প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ৭
অনন্যা
-‘মামি ঠিক’ই বলে, আমি সত্যিই অপয়া।সকাল থেকে কি না হয়েছে আজকে! পুরো শরীর ব্যথায় টনটন করছে।
কুহু কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলো কথাগুলো।বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের সাথেই পকপক করে চলেছে মেয়েটা।চোখেমুখে ঘুম ভর করে আছে তার।কথা বলতে বলতে এক পর্যায় ঘুমে তলিয়ে গেল।হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠলো।কুহু ‘চ’ সূচক শব্দ করে বলে উঠলো
-‘এই টাইমে কে কল দেয় বা/ল!
পাশ থেকে ফোনটা তুললো।অপরিচিত নম্বর দেখে কপাল কুচকালো সে।এতো রাতে আবার তাকে কে কল দিল? কুহু ফোনটা রিসিভ করে ঘুম জড়ানো স্বরে সালাম দিল।আহনাফ থমকে গেল।এই মেয়ের সবকিছুই তাকে এতো টানে কেন?এই যে এখন এই ঘুমজড়ানো স্বরটা!উফফ! আহনাফের হৃদয়ে গিয়ে লেগেছে পুরো।কুহু সাড়া শব্দ না পেয়ে আবার ঘুমজড়ানো স্বরে বললো–“হ্যালো!”
আহনাফ নিজেকে সামলালো।এরপর বললো
-‘কেমন আছো?
কুহুর ঘুমের মাঝেই কপাল কুচকে গেল।সে বললো
-‘আপনি কে বলছেন?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আহনাফ বিরক্ত হলো বড্ড এহেন প্রশ্নে।তার ভয়েসটাও চিনলো না! কিন্তু না এখন রাগ দেখালে চলবে না।এই মেয়ে এমনিতেই পাত্তা দেয় না তাকে।এখন রাগ দেখানোটা ঠিক হবে না। সে বললো
-‘আহনাফ বলছি..
কুহুর চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসছে।সে বললো
-‘কে..
আহনাফ ‘চ’ সূচক শব্দ করলো।আবার বললো সে
-‘আহনাফ শাহরিয়ার…
কুহু এবারও শুনলো না।সে ঘুমজড়ানো স্বরে আবার বলে উঠলো
-‘কে..?
আহনাফ এবার খেকিয়ে বললো
-‘খাটাশ বলছি…শুনেছেন এবার?
আহনাফের চেঁচানোতে কুহু লাফিয়ে উঠলো।ভয় পেয়েছে! ঘুম উড়ে গেছে তার।বুকে তিনবার থুথু দিল সে।এরপর বললো
-‘চিল্লাচ্ছেন কেন? আর আপনি আমার ফোন নম্বর পেলেন কোথায়?
আহনাফ চোখ বুজে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো।এরপর বললো
-‘এখন শরীর কেমন লাগছে সেটা বলো।
কুহুর সহজ-সরল জবাব
-‘কেমন আবার! শরীরের মতোই লাগছে।
আহনাফ বুঝলো যে কুহু ইচ্ছা করে তার সাথে ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলছে।সে বলে উঠলো
-‘ত্যাড়া ত্যাড়া উত্তর না দিলেই নয়!
-‘উঁহু…আপনি কল দিয়েছেন কেন?
আহনাফ ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো
-‘প্রেম করতে…
কুহুর কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠলো কথাটা শুনে।সে “ওয়াক থু” বলে কল কেটে দিল।আহনাফ হতভম্ব! “ওয়াক থু” টা কি তাকে বললো? নাকি তার ভালোবাসাটাকে? কত বড় সাহস এই মেয়ের! আহনাফের রাগ হলো প্রচুর।সে যেচে প্রেমের কথা বলায় ডিরেক্ট ওয়াক থু বলে অপমান করে দিল! আহনাফ যেন এখন পারলে কুহুকে কাঁচা চিবিয়ে খেত! আহনাফ আবার কল করলো।
কুহু রিসিভ করবে কি করবে না ভাবতে লাগলো।রিসিভ করলে যদি প্রেম হয়ে যায়!! ওরে বাবা! নাহ্! সে আর ঝুঁকি নিতে পারবে না।আজকে কল রিসিভ করবে, কথা বলবে, তারপর?হয়তো আবার আগামীকাল কল দিবে।এভাবে অভ্যাস করিয়ে একদিন হারিয়ে যাবে।এরপর কুহুর কি হবে?
