প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬৪
Drm Shohag
ইরফান আবারও করুণ কণ্ঠে বলে, ‘বার্ডফ্লাওয়ার।’
মাইরা ঢোক গিলে।
হঠাৎ-ই ইরফান মাইরাকে ছেড়ে দেয়। এক সেকেন্ডও সময় ব্যয় না করে মাইরার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে।
রুমা নেওয়াজ কিছু বলতে চাইলে তারেক নেওয়াজ তার স্ত্রীকে থামিয়ে বলেন,
– মাইরা আর ওর মধ্যে কোনো ঝামেলা। আমাদের জানানোর হলে জানাবে। আপাতত ওদের একা ছেড়ে দাও।”
রুমা নেওয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– ইরফান রে’গে আছে মনে হচ্ছে। ওকে যদি আবার মারে!
তারেক নেওয়াজ ইরফানের দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বললেন,
– কষ্ট পেয়েছে ও কোনো কারণে। তাছাড়া মারার হলে এখানেই মারতো।
স্বামীর কথা মেনে রুমা নেওয়াজ আর কিছু বললেন না।
মাইরা নিরবে ইরফানের পিছু পিছু ইরফানের পায়ের সাথে তাল মেলায়। সিঁড়ির মাঝপথে ইরফান দাঁড়িয়ে যায়। কেমন যেন থেকে থেকে শরীর কেঁপে উঠছে। বা হাতে পাশের দেয়াল আঁকড়ে ধরে। মাইরা অবাক হয়ে তাকায়। বিচলিত কণ্ঠে বলে,
“আপনি ঠিক আছেন?”
ইরফান তার লালিত চোখজোড়া বুজে দু’বার শ্বাস টানে আবার ফেলে। এরপর পিছু ফিরে মাইরাকে কোলে তুলে নেয়। মাইরা চেঁচালো না। ইরফান মাইরার দিকে তাকায়। মাইরা ইরফানের দিকে চেয়ে আছে। দু’জনের চোখাচোখি হয়। ইরফান বিষাদময় সূক্ষ্ম হেসে বলে, – ‘সেলফিশ গার্ল।’
মাইরা অবাক হয়। লোকটা তো তাকে স্টুপিট গার্ল বলে। আজ সেলফিশ বললো কেন?
ইরফান মাইরাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। থেকে থেকে কেমন যেন শরীর কেঁপে ওঠে। মাইরা অসহায় কণ্ঠে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– আমায় নামিয়ে দিন, আপনাকে অসুস্থ লাগছে।
ইরফানের কণ্ঠে অসহায়ত্ব, সাথে রাগান্বিত স্বরে বলে,
“সেলফিশ গার্ল। আমার কথা ভাবিস তুই? তুই সেলফিশ। আমার কথা ভাবিস না তুই।
কথাগুলো বলে দৃষ্টি সামনে নিবদ্ধ রেখে ধীরপায়ে তার ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বিষাদময় করুণ কণ্ঠে আওড়ায়,
– কেন ভাবলি না আমার কথা বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরা অবাক হয়ে ইরফানের পানে চেয়ে থাকে। এতো অস্বাভাবিক ইরফানকে সে আগে কখনো দেখেনি। ভাবনার মাঝেই ইরফান মাইরাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। দরজা লাগায় শব্দ করে। এরপর পিছু ফিরে দু’হাতে মাইরার গাল আগলে নিয়ে মৃদুস্বরে ডাকে,
– বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরার চোখ টলমল করে ওঠে। লোকটা এতো আবেগি স্বরে কেন ডাকছে তাকে? হঠাৎ-ই মনে পড়লো এই নাম ইরফানের ফোনের পাসওয়ার্ড ছিল। মাইরার চোখেমুখে হাজারো প্রশ্ন, কৌতূহল। ইরফান হঠাৎ-ই মাইরার চোয়াল শক্ত করে ধরে চিৎকার করে বলে,
– আমি তো বলেছিলাম, আমি তোর দেয়া সব শাস্তি মাথা পেতে নিব। কিন্তু তুই এতোটা সেলফিশের মতো করে এতো বড় শাস্তি কেন দিলি আমায় বল?
