প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ২
Drm Shohag
তারেক নেওয়াজ গম্ভীর চোখে ছেলের আটকানো দরজার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। এরপর স্ত্রী রুমার দিকে তাকালে দেখল তার স্ত্রী কটমট দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে। তারেক নেওয়াজ গলা ঝেড়ে বলল,
“ত্যাড়া ছেলে তো তোমার। আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছ কেন, আজব!”
রুমা নেওয়াজ ফোঁসফোঁস করতে করতে বলে,
“হয়েছে তোমার ছেলেকে বিয়ে করানো? সাধ মিটেছে?”
তারেক নেওয়াজ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলে,
“না মেটেনি।”
“মানে? তোমার লজ্জা করে না? ছেলে একটা বউ কেই ছুঁড়ে ফেলছে, আবার আরেকটা করানোর স্বপ্ন দেখছ?”
তারেক নেওয়াজ ভোতা মুখে বলে,
“আনুষ্ঠানিক বিয়ে তো হয়নি। সে বিয়ে না হওয়ার আগেই সাধ কেন মিটবে? দ্বিতীয় বিয়ের করাবো কেন?”
রুমা নেওয়াজ বোকা চোখে তাকালেন স্বামীর পানে। এরপর রাগে গজগজ করতে করতে ধুপধাপ পা ফেলে ঘরের দিকে যায়। শব্দ করে বলে,
“যা ইচ্ছে কর। তোমার ছেলের বউ কে যেখানে ইচ্ছে রাখো। আমাকে এসবে জড়াবে না।”
পিছন থেকে তারেক নেওয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুটা দূরেই মাইরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তারেক নেওয়াজ এগিয়ে গেলেন মাইরার দিকে। মাইরার গায়ে লাল শাড়ি জড়ানো। মাথার উপর লাল হিজাব বাঁধা। তারেক নেওয়াজ মাইরার মাথার উপর হাত রেখে নরম গলায় বলেন,
“আম্মু ভয় পাচ্ছ?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাইরা মাথা নিচু করেই দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর জানায়। তারেক নেওয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনি বুঝতে পারছেন না, এই পরিস্থিতিতে আসলে কি করা উচিৎ। তার ছেলের রাগ সম্পর্কে তার ধারণা আছে। তার আরেকটা ভোলাভালা ছেলে থাকলে ইরফানের দিকে আর নজর দিতেন না। কিন্তুু ছেলে যে একটাই। তার বন্ধুর এই মেয়েকে ছেলের বউ করা বহু দিনের স্বপ্ন। বন্ধু বেঁচে নেই বলে সব ভুলে যেতে পারেন কীভাবে?
মাইরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“এসব কিছু ভুলে যাও। এখন থেকে তুমি আমার মেয়ে। বুঝেছ? আমার মেয়ে আমার বাসায় থাকবে। আর কোনোদিকে মন দিবে না। শুধু পড়াশোনায় মন দিবে বুঝেছ?”
মাইরা অবাক হয়। বাড়ির অন্য মানুষদের ব্যবহার যতটা করুণ, এই লোকটার ব্যবহার তার চেয়ে হাজারগুণ ভালো।
তারেক নেওয়াজ মাইরার হাত ধরে একটি ঘরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন। মাইরা নিরবে তার শ্বশুরের পিছু পিছু যায়।
মাইরা তারেক নেওয়াজ কে চেনে। ইনি তাদের বাড়িতে বেশ কয়েকবার গিয়েছিল। তার ভালোমন্দ জিজ্ঞেস ও করতো। সবচেয়ে বড় কথা ইনি যে তার বাবার বন্ধু ছিল এটা সে জানতো। কিন্তুু তার পরিবারের কাউকে কখনো দেখা হয়নি। বিয়ে হওয়ার সুবাদে সবাইকে দেখা হলো, সাথে সবার আচরণও দেখা হলো। ডান হাতে চোখ মুছে নিল। তার আব্বু মারা যাওয়ার পর থেকে তার জীবনটা এমন-ই হয়ে গিয়েছে। তবুও গ্রামে হেসে খেলে দিন কেটেছে। কিন্তুু এখানে কি করে থাকবে?