একজনের দেওয়া আঘাত সে আজও ভুলতে পারেনি।আবার এক’ই ভুল সে কি করে করবে? কখনোই না।কুহুর ভাবনার মাঝেই কলটা বেজে কেটে গেল।আবার কল করলো আহনাফ।কুহু রিসিভ করলো না।ফোনটা সাইলেন্ট করে শুয়ে পড়লো।মানসপটে কিছু সুমধুর দৃশ্য ভেসে উঠলো।হঠাৎ’ই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো তার।তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো কুহু।
-‘দেখেছো.. আজও তোমার নামে অশ্রুরা দল বাঁধে।অথচ তোমার জন্য শুধু ঘৃণা থাকার কথা।তোমার জন্য আজ এই “ভালোবাসা” শব্দটার প্রতি আমার এত ঘৃণা।অবাধ্য মনটা আজও বলে যে, ওগুলো সব স্বপ্ন ছিল।তুমি এমন না..তুমি..তুমি তো..
কুহু ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো।ঠোঁট কেটে গেল তাও সে একইভাবে রইলো।কিছুতেই ঐ অমানুষটার জন্য সে কাঁদবে না।কিছুতেই না।হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি মুছলো সে।ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো।ঘুমানোর চেষ্টা করলো সে।এপাশ ওপাশ করতে লাগলো।অতীতের স্মৃতিগুলো বারবার মানসপটে ভেসে উঠছে।কুহু বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো।
-‘ধুর বা/ল! এতো প্যারা কেন জীবনে? ভাল্লাগে না আর!
কুহু ফোনটা হাতে নিল।পঞ্চাশটা কল করেছে আহনাফ।কুহু হা হয়ে গেল।
-‘ঐ অমানুষের বা/চ্চাটাও জীবনে এতোবার কল করেনি আমায়! সর্বোচ্চ দুই থেকে চারবার।আর একে দেখো! এর গার্লফ্রেন্ড না বউ লাগি ভাই যে এতোবার কল করছে!
হঠাৎ একটা নোটিফিকেশনের শব্দ! কুহু চমকে উঠে খানিকটা। ফোনের দিকে তাকাতেই দেখে আহনাফের ম্যাসেজ।
“ভার্সিটি তো আসবেন’ই।তখন দেখবেন কি করি আপনাকে, মিস তিলোত্তমা সুন্দরী..!”
কুহুর আত্মাটা লাফিয়ে উঠলো।এই ছেলে মারাত্মক একটা চিজ! হকস্টিক দিয়ে যদি মার শুরু করে দেয়! সকালে অলরেডি মেরেছে। ভর্সা নেই এই ছেলের।কুহু কল করলো আহনাফকে।এবার আহনাফ রিসিভ করলো না। কুহু আবার কল করলো।ভেবেছিল হয়তো এবারেও রিসিভ করবে না।কিন্তু আহনাফ রিসিভ করলো।কুহু চুপ করে রইলো।কিছু বললো না সে।আহনাফ বলে উঠলো
-‘হ্যালো..! তিলোত্তমা!
কুহুর ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। “তিলোত্তমা!” কি আছে এই নামটাতে? কেন বারবার এই নামটা শুনলে তার ভেতরে উথালপাথাল ঝড় শুরু হয়ে যায়! কুহু নিজের মাথায় একটা গাট্টা মারলো।এগুলো ছেলেদের ফাঁদ।প্রথমে এসব বলে পটাবে তারপর অভ্যাসে পরিণত হয়ে হারিয়ে যাবে।কুহু নিজেকে এসব বলে বুঝ দিতে লাগলো।তখন আহনাফ বলে উঠলো
-‘তিলোত্তমা শুনছো?
কুহু ‘চ’ সূচক শব্দ করলো। আবার তিলোত্তমা! সে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কুহু বলে উঠলো
-‘কুহু…কুহু বলে ডাকবেন।এসব ঢং করবেন না।
আহনাফ শব্দ করে হাসলো।কুহু বললো
-‘হাসার মতো কিছু বলেছি?
-‘আহনাফ শাহরিয়ার আর ঢং! ভার্সিটিতে এসে বলো কথাটা।গণপিটুনি না খেলেই হয়!
