প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৪

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৪
Drm Shohag

ইনায়া তার খালা, সাথে জাহারা আর জাহারার বড় ভাই জাহিদ ইরফানদের বাসায় এসে পৌঁছেছে সন্ধ্যায়। ইনায়া মন খারাপ করে বসে আছে। সে তার ভাবিকে দেখার জন্য এতো এক্সাইটেড। এসে দেখে তার ভাবি বাসায়তেই নেই। তার বাবা নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। ইনায়া ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছে। তার পাশের টেবিলে জাহারা বসে। আশেপাশে বারবার চোখ বুলায়। কিন্তুু কাঙ্ক্ষিত মানুষকে দেখতে না পেয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে। কিছুক্ষণ পর ইনায়াকে জিজ্ঞেস করে,
“ইরফান ভাই কোথায়?”
ইনায়া খেতে খেতে বলে,
“শুদ্ধ ভাইয়ের বাসায় হয়তো। আম্মু কল করেছিল, চলে আসবে।”
জাহারা খুশি হলো কথাটা শুনে। কিন্তুু ইরফান ভাই বিবাহিত ভাবতেই মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর জাহিদ এসে ইনায়াদের উল্টো পাশে বসে। ঠিক সেই সময়-ই কেউ বেল বাজায়। কাজের মেয়ে রিতা যেতে নিলে জাহিদ তাকে থামিয়ে নিজেই যায়। ইরফান এসেছে হয়তো, এ ভাবনায় সে নিজেই দরজা খুলতে যায়। ইরফানের সাথে তার দহরম মহরম সম্পর্ক নয়, তবে টুকটাক কথা বলে। যদিও সে ইরফানের চেয়ে দুই বছরের ছোট।
দরজা খুলে সামনে তার খালু তারেক নেওয়াজকে দেখে সালাম দেয়। পাশে মাইরাকে দেখে অবাক হয়ে বলে,

“খালু এটা ইরফান ভাইয়ার বউ?”
তারেক নেওয়াজ মৃদু হেসে বলে,
“হ্যাঁ।”
জাহিদ মাইরার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
“হাই! নাইস টু মিট ইউ।”
মাইরা আমতা আমতা করে। অপরিচিত ছেলের সাথে হাত মেলাবে, কেমন যেন লাগছে। নিজের সংকোচন কাটাতে না পেরে ছোট করে একটা সালাম দিল। জাহিদ ভ্রু কুঁচকে সালাম এর উত্তর নিয়ে তার হাত সরিয়ে আনে। তার খালুর দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই ছোট পুতুলকে কোথায় পেলেন খালু?”
তারেক নেওয়াজ ভেতরে যেতে যেতে বলে,
“ভাগ্যে ছিল তাই পেয়েছি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাইরা বোকা চোখে জাহিদের দিকে চেয়ে আছে। জাহিদ হেসে বলে,
“তুমি তো অনেক ছোট। আমি তোমাকে তুমি করেই বলছি। তোমার নাম?”
মাইরা জোরপূর্বক হেসে উত্তর দেয়,
“জ্বি, মাইরা ইসলাম।”
জাহিদ সাইড দিয়ে বলে,
“ওকে, আমি তোমাকে নাম ধরে ডাকলে মাইন্ড করবে? তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোট। ইরফান ভাইয়া বেশ রাগী। ভাইয়া অনুমতি দিলে কনফার্ম তোমাকে নাম ধরে ডাকব। ওকে?”
মাইরা বিরক্ত। এক পা’গ’লের থেকে ছাড়া পেয়ে আরেক বেয়া’দবের পাল্লায় পড়ল। ধ্যাত! তবুও জোরপূর্বক হেসে মাথা নাড়ালো। জাহিদ সাইড দিয়েছে দেখে দ্রুত ভেতরে যায়। জাহিদ দরজা আটকে এগিয়ে যায়। ভেতর থেকে ইরফানের খালা বেরিয়ে সোফায় বসে। জাহিদ মাইরার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমি এরকম একটা কিউট পুতুল চাই আম্মু। হাউ সুইট!”
জাহিদের কথায় সবাই হাসল। জাহিদের মা বলল,
“তোমার জন্য মেয়ে ঠিক করেছি আমরা।”
জাহিদ মন খারাপ করে বলল,
“এমন কিউট বাচ্চা পুতুল ছাড়া বিয়ে করব না। ডিসিশন ফাইনাল।”

