হোক।আপনার পরিচিত তো!
রাফি রাহুলের দিকে তাকালো।রাহুল কটকট করে তার দিকেই তাকিয়ে।সে হালকা হেসে চলে যেতে নেয় হঠাৎ থেমে গেল কি মনে করে যেন।পকেট থেকে একটা রোমাল বের করে রোদেলার হাতে গুজে দিয়ে বললো

-‘এই চোখদুটোতে তেজ মানায়, পানি নয়।
চলে গেল সে।রোদেলা তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার পানে।রাহুল রোদেলার হাত থেকে রোমালটা কেড়ে নিতে নিলে রোদেলা রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করলো।রাহুল বললো—“হুয়াট?” রোদেলা তার হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ঝাটকা মেরে ছাড়িয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো।আজকের দিনটাই ভালো না।হঠাৎ করে এখন রাফির জন্য খারাপ লাগছে তার।হাতের রোমালটার দিকে তাকালো সে।রাহুল পেছন থেকে ডাকছে তাকে।সে তা শোনার প্রয়োজন মনে করলো না।রাহুল দাঁত কিড়মিড় করলো তা দেখে।দুই দিকে ঘাড় বাঁকালো সে।

-‘স্যার, ম্যাডাম অনেক খুশি হবে আজ।কি বলেন?
সাখাওয়াত আলম হাসলেন।এরপর বললেন
-‘জুতো না মারলেই হয়!
হারুন রহমানের হাসি উবে গেল।এরপর বললেন
-‘এতোগুলো দিন পর দেখবে…অনেক খুশি হবে আপনি দেখবেন।
সাখাওয়াত আলম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।কথা বলতে বলতে গাড়িটা ভার্সিটির গেইট দিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে।সাথে সাথে চারদিকে হৈ হুল্লোড় পড়ে গেল।সাখাওয়াত আলম আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি।সাখাওয়াত আলমের গাড়িটা থামতেই প্রিন্সিপাল নিজে এলেন।ড্রাইভার বেরিয়ে দরজা খুললেন।আশেপাশে সাখাওয়াত আলমের গার্ড দিয়ে ঘেরা।বের হলেন তিনি।কিছু ছেলে-মেয়ে তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিল।সাখাওয়াত হাসি মুখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন।কিন্তু চেনা মুখটা দেখতে পাচ্ছেন না।মেয়েটা কি আসেনি তবে?

কিছু শিক্ষক মিলে তাকে স্টেজে নিয়ে গেল।তখন খোঁজ চলছে আহনাফের।তার’ই তো প্রধান অতিথিকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করার কথা।সে কোথায়? স্যার আহনাফকে খুঁজে আনতে বললেন।সাখাওয়াত আলম চাতক পাখির ন্যায় নিজের রাজকন্যাকে খুঁজছেন।হঠাৎ’ই তার নজর গিয়ে আটকালো ঠিক মাঝবরাবর জায়গাটাতে।ঐ তো! একটা চেয়ারে বসে রয়েছে।মেয়েটাকে অমন মন মরা লাগছে কেন?কপাল কুচকে এলো সাখাওয়াত আলমের।

-‘আহনাফ শান্ত হ, ভাই।
আহনাফ নিজের চুল খামছে ধরে মাথা নিচু করে বসে রইলো।হঠাৎ সে বড্ড আকুল স্বরে বলে উঠলো
-‘ও আমাকে কেন বুঝেনা? আর কি করলে ও আমাকে বুঝবে একটু বলতে পারবি?
নাতাশাও এসে পৌঁছিয়েছে।সে বললো
-‘কুহুর এমনটা করার পেছনে হয়তো কোনো কারণ আছে।তুই সেটা কেন ভাবছিস না, আহনাফ?
আহনাফ তাকালো নাতাশার দিকে।এরপর বললো
-‘কারণ? কি কারণ থাকতে পারে? আর আজকে ও আমাকে কি বলেছে জানিস?আমার নাকি পরিবারের শিক্ষার অভাব! আমি নাকি মেয়েদের গায়ে পড়ে কথা বলি! তাও আবার এতোগুলো মানুষের সামনে বলেছে।সবচেয়ে বড় কথা ঐ রাহুলের সামনে বলছে।
নাতাশা হতবাক।আরিফ বললো

