প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬২
Drm Shohag
মাইরা ভীত চোখে ইরফানের দিকে চেয়ে আছে। ইরফান আবারও রে’গে বলে,
– কেন দিয়েছিস ওগুলো? বল? আমার কোনো জিনিসের ভ্যালু নেই কেন তোর কাছে? বল?
মাইরা ঢোক গিলে। আবারও কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলতে চায় কিছু, তার আগেই গালে শক্ত থা’প্প’ড় পড়ে। মাইরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ডান দিকে হেলে গিয়ে জুতোর র্যাকের সাথে কপাল গিয়ে ঠেকে। রিতা দৌড়ে এসে ধরার আগেই ইরফান টেনে মাইরাকে তুলে বা হাতে মাইরার গাল শক্ত হাতে ধরে
দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– এতো দয়ার শরীর তোর? কোথায় পেয়েছিস এতো দয়া? পুরো পৃথিবীর জন্য এতো মায়া? এতো দয়া? সব ছুটাবো আজ।
কথাটা বলে মাইরার একই গালে আগের চেয়েও জোরে আরেকটা থা’প্প’ড় মেরে দেয়। এতোদিন পর এতো শক্ত একটা থা’প্প’ড় খেয়ে মেয়েটার এমনিই মাথা ঘুরছিল, আবারও আরেকটা থা’প্প’ড় খেয়ে মাইরার মনে হলো, গাল ছিঁড়ে গেল, কান ফেটে গেল। মাইরা আবারও হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, জুতোর র্যাকের সাথে আগের চেয়েও জোরে ধাক্কা খায়। ডান পাশের কপালের কোণে বেশ জোরে লেগেছে। মাইরার মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। চারপাশ কেমন অন্ধকার লাগে।
রুমা নেওয়াজ ইরফানের চিৎকারে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। ইরফানকে এভাবে মাইরাকে মারতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসেন। ইরফান মাইরার দিকে আবারও এগোনোর আগেই রুমা নেওয়াজ দু’হাতে ইরফানকে ঠেলে শব্দ করে বলে ওঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– ইরফান থেমে যাও।
ইরফান এখনো জ্বলন্ত চোখে মাইরার দিকে চেয়ে আছে।
তারেক নেওয়াজ বাইরে বেরিয়েছিলেন। ভেতরে প্রবেশ করে ভেতরের অবস্থা দেখে তার চোখেমুখে বিস্ময় ভর করে। ইরফানকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।
মাইরার পাশে রিতা বসে মাইরাকে আগলে নিয়েছে।
তারেক নেওয়াজ মাইরার পানে চেয়ে রইল মায়া ভরা চোখে। মেয়েটি মাথা নিচু করে আছে। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। যেন বৃষ্টি ঝরছে।
তারেক নেওয়াজ ইরফানের দিকে তাকালো। ইরফান এখনো মাইরার দিকে ভস্ম করে দেয়া চোখে চেয়ে আছে। তারেক নেওয়াজের রাগ হয়, প্রচন্ড রাগ। আর নিতে পারছেন না।
ইরফানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তারেক নেওয়াজ। রাগান্বিত স্বরে বলে,
– আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছ কেন?
ইরফান কোনো উত্তর করল না। তার দৃষ্টি মাইরার পানে। চোখেমুখে এখনো রাগ ঝরছে।
তারেক নেওয়াজ এর পছন্দ হলো না ইরফানের এই স্বভাব। ভীষণ চটল আজ তার ছেলের উপর।
হঠাৎ-ই ইরফানকে থা’প্প’ড় মারার জন্য হাত উঠায়। তখনই ভেতর থেকে তৃণা বেগম বেরিয়ে এসে তার ভাই তারেক নেওয়াজ এর হাত আটকে ধরে বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– কি করছ ভাই? এভাবে মারছ কেন ইরফানকে?
তারেক নেওয়াজ তার বোনের হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিলেন। ইরফানের দিকে চেয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,
– আমি তোমাকে মানুষ করতে পারলাম না ইরফান।
কথাটা বলে দুর্বল পায়ে এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসলেন। তার শরীর খা’রা’প লাগছে। তিনি ভেবেছিলেন ইরফান মাইরাকে মেনে নিয়েছে। এতোদিন পর এসে এই সিনারি দেখে সে আর নিতে পারছে না।
তৃণা বেগম বিস্ময় চোখে ইরফানকে দেখল, সাথে মাইরাকে মেঝেতে বসে ওভাবে নিরবে চোখের পানি ছেড়ে দিতে দেখে অবাক হলো।
ইরফানের দৃষ্টি মাইরার পানে। রা’গ কমেছে কি-না! র্যাকে একটা জোরেসোরে লাথি বসিয়ে হনহন করে বাইরে চলে যায়। মাইরা জুতোর র্যাকের পাশেই হাত রেখেছিলে। ইরফান লাথি দেয়ায় হাতের কয়েকটা আঙুল চাপায় পড়ে। মাইরার মনে হলো জান বের হয়ে যাবে। তবুও মেয়েটি একটা শব্দও বের করল না। ধীরে ধীরে আহত হাতটি বের করে আনে।
তৃণা বেগম দ্রুত এগিয়ে গিসে মাইরার সামনে বসে মাইরাকে আগলে নিল। মাইরা যেন একটা মায়ের কোল পেল এতোক্ষণে। তৃণা বেগমকে জড়িয়ে ফুপিয়ে উঠল।
রুমা নেওয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বামীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তৃণা বেগম মাইরার গালে নজর করলে দেখল, আঙুলের ছাপগুলো যেন মাইরার ফর্সা গালে জ্বলজ্বল করছে। তৃণা বেগম মাইরার মুখ মুছে দিলেন আলতো করে। মৃদুস্বরে বলে,
– কান্না থামা মা।