ইনায়া তার খালাতো বোনের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। গ্রাম তার ভালো লাগে বেশ। কিন্তুু তার খালাতো বোনসহ তার বান্ধবীরা সবাই মিলে একটা ট্যুর দিবে ঠিক করে। সে কী এই সুযোগ হাতছাড়া করে? ফটাফট চলে এসেছে খালার বাড়ি। বাবা মা ভাইয়া কেউ রাজি না। তাকে একা যেতে দিবে না কিছুতেই। এরপর সে জেদ দেখিয়ে বলেছে ট্যুরে যাবে না, তবে খালার বাড়ি যাবে। একপ্রকার কাউকে না বলেই ঘুরে এসেছে। এবার কেউ না জানলেই হলো। তার খালা বলবে না। তার খালা তার বান্ধবী বলা যায়।
সারাদিন জার্নি করে শরীর জুড়ে ক্লান্তির ছড়াছড়ি।
এর মাঝেই একটু আগে তার বাবা ফোন দিয়ে জানায় তার ভাইয়ের নাকি বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কথাটা শুনে সে হজম করতে পারছে না। ওপাশ থেকে তারেক নেওয়াজ হ্যালো হ্যালো করছে। এপাশে ইনায়ার খবর নেই। ইনায়ার খালাতো বোন জাহারা ঘরে এসে ইনায়াকে এভাবে তব্দা খেয়ে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়। এগিয়ে এসে ইনায়াকে ঝাঁকি দিয়ে বলে,
“এই কি হয়েছে তোর? খালু ওপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করছে, তুই জবাব দিচ্ছিস না কেন?”
ইনায়া ভ্রম থেকে বেরিয়ে ঝাঁকি দিয়ে উঠল। ফোন লাউডে থাকায় জাহারা শুনতে পেয়েছে ইনায়ার বাবার গলা। ইনায়া কোনোরকমে বাবাকে বলল,
“বুঝেছি বাবা। কালকেই আসছি খালামণিদের সবাইকে নিয়ে। এখন রাখছি। বাই বাই বাই।”
বলেই কল কেটে দেয়।
জাহারা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে ইনায়ার দিকে। ইনায়া হাতের ফোন রেখে খুশিতে জাপ্টে ধরে জাহারাকে। এরপর জাহারার দু’হাত ধরে ঘুরতে থাকে। হাসতে হাসতে বলে,
“আপু আপু, অনেক বড় অসাধ্য সাধন হয়েছে। আমার বিশ্বাস-ই হচ্ছে না।”
জাহারা বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুই কি আমাকে বলবি হয়েছে টা কি? তোর কি বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
ইনায়া তার ঘোরানি থামিয়ে প্রফুল্ল কণ্ঠে বলল,
“আপু আপু, বিয়ে আমার ঠিক হয় নি। তবে একজনের বিয়ে অলরেডি হয়ে গিয়েছে।”
“মানে? কার?”
ইনায়া হেসে বলতে থাকে,
“ইরফান ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তুমি ভাবতে পারছ ইরফান ভাইয়ার বউ হয়ে গিয়েছে। কাউকে না জানিয়ে এভাবে বিয়ে দেয়ার কারণ জিজ্ঞেস করবেনা তোমরা জানি। কারণ সবাই ভাইয়াকে জানো। সবাইকে না জানানোর চেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে ইরফান ভাইয়ার না-কি বিয়ে হয়েছে। ওয়াহ! কিভাবে সম্ভব? আ’ম সো এক্সাইটেড, ভাবিকে দেখার জন্য।”
জাহারা স্তব্ধ চোখে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরফান ভাই বিয়ে করেছে? তার কাছে অবিশ্বাস্য লাগলো।
ইনায়া তার ফোন নিয়ে ইরফানকে সরাসরি ভিডিও কল দেয়। সে একনজর তার ভাবিকে দেখতে চায়। তার ত্যাড়া নাম্বার ওয়ান ভাইকে বিয়ে করেছে মানে সেই মেয়ে কতটা স্ট্রং হবে সেটাই ইনায়ার ভাবনায়। ইনায়া ফোন দিলে প্রথমবার রিসিভ হয়না। মেয়েটার মন খারাপ হয়। ফোন রেখে দেয়। মন খারাপ করে জাহারার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আজ ওদের বিয়ের প্রথম রাত, আমার হয়তো কল করা উচিৎ হয়নি তাই না আপু? আসলে এক্সসাইটমেন্টে কল দিয়ে দিয়েছি।”
তখনই ইনায়ার ফোন বেজে ওঠে। ইনায়া দ্রুত ভাইয়ের কল রিসিভ করে কিছু বলার আগেই ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
“ট্যুর কেমন হলো?”