কুহু নিজেও ভাবলো কথাটা।খুব একটা ভুল বলেনি আহনাফ। সে এসব কথায় গেল না আর।
-‘কল কেন করছেন সেটা বলেন।
আহনাফ হেসে বললো
-‘ম্যাডাম, কলটা আপনি করেছেন।
-‘আপনি কেন করেছিলেন সেটাই জানতে দিয়েছি।
আহনাফ বলে উঠলো
-‘আসতাগফিরুল্লাহ! কিসব বলছেন? কেন করেছিলাম মানে?কি করেছি আমি? আর আপনি দিয়েছেন মানে…ছিঃ তিলোত্তমা! আই লাভ মাই মাইন্ড…
আহনাফ দুষ্টু হাসছে।কুহু বোকা বনে গেল।এই লোক কোন কথাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কুহু বলে উঠলো
-‘আপনি কিন্তু এবার বেশি বেশি করছেন…
আহনাফ এটা শুনে বলে উঠলো
-‘ছিইইইইই!! কিসব বলছেন আপনি? কোথায় বেশি বেশি করছি আমি..?আপনাকে তো এখনো হাতের কাছেই পেলাম না…আবার বেশি বেশি..! এই এক মিনিট? আপনি কি আবার এসব কল্পনা করছেন আর আমাকে বলছেন?ছিইইইইইই!!!
কুহু বোকা বনে গেল।তার সাদা সিধে কথাগুলোকে কোন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে এই খাটাশটা! কুহু বলে উঠলো
-‘আর একটা ফালতু কথা বলবেন আমি কল কেটে দিব।
আহনাফ হো হো করে হেসে উঠলো।কুহু শুনলো তার হাসির শব্দ।মনে হচ্ছে যেন খ্যাক শিয়াল হুক্কা হুয়া করছে।কুহু বলেই বসলো
-‘আপনার পূর্বপুরুষ কি খ্যাক শিয়াল ছিল?
আহনাফের হাসি থেমে এলো।সে বলে উঠলো
-‘এটা মনে হলো কেন?
কুহুর সোজাসাপ্টা উত্তর
-‘আপনার হাসি আর শেয়ালের ডাক এক’ই লাগছে।তাই মনে হলো।নিশ্চই শিয়ালের সাথে আপনার কানেকশন আছে।
আহনাফ বলে উঠলো
-‘অপমানস্ করলেন, তিলোত্তমা সুন্দরী!! আজ আপনার হাসির মতো আমার হাসি সুন্দর নয় বলে এভাবে অপমান করলেন!
কুহু বলে উঠলো
-‘ফ্ল্যার্ট করছেন?
-‘আসতাগফিরুল্লাহ! কিসব বলেন আপনি?
কুহু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
-‘আপনাকে আগেও বলেছি আমি।আপনি যাকে চাইছেন তাকে নয় যে আপনাকে চায় তাকে বেছে নিন।
আহনাফ বলে উঠলো
-‘আমাকে চায় না কে? আপনি বাদে প্রত্যেকটা মেয়েই আমার জন্য পাগল।এখন তাদের সবাইকে তো আর আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না।তাই না?
কুহু বিরক্ত হলত বড্ড।ঘরের বিরিয়ানি রেখে বাইরের পান্তা ভাতের দিকে নজর দেওয়াটা কি প্রত্যেক পুরুষের স্বভাব?ঘরের সুন্দরী চাচাতো বোন’ই তো তোকে চাইছে। সেটা কেন বুঝছিস না খাটাশ! কুহু দরকার পড়ে সিঙ্গেল মরবে তাও তো তোকে বিয়ে করবে না।কারণ তুই যে রোদের স্বপ্নের রাজকুমার আহনাফ আলম। কুহু বলে উঠলো
-‘একটু খেয়াল করে দেখবেন আপনার আশেপাশেই আছে হয়তো কেউ যে আপনাকে মনে প্রাণে চাইছে।তাকে এক্সেপ্ট করে নিন আর আমাকে জ্বালায়েন না।আমি আপনার নই।নিজেকে বুঝিয়ে নিন এই কথাটা…আর হ্যাঁ..এই যে কল কাটলাম দ্বিতীয়বার যেন আর কল না আসে।বাই…
কুহু কথাগুলো বলেই কল কেটে দিল।আহনাফ ঠোঁট কামড়ে তাকালো ফোনের দিকে। তিলোত্তমা কি করে এই কথাটা বলে দিল যে সে অন্য কারো! তার জিহ্বা কাঁপলো না একবারও এই কথাটা বলতে গিয়ে! নিষ্ঠুর মেয়ে মানুষ! আহনাফ ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো…
-‘তোমাকে যদি আমার কোলবালিশের সতীন না বানিয়েছি তো আমার নামও আহনাফ নয়, তিলোত্তমা সুন্দরী…মাইন্ড ইট..