জাহিদের কথায় মাইরা বেশ বিব্রতবোধ করছে। এতোগুলো মানুষ কারা কাউকেই চিনতে পারছে না মেয়েটা।
ইনায়ার পিঠ সমান চুলগুলো ছেড়ে দেয়া। এসে গোসল করেছে। চুল ভেজা তাই ছেড়ে রেখেছে। খাবার শেষে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মাইরার পাশে এসে দাঁড়িয়ে জাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“জাহিদ ভাইয়া, আমার ভাবির দিকে নজর দিও না তো। যাও।”
ইনায়ার কথা শুনে জাহিদ ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে তার মায়ের পাশে গিয়ে বসে হেসে বলল,
“ওহ হো, ইনায়া আমি তোমার ভাবির দিকে নজর দিইনি। তোমার ভাবির মতো একজনকে চেয়েছি।”
ইনায়া মাইরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“মাশাআল্লাহ। তুমি এতো সুন্দর ভাবি। আমার তো মেয়ে হয়েও হিংসা হচ্ছে।”
মাইরা খুবই বিব্রতবোধ করছে। এরা সবাই তাকে কি এখন জাদুঘরে রাখবে না-কি! একটু নাহয় ফর্সা-ই। মাইরার মনে হলো এরা তাকে পাম দিয়ে ফোলাতে চাইছে। অনেকক্ষণ তো চুপ থাকলো। এখন কথা না বললে পেট ফেটে যাবে। মেকি হেসে বলল,

“তোমরা এই বাসার কে আমি জানিনা। তবে তোমরা সবাই আমাকে পাম দিচ্ছ, আমি ধরে ফেলেছি।”
মাইরার কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে তাকালো। নতুন বউ এর মুখে এমন কথা শুনে সবাই একটু অবাক হয়েছে। মাইরা সবার এক্সপ্রেশন দেখে বুঝল না, সে কী ভুল কিছু বলে ফেলল? ইনায়া হেসে বলল,
“মোটেও পাম দিচ্ছি না, তুমি আসলেই খুব সুন্দর।”
এর মাঝে ইরফানের মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে,
“কি হয়েছে?”
ইনায়া মাইরার হাত ধরে বলে,
“আম্মু ভাবি অনেক কিউট!”
“তো আমি কি করব?”
মায়ের কথায় ইনায়ার মুখ চুপসে গেল। ইনায়া তার বাবার দিকে তাকালে দেখল তার বাবা তার দিকেই গম্ভীর মুখে চেয়ে আছে। ইনায়া বুঝল না মা এভাবে কথা বলছে, বাবা ওভাবে দেখছে। তার ট্যুর এর ব্যাপার কি ভাইয়া বলে দিয়েছে? আপাতত এই ভাবনা রেখে মাইরার দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমি কীসে পড় ভাবি?”
মাইরা মৃদু হেসে বলল,
“আমি এইবার এসএসসি দিব। তুমি আমার বরের বোন তাই না? আমার শ্বাশুড়িকে আম্মু ডাকলে তাই ধরে ফেলেছি।
জাহারা, জাহিদ আর ইনায়ার খালার সবার দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে,
ওনারা সবাই কারা? আমাকে পরিচয় করিয়ে দাও তো আপু।”
মাইরার কথা শুনে ইনায়া হা করে তাকালো। দেখে মনে হচ্ছে মাইরা তার বান্ধবী। মেয়েটার মাঝে কোনো সংকোচ নেই। ইনায়ার ভালোই লাগলো। তবে মাইরা এসএসসি দিবে শুনে অনেক অবাক হলো। এতো ছোট? সে এবার এইচএসসি দিবে। তার এতো বড় ভাইয়ের বউ তার চেয়েও দুই বছরের ছোট? হায় আল্লাহ! অতঃপর বলে,
“তুমি তো অনেক ছোট। আমার চেয়েও ছোট।”
মাইরা হেসে বলল,