ইনায়ার হাসি হাসি মুখটা মুহুর্তেই চুপসে যায়। ঢোক গিলে। তার ভাই কিভাবে জানলো সে ট্যুরে গিয়েছিল? সে তো কাউকে বলেনি।
ইরফান টেবিলের উপর ল্যাপটপ রেখে সোফায় বসে ভার্সিটির কাগজপত্র গুছিয়ে রাখছিল। ইনায়ার নিরবতায় কাজ করতে করতে গম্ভীর গলায় বলে,
“বাসা থেকে বের হওয়া এটাই লাস্ট ছিল তোর। আর তোর পাশের গর্ধব আমার হাতে বে-হিসাব থাপ্পড় খাবে। ওকে রেডি থাকতে বলিস।”
জাহারার কোনো ভাবান্তর নেই। ইনায়া বারবার ঢোক গিলছে। কোন দুঃখে যে কল করতে গেল। এখন নিজেই বাঁশ খাচ্ছে। প্রসঙ্গ পাল্টাতে মেকি হেসে বলল,
“ভাইয়া কংগ্রাচুলেশনস!”
ইনায়ার কাজে ডুবে থেকেই ভ্রু কুঁচকে বলল,
“হোয়াই?”
ইনায়া অবাক হলো। বিয়ে করেছে। সে কংগ্রেস করছে। অথচ তার ভাই বলছে কেন সে কংগ্রেস করছে। তার মাঝে আবার এসব কাজ বাজ করছে। নতুন বউ রেখে এসব কি করছে তার ভাই? ভাবনা রেখে বলল,
“ভাবিকে দেখতে চাই। ক্যামেরা টা একটু ঘোরাবে ভাইয়া?”
ইরফানের হাত থেমে যায়। ভ্রু কুঁচকে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কার ভাবি?”
ইনায়া বিরক্ত হয়ে বলে,
“আমার ভাবি, তোমার বউ।”
কথাটা শোনার সাথে সাথে ইরফান রেগে ল্যাপটপ ঠাস করে বন্ধ করে দেয়। ওপাশে ইনায়া তব্দা খেয়ে যায়। কি হলো? জাহারার দিকে খেয়াল করলে দেখল, সে উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়েছে। ইনায়া এগিয়ে গিয়ে বলল,
“জাহারা আপু, ভাইয়া তো রেগে গেল।”
জাহারা কোনো কথা বললো না। ইনায়া হতাশার শ্বাস ফেলে বলে,
“ভাইয়া হয়তো শুধু কবুল বলেছে। বউ মানছে না। এখন কি হবে?”
জাহারা উৎফুল্ল হয়ে বলল,
“সত্যি?”
ইনায়া ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। বুকে থুতু দিয়ে বলে,
“তাই তো মনে হলো। কিন্তুু তুমি খুশি হচ্ছো কেন?”
