প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ৩৬

প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ৩৬
অনন্যা

-‘আরিশ মরেছে আজ অনেক বছর।ওর কথাও সবাই ভুলে গেছে।হঠাৎ তুমি এমন উতলা হচ্ছো কেন বুঝলাম না আমি।
সাজ্জাদ শাহরিয়ারের কথা শুনে রাহুল বলে উঠলো
-‘না, না ও মরেনি।আই থিংক ও বেঁচে আছে।ড্যাড ও সামনে এলে আমি শেষ হয়ে যাব।সাথে তুমিও।
সাজ্জাদ শাহরিয়ার বড্ড বিরক্ত হলেন।
-‘আহনাফের যে ছোট ভাই ছিল এটাই তো অনেকে ভুলতে বসেছে।আর তুমি বলছো ও বেঁচে আছে!
রাহুল ঘেমে একাকার হয়ে গেছে।সে একটা শুকনো ঢোক গিলে অপরিচিত নম্বর থেকে আসা ম্যাসেজটা দেখালো।

-‘How are you, my dear Hul?
সাজ্জাদ শাহরিয়ার বললেন
-‘এর সাথে আরিশের বেঁচে থাকার কি সম্পর্ক?
রাহুল অস্থির স্বরে বললো
-‘হুল..ও আমাকে হুল বলতো।ভুলে গেলে?
সাজ্জাদ শাহরিয়ার ‘চ’ সূচক শব্দ করলেন।এতো পুরোনো ঘটনা কি মনে থাকে?তাছাড়া তার বয়স হচ্ছে।তিনি বললেন
-‘না মনে নেই।আর তুমি এসব ফালতু ম্যাসেজ দেখে এমন আজাইরা কথা বলো না।নিজেও পাগল আমাকেও পাগল বানাচ্ছো।
রাহুল সাজ্জাদ শাহরিয়ারের হাত ধরে বলে উঠলো
-‘ড্যাড, প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড..ব্যাপারটা হালকা ভাবে নিও না।
সাজ্জাদ শাহরিয়ার ছেলের অস্থিরতা দেখে বলে উঠলেন

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘আচ্ছা আমি দেখছি নম্বরটা দিয়ে কিছু বের করতে পারি কিনা।তুমি বিয়েতে ফোকাস করো।এসব আমি দেখছি।
রাহুল একটা শুকনো ঢোক গিললো।আরিশের মৃত্যুর ঘটনার জন্য আহনাফের সাথে তাদের সম্পর্কের এই অবস্থা আজ।আহনাফ আজও আরিশের মৃত্যুর জন্য তাদের সন্দেহ করে।আট বছরের ছোট্ট আরিশ রাহুলদের সাথে বিদেশ যাওয়ার বায়না ধরে।রাহুলও যেন উসকে দিয়েছিল আরো যাওয়ার জন্য।আহান শাহরিয়ার কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না তখন সাজ্জাদ শাহরিয়ার মানায় তাকে।মায়ের মৃত্যুর পর আরিশ আর আহনাফ দুজনেই কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল।ঘুরে আসলে ভালো লাগবে।আহনাফকেও যেতে বললো সাথে কিন্তু সে রাজি নয়। ভাইয়ের যাওয়ার বিষয়েও আহনাফের মত ছিল না।কিন্তু আহান শাহরিয়ার সাজ্জাদ শাহরিয়ারের কথাগুলো ভেবে দেখেছেন।সত্যিই মায়ের মৃত্যুর পর ছেলে দুটো কেমন হয়ে গেছে।তাই তিনি রাজি হন।আহনাফ না গেলেও আরিশ যায়।
কিন্তু ভাগ্যে বুঝি ভিন্ন কিছু লেখা ছিল। বিদেশের মাটিতে পা রাখতেই শুরু হয় ছোট্ট আরিশের উপর নির্যাতন।কথায় কথায় চড়-থাপ্পর..একবেলা খেলে দুইবেলা না খেতে পাওয়া।কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটা বলতো–“আমি আর বিদেশ আসবো না।” সাধ মিটিয়ে দিয়েছিল একদম।তবে একদিন ঘটলো সবচেয়ে জঘন্য ঘটনা।..ছেলেটাকে একদিন রাহুল রেগে গলা চেপে ধরলো তার একটা খেলনা নিয়ে নেওয়ায়।বেজায় খারাপ অবস্থা হয় সেদিন।আরিশ ছটফট করে কিন্তু সে ছাড়ে না।রাগের বসে মেরেই ফেললো।ছোট্ট প্রাণটা বুঝি উড়ে গেল।মায়ের কাছে সেও বুঝি শত অভিমান নিয়ে চলে গেল!