-‘হেহে মাইয়া মানুষের জ্বালা এবার বুঝবা তুমি।
আহনাফ সরু চোখে তাকালো তার দিকে।আদিত বললো
-‘তোদের দেখে আমার আর প্রেম করার শখ নাই, মামা।
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।এই মেয়েটা কেন তাকে বুঝেনা?আর কত অপেক্ষা করাবে তাকে? আর কি করলে ও তাকে এক্সেপ্ট করবে? আহনাফ সেটাই করবে।আহনাফের বুকের বা পাশটা হঠাৎ কেমন চিনচিন করে ব্যথা করতে লাগলো।সে আর সইতে আর পারছে না।একটাবার…একটাবার যদি মেয়েটা তাকে বুঝতো, একটু জড়িয়ে ধরে ভালোবাসি বলতো…হাসলো আহনাফ।আদেও এমন দিন আসবে তো? তখন হঠাৎ কিছু ছেলে এসে বললো

-‘আহনাফ ভাই! আপনাকে ডাকছে।প্রধান অতিথি এসে গেছে তো।
আহনাফ ‘চ’ সূচক শব্দ করলো।গালি দিল দুইটা।এরপর উঠে দাঁড়ালো।বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে।পেছন পেছন আদিতরাও ছুটলো।
চারদিক মানুষে গমগম করছে।এতো মানুষ দেখে কুহু অনেকটা অস্বস্থি বোধ করছে।এতো মানুষ হবে জানলে সে আসতোই না।তার পাশে রোদেলা বসে।দুজনের মুখ’ই ভারি।আয়ান আর রাহুলের মাঝে ওরা দুজন বসে।পেছন থেকে হঠাৎ একজন বলে উঠলো
-‘আপু একটা সেলফি তুলতে পারি?
ওরা প্রত্যেকে পেছনে তাকালো।কালো রঙের শাড়ি পড়া একটা মেয়ে।মুখে অমায়িক হাসি।কুহু আশেপাশে দেখে বললো

-‘আমাকে বলছেন?
-‘জ্বী…আপনিই না ঐ এমপির টাকে জুতোর বারি দিয়েছিলেন! আপনি তো সেলিব্রেটি।তাই আরকি…
কুহু বড্ড বিরক্ত হলো।বারবার এই কথা শুনতে তার ভালো লাগছে না।এমপির মাথায় জুতোর বারি মানে! এটা মানুষের কাছে বিনোদন মনে হচ্ছে! আর সে কি ইচ্ছা করে মেরেছে! কুহু বললো
-‘ঐ এমপি আপনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে যে আপনি এতো খুশি তাকে মারায়?
-‘আরে না না আপু…আসলে আপনি তো এখন ভাইরাল তাই আরকি…আর এমপিকে মেরেছেন তাও জুতা দিয়ে এতো অনেক বড় কথা।এমপিটাও তো অনেক বড় হারামি!
কুহু চেতে গেল।সে বলে উঠলো
-‘মেরে না একদম পা/ছা ফাটিয়ে দিব।জুতা দিয়ে মারছি এটা বড় কথা! আমি অনুশোচনায় ভুগছি আর এদের কাছে বড় ব্যাপার! আর ঐ এমপি হারামি মানে? যদি কোনোদিন এই এমপিকে নিয়ে খারাপ কিছু বলেছেন তো দেখবেন!
কুহু আরোকিছু বলতে নিলে আয়ান আটকে দিল।মেয়েটা ভড়কে গিয়েছে।কুহুকে বকতে বকতে সে চলে গেল। রাহুল হতভম্ব নয়নে দেখছে কুহুকে। তার মুখে কালো রঙের একটা মাস্ক।মেয়েটা তো এমন ছিল না।কবে থেকে এরকম হয়ে গেল? ঠিক তখন স্টেজে কিছু এনাউসমেন্ট করা হলো।আহনাফকে ডাকা হচ্ছে প্রধান অতিথিকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়ার জন্য।আহনাফ উঠে গেল স্টেজে।মুখ যথেষ্ট গম্ভীর।সে ফুলের মালাটা নিয়ে সাখাওয়াত আলমের গলায় পড়িয়ে দিল।চারদিক করতালিতে ভরে গেল। সাখাওয়াত আলম হেসে হ্যান্ডসেক করলেন ওর সাথে। আহনাফের চোখ মুখ গম্ভীর। সাখাওয়াত আলম আস্তে করে বললেন