মাইরা বিস্ময় চোখে ইরফানের পানে চেয়ে। সে বুঝতে পারছে না ইরফানের কথা। ইরফান আবারও চিৎকার করে বলে,
– কেন মরতে চাস তুই? তোর এতো বড় কলিজা কবে হয়ে গেল বার্ডফ্লাওয়ার? আমি কি করে থাকবো? আমি বার্ডফ্লাওয়ার ছাড়া থাকতে ভুলে গিয়েছি। তুই কেন এতো সেলফিস বল?
মাইরা ভীত চোখে তাকায় ইরফানের দিকে। থেমে থেমে বলে,
– আপনি জেনে….
ইরফান মাইরাকে ধাক্কা দিয়ে দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরে বলে,
– হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জেনে গিয়েছি। জেনে গিয়েছি আমি।
ইরফানের কানে সীমান্তের বলা কথাগুলো বাজে,
‘তুই কি জানিস না তোর বউয়ের ব্রেইন টিউমার? ওই বাচ্চা মেয়েকে একা একা পাঠিয়েছিস কেন হসপিটালে? তাছাড়া মেয়েটা আরও বেশ কয়েক মাস আগে না-কি এসেছিল আমার ফ্রেন্ডের কাছে। সে তোর বউকে বলেছিল, যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা করাতে, আজ আবার এতোগুলো মাস পর এসেছে, সিচুয়েশন আগের চেয়েও ক্রিটিকাল হয়ে গিয়েছে। আর সপ্তাহখানেক পেরিয়ে গেলেই এই টিউমার ক্যান্সারে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা হিউজ।’
মাইরা মাথা নিচু করে নিরবে চোখের পানি ফেলে। ইরফান আবারও এগিয়ে গিয়ে মাইরাকে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। তার বুক কাঁপছে যে। তার বার্ডফ্লাওয়ার এটা। কি করে থাকবে সে একে ছাড়া।
হঠাৎ-ই মাইরাকে ছেড়ে ডান হাতে মাইরার চোয়াল করে ধরে হিসহিসিয়ে বলে,
– কেন মরতে চাস বল? এ্যাই বার্ডফ্লাওয়ার বল, আমায় একটাবার কেন বলিস নি, তুই সিক। কেন বললি না বল? কেন লুকিয়ে রাখলি আমার থেকে? কেন এতো সেলফিস হয়ে গেলি বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরা কাঁদতে কাঁদতেই হঠাৎ-ই ইরফানকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে,
– আমার কেউ নেই, কেউ ভালোবাসে না আমায়। কার জন্য বাঁচবো আমি? আপনিও তো আমায় পছন্দ করেন না। আমার এই সাদা চামড়ার জন্য একটু একটু কাছে আসেন। তবে কেন বাঁচতে যাবো আমি?”