রাহুল তখনো বুঝতে পারলো না যে সে খুন করে ফেলেছে।পরে যখন সাজ্জাদ শাহরিয়ার দেখলেন আরিশ নিশ্বাস নিচ্ছে না তিনি খুব একটা ভাব-বেগ দেখালেন না।ছোট্ট ছেলেটার দেহ একটা জঙ্গলে ফেলে আসলেন।কোনো জন্তু-জা’নো’য়া’র ছিড়ে খাবে সেই আশায় রেখে এলেন।যেন আরিশের মৃত্যুর অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি।আনিসা বেগম অবশ্য কেঁদে ভাসিয়েছিলেন।সেটা কি আরিশের মৃত্যুর জন্য নাকি এই খবর কেউ জানলে ছেলের ভবিষ্যৎ খারাপ হয়ে যাবে এই ভয়ে?
বাসায় খবর দিয়ে জানানো হয় আরিশ একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে এবং তার দেহও আগুনে পুড়ে গেছে একদম।আহান শাহরিয়ার পাথর বনে গিয়েছিলেন।কান্না করেননি তিনি সেইদিন।গম্ভীর আহনাফ এরপর থেকে আরো গম্ভীর হয়ে যায়।তবে আজও কেউ জানে না আসল ঘটনা।আরিশের নামটাই যেন কোথায় একটা হারিয়ে গেছে।ভুলতে বসেছে সবাই শাহরিয়ার বাড়ির ছোট ছেলেটাকে।অথচ আজ এতগুলো বছর পর হঠাৎ এই ম্যাসেজ রাহুলের দিন-দুনিয়া উলোটপালোট করে ফেলেছে।সেও তো ভুলে গিয়েছিল সেই ঘটনা।বয়স’ই বা কত ছিল তার! রাহুলের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।

হাঁটতে হাঁটতে কখন যে রুমে এসে পড়েছে বুঝতেও পারলো না।হঠাৎ বিছানার উপর একটা শপিং ব্যাগ দেখে ভড়কে গেল।কে রাখলো এটা? রাহুল গিয়ে সেটা হাতে তুললো।ভেতরে একটা বক্স।রাহুল একটা শুকনো ঢোক গিলে বক্সটা খুলে।খুলতেই হঠাৎ একটা রক্তমাখা পুতুল উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে লাগলো।রাহুল ভয়ে দূরে ছুড়লো সেটা।কে পাঠালো এটা?ভেতরে একটা চিরকুট রাখা।রাহুল সেটা খুললো।
“একটা খেলনার জন্য প্রাণটাই কেড়ে নিয়েছিলি নি?তাই খেলনাটা পাঠালাম।পছন্দ হয়েছে তো?”
রাহুল ভয়ে কাঁপতে লাগলো।কে রাখলো এটা? সে আশেপাশে ঘুরে তাকায়।দরজার বাহিরে গিয়ে দেখে।কে রাখলো এটা?

