প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ৩৭
অনন্যা
পুরোটা রাস্তা অস্থিরতায় কাটালো নিধি।বাড়ির সামনে বাইকটা থামাতেই সে দৌঁড়ে যায়।আরিফ পিছন থেকে ডাকলেও শুনলো না।নিধির ভেতর কাঁপছে।আরিফ হেলমেট খুলে পেছন পেছন গেল তার।নিধি অনবরত বেল বাজাচ্ছে।হঠাৎ দরজাটা খট করে খুলে গেল।হৃদি খুলেছে।কাঁদতে কাঁদতে চোখ-মুখ ফুলে গেছে মেয়েটার।নওশাদ আহমেদ হয়তো বারণ করছিলেন দরজা খুলতে তার চেহারায় সেই ছাপ’ই ফুটে উঠেছে।নিধি হাঁটু গেড়ে বসে হৃদিকে জড়িয়ে ধরে।
-‘আপু এসে গেছে তো…কাঁদে না..
হৃদি কেঁদেই চলেছে বোনকে দেখে।নওশাদ আহমেদ রাগি স্বরে বলে উঠলেন
-‘তোমার সাহস কি করে হলো আবার এ বাড়িতে পা রাখার? বের হও এক্ষুণি…
নিধি তাকালো বাবার দিকে।এরপর বলে উঠলো
-‘মা কোথায়? মাকে কি করেছো তুমি?
নওশাদ আহমেদ কপাল কুচকে ফেললেন।নিধিকে জানালো কে এই কথা? হৃদি?পরক্ষণেই রাগ উঠে গেল।হৃদির দিকে তেড়ে আসতে আসতে বলতে লাগলেন
-‘তুই তার মানে ওকে খবর দিয়েছিস? তোকে আজকে…
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরিফ সামনে এসে দাঁড়ালো ওদের।হৃদি নিধিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।আরিফ বলে উঠলো
-‘আপনি এমন রিয়াক্ট করছেন কেন? শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে দেখা করেই চলে যাব আমরা।ওনাকে ডাকুন।
নওশাদ আহমেদ একবার রুমের দিকে তাকালেন এরপর একটা শুকনো ঢোক গিলে বললেন
-‘ও ঘুমাচ্ছে।আর তোমাদের সাথে আমি সম্পর্ক ছিন্ন করেছি।তোমরা এ বাড়িতে এলে কোন সাহসে?
নিধি সেসব কথা পাত্তা দিল না।সে বললো
-‘আ’আমি মায়ের সাথে দেখা করবো।
নওশাদ আহমেদ বলে উঠলেন
-‘বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় মনে ছিল না মায়ের কথা? এখন যে মা মা করছো! বের হও বাড়ি থেকে।
নিধির নজর হঠাৎ নওশাদ আহমেদের হাতের দিকে গেল।রক্ত লেগে রয়েছে।ভড়কে গেল মেয়েটা।একপ্রকার নওশাদ আহমেদকে ধাক্কা দিয়েই ভেতরে চলে গেল সে।নওশাদ চেঁচাচ্ছেন পেছন থেকে।রুমে আসতেই নিধির ভেতরটা ধ্বক করে উঠে।তার মা রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে রয়েছে।মাথা থেকে রক্ত পড়ছে, পেট থেকে রক্ত বেরিয়ে ফ্লোর রাঙা হয়ে গেছে..নিধির মাথা চক্কর দিয়ে উঠে।মা বলে চেঁচিয়ে উঠলো মেয়েটা।নওশাদ হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে ফেললেন।
নিধি ছুটে গিয়ে মায়ের শিওরে বসে।
-‘মা..ওমা! একি হলো তোমার? এতো রক্ত! আল্লাহ! আ’আরিফ!! আ’আমার মা….
আরিফ নিজেও হতভম্ব।নিধি ঘুরে সিক্ত চোখে নওশাদ আহমেদের দিকে তাকায়।
-‘মেরে ফেললে! ম’মাকে মেরে ফেললে তুমি!
