প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ৬
অনন্যা
-‘ওরে বাবাগো…আল্লাহ গো…..ভাই..এসেছেন ভাই..
রাফি ব্যান্ডেজে মোড়া হাতটা কোনোমতে উঠিয়ে বললো।আহনাফ দৌঁড়ে তার কাছে গেল।রাফির মাথায়,হাতে ব্যান্ডেজ।আহনাফ বলে উঠলো
-‘তিলোত্তমা কই?
রাফি হাবার মতো তাকিয়ে রইলো আহনাফের পানে।তাকে একবার কিছু জিজ্ঞাসাও করলো না? রাফি অভিমানী স্বরে বললো
-‘জানি না..
আহনাফ তার অভিমানী চেহারা খেয়াল করলো না।সে ওর কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।রাফি মুখ ভেংচি কাটলো।তখন হাজির হলো আহান শাহরিয়ার।সে বিচলিত স্বরে বলে উঠলো
-‘একি অবস্থা তোর!
রাফি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো।আহান শাহরিয়ার এগিয়ে গেলেন।ওর পাশে বসলেন তিনি।এরপর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন
-‘ছেলে হয়ে কান্না করলে তোকে কোন মেয়ের বাবা মেয়ে দিবে রে বাপ? চুপ যা …
রাফি কান্নারত স্বরে বলে উঠলো
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-‘আংকেল, ভাই বদলে গেছে…আমার ভাই বদলে গেছে…আপনি কিছু বলেন ভাইকে..
আহান শাহরিয়ার বললেন
-‘ওই হারাম/জাদার তো আমাকে দেখলেই পেছন গরম হয়ে যায় রে বাপ…আমি ওরে কি বলবো?
রাফি আরো জোরে জোরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগলো।আহান শাহরিয়ার বলে উঠলেন
-‘আচ্ছা আচ্ছা…আমি দেখছি..
রাফি কান্না থামালো এবার।আহান শাহরিয়ার বললেন
-‘ছেলেটা পুরো আমার মতো হয়েছে।ওর মায়ের জন্যও আমি এমন পাগলামো করতাম।জানিস..আহনাফ হওয়ার সময় আমিই তিনদিন অজ্ঞান ছিলাম ভয়ে..
কথাটা বলে রাফির ব্যান্ডেজে মোড়ানো হাতে এক থাবা বসিয়ে জোরে হেসে উঠলেন আহান শাহরিয়ার।এদিকে রাফি “আম্মা” বলে চেঁচিয়ে উঠলো।হঠাৎ এমন চেঁচানোতে আহান শাহরিয়ার ভয়ে নিচে পড়ে গেলেন।বুকে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালেন ভদ্রলোক।রাফি বলে উঠলো
-‘বাপ-ছেলে দুইটাই এক…যাই করে না কেন পেছন আমার’ই মারে…আল্লাহ গো…
আহান শাহরিয়ার মেকি হাসলেন।
এদিকে আহনাফ পাগলের মতো এদিক সেদিক খুঁজতে লাগলো তার তিলোত্তমাকে।হঠাৎ একটা কেবিনের সামনে আসতেই থেমে গেল সে।দরজাটা খোলা ছিল কেবিনের।কুহু আয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।আয়ানের মাথায় ব্যান্ডেজ।
আহনাফ নড়লো না।ওখান থেকেই দেখতে লাগলো কুহুকে।এই মেয়ের জন্য সে চিন্তায় মরছিল আর একে দেখো! এক হতোচ্ছোরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে! ইচ্ছা তো করছে ওর ফাঁটা মাথায় হকস্টিক দিয়ে আরো কয়েকটা….আহনাফ সামনে এগোতে গেলে হঠাৎ এক মহিলা তাকে ধাক্কা মেরে ভেতরে চলে গেল।আহনাফের কপাল কুচকে গেল বিরক্তিতে।মহিলাটা ভেতরে গিয়েই কুহুকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে আয়ানকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।আহনাফের রাগ লাগলো।কতো বড় সাহস এই মহিলার! তার তিলোত্তমাকে এভাবে ধাক্কা মারে!
-‘আয়ান..বাবা ঠিক আছিস তুই? আমার সোনা…ইশ! কত আঘাত লেগেছে তোর! পইপই করে বারণ করেছিলাম যে ঐ কলঙ্কিনীকে আনতে যাস না।শুনলি না তো মায়ের কথা..এখন দেখলি…
আয়ান ‘চ’ সূচক শব্দ করে বললো
-‘ফালতু কথা বলো না তো মা..ভাগ্যে ছিল তাই এমন হয়েছে।এখানে কুহুর দোষটা তো আমি দেখতে পাচ্ছি না।
আনোয়ারা বেগম বলে উঠলেন
-‘ঐ পোড়ামুখীর তো কিছুই হয়নি।তোর’ই তো কত আঘাত লেগেছে!