স্নিগ্ধ এক উষ্ণ বিকেল।কুহু আহনাফের বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে রয়েছে।আহনাফ একটা অ্যালবাম করেছে।তাদের ফ্যামিলি ফটো সব আছে এতে।আহনাফের ছোটবেলার ছবিও আছে।সব একে একে দেখাচ্ছে আহনাফ।হঠাৎ একটা ছবিতে এসে আহনাফ থামে। তিনটা ছেলে দাঁড়িয়ে আর মাঝে একটা মেয়ে।দুজন সমবয়সী হলেও একজন তাদের থেকে ছোট।হাইট দেখে তাই বুঝা যাচ্ছে। কুহু বলে উঠলো
-‘ওয়াও! সুন্দর তো ছবিটা।এটা তো আপনি..আর এটা মেইবি রেনান।মাঝেরটা তো রোদ।কিন্তু এই ছেলেটা কে?
আহনাফের মুখ থমথমে।গম্ভীর স্বরে বললো
-‘আমার ভাই, আরিশ।
কুহু হকচকিত হলো।ভাই! সে বললো

-‘আপনার ভাই আছে? দেখলাম না তো তাকে।
আহনাফ হাসলো।নিঃশব্দে হাসলে বুক কাঁপে তার।কুহু বললো
-‘হাসছেন যে? কোথায় সে?
-‘সে আর নেই।
-‘মানে?
আহনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো
-‘আরিশ বেঁচে নেই।
কুহু চমকে গেল।
-‘হায় আল্লাহ! কি বলছেন?
-‘হুম।
কুহুর খারাপ লাগলো ভীষণ।আহনাফ বললো
-‘বাদ দাও।ওর দোষেই ও মরছে।আমার কথা শুনলে এমন হতো না।
-‘মানে?
-‘অন্য কোনোদিন বলবো।
কুহু কিছু বলে না।আহনাফ অ্যালবামটা বন্ধ করে পাশে রেখে দিল।এরপর কুহুকে ছাড়িয়ে সে নিজে ওর বুকে মাথা রেখে বললো

-‘ভাল্লাগছে না।একটু ভালো লাগিয়ে দাও।
কুহু প্রথমে একটু ঘাবড়ায়।পরে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে আহনাফের চুলে হাত বোলায়।আহনাফ বলে উঠলো
-‘ভালোবাসি।
-‘তুই একটা দেশি খাসি।
-‘অ্যাঁ!!
কুহু ফিক করে হেসে ফেলে।আহনাফ বলে উঠলো
-‘আমি খাসি?
-‘হ ভুটকা খাসি।
আহনাফ এবার চোখ বড় বড় করে ওর পানে তাকায়।
-‘ভুটকা!! তু’তুমি আমাকে মোটা বললে?
কুহু হাসছে।হেসেই চলেছে মেয়েটা।আহনাফ বললো
-‘আই’ম পারফেক্ট।অনলি সেভেনটি নাইন। হুহ!
কুহুর হাসি থেমে গেল।বিস্ময় হয়ে বললো
-‘সেভেনটি নাইন!!! আপনি দেখি ভুটকার ভুটকা মহা ভুটকা।
আহনাফ এবার উঠে বসে।
-‘হুয়াট!! আমার হাইট আর বডি দেখেছো তুমি? এটাই পারফেক্ট আমার জন্য।
কুহু বললো

-‘আবার বলে পারফেক্ট! এই হাতির মতো দেহটা নিয়ে ঘুরেন কেমনে?
আহনাফ ওর দিকে তাকালো।এরপর বললো
-‘তোমার ওজন কত?
কুহু এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল।খুকখুক করে কেঁশে বললো
-‘ইয়ে যাই হোক…তো কি যেন মানে…
আহনাফের ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেল।সে বললো
-‘আপনার ওজন কত, ম্যাডাম?
কুহু ইনোসেন্টের মতো করে তাকায়।মিনমিন করে বলে
-‘বাদ দিন।আমরা দুজনেই ভুটকা।
আহনাফ হো হো করে হাসতে লাগলো এটা শুনে।কুহু তা দেখে এক আঙুল দিয়ে চশমাটা নাকের ডগার উপরে তুলে বললো