নওশাদ আহমেদ নিরুত্তর।নিধি চেঁচিয়ে উঠলো
-‘কেন মারলে আমার মাকে? এত বিরক্ত লাগলে আমাকে বলতে আমি নিয়ে যেতাম…হায় আল্লাহ! মাআআআ…
মায়ের নিথর দেহটা বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো নিধি।আরিফ একটু রুমের বাহিরে গিয়েছিল।সে এসে নিধিকে জড়িয়ে ধরে।নওশাদ আহমেদ বলে উঠলেন
-‘আমার পথে বাঁধা হলে এই অবস্থাই হবে।আর তোর মায়ের মৃত্যুর জন্য তো তুই দায়ী।বেচারি তোর জন্য নিজের প্রাণটাই দিয়ে দিল।
নিধি হতভম্ব হয়ে তাকায়।নওশাদ আহমেদ পাশ থেকে রিভালবারটা নিয়ে ঘুরাতে লাগলেন।
-‘আরিফকে মেরে তোকে আনতে যাচ্ছিলাম আমি।শাহীন বলেছে যে তোকে ওর ছেলের সাথে বিয়ে দিলে ও আবার আমার সাথে বিজনেস করবে।কোটি কোটি টাকার ব্যাপার এটা।বুঝতে পারছিস তুই? কিন্তু মাঝপথে বাঁধা দিল তোর মা।কিছুতেই যেতে দিবে না আমাকে।তাই বাধ্য হলাম..
-‘চুপ করো..চুপ করো তুমি….তুমি একটা অমানুষ।টাকার জন্য তুমি…হায় আল্লাহ! এটা কি করে করলে তুমি?
নিধি কাঁদতে কাঁদতেই বললো কথাগুলো। আরিফ বলে উঠলো
-‘আমি পুলিশকে কল করেছি।এক্ষুণি আসছে তারা।
নওশাদ আহমেদ চমকে গেলেন।পরক্ষণেই হো হো করে হাসতে লাগলেন। বলে উঠলেন
-‘জেলে পাঠাবে আমাকে!! এত সহজ! যদি যেতেও হয় তবে তোদের ধ্বংস করে যাবে।
কথাটা বলে নওশাদ আহমেদ আরিফের দিকে বন্দুক তাক করলেন।নিধি আঁতকে উঠলো।হৃদি আরিফের শার্ট খামচে ধরে কাঁদছে।আরিফ হাসলো।নওশাদ আহমেদ কপাল কুচকে ফেললেন।
-‘হ্যান্ডস্ আপ!
নওশাদ আহমেদ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেন।পুলিশ দেখে ভড়কে গেলেন।এত দ্রুত পুলিশ চলে এলো! উড়ে আসলো নাকি? নওশাদ একটা শুকনো ঢোক গিললেন।
-‘বন্দুক ফেলে দিন মিস্টার নওশাদ…
নওশাদ আহমেদ হঠাৎ’ই হৃদির হাত ধরে হেচকা টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে এলেন।হৃদি আপু বলে চেঁচিয়ে উঠলো।
-‘এক পা নড়বেন না ওসি সাহেব…নড়লেই গুলি করে দিব…
ওসি সাহেব হাসলেন।বললেন
-‘করেন গুলি…আপনার’ই তো মেয়ে।আমাদের আর কি?
নওশাদ আহমেদ ভয়ে ঘামছেন।মাথা ঠিক নেই তার।
-‘এখন আমি কাউকে চিনি না।সত্যিই মেরে দিব…
-‘আপনি মারুন…আর আমরা আঙুল মুখে দিয়ে বসে তা দেখি।নিন মারুন…
নওশাদ আহমেদ রেগে বলে উঠলেন
-‘ভেবেছেন পারবো না?এক্ষুণি মেরে দিব।
-‘জলদি মারেন।এরপর জেলে নিয়ে যাই।
নওশাদ আহমেদ ওসির দিকে বন্দুক তাক করে বললেন
-‘আপনাকে মেরে দিব…য’যেতে দিন আ’আমাকে…
ওসি সাহেব এবারেও হাসলেন।
-‘বাসা থেকে বের হওয়ার সময় এটা ভেবেই বের হই যে আর বাড়ি ফিরতে পারবো না।আর আপনি আমাকে প্রাণের ভয় দেখাচ্ছেন!