-‘নবাবজাদীর ঘুম ভাঙেনি এখনো…! ঘরের কাজগুলো কে করবে হ্যাঁ? এই মুখপুড়ি…
আনোয়ারা বেগমের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙলো কুহুর।কোনোমতে উঠে বসলো।পুরো শরীরে ব্যথা।শরীর’টাও কেমন গরম।জ্বর এসেছে বোধহয়।কুহু ঘড়ির দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো।দশটা বেজে গেছে! কুহুর ভেতরে তুফান শুরু হয়ে গেল।ফজরের নামাজটা পড়ে একটু গা এলিয়ে দিয়েছিল বিছানায়।তখন’ই চোখটা লেগে গেছে তাহলে। এখন কি হবে? কুহু নিজের দুই গালে হাত রাখলো।একটা মারও আজ মাটিতে পড়বে না রে..! এদিকে আনোয়ারা বেগম অনবরত দরজা ধাক্কাচ্ছে।গেলেও বিপদ না গেলেও বিপদ।ভয়ে কুহুর শরীর ঘেমে গেল। যা! জ্বরও ছেড়ে দিল!
এদিকে আনোয়ারা বেগম কুহুর সাড়া শব্দ না পেয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। কি হলো এই মেয়ের? কখনো তো এমন করে না।ঠিক আছে তো? ভদ্রমহিলার ভয় হতে লাগলো।সে আয়ানকে গিয়ে ডেকে আনলো।আয়ানকে আজ সকালেই ডিসচার্জ করে দিয়েছে।মূলত সে’ই পাগল হয়ে গিয়েছিল বাসায় আসার জন্য।আয়ান দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিল।আনোয়ারা বেগমের ভয়ে আত্মা লাফাচ্ছে।যত যাই বলুক সে এই মেয়েকে তো সে নিজের মেয়ের মতোই মনে করে।ঐ একটা ঘটনার জন্য মেয়েটাকে দোষারোপ করলেও সে কখনো মেয়েটার ক্ষতি চায়নি।তাও তো আজও নিজের কাছে রেখে দিয়েছে।কোনো খারাপ পরিবারে মেয়েটাকে দেয়নি।আল্লাহ’র কাছে খুব করে চাইলো সে যেন খারাপ কিছু না হয়।
আয়ান বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর সফল হলো।দরজা খুলতেই নজরে এলো কুহু মেঝেতে চিতপটাং হয়ে পড়ে রয়েছে। আনোয়ারা বেগম চেঁচিয়ে উঠলেন–“কুহুউউউ..!”
কুহুর আত্মাটা এহেন চিৎকারে বেরিয়ে গিয়েও যেন গেল না।মটকা মেরে পড়ে রইলো।মারের হাত থেকে বাঁচার এটাই একমাত্র উপায়।এদিকে আয়ান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।আনোয়ারা বেগম কুহুর মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে কান্না জুড়ে দিলেন।
-‘কুহু…মা চোখ খোল..কুহু..
কুহুর বুঝে আসলো না যে এরা আসলে কাঁদছে কেন।মরে গেছে মনে করছে নাকি আবার? শিট্! এমন সময় আনোয়ারা বেগম বলে উঠলেন
প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ৬
-‘ওও আয়ান..মেয়েটা এভাবে অভিমান করে চলে গেল….
কুহুর পিলে চমকে উঠলো এটা শুনে।সে মরে গেছে! হায় আল্লাহ! মামি একটু বেশিই ইমোশনাল হয়ে গেল না!ডিরেক্ট মেরে না দিলেও পারতো। আয়ান কুহুর পাশে বসে ওকে ডাকতে লাগলো
-‘এই কুহু..সুহাসিনী..চোখ খোল না…সুহাসিনী..
কুহু মনে মনে বলতে লাগলো
-‘তোর পা/দের সুহাসিনী! বা/ল! পানি তো ছেটা চোখে…. তা না করে কানের কাছে মরা কান্না জুড়ে দিছে। এটা কি বাংলা সিনেমা পেয়েছিস যে তোর ভালোবাসার জোড়ে চোখ মেলে তাকাবো!