কথাগুলো বলতে বলতে মাইরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। ইরফান স্তব্ধ চোখে মাইরার পানে চেয়ে রয়। তার কথা বলার ভাষা হারিয়েছে। তার বার্ডফ্লাওয়ার এসব কি ধারণা নিয়ে থাকে তার ব্যাপারে? কতক্ষণ যে মাইরার কান্নারত মুখটার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে রইল তার ইয়ত্তা নেই।
হঠাৎ-ই ইরফান ধীরে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মাইরার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শীতল কণ্ঠে ডাকে,
“বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরার বুক ধ্বক করে ওঠে। এতো করুণ সুর, এতো আবেগ কেন এই লোকটার গলায়। তার জন্য তার শিসওয়ালা কষ্ট পাচ্ছে? সে মরে গেলে তার শিসওয়ালার খুব কষ্ট হবে? ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকায় ইরফানের পানে। চোখমুখ কান্নার পানিতে একাকার। ইরফান মাইরার চোখে দৃষ্টি রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
– যদি তোকে পুড়িয়ে দিলে আমার বার্ডফ্লাওয়ারের
এক বিন্দু পরিমাণও কষ্ট না হতো, যদি তুই আমার সাথে বেঁচে যেতি, তবে আমি তোকে সবচেয়ে ভ’য়ং’ক’রভাবে পুড়িয়ে দিতাম। এরপর তোকে ভালোবাসার ডেফিনেশন বোঝাতাম বার্ডফ্লাওয়ার।”
কথাটা বলে থামে। এরপর করুণ কণ্ঠে বলে,
“বাট এটা তো আমি পারবো না বার্ডফ্লাওয়ার।”
মাইরা অবাক হয়ে ইরফানের দিকে চেয়ে থাকে। তার এতো দৃঢ় শিসওয়ালাকে এমন ভাঙা লাগছে কেন? এতো বিধ্বস্ত লাগছে কেন? মাইরা ঢোক গিলে ভাঙা গলায় বলে,
“কেন পারবেন না? আমি আপনার কে?”
ইরফান মাইরার কথাটা শুনে বিষন্ন মুখাখানায় এক সূক্ষ্ম হাসি ফোটায়। এগিয়ে গিয়ে দু’হাতের আঁজলায় মাইরার মুখটা নিয়ে কপালের মাঝ বরাবর শব্দ করে একটা চুমু আঁকে। মাইরার শরীর শিরশির করে অনুভূতির জোয়ারে।
ইরফান তার দু’হাতের মাঝে মাইরার মুখ রেখে, মাইরার মুখটা সামান্য উঁচু করল।
মাইরা পলক না ফেলে ইরফানের লালিত চোখজোড়ায় চেয়ে আছে। ইরফান মাইরার টলমল করে ওঠা চোখে দৃষ্টি রেখে গেয়ে ওঠে,
তুমি আমার..
এমন-ই একজন..
যারে এক জনমে ভালোবেসে
ভরবে না এ মন।
এটুকু গেয়ে থামে ইরফান। মাইরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। তার শিসওয়ালা তাকে ভালোবাসে?
ইরফান হঠাৎ-ই মাইরা গাল চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– মরবি তুই? এতো শখ মরার? পারবি না মরতে। আল্লাহ ছাড়া এই জমিনের কারো ক্ষমতা নেই তোকে আমার থেকে কেড়ে নেয়ার।
ইরফান নেওয়াজ তার জিনিস আগলে রাখতে জানে। কখনো আমার থেকে বাঁচতে পারবি না তুই। পারবি না মরতে। তোর যে কলিজায় সাহসে ভরপুর, সেই কলিজা কেটে আমি টুকরো টুকরো করবো বার্ডফ্লাওয়ার।
যেই কলিজা দিয়ে তুই আমার থেকে মুক্তি পেতে চাস, সেই কলিজা আমি জ্বালিয়ে দিব।
কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে আসে ইরফানের। মাইরার গালে ধরে রাখা হাত শিথীল করে কিছুটা। এরপর মাইরার দিকে চেয়ে জড়ানো কণ্ঠেই বলে,
– আমি তোর সাহসে ভরা কলিজা ছিঁড়ে ফেলব বার্ডফ্লাওয়ার।
মাইরা নিরব কান্না নিয়ে ইরফানকে শুধু দেখে। সে তো ইরফানকে চিনতে পারছে না। এটা ইরফান? তার শিসওয়ালা তাকে ভালোবাসে? শিসওয়ালার ভালোবাসা পাওয়া তো তার স্বপ্ন ছিল। আজ যেন ভীষণ তীব্রভাবে অনুভব করছে, তার শিসওয়ালার ভালোবাসা।
মাইরার চোখজোড়া থেকে অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ইরফান তার ডান হাতে মাইরার মুখ মুছে দিল। এরপর হঠাৎ-ই আবারও মাইরাকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। হাসফাস কণ্ঠে বলে,
– বার্ডফ্লাওয়ার? আমি তোকে ছাড়া থাকতে ভুলে গিয়েছি। আমায় জীবন্ত লাশ বানিয়ে কোথাও যাবি না তুই।
মাইরা ফুঁপিয়ে কাঁদে। তার শিসওয়ালা তার জন্য এভাবে পা’গ’লামি করছে? তার বিশ্বাস-ই হয় না। সে কথা খুঁজে পায় না। শুধু কাঁদে মেয়েটা। তার তো কথা বলার ভাষা নেই।
ইরফান আবারও রে’গে মাইরাকে ছেড়ে মাইরাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। দু’হাতে নিজের মাথার চুল ধরে টানে। তার সবকিছু এতো অসহ্য লাগছে। ইরফান রেগে চিৎকার করে বলে,
– Why are you so selfies Birdflower?