-‘ক’কিন্তু আমার ওজন আপনার মতো ওতো না।ওতো মোটাও না আমি।মাত্র ফিফটি এইট’ই তো।
আহনাফ হাসতে হাসতেই ওর গাল দুটো টেনে বললো
-‘আমার রসগোল্লাটা…
কুহু নাকে ডগা ফুলিয়ে বললো
-‘মোটেও না…আই’ম পারফেক্ট।আর আমি এতেই সন্তুষ্ট।
আহনাফ ওর হাত টান মেরে বুকে ফেলে বললো
-‘আমি কি বলেছি আপনি মোটা? আল্লাহ আমার জন্যেই বানিয়েছেন আপনাকে।আমাকেও তো সামলাতে হবে তাই না?
শেষের লাইনটা ফিসফিস করে বললো আহনাফ।কুহু বলে উঠলো

-‘আপনি একটা বাঙ্গি।
আহনাফ তখন বলে উঠলো
-‘ভালো কথা…তুমি বাঙ্গি বাঙ্গি করো কেন এতো?বাঙ্গির উপর ক্ষেপলে কেন তুমি? বেচারা কি দোষ করেছে বলোতো? নাকি এটাও কোনো গালি?
কুহু কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেল।এরপর বললো
-‘তা না…বাঙ্গি গালি নয়।এমনিই বলি এটা।
-‘উঁহু, কোনো কারণ তো আছে।
কুহু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো
-‘আসলে আমি ছোটবেলায় বাঙ্গি শব্দটা বলতে পারতাম না।ব্যাঙ ব্যাঙ বলতাম।তো দাদি এক শপথ নেয় যে আমাকে দিয়ে সঠিক উচ্চারণটা করিয়েই ছাড়বে।এমন শেখান শেখালো যে এরপর থেকে কথায় কথায় বাঙ্গি বলতাম।অভ্যাস হয়ে গেছে আরকি।

-‘ওহ তাই বলো।
-‘হুম…একবার ক্লাসে ম্যাম জিজ্ঞাসা করেছিল যে বড় কি হবো..আমি বলছিলাম আপনার মতো বাঙ্গির টিচার হবো।ম্যাডাম মনে করছিল ওনাকে গালি দিছি।দাদিকে ডাকালো।কতকিছু যে বললো আমাকে! তারপর দাদি জানালো যে এটা আমার বদভ্যাস। ম্যাডামকে সরি বলতে বললো।আমি কি বলেছিলাম জানেন?
-‘কি?
-‘বাঙ্গি শব্দটা মুখ থেকে জোর করে আসতে চাইছিল কিন্তু আমি বলতে চাইছিলাম না।ক্ষমা করেন বলতে গিয়ে একসাথে বলে ফেলছি ক্ষাঙ্গি করেন ম্যাডাম।
-‘হুয়াট!!!
কুহু হেসে বললো
-‘আপনিও ভুল শুনছেন মেইবি।ম্যাডামও ঐটাই শুনছিল।তারপর কত কথা টথা বলে সব সামলালো দাদি।
আহনাফ হো হো করে হাসতে লাগলো এটা শুনে।কুহু বললো
-‘এখন অনেক ভালো হয়ে গেছি।
-‘আল্লাহ রে! আমার বউটা কি চিজ মাইরি!
কুহু হাসলো।আহনাফ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

-‘আহহা! এভাবে না…তুমি আমার গলাটা জড়িয়ে ধরবে।এই যে এইভাবে…
আয়ান নাতাশাকে তার দুই হাত নিজের গলায় জড়িয়ে ধরে উঁচু করে ফেললো।নাতাশা ভড়কে গেল।রাইফা হা করে তাকিয়ে আছে।সে মূলত এদের ফটোগ্রাফি করবে।সবাই এখন ছাদে এসেছে তাই। আয়ান বলে উঠলো
-‘আপু! তুমি নাতাশার পেছন থেকে ছবিটা তুলবে।আমার ফেইস দেখা যাবে কিন্তু নাতাশার ফেইস হাইড থাকবে।বুঝছো?
রাইফা হা করে থেকেই উপর নিচ মাথা নাড়লো।
-‘তো অপেক্ষা করছো কিসের জন্য? তুলো…
রাইফা মুখ বন্ধ করে ফোনটা ঠিক করে দাঁড়িয়ে, বসে বাঁকা হয়ে যেভাবে পারছে তুলছে।আয়ান এই ছবিগুলো ফেইসবুকে পোস্ট করবে কুহুকে জ্বালানোর জন্য।আয়ান দাঁত কেলিয়ে হাসছে।এমনভাব যেন বউকে সাথে নিয়ে ছবি তুলছে।নাতাশার পড়ণে শাড়ি।পিঠ অবধি চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া।বিকেলের উষ্ণ রোদ এসে আছড়ে পড়ছে মেয়েটার মুখে।আয়ান অনেক ভঙ্গিমাতে ছবি তুললো।এক পর্যায় নাতাশাকে কোলে তুলে নিল।এটা বোধহয় কেউ’ই আশা করেনি তারা।না নাতাশা আর না রাইফা।নাতাশা ভয়ে আয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে।রাইফা মুখ কুচকে তাকিয়ে।সে বলে উঠলো