মাইরা দু’হাতে তৃণা বেগমকে জড়িয়ে রাখলো। কান্না থামে না মেয়েটার। তৃণা বেগম ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে তারেক নেওয়াজ এর পাশে মাইরাকে বসিয়ে দেয়। মাথার এলোমেলো হিজাব খুলে দেয় নিজ হাতে। মাইরার দিকে পানি এগিয়ে দেয়। মাইরা একটু পানি খেয়ে মাথা নিচু করে থাকে। তৃণা বেগম মাইরার পাশে বসে মাইরাকে জড়িয়ে নিল তার সাথে। মাইরা তৃণা বেগমের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে নেয়। বন্ধ চোখের পাতা দিয়ে অশ্রু গড়ায়।
তারেক নেওয়াজে অসহায় চোখে মাইরার মলিন মুখটার দিকে চেয়ে রইল। হাত বাড়িয়ে মাইরার মাথায় হাত বুলিয়ে তুই সম্মোধন করে বলে,
– আমায় ক্ষমা করিস মা। আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে আমি তোর নিজের বাবা হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা তো হতে পারলাম না। উল্টে আমার ছেলেকে দিয়ে তোর উপর নির্যাতন বাড়িয়ে দিয়েছি।
কথাটা বলে তারেক নেওয়াজ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার ঘরের দিকে চলে যায়। রুমা নেওয়াজ মাইরার জন্য ভাত বেড়ে তৃণা বেগমের কাছে দিয়ে বলল,
– ওকে খাইয়ে দিও।
তৃণা বেগম মাথা নেড়ে বলে,
– আচ্ছা ভাবি।
রুমা নেওয়াজ তার স্বামী পিছু গেলেন। তিনি বুঝেছেন তারেক নেওয়াজ আজকের ঘটনা নিয়ে বেশ কষ্ট পেয়েছেন। ইরফানের উতর তার নিজেরও কেন যেন অনেকটা রা’গ হলো। এই বাচ্চা মেয়েটাকে এভাবে মারে তার ছেলেটা! কিন্তু তিনি কি করবেন? ইরফান কি কখনো শুধরাবে না? আজকেই ভেবেছিল ইরফান মাইরাকে মেনে নিয়েছেই। অথচ আবারও সেই আগের সিন। রুমা নেওয়াজ এর ভেতর থেকে একটা হতাশার শ্বাস বেরিয়ে আসে।
তৃণা বেগম হাত ধুইয়ে এসে ভাত মাখিয়ে মাইরার সামনে ধরলে মাইরা মুখ ফিরিয়ে ভাঙা গলায় বলে,
– খাবোনা আম্মাজান। আমি ঘুমাবো।
তৃণা বেগম মাইরার মাথায় বা হাত রেখে বলে,
– বাচ্চামি করিস না মা। খেয়ে ঘুমাবি। রাতে না খেয়ে থাকলে সকালে শরীর তুলতে পারবি না।
মাইরা মলিন গলায় বলে,
– এসবের আমার অভ্যেস আছে আম্মাজান। কিছু হয় না।
তৃণা বেগম মায়া ভরা চোখে মাইরার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা কত ভারী কথা বলে দেয়। তৃণা বেগম বুঝলেন মাইরা প্রায়ই রাতে না খেয়ে ঘুমাতো। তিনি জোর করেই মাইরাকে কয়েকবার খাইয়ে দেন। এরপর মাইরাকে তার ঘরে নিয়ে যায়। মাইরা আজ আর কিচ্ছু বললো না। গায়ের বোরখা খুলে রেখে চুপ করে বেডের এক কোণায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।
তৃণা বেগম মাইরাকে দেখলেন। ইরফান কেন এভাবে মারে মেয়েটাকে? মাইরার অনেক কাজ বিরক্তিকর হতে পারে, সে নিজেও মাইরার কিছু কাজে বিরক্ত হয়। কিন্তু এই ফুলের মতো মেয়েটাকে দেখলে কি যে মায়া হয়! তাকে কিভাবে ইরফান মারে? ভদ্রমহিলার সত্যিই নিজেকেই অসহায় লাগলো। আসলে ইরফানের জন্য মাইরা নয়। তার ভাইজান কাজ টা ভালো করেনি। ইরফান মাইরার মতো মেয়েকে নিতে পারেনা। ইরফানের জন্য শান্তশিষ্ট, বুঝদার মেয়ে প্রয়োজন ছিল। মাইরা যার উল্টো।
আর মাইরার জন্য এরকম একজনকে দরকার ছিল, যে মাইরার চঞ্চলতা, বোকামি, বাচ্চামি এসব সহ্য করতে পারবে। মেয়েটির গল্প সে তার ভাইয়ের কাছে শুনেছে। তার মাইরার জন্য কান্না আসে কেন যেন। মেয়েটার ভালো থাকাটা বোধয় ভাগ্যে লেখা নেই।
মাইরার হঠাৎ-ই ঘুম ভেঙে যায়। পাশ ফিরে দেখল তৃণা বেগম ঘুমিয়েছে। মাইরা ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসে। মাথার কাছেই একটা ছোট ঘড়ি দেখল মাইরা। ১১ টা বাজে। মাইরা চুপ করে বেশ অনেকক্ষণ বসে থাকলো। এতোদিন পর ইরফানের হাতে শক্ত মার খেয়ে মেয়েটার মন বিষিয়ে উঠল। চোখের কোণ ঘেঁষে পানি গড়িয়ে পড়ে। চোখ মুছে বেড থেকে নেমে দাঁড়ায়। বেলকনির দিকে এগিয়ে যায়।
বেলকনিতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে থাকে মাইরা। বিষন্ন মনে কিছুটা নিরব, কিছুটা ব্যস্ত শহর দেখে। রঙবেরঙের লাইট রাতের অন্ধকারময় চারপাশটাকে আলোকিত করে রেখেছে। থেকে থেকে গাড়ি, বাইক, ট্রাক সব নিজ নিজ গন্তব্যে ছুটছে। মাইরা নিরব চোখে চেয়ে দেখে। একসময় মাথা তুলে খোলা আসমানের দিকে তাকায়। আজ জোছনা নেই, তবুও মাইরার আকাশ ভালো লাগলো। ইরফানের দেয়া থা’প্প’ড় গুলোর কথা মনে পড়ল। সেই প্রথমদিকে থা’প্প’ড় খেয়ে মাইরার শুধু তার না দেখা মায়ের কথাই মনে পড়ত। নিজের জন্য তেমন কষ্ট হতো না। সে তো ইরফানকে ভালোবাসতো না। কিন্তু আজ দু’টো থা’প্প’ড় খেয়েই মাইরার ভীষণ কষ্ট হলো। গালে তীব্র ব্য’থা। তবে মাইরাকে সেই শরীরের ব্য’থা কাবু করতে পারলো না। ইরফানের দেয়া থা’প্প’ড় দু’টো তার মনে লেগেছে। সে কি অনেক বড় অপরাধ করেছে? যে ঠিকমতো খেতেই পারতো না, সে ওতো জুতো নিয়ে কি করবে?