“জ্বি আপু। আসলে তোমার ভাই বুড়ো। সে হিসেবে আমি একটু ছোট-ই।”
মাইরার কথা শুনে প্রত্যেকে হা করে চেয়ে আছে। ইরফানের খালার মাইরাকে পছন্দ হলো না। বিরক্ত হয়ে বলল,
“এই বাঁচা’ল মেয়েকে কোথা থেকে তুলে এনেছ আপা?”
রুমা নেওয়াজ কোনো কথা বলল না। তারেক নেওয়াজ গম্ভীর গলায় বলল,
“আমার বউমা কে নিয়ে বাজে কমেন্ট করবে না কেউ।”
তারেক নেওয়াজ এর কথায় জাহারার মা চুপ হয়ে গেল। কিন্তুু মাইরা হেসে এগিয়ে এসে বলল,
“আন্টি আপনি আমাকে বাঁ’চাল বলায় আমি অনেক খুশি হয়েছি। আপনি জানেন, আমি পেটে কথা জমিয়ে রাখতে পারি না বলে আমার হার্ট আপনাদের চেয়ে অনেক ভালো। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি এক্ষুনি পরীক্ষা করলে আমার হার্ট সবচেয়ে ভালো পাওয়া যাবে।”
মাইরার কথায় ইরফানের খালা বিরক্ত হলো। পাশ থেকে জাহিদ হাত তালি দিয়ে বলল,

“কারেক্ট বলেছ তুমি মা’রা।”
মাইরা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“মা’রা কি?”
জাহিদ হেসে বলল,
“তোমার নাম।”
মাইরা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আমার নাম মাইরা, নট মা’রা।”
জাহিদ মাথা চুলকে বলল,
“ওহ স্যরি! ই বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।”
জাহারা বিরক্ত, চরম বিরক্ত মাইরার উপর। কেন যেন ভীষণ রাগ লাগছে। ইচ্ছে করছে মাইরার গালে ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় লাগিয়ে দিতে। কেন এমন ইচ্ছে তার মাঝে উদয় হলো বুঝল না। বিড়বিড় করল,
“ঢঙ্গি একটা। অসহ্য।”
ইনায়া মাইরাকে টেনে জাহারার সামনে নিয়ে গিয়ে বলল,
“ভাবি এটা আমার খালাতো বোন জাহারা।”
মাইরা হেসে জাহারার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে জাহারা বিরক্ত চোখে তাকালো মাইরার দিকে। মাইরা জাহারার এমন বিরক্তি এক্সপ্রেশনে হেসে বলল,

“তুমি কি আমার বেশি কথা নিতে পারছ না বলে বিরক্ত? ঘরে আমার ব্যাগে তুলো আছে। একটু পর তোমাকে এনে দিব কেমন? আসলে আমি বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারি না। স্যরি আপু।”
জাহারা দাঁতে দাঁত চেপে মাইরার দিকে তাকিয়ে আছে। ইনায়া জাহারার কাণ্ডে কিছু বুঝল না। এখানে কিছু বললো ও না। আর এদিকে মাইরা তো ফটাফট মুখের উপর সত্যিটা বলে দেয়। ইনায়া যত দেখছে ততই অবক হচ্ছে। মাইরাকে নিয়ে তার খালাের সামনে গিয়ে বলল,
“এটা আমার খালামণি।”
মাইরা ইরফানের খালাকে সালাম দিয়ে বলল,
“আন্টি মানে খালা। এর আগে আন্দাজে বললেও ঠিকই বলেছি তাই না খালামণি?”
ইরফানের খালা ভ্রু কুঁচকে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। বিরক্তির সীমা পার করছে এই মেয়ে। এরই মাঝে আবারও বেল বাজলে জাহারা বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। একটু আগেই ইনায়ার কাছে শুনেছে, ইরফান আসবে। তাই কাউকে সুযোগ না দিয়ে দ্রুতপায়ে সে দরজা খুলে দিল। ইরফানকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল,
“কেমন আছো ইরফান ভাই?”
ইরফান একবার ভেতরে তাকালো। সবাইকে ডাইনিং এ বসে থাকতে দেখল। এরপর জাহারার দিকে তাকিয়ে ভেতরে যেতে যেতে ছোট করে বলল,