-‘ভাই বলছিলাম যে বাসরটাও কি করে ফেলবি? কর সমস্যা নেই আমি ভিডিও করতেছি…..ওইটা ফেইসবুকে পোস্ট করিস।
আয়ান ‘চ’ সূচক শব্দ করলো।নাতাশা লজ্জায় আয়ানের বুকে মুখ লুকালো।আয়ান বললো
-‘ফালতু কথা বলো না তো…ছবি তুলো তুমি…
রাইফা মুখ কুচকে ছবি তুললো।আয়ান নাতাশাকে নামিয়ে দিয়ে ছবিগুলো দেখতে লাগলো।নাতাশা লাজুক হাসছে।আয়ান হঠাৎ তা খেয়াল করতেই একটু অপ্রস্তুত হলো।সে রাইফার থেকে ফোন নিয়ে বললো
-‘তোমার কাজ শেষ।তুমি নিচে যাও।
রাইফা দুই কাঁধ উঁচু করে বললো
-‘এমনিতেও চলেই যেতাম।
রাইফা চলে গেল।আয়ান নাতাশার দিকে তাকালো আড়চোখে।এরপর বললো
-‘ধন্যবাদ নাতাশা।বিপদে পাশে থাকার জন্য।তুমি সত্যিই আমার একজন ভালো বন্ধু।
নাতাশার মুখের হাসিটা মলিন হলো।আয়ান খেয়াল করলো তা।সে বললো
-‘তু’তুমি আবার সিরিয়াসলি তো নেওনি?
নাতাশা জোরপূর্বক হেসে দুইদিকে মাথা নাড়লো।আয়ান স্বস্থির শ্বাস ছাড়লো।নাতাশা মনে মনে বললো

“একদিন বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু হবো।ইটস্ মাই প্রমিস।”
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে অথচ রোদেলার খবর নেই।একবার কল করে শুধু বললো কোন এক পুরোনো বান্ধবীর বাসায় গেছে ভার্সিটি থেকে।রাহুল ঠিকানা বলতে বললে সেটাও বললো না।টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে এখন ছেলেটার।বাকিদের হেলদোল নেই অবশ্য।সবাই বিয়ের প্ল্যানিং এ ব্যস্ত।রাহুল নিজের কক্ষে অনবরত হেঁটে চলেছে।একবার জানালা দিয়ে বাহিরে উঁকি দিয়ে দেখছে যে এসেছে কিনা।বাড়ির গাড়িটাও তো নেয়নি।ড্রাইভার বললো আহনাফের ওখানে গেছে অথচ রোদেলা বলছে বান্ধবীর ওখানে।মাথা কাজ করছে না রাহুলের।হঠাৎ গাড়ির শব্দ কানে আসতেই তড়িঘড়ি করে জানালার কাছে গিয়ে বাহিরে তাকায় সে।গাড়ি থেকে আহান শাহরিয়ার নেমে এলেন।অপর দরজা খুলে রোদেলা নেমে এলো।রাহুল কপাল কুচকায়।সে আর সময় অপকয় না করে নিচে গেল।