-‘গার্লফ্রেন্ড পেয়েছো নাকি শুনলাম!
মুখে তার অদ্ভুদ হাসি।আহনাফ রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করলো তার পানে।দাঁতে দাঁত পিষে বললো
-‘ওর দিকে তাকালে তোর চোখ উঠিয়ে ফেলবো আমি।
সাখাওয়াত আলম ক্ষুব্ধ হলেন তুইতুকারিতে।কিন্তু স্টেজে দেখে কিছু বললেন না।তবে চোখে চোখে অনেক কথাই হলো।কে বলেছে শুধু প্রেমিক-প্রেমিকারা চোখের ইশারায় কথা বলে! শত্রুপক্ষের সাথেও এভাবে কথা হয়।আহনাফ স্টেজ থেকে নেমে গেল।

কুহু দেখলো আহনাফকে।তখনকার কথা মনে পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল তার।কার রাগ কার উপর দেখিয়েছে সে! সরি বলা লাগবে।কিন্তু ছেলেটাও তো তার পিছু ছাড়ছে না।এমন খারাপ ব্যবহার করলে কি ছেড়ে দিবে? দরকার পড়লে কুহু তাই করবে কিন্তু একজনের জীবন সে নষ্ট করতে পারবে না।কুহু জঘন্য অতীত এখনো জানে না আহনাফ।যে অতীত মনে পড়লে কুহুর নিজের’ই নিজের উপর ঘৃণা হয় সেই অতীত আহনাফ কি করে মানবে! আর তার অতীতটা গোপন রাখা হলে আহনাফকে ঠকানো হবে।সে তা পারবে না।

কুহু তাকালো রাহুলের দিকে যে ফোনের দিকে তাকিয়ে।যাকে একটা সময় হৃদয়ের সবটাজুড়ে ভালোবেসেছিল আজ সে-ই তাকে কলঙ্কিনী নামে পরিচয় দিয়েছে।অথচ তার চোখে-মুখে আফসোসের কোনো ছিটেফোটাও নেই।কুহুর চোখদুটো ছলছল করে উঠলো।মুখ ফিরিয়ে নিল সে।হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিল। স্টেজের পাশে চোখ যেতেই থমকালো মেয়েটা।আহনাফ তার দিকেই তাকিয়ে।বড্ড ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে।কুহুর মাঝে মাঝে বড্ড খারাপ লাগে।সে অতো সুন্দর নয়।আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই সে।অথচ আহনাফ! অসম্ভব সুদর্শন সে।কুহুকে তারপাশে দাঁড়ালে মানাবেও না।তাও কেন ছেলেটা এতো পাগলামি করে কুহু ভেবে পায় না।অথচ রোদেলাকে দেখো! কত ফর্সা! কথ সুন্দর! আবার আহনাফকে ভালোওবাসে।অথচ ছেলেটা কুহুর পেছনেই পড়ে আছে।কুহু দৃষ্টি সরিয়ে নিল।

আহনাফের বুকে আজ বড্ড ব্যথা।তার তিলোত্তমা আজ তাকে অনেক কঠিন কথা শুনিয়েছে।আজ যদি মেয়েটা তার তিলোত্তমা না হতো তাহলে হয়তো সে এতক্ষণে সে কবরে থাকতো…তাচ্ছিল্য করে হাসলো আহনাফ।আকাশের পানে তাকালো।আকাশের পানে তাকিয়ে একটা প্রশ্ন ছুঁড়লো সে
“ভালোবাসায় এতোটা যন্ত্রণা কেন?”
কিছুক্ষণ বাদে স্টেজে তখন আহনাফের নাম ঘোষণা করা হলো। সবাই এক প্রকার ঝিমিয়ে গেছে।সাখাওয়াত আলমের কল এসেছে তাকে যেতে হবে তাড়াতাড়ি তাই সে পাঁচ-দশ মিনিটের মতো বক্তৃতা দিয়ে চলে যায়।এখন এদের একটু চাঙ্গা করা যাক। আহনাফের নাম বলতেই সবাই চেঁচিয়ে উঠলো।আয়ান বললো
-‘মিস্টার আহনাফ গানও গাইতে পারে! সেই কিন্তু…
রোদেলা উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে উঠলো
-‘আহনাফ ভাই গান গাইবে?ওয়াও…
রাহুল বললো