জাহারা থতমত খেয়ে মন খারাপ করে বলল,
“এমনিই। তুই ঘুমা।”
গত দুই ঘণ্টা যাবৎ ইরফান বেলকনিতে পায়চারি করছে। তার মাথায় আগুন জ্বলছে। কাজে ব্যস্ত হয়ে ভুলেই গিয়েছিল তার গলায় বাচ্চা ঝুলেছে। ইনায়া বলায় মনে পড়ল। তারপর থেকেই অসহ্য লাগছে। শরীর থেকে শার্ট খুলে ফেলেছে। উদাম শরীরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ইরফান ফোস করে শ্বাস ফেলে দ্রতপায়ে ওয়াশরুমে যায়। শাওয়ার অন করে দেয়। চোখ বুজে পুরো ৩০ মিনিট স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শক্তপোক্ত শরীর বেয়ে পানির কণা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। ইরফানের রাগ যেন কমার নয়। রাগের চোটে হাত মুঠো করে দেয়ালে দু’টো পাঞ্চ মারে।
নিজেকে বৃথা সামলানোর চেষ্টা করে। এরপর শাওয়ার শেষে বের হয়ে, রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। হাতঘড়িতে একবার সময় দেখল, ১২:৩০।
মাইরাকে তার শ্বশুর একটা ঘরে দিয়ে গিয়েছে। কোনো প্রবলেম হলে তাকে জানাতে বলেছে। শাড়ি পাল্টে একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে নিল। এরপর নামাজ পড়ে নিল। অতিরিক্ত কান্নার ফলে মাথা ব্য’থা বেড়েছে। তার ব্যাগে টাফলিন থাকে সবসময়। অতিরিক্ত কান্নার ফলে মাঝে মাঝেই এই টাফলিন তার প্রয়োজন পড়ে। আশেপাশে তাকালো, কোথাও পানি নেই। তাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, ডাইনিং এ পানি আছে নিশ্চয়ই। জিরো বাতির আলোয় ডাইনিং আবছা আলোয় ভরপুর। সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। মাইরা লাইট জ্বালালো না। জিরো বাতির আলোয় যা দেখতে পাচ্ছে সে আলোতেই পা টিপে টিপে এগোয়, পাছে কেউ জেগে না যায় সেই ভয়ে। ডাইনিং টেবিলের উপর এক জগ ভর্তি পানি পেয়ে খুশি হলো মেয়েটা। কোনোদিকে না তাকিয়ে উল্টো ঘুরে আসতে নিলে হঠাৎ-ই শক্ত কিছুর সাথে তার পিঠ ধাক্কা খায়। মাইরা ভয় পেয়ে যায়। এমনিতেই চারদিকে অন্ধকার, ভয়ে ভয়ে চারপাশে একবার চোখ বুলালো। পিছনে ফেরার সাহস পাচ্ছে না। বার বার ঢোক গিলছে। একহাতে জগ, আরেকহাতে মুখ চেপে আছে। এক্ষুনি গলা ফেটে চিৎকার দিলে কি বাজে অবস্থা হতো!
ইরফান বাইরে বেরচ্ছিল। হঠাৎ-ই তার পিঠে এসে কিছুর ধাক্কা লাগে। ভ্রু কুঁচকে পিছন ফিরে তাকায়। ঝাপসা আলোয় বুঝল, কোনো মেয়ে। গোসল করে মাথা ঠাণ্ডা না হলেও শরীর ঠাণ্ডা হয়েছিল। কিন্তুু যখন বুঝল সেই বাচ্চা মেয়েটা এটা, রাগ যেন তরতর করে বেড়ে আবারও শরীর উত্তপ্ত হতে লাগলো।
আপাতত বাসায় তার বাবা মা ছাড়া কেউ নেই। বাকি এই উটকো ঝামেলা। ইরফান মেয়েটাকে না দেখলেও খুব ভালোই বুঝল এটাই সেই মেয়ে।
মাইরার মাথা ব্য’থা সারানোর ইচ্ছে পালিয়েছে। সে এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। দৌড় দেয়ার জন্য এক পা বাড়ালে ইরফান মাইরার কোমড় সমান ঝুঁটি করা চুল ডান হাতে টেনে ধরে। হাতে ঘুরিয়ে দু’বার পেঁচায়। মাইরা ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে এবার ইরফানের বুকে গিয়ে ধাক্কা খায়। ইরফান বাম হাতে মাইরাকে ঠেলে তার থেকে সরিয়ে দেয়। তবে চুলের গোছা ছাড়ে না। শক্ত হাতে চেপে দাঁতে দাঁত চেপে নিরেট কণ্ঠে বলে,
“সামনে আসতে নিষেধ করেছি, এজন্য পিছে এসেছ?”