রোদেলা আর আহান শাহরিয়ার দরজা দিয়ে ঢুকেছে মাত্র।রাহুল রাগি রাগি চোখে রোদেলার দিকে তাকিয়ে।রোদেলা আহান শাহরিয়ারের সাথে কথা বলতে বলতে আসছে।অখিল শাহরিয়ার উঠে ভাইয়ের সাথে আলিঙ্গন করলেন।সাজ্জাদ শাহরিয়ারও এগিয়ে গেলেন।আহান শাহরিয়ার সোফাতে এসে বসলেন।জেরিন বেগম আর আনিসা বেগম রান্নাঘরে ছুটলেন।রোদেলা সিড়ির কাছে এসে উপরে উঠতে যাবে রাহুল ওর হাত চেপে ধরলো।রোদেলা আর্তনাদ করে উঠলো জোরে ধরায়।আহান শাহরিয়ার বলে উঠলেন

-‘কি হলো মা?
রোদেলা বলে উঠলো
-‘রাহুল ভাইয়া মারছে আমাকে।
সবাই ঘুরে তাকালো তাদের দিকে।রাহুল ভড়কে গেল।
-‘কিসব বলছো?
সাজ্জাদ শাহরিয়ার লোক দেখানো ধমক দিলেন
-‘এই বেয়াদব! সাহস কত বড় তোমার হ্যাঁ! আমাদের সামনে আমাদের মেয়েকে মারো!
রান্নাঘর থেকে আনিসা বেগম বললেন
-‘চাপকে পিঠের ছাল তুলে দিব।
রাহুল বলে উঠলো

-‘আরে! আমি মারলাম কখন?
সে রোদেলা দিকে তাকালো তীক্ষ্ণ নয়নে।রোদেলা বললো
-‘আবার ভয় দেখাচ্ছে আমাকে…
রাহুল ওর হাত ছেড়ে দিয়ে হতাশার শ্বাস ছাড়লো।সবার কাছে আরো একবার ঝাড়ি শুনলো রাহুল।চোখ দিয়ে রোদেলাকে বুঝালো
“পরে দেখে নিব তোমাকে।”
রোদেলা ওকে ব্যাঙ্গ করে উপরে যেতে নিলে রাহুল বললো
-‘বাড়িতে ফিরতে এত দেরি হলো কেন?
রোদেলা আহান শাহরিয়ারের দিকে তাকালো।এরপর বললো
-‘বলেছিলাম তো বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছি।
-‘এতক্ষণ কি করলে বান্ধবীর বাসায়?
-‘নোট নিচ্ছিলাম।
রাহুল বলে উঠলো

-‘ড্রাইভার চাচা যে বললো তুমি নাকি আহনাফের ফ্ল্যাটে যাচ্ছো..
রোদেলা একটা শুকনো ঢোক গিললো।বললো
-‘গিয়েছিলাম তো…ভেবেছিলাম কুহু যাবে বোধহয় ভার্সিটি।কিন্তু পরে একাই যাই।আর সেখান থেকেই…
আহান শাহরিয়ার বলে উঠলেন
-‘আহা থাক না! এমন তো না একা বাড়ি ফিরেছে।বুদ্ধিমতির মতো আমাকে কল করে নিয়ে আসতে বলেছিল।বাদ দাও এখন।
রাহুল কিছুক্ষণ সন্দেহের চোখে চেয়ে রইলো রোদেলার দিকে।রোদেলা ওর চোখের দিকেই তাকিয়ে অথচ ভেতরটা ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে।রাহুল ওর থেকে নজর সরিয়ে সোফার দিকে যেতে যেতে কঠোর স্বরে বললো
-‘আর যেন এমন না হয়।এটাই লাস্ট।
রোদেলা কিছু না বলেই উপরে চলে গেল।রাহুল ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো।

-‘নওশাদ পাগল হয়ে গেছো তুমি!! দয়া করে মেয়ের জীবনটা নষ্ট করো না এভাবে।আমি তোমার পায়ে ধরছি…
নিধির মা নম্রতা বেগম স্বামীর পা’ই জড়িয়ে ধরলেন।নওশাদ আহমেদ রেগে বলে উঠলেন
-‘পা ছাড়ো নম্রতা….আমার কাজে একদম বাঁধা দিতে আসবে না।ছাড়ো…
নম্রতা বেগম ছাড়লেন না।কেঁদে বলে উঠলেন
-‘মেয়েটাকে তো ত্যাজ্য করেই দিয়েছো তাহলে কেন এমন করছো? ও থাক না ওর মতো।ছেলেটাকে মেরো না দহাই লাগে..