নওশাদ আহমেদ অন্যদিকে গুলি ছুঁড়লেন।সবাই চমকে উঠলো।
-‘মেরে দিব যদি যেতে না দেন…
-‘দিন…
নওশাদ আহমেদ একটা শুকনো ঢোক গিললেন।এ কেমন পুলিশ রে বাবা! একটু তো ভয় পাবি! নওশাদ আহমেদ ঠিক করলেন সত্যিই গুলি করবেন।তাকে বাঁচতে হবে যে করেই হোক।তিনি একটা লম্বা শ্বাস টেনে ট্রিগারে প্রেস করতে নিবেন ঠিক তখন অদ্ভুদ এক ঘটনা ঘটলো। ভয়ংকর এক বায়ুদূষণের শব্দ! গন্ধে সবার’ই অবস্থা খারাপ।নওশাদ আহমেদ থম মেরে গেছেন।লম্বা শ্বাস নিয়েই ভুলটা করেছিলেন তিনি। তার দিকে ঘুরেই কাজটা সেরেছেন ওসি সাহেব।তিনি উঁচু পেটটা ধরে বললেন
-‘আহ্! শান্তি…!
নওশাদ আহমেদের হাত থেকে বন্দুকটা পড়ে গেল।একজন কনস্টাবেল নাক চেপে বলে উঠলো
-‘আমাদের স্যারের হিডেন ট্যালেন্ট এটা।
নওশাদ আহমেদকে খপ করে ধরে ফেললো।নওশাদ এখনো ট্রমায় আছে।আরিফ নাক কুচকে বলে উঠলো
-‘ওসি সাহেব! আপনার এই হিডেন ট্যালেন্ট অপরাধীদের পার্সোনাললি দেখানোর অনুরোধ।
ওসি সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন।নিধি বলে উঠলো
-‘আপনারা মজা করছেন এখানে! আমার মা..আ’আরিফফ..
আরিফ সময় ব্যায় না করে নম্রতা বেগমকে কোলে তুলে নিল।হৃদি বোনের কাছে এলো ছুটে।ওসি সাহেব বললেন
-‘আমার গাড়িতে করে নিয়ে চলুন।অ্যাম্বুলেন্স আসতে আসতে দেরি হয়ে যাবে।
মাথা নাড়িয়ে সেদিকেই গেল ওরা।ওসি সাহেব হতাশার শ্বাস ছাড়লেন।
-‘মনে তো হচ্ছে না নিয়ে গিয়ে কাজ হবে।আল্লাহ! এমন স্বামী, এমন বাবা কারোর না হোক।
নিধির বাবার বডি পোস্ট মোর্টেম করতে নিয়ে যাওয়া হলো।নিধি একবার দেখেই চোখ ফিরিয়ে নেয়।নওশাদ আহমেদকে গাড়িতে তোলার সময় কেউ গুলি করে।গুলিটা সোজা মাথায় বিদ্ধ হয় যার দরূণ সাথে সাথেই মারা যান তিনি।নিধির মায়ের অপারেশন চলছে।ডাক্তার বলেছেন বাঁচার চান্স ভীষণ কম।মাথার আঘাত প্লাস পেটের আঘাত অনেক গভীর।তাছাড়া অনেক পরে হসপিটাল আনা হয়েছে তাকে।নিধি কুহুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।বাবার মৃত দেহটা দেখে ভেতরটা ছিড়ে যাচ্ছিল তার।খারাপ হলেও বাবা হয় তো! আজ যদি মায়েরও কিছু হয়ে যায় নিধি কি করে বাঁচবে! কুহু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দিচ্ছে।অপর পাশে রোদেলা বসে।কুহু বললো
-‘কিছু হবে না আন্টির…কাঁদিস না…
রোদেলা বললো
-‘নিজেকে শক্ত কর নিধি।হৃদিকে কে সামলাবে তুই এমন করলে? মেয়েটাকে দেখ..কেমন তোর দিকে তাকিয়ে আছে।
নিধি সিক্ত চোখে বোনের দিকে তাকায়।হৃদি এসে জড়িয়ে ধরলো।নিধি ওকে জড়িয়ে ধরেই হাউমাউ করে কাঁদলো।ডাক্তার বেরিয়ে এলেন।আরিফ আহনাফের সাথে কিছু কথা বলছিল।ডাক্তারকে দেখেই তারা এগিয়ে গেল।
-‘ডাক্তার..উনি ঠিক আছে তো?