মাইরা কেঁপে ওঠে। সে বুঝল এটা তার স্বামী নামক জম। ইরফান একই কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আন্সার মি।”
মাইরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। চুলের গোছা শক্ত হাতে ধরায় ব্য’থায় পায় মেয়েটা। দু’হাতে জগ চেপে কিছু বলতে চায়, তার মাঝেই ইরফান দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আর একবার যদি দেখেছি আমার সামনে, পিছে, ডানে, বামে এসেছ তো থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিব। ড্যাম ইট।”
কথাটা বলেই মাইরাকে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলে সামনের দিকে। মাইরা কয়েক পা এগিয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। জগের পানি থেকে কিছুটা পানি তার জামায় পড়ে যায়। মাইরার রাগ লাগলো। সে পানি নিতে এসেছিল, এই বেয়া’দব লোকের সামনে পিছনে ডানে বামে কেন যাবে। রাগে উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়। আবছা আলোয় দেখল পিছন থেকে লোকটির অবয়ব বেরিয়ে যাচ্ছে। মাইরা হাতে থাকা জগের পানি ইরফানের দিকে ছুঁড়ে মারে। ইরফানের পা থেমে যায়।
মাইরাকে আর কে পায়। ডান হাতে জগ শক্ত করে ধরে, বাম হাতে সালোয়ার কিছুটা উঁচু করে ধরে দৌড় তার ঘরের দিকে। যেতে যেতে পিছু ফিরে বলে,
“আপনার পিছনে সামনে ডানে বামে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। ওমন ভদ্র বাবার এমন বেয়া’দব ছেলে কীভাবে হয়েছে আল্লাহ-ই জানে।”
কথাগুলো বলাও শেষ, তার ঘরে পৌঁছানোও শেষ। ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
এদিকে ইরফান সাপের মতো ফোঁসফোঁস করছে। মাত্র গোসল করে বেরচ্ছিল, আর এই বেয়া’দব মেয়ে তার গায়ে পুরো এক জগ পানি ঢেলে দিয়েছে। আবার তাকে বেয়া’দব বলে গেল। ইচ্ছে করছে দরজা ভেঙে ওই মেয়েকে পাগলা কুকুরদের মাঝে ছেড়ে দিয়ে আসতে।
ধুপধাপ পা ফেলে বাইরে বেরিয়ে যায়। দরজা আটকে দু’হাতে ঝাঁকড়া চুল টেনে ধরে। কয়েকবার এপাশ-ওপাশ করে গায়ের জোরে দরজায় একটা লাথি বসায়। হিসহিসিয়ে একা একাই বলে,
“আই উইল যাস্ট কি’ল ইউ, ইডি’য়েট গার্ল।”
এরপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়।
এদিকে মাইরা অসহায় চোখে জগের দিকে তাকিয়ে থাকে। পানি নিতে গিয়ে ফাঁকা জগ নিয়ে চলে আসল। আবার তার রাগও হলো। কি পরিমাণ খা’রা’প হলে বিয়ের রাতে বউকে অস্বীকার করে। ওমন বরের পিছনে মাইরা ঘুরবে? সে ওতো সস্তা না-কি! ঠিক করেছে পানি ছুঁড়েছে, যা বলেছে সেটাও ঠিক বলেছে। সে ওতো সাদাসিধে নয়, কিন্তুু সে যা করল আর বলল, আগামীকাল তার কি হবে? তা ভেবেই একটা ঢোক গিলল। আবার ভাবল, কিছুই হবে না। এই লোকের বাবা খুব ভালো। এটা ভেবে একটু সাহস উদয় হলো তার মনে।
মাথা ব্য’থা বাড়তে লাগলো। পানি ছাড়া কিভাবে ওষুধ খাবে? বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে গিয়ে শুয়ে পড়ল। এই মাথা ব্য’থায় আজ আর ঘুম হবে না। উফ!