-‘আমি আবার বলছি আমার কাজে বাঁধা দিতে এসো না তুমি।
নম্রতা বেগম হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন।বলে উঠলেন
-‘আমি কিছুতেই আমার মেয়ের এতো বড় ক্ষতি হতে দিব না।আ’আমি পুলিশে কল করবো।
নম্রতা বেগম যেতে নিলে নওশাদ আহমেদ তার চুলের মুঠি ধরে ফেললেন।আর্তনাদ করে উঠলেন নম্রতা বেগম। রাগে গজগজ করতে করতে নওশাদ বললেন
-‘কি বললি তুই? পুলিশে কল করবি?আমি যে কত বড় অমানুষ সেটা তোর জানা নেই? আমার কাজে বাঁধা দিতে আসলে তোকেও আমি খুন করে ফেলতে পারি।
-‘নওশাদ!
নওশাদ আহমেদ বললেন
-‘ঐ ছেলেকে আজ’ই মেরে দিব আমি।মেরে ঐ কুলাঙ্গার মেয়েটাকে নিয়ে আসবো।শাহীন বলেছে যে ওর ছেলে এখনো রাজি নিধিকে বিয়ে করতে।নিধিকে দিতে পারলে আবার আমার আমার সাথে পার্টনারসিপ করবে সে।কতগুলো টাকা আসবে বুঝতে পারছিস তুই?
-‘তুমি টাকার জন্য মেয়ের জীবনটা নষ্ট করে ফেলবে! এতোটা নিচে নেমো না নওশাদ।
নওশাদ আহমেদ বললেন

-‘কি করবি নামলে? পুলিশে খবর দিবি? বেঁচে থাকতে পারবি?
নম্রতা বেগমকে জোরে ধাক্কা মারলেন তিনি।নম্রতার মাথাটা টেবিলের কোণার সাথে লেগে কেটে গেল।আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি।নওশাদ আহমেদ রিভালবার গুজে বের হতে নিলে নম্রতা আবার তার পা ধরে।
-‘এমন করো না…মেয়েরটার এত বড় সর্বনাশ করো না..
-‘পা ছাড়..ছাড়..
ধাক্কা মারলেন নওশাদ আহমেদ।তিনি বেরিয়ে যেতে নিলে নম্রতা বেগম দ্রুত উঠে ফোন হাতে নিয়ে পুলিশ স্টেশনে কল করলো।কিছু বলতে নিবে তার আগেই তার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলেন নওশাদ।কল কেটে তার চুলের মুঠি ধরে গালে এলোপাথারি থাপ্পর বসালেন।বিশ্রি ভাষায় গালি দিতে লাগলেন।