তার শিসওয়ালা সত্যিই খুব নিষ্ঠুর। সে যতটা ভাবে, তার চেয়েও ভীষণ নিষ্ঠুর। লোকটা তাকে মেরেই বোধয় শান্তি পায়। চোখ থেকে না চাইতেও দুঃখ ভরা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
মনে মনে সেই না দেখা মাকে কল্পনা করল। যে মা তাকে এতো এতো কষ্ট করে ১০ মাস পেটে বইয়ে বেড়িয়েছে। সে শ্যামলা রঙের ছিল। মাইরার ভীষণ ভালো লাগে শ্যামলা মেয়েদের। এই যেমন মিলা মেয়েটা। মাইরা মিলাকে ভেবে কল্পনায় তার মাকে সাজায়। মাইরা তাকে নাম দিয়েছে একটা। বিড়বিড় করে আওড়ালো, ‘শ্যামা মা’
মনে প্রশ্ন জাগে, তার শ্যামা মা থাকলে সে কী তার মায়ের বুকে ঘুমাতে পারতো? কেউ বাঁধা দিলেও সে ঘুমাতো জোর করেই। যে যা ইচ্ছা বলুক। সে শুনতো না। কেউ কিছু বললে বলত, এটা তার গর্ভধারিণী মা।
কিন্তু এখন তো পালিত মাকে চেনে। রক্তের সম্পর্ক নেই, সে সেই মায়ের বুকে না যেতেই তাকে কত কটু কথা শুনতে হয়! মাইরার আর সাহস হয় না পা বাড়ানোর। অন্ধকার আকাশপানে চেয়ে থাকা দু’টি চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গাল বেয়ে পড়ে। তার শিসওয়ালা, আর না দেখা অদৃশ্য শ্যামা মা কে যেন ঝাপসা দেখল। যারা ভীষণ নিষ্ঠুর, একজন তাকে রেখেই চলে গেল। আরেকজন শুধু মারার সুতো খুঁজে বেড়ায়।
বেলকনি থেকে ভেতরে এসে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মাইরা। ঘর থেকে বেরোলে ইরফানের দাদিকে দেখে ডায়নিং-এ বসে পানি খেতে। ইরফানের দাদি মাইরাকে দেখে কাছে ডাকলো। মাইরা মাথা নিচু এগিয়ে গিয়ে দাদিমার পাশে দাঁড়ায়। ইরফানের দাদি মাইরাকে তার পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে মাইরার গালে হাত দিল। সে সন্ধ্যার পর পর ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিল বলে তখন কোনো কিছু জানেনি। পরবর্তীতে তৃণা বেগম তাকে সব বলেছে। মাইরার জন্য তার মায়া হলো। মৃদুস্বরে বলে,
– ঠিক হয়ে যাবে দিদিভাই।
মাইরা মায়া মায়া চোখে তাকালো ইরফানের দাদির দিকে। তার নিজের দাদির কথা মনে পড়ল। এই নামে তাকে তার দাদি ডাকতো।
তার দাদি গ্রামের হলেও গায়ের রঙ ছিল ফর্সা। দাদি বেঁচে থাকতে মাইরা মাঝে মাঝেই দাদির কাছে গিয়ে ঘুমাতো। তার দাদি নিজেই অন্যের বাড়ি থাকতো, তাই তাকে সবসময় নিতে পারতো না। কিন্তু মাঝে মাঝে তাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতো। একদিন সেই বুকটাও হারিয়ে গেল মাইরার জীবন থেকে। সবাই তাকে একা ফেলে চলে গেল।
মাইরা ইরফানের দাদির দিকে চেয়ে আবদার করে,
– দাদিমা আজ আপনার সাথে আমায় ঘুমাতে নিবেন?