“ভালো।”
জাহারার মন খারাপ হলো। সে কেমন আছে এটা একবার জিজ্ঞেস করলে কি এমন হতো! ইরফান তার খালার সাথে কথা বলার জন্য সেদিকে এগিয়ে যায়। তার খালার সামনে তার উল্টো ঘুরে কেউ দাঁড়িয়ে। ইরফান বিরক্ত হয়ে তার খালার দিকে তাকালো। অসুবিধা হলো না। কারণ মেয়েটা তার বুক সমান। বেশ খাটো। নাহ মেয়েটা খাটো না হয়তো, ইরফানের হাইট একটু বেশি। তাই সেভাবেই তার খালাকে একটা সালাম দিল।
মাইরা একদম তার পিছন থেকে কারো গমগমে কণ্ঠে সালাম শুনে ভ্রু কুঁচকে পিছন ফিরে তাকায়।
ইরফানকে দেখে মাইরার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ভয়ে আতঙ্কে এক চিৎকার দেয়। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে। পিছন দিকে পড়তে পড়তেও ডান হাতে সোফার কোণা ধরে নিজেকে সামলে নেয়। ইরফান ভ্রু কুঁচকে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। মাইরা ভয়ে ঢোক গিলছে বারবার। সবাই বুঝল না মাইরা এভাবে চিৎকার দিল কেন? তারেক নেওয়াজ বসা থেকে উঠলেন। এগিয়ে এসে বললেন,

“কি হয়েছে আম্মু?”
ইনায়া মাইরাকে ধরে বলল,
“কি হয়েছে ভাবি?”
মাইরা ভীত চোখে ইরফানের দিকে চেয়ে ঢোক গিলে কাঁ’পা কণ্ঠে বলল,
“পপা’গ’ল টা আমাকে ফলো করতে করতে বাসায় চলে এসেছে। আমায় কেউ বাঁচাও।”
মাইরার কথা কেউ কিছু বুঝল না। ইরফানের চোখমুখের রঙ পাল্টে গিয়েছে। হঠাৎ-ই মাইরার হাত শক্ত করে ধরে মাইরাকে টানতে টানতে বাইরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। সবাই হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। কি হচ্ছে এসব?
মাইরা ইরফানের হাতে তার অপর হাত দিয়ে সমানে খামচি দেয়। রেগে বলে,
“ছাড়ুন বলছি। আমায় ছাড়ুন। অ’সভ্য লোক, অন্যের বউকে টাচ করতে ল’জ্জা করে না?”
ইরফানকে মুহূর্তের মধ্যে দরজা খুলে মাইরাকে একপ্রকার ছুঁ’ড়ে ফেলে মাইরার মুখের উপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দেয়।

মাইরা ভয়ে কেঁদে দিয়েছে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। এই লোকটা তাকে এভাবে বের করে দিল কেন?
ইরফানের পিছন থেকে তারেক নেওয়াজ রেগে বলে,
“তুমি ওকে বের করে দিলে কেন এভাবে?”
ইরফান তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কারণ ও ইডিয়েট। তাছাড়া যাকে তাকে বাসায় ঢুকতে দাও কেন?”
জাহিদ পাশ থেকে বলল,
“ভাইয়া যাকে তাকে কাকে বলছো। ওই পুতুল টা তো তোমার বউ। নিজের বউকে নিজেই চিনছো না?”
ইরফান ভ্রু কুঁচকে তাকালো জাহিদ এর দিকে। অদ্ভুদভাবে বিড়বিড় করল,
“বউ?”
তারেক নেওয়াজ দ্রুত দরজা খুললেন। মাইরা ভেজা চোখে তাকিয়ে ছিল দরজার দিকেই। দরজা খুলতে দেখে মুখে হাসি ফুটল। দ্রুত ভেতরে এসে ইরফানের হাত ধরে টেনে বলে,
“এই পা’গ’ল বের হ। এটা আমার শ্বশুর বাড়ি। আমার বাড়ি থেকে আমাকেই বের করে দেয়, কত্ত বড় সাহস?”
মাইরার কাণ্ডে সকলে অবাক হয়ে তাকায়। সবচেয়ে বেশি অবাক হয় ইরফানের খালারা। নিজের বরকে এভাবে বলছে কেন? জাহারা এগিয়ে এসে রেগে বলে,