মাইরা কেঁপে ওঠে। কান্নামাখা গলায় বলে,
– আপনি যে বলতেন, আপনি আমাকে পছন্দ করেন না। তবে….
মাইরার মুখে আবারও সেই একই কথা শুনে ইরফানের রাগ হয়। প্রচন্ড রাগ। জ্বলন্ত চোখজোড়া থেকে যেন ধৌঁয়া বের হচ্ছে। রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে ডান হাতে সেন্টার টেবিলের কাঁচ উল্টে ফেলে চিৎকার করে বলে,
– Exactly, I don’t like you. But you are my feelings, my addiction, my emotions.
You are my heart stupid girl.”
কথাটা বলে বড়বড় পা ফেলে মাইরার সামনে গিয়ে মাইরাকে আবারও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বিড়বিড়িয়ে শাতল কণ্ঠে বলে,
– You are my heart Birdflower.
কথাটা বলতে বলতে টুপ করে মাইরার কাঁধে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। মাইরা বুঝতে পারে। এরকম কঠোর ব্যক্তিত্বের এক মানুষের চোখে পানি তার জন্য? তার শিসওয়ালা তাকে অনেক বেশি ভালোবাসে?
কাঁপা কাঁপা দু’হাত ইরফানের পিঠে আলতো করে রেখে ডাকে,
– শিসওয়ালা?
ইরফান হাতের বাঁধন শক্ত করলো। মাইরা নিঃশব্দে কাঁদে।
ইরফান হঠাৎ-ই মাইরাকে ছেড়ে দু’হাতের মাঝে মাইরার মুখটা আগলে নেয়। মাইরা পিটপিট করে তাকায় ইরফানের দিকে। ইরফানের র’ক্তলাল চোখজোড়া ভেজা। মাইরার ভীষণ কান্না পায়। এই কি হাল হয়েছে তার শিসওয়ালার?
ইরফান দু’হাতে মাইরার গাল মুছে দিয়ে মাইরার কপালের সাথে তার কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে ভাঙা গলায় বলে,
– বার্ডফ্লাওয়ার? ইউ নো? আই আ…..
কথাটা বলতে বলতে ইরফানের কথা জড়িয়ে আসে।
মাইরাকে ছেড়ে দু’পা পিছিয়ে যায়। তার মাথা ঘুরছে।
ইরফান পড়ে যেতে যেতে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়ে। দু’হাত ছেড়ে দেয়। মাথা নিচু করে লালিত চোখজোড়া বুজে নেয়। এরপর আবারও চোখ মেলে তার সামনে দাঁড়ানো মাইরার দিকে তাকায়। জড়ানো কণ্ঠে বলে,
– ইউ আর যাস্ট মাই বার্ডফ্লাওয়ার।
মাইরা দু’হাতে মুখ চেপে কাঁদছে। তার শিসওয়ালা কেমন পা’গ’ল হয়ে গিয়েছে। সে মরে যাবে বলে তার শিসওয়ালাকে এতো অসহায় লাগছে?