-‘আল্লাহ আপনাদের দোয়া শুনেছে।মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন বলতে গেলে।
নিধির ভেতরটা শান্ত হলো এতক্ষণে।সবাই স্বস্থির শ্বাস ছাড়লো।রাহুল এক কোণায় দাঁড়িয়েছিল।ফোন স্ক্রল করছে সে।রোদ এসেছে বিধায় সেও এসেছে।তানাহলে নিজের পাকানো ঝামেলায় নিজে আসে নাকি আবার!
রোদেলা বলে উঠলো
-‘আলহামদুলিল্লাহ! আর কাঁদিস না।চোখ মুছ এবার শালি…কেমন পেত্নির মতো লাগছে..
নিধি চোখ মুছে হাসলো।হৃদি বললো
-‘মা ঠিক আছে, আপু?
কুহু তাকে জড়িয়ে ধরে বললো
-‘হ্যাঁ সোনা…তোমার মা একদম ঠিক আছে।
আরিফ বলে উঠলো
-‘বেচারা আমার শ্বশুর! বউকে উপর পাঠাতে গিয়ে নিজেই চলে গেল।
নিধি চোখ রাঙালো তাকে।আরিফ মেকি হাসলো।আহনাফ বললো
-‘আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য’ই করে।উম..রাত তো হলো…নিধি, হৃদি আর কুহু বরং আজ আমার ফ্ল্যাটে থাক।আমি আর আরিফ এখানে থাকি।
নিধি প্রথমে যেতে রাজি হচ্ছিল না পরে জোর করে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।রোদ বললো
-‘আমিও বরং আজ ওদের সাথেই থাকি।আমি ড্রাইভ করে নিয়ে যাবো।তোমাকে যেতে হবে না, ভাইয়া।
আহনাফ হেসে বললো
-‘আচ্ছা….
রাহুল বলে উঠলো
-‘আমি কি ঘোড়ার ঘাস কাটবো নাকি? তোমাকে নিয়েই বাড়ি ফিরছি আমি।
রোদেলা কিছু বলতে নিলে রাহুল বললো
-‘নো মোর ওয়ার্ডস্!
রোদেলা বলে উঠলো
-‘পারলে আটকে দেখান আমাকে..আমি যবোই..
রাহুল বলে উঠলো
-‘রাগিও না বেইবি…আমার সাথে চলো…
কুহু বলে উঠলো
-‘এত বড় ছেমড়িকে আপনার বেবি মনে হচ্ছে! হাউ মাচ কানা!
রাহুল বিরক্তমাখা স্বরে বলে উঠলো
-‘তোমার সাথে কথা বলছি আমি? মুখ বন্ধ রাখো..
-‘কি বললি রে? শুনতে পাইনি…
আহনাফের কথা শুনে রাহুল ওর দিকে তাকালো।আহনাফ বলে উঠলো
-‘মুখটা সামলে কথা বলবি।ওকে?
-‘না বললে কি করবি?
আহনাফ হাসলো।
-‘ আমার বউ এর আগেরবার তোর পিছনে ছুড়ি মেরেছিল না! আমি মারলে একদম জায়গামতোই মারবো..আহনাফ শাহরিয়ারের আবার টার্গেট মিস হয় না।
কুহু,নিধি ঠোঁট চেপে হাসলেও রোদেলা হো হো করে হাসতে লাগলো।রাহুল চেয়েও কিছু বলতে পারলো না।রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল সে।
সময় প্রবহমান।দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলেই এসেছে।আজকে হলুদ।কুহুকে আয়ান এসে নিয়ে গেছে।সাখাওয়াত আলম বড্ড অশান্তিতে আছেন এ নিয়ে।তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে সে ধুমধাম করে দিবে তা না! অন্য কেউ তার মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করছে।কেন? সে কি মরে গেছে? ইগোর কারণে বলতেও পারছেন না যে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিব।আহনাফকে উনি মানেন’ই তো নি।বলবে কি করে? কোনোকিছু ভাল্লাগছে না তার।হারুন রহমান তো শপথ নিয়েছেন যে ঐ আহনাফের সামনে কোনোদিন যাবেন না।আহনাফের নাম নিলেই তার পেছন ব্যাথা করে।সাখাওয়াত আলমকে এমন নিরাশ দেখে বললেন
-‘কি হয়েছে স্যার?