“এই মেয়ে কি করছ?”
তারেক নেওয়াজ নরম কণ্ঠে বলল,
“আম্মু ওকে ছাড়ো।”
মাইরা ভাঙা গলায় বলল,
“আব্বু আপনি দেখছেন না? অন্যের বাড়ি এসে এই পা’গ’ল কেমন পা’গ’লামি করছে। আপনার ছেলের বউকে বের করে দিয়েছে, কত্ত বড় সাহস?”
ইরফান ক্রোধান্বিত চোখে মাইরার দিকে চেয়ে। তার সহ্যের সীমা পার করে দিয়েছে এই মেয়ে। রেগেমেগে মাইরাকে একটা ধাক্কা দিয়ে মাইরার ডান গালে একটা শক্তপোক্ত থাপ্পড় বসিয়ে দিল।
মাইরা উল্টে পড়তে নেয়, পিছনে ইরফানের মা এসে দাঁড়ানোয় মাইরা ইরফানের মায়ের সাথে গিয়ে ধাক্কা খায়।
রুমা নেওয়াজ রেগে মাইরাকে টেনে মাইরার একই গালে কষিয়ে একটা থা’প্পড় মেরে দেয়। মাইরা তাল সামলাতে না পেরে ঠাস করে পড়ে যেতে নেয়, জাহিদ দৌড়ে এসে ধরতে নিলে তার আগেই ইনায়া মাইরাকে ধরে নেয়। মাইরা ফুঁপিয়ে ওঠে। একই গালে মা ছেলের থা’প্পড় খেয়ে মাথা পুরো ঝিমঝিম করছে।
চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে। ওভাবেই বিড়বিড়িয়ে বলে,

“শ্বাশুড়িটা একদম দা’জ্জা’ল এর মতো। ছেলেটাও হুবহু তেমন। কী শক্ত হাত মাইরি, উফ! গাল টা গলে গেল রে।”
কথাগুলো শুধু ইনায়া শুনতে পেয়েছে। সে মাইরার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অবাক হলো মেয়েটা। এতো জোরে মার খেয়েও এ মেয়ের মুখ বন্ধ হয় না।
রুমা নেওয়াজের কাজে সকলে হতভম্ব।
তারেক নেওয়াজ রেগে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,
“রুমা?”
রুমা নেওয়াজ স্বামীকে ভয় পেলেন না বিন্দুমাত্র। পাল্টা রেগে বললেন,
“তোমার বন্ধুর মেয়ের এসব বেয়া’দবি আমি একদম সহ্য করব না। ওর হয়ে সাফাই গাইতে এসো না। ও আমার ছেলেকে এভাবে অপবাদ দিচ্ছে কেন? এমনিতেই ওর জন্য আমার ছেলেটা কালকে থেকে বাড়িতেই আসেনি। আজ বলে কয়ে নিয়ে এসেছি, আর এই মেয়ে আবার ওকে বের করে দেয়ার পায়তারা করছে।”
“তাই বলে তুমি মারবে?”