ইরফানের দাদি মৃদু হেসে বলে,
– অবশ্যই দিদিভাই।
মাইরার মুখেও ছোট্ট এক প্রাপ্তির হাসি ফুটে ওঠে।
রাত বাজে ১ টা। ইরফান বাড়ি ফিরেছে। ঘরের লাইট জ্বালালো। বেডের উপর নজর করলে দেখল বেড ফাঁকা। ইরফান ঢোক গিলল। দ্রুতপায়ে বেলকনিতে গিয়ে চেক করল, মাইরা আছে কি-না! নেই। ওয়াশরুমেও চেক করল। কিন্তু পায় না। ইরফান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। ঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। তার ফুপু দাদি দু’জনেই আছে। তাদের কারো কাছেই মাইরা আছে বলে মনে হয় ইরফানের। ইরফান আগে তার ফুপুর ঘর চেক করল, মাইরাকে না পেয়ে সরাসরি তার গ্রান্ডমায়ের ঘরে যায়। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। ডিম লাইটের আলোয় মাইরার মুখটা সর্বপ্রথম তার চোখে পড়ল। তার গ্রান্ডমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। ইরফান ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মাইরার পাশে দাঁড়ায়। মাইরার মুখপানে চেয়ে থাকে। চোখেমুখে অসহায়ত্ব। আজ কতদিন পর রা’গ টাকে সামলে নিতে না পেরে আবারও তার বার্ডফ্লাওয়ার কে আঘাত করল! ইরফানের গলা শুকিয়ে আসে। সামান্য নিচু হয়ে মাইরাকে তার গ্রান্ডমায়ের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। মাইরাকে কোলে নিতে গেলেই ইরফানের দাদি মাইরাকে নিজের সাথে শক্ত করে ধরে বলে,
– কেন এসেছ এখানে?
ইরফান ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর গলায় বলে,
– ওকে দাও।
ইরফানের দাদি মাইরার মাথায় হাত বুলিয়ে রে’গে বলল,
– ওকে ভুলে যাও। ওকে আর পাবে না তুমি। আমি তোমাদের মাঝে সব ঠিক করতে আসলাম। দেখে যা একটু ঠিক ঠিক লাগলো, সব শেষ এখন। ওকে আমি আমার সাথে কানাডা নিয়ে গিয়ে কানাডিয়ান এক ছেলের সাথে….
ইরফান তার গ্রান্ডমায়ের কথা বলার মাঝেই শক্ত গলায় শব্দ করে বলে ওঠে,
– গ্রান্ড মা?
এতো শব্দ করে কথা বলায় মাইরা ঘুমের মধ্যেই নড়েচড়ে ওঠে। ইরফানের দাদি চোখ বুজলেন। তিনি রে’গে আছেন ইরফানের উপর। এই মেয়েটাকে মেরে গালটার কি অবস্থা করে দিয়েছে। চোখ বুজে রেখেই বলে,
– ইরফান দাদুভাই তুমি এখান থেকে যাও। তুমি কি দেখেছ ওর গালের অবস্থা? তোমার মাঝে দয়ামায়া নেই। ও আমার সাথেই থাকুক। তুমি যাও।
ইরফান মাইরার দিকে তাকালো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মাথা নিচু করে মাইরার গালে দু’টো চুমু খায়। ইরফানের দাদি চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– আমাকে তোমার চোখে পড়ছে না?
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– ওকে দিচ্ছো না, তো কি করব? ওকে এখানেই আদর করছি, তুমি চাইলে দেখ।
ইরফানের দাদি চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
– তুমি যাবে এখান থেকে?
ইরফান বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– আমার বার্ডফ্লাওয়ারকে আমাকে দাও। আমি কিন্তু নিজেই নিতে পারবো, তুমি ব্য’থা পাবে বলে চেয়ে নিচ্ছি।
ইরফানের দাদি আবারও চোখ বুজে বলে,
– তুমি যাও এখান থেকে। আজ কিছুতেই আমার দিদিভাইকে তুমি পাবে না।
ইরফান মাইরাকে টেনে ধরে বলে,
– গ্রান্ড মা ওকে ছাড়ো।
ইরফানের দাদি মাইরাকে ছাড়ে না। রেগে বলে,
– ইরফান আমি কিন্তু তোমাকে মারবো। ওকে ছাড়ো।
ইরফান অসহায় কণ্ঠে বলে,
– গ্রান্ডমা তুমি ওকে ছাড়ো। প্লিজ!
ইরফানের দাদি এবার কিছুটা দমলো মনে হয়। ইরফানকে একটু অন্যরকম লাগছে। মাইরাকে ছেড়ে দেয়ার সাথে সাথে ইরফান মাইরাকে কোলে তুলে নেয়। এক সেকেন্ড ও সময় নষ্ট না করে বড় বড় পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ইরফানের দাদি অবাক হয় ইরফানের কান্ডে। এ এমন ধুপধাপ মেরে দেয় আবার এই মেয়ে ছাড়াও চলে না। একে কিভাবে সিধে করা যায়?
ইরফান মাইরাকে তার বেডে শুইয়ে দিল। এরপর বাইরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে আসে। মাইরার পাশে বসে দু’হাতে খুব মনোযোগ দিয়ে মাইরার গালে বরফ দিয়ে দেয় আলতো হাতে। মাইরার চোখেমুখে বিরক্তি। গালে ঠাণ্ডা অনুভূতি হওয়ায় মেয়েটা চরম বিরক্তিতে এপাশ থেকে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। ইরফান মাইরার দিকে হেলে গিয়ে মাইরাকে তার দিকে ফেরায়। মুখ নামিয়ে মাইরার ভেজা গালে চুমু আঁকে।
হাতের অর্ধেক বরফ ছুঁড়ে ফেলে হাত থেকে।
এরপর আবারও আহত গালে বেশ কয়েকটা চুমু আঁকে। এরপর ইরফান বেড থেকে নেমে গিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে। ঘড়িতে একবার সময় দেখে, ১ টা বেজে ২৫ মিনিট।
এগিয়ে গিয়ে তার লাগেজ গোছায়। বেশ সময় নিয়ে তার কাজ শেষ করে। এরপর সে নিজে ফরমাল শার্ট-প্যান্ট পরে নেয়। সাদা শার্ট, উপরে কালো কোট, কালো প্যান্ট। এরপর হাতঘড়ি পরে নিয়ে মাইরার পাশে এসে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে মাইরার গালে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলে, – স্যরি বার্ডফ্লাওয়ার।
কথাটা বলে মাইরার কপালে একটা চুমু আঁকে। এরপর লাগেজ নিয়ে গটগট পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
রুমা নেওয়াজ তার স্বামীর জন্য জেগে বসে আছেন। তারেক নেওয়াজ ঘুমাতে পারছেন না। কেমন ছটফট করেছেন। রুমা নেওয়াজ পানি আনার জন্য দরজা খুলে দাঁড়ালে ইরফানকে দেখে অবাক হয়। বেশি অবাক হয়, ইরফানকে ফিটফাট হয়ে রেডি হয়ে দেখে। বিস্ময় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– এতো রাতে কোথায় যাচ্ছে তুমি?