-‘শানায়ার বিয়ে আজ।
-‘জ্বী স্যার।
সাখাওয়াত আলম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।ফাইলটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালেন।আয়ান দাওয়াত দিয়ে গেছে বিয়েতে। নিজের মেয়ের বিয়েতে কিনা অতিথি হয়ে যাবেন তিনি!! আজকে তো হলুদ।মেয়েটাকে কেমন লাগছে দেখতে?ঠিক করলেন যাবেন তিনি।মেয়েটাকে দেখার লোভ সামলাতে পারছেন না।
-‘হারুন..গাড়ি বের করো…
হারুন রহমান প্রশ্ন করলেন না।হয়তো বুঝেছেন তিনি।চুপচাপ চলে গেলেন।
আয়ানদের বাড়ি আজ আলোয় ঝলমল করছে।পুরো বাড়ি সুন্দর করে লাইটিং করা হয়েছে।কুহুর মামা এসেছেন গত পরশুদিন।তিনিই ভাগ্নির বিয়ে ধুমধাম করে দিবেন বলে ঠিক করেন।এদিকে আয়ানের বুকটা ফেটে যাচ্ছে।তাদের প্ল্যান কোনো কাজেই আসেনি।কুহু উল্টো তার পোস্টে কেয়ার রিয়াক্ট দিয়ে কংগ্রাচুলেশন জানিয়েছে।নাতাশাকে নিয়ে ওদের সাথে শপিং এ গিয়ে কত নাটক’ই না করলো সে! নাতাশার প্রতি কত ভালোবাসা দেখিয়েছে যেন এই কুহু একটু জেলাস ফিল করে।কিন্তু সে উল্টো তাকে খোঁচা মেরে দুষ্টু হাসছিল।আয়ান একটা চেয়ারে বসে হতাশ হয়ে খালি স্টেজের দিকে তাকিয়ে ছিল।কিছুক্ষণ পর এখানে সুহাসিনী বসবে।আহহ্!!
আয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এদিক ওদিক ঘুরে তাকালো।হঠাৎ একটা জায়গাতে চোখ যেতেই তার মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেল।ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো।নাতাশা একটা হলুদ রঙের শাড়ি পড়েছে বাঙালি স্টাইলে।মুখে হালকা মেকাপ, চুলগুলো স্টাইল করে খোপা বাঁধা।একদম বউ বউ লাগছে তাকে।জাস্ট ঘোমটা দিলেই..উফ!
হঠাৎ একটা ছেলে এসে নাতাশার সামনে দাঁড়ায়।আয়ানের কপাল কুচকে এলো।ছেলেটা তার’ই ফুপাতো ভাই।রাইফার ছোট ভাই..বয়সে আয়ানের সমান’ই সে।নাতাশার সাথে কি নিয়ে যেন কথা বলছে।আর নাতাশাকে দেখো! কেমন হেসে হেসে কথা বলছে! কেন সে ঐ ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলবে? আয়ানের তো ভাল্লাগছে না।হঠাৎ’ই ভড়কে গেল আয়ান।সে কি জেলাস? না, না..।তবে মনটা বলে উঠলো “হ্যাঁ..আমি জেলাস”।নাতাশা কি মনে করে তাকালো তার দিকে। আয়ান চোখ ঘুরিয়ে নিল।একটা শুকনো ঢোক গিললো সে।সে কি আবার নাতাশাকে সত্যিই…
হঠাৎ মিউজিক বেজে উঠলো।কুহুকে স্টেজে নিয়ে আসা হচ্ছে। আয়ান সেদিকে তাকালো।মেয়েটাকে অসাধারণ লাগছে আজ।সবুজ পাড়ের হলুদ রঙের শাড়ি পড়েছে সে। ভারি সাজে আজ এই প্রথম আয়ান তাকে দেখলো।কিন্তু আজকাল মনটা আর ওতো পাগলামো করে না।একটু খারাপ লাগে হয়তো কিন্তু..