হঠাৎ-ই ইরফানের নাক দিয়ে অনর্গল র’ক্ত আসে।
মাইরা ইরফানের দিকে তাকিয়ে ছিল এভাবে নাক দিয়ে রক্ত পড়তে দেখে মেয়েটা চিৎকারে দিয়ে ওঠে। একপ্রকার দৌড়ে এসে ইরফানের সামনে বসে পড়ে। ছোট ছোট দু’হাতে ইরফানের মুখ টা তার হাতে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে,
– আপনার কি হয়েছে? র.র.র’ক্ত কেন পড়ছে? কি হয়েছে আপনার?
ইরফানের কাছে মাইরাকে ঝাপাসা লাগে। দুর্বল শরীরে বা হাত বাড়িয়ে মাইরার গলার নিচ বরাবর হাত রেখে সজোরে মাইরাকে ধাক্কা দেয়। মাইরা ইরফানের ধাক্কা খেয়ে বেশ অনেকটা পিছিয়ে যায়। কোমড়সহ হাতে ব্য’থা পায়।
ইরফান আদো আদো চোখ মেলে, দুর্বল কণ্ঠে তেজ মিশিয়ে থেমে থেমে বলে,
“ডোন্ট টাচ মি। ইউ আর আ সেলফিশ গার্ল। আউট! আউট! আই ডোন্ট লাইক ইউ সেলফিশ গার্ল।
একটু থেমে বিড়বিড় করে,
তুই কেন এতো সেলফিস বার্ডফ্লাওয়ার?”
মাইরার মাথা ব্য’থা শুরু হয়। ইরফানের এমন র’ক্ত দেখে তার নিজেরও মাথা ঘুরছে। তবুও বসে বসে এগিয়ে ইরফানের সামনে এসে ইরফানের গালে হাত দিয়ে আদো আদো স্বরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– আপনার কি হয়েছে? এভাবে র’ক্ত পড়ছে কেন, বলুন না?
ইরফান ঢুলছে মনে হচ্ছে। মাইরার দু’হাত ইরফানের র’ক্তে ভরে গিয়েছে। মাইরার সেদিকে হুশ নেই। সে দু’হাতে ইরফানের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে,
– আপনি ভালো হয়ে যান, প্লিজ! কি হয়েছে আপনার?
ইরফান চোখ টেনেটুনে খোলে। বিড়বিড় করে আওড়ায়,
– অ্যা’ম ওকে।
মাইরা মাথা তুলে ইরফানের নাক বেয়ে গড়িয়ে পড়া র’ক্ত দেখে ভীষণ ভয় পায়। চোখ বন্ধ হয়ে আসে। দু’হাতে ইরফানের গালে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আর খোলে, এভাবেই থেমে থেমে বলে,
– ডক্টরের কাছে যান প্লিজ! আমি বাবাকে ডাকছি।
কথাটা বলে উঠতে নিলেও পারলো না। তীব্র মাথা ব্য’থা সাথে মাথা ঘুরানো দু’টো মিলিয়ে মাইরা পড়ে যেতে নিলে ইরফান তার দুর্বল শরীরে মাইরাকে আগলে নেয়। ইরফান সামলে নিতে পারে না নিজেকে। তার সবকিছু ঘুরছে, মাইরার ভারে সে মেঝেতে ঠাস করে পড়ে যায়। তার বুকের উপর মাইরা পড়ে যায়। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ওঠে। ইরফানের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে দু’হাতে ইরফানের গাল ধরে ফোঁপানি কণ্ঠে ডাকে,
– শিসওয়ালা?