ইরফান মৃদুস্বরে বলে,
– কানাডা। আসছি আম্মু।
রুমা নেওয়াজ অবাক হয়ে বলেন,
– কি বলছো এসব? বিদেশ যাবে কেন?
ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– অফিসের কাজ + ভার্সিটির কাজ
কথাটা বলে ইরফান কিছুটা শব্দ করে বলে,
– বাবা আসছি।
ভেতর থেকে তারেক নেওয়াজ গম্ভীর গলায় বলে,
– খবরদার আমাকে বাবা বলে ডাকবে না। যেদিন মানুষ হতে পারবে সেদিন আমায় ডাকবে। আমি কোনো অ’মানুষের বাবা হতে চাই না।
রুমা নেওয়াজ ইরফানের দিকে তাকিয়ে। ইরফানের মাঝে তেমন কোনো হেলদোল দেখা গেল না। নিরবে উল্টে ঘুরে দাঁড়ায়।
রুমা নেওয়াজ দ্রুত তার স্বামীর কাছে এসে বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– ইরফান বিদেশ যাচ্ছে কেন ইরফানের বাবা? তুমি জানতে? ও কতদিনের জন্য যাচ্ছে?
তারেক নেওয়াজ চোখ বুজে রেখেই বলল,
– যতদিনের জন্য ইচ্ছা হয় যাক, আর না আসুক কখনো সেটাও ভালো। এরকম ছেলে লাগবে না আমার।
রুমা নেওয়াজ এর চোখ ছলছল করে ওঠে। অতঃপর ভাঙা গলায় বলে,
– তুমি আমার ছেলেটার সাথে এরকম করছ কেন? তুমি শুধু ওর উপরটা দেখছ? ভিতর টা দেখছ না? ও তোমার সেই আদরের মেয়ের কত যত্ন করে সেসব দেখ না? তুমি জানো তোমার সেই আদরের মেয়ে কি করেছে?
ওকে আমার ছেলেটা ভালোবেসে কতগুলো জুতো এনে দিয়েছে। তোমার আদরের সেই মেয়ে আমার ছেলের কথা না ভেবে সবাইকে বিলিয়ে দিয়েছে। এটা ঠিক করেছে ও?”
তারেক নেওয়াজ তার স্ত্রীর কথা শুনে রে’গে তাকালো। শক্ত গলায় বলল,
– একদম ছেলের হয়ে সাফাই গাইবে না। ওটাকে আজ আমার মানুষ বলতে ইচ্ছে করছে না। ওই ফুলের মতো মেয়েটাকে মারতে তোমার ছেলের বুক তো দূর, সামান্য হাত টাও কাঁপে না। ও কত বড় অপরাধ করেছে? মানলাম তোমাদের মা ছেলের কথা ঠিক, সে অনেক বড় অপরাধ করেছে। কিন্তু ও বাচ্চা মেয়ে, আরও হাজার টা অপরাধ করবে। তাই বলে ওকে মারতে হবে?
তারেক নেওয়াজ কথা বলতে বলতে হাইপার হয়ে যায়। একটু থেমে শ্বাস নেয়ে। লোকটার চোখের সামনে কিছু স্মৃতি ভেসে ওঠে। গলার জোর কমে যায়। মলিন গলায় বলে,
– মাইরা যে পরিবেশে বড় হয়েছে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না রুমা।
একদিন বিকেলে আমি ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। মাইরার জন্যই আমি ওদের বাড়ি যেতাম সবসময়, তুমি তো জানোই। তো গিয়ে বাড়ির উঠানে মাত্র পা রেখেছি। তখন-ই দেখি একটা মেয়ে আমার পায়ের কাছে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আমি এতো অবাক হয়েছি। মাইরা দ্রুত আমার পায়ের কাছ থেকে উঠে দাঁড়ায়। এরপর কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে সালাম দেয়। আমি কথা বলতে পারছিলাম না। মেয়েটার দু’গাল পুরো কেটে র’ক্ত ঝরছিল যেন, এমন হয়েছিল।
মাইরার সৎ বাবা এভাবে মেরেছিল। কারণ জানিনা। মাইরাকে সেদিন দেখে অবাক হয়েছিলাম। মেয়েটার চোখে ল’জ্জা ছিল। আমার সামনে মার খাওয়ায় হয়তো ল’জ্জা পেয়েছিল, আর মুখে হাসি। আমি হাসতে পারলাম না ওমন ফুলের মতো মেয়ের গালের অবস্থা দেখে। তার সৎ বাবা আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে ভেতর থেকে মোড়া এনে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে কি মিষ্টি করে বসতে বলল!