কুহু নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।আয়ান বলে উঠলো
-‘শুকরিয়া আদায় করো যে কিছু হয়নি।আর ফালতু কথা কম বলো।
আনোয়ারা বেগম চোখের পানি মুছে কুহুর দিকে তাকালেন।এরপর বলে উঠলেন
-‘অপয়া মেয়ে একটা! মা-বাবা, দাদি সবাইকে খেয়েছে এখন আমার ছেলেটাকে খাওয়ার ধান্দা…
-‘মাআআআ…
আয়ান রাগি স্বরে বলে উঠলো।আনোয়ারা বেগম কিছু বললেন না আর।কুহুর চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো।নিকাব খুলে ফেলেছে সে।তাই ওর ক্রন্দরত মুখখানা দেখতে পেল সবাই।আয়ানের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।খুব করে ইচ্ছা করলো সযত্নে তার সুহাসিনীর চোখের পানি মুছিয়ে দিতে।কিন্তু পারলো না।আহনাফ বাহিরে দাঁড়িয়ে সবই দেখতে লাগলো।পেছন থেকে হঠাৎ আহান শাহরিয়ার এসে বলে উঠলেন
-‘এই তাহলে আমার বউমা!
আহনাফ ভড়কালো খানিকটা। পরপর’ই ‘চ’ সূচক শব্দ করলো।চলে এলো সে ওখান থেকে।আহান শাহরিয়ার বলে উঠলেন
-‘কিরেহ! বউমা কাঁদছে তো..কান্না থামাবি না?
আহান শাহরিয়ারের চেঁচানোতে সবাই তার দিকে তাকালো।কুহু কপাল কুচকালো।আহান শাহরিয়ার তা দেখে হাত উঁচু করে বললো—“হাই বউমা..!” আহনাফ দৌঁড়ে এসে তার মুখ চেপে ধরলো।এরপর টানতে টানতে নিয়ে চলে এলো।আয়ান বলে উঠলো
-‘কে ছিল রে ওটা?মিস্টার আহনাফের ভাই নাকি?
কুহু চোখ মুছে বললো
-‘হবে হয়তো…
আনোয়ারা বেগম বলে উঠলেন
-‘আহনাফ কে?
আয়ান সব ঘটনা বললো তার মাকে শুধু কুহু যে গাড়ি থেকে জাম্প মেরেছিল সেটা চেপে গেল।আনোয়ারা বেগম বলে উঠলেন
-‘এমনি এমনি আর এই মেয়েকে অপয়া বলি আমি! দেখেছিস তো! পেয়েছিস প্রমাণ? একে এখন ঘর থেকে দূর করতে পারলে বাঁচি।এরকম কলঙ্কিনী মেয়েকে নিবেই বা কে…
-‘আমি নিয়ে নিব তাও তুমি প্লিজ ওকে বাজে কথা বলো না।ভাল্লাগে না আমার।
আনোয়ারা বেগম মুখ ঝামটা মারলেন।কুহুর চোখ পুনরায় ছলছল করে উঠলো।ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো মেয়েটা।
-‘কি অসভ্য ছেলে! বাপের মুখ ধরো তুমি! তাও কিনা বাম হাত দিয়ে! ছ্যাহ্…
আহনাফ খেকিয়ে বললো
-‘এই তোমাকে বউমা বলে চেঁচাতে কে বলেছিল হ্যাঁ?
-‘আমার অবলা মন…
আহনাফ ভ্রু কুচকে বিরক্ত হয়ে তাকালো।আহান শাহরিয়ার বললেন
-‘তোমার’ই তো উপকার করলাম।ওর পরিবারের সামনে ওকে বউমা বললাম যেন তোমার সুবিধা হয়।এখন বলো বিয়ের সমন্ধ নিয়ে কবে যাচ্ছি আমরা?
আহনাফ বলে উঠলো
-‘তোমার বউমা আমাকে রিজেক্ট করেছে।বুঝছো? ওই যে ছেলেটাকে শুয়ে থাকতে দেখেছো..ঐটা তোমার বউমার উডবি..
আহান শাহরিয়ার মুখে হাত দিয়ে ফেললেন।
-‘হায়হায়! বলো কি!
আহনাফ কিছু বললো না।আহান শাহরিয়ার বললেন
-‘তুমি চাইলে আমি তোমার হেল্প করতে পারি।
-‘লাগবে না।
ওদের কথোপকথনের মাঝে কুহু বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে।ওদের পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে আহান শাহরিয়ারের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো।উনি আহনাফকে ধাক্কা মেরে কুহুর উপর ফেলে দিলেন। আহনাফ গিয়ে সোজা কুহুর উপর পড়লো।কুহু তাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেল।আহনাফের প্রথমে রাগ হলেও কুহুর চোখে চোখ পড়তেই তা উধাও হয়ে গেল।কুহুর পুরো ফেইস এতো কাছ থেকে আজ দ্বিতীয়বার দেখছে সে।এদিকে কুহুর অবস্থা নাজেহাল।আজকে কার মুখ দেখে যে ঘুম থেকে উঠেছিল সে! সকাল থেকে একটা কিছু ভালো হয়নি।কোমড়টা বোধহয় গেছে এবার! সে আহনাফকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে উঠলো
-‘কি আশ্চর্য! উঠছেন না যে! এটা কি সিনেমা পেয়েছেন যে ব্যাকরাউন্ডে এখন লালালা মিউজিক বাজবে আর আপনি তাকিয়ে থাকবেন! আল্লাহ গো! হাতিও মনে হয় না এতো ভারি!