রুমা নেওয়াজ কিছু বলল না। একটু থেমে বলে উঠল,
“আমার ছেলেকে পুতুল পেয়েছ তুমি? জোর করে বন্ধুর মেয়ের সাথে বিয়ে করিয়ে দিয়েছ। দিয়েছ তো দিয়েছো এমন একটা বে’প’রোয়া মেয়ের সাথে, যে আমার ছেলেকে অপবাদ দিয়েই যাচ্ছে দিয়েই যাচ্ছে।
তুমি আর তোমার বন্ধুর মেয়ে চাইছো আমার ছেলেটা আমার থেকে দূরে থাকুক? ওর ভার্সিটি এখান থেকে দূরে বলে এখানে থাকতে চায় না। ভার্সিটির কাছে বাসা নিয়ে থাকতে চায়। আমি পারিনা, আমার ছেলে আমার কাছ ছাড়া হলে আমি কীভাবে থাকবো? কত বলে কয়ে ওকে এখানে রেখেছি।
তোমার ছেলের যা রাগ জেদ। একবার বাড়ি থেকে বের হলে দেখবে আর আসবেই না। তোমরা সবাই তো ভালোই থাকবে। আমি মা, তাই ক’ষ্ট শুধু আমার-ই হবে।”
কথাগুলো বলতে বলতে রুমা নেওয়াজের চোখ ভিজে যায়।
তারেক নেওয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ইরফান এগিয়ে এসে তার মাকে আগলে সোফায় বসিয়ে দিল। মায়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তার মায়ের দু’হাত তার দু’হাতের মাঝে নিয়ে চুমু আঁকলো। এরপর মায়ের দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

“আমি সবসময় তোমার সাথেই থাকব আম্মু। প্লিজ ডোন্ট ক্রাই।”
রুমা নেওয়াজ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তার ক’ষ্ট হয় ছেলেটার জন্য। ছেলেটা এমন একরোখা, রাগী, বদমেজাজী কেন বোঝে না। মুখ ফুটে কিছু বলে না। হাজার ক’ষ্ট পেলেও মুখ ফুটে বলে না। শুধু রাগ দেখায়। বাইরে থেকে তার ছেলেকে সবাই খা’রা’প ভাবলেও সে তো মা। সে জানে তার ছেলে কেমন। কিন্তুু ছেলেটা তার কথা শোনেনা। কারো কথাই না। মেয়েটা যখন বারবার তার ছেলেকে পা’গ’ল বলছিল ক’ষ্টে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। এই চুল কাঁটার ব্যাপারে সে কত বলেছে, কিন্তুু ইরফানের মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। মাইরা বারবার পা’গ’ল বলায় এসব তার মাথা চারা দিয়ে উঠেছিল। চুল এমন রাখার জন্য তাকে মা হিসেবে অনেকের অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে। বিশেষ করে তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা সব দোষ তাকে দেয়। কারণ সে মা।
ইরফান তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তুু কিচ্ছু বলল না। মাথা নিচু করে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।

চুপচাপ তার ঘরের দিকে যেতে যেতে বাবা কথায় দাঁড়িয়ে পড়ল।
“বিয়ে করা বউ তোমার। মেনে নিতে শেখ। অ’সভ্য ছেলের পরিচয় দিও না।”
ইরফান ঘাড় বাঁকিয়ে বাবার দিকে তাকায়। উপহাসের সুরে বলে,
“মেনে নেয়ার জন্য ছেলের মতামত নিতে হয়, তুমি কেমন সভ্য বাবা যে তার ছেলের গলায় জোর করে একজনকে গছিয়ে দিয়েছ।”
তারেক নেওয়াজ ধমকে ওঠেন,
“ইরফান?”
ইরফান রাগে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করল। বাবার দিকে চেয়ে বলল,
“এই বাচ্চাকে বউ মানি না। মানি না এই বিয়ে। এ নিয়ে আর একটা কথাও বলবে না। বাড়াবাড়ি করলে আম্মুকে নিয়ে এই বাসা থেকে চলে যাব। দ্যাট’স ইট।”
কথাগুলো বলে যাওয়ার সময় শক্ত চোখে একবার মাইরার দিকে তাকালো। মাইরার গালের দিকে নজর পড়লে দেখল, ফর্সা গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। যেন কেটে গিয়েছে। কেঁদেকেটে চোখমুখ রক্তজবার ন্যায় হয়ে গিয়েছে। ফর্সা হওয়ায় বেশি চোখে লাগছে।