আমি কি বলব বুঝিনি। শুধু মেয়েটাকে দেখেই গিয়েছিলাম।
কথাটা বলে তারেক নেওয়াজ শ্বাস নেয়। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলে,
– এরপর আরেকদিন গিয়েছি, হঠাৎ-ই আমার সামনে ভাতের থালা উল্টে এসে পড়ে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, মাইরা টেবিলে বসে আছে, আর ওর সৎ বাপ নামে জা’নো’য়া’র মেয়েটার মুখ থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছে। সেদিনের কারণ শুনেছিলাম, ওই পশুর নাকি খাবার কম পড়বে, মাইরা তার আগে খেতে বসায় এমন করেছিল।
মাইরা সেদিন ও চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছিল। আমি মাইরাকে দেখতে গিয়ে একেকদিন একেকভাবে অ’ত্যা’চা’রি’ত হতে দেখতাম মেয়েটাকে। এজন্যই ইরফানকে এতো করে বলতাম বিয়ে টা করে নিতে। মাইরার মা আমার হাতে পায়ে ধরত আমার ছেলেটার সাথে যেন বিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে ওই জা’হা’ন্না’ম থেকে নিয়ে আসি। কিন্তু আমি কি করব? এতো নিরুপায় ছিলাম, ইরফানকে শুধু বলতেই থাকতাম। কিন্তু ও তো রাজি হতো না। মাঝে মাঝে ভাবতাম, অন্য ছেলে দেখে বিয়ে দিই। কিন্তু মেয়েটাকে দেখে এতো মায়া লাগে! আমি যেন তার বাবা হওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। আমার বন্ধুর রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতি ও।
কথাগুলো বলে তারেক নেওয়াজ আবারও থামে। গলা জড়িয়ে আসে। আবারও বলে,
– ইরফানকে শেষমেশ রাজি তো করাতে পেরেছি, কিন্তু কখনো বুঝিনি মেয়েটাকে এখানে এসেও এভাবে মার খেতে হবে। যদি জানতাম তবে সত্যিই মাইরাকে আমার মেয়ে করে আনার দুঃসাহস দেখতাম না।
কথাগুলো বলে তারেক নেওয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। যেখানে হাজারো আক্ষেপ জমানো। এরপর আবারও বলে,
– একদিন মাইরার সাথে রাস্তায় দেখা হয়। মেয়েটি খালি পায়ে মাথা নিচু করে একা একা হাঁটছিল। আমি ডাকলে আমাকে সালাম দেয়। মেয়েটির মুখ একদম শুকনো ছিল। বিকাল ছিল তখন। আমি মাইরাকে জিজ্ঞেস করলাম, খেয়েছে কি-না! মাইরা হেসে বলে, ‘
হ্যাঁ খেয়েছি আঙ্কেল। পেটে জায়গা নেই একদম।’
তুমি জানো, সেদিন ওকে যেই দেখবে সেই বলবে মেয়েটি সারাদিন না খেয়ে আছে। অথচ মুখে কি নিদারুণ হাসি ফুটিয়ে মিথ্যে বলে দিল। আমি বলেছি, মিথ্যে বলছে তুমি।
মাইরার মুখ মলিন হয়ে যায়। মেয়েটা মাথা নিচু করে নেয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন না খেয়ে আছে।
মাইরা হেসে উত্তর দিয়েছিল, ‘এটা তো নতুন নয় আঙ্কেল। তাছাড়া আমার অভ্যেস আছে।’
আমি যখন বললাম, তুমি কি মাঝেই মাঝেই এমন না খেয়ে থাকো?
ও কি যে একটা ভারী উত্তর দিয়েছিল হেসে। কথাটা বলে তারেক নেওয়াজ বেশ অনেকক্ষণ চুপ থাকে। এরপর ভারী গলায় বলে,
‘বলেছিল, ‘যারা তিন বেলা খেতে পায়, তারা তো ভাগ্যবতী হয় আঙ্কেল।’
তুমি বুঝতে পারছো রুমা? ওই মেয়েটা তিনবেলা কখনো খেতে পায়নি। যারা তিনবেলা পেট ভরে ভাত খায়, মাইরা তাদের ভাগ্যবতী ভাবে। এই মেয়ের গায়ে তোমার ছেলে দিনের পর দিন হাত তোলে।
মেয়েটা এতোকিছুর পর ও সৎ মায়ের একটুখানি ভালোবাসা পেয়ে বলতো, সে অনেক ভাগ্যবতী। এমন মা কয়জন পায়? সে তার সৎ বাবার মার খেয়ে ভুলে যেত, অবজ্ঞা, অপমান সব ভুলে যেত। তার সৎ মায়ের হাতে কখনো মার খায়নি যে, সৎ মা আদর করত যে। তাই সে সব ভুলে থাকতো।
আমার বন্ধুটার উপর খুব রাগ আর অভিমান বুঝলে? ও ওর বউয়ের সাথে যেই আচরণগুলো করতো, মাইরা সন্তান হয়ে বাপের পাপের শাস্তি বোধয় পেয়েছে জীবনে।
মাইরার দাদির সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল, মায়ের মতো একদম। সে মাইরাকে মাইরার মায়ের জীবন কাহিনী শুনিয়েছে। ওর মায়ের কাহিনী আরও করুণ। সেসব বলে শেষ করা যাবে না। ভদ্রমহিলা মাইরাকে পেটে নিয়ে যে অত্যাচারগুলো সহ্য করেছে, ওসব ভাবলেও এতো খা’রা’প লাগে!
সেই কাহিনী শুনে মাইরা না-কি সেদিন খুব কেঁদেছিল। একটু পর পর জ্ঞান হারাচ্ছিল। ওর মা আমাকে বললে আমি মাইরাকে ডক্টর দেখাই। ডক্টর বলেছিল,
মেয়েটার ব্রেইনের উপর খুব চাপ পড়েছে, তাই এমন। আমি নিজেই ওষুধ কিনে বেশ অনেকদিন মেয়েটির চিকিৎসা করাই।
তুমি কি বুঝতে পারছো? মেয়েটা যেই কাহিনী শুনে পাগল হতে বসেছিল। বিয়ের পর তার সেই মায়ের কাহিনী তার নিজের সাথে রিপিট হতে দেখেছে। ইরফানের এতো এতো জঘণ্য ব্যবহার ওর মনে প্রভাব ফেলেনি? এখন ইরফান ওর সামনে চাঁদ, সূর্য এনে দিলেও ওর মনে ধরবে সেসব?