-‘হেই আয়ান!
আয়ান কাঁধে স্পর্শ পাওয়ায় পেছন ঘুরে তাকালো।নাতাশা দাঁড়িয়ে।নাতাশার থেকে চোখ সরানো যাচ্ছে না যেন আজ।মেয়েটা এমনিতেই সুন্দর তার উপর এমন সেজে এসেছে।আয়ান তাকিয়েই রয়েছে তার দিকে।এদিকে রাইফা নাতাশাকে ইশারায় ডাক দিলে সে গিয়ে কুহুর মাথার উপর ধরে রাখা পাতলা উড়নাটার এক কোণা ধরলো।কুহুকে স্টেজে বসানো হলো।অথচ আয়ান আজ হা করে নাতাশার দিকে তাকিয়ে।এর কারণ তার অজানা।
এদিকে নিধি ভিডিও কলে সবটা আহনাফকে দেখাচ্ছিল।ছেলেটা একটা পাতলা গেঞ্জি আর ট্রাউজার পড়ে বসে রয়েছে।কুহুকে দেখে হার্টবিট বেড়ে গেছে তার।কুহু জানে না আহনাফ দেখছে তাকে।তার ঠোঁটে লাজুক হাসি লেপ্টে রয়েছে।রাইফার সাথে টুকটাক কথা বলছে। আহনাফ নিধির কল কেটে সরাসরি কুহুকে কল করলো।কুহু প্রথমে হকচকালো।রাইফা দুষ্টু হেসে মজা নিল তা নিয়ে।এরপর চলে গেল।আহনাফ ভিডিও কল করেছে।কুহু রিসিভ করলো।আহনাফ ভেবেছিল রিসিভ করবে না তাই তো নিধির ফোনে দেখছিল। কুহু আহনাফের দিকে তাকানো মাত্র’ই আহনাফ বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে অজ্ঞান হওয়ার ভান করলো।কুহু হেসে ফেললো।আহনাফ চোখ খুলে তা দেখতেই বলে উঠলো
-‘আআআআ…তিলোত্তমাআআআ…আমার বউ বউ লাগছে পুরো….
কুহু মিউজিকের কারণে শুনতে পেল না।তবে আহনাফের কথা বলার ধরন দেখে হাসলো।এরপর ইশারায় বুঝালো মিউজিকের কারণে শুনতে পাচ্ছে না।আহনাফ বুঝতে পেরে ঠোঁট চোকা করে চুমু দিল।কুহু চোখ বড়বড় করে ফেললো।আহনাফ ইশারায় বুঝালো
-‘আসবো আমি?
কুহু ফোনটা মুখে কাছে এনে জোরে বললো
-‘বাঙ্গি ছুঁড়ে মারবো আসলে…অসভ্য লোক!
আহনাফ হো হো করে হাসতে লাগলো।কুহু আহনাফের ড্রেস দেখে বললো
-‘এগুলো পড়ে স্টেজে বসবেন? হাউ মাচ ফকিরগিরি!
আহনাফ জোরে জোরে হাসতে লাগলো।এরপর হঠাৎ কল কেটে দিল।কুহু হতভম্ব হলো।কিছুক্ষণ বাদে আবার আহনাফ কল করলো।কালো টি শার্ট আর সাদা লুঙ্গি পড়েছে সে।কুহু কপাল কুচকালো।
-‘লুঙ্গি!
আহনাফ হেসে ইশারায় বুঝালো
-‘এটা পড়েই স্টেজে যাবে।
কুহু মুখ কুচকালো।বললো
-‘প্যান্ট’ই তো খুলে যায় আপনার..লুঙ্গি তো সেকেন্ডের ব্যাপার..
আহনাফ চোখ বড়বড় করে ফেললো এটা শুনে।কুহু খিলখিল করে হাসে।কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দেয়।
-‘ভাইই!!