মাইরা ইরফানের দিকে তাকালে দেখল ইরফান তার দিকে চেয়ে আছে। ইরফান মাইরার একে অপরের চোখে চোখ পড়ায় মাইরা ভেংচি কেটে চোখ সরিয়ে নেয়।
ইরফান বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড় করে,
“স্টুপিট বাঁদর।”
এরপর হনহন করে তার ঘরের দিকে চলে যায়।
মাইরা বুঝতে পেরেছে সে ভুল। শ্বাশুড়ির হাতের থা’প্প’ড় খেয়েই বুঝেছিল এই লোকটাই এই বাড়ির ছেলে, সবচেয়ে বড় কথা তার স্বামী। নাহ নাহ স্বামী নয়, এটা হলো তার অ-স্বামী। বারবার তাকে অস্বীকার করে, একদিন সেও বলবে, এই যে অসভ্য লোক কান খুলে শুনুন আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে মানি না।’ কথাগুলো বিড়বিড় করছে, আর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।

পুরো ডাইনিং জুড়ে থমথমে। একে একে সবাই সবার ঘরে চলে যায়। জাহারা বিরক্ত চোখে কিছুক্ষণ মাইরার দিকে চেয়ে সেও চলে যায়। তারেক নেওয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে কী সত্যিই ভুল করে ফেলল? মাইরার বাবা বেঁচে থাকতে তার সাথে কথা ফাইনাল হয়েছিল তার মেয়ের বয়স হলেই তার ছেলের সাথে বিয়ে দিবে। কিন্তুু সে পর্যন্ত তো তার বন্ধু বাঁচলো না। তবে তারেক নেওয়াজ নিজের দেয়া কথার অমান্য করল না। তার ছেলের সাথে তার বন্ধুর মেয়ের বিয়ে দিল।
তার ছেলের মেয়েঘটিত কোনো ব্যাপার নেই, এমন হলে সে মনের উপর জোর করত না। কিন্তুু এখন এর পরিণতি কী? কথাগুলো ভাবতেই তারেক নেওয়াজের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।
ভাবনা রেখে এগিয়ে গিয়ে মাইরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“তোমার বাবা আছি তোমার সাথে, বুঝেছ আম্মু? একদম মন খা’রা’প করবে না, কেমন?”
মাইরা ছলছল দৃষ্টিতে তাকায় তারেক নেওয়াজের দিকে। নিজের বাবার কথা মনে পড়ল। তার বাবাকে ঠিক করে মনেই নেই। ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে। মাইরার মনে হয় তার বিয়ে হয়ে সে তার হারানো বাবাকে ফিরে পেয়েছে। তারেক নেওয়াজ তার ঘরের দিকে যেতে যেতে গম্ভীর গলায় বলল,
“ইনায়া আমার ঘরে একবার এসো।”
ইনায়া ‘ওকে বাবা’ বলে সম্মতি দেয়।
জাহিদ এর মন খারাপ হয়। এতে সুন্দর একটা পুতুলের মতো বউকে মা ছেলে মিলে মারল। আহারে! মাইরার পাশে গিয়ে বলে,