ইরফান ঝাপসা চোখে মাইরাকে দেখে। থেমে থেমে বলে,
– মাই বার্ডফ্লাওয়ার, ডোন্ট ওয়ারি, কিচ্ছু হবে না তোমার।
মাইরা ফোঁপাতেই থাকে। ইরফান বেশ কিছু সময় পর শক্তি খাঁটিয়ে মাইরাকে দু’হাতের উপর নিয়ে উঠে বসে। মাইরা ধীরে ধীরে জ্ঞান হারায় যেন, বিড়বিড় করে,
– শিসওয়ালা আপনি ডক্টরের কাছে যান।
ইরফান মাইরাকে তার বুকে জড়িয়ে নিল। মাইরা ইরফানের ঘাড়ে পিছনে হাত দিতে গিয়েও জ্ঞান হারানোর ফলে আর তা পারলো না। ইরফান ঝাপসা চোখে দরজার দিকে তাকায়। সে উঠতে পারছে না। মনে হচ্ছে পড়ে যাবে যাবে ভাব।
তখনই একপ্রকার দৌড়ে শুদ্ধ ইরফানের ঘরে প্রবেশ করে। ঘরের ছিটকিনি ভেঙেছে মূলত। তারেক নেওয়াজ সহ রুমা নেওয়াজ সবাই ইরফানের ঘর থেকে চিৎকার, সাথে কাঁচ ভাঙার শব্দ পেয়ে ইরফানকে দরজা খুলতে বলছিল। কিন্তু এরা হয়তো শুনতেই পায়নি।
ইরফানের অবস্থা দেখে শুদ্ধ সহ সবার শরীর শিউরে ওঠে। মাইরা সহ ইরফান র’ক্তে পুরো মাখামাখি হয়ে আছে।
ইরফানের কোলে মাইরাকে অজ্ঞান হয়ে থাকতে দেখে তাদের গলা শুকিয়ে আসে। শুদ্ধ চোখ বড় বড় করে বলে,
– ভাই ইরফান তোদের কি হয়েছে?
কথাটা বলতে বলতে দ্রুত এগিয়ে আসতে নিলে ইরফান মাইরাকে তার সাথে আরেকটু চেপে ধরে আওড়ায়,
– ডোন্ট টাচ হার।
শুদ্ধ ইরফানের কথা শুনে বলে,
– ওকে ওকে। মামা নিবে।
শুদ্ধ দ্রুত বলে,
– মামা মাইরাকে কোলে নিন।
তারেক নেওয়াজ যেন শক্তি পাচ্ছেন না শরীরে। রুমা নেওয়াজ দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে তার ছেলের কাছে বসে কেঁদে দিয়ে বলে,
– ইরফান বাবা, তোমার কি হয়েছে? এসব কি করে হলো?
বলতে বলতে শাড়ির আঁচল দিয়ে ছেলের নাক বেয়ে পড়া র’ক্ত মুছে দেয়। আবারও পড়ে। রুমা নেওয়াজ কেঁদে দেয়। এ কি অবস্থা হয়েছে তার ছেলের। মাইরার-ই বা কি হয়েছে।
ইরফান ঝাপসা চোখে তার মাকে দেখে। কিছু বলতে চায় বোধয়, কিন্তু পারছে না।
শুদ্ধ আবারও তার মামাকে তাগিদ দেয়।
– মামা প্লিজ! মাইরাকে কোলে নিন দ্রুত। ইরফানকে হসপিটাল নিতে হবে।
তারেক নেওয়াজ নিজেকে সামলে নিল। এরপর এগিয়ে গিয়ে ইরফানের থেকে মাইরাকে তার কোলে তুলে নেয়। এরপর ঘরের বাইরে যেতে যেতে বলে,
– আমার বাবাকে হসপিটাল নিয়ে এসো শুদ্ধ।
ইরফানের শরীর দোলে। সে পড়তে নিলে শুদ্ধ দৌড়ে এসে ইরফানকে আগলে ধরে। পাশেই রুমা নেওয়াজ ছেলের গালে হাত দিয়ে বলে,
প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬৩
– বাবা ইরফান, তোমার কি হয়েছে? এসব কি করে হলো?
তার মামিকে তাড়া দেয় বের হতে। ইরফান শুদ্ধর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে বিড়বিড় করে,
– আমার বার্ডফ্লাওয়ার সিক। ওকে ভালো করে দে, প্লিজ!