অনবরত বেল বাজানোর শব্দে শুদ্ধ বারবার এপাশ-ওপাশ করছে। ঘুমের মাঝেই বিড়বিড় করল,
“কোন মাতাল রে, মাঝরাতে আমার বাড়ি এসে মাতলামি করছিস, ব্যাটা বেয়া’দব। যা ভাগ।”
বিড়বিড় করতে করতে আবারও ঘুমিয়ে যায়। নাহ, থামাথামির নাম নেই। শুদ্ধ বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়। পাশ থেকে ফোন নিয়ে সময় দেখল, ১ টা বেজে ২০ মিনিট। শুদ্ধ অলসতা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘুমঘুম ভাব নিয়ে দরজা খুলে সামনে তাকিয়ে ইরফানকে দেখে ঘুম উবে গেল। বউ কে রেখে তার কাছে এসেছে কেন? না-কি সে তার ভাইকে একটু বেশিই মিস করছে বলে মাতালকে ইরফান রূপে দেখছে? নিজের ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হলো। একে মিস করবে কোন দুঃখে! এর ঝাড়ি আবার কোন বলদ মিস করবে? দু’হাতে চোখ কচলে বলে,
“কে তুমি বৎস?”
ইরফান বিরক্ত হয়ে শুদ্ধর পাশ কেটে ভেতরে গেল। শুদ্ধ দরজা আটকে পিছু পিছু আসতে আসতে বলল,
“কি রে? উত্তর দে। এতো রাতে এখানে কি? বউ বের করে দিয়েছে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! একটা বাচ্চা তোকে বের করে দিল? বিয়ে করতে না করতেই এই হাল?”
ইরফান রেগে শুদ্ধর কলার ধরতে নিলে শুদ্ধ মেকি হেসে বলে,
“শরীরে কিছু নেই, কলার কই পাবি? তোর প্রবলেম হলে আমি শার্ট পরছি।”
ইরফান শুদ্ধর মাথার চুল মুষ্টি করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আর একটা বাজে কথা বলবি না। স্টপ।”
শুদ্ধ কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলল,
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমার সব এমন টানাটানি করার কোনো মানে হয়? শার্ট, চুল,, কবে না জানি বউয়ের সম্পদ ধরেও টান দিয়ে দিস। সর সর।”
ইরফান ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। এই বেয়া’দব ভাঙা রেডিওকে কিছু বলেও লাভ নেই। শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কেউ কি মরেছে? চল্লিশার দাওয়াত দিতে এসেছিস? আমি নিজেই চলে যেতাম। এতো কষ্ট করে আসলি কেন?”