-‘তোর এত বড় সাহস তুই পুলিশ স্টেশনে কল করিস!
নওশাদ তার ঘাড় ধরে দেয়ালে জোরে জোরে মাথা ঠুকাতে লাগলেন।বাহির থেকে বারো বছরের ছোট্ট হৃদি তা দেখে ভয়ে কুকড়ে গেল।বাবা-মায়ের এই ঝগড়া সে আগেও দেখেছে কিন্তু তখন তো বড় বোন নিধি ছিল তার সাথে।আজ কেউ নেই।মেয়েটা মাকে এমন মারতে দেখে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।নওশাদ আহমেদ থেমে গেলেন।পেছন ফিরে মেয়ের দিকে তাকালেন।নম্রতা বেগমের মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে।নওশাদ হৃদির দিকে তাকিয়ে জোরে বলে উঠলেন
-‘হৃদি ঘরে যাও…ঘরে যাও..
ধমকে মেয়েটা আর জোরে কাঁদতে লাগলো।বাবাকে সে আগে থেকেই ভয় পায় আজ এই রূপ দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগলো।দৌঁড়ে রুমে চলে গেল।নওশাদ আহমেদ নম্রতা বেগমের গাল চেপে ধরে বললেন
-‘খুব শখ না স্বামীকে পুলিশে দেওয়ার! আজ তোর শখ মেটাবো আমি।
নওশাদ আহমেদ আরেকবার তার মাথাটা দেয়ালে বারি মারলেন।নম্রতা বেগম আর্তনাদ করে উঠলেন।নওশাদ ড্রয়ার থেকে ছুড়ি বের করলেন।বাঁকা হাসলেন।
এদিকে ছোট্ট হৃদি তার কাছে থাকা বাটন ফোনটা দিয়ে বোনকে কল করলো।এটা নিধি দিয়েছিল তাকে বাড়ির সবার খবর জানতেই বোনকে এই ফোনটা দেয় সে।মাঝে মাঝে কথা বলে তারা।হৃদি হেচকি তুলে কাঁদছে।

নিধি রান্নাঘরে সবার জন্য চা বানাচ্ছিল।শ্বশুর-শ্বাশুড়ি তার বড্ড ভালো।এই যে এখন চা বানাবে সেটাও জোর করেই।তাকে রান্নাঘরে কিছুতেই আসতে দিতে চায় না।হয়তো ভয় পায় যে যদি রান্না করতে গিয়ে সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে যায়! বড়লোকের মেয়ে রান্না না পারার’ই কথা।নিধি জোর করে চা বানাতে আসলো তাই।মাঝেমাঝে চা বানিয়ে খাওয়ায় সে।সবাই খুব প্রশংসা করে তখন।আরিফ হঠাৎ হাজির হলো নিধির ফোন নিয়ে।
-‘জান, আমার শালী কল করেছে।কথা বলো..

নিধি কপাল কুচকায় ।এখন আবার কেন কল করলো?নিধি ফোনটা নিয়ে রিসিভ করবে অমন সময় আরিফ এদিক ওদিক দেখে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।নিধি কেঁপে উঠলো।
-‘কি করছো? ছাড়ো তো! কেউ এসে পড়বে..
-‘আসুক..তুমি কথা বলো না! আমাকে আমার কাজ করতে দাও।
নিধি কিছু বললো না আর।কল রিসিভ করলো।
-‘হ্যালো হৃ..কি হয়েছে বনু? কাঁদছিস কেন? হ্যালো! হৃদি!
হৃদিতা হেচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বললো

-‘মা..বাবা..মাকে..
-‘কি হয়েছে বাবা-মায়ের?
আরিফ হকচকিত হলো যেন।নিধিকে ছেড়ে দিয়ে বললো
-‘এনিথিং রং?
নিধি ওকে হাত দিয়ে চুপ থাকতে বললো।
-‘কি হয়েছে বল না সোনা? বাবা-মা আবার ঝগড়া করছে?
হৃদি কাঁদতে কাঁদতে বললো
-‘বাবা মাকে মারছে..
নিধি থমকে গেল কিছুক্ষণের জন্য।বলে উঠলো

-‘আ’আমি আসছি।তুই ভয় পাস না।আসছি আমি…
হঠাৎ ফোনের ওপাশ থেকে একটা চিৎকার ভেসে এলো।চিৎকারটা তার মায়ের।নিধির পুরো শরীর জমে গেল।হৃদি চিৎকার করে কাঁদছে।
-‘ভ’ভয় পাস না বোন আসছে..আসছি আমি..

প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ৩৫

-‘কি হয়েছে?
নিধি কল কেটে বললো
-‘দ্রুত বাইক বের করো।পরে বলছি কি হয়েছে…
আরিফ ভড়কে গেল।নিধি চুলা বন্ধ করে বাহিরে ছুটলো।আরিফও বাইকের চাবি নিয়ে ছুটলো।বুঝলো খারাপ কিছু হয়েছে।

প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ৩৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here