“এই যে কিউটি, তুমি যে বললে তোমার হার্ট ভালো। কাঁদলে কিন্তুু হার্ট ভালো থাকে না।”
মাইরা দু’হাতে মুখ মুছে হেসে বলে,
“আমি কাঁদছি না, এই যে হাসছি।”
ইনায়া, জাহিদ দু’জনেই অবাক হয়। মাইরা মেয়েটা বেশ ইন্টারেস্টিং তো। জাহিদ হেসে বলে,
“তুমি খুব ভালো মাইরা।”
মাইরা বিরক্ত হয়ে বলল,
“আপনি না বললেও আমি জানি আমি ভালো। আপনি কি ভাবছেন, আমায় মা ছেলে মেরে গেল, ওমনি আমার দোষ? কখনো না। আমি ভালো বলেই মেরেছে বুঝলেন? আসলে পৃথিবীতে ভালো মানুষের কদর নেই সেটাই প্রমাণ হলো।”
মাইরার কথায় ইনায়া জাহিদ দু’জনেই অবাক হয়। কি মেয়েরে বাবা। স্বামী শ্বাশুড়ির হাতে মার খেয়ে, স্বামীর মুখে এসব শুনেও এ তো দিব্যি কাঁদছে আর হাসছে। মাইরা কিছু না বলে তার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে,
“বাই বাই, আবার দেখা হবে।”
ইনায়া হা করে তাকিয়ে আছে। একে কেন্দ্র করে এতো কাহিনী। মারও খেয়েছে এই মেয়ে, এখন এমন ভাবে কথা বলছে যেন দুঃখ তাদের। আর মাইরা হইলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। ইনায়া মাথা ভর্তি চিন্তা নিয়ে তার বাবার ঘরের দিকে গেল। জাহিদও অবাক হয়ে ঘরে গেল।
এদিকে মাইরা বারবার গাল গড়িয়ে পড়া চোখের পানি মুছতে ব্যস্ত। আবার মুখে হাসি। ভাঙা গলায় বিড়বিড় করে,
“অ-স্বামী একটা। আমাকে বলে,, ‘এই বাচ্চাকে বউ মানি না। মানি না এই বিয়ে।’
একদিন তার সব চুল কেটে তাকে টাক করিয়ে আমিও বলব, এই টাকলাকে আমি বর হিসেবে মানি নাহ। মানি না এই বিয়ে, হুহ। আমায় চেনে না!”

ইনায়া তার বাবার ঘরের সামনে গিয়ে বলে,
“বাবা আসব?”
তারেক নেওয়াজ ইজি চেয়ারে বসে চোখ বুজে আছে। গম্ভীর গলায় বললেন, “এসো।”
ইনায়া গুটিগুটি পায়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে, তারেক নেওয়াজ উঠে দাঁড়ায়। ইনায়া ভয় পাচ্ছে সে ট্যুর এর ব্যাপারে বাবা জেনেছে কি-না। জানলে খুব বকবে।
তারেক নেওয়াজ বেশ কিছুক্ষণ ইনায়ার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ-ই ইনায়ার ছেড়ে রাখা ওড়নার একপাশ তুলে মেয়ের মাথা ঢেকে দেয়। ইনায়া অবাক হয়ে তাকায় বাবার দিকে। তারেক নেওয়াজ ইনায়ার থুতনিতে হাত রেখে মৃদু হেসে বলে,
“তুমি বড় হয়েছ, সবসময় নিজেকে এভাবে ঢেকে রাখবে, বুঝেছ আম্মু?”
ইনায়া জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
“আমি তো বাইরে হিজাব পরে-ই বের হই বাবা।”
তারেক নেওয়াজ মৃদু হেসে বললেন,

“আমার আম্মু বড় হয়ে গিয়েছে। বিয়ে দিতে হবে তাকে। তোমার খালাতো ভাই কিন্তুু বেশ বড়। তার সামনে এভাবে আর খোলামেলাভাবে থাকবে না কেমন? আমার আম্মু ভীষণ দামী। আমি চাই আমার আম্মু নিজেকে ঢেকে রাখুক।”
ইনায়া বাবার কথায় তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ওকে আব্বু। জাহিদ ভাইয়ার সামনে আর মাথার কাপড় ফেলব না। ডান।”
তারেক নেওয়াজ মৃদু হাসে। রুমা নেওয়াজ পিছনে দাঁড়িয়ে একটা মলম এগিয়ে দিয়ে বলে,
“ইনায়া এটা ওই মেয়েটার গালে লাগিয়ে দিও।”
ইনায়া বাবাকে ছেড়ে মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের হাত থেকে মলম নিয়ে বলল,
“ওকে আম্মু।”

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৩

“আজ মেয়েটার সাথে তুমি থাকবে, বুঝেছ?”
ইনায়া অবাক হয়। তার মা-ই মেয়েটাকে মারল। আবার আড়াল থেকে তার কত সুন্দর যত্ন নিচ্ছে। তারেক নেওয়াজ মৃদু হাসে। তিনি জানেন তার স্ত্রী হঠাৎ রেগে যা-ই করুক, উপর থেকে যেমন-ই হোক, ভেতরটা ভীষণ নরম।

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৫