আহনাফ তাৎক্ষণাৎ উঠে পড়লো।রাগি চোখে তাকালো তার বাবার দিকে।ভদ্রলোক ঠোঁট চেপে হাসছে।কুহু একা উঠতে নিলে ব্যর্থ হলো।আহনাফ ধরে উঠালো তাকে।কুহু ঝাটকা মেরে হাত সরালো তার।এরপর রাগি স্বরে বলে উঠলো
-‘মেয়ে মানুষ দেখলেই ধাক্কা মারা লাগে! আপনার ভাই তো আপনার চেয়েও বড় খাটাশ…
আহান শাহরিয়ারের মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল।আহনাফ আর আহান শাহরিয়ার একসাথে বলে উঠলো–“অ্যাঁ!!”
কুহু বলে উঠলো
-‘অ্যাঁ কি …ঠিক’ই তো বলছি।
আহনাফ বাবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো
-‘এটা আমার ভাই?
কুহু বললো
-‘ভাই হোক আর বন্ধু হোক আস্ত একটা খাটাশ লোক…
-‘আমার বাপ এটা…
কুহু জোরে জোরে হাসতে লাগলো
-‘বলদ মনে হয় আমাকে?মানে যাকে খুশি একটা বললেই বলো হ্যাঁ!”
-‘কি আশ্চর্য! ইনি সত্যিই আমার বাবা।
কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল মেয়েটা।একবার আহান শাহরিয়ার আরেকবার আহনাফকে দেখতে লাগলো হা করে।সে অবাক স্বরে বললো
-‘এ’এটা আপনার বাবা?
আহনাফ উপর নিচ মাথা ঝাঁকালো।কুহু মাথাটা ভনভন করে ঘুরতে লাগলো।আর নিতে পারছে না সে।সে আহান শাহরিয়ারের দিকে তাকালো।ভদ্রলোক তার দিকেই তাকিয়ে।কুহু কি বলবে কি করবে কিছুই বুঝতে পারলো না।সে হঠাৎ দৌঁড় লাগালো।মাথা কাজ করছে না তার।বাসায় গিয়ে ঠাণ্ডা পানি ঢালতে হবে।সকাল থেকে যা যাচ্ছে আজ তার উপর দিয়ে! এদিকে কুহুকে দৌঁড়াতে দেখে আহান শাহরিয়ার হেসে উঠলেন।আহনাফ চেঁচিয়ে উঠলো
-‘তিলোত্তমা আস্তে….হায়রে কপাল! এইদিন’ই দেখার বাকি ছিল আমার!
শেষের কথাটুকু হতাশ হয়ে বললো আহনাফ।আহান শাহরিয়ার বললেন
-‘ব্যাপারটা কিন্তু সেই…তোমার মাও প্রথম দেখায় আমাকে খাটাশ বলে আখ্যায়িত করেছিল।কপাল দেখো! বউমাও আজ এটা বলে গেল।
আহনাফ বলে উঠলো
-‘আমার চেয়ে বড় খাটাশ বলছে মানে ইনডায়রেক্টলি আমাকেও বলে গেছে।আল্লাহ জানে তোমার জন্য আর কত গালি খাবো!
আহান শাহরিয়ার হঠাৎ বললেন
-‘কিন্তু গাড়ির ব্রেক ফেইল হলো কি করে?
আহনাফ বলে উঠলো—“শত্রুর তো আর অভাব নেই আমার।করিয়েছে হয়তো কেউ একজন।হয়তো পরিচিত আবার হয়তো অপরিচিত..”
হঠাৎ আহনাফের ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠলো।সে রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে বলে উঠলো
প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ৫
-‘ম্যাডাম ড্রেনে পড়ে গেছে স্যার..জলদি আসুন…
আহনাফ ‘চ’ সূচক শব্দ করে বলে উঠলো
-‘বা/ল একটা! একটা সেকেন্ড শান্তি দিল না আমায়।
-‘কি হয়েছে?
-‘তোমার বউমা ড্রেনে পড়ে গেছে।তখন যে দৌড় দিছে পড়ার’ই কথা।তবে যাবে যাবে ড্রেনেই যে যাবে সেটা বুঝিনি।শান্তি দিল না আমারে..!