আমি প্রথমেই বুঝেছিলাম, মাইরা ইরফানের সাথে স্বাভাবিক হতে পারবে না। তাই ডিভোর্সের কথা বলতাম। কিন্তু কখনো কখনো স্বার্থপর হয়ে ভাবতাম, মেয়েটা আমার কাছেই থাক। ও কখনো বাবার ভালোবাসা পায়নি। আমি ওকে একটু বাবা হয়ে ভালেবাসি।
ইরফানও মাইরাকে মেনে নিচ্ছে মনে হলো। সব মিলিয়ে ভাবলাম মাইরা হয়তো একটা স্বাভাবিক জীবন পাবে। কিন্তু নাহ, তোমার ছেলের দ্বারা এসব হবে না। আমি মেয়েটাকে একটা সুস্থ জীবন দিতে পারলাম না। একটু সুখ এনে দিতে পারলাম না।”
তারেক নেওয়াজ কথাগুলো বলে তার ঝাপসা চোখজোড়া মুছে নিল। রুমা নেওয়াজ বিস্ময় চোখে চেয়ে রইল তারেক নেওয়াজের পানে। ওইটুকু মেয়ের জীবন এমন? মেয়েটিকে দেখে একটুও বোঝা যায় না। রুমা নেওয়াজ এর চোখ কখন যে ভিজে উঠেছে সে নিজেও টের পায়নি।
ইরফান বেশ কিছুক্ষণ তার বাবা মায়ের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু। পা বাড়াতে নিলে তার বাবার কথা শুনে থেমে যায়। মাইরার জীবন কাহিনীর এক টুকরো দুঃখ তার কানে এসে বারি খায়। তার ক’ষ্ট হচ্ছে। অস্থির লাগছে।
ইরফান একপ্রকার দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। তার ঘরের ভেতর প্রবেশ করে তার পায়ের গতি থামিয়ে দেয়। বেডের দিকে তাকায় অসহায় চোখে।
মাইরা গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। ডান হাতটি ডান গালের নিচে পেতে কি নিশ্চিন্তে ঘুমায় মেয়েটা! ইরফান ঢোক গিলে৷ তার বাবার কথাগুলো কানে বাজে। তার বার্ডফ্লাওয়ার কখনো তিনবেলা খেতে পারেনি? তার বার্ডফ্লাওয়ারের সামনে থেকে ভাতের প্লেট উল্টে ফেলে দেয়া হতো! এতো কষ্ট পেয়ে বার্ডফ্লাওয়ার কোটিপতি হওয়ার ইচ্ছে করেছিল? ইরফান দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরে।
তার বার্ডফ্লাওয়ারকে অন্যকেউ মেরে মেরে কেটে দিত! এরপর বিয়ের পর সেও মারতো তার বার্ডফ্লাওয়ারকে, আজও মেরেছে। ইরফান ডান হাত উঠিয়ে বুকে বা পাশে কয়েকবার মালিশ করে। কেমন চিনচিন ব্য’থা করছে। গলা শুকিয়ে আসছে। হঠাৎ-ই বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে বেডের উপর উঠে মাইরাকে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল। তার শরীর কাঁপছে মৃদু। মাইরা ঘুমের মাঝে নড়েচড়ে ওঠে, এতে শক্ত বাঁধন অনুভব করে। ইরফান মাইরার গলায় মুখ গুঁজে কাঁপা কণ্ঠে বিড়বিড় করে,
– অ্যা’ম রিয়েলি স্যরি বার্ডফ্লাওয়ার।
কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে মাইরার ঘুমন্ত মুখপানে অসহায় চোখে চেয়ে কেমন করে যেন ডাকে,
– বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরা ঘুমের ঘোরে ফোঁপানো কণ্ঠে বলে,
– শিসওয়ালা আমায় মেরে…..
ইরফান মাইরাকে শেষ করতে দেয় না। তার ঠোঁট দ্বারা মাইরার ঠোঁট চেপে ধরে। শব্দ করে একটা চুমু আঁকে মাইরার শুকনো ঠোঁটজোড়ায়। এরপর মাইরার কানের কাছে মুখ নিয়ে ছোট করে বলে,
– I promise you, Birdflower, I will never hurt you again.