-‘বল…
রাফি হতাশ স্বরে বলে উঠলো
-‘নিজের বউয়ের বিয়ের হলুদের অনুষ্ঠানে গেস্ট হিসেবে এসেছি।দিলটা পুড়ে যাচ্ছে…
আহনাফ হাসলো।রাফি বললো
-‘এসব পড়েই যাবে?
-‘আহনাফ শাহরিয়ার কথা রাখতে জানে।
রাফি হেসে ফেললো।সে তো মজা করে বলেছিল।হঠাৎ সেখানে রোদেলা হাজির হলো।
-‘ভাইয়া! বাঁচান!
রাফি তাকাতেই থমকে গেল।মেয়েটা হলুদ সবুজ পাড়ের হলুদ রঙের শাড়ি।মুখে ভারি সাজ..আহ্! এদিকে রোদেলা রাফিকে দেখে ভড়কে গেল।আহনাফ বললো
-‘কি হয়েছে?
রোদেলা রাফির থেকে নজর সরিয়ে বললো
-‘রাহুইলা পেছনে পড়ে গেছে…বলে কিনা…
-‘কি?
রাফির গম্ভীর স্বর।
-‘বলে কিনা..একটা চুমু খাবো বেইবি…
রাফি ঠোঁট কামড়ে পাঞ্জাবির হাতা গোটালো।
-‘শালাকে তো…
-‘বেইবি!!
রাহুল এসে হাজির হলো হঠাৎ।রোদেলা ভড়কে গেল।আহনাফ পরিস্থিতি সামলাতে বললো
-‘রোদ আমার কয়েকটা ছবি তুলে দে তো..
রাহুল বলে উঠলো
-‘আমার বউ তোর ছবি তুলবে কেন?
-‘আমার বউকে দেখাতে।
-‘কিহ্!!
-‘খা নাকের ঘি..
-‘হুয়াট!!
-‘তুই হলি গন্ধওয়ালা পাট।
আহনাফের কথা শুনে রোদেলা ফিক করে হেসে ফেললো।রাফি তো রাগে গজগজ করছে।রাহুল ফোঁস ফোঁস করতে করতে চলে গেল।রাফি বললো
-‘শালার মুখটা ফাটিয়ে দিতে পারলে শান্তি পেতাম।
রোদেলা বলে উঠলো
-‘প্লিজ মদনাগিরি করবেন না।এ বাবা! আপনার বিস্কুট কই আজ?
রাফি রোদের দিকে সম্মোহনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
-‘তুমিই তো আছো…বিস্কুট দিয়ে কি করবো?
আহনাফ কেঁশে উঠলো।রোদেলা বললো
-‘সাধেই তো আর মদনা বলি না! শালা বিস্কুটখোর মদন!
রোদেলা চলে গেল।রাফি বলে উঠলো
-‘হেই চোরনি…স্বামীকে অপমান করো হ্যাঁ! ঠাডা পড়বো ঠাডা।
রোদেলার উত্তর শোনা গেল যেটা না শুনলেই ভালো হতো বোধহয়..
-‘বা/লের স্বামী।
রাফি হতাশ হলো।আহনাফ হো হো করে হেসে উঠলো।
সাখাওয়াত আলমের গাড়িটা এসে থামলো।গার্ডস্ তাকে ঘিরে ফেললো।সাখাওয়াত আলম নামলেন।ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো।মেয়েটার বিয়ের দায়িত্বটাও নিতে পারলেন না! তিনি ভেতরে যেতেই কুহুর মামা এগিয়ে এলেন।
-‘কি পরম সৌভাগ্য আমার! আসুন আসুন..এই কে কোথায় আছিস..ঠাণ্ডা কিছু নিয়ে আয়…
-‘ব্যস্ত হবেন না।আমি আছি…
-‘স্যার আসুন…
সাখাওয়াত আলমের দিকেই সবাই তাকিয়ে।কুহুও তাকালো তার দিকে।আচমকা মেয়েটার চোখ ছলছল করে উঠলো।সাখাওয়াত আলম তাকালেন মেয়ের দিকে।মুচকি হাসলেন।কুহু চোখ সরিয়ে নিল।হতাশ হলেন সাখাওয়াত আলম।তাকে ভেতরে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি যেতে চাইলেন না।তখন কুহুর মামা বললেন
-‘স্যার আপনি ভেতরে বসুন আমি বরং কুহুকে পাঠাচ্ছি।
সাখাওয়াত আলম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গেলেন।সামনে নির্বাচন তার উপর আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক।তাই হয়তো ভদ্রলোক এ কথা বললেন।তিনি গেলেন বাড়ির ভেতরে।আয়ান নিয়ে গেল।যাওয়ার পথে আনোয়ারা বেগমের সাথে দেখা।হারুন রহমান দাঁত কেলালেন তাকে দেখে।আনোয়ারা বেগম মুখ কুচকালেন তাকে দেখে।হারুন রহমান বললেন
-‘আপনার হাতের আঁখ-চা খেতে চলে এলাম।আজকে কি আঁখ দিবেন চায়ের সাথে নাকি অন্যকিছু?