ইরফান শক্ত চোখে তাকায় শুদ্ধর দিকে। শুদ্ধ মেকি হেসে বলে,
“জানি জানি এসব আমার ধর্মে ঠিক নয়। এভাবে তাকাচ্ছিস কেন, একটু মজাও করতে দেয় না। কি দিনকাল আসলো।”
ইরফান তার শরীর থেকে হালকা ভেজা শার্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলে শুদ্ধর বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আরে এটা আমার বিছানা। তুই তোর বাড়ি যা। কাল ভার্সিটি আছে। একটু ঘুমাতে দে।”
ইরফান চোখ বুজে বলল,
“ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।”
শুদ্ধ হা করে তাকালো। তার বাড়িতে এসে তার ঘুম ভাঙিয়ে তার বিছানা দখল করে বলছে, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি! ওয়াহ! নাইস জোক্স। দাঁত কিড়মিড় করে ইরফানের গায়ের উপর ধপ করে শুয়ে পড়লে ইরফান এক লাথি দিয়ে শুদ্ধকে ফেলে দেয়। শুদ্ধ ঠাস করে মেঝেতে পড়ে চোখমুখ কুঁচকে নেয়। ইরফান চোখ বুজে, যেন কিছুই হয়নি। শুদ্ধ কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলল,
“মীরজাফর ও এর চেয়ে ভালো ছিল। শালা সন্যাসী বউকে মানবি না ভালো কথা নয়, কিন্তুু এখানে এসে আমার ঘুম কাড়ছিস কেন? এটা তো আরও ভালো কথা নয়।
তোর বউকে আমায় দিয়ে দে তো। তুই তোর বাড়ি বিদেয় হো, যাহ।”
ইরফান পাশ থেকে একটা বালিশ নিয়ে শুদ্ধর দিকে ছুঁড়ে বলল,
“রেডিও অফ করে ঘুমা।”
শুদ্ধ দাঁত কিড়মিড় করল। বালিশ নিয়ে ঠাস করে মেঝেতেই শুয়ে পড়ল। যার এমন বন্ধু রূপী ভাই আছে তার জীবনে এর চেয়ে বেশি সুখ নেই।
কিছুক্ষণ পর ইরফান শোয়া থেকে উঠে ওয়াশরুমে যায়। চোখমুখে পানি দিয়ে এসে শুদ্ধর পেটে পা দিয়ে খোঁচায়।
শুদ্ধ রেগে বল,
“আবার কি রে ভাই? ঘুমোতে দে। সবাই তোর মতো রোবট না-কি, সারারাত জেগে কাল ক্লাস নিতে পারব না। ঘুমাতে দে।”
ইরফান গম্ভীর গলায় বলল,
“উপরে যা, ঠাণ্ডা লাগবে।”
শুদ্ধ বালিশ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। পরনের ট্রাউজার উপর দিকে টেনে তুলে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“এ্যাহ ঢং দেখ, আলগা পিরিত।”
ইরফান কিছু বলল না। শুদ্ধর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। শুদ্ধ ইরফান কে জাপ্টে ধরলে ইরফান রেগে বলে,
“আরেকটা লাথি খেতে না চাইলে দূরে যা।”
শুদ্ধ অসহায় মুখ করে আরও জাপ্টে ধরল। কোলবালিশ পেলে কে ছাড়ে। ইরফান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে চোখ বুজল। বেশ অনেকক্ষণ সময় পেরিয়ে গেলেও ইরফানের চোখে ঘুম ধরা দেয় না। এভাবে কেউ জাপ্টে ধরলে ঘুমানো যায়? একটু পর পর শুদ্ধকে খোঁচাতে লাগলো পা দিয়ে। শুদ্ধ ঘুমের মাঝেই বিরক্ত হয়ে ইরফানকে আরও জাপ্টে ধরে।
ইরফান রেগে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। সে জানে এই বেয়া’দব টা তাকে ঘুমোতে দিবে না। আজ আর তার ঘুম হবে না। বিরক্তির শ্বাস ফেলে বেলকনিতে যায়।
বসন্তকালের শুরু। প্রকৃতি জুড়ে মিটিমিটি ঠাণ্ডা বাতাস। মাঝরাতের দমকা হাওয়া ইরফানের উদাম শরীর ছুঁয়ে দেয়। ইরফান গম্ভীর মুখাবয়বে একমনে চেয়ে থাকে। তার মনে কি চলে সেই জানে।
প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ১
মেয়েটার ফেলা পানি গায়েই শুকিয়েছে। কথাটা মনে পড়তেই মেজাজ সোজা ৩৬০° অ্যাঙ্গেলে ঘুরে লো থেকে হাই হয়ে গেল। ওই পুচকি মেয়ে আজ এসে আজকেই তার গায়ে পানি ছুঁড়েছে। এতো সাহস হলো কি করে? ডান হাত পকেটে রেখে এপাশ-ওপাশ পাইচারি করতে করতে একসময় দাঁড়িয়ে যায়। বামহাতে দেয়ালের সাথে একটা পাঞ্চ মারে। রাগ কমে না। এই পাঞ্চ ওই মেয়ের মুখে মারতে পারলে হয়তো রাগ কিছুটা কমতো।