কথাটা বলে মাইরার দিকে তাকালে দেখল মেয়েটা ঘুমে বিভোর। কতক্ষণ যে মাইরার মুখপানে চেয়ে রইল তার ইয়ত্তা নেই। এরপর বেড থেকে নেমে টেবিলের উপর থেকে একটি প্যাড আর একটি কলম নিয়ে আবারও বা হাতে মাইরাকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। মাইরার মাথা তার বুকে চেপে রাখে। তার বা গাল মাইরার মাথায় ঠেকিয়ে রাখে।
ডান হাতের প্যাড মাইরার মাথার কাছে বালিশের উপর রেখে মেলে। এরপর কলমের হেড খুলে লেখার জন্য কলম ধরে। হাত কাঁপছে। মুখ নামিয়ে মাইরার মাথায় একটা চুমু আঁকে। এরপর লেখা শুরু করে,
আমার একান্ত বার্ডফ্লাওয়ার,
আমার বার্ডফ্লাওয়ার কে জানো? আমার মাইরা পরী।
বার্ডফ্লাওয়ার আমার এক ভয়ানক অাসক্তি, যে আসক্তির শিকড় বহুবার ছিঁড়তে গিয়ে আমি বারবার ভীষণ বাজেভাবে জড়িয়ে গিয়েছি বার্ডফ্লাওয়ার নামক আসক্তির শিকড়ে।
যে আমার বার্ডফ্লাওয়ার কে আঘাত করেছে, তার শাস্তি তোমার শিসওয়ালা প্রস্তুত করবে। আর তোমার শিসওয়ালা তোমায় যে আঘাত করেছে, এর শাস্তি শিসওয়ালার বার্ডফ্লাওয়ার দিবে। তোমার শিসওয়ালা তার বার্ডফ্লাওয়ারের থেকে শাস্তি পেতে খুব শীঘ্রই তোমার চরণে মাথা পাতবে। তুমি শাস্তি প্রস্তুত করে নাও।
তোমার হার্টলেস শিসওয়ালা তার বার্ডফ্লাওয়ারের শাস্তি গ্রহণ করবে নিঃশব্দে। আর তারপর সে তার বার্ডফ্লাওয়ারের সম্পূর্ণ সংস্পর্শে আসবে তোমার সকল অভিমান, অভিযোগ মুছে দিতে।
ইতি
তোমার একান্ত শিসওয়ালা
লেখা শেষ করে ইরফান কাগজটি ছিঁড়ে এক ভাঁজ করে বালিশের উপর রেখে দেয়, কাগজটির উপর কলম। এরপর মাইরার সারামুখে ছোট ছোট বেশ অনেকগুলো চুমু আঁকে। সবশেষে কপালে সময় নিয়ে ঠোঁট দাবিয়ে রাখে। এরপর মাইরাকে ছেড়ে বেড থেকে নেমে দাঁড়ায়। মাইরা গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে। ইরফান মাইরাকে কাঁথা দিয়ে ঢেকে দেয়। ঘরের এসি অফ করে হালকা করে ফ্যান দেয়। মাইরার ঘুমন্ত বেশ অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে। এরপর সময় নষ্ট না করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
ইরফান লাগেজ গাড়ির ডিকির ভেতর রাখলো। তখনই পিছন থেকে শুদ্ধ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে,
– কি রে? তোর না কালকে যাওয়ার কথা ছিল! আজ যাচ্ছিস যে?
ইরফান কিছু বললো না। শুদ্ধ বিরক্ত হলো। সে ইরফানদের বাড়িতেই ছিল। তবে বাইরে থেকে এসেছিল ১০ টার পর পর। এসে ঘুমিয়েছিল। এখন তার মামা তাকে ডেকে উঠালো। ইরফানকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করে দিয়ে আসতে বলল। এগিয়ে এসে বলে,
– আজ যাচ্ছিস কেন?
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– মাই উইশ। তুই গাড়ি নিয়ে আয়।
কথাটা বলে ইরফান তার বাইকের কাছে যায়। বেশ অনেকগুলো দিন পর বাইকের কাছে আসলো। ইরফান বাইকের হেলমেট পরে বাইকে উঠে বসলে শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– বাইক, গাড়ি একসাথে কেমনে আনব আমি?
ইরফানের গম্ভীর স্বর,
– এই বাইক টাচ করলে হাত ভেঙে দিব।
কথাটা বলে বাইক স্টার্ট দেয়। চোখের পলকে হাওয়া হয়। শুদ্ধ চেঁচিয়ে ওঠে,
– আস্তে চালা। মরবি না-কি?
ইরফান ততক্ষণে মিলিয়ে গিয়েছে। শুদ্ধ গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল। একে কখন কোন ভূত ধরে আল্লাহ জানে। বাইক ধরতে দিবে না মানে দিবে না। হয়তো রাখার ব্যবস্থা করবে ওখানেই। শুদ্ধ কিছু একটা ভেবে হাসলো।
এয়ারপোর্টে পৌঁছে শুদ্ধ লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে। এক সাইডে ইরফানকে উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বলে,
– ধর তোর লাগেজ।
ইরফান উল্টো ঘুরে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলে,
– ওকে দেখে রাখবি।
শুদ্ধ মিটিমিটি হেসে বলে,
– হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। তুই থাকবি না। আমি দেখে রাখবো। সময় সুযোগ করে ডেট করব। চলবে না সোনা?
ইরফান বিরক্ত চোখে তাকালো শুদ্ধর দিকে। গম্ভীর গলায় বলে,
– ফারাহ’র পিছে কাউকে লাগায়নি বলে সাহস পাচ্ছিস। ফিরে এসে আগে এই ব্যবস্থাই করব। ওয়েট।
শুদ্ধ মেকি হেসে বলে,
– আরে এসব কি অভদ্র কথা। আমি বলতে চাচ্ছিলাম, মাইরা তো আমার-ই মায়ের পেটের বোন-ই প্রায়। ও আসলে আমার মায়ের পেট থেকে বেরোতে গিয়ে এক্সিডেন্টলি কার না কার পেট থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।
ইরফান শুদ্ধর হাতের থেকে লাগেজ নিয়ে এগিয়ে যায় কয়েক পা। হঠাৎ-ই থেমে গিয়ে পিছু ফিরে ডাকে,
প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬১
– শুদ্ধ?
শুদ্ধ ফেনে কিছু করছিল। ইরফানের ডাকে শুদ্ধ মাথা তুলে তাকায়। এগিয়ে গিয়ে ইরফানের সামলে দাঁড়ালে ইরফান বলে,
– ওকে কলেজ গেট থেকে বের হতে নিষেধ করবি। আর একা একা কোথাও যেতে দিবি না।
ঢোক গিলে বলে,
আর ও যখন যা খেতে চাইবে সব এনে দিবি।
শুদ্ধ কিছু বলতে চায়, তার আগেই ইরফান বলে ওঠে,
– আই রিকুয়েষ্ট ইউ, ওকে নিয়ে আর একটাও ফান করবি না।