-‘এতে ওয়াও এর কি আছে? আমিও পারি গান।
রাহুলের কথা শুনে কুহুর হঠাৎ তিক্ত অতীতের কিছু মিষ্টি মুহূর্ত মনে পড়ে গেল।রাহুলের সাথে তার ফেইসবুকে পরিচয়।ওখান থেকেই প্রেম।তার বয়সটা ছিল’ই তখন আবেগের।ক্লাস নাইনে ছিল সে তখন।রাহুলের সাথে যখন রাতে কথা হতো তখন প্রায়’ই রাহুল তাকে গান শোনাতো।রাহুলের গলায় সবচেয়ে “তোমার জন্য” গানটা বেশি পছন্দ ছিল কুহুর।সেগুলো ভাবতেই কুহু তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠলো।
আহনাফ স্টেজে উঠতেই সবাই “আহনাফ ভাই..আহনাফ ভাই” বলে চেঁচাতে লাগলো।রোদেলাও বাদ গেল না।রাহুল বিরক্ত হলো।তাতে রোদেলার কি?সে চেঁচাচ্ছে। আহনাফের গলায় গিটার ঝোলানো।কুহু জানতো না যে আহনাফ গানও গাইতে পারে।চাচাতো ভাই হয় না এরা! কত মিল! ক্যারেক্টারটা না মিললেই ভালো।তখন হঠাৎ মিউজিকের সুর শোনা গেল।হৈচৈ বেড়ে গেল আরো।এতো মানুষের ভিড়ে আহনাফের নজর গিয়ে ঠিকই আটকেছে তার তিলোত্তমার দিকে।কুহু অপ্রস্তুত হলো তা দেখে।ভেসে এলো আহনাফের ব্যথাতুর সুর..

আমাকে কে নে তোর গানে, আর মনের দুনিয়ায়
নে আমাকে অকারণে, তোর শব্দ শুনি আয়।।
এঁকেছি এক সূর্য দেখ, যার উষ্ণতা দারুন
আমাকে নে সে বারণে আর তোর আবছায়া
(এই পর্যায় সবাই দাঁড়িয়ে পড়লো।রোদেলাও কুহুর হাত টেনে দাঁড় করিয়ে দিল।সবাই তালমিলিয়ে চেঁচিয়ে আহনাফের সাথে গাইছে।)
বরবাদ হয়েছি আমি তোর অপেক্ষায়
চুরমার করে দে আরোও কিছু ইশারায়
আমাকে থাকতে দে ,ডুবে থাকতে দে তোর নাম ধরে
আমাকে রাস্তা বল কোনো আস্তানার,কোনো বন্দরের
বলে দে…বল আমায়…(নিজ দায়িত্বে পুরোটা শুনে নিবেন)

প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ১৪

গানের প্রত্যেকটা লাইন যেন আহনাফ তাকে উদ্দেশ্য করেই গাইছে।এখনো সে তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।কুহুর ভেতরটা আজ এলোমেলো হলো যেন।হৃদয়স্থলে আজ কেমন অদ্ভুদ এক শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। তখনকার ঘটনার জন্য অনেকটা অনুতপ্ত বোধ করছে সে।আর কত উপেক্ষা করবে সে! তার ভেতর থেকে হঠাৎ বলে উঠলো…”সবাই খারাপ হয় না কুহু।আহনাফকে আর কত কষ্ট দিবি তুই!” কুহু তাকালো আহনাফের দিকে।এরপর কি মনে করে রোদেলার দিকে তাকালো।

প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ১৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here