-‘আহহা! হারুন!
হারুন রহমান থেমে গেলেন।আনোয়ারা বেগম হেসে বললেন
-‘চা পাতির জায়গায় গোবর দিব ভাবছি..আপনার মাথায় তো সেটারও অভাব আবার।
ভদ্রলোকের হাসি উবে গেল।আয়ান বললো
-‘আহহা! মা!
দুজন দুজনকে ভেংচি কাটলেন ওনারা।সাখাওয়াত আলম কুহুর রুমে এসে বসেছেন।কিছুক্ষণ বাদে কুহু এলো।
-‘ভাবিনি আপনি আসবেন।
সাখাওয়াত আলম তাকালেন মেয়ের দিকে।হেসে বললেন
-‘আমার মেয়ের বিয়ে আর আমি থাকবো না? তোমার মা নির্ঘাত আমাকে উপর থেকে গালিগালাজ করছে তোমার বিয়ের দায়িত্ব নেইনি বলে।কপাল!
হঠাৎ কুহু দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে।সাখাওয়াত আলম থমকালেন।অবিশ্বাস্য যেন এটা।
-‘কেন আমাদের সম্পর্কটা আর পাঁচটা বাবা,মেয়ের মতো না? কেন এত দূরত্ব বাবা? কেন?
কুহু কাঁদছে আজ।সাখাওয়াত আলমের চোখেও পানি এলো।জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে।
-‘আমার ভুল মা..আমার দোষ সব।প্রতিশোধের নেশায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি।আমার কারণে আজ এত দূরত্ব।
কুহু কিছু বলে না।সে কাঁদছে।হেচকি উঠে গেছে কাঁদতে কাঁদতে।কাঁদতে কাঁদতে বললো
-‘ভালোবাসি বাবা…ভালোবাসি…এতক্ষণ তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি।ভালোবাসি বাবা…
সাখাওয়াত আলমের ভেতরটা শান্তিতে ভরে গেল।চোখ বুজে ফেললেন তিনি।হুহু করে কেঁদে উঠলেন তিনিও।
-‘আমার মা..আমিও তোমাকে ভালোবাসি…
হারুন রহমানের চোখেও পানি এলো।তিনি রুমাল বের করে চোখ মুছলেন।তিনি দরজার বাহিরে দাঁড়িয়েছিলেন।আনোয়ারা বেগম চা নিয়ে আসছিলেন।ওনাকে কাঁদতে দেখে কপাল কুচকে বললেন
-‘আপনি কাঁদছেন নাকি?
ভদ্রলোক চেতে বললেন
-‘না..চোখ দিয়ে হি’সু করতেছি।
আনোয়ারা বেগম নাক কুচকে বললেন
-‘কেন আপনার যন্ত্র নষ্ট নাকি?
প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ৩৬
ভড়কে গেলেন ভদ্রলোক।চোখ বড় বড় করে তাকালেন তিনি।আনোয়ারা বেগম বলতে লাগলেন
-‘ওয়াক! রাজনীতিবীদরা চোখ দিয়ে মু’তে!! ছ্যাহ! কি দিনকাল এলো মাবুদ!
ভদ্রমহিলা চলে গেলেন বলতে বলতে।হারুন রহমান বোকা বনে গেলেন।এ কে বে? সত্য ভেবে নিয়েছে! ছ্যাহ!!
